মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

তাজুদ্দিন আহমদ এবং খন্দোকার মোশতাক আহমদের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়।

 
   
 

 

শুরু থেকেই নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে মতপার্থক্য হতে থাকে। ভারত সরকার যে কোন কারণেই হোক খন্দোকার মোশতাক আহমদের প্রতি সন্তুষ্ট ছিল না।

ইতিমধ্যে থিয়েটার রোডের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সাথে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিরোধিতার কথা প্রকাশ হয়ে পড়তে থাকে। নীতিগত অনেক বিষয়েই জনাব তাজুদ্দিন ও তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মাঝে ব্যবধান গড়ে উঠতে থাকে। ভারতীয় সরকারও জনাব মোশতাকের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠে। বাজারে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে জনাব খন্দোকার মোশতাক আহ্‌মদ গোপনে সিআইএ এর মাধ্যমে আমেরিকার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন। অস্থায়ী সরকারের অলক্ষ্যে আমেরিকার মধ্যস্থতায় তিনি নাকি পাকিস্তান সরকার ও শেখ মুজিবের সাথে আলোচনার মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধান খুজে পাবার চেষ্টায় আছেন। তার এই উদ্যোগের পেছনে আওয়ামী লীগের দক্ষিনপন্থী বেশ একটা বড় প্রভাবশালী অংশের সমর্থনও নাকি রয়েছে। এ ধরণের গুজব ছড়িয়ে পড়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলেন। তার এই ঘোষণাকে কেন্দ্র করে মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক নেতাদের মাঝে ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হল। নেতাদের অনেকেই তখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ করে সহসা বা কোনদিনই দেশ স্বাধীন করা যাবে কিনা এ বিষয়ে বিশেষ সন্দেহ পোষণ করতেন।

তাদের মনোভাব ছিল এরূপ:- যা হবার তাতো হয়েই গেছে। আখের যতটুকু গোছাবার তাও বেশ গুছিয়ে ফেলা হয়েছে সেক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরতে না পারলে, গোছান সম্পদ ভোগ করা যাবে না। তাই ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমার সুযোগটা বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।

তারা কোলকাতায় বেশ আরাম-আয়েশেই সময় কাটাচ্ছিলেন কিন্তু ক্রমান্বয়ে তাদের অসৎ উপায়ে লুটপাট করার কথা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছিল। এতে তাদের সম্মানেরই শুধু হানি হচ্ছিল তা নয় তাদের অনেকের প্রতিই বিক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। তারা যেখানে অনাহারে, অস্ত্রহীন-বস্ত্রহীন অবস্থায় দেশকে স্বাধীন করার জন্য জীবনবাজী রেখে রণাঙ্গনে লড়ছেন তখন এ সমস্ত অসৎ রাজনীতিবিদ ও লুটেরার দল লুটপাটের বেশুমার টাকায় বিলাসী জীবন যাপন করে বাঙ্গালীদের বদনাম করছিলেন অতি র্নিলজ্জভাবে। এ অপমান মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না।

ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিতে চাচ্ছেন আওয়ামী লীগের অনেক সদস্যই। তারা বাংলাদেশের অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে দোদুল্যমনতায় ভুগছেন। অনেকেই আবার ভারতীয় নীল নকশার কথা আচঁ করতে পেরে শংকিত হয়ে পড়ছেন। কিন্তু তাদের ফিরে যাবার পথে মূল বাধা হয়ে দাড়িয়েছে ইন্দিরা সরকার। ভারত সরকার কিছুতেই চাচ্ছে না বাংলাদেশ প্রবাসী সরকার ইয়াহিয়া সরকারের সাথে কোনরূপ রাজনৈতিক আপোষের চেষ্টা করুক। তাদের চাপের মুখে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে জনাব তাজুদ্দিন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে বাধ্য হন, “ইয়াহিয়া সরকারের সাধারণ ক্ষমা প্রবাসী সরকারের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।” মুক্তিযোদ্ধারাও সংগ্রামের এই পর্যায়ে কোনরকম আপোষের বিরোধিতা করছিলেন। তারা চাইছিলেন দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে। এভাবেই সার্বিক অবস্থা ক্রমশঃ জটিল হয়ে উঠছিল। হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশতাক আহ্‌মদ আমেরিকা যাচ্ছেন লন্ডন হয়ে এক সফরে। বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে জাতিসংঘ প্রধান এবং অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধান বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়কদের সাথে তিনি মত বিনিময় করে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি তাদের সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করবেন তিনি এ সফরকালে। অতএব তার এই সফর হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাবার সব প্রস্তুতিই প্রায় শেষ। কামাল সিদ্দিকীও যাচ্ছে সফরসঙ্গী হয়ে। কিন্তু সেই অবস্থাতেই আকস্মিকভাবেই সফর স্থগিত করে দেয় প্রবাসী সরকার। শুধু তাই নয়, মোশতাক আহ্‌মদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয় এবং তার স্থলে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানানো হয়। জনাব মাহ্বুব আলম চাষীকেও সরিয়ে দেয়া হয় পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব থেকে। এই ধরণের পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে সবকিছুই চেপে যায় তাজুদ্দিন সরকার। কিন্তু পরে সব গোপনীয়তাই ফাঁস হয়ে যায়।

জানা যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা নাকি জানতে পারে যে, জনাব মোশতাক আহ্‌মদ গোপনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। তার লন্ডন সফরের উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন সরকারের মধ্যস্থতায় শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া সরকারের সাথে একটা চুড়ান্ত ফায়সলা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছা। এই চক্রান্তের খবর পেয়েই জনাব তাজুদ্দিন ভারত সরকারের নির্দেশেই ঐ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন। আরো তথ্য জানা যায়- খন্দোকার মোশতাক আহ্‌মদ, ইয়াহিয়া সরকার এবং মার্কিন সরকারের ত্রি-পাক্ষিক ঐ সমঝোতা-আলোচনার প্রতি শেখ মুজিবর রহমানের সমর্থন ছিল।