মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

২রা নভেম্বর ১৯৭৫ সাল। ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও তার সঙ্গীরা প্রতিবিপ্লবী ক্যু’দাতা ঘটাবার চেষ্টা করে

 
   
 

 

সেই ক্রান্তিলগ্নে নিম্মী ছিল আমার পাশেই। সর্বদাই ও আমার সব দুঃখ-কষ্টের সমান ভাগীদার হয়ে থেকেছে। সব বিপদ-আপদের মোকাবেলা করতেও কুন্ঠিত হয়নি কখনো।

২রা নভেম্বর ১৯৭৫ সাল। গত বেশ কয়েকদিন কাজের চাপে বাসায় যাওয়া হয়নি। ঠিক করলাম দুপুরের পর কিছু সময়ের জন্য বাসায় যাব। প্ল্যান মাফিক লাঞ্চের পর এক ফাঁকে চলে এলাম মালিবাগে। বেশ কয়েকদিন বিরতির পর হঠাৎ আমার আগমনে বাসার সবাই খুব খুশী হল। সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া, হৈ-হুল্লোড় করা হল আনন্দঘন পরিবেশে। সন্ধ্যায় নিম্মীকে নিয়ে গেলাম মিনু ফুপ্পুর বাসায়। রাতের খাওয়া ওখানেই খেতে হল। বেশ রাত অব্দি গল্প-গুজব করে আমি আর নিম্মী ফিরছিলাম মালিবাগে। হঠাৎ নিম্মী বলল, “আজ আমি তোমার সাথে বঙ্গভবনে থাকব।” ১৫ই আগষ্টের পর থেকেই বেচারী ভীষণভাবে অবহেলিত। একদম সময় দিতে পারছিলাম না ওকে। বললাম, ঠিক আছে তাই হবে। দু’জনে ফিরলাম বঙ্গভবনে। সময় তখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। তেমন কোন ব্যতিক্রম চোখে পড়ল না। সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় আমার কামরার দিকে এগুচ্ছি, ডিউটিরত হাবিলদার এগিয়ে এসে বলল, “স্যার মেজর হাফিজ এবং ক্যাপ্টেন ইকবাল সাহেব বঙ্গভবন ছেড়ে চলে গেছেন। ১ম ইষ্টবেঙ্গলের গার্ড রিপ্লেসমেন্ট ও এখন পর্যন্ত এসে পৌঁছায়নি ঢাকা ব্রিগেড হেডকোয়াটার্স থেকে। সবাই আপনাকে খুঁজছেন। কর্নেল রশিদ, কর্নেল ফারুক এবং অন্যান্য সব অফিসাররাই প্রেসিডেন্ট সাহেবের সাথে বৈঠক করছেন।” আচমকা খবরটা পেয়ে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু যেভাবে অবস্থা গড়াচ্ছিল তাতে এমন কিছু একটা ঘটতে পারে সেটা অপ্রত্যাশিতও ছিল না। বিগত দিনগুলোর ঘটনা প্রবাহের স্বাভাবিক পরিণতি হিসাবেই ধরে নিয়েছিলাম সমস্ত ব্যাপারটাকে। নিম্মীকে কামরায় যেতে বলে দ্রুত গিয়ে হাজির হলাম প্রেসিডেন্টের স্যুইটে। প্রেসিডেন্ট সাহেব বেশ কিছুটা বিরক্ত এবং উত্তেজিতভাবে একটা সোফায় পা গুটিয়ে তার নিজস্ব স্টাইলে বসে তার পাইপে তামাক ভরছিলেন। কর্নেল রশিদ রেড টেলিফোনে কার সাথে যেন যোগাযোগের চেষ্টা করছিল। কর্নেল ফারুক আরেকটি সোফায় নিশ্চুপ বসেছিল। ঘরে ঢুকে প্রেসিডেন্টকে সালাম জানিয়ে কর্নেল রশিদের কাছে জানতে চাইলাম,
- ব্যাপার কি রশিদ, কি হয়েছে?
- যা এতদিন সন্দেহের পর্যায়ে ছিল তাই হয়েছে। তোর দুই বন্ধু হাফিজ এবং ইকবাল ১ম ইষ্টবেঙ্গলের সব troops withdraw করে নিয়ে গেছে বঙ্গভবন থেকে। প্রথমে সবাই মনে করেছিলাম এটা routine replacement এর ব্যাপার। কিন্তু সন্ধ্যার পরও যখন replacement এসে পৌঁছালো না তখন থেকেই ক্যান্টনমেন্টে ফোন করে চীফ জেনারেল জিয়া, সিজিএস ব্রিগেডিয়ার খালেদ, ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত কাউকেই কন্ট্যাক্ট করা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে খবর পাওয়া যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টে অস্বাভাবিক troops movements হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কেউই কিছু পরিষ্কার করে বলতে পারছে না ক্যান্টনমেন্টে কি ঘটছে। জেনারেল ওসমানীর সাথে যোগাযোগ করতে পেরেছি কিন্তু তিনিও সঠিক কিছু বলতে পারলেন না। তিনি বঙ্গভবনে আসছেন। জেনারেল ওসমানী ব্রিগেডিয়ার খলিলকে ইতিমধ্যেই নির্দেশ দিয়েছেন বিডিআর-এর দু’টো রেজিমেন্ট বঙ্গভবনে পাঠিয়ে দিতে। হাফিজ এবং ইকবালকেও পাওয়া যাচ্ছে না টেলিফোনে। আমার সাথে কথা শেষ করে কর্নেল ফারুককে বলা হল রেসকোর্সে তার ট্যাঙ্ক রেজিমেন্টের কাছে চলে যেতে। কর্নেল ফারুক রেসকোর্সে যাবার জন্য উঠে দাড়াতেই আমি বললাম, “ফারুক তুই অবশ্যই রেসকোর্সে যাবি তবে you would not move under any provocation or circumstances whatsoever. সব বিষয়ে পরিষ্কার হবার পরই আমাদের করণীয় কি হবে সেটা বিবেচনা করা হবে। এর আগে আমাদের তরফ থেকে কোন মুভ নেয়াটা যুক্তিসঙ্গত হবে না। প্রথমত: চেষ্টা করতে হবে এই সমস্যার সমাধান শান্তিপূর্ণভাবে করা যায় কিনা। এর জন্য আমি নিজেই যাব ক্যান্টনমেন্টে। আমি ফিরে না আসা পর্যন্ত অথবা আমার কোন কিছু না হওয়া পর্যন্ত no action at all, is that clear?  ইতিমধ্যে জেনারেল ওসমানীও এসে পৌঁছেছেন। তিনিও আমার অভিমতকে সমর্থন জানালেন। আমরা যখন আলোচনায় ব্যস্ত তখন বিডিআর-এর দু’টো রেজিমেন্ট এসে পৌঁছে গেছে সে খবর নিয়ে এল মেজর পাশা, মেজর শাহরিয়ার এবং ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা। নিম্মীই গিয়ে তাদের ঘুম থেকে ডেকে তুলেছিল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মেজর শাহরিয়ার চলে গেল তার রেডিও বাংলাদেশের কন্ট্রোল সেন্টারে। ক্যাপ্টেন হুদা প্রেসিডেন্ট, জেনারেল ওসমানী এবং কর্নেল রশিদকে সাহায্য করার জন্য বঙ্গভবনেই থাকবে সেটাই সিদ্ধান্ত হল। বাকিরা সবাই প্রত্যেকের জন্য নির্দিষ্ট এবং ডেপ্লয়েড ইউনিটগুলোর কমান্ড নেবার জন্য যার যার পজিশনে চলে গেল। আমি বেরিয়ে আসছিলাম ঠিক সেই সময় কর্নেল রশিদ আন্তরিকভাবেই বলেছিল,
- ডালিম ভেবে দেখ, এই অবস্থায় ক্যান্টনমেন্টে যাওয়া ঠিক হবে কিনা? সেই তরল অবস্থায় ক্যান্টনমেন্টে যাওয়াটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও তাৎক্ষণিক জবাব দিয়েছিলাম,
- এই ক্রান্তিলগ্নে দেশ ও জাতিকে বাঁচাতে someone has to clean the dirty linen then why not me?
প্রেসিডেন্টের স্যুইট থেকে বেরিয়ে চলে এলাম আমার কামরায়। বেচারী নিম্মী অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে বেশ কিছুটা ঘাবড়ে গেছে। জিজ্ঞেস করল,
- এখন কি হবে? আমি বললাম,
- তুমি বঙ্গভবন ছেড়ে ড্রাইভারকে সঙ্গে নিয়ে কোন নিরাপদ জায়গায় চলে যাও। ঠিক বুঝতে পারছি না ঘটনা কোনদিকে মোড় নেয়। যাই হোক না কেন; বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। ড্রাইভারকে ডাকিয়ে এনে নির্দেশ দিলাম,
-বেগম সাহেবের হুকুম মত তার সাথেই থাকবে তুমি যতক্ষণ তিনি চান। নিম্মী কিছুক্ষণ ইতস্তত করে নিশী রাতে একা একা বেরিয়ে গেল একরাশ আশঙ্কা মনে নিয়ে অজানা ঠিকানার উদ্দেশ্যে। যাবার সময় অশ্রুসিক্ত চোখে ধরা গলায় শুধু বলে গেল,
- আল্লাহর হাতেই তোমাকে সোর্পদ করে দিয়ে গেলাম। সাবধানে থেকো।

 
 
 
     
     
  Design & Developed By: Hemu
All Rights Reserved 2008 @www.majordalimbangla.net