মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেবার পরিকল্পনা

 
   
 

সরকার জেনারেল জিয়াকে বার্মায় ‘ডিফেন্স এ্যটাসী’ করে পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়।

আমরা তখনো সারাদেশে ডিপ্লয়েড। একদিন নূর ফোন করে জানাল- জেনারেল জিয়া অতি জরুরী প্রয়োজনে আমার সাথে দেখা করতে চান। ফোন পেয়েই এলাম ঢাকায়। নূর জানাল বস আমাকে বাসায় দেখা করতে বলেছেন। বুঝলাম বিশেষ জরুরী বিষয়ে আলাপ করতে ডেকে পাঠিয়েছেন তিনি। জরুরী এবং গোপন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা সাধারণতঃ তার বাসাতেই হত। বাসায় গিয়েই দেখা করলাম। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে অনেক আলোচনার পর তিনি আসল কথাটা বললেন,
-I hear that I am going to be sent out from the army as Defense Attaché to Burma soon, do you know anything about it?
-আকাশ থেকে পড়লাম! কি বলছেন জেনারেল জিয়া? শেখ মুজিবতো কথা দিয়েছিলেন কিছুদিনের মধ্যেই তিনি তাকে চীফ বানাবেন; তাহলে? জবাব দিলাম,
-আমি কিছুই জানি না স্যার। তবে আপনার যাওয়া চলবে না। আপনাকে হারাতে চাই না আমরা।
- Well then try to do something.. তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। তিনি চাচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সাথে এ বিষয়ে আমি আলাপ করি। অবশ্যই আমার সাধ্যমত যা করার সেটা আমি করব। প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করব আজই। বললাম আমি।
- I shall appreciate that. Do let me know the outcome of your meeting. I shall be waiting for your return.
-ঠিক আছে স্যার। বলে বেরিয়ে এসেছিলাম তার বাসা থেকে।
সেদিন রাতেই গিয়ে উপস্থিত হলাম ৩২নং ধানমন্ডিতে। নেতা তখনো বাড়ি ফেরেননি। রেহানা ও জামালের সাথে বসে গল্প-গুজব করছিলাম। জামাল জানাল সে স্যান্ডহার্টস না হয় যুগোস্লাভিয়ায় যাচ্ছে Army officer’s course করার জন্য। শুনে বললাম, “ ভালইতো; ক্যারিয়ার হিসাবে আর্মিকে যদি তোমার পছন্দ হয় তবে তো তোমার যাওয়াই উচিত।” আমরা যখন কথা বলছিলাম কামাল যেন কোথা থেকে বাসায় ফিরে এল। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল,
-বস কি ব্যাপার ?
-কোন ব্যাপার ছাড়া ৩২নং এ বুঝি কেউ আসে না? আমার পাল্টা প্রশ্নে ও একটু লজ্জা পেলো। তাড়াতাড়ি পরিবেশ হালকা করার জন্য বলল,
-না না তা ঠিক নয়। তবে বেশিরভাগ লোকজনদেরই কিছু না কিছু ব্যাপার থাকে; তবে ব্যতিক্রমও আছে যেমন আপনি। আপনি আসেন শুধু আব্বার সাথে ঝগড়া করতে।
-ঝগড়া করার অধিকার তার, ভালবাসার অধিকার যার। জবাবে বলেছিলাম আমি।
-তাতো অবশ্যই, সেটা কি আমরা বুঝি না। বাদ দেন এসব। একটা পরামর্শ দেনতো বস। বলল কামাল।
-কি বিষয়ে? জিজ্ঞেস করলাম।
-একটা স্কলারশীপ পাইছি ক্যানাডায় ল’ পড়ার জন্য। ঠিক করতে পারতাছি না যামু কি যামু না।
-এটাতো অত্যন্ত সুখবর! যাবে না মানে? নিশ্চয়ই যাওয়া উচিত। জ্ঞান অর্জন করার জন্যতো চীন পর্যন্ত যেতে বলেছেন আমাদের প্রিয় নবী। মাত্র ৩-৪ বছরের ব্যাপার। সময় দেখতে দেখতে কেটে যাবে। আমি যদি এমন একটা সুযোগ পেতাম তবে খুশী হয়ে চলে যেতাম। আমার জবাব শুনে কামাল বলল,
-তাহলে যাওয়াই উচিত আপনার মতে?
-অবশ্যই যাওয়া উচিত। এরই মধ্যে বাড়ির কাজের ছেলেটা এসে জানাল কেউ এসেছে কামালের সাথে দেখা করতে তাই বিদায় নিয়ে কামাল চলে গেল। নেতা ফিরলেন বেশ রাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার ডাক পড়ল।
-কি খবর অনেকদিন পর আইলি যে? শেখ সাহেব বললেন।
-ঢাকায় কাজে এসেছি ভাবলাম আপনাকে সালাম জানিয়ে যাই। তিনি বেশ খোশমেজাজেই ছিলেন। কথার সাথে সাথে পাইপ টানছিলেন।
-চাচা, আপনি নাকি জেনারেল জিয়াকে বার্মায় Defense Attaché করে পাঠবেন ঠিক করেছেন? তার ভাল মুড এর সুযোগ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
-ঠিক করি নাই; তবে বার্মায় একজনরে পাঠাইতে হইবো। শফিউল্লাহ কইলো জিয়ার নাকি ইন্টিলিজেন্সের ট্রেনিং আছে তাই ওর ব্যাপারে চিন্তা-ভাবনা করা হইতাছে।
তার কথার খেই ধরে আমি বললাম,
-ইন্টিলিজেন্স কোর্স করা আর্মিতে আরো অনেক অফিসারই আছে। তাদের থেকে কাউকে পাঠান। General Zia is too senior for that post anyway. তাছাড়া এই মুহুর্তে তাকে বাইরে পাঠালে সবাই ভাববে আপনি আপনার কথার খেলাপ করে তাকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আর্মি থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। এটা আপনার জন্য ভাল হবে কি? তাছাড়া বেশকিছু কারণে আর্মির ভেতরে একটা সুপ্ত ক্ষোভ বিরাজ করছে। এ অবস্থায় এ ধরণের একটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে যদি কোন Out burst ঘটে; সেটা সরকার এবং সরকার প্রধান হিসাবে আপনার জন্য বিব্রতকরও হতে পারে। বেয়াদবী নেবেন না চাচা, আমার মনে হয় এই সিদ্ধান্ত নেয়াটা ঠিক হবে না। চুপ করে আমার কথাগুলো শুনে গেলেন শেখ সাহেব পাইপ মুখে নিয়ে।
-তুই কেমন আছস? কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন তিনি।
-যেমন রাখছেন। জবাব দিলাম।
-তোরাতো একটা কথা বুঝস না। পার্টির রাজনীতি করতে গেলে সবকিছুতে যুক্তি চলে না। নিজের ইচ্ছামতও সবকিছু করন যায় না। আমার অবস্থাটা বুঝিস। দেশও চালাইতে হয় আবার পার্টির স্বার্থও দেখতে হয়।
-চাচা আমি রাজনীতি করি না। প্রত্যক্ষ রাজনীতি সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা অনেক। সেই তুলনায় আমার কোন জ্ঞান নাই বললেই চলে। তবু কেন জানি মনে হয় প্রচলিত প্রবাদটায় একটা গভীর মানে আছে, একটা ঈঙ্গিত বলা চলে।
-কোন প্রবাদের কথা কছ তুই? জানতে চাইলেন জনাব শেখ মুজিব।
-ঐ যে, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়; দলের চেয়ে দেশ বড়।’ হালকাভাবে কথাটা বলেই ফেললাম। পূর্ব প্রসঙ্গে ফিরে গেলেন শেখ সাহেব।
-জিয়া তোরে পাঠাইছে? প্রশ্ন করলেন তিনি।
-জিয়া পাঠাবে কেন? আপনিই আমাকে কথা দিয়েছিলেন উপযুক্ত সময় তাকে আপনি চীফ বানাবেন; তাই খবরটা জানার পর আমি নিজেই এসেছি স্বেচ্ছায় আপনার কাছ থেকে এ ব্যাপারে জানতে। বেয়াদবী হয়ে থাকলে মাফ করে দেবেন।
-ঠিক আছে বুঝলাম। তুই যা এখন, কিছু লোকজন আইবো।
আমি সালাম জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। পরদিন জেনারেল জিয়াকে সবকিছু জানিয়ে কুমিল্লায় ফিরে এলাম। আমাদের সেদিনের আলোচনার ফলেই হোক কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক জেনারেল জিয়াকে আর বার্মায় যেতে হয়নি। তার জায়গায় পাঠানো হয়েছিল কর্নেল নূরুল ইসলাম শিশুকে। তিনি অত্যন্ত খুশী হয়ে চলে গেলেন বার্মায়। তার খুশী হওয়ার কারণ ছিল। যুদ্ধের সময় হার্টের পালপিটেশনের অযুহাতে রণাঙ্গন ছেড়ে কোলকাতার মুজিবনগর হেডকোয়াটার্স চলে এসেছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হবার কিছুদিন পর তিনি হঠাৎ করে একদিন ২৭নং মিন্টু রোডের হেডকোয়াটার্স থেকে লাপাত্তা হয়ে যান। বেশ কিছুদিন হয়ে গেল তবুও তিনি ফিরলেন না। এতে জেনারেল ওসমানী ভীষণ ক্ষেপে গেলেন। তৎকালীন সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর প্রধান ক্যাপ্টেন সালাহ্‌উদ্দিনকে ডেকে হুকুম দিলেন যেকরেই হোক না কেন deserter শিশুকে খুঁজে বের করে ধরে নিয়ে আসতে। আমরা সবাই জানতাম আর্মিতে আর চাকুরি করতে চাচ্ছেন না শিশু ভাই। কিন্তু জেনারেল ওসমানীও ছাড়বেন না তাকে। সে এক উভয় সংকট অবস্থা। এ কারণেই লাপাত্তা হয়েছিলেন তিনি। যাই হোক অনেক কষ্টে তাকে সবাই মিলে বুঝিয়ে কোনরকমে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। সেই শিশু ভাই পরবর্তিকালে জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনামলে মেজর জেনারেল ইসলাম '‘The Rasputin of Bangladesh’' হয়ে উঠেন। একেই বলে ‘কপালের নাম গোপাল’। বাংলাদেশের রাজপুটিন শিশুর কর্মতৎপরতার পরিণাম কি হয়েছিল সে এক করুণ ইতিহাস। সেক্সপিয়রীয় বিয়োগান্তর নাটকের জুলিয়াস সিজারে পরিণত হয়েছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। যাই হোক, জেনারেল জিয়াকে বাইরে পাঠিয়ে দেবার প্রচেষ্টায় আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম। এ যাত্রায় তিনি রক্ষা পেলেও পরিষ্কার বোঝা গেল সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী চেতনার অধিকারী অংশকে দুর্বল করে তোলার জন্য সরকার ক্ষেপে উঠেছেন। মেজর জলিল, কর্নেল জিয়াউদ্দিন এবং কর্নেল তাহেরকে ইতিমধ্যেই হারিয়েছি এবং আরো অনেককেই হয়তো বা বের করে দেয়া হবে সেনাবাহিনী থেকে কোন না কোন অজুহাতে। বিষয়টি নিয়ে নিজেদের মধ্যে, রাজনৈতিক মহল এবং অন্যান্য ক্ষেত্রের সমমনা লোকদের সাথে আলোচনা হল। প্রায় সবাই একই মত পোষণ করলেন যে, সেনাবাহিনীতে স্বাধীনচেতা দেশপ্রেমিকদের ক্রমান্বয়ে বের করে দিয়ে শুধুমাত্র খয়ের খাঁ, জী হুজুর টাইপের সদস্যদেরকেই রাখা হবে সেনাবাহিনীতে। এরপর এক সময় রক্ষীবাহিনীকে তাদের সাথে একত্রীভূত করে গড়ে তোলা হবে সম্পূর্ণভাবে সরকারের তাবেদার এক সেনাবাহিনী। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম- এখন থেকে যতটুকু সম্ভব এ বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখব।