মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

মাওলানা ভাসানী ছিলেন দিব্যদৃষ্টির অধিকারী

 
   
 

বাংলাদেশের পরিসীমা সম্পর্কে মাওলানার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল পরিষ্কার। কিংবদন্তীর নেতা আমাদের শেষ বৈঠকে সেটা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন।

১৯৭৬ সালের আগষ্ট মাসে তিনি লন্ডন গিয়েছিলেন অপারেশনের জন্য। আমিও তখন লন্ডনেই অবস্থান করছিলাম। খবরটা তাঁর কাছে পৌঁছে যায়। খবর পেয়েই তিনি একদিন আমার এক ঘনিষ্ট বন্ধু সাংবাদিক জনাব গাজীউল হাসান খানের মাধ্যমে ডেকে পাঠান। সময়মত আমি ও গাজী তার ফ্ল্যাটে গিয়ে উপস্থিত হলাম সকাল ১০টার দিকে। হাসপাতাল থেকে অপারেশনের পর বাংলাদেশ দূতাবাসই তাকে সেই ফ্ল্যাটে থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছে। সেখানে পৌঁছে দেখলাম তার পুত্র জনাব নাসের খান ভাসানী মাওলানা সাহেবের ঘরে উপস্থিত রয়েছেন। হুজুর আধশোয়া অবস্থায় বিছানায় চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে কি যেন ভাবছিলেন! অপারেশনের ক্ষত তখনও শুকায়নি। চলাফেরা, পথ্য সব কিছুই রেসট্রিকটেড। আমরা এসেছি শুনে তিনি চোখ মেলে আমাকে ইশারায় তার বিছানায় গিয়ে বসতে বললেন। আমি তার আদেশ অনুযায়ী তাঁর শিয়রে গিয়ে বসলাম। গাজী কাছেই একটা চেয়ার টেনে নিল। সালাম দোয়ার পর হুজুর জিজ্ঞেস করলেন,
-নাস্তা করছস?
-হ্যাঁ হুজুর, নাস্তা কইরাই আইছি। জবাব দিলাম।
-ভালো কথা। তাইলে আমারে নাস্তা খাওয়া। আমি ডিম খামু। স্বল্প দূরে দাড়িয়ে থাকা জনাব নাসের ভাসানীর সাথে চোখাচোখি হল। নিচুগলায় তিনি আপত্তি জানালেন। বললেন,
-ডাক্তারকে না জানিয়ে ডিম দেয়া ঠিক হবে না। ক্ষেপে গেলেন মাওলানা। জেদ ধরে বসলেন ডিম তিনি আজ খাবেনই। অগত্যা দু’টো ডিমের পোঁচ করে আনলেন নাসের ভাসানী। ডিমের প্লেটটা হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই ইশারায় সেটা আমাকে দিতে বলে তাকে বাহিরে গিয়ে অপেক্ষা করার ইঙ্গিত দিলেন মাওলানা। নাসের ভাসানী চলে গেলেন। গাজী বসে আছে চুপচাপ। হুজুর বললেন,
-নে শুরু কর। খাওয়াইয়া দে।
আমি আস্তে একটু একটু করে চামচ দিয়ে তাঁকে ডিম খাওয়াতে শুরু করলাম। এ বয়সে অপারেশনের ধকলে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কথা বলছিলেন অতি ক্ষীণ স্বরে। খাওয়ার ফাকেই তিনি আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই জেনে নিলেন। লন্ডনে কবে এলাম? কেন এলাম? পরিবার কোথায়? সবকিছুরই সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম। খাওয়া শেষে মুখ ধুইয়ে মুছে দিলাম। খাওয়ার পর কিছু ঔষধ খাওয়ার ছিল সেগুলোও তাকে খাইয়ে দিলাম। এবার তাকে কিছুটা রিলাক্সড মনে হচ্ছিল। পাশে বসে আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। লক্ষ্য করলাম, মাওলানা যেন কোন এক গভীরে তলিয়ে গেছেন। বেশ অনেকক্ষণ পর হঠাৎ করেই বলা শুরু করলেন, 
-বাবা, ৯৭ বছরের বেশি বয়স হইয়া গেছে। কবে আছি, কবে নাই কে জানে! তবে একটা কথা তোরে কইয়া যাইবার চাই। এ বুড়া সারাজীবনে যা করতে পারে নাই তুই ও তোর সাথীরা সেটা কইরা বাংলাদেশের ১০কোটি জনগণরে বাচাঁইছোস জালেমের হাত থ্যাইকা। এ বুইড়া তোদের দোয়া দিতাছে, আল্লাহ তোদের হায়াত দারাজ করুক। বলেই তিনি আমার মাথায় গায়ে তার ক্ষীণ হাত বুলিয়ে শরীরে, বুকে ফুঁক দিলেন। তার চোখের কোল ঘেষে তখন পানি বেরিয়ে এসেছে। চোখ বোঁজা অবস্থায় তিনি আমার জন্য দোয়া করছিলেন বিড়বিড় করে। কাছে বসেও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম না কোন সুরা বা আয়াত পড়ছিলেন তিনি। আমি তার অশ্রুধারা মুছিয়ে দিয়ে আবেগে বিহ্‌বল হয়ে বসে রইলাম। আমার প্রতি তার স্নেহ ও মমতা দেখে আমার চোখ দু’টোও অশ্রুসজল হয়ে উঠল। কেমন যেন এক ঐশ্বরিক স্তব্ধতায় মহীয়ান হয়ে চোখ বুজে ছিলেন কিংবদন্তীর নায়ক বাংলাদেশের মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানী। সে এক অভূতপূর্ব পরিবেশ! অতি কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে তার হাত ধরে নিশ্চুপ বসে থাকলাম। তিনি চোখ খুললেন,
-বাবা, তোর জায়গা লন্ডন না, দেশে যাইতে হইবো।
হুজুরের কথার জবাব কি দেব ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সে সময় আমাদের সাথে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের কিছু রাজনৈতিক বিষয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিল। ভাবছিলাম হুজুরকে সব খুলে বলবো কিনা। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনিই বলে উঠলেন,
-জিয়ার সাথে মতের অমিল হইছে; সেইডা আমি জানি; কিন্তু জিয়ারই সব ভুল। আমি গিয়া তারে বুঝামু। কথা শুনলে ভালো আর না বুঝলে আমি জানি কি করতে অইবো। তুই তৈরি থাকিছ। তবে বাবাজান একটা কথা। বুড়া মানুষের কথাটা মন দিয়া হুনিস। যে কাজ শুরু করছস তার শেষ বহুদূরে। বাংলাদেশের মধ্যেই চোখ বন্ধ কইরা উট পাখি হইয়া বইসা থাকলে চলব না। চোখ খুইলা চাইতে হইবো সীমানার বাইরে। কথাটা একটু ভাল কইরা চিন্তা কইরা দেখিছ।
কথা বলতে বলতে তিনি বেশ কিছুটা হাঁপিয়ে উঠেছিলেন। আমি আস্তে আস্তে তার কপালের ঘাম মুছিয়ে দিতে দিতে বললাম,
-হুজুর আপনি দোয়া করবেন যাতে আমি আমার নিয়তে কায়েম থাকতে পারি। আল্লাহ্‌পাক যেন আমারে সুযোগ দেন যাতে একজন মুজাহিদ হিসাবে আপনার ইশারা অনুযায়ী সঠিক রাস্তায় বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য নিজেকে প্রয়োজনে কোরবান করতে পারি।

আমার জবাব শুনে বিছানায় শুয়েই তিনি আমাকে বুকে টেনে নিলেন। তার উষ্ণতা ও আন্তরিকতায় আমার বুক ভরে উঠেছিল। ডাক্তার এসে গেছে। আমাদের বিদায় নিতে হবে। সালাম করে আমি আর গাজী বেরিয়ে এলাম। বুকের মাঝে গেথে নিয়ে এলাম মহান নেতার অমূল্য দিক নির্দেশ। সেটাই মাওলানা ভাসানীর সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ। এর অল্প কিছুদিন পরই তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহে........রাজেউন)। তার মৃত্যুতে জাতি হিসেবে আমরা হারালাম একজন জনদরদী অভিজ্ঞ মুরুব্বী এবং দূরদর্শিতা সম্পন্ন বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ।

অর্থনৈতিক সংকট, হতাশা, শেখ মুজিবের ভারত তোষণ নীতি এবং দুর্নীতিপরায়ন অত্যাচারী সরকার সর্ম্পকে জনগণের নেতিবাচক মনোভাব, আইন-শৃঙ্খলা ক্ষেত্রে চরম নৈরাজ্য সবকিছু মিলিয়ে দেশে যে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয় তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে তখনকার সবকয়টি প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক দল। আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে অগ্রণীর ভূমিকায় এগিয়ে আসেন বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান মজলুম জননেতা মাওলানা ভাসানী। দেশের সাধারণ গণমানুষের মুক্তির স্বপ্ন চিরজীবন দেখেছেন মাওলানা ভাসানী। মার্কসীয় দর্শনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষদের মুক্তি আসতে পারে এটা সম্পূর্ণভাবে মাওলানা ভাসানী কখনই মেনে নেননি। ঐতিহ্যবাহী ইসলামী রাষ্ট্রীয় ধারণাকে তিনি অধুনাকালের বৈজ্ঞানিক ও বৈপ্লিবক রাষ্ট্রীয় চেতনায় বাস্তবায়িত করে মানুষের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মুক্তি এনে রাষ্ট্রীয় দুঃশাসনের অবসান করতে চেয়েছিলেন তিনি। তার রাজনৈতিক চিন্তার ব্যাখ্যায় তিনি সর্বদা স্রষ্টা ও সৃষ্টির হকের কথা বলতেন। এ সমস্ত কিছু নতুন কথা নয়। ইউরোপীয় রাজনৈতিক দর্শন, ক্রিশ্চিয়ান সোস্যালিজম ও আঞ্চলিক সাম্যবাদ, ইউরো কম্যুনিজম এর মধ্যেও একই ভাবধারা বিরাজমান। ইন্দোনেশিয়ার সুকার্নো চেয়েছিলেন ধর্ম, জাতীয়তাবাদ এবং কম্যুনিজমকে একত্রিকরণের মাধ্যমে ‘নাসাকম’ কায়েম করতে। পরে কম্যুনিজম বাদ দিয়ে সে জায়গায় সোস্যালিজম গ্রহণ করে তিনি স্থাপন করেন ‘নাসাসোস’। মাওলানা ভাসানী চেয়েছিলেন ধর্ম ও সমাজতন্ত্রের সমন্বয়ে কায়েম করতে ‘হুকুমতে রব্বানিয়া’। ১৯৭১ সালে ভারতে নজরবন্দী হিসেবে মাওলানা ভাসানীর সার্বক্ষণিক সঙ্গী বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ জনাব সাইফুল ইসলাম যখন শেষ বিদায় নিয়ে দেশে ফিরছিলেন তখন মাওলানা ভাসানী তাকে বলেছিলেন,
-চাইছিলাম লন্ডন যাব, প্রবাসী সরকার গঠন করব। কিন্তু কুটুম বাড়ি বেড়াইয়া গেলাম। অনেক বড় স্বপ্ন দেইখা দায়িত্ব কান্ধে নিয়া আমার সাথে আসছিলা। স্বপ্ন আমারও ছিল, বাংলার দুঃখী গরীব মানুষের মুক্তির স্বপ্ন। সেটা পাইতে হইলে আর একটা লড়াই লড়তে হইবো। এতো রক্ত ঝরাইলো কিন্তু দ্যাশের মানুষ তো মুক্তি পাইবো না। আধা স্বাধীনতা নিয়া দ্যাশে ফিরলে আবার লাইগবো খটাখটি, তাই ভাইবতাছি----।
-হুজুর কথা ঠিক! কিন্তু সে লড়াইতো বাইরের দুশমনের সাথে সরাসরি নয়। দেশের মধ্যেই সে লড়াই ঘরে ঘরে।
-সেই জন্যই আরও কঠিন আরও হিংসার মনডা পোক্ত কইরা নিয়া যাইতে হইবো।

একাত্তরের বিচক্ষণ নেতা তার অর্ন্তদৃষ্টি দিয়ে ভবিষ্যতের যে অবস্থা দেখেছিলেন ঠিক সে অবস্থাই পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছিল মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী-বাকশালী চক্র বাংলার মাটিতে স্বৈরশাসনের একনায়কত্ব কায়েম করে। স্বৈরশাসনের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে জনগণকে মুক্ত করার সংগ্রামে অগ্রণীয় ভূমিকা গ্রহণ করে অকুতোভয় মাওলানা ভাসানী ১৯৭১ সালে জনাব সাইফুল ইসলামের কাছে তার ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কে যে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন ঠিক সেই দায়িত্বই আন্তরিকভাবে পালন করেন। দেশ ও জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে আপোষহীন ছিলেন মাওলানা। না ভারতের প্রতি দুর্বলতা, না পাকিস্তানের পায়রবী। প্রয়োজনে চৈনীক নীতির তিরষ্কার, মার্কিনীদের অবিশ্বাস, সোভিয়েতের সমালোচক - এই হল সিংহ পুরুষ মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী।