মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

তথাকথিত মিত্রবাহিনীর কালো ছায়ার আচ্ছাদনে ঢাকা পড়ে যায় মুক্তিফৌজ এবং জনগণের বীরগাঁথা, আত্মত্যাগ এবং সাহসিকতা

 
   
 

যৌথ কমান্ড স্থাপিত হলো কিন্তু মুক্তি ফৌজের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীকে সব ব্যাপারেই পাশ কাটিয়ে চলার নীতি গ্রহণ করা হয়।

নভেম্বর মাসে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় ব্যাপকভাবে। বর্ডারে সম্মুখ সংঘর্ষের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভারত সরকার ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনা বাহিনীকে পাক বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনে বাংলাদেশের সীমানার ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি প্রদান করেছে। গঠন করা হয়েছে মুক্তিফৌজ ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড। যৌথ কমান্ড গঠিত হবার পর ভারতীয় কমান্ডারদের প্রচন্ড প্রভাবে কর্নেল ওসমানী এবং তার হেডকোয়াটার্স প্রকৃত অর্থে অকেজো হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ আক্রমণের পরিকল্পনা এককভাবে ভারতীয় বাহিনীর ইর্ষ্টান কমান্ডই প্রণয়ন করার দায়িত্ব গ্রহণ করে কর্নেল ওসমানীকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুদ্ধের আভাস পেয়ে জনাব ভুট্টোকে তার বিশেষ দূত হিসেবে চীনে পাঠালেন ভারতীয় যেকোন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন আদায় করার জন্য। কিন্তু পিকিংএ গণচীনের নেতৃবৃন্দ জনাব ভুট্টোকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, “পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপকে গণচীন পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার হীন চক্রান্ত হিসাবেই দেখবে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সাথে যেকোন সামরিক সংঘাতে নীতিগতভাবে তারা পাকিস্তানের পক্ষেই থাকবে।” একইসাথে জনাব ভুট্টোর মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যথাশীঘ্র সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছানুযায়ী বর্তমান সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য। তাদের Considered Opinion ছিল বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র একটি যুক্তিসঙ্গত এবং গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমেই পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায়ে রাখা সম্ভব। বল প্রয়োগ করে এই সমস্যার সমাধান কখনও সম্ভব হবে না। চীনা নেতৃবৃন্দের উক্তি থেকে দু’টো বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠে।

প্রথমত: গণচীন একদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার নিরসনের জন্য পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠিকে বাঙ্গালীদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান পেশ করার যুক্তিসঙ্গত পরামর্শ দেন।

দ্বিতীয়ত: পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার কোন সমাধান করতে ব্যর্থ হলে সেই সুযোগে উপমহাদেশে ভারতীয় সমপ্রসারনবাদের নগ্ন থাবা বিস্তার করার চক্রান্তের ব্যাপারেও তারা বন্ধুরাষ্ট্র পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করে দেন। কিন্তু দেশে ফিরে জনাব ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও সামরিক জান্তার কাছে চীনা নেতৃবৃন্দের বন্ধুসুলভ এবং যুক্তিসম্পন্ন অভিমতের অপব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, “ভারতের সাথে সামরিক সংঘর্ষে চীন পাকিস্তানকে সার্বিকভাবে সাহায্য করবে। প্রয়োজনে গণচীন প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করতে দ্বিধাবোধ করবে না এ ধরণের আভাসই নাকি তিনি পেয়েছিলেন চীনা নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে একান্ত বৈঠকে।

পক্ষান্তরে ভারতীয় সরকার বুঝতে পেরেছিল গণচীন বাংলাদেশের ব্যাপারে একটি রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে। তাছাড়া সদ্য সমাপ্ত রুশ-ভারত মৈত্রী চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে পাক-ভারত যুদ্ধে গণচীনের প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পরার সম্ভাবনা খুবই কম বলেও ধারণা পোষণ করছিল ভারত সরকার। এ ধরণের চিন্তা-ভাবনার পেছনে যথেষ্ট যুক্তি ছিল। এ অবস্থায় ঝটিকা অভিযান চালিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করে সেখানে তাদের পছন্দের সরকার কায়েম করতে পারা যাবে সহজেই। এ ধরণের বিশ্লেষনের পরই যুদ্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ভারত সরকার। যুদ্ধের জন্য অতি প্রয়োজনীয় আনুসাঙ্গিক সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেই সামরিক আগ্রাসনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত সরকার।

এবারের যুদ্ধের প্রেক্ষাপট অতীতের পাক-ভারত যুদ্ধের  প্রেক্ষাপট থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্তমান অবস্থায় বিশ্ব জনমত সামরিক জান্তার শ্বেতসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এবং বাংলাদেশীদের স্বাধীনতার পক্ষে। মানবাধিকার এবং শরনার্থীর প্রশ্নে সারা বিশ্বের সহানুভূতিও ভারতের পক্ষে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা গণচীন যদি Geo-Strategic কারণে কোন পদক্ষেপ নেবার চেষ্টা করে তবে তাদের পরম শত্রু সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিক্রিয়ায় ‘মৈত্রী চুক্তির’ আচ্ছাদনে নিশ্চুপ বসে না থেকে ভারতের পক্ষ নেবে নিশ্চিতভাবে ফলে বেধে যাবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বর্তমানে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে একটা বিশ্বযুদ্ধ শুরু করার দায়-দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে নিতে চাইবে কিনা যুক্তরাষ্ট্র অথবা গণচীন সে বিষয়েও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা পূর্ব পাকিস্তানের ৮কোটি জনগণ আজ পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে। মুক্তি বাহিনীর দেশব্যাপী প্রচন্ড তৎপরতায় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাক বাহিনীর অবস্থান সম্পূর্ণরূপে বিপর্যস্ত এবং যেকোন যুদ্ধের জন্য অত্যাবশ্যকীয় ফ্যাক্টর সৈনিকদের মনোবলও সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। খান সেনারা সার্বিকভাবে শুধু দুর্বল হয়ে পড়েছিল তাই নয়; তাদের Strategic Locations, Line Of Communication, Defensive Positions, Supply Points, Re-Enforcement Capabilities, Battle Tactics, Logistic Support Line এ সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয় বিষয়ে সব খবরা-খবরই এখন রয়েছে ভারতীয় বাহিনীর নখদর্পনে। এসব খবর সংগ্রহ করা হয়েছে মুক্তি বাহিনীর ইনটেলিজেন্স ইউনিট এবং সেক্টরগুলোর নিজস্ব গোয়েন্দা তৎপরতার মাধ্যমে। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারনের বিরোধিতার মুখে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমাদের জবরদখল আজ অযৌক্তিক হয়ে পড়েছে। শত্রুপক্ষের অবস্থা বর্তমানে Totally Untenable. প্রয়োজন শুধু সুযোগমত আক্রমণের ধাক্কা তাহলেই কেল্লা ফতে হবে। সুযোগ এসে গেল। ৩রা ডিসেম্বর বিকেল ৫:৪৫ মিনিটে আকস্মিকভাবে Pakistan Air Force Pre-Emptive Stick করে বসলো ভারতের বিভিন্ন জায়গায় স্ট্রাটেজিক টার্গেটগুলোর উপর। একইসাথে আঘাত হানা হল শীণগর, অভিন্তিপুর, পাঠানকোট, উত্তরলাই, যোধপুর, আম্বালা এবং আগ্রা বিমান ঘাটির উপর।

ঠিক সেই সময়ে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী কোলকাতায় এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। বিমান হামলার খবর তাকে দেয়ামাত্র তিনি মুহুর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ঐ জনসভাতেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক পাল্টা আক্রমণের ঘোষণা দিলেন। কোলকাতা থেকে সেদিন সন্ধ্যায় দিল্লী ফেরার আগেই ইর্ষ্টান কমান্ডের এঙঈ GOC (General Officer Commanding) Genarel Arora -কে দিল্লীর সেনাসদর থেকে হুকুম দেয়া হল পূর্ব পাকিস্তানে সর্বাত্মক হামলা চালাবার জন্য। জেনারেল অরোরার অধিনে দেয়া হল ৩টি স্বয়ংসম্পূর্ণ আর্মি কোর। ২য়, ৩৩শ এবং ৪র্থ কোর। এছাড়াও দেয়া হল ‘কম্যুনিকেশন জোন হেডকোয়াটার্স’ আরো একটি ভ্রাম্যমান আর্মি ইউনিট। এছাড়া ২য় কোরের অধিনে দেয়া হয়েছিল অতিরিক্ত একটি মিডিয়াম আর্মাড রেজিমেন্ট এবং একটি লাইট আর্মাড রেজিমেন্ট। এই কোরের কমান্ডার ছিলেন Lt. Gen T.N.Raina হেডকোয়াটার্স কৃষ্ণনগর। এই কোরের অধিনে দেয়া হয়েছিল অতিরিক্ত আরো একটি মিডিয়াম আর্টিলারী রেজিমেন্ট ও একটি ইঞ্জিনিয়ারস এর ব্রিজিং ইউনিট।

৩৩ কোরের কমান্ডার ছিলেন Lt. Gen M.L.Thapa. হেডকোয়াটার্স শিলিগুরী। এই কোরের অধিনে দেয়া হয়েছিল অতিরিক্ত একটি লাইট আর্মাড রেজিমেন্ট, একটি মিডিয়াম আর্টিলারী রেজিমেন্ট এবং একটি ইঞ্জিনিয়ারস এর ব্রিজিং ইউনিট।
১০১ কম্যুনিকেশন জোনের কমান্ডার ছিলেন প্রথমদিকে Lt.Gen.Gill পরে Lt.Gen.Nagra -কে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়। হেডকোয়াটার্স গৌহাটি। এই ফর্মেশনের ৪র্থ কোরের হেডকোয়াটার্স ছিল আগরতলায়। কোর কমান্ডার ছিলেন Lt.Gen. Sagat Singh. এই কোরের অধিনে অতিরিক্তভাবে দেয়া হয় একটি মিডিয়াম আর্টিলারী রেজিমেন্ট এবং দু’টো লাইট আর্মাড রেজিমেন্ট। সব মিলিয়ে পূর্ব রনাঙ্গনে ভারতীয় সৈন্যসংখ্যা ছিল ৫ লক্ষেরও বেশি। তার সাথে ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণের রণসম্ভার। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত প্রায় ১ লক্ষ খানসেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য এ ধরণের বিশাল বাহিনী মোতায়ন করার প্রয়োজন ছিল না। এই বিশাল সৈন্য সমাবেশ ঘটানো হয়েছিল গণচীনের তরফ থেকে যদি কোন সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হয় তার মোকাবেলা করার লক্ষ্যেই।

যাই হোক, প্রয়োজনীয় Air ও Naval Cover এবং প্রায় দুই লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিশাল ভারতীয় বাহিনী একই সময়ে সব সেক্টর থেকে আক্রমণ চালালো। সব সেক্টরেই ভারতীয় বাহিনীর অগ্রসর হওয়ার জন্য রাস্তা করে ব্রিজহেড তৈরী করে দিচ্ছিল মুক্তিবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধারাই। ঐ সমস্ত ব্রিজহেড তৈরী করা সম্ভব হয়েছিল বলেই অতি সহজেই শত্রুপক্ষের ডিফেন্স ভেদ করে ঢাকা অভিমুখে তরিৎ গতিতে এগিয়ে যেতে পেরেছিল ভারতীয় মিত্র বাহিনী। যুদ্ধের এই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে কর্নেল ওসমানীকে সম্পূর্ণরূপে পাশ কাটিয়ে চলেছিল ভারতীয় সেনাকমান্ড। ভারতীয় সেনা বাহিনীর স্ট্রাটেজি ছিল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শত্রুপক্ষের ডিফেন্স লাইন ভেদ করে তাদের Withdrawal এর পথ Cut Off করে তাদেরকে ছোট ছোট অংশে বিভক্ত করে পরাজিত করে ঢাকা অবরোধ করা এবং পাক বাহিনীকে সারেন্ডার করতে বাধ্য করা। বাংলাদেশে অবস্থিত পাক বাহিনী তাদের চেয়ে সংখ্যায় ৬-৭গুন বড় ভারতীয় বাহিনী এবং মুক্তিফৌজের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে অতি করুণ অবস্থায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশের জনগণের অসহযোগিতা এবং মুক্তি বাহিনীর দুঃসাহসিক গেরিলা তৎপরতা পাক বাহিনীর যুদ্ধস্পৃহা এবং মনোবল একদম নষ্ট করে দিয়েছিল। অন্য সব কারণের মধ্যে এটাই ছিল প্রধান কারণ যার জন্য পাকবাহিনীকে অতি অল্পসময়ের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করে নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হয়েছিল। এভাবেই ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের ফলে স্বাধীনতা লাভ করে বাংলাদেশ।

১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পন অনুষ্ঠানে মুক্তিফৌজের কমান্ডার-ইন-চীফ এবং যৌথ কমান্ডের প্রধান কর্নেল ওসমানীর আমন্ত্রণে মিত্র বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল অরোরা স্বাধীন বাংলাদেশে আসবেন এবং যৌথ কমান্ডের তরফ থেকে Instrument Of Surrender এ যৌথ কমান্ডের শীর্ষ ব্যক্তি কর্নেল ওসমানীই সাক্ষর করবেন সেটাই ছিল সমগ্র জাতির প্রত্যাশা। কিন্তু ঘটনা ঘটে ঠিক তার বিপরীত। Instrument Of Surrender এ যৌথ কমান্ডের তরফ থেকে সাক্ষর দান করার সৌভাগ্য লাভ করলেন জেনারেল অরোরা। শুধু তাই নয় অদৃশ্য অঙ্গুলী হেলনে মুক্তিফৌজের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীকে ১৬ই ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক Surrender Ceremony -তে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য থেকেও বঞ্চিত করা হল। কেন তাকে তার ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত করে সেদিন জেনারেল অরোরাকে সমগ্র জাতি এবং বিশ্ব পরিসরে বিজয়ী শক্তির একচ্ছত্র অধিকর্তা হিসেবে জাহির করা হল সে রহস্যের উদ্ঘাটন আজঅব্দি হয়নি। এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিশদ বিশ্লেষণের দাবিদার। এ থেকে জানা যাবে ভারতীয় নীল নকশা এবং প্রবাসী সরকারের নতজানু নীতির অনেক কিছুই।

কর্নেল ওসমানী চেয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিফৌজের সর্বাধিনায়ক হিসেবে তিনিই অভিনন্দন জানাবেন মিত্র বাহিনীর জুনিয়র পার্টনার জেনারেল অরোরাকে। এতে করে বিশ্ব পরিসরে এটাই প্রমাণিত হবে মূলতঃ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচেষ্টাতেই স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ, ভারতীয় বাহিনী সহায়ক শক্তি হিসেবে সাহায্য করেছে মাত্র। কিন্তু ভারতীয় সরকার তার সেই প্রস্তাবে সম্মত হয়নি। উল্টো ভারত সরকার দাবি জানায় Instrument Of Surrender-এ সাক্ষর করবে ভারতীয় বাহিনীর অধিনায়ক। উদ্দেশ্য পরিষ্কার- বিশ্ববাসী জানুক পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতের বিজয়ের ফলেই সৃষ্টি হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারতের দান। দুর্বল চিত্তের নতজানু প্রবাসী সরকার ভারতের সেই অযৌক্তিক দাবি মেনে নেয়। কিন্তু প্রচন্ড আত্মসম্মানবোধের অধিকারী আপোষহীন বঙ্গবীর কর্নেল ওসমানী নীতির প্রশ্নে অটল থেকে এ অন্যায়ের প্রতিবাদে নিজেকে সবকিছু থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন।

১৬ই ডিসেম্বর ঢাকা শহরে দেশবাসী দেখেছে ভারতীয় সেনা বাহিনীকে বিজয়ীর বেশে। তাদের ঘিরে ছিল বিএলএফ, মুজিব বাহিনী এবং রাতারাতি গজিয়ে উঠা ‘Sixteen Division’ এর সদস্যরা। কারণ সত্যিকারের মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের ঢাকা কিংবা দেশের বড়বড় শহরগুলোতে ঢুকতে দেয়া হয়নি নিষেধাজ্ঞা জারি করে। ভারতীয় বাহিনীর প্রাধান্য জাহির করার জন্যই এ আদেশ জারি করা হয়েছিল। প্রকৃত মুক্তিফৌজের যোদ্ধারা ঢাকা এবং অন্যান্য শহরগুলোতে আসার অনুমতি পান ১৬ই ডিসেম্বরের অনেক পরে। এ ধরণের চক্রান্তের ফলে বিশাল ভারতীয় সেনা বাহিনীর আগমনে বাধাগ্রস্থ হয়ে শুকিয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধের নিজস্ব ধারা। কালো ছায়ার আধাঁরে ঢাকা পরে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব, আত্মত্যাগ। হারিয়ে গেল অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত তাদের জয়গাথাঁ। আচম্‌কা হোচট খেয়ে মুখথুবড়ে পড়ল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন হয়ে উঠল সুদূরপরাহত। ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে জাতি স্বাধীনতার সঠিক মূল্য অনুধাবন করার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হল। এজন্যই আজঅব্দি ক্ষমতাবলয়ে যারা অবস্থান করছেন সে সমস্ত বুদ্ধিজীবি, সামরিক-বেসামরিক আমলা এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে অতি কম দামে স্বাধীনতা এবং জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেবার ন্যাক্কারজনক প্রতিযোগিতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধকে যদি তার নিজস্ব ধারায় বয়ে যেতে দেয়া হত তবে দখলদার বাহিনীর পাশবিক নৃশংসতার শিকার হতে হত আরো অনেককেই, রক্তাহুতি দিতে হত প্রতিটি পরিবারকে। এভাবে অর্জিত স্বাধীনতা আমাদের প্রত্যেকের কাছেই হয়ে উঠতো এক অমূল্যধন। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কষ্টার্জিত সেই পবিত্র স্বাধীনতাকে যেকোন ষড়যন্ত্র অঙ্কুরেই নস্যাৎ করে দিত পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা এবং ত্যাগী-সচেতন জনতা। দুর্ভাগ্য তৎকালীন দুর্বল রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম বিশ্বাসঘাতকতায় খাঁদহীন বলিষ্ঠ জাতীয় চরিত্র গঠন করার নূন্যতম সময় ও সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলাম আমরা।

১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের অধিনে জেনারেল ইয়াহিয়ার সরকারের LFO (Legal Frame Work) এর আওতায় পাকিস্তানের অখন্ডতা বজিয়ে রাখার ওয়াদা করে নির্বাচন করেন শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগ। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকার প্রধান হবার জন্যই জনগণ তাকে সে নির্বাচনে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যাবার পর জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর যোগসাজশে ২৫-২৬শে মার্চ রাতে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙ্গালী জাতির উপর শ্বেত সন্ত্রাস চালিয়ে অস্ত্রের জোরে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফলে ১৯৭০ সালের নির্বাচন হয়ে পড়ে অর্থহীন। বাংলাদেশের আপামর জনগণ পাকিস-ানী আচমকা হামলা ও শ্বেত সন্ত্রাসের বিরোধিতায় এবং দেশকে স্বাধীন করার জন্য স্বতঃস্ফুর্তভাবে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবেই ১৯৭০ সালের নির্বাচন তার গ্রহণযোগ্যতা হারায়। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা যখন মরণপন করে প্রতিরোধ সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তখন শেখ মুজিবর রহমান বন্দী হয়ে চলে যান পশ্চিম পাকিস্তানে। আওয়ামী নেতৃবৃন্দ ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচান। সশস্ত্র সংগ্রামের কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না বলেই তাদের দিশেহারা হয়ে পালিয়ে যেতে হয়। এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফলে ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিজয়ের পিছনে রয়েছে সমগ্র জাতির অবদান। সেক্ষেত্রে এই জাতীয় সংগ্রামের নেতৃত্বের একমাত্র দাবিদার হয়ে কোন যৌক্তিকতায় আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দলীয়ভাবে কব্জা করে নিল তার জবাব অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে দেশপ্রেমিক ঐতিহাসিকদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য।

১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনে জনাব এ কে খন্দোকার ও মাঈদুল হাসানের মধ্যে প্রায় চার ঘন্টা দীর্ঘ এক আলাপ হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধ ও ভারত সম্পর্কের মূল্যায়নের জন্য সেই আলোচনার সারাংশ এখানে লিপিবদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। যুদ্ধকালে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিফৌজের ডেপুটি চীফ অফ ষ্টাফ এবং জনাব মাঈদুল হাসান ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর নীতি নির্ধারনের ক্ষেত্রে একজন পরামর্শদাতা। তাদের কথোপকথন থেকে বোঝা যায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কর্নেল ওসমানীকে বাইপাস করে মূলতঃ যোগাযোগ রক্ষা করতেন জনাব তাজুদ্দিন এবং খন্দোকার সাহেবের সাথে। যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে বেশিরভাগ আলোচনাও হত গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার সাহেবের সাথেই। জেনারেল অরোরা, ব্রিগেডিয়ার জ্যাকব, ব্রিগেডিয়ার গুপ্তই ছিলেন মূলতঃ তাদের counter part. 

জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগে বীর বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধারা যে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেন তার যথার্থ মূল্য ভারত কখনোই দিতে চায়নি। এ নিয়ে মুক্তি ফৌজের কমান্ডারদের সাথে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দ্বন্দ্ব শুরু হয় প্রথম থেকেই। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিচালনার জন্য মুজিবনগরে (৮নং থিয়েটার রোড) কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে একটি হেডকোয়টার্স স্থাপন করা হলেও জনাব ওসমানীর কর্মক্ষমতা ছিল সীমিত। জুলাই মাস অব্দি মুক্তিযুদ্ধ কমান্ডাররা হেডকোয়াটার্স এর কাছ থেকে তেমন কোন সাহায্যই পাননি সংগ্রাম পরিচালনা করার জন্য। বিভিন্ন সেক্টরে কমান্ডাররা সম্পূর্ণভাবে নিজেদের উদ্যোগেই মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এ প্রসঙ্গে এভিএম খন্দোকার বলেন, “আমি যখন কোলকাতায় গিয়ে পৌছলাম তখন দেখলাম যে, হেডকোয়াটার্সের সাথে সেক্টর কিংবা সাব-সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে কোন যোগাযোগ নেই এবং এ পর্যায়ে ভারত আমাদের সংগ্রামে তেমন কোন সাহায্যই দেয়নি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করাও তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ফলে কোন সঠিক নীতিও গড়ে তুলতে পারেনি তারা। তবে তারা তখন চাচ্ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের ইস্যুটা জিইয়ে থাক। ভারতীয় নীতি নির্ধারকরা চাচ্ছিলেন স্বাধীনতা যুদ্ধের ধারাবাহিকতা এবং গতি-প্রকৃতি থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সংগ্রামীদের বুঝে নিয়ে তারা তাদের নীতি চুড়ান্ত করবেন। চুড়ান্ত নীতি নির্ধারন করার সময় পর্যন্ত সমস্ত বিষয়টাকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন তারা। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এবং সেনা বাহিনীর এ ধরণের মানসিকতার ফলে ভারতীয় সেনা বাহিনী এবং মুক্তি বাহিনীর মধ্যে বৈরীভাব এবং রেষারেষি পরবর্তিকালে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে গড়ে উঠা বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর মধ্যে যে ভারত বিরোধী মনোভাব দেখা যায় সেটা মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই crystallize করে।” এ প্রসঙ্গে জনাব খন্দোকার আরও বলেন, “মুক্তিফৌজ এবং ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে বিরোধ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম লগ্ন থেকেই দাঁনা বেধে উঠেছিল বিভিন্ন কারণে। ঐ সেন্টিমেন্ট, আবেগ-অনুভূতি বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন Disappointment এর মধ্য দিয়ে ক্রমশঃ আরো বেড়েছে।” মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সাহায্য ও সহযোগিতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকার বলেছেন, “মে, জুন, জুলাই, আগষ্ট পর্যন্ত ভারতের Involvement ছিল অতি সামান্য। যা ছিল তা মোটামুটিভাবে মুক্তি বাহিনীর জন্য কিছু যৎসামান্য হালকা অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ সরবরাহ, কিছু লজিস্টিক সাপোর্ট এর বেশি কিছুই নয়। মুক্তিফৌজ কমান্ডারদের মূলতঃ শত্রুপক্ষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধ সম্ভারের উপর নির্ভর করেই চালিয়ে যেতে হচ্ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম।”

মুক্তিফৌজ সেক্টর কমান্ডারদের জুলাই মাসের কনফারেন্সের কথা আগেই বলা হয়েছে। সেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়, দুই লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাকে ট্রেনিং দিয়ে গেরিলা হিসেবে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠানো হবে। এ প্রসঙ্গে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দোকারের বক্তব্য প্রাণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, “সেক্টর কমান্ডারদের মিটিং এর পর একদিন জেনারেল অরোরা এলেন। মিটিং হল। কর্নেল ওসমানীর সাথে সেই মিটিং এ আমিও উপস্থিত ছিলাম। মিটিং এ আলোচনার মূল বিষয় ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ট্রেনিং নিয়ে। কতজনকে ট্রেনিং দেওয়া হবে, কোথায় কোথায় ট্রেনিং দেওয়া হবে, কিভাবে ট্রেনিং দেওয়া হবে, কি করে রিক্রুটমেন্ট করা হবে, কতদিন ট্রেনিং দেওয়া হবে ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। জেনারেল অরোরা প্রস্তাব দিলেন পাঁচ হাজার গেরিলা ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করলেই হবে। শুনে কর্নেল ওসমানী এবং আমি দু’জনেই অবাক হয়ে গেলাম। আমি বলেই ফেললাম এত অল্প সংখ্যক গেরিলা দিয়ে কি হবে? জবাবে জেনারেল অরোরা বললেন, “These are the people who will go inside, bleed the enemy and all those things.” কর্নেল ওসমানী জেনারেল অরোরাকে দৃঢ়ভাবে জানিয়ে দিলেন তার দুই লক্ষ মুক্তিযোদ্ধা দরকার। সেক্টর কমান্ডারদের সদ্য সমাপ্ত কনফারেন্সে সেটাই সিদ্ধান্ত হয়েছে। যাই হোক ট্রেনিং শুরু হল। ট্রেনিং শেষ করে গেরিলারা ফিরে আসল। কিন্তু তারপর একটা বিরাট সমস্যা দেখা দিল। এ সমস্যাটার জন্য পুরোপুরি দায়ী ভারত সরকার।

ট্রেনিং এর পর ভারতীয় আর্মি সম্পূর্ণভাবে তাদের নিজেদের অধিনে রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল। এতে ভীষণ বিরূপ প্রতিক্রিয়া হল। ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের বিভিন্ন সেক্টর থেকে রিক্রুট করা হয়েছিল। ট্রেনিং-এর পর তারা নিজ নিজ সেক্টরে ফিরে গিয়ে তাদের প্রিয় সেক্টর কমান্ডারদের অধিনে যুদ্ধ করবে এটাই ছিল তাদের আশা। ভারতীয় সেনা কমান্ডারদের অধিনে যুদ্ধ করতে তারা রাজি হল না। ভারতীয় বাহিনী ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে দেশের ভেতরে তাদের কমান্ডের আওতায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সেটা আমাদের হেডকোয়াটার্সকেও জানতে দেয়া হয়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু কিছু জায়গায় জোর করে ইন্ডিয়ান কমান্ডাররা গেরিলাদের পাঠায় মূলতঃ লুটপাট করে নিয়ে আসার জন্য। যুক্তি হিসেবে তাদের বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধ চালাতে হাতিয়ার এর সাথে টাকা-পয়সারও প্রয়োজন রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা এ ধরণের অমানবিক অপারেশন এবং ইন্ডিয়ান আর্মির অধিনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে তাদের নিজ নিজ সেক্টরে পালিয়ে যায়। এর ফলাফল ও প্রতিক্রিয়া even at a later date was very bad মুক্তিযোদ্ধারা did not like the way Indian Army wanted them to be used. অল্প সময়ের মধ্যেই সব সেক্টরে এ সম্পর্কে তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর মাঝে অবিশ্বাসের জন্ম হয়। এ খবর জানাজানি হয়ে যাবার পর মুক্তিযোদ্ধাদের সেক্টর কমান্ডারদের দাবি অনুযায়ী আমাদের হেডকোয়াটার্স থেকে চাপ দেয়া হল, ‘আমাদের এই ট্রেইন্ড গেরিলাদের বাংলাদেশী কমান্ডারদের হাতে না দিলে This will be a disaster and catastrophe. বাংলাদেশের প্রশিক্ষিত গেরিলা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বাংলাদেশী সেক্টর কমান্ডারদের হাতে দিতেই হবে।’ এ সর্ম্পকে ভারতীয় মিলিটারী হাইকমান্ডের প্রথম থেকেই প্রচুর reluctance থাকা সত্ত্বেও ভারতীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ অনিচ্ছাসত্ত্বে নেহায়েত নিরূপায় হয়েই আমাদের চাপের মুখে নতি স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। পরবর্তী পর্যায়ে অবশ্য মুক্তিফৌজদের কাউন্টার ফোর্স হিসেবে ভারতীয় গোয়েন্দা বাহিনী (‘র’) এবং সেনা বাহিনীর মিলিত চেষ্টায় গঠিত হয়েছিল বিএলএফ। সে এক অন্য অধ্যায়।

ভারতীয় নেতৃত্বের এ ধরণের মনোভাবের দু’টো কারণ হতে পারে। প্রথমত: বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ফিল্ড কমান্ডারস এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ভারত সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস করেনি। তাই তারা সবসময় মনে করত এদের উপর নির্ভর করা যায় না। দ্বিতীয়ত: তাদের মনে এমন একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল যে শেষ পর্যন্ত তাদের সরাসরি যুদ্ধের বিজয় ফল হিসেবে স্বাধীনতা লাভ করবে বাংলাদেশ। তাই পাক বাহিনীকে দুর্বল করার জন্য গেরিলা বাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে তাদের শুধু ব্যবহার করতে হবে সীমিত লক্ষ্যে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের বৃহৎ অংশ এবং সদস্যরা চেয়েছিলেন দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রয়োজনে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম পরিচালনা করে নিজেদের প্রচেষ্টায় তারা স্বাধীন করবেন তাদের মাতৃভূমি। কিন্তু তেমনটি হয়নি। আমার মনে হয় এখানেই মুক্তি বাহিনী এবং ভারতীয় নেতৃবৃন্দ ও সেনা বাহিনীর মধ্যে একটা Credibility Gap হয়ে গেছে। আমাদের সামরিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ছিল পরিষ্কার, ‘আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীন করব। বন্ধুরাষ্ট্র ভারত মুক্তিকামী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করলে আমরা অবশ্যই সে সাহায্যকে অভিনন্দন জানাব। কিন্তু necessarily this is our struggle and we have to fight it ourselves. তাছাড়া শুধু ভারত কেন? পৃথিবীর যে কোন দেশ আমাদের সংগ্রামে সাহায্য করতে চাইলে আমরা তা সানন্দে গ্রহণ করব। মোটকথা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে ভারত ও আমাদের মধ্যে approach of mutual confidence ছিল না বা কখনো গড়ে উঠেনি because of their overall policy. একথাও সত্য যুদ্ধক্ষেত্রের অনেক সেক্টরে ইন্ডিয়ান কমান্ডারদের কার্যকলাপে মুক্তিযোদ্ধাদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়েছে। ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টিও হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। সত্যিকথা বলতে গেলে ৯ই আগষ্ট রুশ-ভারত চুক্তি সই হওয়ার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল বাঙ্গালী মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের চেষ্টায়। ৯ই আগষ্টের পরই ভারত সরাসরিভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করা শুরু করে এবং বাংলাদেশের ব্যাপারে ইন্ডিয়ান আর্মি ৎবধষষু really started taking closer interest.”

মাঈদুল হাসান এ পর্যায়ে জিজ্ঞেস করেন, “ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশ বোধ হয় স্বাধীনতা পেত না, কি বলেন?” খন্দোকার সাহেব মাঈদুল হাসান সাহেবের সাথে ভিন্নমত পোষণ করে বলেন, “যদিও মুজিবনগরের অনেকে এমনকি আমাদের মন্ত্রীসভার অনেকেই হতাশা বোধ করতেন, সংসদ সদস্যদের অনেকেই ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার সুযোগ নিয়ে ফিরে যাবার চিন্তা-ভাবনাও করছিলেন। মুক্তি বাহিনীর তৎপরতায় আস্থাহীন হয়ে হতাশা বোধ করতেন। দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের কথা শুনলেই আতঁকে উঠতেন। ভাবতেন কি হচ্ছে! দেশে বোধ হয় আর ফিরে যাওয়া যাবে না। এ ধরণের পরিস্থিতিতেও আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতাম, মুক্তিফৌজের গেরিলা তৎপরতা বেড়ে গেলে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাবে বলে যুক্তির অবতারণা করে যারা আমাদের মুক্তি সংগ্রামের গতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলেন তাদের সে যুক্তি ছিল সম্পূর্ণ ভুল এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। পক্ষান্তরে আমরা যদি আমাদের সংগ্রামের তীব্রতা প্রথম থেকেই বাড়াতে সক্ষম হতাম তবে আমাদের প্রচন্ড গেরিলা তৎপরতার মুখে পাকিস্তান দখলদার বাহিনীকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই আত্মসর্মপন করতে হত মুক্তি ফৌজের কাছে। কারণ They had no chance to fight. Their moral was completely shattered and the losses would have been unacceptable to them. (সংবাদ ২৬শে মার্চ ১৯৯০)।

জনাব মাঈদুল হাসান জবাবে বলেছিলেন, “আপনার চিন্তা-ভাবনায় যুক্তি থাকলেও ভারতীয়রা ভেবেছিলেন অন্যরকম। তারা চেয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে ছোট করে দেখাতে এবং বিশ্ব পরিসরে পাক-ভারত যুদ্ধের ফল হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করতে। এতে ভারত এক ঢিলে দুই পাখি বধ করতে সক্ষম হয়।
প্রথমত: ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের প্রতিশোধ নিয়ে নিজেকে উপমহাদেশের প্রধান সামরিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় ভারত।

দ্বিতীয়ত: বাংলাদেশের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ রাখার যৌক্তিকতা অর্জন করে।