মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

বিরোধী পক্ষের উপর নির্যাতন শুরু হল

 
   
 

বিরোধী পক্ষের প্রতি হুশিয়ারী উচ্চারণ করে গর্বের সাথে শেখ মুজিব বললেন, “রাষ্ট্র বিরোধী দুঃস্কৃতিকারীদের হুশিঁয়ার করে দিচ্ছি, প্রয়োজনে আমি লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দিব।” সরকার ও সরকারি দলের প্রভাবশালী নেতাদের ব্যক্তিগত বিভিন্ন বাহিনীগুলোর প্রতিই ছিল তার এই ইঙ্গিত।

১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহের উপর বর্বর নির্যাতন শুরু হয়। এ নির্যাতনে শুধু রাষ্ট্রীয় প্রশাসন যন্ত্রের বিভিন্ন বাহিনীই অংশগ্রহণ করেনি, তাতে অংশ নেয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত বিভিন্ন লাঠিয়াল ও বেআইনী সশস্ত্র পেটোয়া বাহিনী। রাজনৈতিক নির্যাতন ও হয়রানির অভিযোগ তোলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির চেয়ারম্যান মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, কাজী জাফর আহমদ, ছাত্রলীগের রব-সিরাজ গ্রুপ। তারা আওয়ামী সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাড়াবার জন্য জনগণের কাছে আবেদন জানান। তারা বিবৃতি সমাবেশের মাধ্যমে বলেন, “বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ও সংগ্রামী ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ শক্তিকে শেষ করে দেবার জন্য মাত্র ৯মাস আগে নির্যাতন এবং পুলিশ ও সেনা বাহিনীর বেপরোয়া গুলি চালানোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠতেন যারা; ক্ষমতায় আসীন হয়ে গত মাসেই প্রায় ডজনখানেক জায়গায় ছাত্র-জনতার সমাবেশে ও মিছিলে গুলি চালিয়েছেন তারা। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাসীন দল দখলদার বাহিনীর দালালদের সহায়তায় প্রশাসন যন্ত্রকে প্রভাবিত করে ছাত্র, বিরোধী দলীয় কর্মী ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে মিথ্যে মামলা দায়ের করে তাদের গ্রেফতার করছেন। রাজনৈতিক নেতারা রাজধানী থেকে সরকারি ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কর্মী, ছাত্র, যুবকদের শায়েস্তা করার জন্য গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে তাদের অযথা হয়রানি করছেন।”

৯ই সেপ্টেম্বর ১৯৭২ সালে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান আব্দুর রাজ্জাক বলেন, “বাংলাদেশের প্রতিটি বাড়ির দোর গোড়ায় মুজিববাদের বাণী পৌছে দেয়ার জন্য আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবে। আঞ্চলিক, জেলা এবং মহকুমা পর্যায়ের নেতাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই বাহিনীর প্রশিক্ষণ এবং কর্মকান্ডের সমন্বয় সাধন করা হবে। প্রতিটি ইউনিয়নে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের বাশের লাঠির মাধ্যমে জঙ্গি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে।” এরপর ট্রেনিং শুরু হয়। ইতিমধ্যে আওয়ামী-লীগের নেতা জনাব আব্দুল মান্নান এক লক্ষ লোকের এক সমাবেশের আয়োজন করেন ১লা মে ১৯৭২-এ এবং ঐ সমাবেশে তিনি ঘোষণা দেন, “আগামী ৯ই জুন থেকে তার অনুসারীরা জাতীয় শত্রুদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করবে।” তিনি সরকারের কাছে দাবি জানান যাতে করে তার বাহিনীর সদস্যদের এ্যারেষ্ট, সার্চ, ইন্টারোগেশন এবং শাস্তি দেবার ক্ষমতা দেয়া হয়। এভাবে মুজিব ভক্তরা সবাই আইনকে নিজেদের হাতে নেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। এক সভায় স্বয়ং শেখ মুজিবর রহমান অতি দম্ভের সাথে তার সমালোচকদের উদ্দেশ্যে বলেন, “আমি আমার লাল ঘোড়া দাবড়াইয়া দেব।” ইঙ্গিতটি ছিল আওয়ামী লীগের বেসরকারি বাহিনীগুলোর প্রতি। শ্রমিকলীগের নেতার ঐ অভিযান শুরু হওয়ার ৭দিনের মাথায় খুলনায় পুলিশ ও লালবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। দেশের অন্যান্য অঞ্চলেও ঐ ধরণের সংঘর্ষের খবর পাওয়া যায়। সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিসি'তির আরো অবনতি ঘটে। ঐ সমস্ত ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের বাহিনীর হাতে নাজেহাল হতে থাকে সাধারণ নিরীহ মানুষ।

অবস্থার এতই অবনতি ঘটে যে, আওয়ামী লীগের ‘বি’ টিম হিসেবে পরিচিত মোজাফফর ন্যাপও ঐ ধরণের ঔদ্বত্ত বন্ধ করার জন্য সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করতে বাধ্য হয়। জনাব মোজাফফর আহমদ এক বিবৃতিতে বলেন, “স্বেচ্ছাসেবক এবং একটি রাজনৈতিক দলের অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা অন্যায়ভাবে নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। সংগঠনের দায়রার বাইরে গিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র এবং শ্রমিক সংগঠনগুলো ঐ ধরণের বর্বরতা করে চলেছে অবিরাম। তারা ইচ্ছানুযায়ী কারফিউ জারি করে স্থানীয় প্রশাসনকে অবজ্ঞা করে লোকজনকে ধরে তথাকথিত আদালতে তাদের বিচারের নামে অমানুষিক জুলুম করছে। প্রশাসন এবং পুলিশ রহস্যজনকভাবে ঐ ধরণের কার্যকলাপের ব্যাপারে নিরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করে নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে।” তিনি জনগণের প্রতি আবেদন জানান যাতে করে ঐক্যবদ্ধভাবে তারা ঐ সমস্ত অন্যায় ও অসহনীয় নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তুলেন।