মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

আমি এবং ৩২নং ধানমন্ডি

 
   
 

ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে ৩২নং ধানমন্ডির বাসভবন আমার জন্য ছিল অবারিত দ্বার। যখন ইচ্ছে তখনই আমি সেখানে যেতে পারতাম।

যখনই আমি ৩২নং এ গিয়েছি, সবসময় দেখেছি লোকের ভীড়; সবাই শেখ মুজিবকে ঘিরে রাখছে। কিন্তু কম লোকজনকেই দেখেছি তার সামনে কোন প্রশ্নের সঠিক এবং সত্য জবাব দিতে। বেশিরভাগ লোকই তোষামোদ করে যা বললে তিনি খুশি হন সেটাই বলত। আশ্চর্য হতাম তাদের চাটুকারিতা এবং মোশায়েবীপনায়। দর্শনার্থীরা একথা সেকথার পর সুবিধামত নিজের ব্যক্তিগত কাজটি বাগিয়ে নিয়ে কেটে পড়তেন। এটাই ছিল নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। তিনি আমাকে বিশেষভাবে স্নেহ করতেন। মুজিব পরিবারের অন্য সবাইও আমাকে এবং আমার স্ত্রী নিম্মীকে খুবই ভালোবাসতো। পাকিস্তান থেকে ফেরার পর ১৯৭২ সালে আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে তিনি স্বপরিবারে উপস্থিত হয়ে আমাদের আর্শীবাদ করেছিলেন। সে অনুষ্ঠানই ছিল তার বাংলাদেশে আসার পর প্রথম কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে উপস্থিতি। পুরো মন্ত্রী পরিষদও উপস্থিত ছিলেন সে অনুষ্ঠানে। আমি ও আমার পরিবারবর্গ রাজনৈতিকভাবে তার দল ও রাষ্ট্র পরিচালনা করার নীতিকে সমর্থন না করলেও তাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করতাম। নিজের কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য আমি তার কাছে কখনোই যাইনি। যেতাম সত্যকে তার কাছে তুলে ধরার জন্য। ভাবতাম, সবাই যেখানে চাম্‌চাগিরী করছে সেখানে সাহস করে সত্যকে তার সামনে তুলে ধরলে তিনি নিশ্চয়ই তা অনুধাবন করতে পারবেন এবং এতে করে তার দায়িত্ব সুষ্ঠভাবে পালন করতে তার সুবিধা হবে। তার রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটবে।
একদিন বেশ রাত করে ধানমন্ডির এক বন্ধুর বাসার পার্টি থেকে ফিরছিলাম আমি ও নিম্মী। মশুলধারে বৃষ্টি পড়ছে। অল্পদূরেও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ইন্টারকন ছেড়ে পুরনো গণভবন মানে বর্তমানের সুগন্ধার কাছাকাছি এসেছি; হঠাৎ বিপরীত দিক থেকে একটি গাড়ি অতি দ্রুতগতিতে আসছে দেখলাম। দূর থেকেই গাড়ির ভিতর থেকে হৈ-হুল্লোড়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। কিছু উশৃঙ্খল তরুন বেসামাল অবস্থায় হৈ-হুল্লোড় করছিল। গাড়িটিও এগিয়ে আসছিল ঠিক একই অবস্থায় একেবেকে। নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ি থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য গাড়ি একটু সাইড করতেই গাড়ি স্কিড্‌ করে গিয়ে জোরে মুখোমুখি ধাক্কা খেল সামনের ল্যাম্পপোষ্টের সাথে। জোরে ধাক্কা লাগায় ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেল। সামনের বনেটটাও দুমড়ে-মুচড়ে ভিতরে ঢুকে গেছে। গাড়ি কিছুতেই আর স্টার্ট নিচ্ছে না। অন্য গাড়িটি আমাদের অবস্থা দেখে না থেমে আরো দ্রুতবেগে দৃষ্টির বাইরে চলে গেছে। বৃষ্টির প্রচন্ডতা ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। রাত অনেক হয়েছে তার উপর এমন বৃষ্টি তাই রাস্তাও একদম ফাঁকা। ষ্টিয়ারিং এর সাথে মাথা লেগে মাথা ফেটে রক্ত ঝরে পরছে আমার কপাল বেয়ে। নিম্মীর অবশ্য কিছুই হয়নি। আমার রক্ত দেখে ঘাবড়ে গেছে বেচারী। কি করব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ইঞ্জিনটা একটু নেড়েচেড়ে দেখছিলাম যদি কোনমতে গাড়িটা স্টার্ট নেয়। না; কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। হঠাৎ সাইরেন বাজিয়ে রাষ্ট্রপতির কাফেলা এগিয়ে আসছে দেখতে পেলাম। আমি তখন অসহায় অবস্থায় দাড়িয়ে আছি গাড়ির পাশে। কাফেলা কাছে আসতেই রাষ্ট্রপতির গাড়ি দাড়িয়ে পড়ল। গাড়ির জানালার কাঁচ নামিয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রপতি মুখ বের করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কি ব্যাপার? কপালের রক্তক্ষরণ দেখে বুঝতে পারলেন গাড়ির এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মুহুর্তে তিনি তার একজন সহযোগীকে নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে গাড়িতে করে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যেতে। তার হুকুমে আমি ও নিম্মী তার কাফেলারই একটি গাড়িতে করে সিএমএইচ-এ পৌঁছালাম। চিকিৎসার পর তার গাড়িতেই বাসায় ফিরলাম। বাসায় ফিরে দেখি বাসার সবাই উৎকন্ঠিত অবস্থায় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। আমার মাথায় ব্যান্ডেজ দেখে সবাই ভড়কে গিয়েছিল। রাষ্ট্রপতি বাড়ি ফিরেই মালিবাগে আমাদের দুর্ঘটনার খবরটা পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফোনে অবশ্য জানানো হয়েছিল অ্যাকসিডেন্ট তেমন একটা সিরিয়াস নয়; তাই ঘাবড়াবার কোন কারণ নেই। আব্বাকে আস্বস্ত করার জন্য বলা হয়েছিল র্দুঘটনাস্থলের কাছ দিয়ে যাবার সময় আমাদের দেখতে পেয়ে স্বয়ং রাষ্ট্রপতিই আমাদের গাড়ি করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেবার বন্দোবস্ত করেছেন। সবাইকে দুঃশ্চিন্তামুক্ত করার জন্য বলেছিলাম, “Injury is not serious at all only three stitches that’s all. So nothing to worry about and Nimmi is absolutely unhurt.”

এ ঘটনার অবতারনা এখানে এর জন্য করা হল যা থেকে পাঠক বুঝতে পারবেন ব্যক্তি এবং পারিবারিক পর্যায়ে মুজিব পরিবারের সাথে আমাদের কি ধরণের ঘনিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু কোন সম্পর্কই নীতি-আদর্শের র্উদ্ধে নয়। তাই আমিও পারিনি আপোষ করতে। ব্যক্তি মুজিব নয়; গণবিরোধী পুতুল সরকার প্রধান, গণতন্ত্রের হত্যাকারী, বাকশালী স্বৈরশাসনের প্রবর্তক শেখ মুজিবর রহমানের সাথে।