মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

আওয়ামী-বাকশাল সরকারের ব্যর্থতা সম্পর্কে আর্ন্তজাতিক সংবাদ মাধ্যমগুলোর বক্তব্য কেমন ছিল?

 
   
 

 

বিদেশী সংবাদ মাধ্যমগুলোর প্রতিক্রিয়া জানার জন্য তাদের প্রকাশিত কয়েকটি নিবন্ধ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হল। 

লন্ডন থেকে প্রকাশিত নিউ স্টেটসম্যান পত্রিকায় ২৭শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ এ জনাথন ভিন্নাম্বলম্বী এক প্রতিবেদনে লেখেন, “এমন একদিন ছিল যখন শেখ মুজিব ঢাকার রাস্তায় বের হলে জনসাধারণ হাত তুলে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে মেতে উঠত। আর আজ যখন স্বীয় বাসভবন থেকে তিনি অফিসের দিকে যান তখন চর্তুদিকে থাকে পুলিশের কড়া পাহারা। পথচারীরা সজ্ঞানে তার যাতায়াত উপেক্ষা করে। জাতির পিতাও আর গাড়ির জানালা দিয়ে হাত আন্দোলিত করেন না। তার দৃষ্টি থাকে সামনের দিকে নিবদ্ধ। বাংলাদেশ আজ বিপজ্জনকভাবে অরাজকতার মুখোমুখি। লাখ লাখ লোক ক্ষুধার্ত। হাজার হাজার মানুষ আজ অনাহারে মরছে। মফস্বল এলাকার স্থানীয় কর্মচারীরা ভয় পাচ্ছে যে আগামী মাস খুব দুঃসময় হবে। ক্ষুধার্ত মানুষের ভীড়ে ঢাকায় দম বন্ধ হয়ে আসে। এখন আবার চলছে বন্যা উপদ্রুতদের ভীড়। আগত লোকজনরা এমন নোংরা অবস্থায় থাকে যার তুলনা দুনিয়ার কোথাও নাই। কোথাও বিনামূল্যে কিছু বিতরণ করা হলে শরনার্থীদের মধ্যে মারামারি লেগে যায়। বুদ্ধিজীবিরা বলেন, এই ক্ষুধার্ত জনতা ক্ষেপে গেলে তাদের রক্ষা নেই। বাংলাদেশ আজ দেউলিয়া। গত আঠারো মাসে চালের দাম ৪ গুন বেড়েছে। সরকারি কর্মচারীদের মাইনের সবটুকুই চলে যায় খাদ্যসামগ্রী কিনতে আর গরীবরা থাকে অনাহারে। কিন্তু যতই বিপদ ঘনিয়ে আসছে শেখ মুজিব ততই মনগড়া জগতে আশ্রয় নিচ্ছেন। ভাবছেন দেশের লোক এখনও তাকে ভালোবাসে। সমস্ত মুসিবতের জন্য পাকিস্তানই দায়ী আর বাইরের দুনিয়া তার সাহায্যে এখনো এগিয়ে আসবে এবং বাংলাদেশ উদ্ধার পাবে এ ধরণের ভাবনা তার নিছক দিবাস্বপ্ন। মুজিব সম্পর্কে বরাবরই সন্দেহ ছিল। নেতা হিসাবে আজো তার আকর্ষন রয়েছে। তিনি আবেগপ্রবণ বক্তা। তার অহংকার আছে, সাহস আছে। কিন্তু আজ দেশ যখন বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তখন তিনি দিনের অর্ধেক ভাগ আওয়ামী লীগের চাইঁদের সঙ্গে ঘরোয়া আলাপে কাটাচ্ছেন। যিনি বাংলাদেশের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং বহু ছোট-খাটো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন; তিনি আজ আত্মম্ভরিতার মধ্যে কয়েদী হয়ে চাটুকার ও পরগাছা পরিবেষ্টিত হয়ে আছেন। বাইরের দুনিয়া বাংলাদেশের র্দুনীতির কথা ফলাও করে বলে থাকে। সমাজের নীচুতলায় যারা আছে তারা হয়তো আজ খেতে পেয়েছে কিন্তু কাল কি খাবে জানে না। এমন দেশে দুর্নীতি অপরিহার্য। তবে এমন লোকও আছে যাদের দুর্নীতিবাজ হবার কোন অজুহাত নেই। সদ্য ফুলে ফেঁপে উঠা তরুণ বাঙ্গালীরা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের শরাবখানায় ভীড় জমায়। তারা বেশ ভালোই আছে। এরাই ছিল তথাকথিত ‘মুক্তিযোদ্ধা’। তাদের প্রাধান্য আজ অপরিসীম। রাজনৈতিক দালালী করে এবং ব্যবসায়ীদের পারমিট যোগাড় করে তারা আজ ধনাঢ্য জীবন যাপন করছে। সরকারি কর্মচারীদের ভয় দেখাচ্ছে। নেতাদের উপর প্রভাব বিস্তার করছে এবং প্রয়োজন হলে অস্ত্র প্রয়োগ করছে। এরাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের বাছাই করা পোষ্য। আওয়ামী লীগের উপর তলায় যারা আছেন তারা আরো জঘণ্য। যারা দেশ মুক্ত করেছেন সেই জনসাধারণের মেরুদন্ড ভেঙ্গে তারা আজ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। অবশ্য তাদের অসদুপায়ে অর্জিত অর্থ নিয়ে তারা আজ শুধু নিজেদের কথা ভেবেই শংকিত হয়ে উঠেছে। ভাবছে আগামীকাল তাদের কি হবে? শুনতে রূঢ় হলেও কিসিঞ্জার ঠিক কথাই বলেছেন, ‘বাংলাদেশ একটা তলাবিহীন ভিক্ষার ঝুলি।’ ত্রাসজনক পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষে বিপর্যয়ের মোকাবেলা করা অসম্ভব। আন্তর্জাতিক সমাজ বাংলাদেশের ‘পুতুল সরকার’ সম্পর্কে ধৈর্য্যহারা হয়ে পড়েছে। এই কঠোর সত্যের মুখোমুখি হয়ে রিলিফ কর্মী এবং কূটনৈতিক মিশন ও জাতিসংঘের অফিসাররা বাংলাদেশ সরকার ও সরকার দলীয় লোকজনদেরই দোষারোপ করছেন।”

লন্ডনের ডেইলি মেইল পত্রিকার ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৪ সালে জন পিনজার লেখেন, “পশ্চিম এশিয়ার এবং দুর্ভিক্ষের প্রাচীনতম বিচরণভূমি বাংলাদেশে মহা দুর্ভিক্ষের পূর্ণঃআর্বিভাব ঘটেছে। এত ব্যাপক দুর্ভিক্ষ সম্ভবতঃ অনেককাল দেখা যায়নি। মৃতের কোন নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। এক হিসাব মতে গত জুলাই মাসের বন্যায় সমস্ত ফসল এবং পরবর্তী মৌসুমে বীজ ধান বিনষ্ট হবার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে এবং পাশ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গে কয়েক লাখ লোক মারা গেছে। ঢাকার ‘সেফ দি চিলড্রেন ফান্ড’ এর কো-অর্ডিনেটর মিঃ মাইকেল প্রোসার বলেন, “আমাদের চরম আশংকাই ফলে গেছে। আমরা এমন একটা বিপর্যয়ের সূচনাতে আছি যা আমি এই উপমহাদেশে গত ৩১ বছর দেখিনি। বসন্তের আগে নতুন ফসল উঠবে না। বাইরের দুনিয়া থেকে যদি বাংলাদেশ প্রতি সপ্তাহে ১লাখ টন খাদ্যশস্য ও তদসঙ্গে প্রয়োজনীয় মেডিক্যাল সাহায্য না পায় তবে আমার ভয় হচ্ছে বহু লোকের জীবন বিপন্ন হবে। বস্তুতঃ বাংলাদেশের একটি অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান হচ্ছে এই যে, দেশের সবগুলি হাসপাতাল মিলিয়ে শিশুদের জন্য সর্বমোট ৭৫টি বেড আছে। অর্থাৎ প্রতি ১০ লাখে একটি। মিরপুর শরনার্থী শিবিরের প্রকান্ড লৌহ কপাটের বাইরে বহু নারী ও শিশু ভীড় করে আছে। গেটের সামনে একজন সিপাই পুরনো ৩০৩ রাইফেল হাতে পাহারা দিচ্ছে। তার কাজ আশ্রয়প্রার্থীদের দূরে সরিয়ে রাখা। এসব শরনার্থীদের বেশিরভাগ লোকই এসেছে উত্তরের রংপুর, দিনাজপুর জেলা থেকে। এরা দু’দিন পায়ে হেটে না খেয়ে এসেছে। দেখে মনে হল দু’টো শিশু ছাড়া প্রায় সবগুলো শিশুই বসন্তে আক্রান্ত। এরা এতটাই দুর্বল যে গা থেকে মাছিও তাড়াতে পারে না। এদিকে রিলিফ ক্যাম্পেও তিল ধারণের জায়গা নেই। বরাবর যেমন হয়ে থাকে আমার ক্ষেত্রেও তাই হল। একজন বিদেশী সাংবাদিককে দেখে ক্যাম্পের গেট খুলে দেয়া হল। সুপারিনটেন্ডেন্ট আব্দুস সালাম আমাদের ভিতরে প্রবেশ করার জন্য ঈঙ্গিত দিলেন। আর ওমনি ওরা প্রাণপন ছুটল ভিতর পানে। এ কথা আমি আক্ষরিক অর্থেই বলছি। জনাব সালাম বললেন, ‘এখানে তিন হাজার শরনার্থী আছে। শুক্রবার থেকে ওদের খিচুড়ি দেয়া সম্ভব হবে না। শনিবারে হয়তো আমেরিকান কিছু বিস্কুট পাওয়া যেতে পারে।’ এ দেশে একটি শিশুকে একটু গুঁড়ো দুধ ও একমুঠো দানা দিয়ে বাচিঁয়ে রাখতে মাত্র ২৫ পেন্স খরচ হয়। একটি তিন বছরের শিশু এতো শুকনো যে, মনে হল যেন মায়ের পেটে থাকাকালীন অবস্থায় ফিরে গেছে। আমি তার হাতটা ধরলাম, মনে হল তার চামড়া মোমের মত আমার হাতে লেগে গেল। এই দুর্ভিক্ষের আর একটি ভয়াবহ পরিসংখ্যান এই যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মত ৫০ লাখ মহিলা আজ নগ্ন দেহী। বাচাঁর তাগিদে বস্ত্র বিক্রি করে তারা চাল কিনে খেয়েছে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, আমার গাড়ি ইসলামিক মানবকল্যাণ সমিতি ‘আঞ্জুমান-এ-মফিদুল ইসলাম’ এর লরীর পেছনে পেছনে চলছে। এই সমিতি রোজ ঢাকার রাস্তা থেকে দুর্ভিক্ষের শেষ শিকারটিকে কুড়িয়ে তুলে নেয়। সমিতির ডাইরেক্টর ডঃ আবদুল ওয়াহিদ জানালেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে আমরা হয়তো কয়েকজন ভিখারীর মৃতদেহ কুড়িয়ে থাকি কিন্তু এখন মাসে অন্ততঃ ৬০০ লাশ কুড়াচ্ছি। সবই অনাহারজনিত মৃত্যু।’ লরীটা যখন গোরস্থানে গিয়ে পৌঁছলো ততক্ষণে সাতটি লাশ কুড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে চারটি শিশুর। সব কয়টাই বেওয়ারিশ। লাশগুলো সাদা কাপড়ে মুড়ে সংক্ষিপ্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানের পর গোরস্থানের একপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে গত মাসে দুর্ভিক্ষে যারা মারা গেছে তাদের কবর খুঁড়েই দাফনের জায়গা করা হয়। এ ধরণের দৃশ্য আমি আর কখনো দেখিনি। প্রকৃতি আর মানুষ মিলে যদি কখনো ‘বেলসেন আর অশ’ উৎসবের অসংখ্য কবর নতুন করে রচনা করার চেষ্টা করে থাকে তাহলে তারা এই গোরস্থানে সফল হয়েছে। যতদূর দৃষ্টি যায় শুধু কংকাল আর কংকাল। বোধ করি হাজার হাজার। প্রথমে লক্ষ্য করিনি। পরে বুঝতে পারলাম অধিকাংশই শিশুদের কংকাল।”

‘ভারতীয় আধিপত্যের কবলে বাংলাদেশ’ শিরোনামে লস এঞ্জেলস টাইমস এ প্রকাশিত প্রতিবেদনটি ছিল নিম্নরূপ:-
“ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর বিপুল সহায়তায় স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির তিন বছরের মধ্যেই বাংলাদেশের জনমত ভারতের প্রতি বিরূপ হয়ে গেছে। ভারত ও বাংলাদেশের সরকারি কর্মচারীরা এখনো বলে যে, দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক খুবই আন্তরিক। কিন্তু বেসরকারি অধিকাংশ বাঙ্গালীর মনোভাবে তা প্রতিফলিত হয় না। কোন নিদির্ষ্ট অভিযোগের চেয়ে বহু বাঙ্গালীর অভিযোগ হল এশিয়া মহাদেশে ভারত প্রাধান্য লাভ করার চেষ্টা করেছে এবং শুধু আয়তনের বিশালত্ব দ্বারাই ভারত বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে নিয়ন্ত্রণ ও প্রভাবিত করতে সক্ষম। এই কিছুদিন আগে একজন মাঝারী শ্রেণীর বাংলাদেশী সরকারি কর্মচারী জনৈক বিদেশীকে কৌতুকের ছলে বলেছিলেন, ‘ভারত বলছে পৃথিবীর মধ্যে সেই হচ্ছে বৃহত্তম গণতন্ত্র। তাই যদি হয় তাহলে বাংলাদেশ অবশ্যই পৃথিবীর ক্ষুদ্রতম গণতন্ত্র।’ বেশ কিছু সংখ্যক বাংলাদেশী এখন এই ধারণা পোষণ করেন যে, ১৯৭১ সালের যে যুদ্ধের ফলে বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়েছে তাতে ভারতের প্রধান স্বার্থ ছিল পাকিস্তানকে ভেঙ্গে এই উপমহাদেশে স্বীয় স্বার্থ নিশ্চিত করা। হলিডে পত্রিকার সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ খান বললেন, ‘বাংলাদেশ মূলতঃ একদিকে ভারতীয় সম্প্রসারনবাদ ও অপরদিকে বাঙ্গালীদের ইচ্ছার ফল।’ ভারত সম্পর্কে বাঙ্গালীদের মোহ কেটে গেছে সেটা বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান আভ্যন্তরীন সমস্যারই প্রতিফলন। কিছু বাংলাদেশী মনে করছেন যে, বাংলাদেশের সৃষ্টির জন্য ভারত যেমন প্রধানতঃ দায়ী তেমনি বাংলাদেশের বর্তমান দুদর্শার জন্যও ভারত দায়ী। অত্যন্ত উত্তেজনামূলক যে কয়টি সমস্যা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিরাজমান তার মধ্যে একটি হচ্ছে ভারত সীমান্তের ১২মাইল অভ্যন্তরে গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ। ডিসেম্বর মাসে যখন এই বাঁধ চালু হবে তখন গঙ্গার পানি কোলকাতার পাশ দিয়ে বহমান হুগলী নদী দিয়ে প্রবাহিত হবে। গঙ্গার পানির এই ধারা পরিবর্তনের উদ্দেশ্য হল কোলকাতা বন্দরকে তলানী মুক্ত করা। তলানীর জন্য কোলকাতা বন্দর প্রায় অনাব্য হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশীরা ভয় করছে যে এই পরিবর্তনের ফলে গঙ্গা নদীর নিম্নাংশ যা বাংলাদেশের ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে সে অংশ গ্রীষ্মের মৌসুমে একদম শুকিয়ে যাবে। কিছু বাংলাদেশী এ অভিযোগও করে যে, ভারত সরকার বাংলাদেশ থেকে পাট ও চাল পাচাঁরে উৎসাহ যোগাচ্ছে। ভারতীয় সরকারি কর্মচারীরা স্বীকার করেছেন যে, বাংলাদেশের পাট ও চাউল ভারতে পাঁচার হচ্ছে। বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদেরই উৎসাহ রয়েছে সীমান্তের ওপারে কাচাঁমাল পাচাঁর করার; কেননা সরকারিভাবে বাংলাদেশ ও ভারতীয় মুদ্রার বিনিময় হার এক হলেও কালোবাজারে ভারতীয় মুদ্রার মূল্য বাংলাদেশী মুদ্রার দ্বিগুন। ফলে বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা কাঁচামাল ভারতে পাচাঁর করে যে অর্থ উপার্জন করে সে টাকায় বাংলাদেশে যে সমস্ত জিনিষের অভাব তা ভারত থেকে কিনে এনে দ্বিগুন মুনাফায় বিক্রি করে। ভারতের একটা উদ্বেগের কারণ হচ্ছে চীনের সাথে বাংলাদেশের ভবিষ্যত সম্পর্ক। চীন হচ্ছে ভারতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ভারত কখনো বাংলাদেশকে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে দেবে না। ভারত চায় বাংলাদেশ জোট নিরপেক্ষ থাকবে এবং এমন বৈদেশিক সম্পর্ক গড়ে তুলবে না যা হবে ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী। অন্যান্য পর্যবেক্ষকরা আরো বলেন, ‘যদি বাংলাদেশের উপকূলে তেল পাওয়া যায় তবে ভারত সরাসরি বাংলাদেশের উপকূল দখল করবে।’ ব্যাঙ্গোক্তি করলেন একজন পদস্থ অফিসার, ‘বাংলাদেশের ভাগ্য বাংলাদেশের হাতে নাই’।”

লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলী টেলিগ্রাফ এর ১৯৭৫ সালের ২৭শে জানুয়ারী সংখ্যায় পিটার গিল ‘মুজিব একনায়কত্ব কায়েম করেছেন’ শিরোনামে লেখেন, “বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান তার দেশে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের শেষ চিহ্নটুকু লাথি মেরে ফেলে দিয়েছেন। গত শনিবার ঢাকায় পার্লামেন্টের এক ঘন্টা স্থায়ী অধিবেশনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শেখ মুজিবকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছে এবং একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তাকে ক্ষমতা অর্পন করেছে। অনেকটা নিঃসন্দেহে বলা চলে গণতন্ত্রের কবর দেয়া হয়েছে। বিরোধী দল দাবি করেছিল যে, এ ধরণের ব্যাপক শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের ব্যাপারে আলোচনার জন্য তিন দিন সময় দেয়া উচিত। জবাবে সরকার প্রস্তাব পাশ করল যে এ ব্যাপারে কোন বিতর্ক চলবে না। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় মাস গৃহযুদ্ধের পর বিধ্বস্ত কিন্তু গর্বিত স্বাধীন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিব এমপিদের বলেছেন যে, পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র ছিল ঔপনিবেশিক শাসনের অবদান। কিন্তু বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়নে বৃটিশ বিশেষজ্ঞরাই সাহায্য করেছিলেন। তিনি দেশের স্বাধীন আদালতকে ঔপনিবেশিক ও দ্রুত বিচার ব্যাহতকারী বলে অভিযুক্ত করেন। প্রেসিডেন্ট খেয়ালখুশি মত বিচারক বরখাস্ত করতে পারবেন। নাগরিক অধিকার বিন্দুমাত্রও যদি প্রয়োগ করা হয় তা প্রয়োগ করবে নতুন পার্লামেন্ট কর্তৃক নিযুক্ত স্পেশাল আদালত। এক্সিকিউটিভ অর্ডারের মাধ্যমে একটি জাতীয় দল প্রতিষ্ঠার জন্য নতুন শাসনতন্ত্র মুজিবকে ক্ষমতা প্রদান করেছে। তার গঠিত দলই হবে দেশের একমাত্র বৈধ দল। যদি কোন এমপি যোগদান করতে নারাজ হন অথবা এর বিরুদ্ধে ভোট দেন, তবে তার সদস্যপদ নাকচ হয়ে যাবে।

এহেন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ঢাকায় সমালোচনা বোধগম্য কারণেই চাপা রয়েছে। কিন্তু ৩১৫ সদস্য বিশিষ্ট পার্লামেন্টের ৮জন বিরোধী দলীয় সদস্যের ৫জনই এর প্রতিবাদে সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগের ১১জন সদস্য ভোট দিতে আসেননি। তাদের মধ্যে ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ গেরিলা বাহিনীর নায়ক ও প্রাক্তন মন্ত্রী জেনারেল এম এ জি ওসমানী। শেখ মুজিব ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বেচ্ছাচারিতার সঙ্গে শাসন করতে পারবেন। নতুন শাসনতন্ত্র ১৯৭৩ সালে নির্বাচিত জাতীয় পার্লামেন্টের মেয়াদও ১৯৮০ সাল পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। তবে পার্লামেন্ট বছরে মাত্র দু’বার অল্প সময়ের জন্য বসবে। ভাইস প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও কাউন্সিল অফ মিনিষ্টারস এর মাধ্যমে সরকার পরিচালিত হবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং মনসুর আলীকে যথাক্রমে ভাইস প্রেসিডেন্ট ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট।

বাংলাদেশের ঘনায়মান আর্থিক ও সামাজিক সংকটে বিদেশী পর্যবেক্ষকগণ সন্দেহ করছেন যে, দেশে একনায়কত্বের প্রয়োজন আছে কিংবা শেখ মুজিবের আরো ক্ষমতার প্রয়োজন আছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশে যে নিশ্চিত দুর্ভিক্ষ ও অরাজকতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে শেখ মুজিবের নতুন ম্যান্ডেট তাতে তেমন কোন তারতম্য ঘটাতে পারবে কিনা? এক মাস আগে শেখ মুজিব জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছেন। অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে এবং বামপন্থী গেরিলা নেতা সিরাজ সিকদারকে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই সন্দেহ দেখা দিয়েছে যে, জরুরী আইন প্রয়োগে বিন্দুমাত্র সুশাসন (বর্তমানে সুশাসন বলতে কিছু নেই) পুনঃপ্রতিষ্ঠা আদৌ সম্ভব কিনা? নতুন প্রেসিডেন্টের যে আদৌও প্রশাসনিক দক্ষতা নেই তা গত বছরেই প্রমাণিত হয়েছে। তার ষ্টাইল হচ্ছে ডিকটেটরের স্টাইল। তিনি গুরুত্বহীন বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ দেখান এবং গুটিকয়েক আমলার প্রমোশনে ও তাদের অভিমতকে যথেষ্ট প্রাধান্য দেন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি প্রায়ই ফেলে রাখেন।

একদলীয় শাসন সৃষ্টির ফলে র্দুনীতি দূর না হয়ে বরং বাড়তে থাকবে। কেননা, উদ্ধত আওয়ামী লীগারদের চেক করতে পারবেন একমাত্র প্রেসিডেন্ট। আর তিনি থাকবেন অতিরিক্ত কাজের চাপে সর্বদাই ব্যস্ত। সরকার বিরোধীরা যতই আত্মগোপন করতে বাধ্য হবে ততই গ্রাম-বাংলায় চরমপন্থী গেরিলা ও লুটতরাজকারীদের দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকবে।”

ফার ইর্ষ্টাণ ইকোনমিক রিভিউ-এর ১৯৭৫ সালের ১৪ই মার্চ সংখ্যায় হার্ডি ষ্টক উইল লেখেন, “আরেকটি এশীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হল। আরো একবার অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে গণতন্ত্রকে ঝেটিয়ে বিদায় দেয়া হয়েছে। বৃটিশ শাসনের অবসানের পর এই দ্বিতীয়বার বাংলাদেশের জনগণের জন্য গণতন্ত্র অনুপযোগী বিবেচিত হয়েছে। ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খানের বিদেহী আত্মা নিশ্চয়ই স্মিতহাস্যে মৃদুস্বরে বলছে, ‘আমি তোমাদের বলেছিলাম ......।’

১৯৫৮ সালে আইয়ূব কর্তৃক ক্ষমতা জবরদখল গণতন্ত্র বিরোধী ছিল। তিনি নেতৃত্বের অভাব লক্ষ্য করেছিলেন এবং জাতীয় জীবনে যোগ্যব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানিক শূন্যতা পূরণ করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। ১৯৭৫ সালে সেই পটভূমি আদৌ নেই। শেখ আগেও বাংলাদেশের একমাত্র মুখ্য নেতা ছিলেন, এখনো আছেন। যে সময় তিনি আইয়ূবের রূপ পরিগ্রহ করেন তখন গণতন্ত্রে এমন কাটছাট হয়ে গিয়েছিল যে, তার ক্ষমতার অভাব ছিল এ কথা তিনি আদৌ বলতে পারতেন না। আইয়ূবের মত সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে জড়িত না করলেও সদ্য গঠিত একমাত্র জাতীয় দলে কয়েকজন সামরিক চাইকে কোঅপ্ট করে নেয়ার কৌশল গ্রহণ করেন তিনি। দ্বিতীয় বিপ্লবের আগেও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সশস্ত্র বাহিনীকে ঠেঙ্গারে বাহিনী হিসেবে প্রয়োগ করার ক্ষমতার অধিকারী ছিল শেখ মুজিব। কেননা, সামরিক বাহিনীর কায়দায় গঠিত এবং মুজিবের ব্যক্তিগত বাহিনী বলে সাধারণভাবে পরিচিত রক্ষীবাহিনীকে বরাবরই অপ্রীতিকর কার্য সম্পাদনে নিয়োজিত করা হত নির্বিচারে। দাঙ্গা বিক্ষোভ দমন করা এবং সন্ত্রাসবাদী ও বিদ্রোহীদের মোকাবেলা করা এগুলোও ছিল রক্ষীবাহিনীর কাজ। ‘নীতি প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমন’ একচ্ছত্র ক্ষমতা গ্রহণের মামুলি অজুহাত মাত্র। আইয়ূব ও মুজিবের ক্ষমতা দখলে পার্থক্য রয়েছে। আইয়ূব ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন জাদরেল পাচাঁরকারী ও কালোবাজারীকে পাকড়াও করেছিলেন। এতে সারা পাকিস্তানে বৈদ্যুতিক প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। গোটা দেশে চালের দামও কমে গিয়েছিল। পরে অবশ্য দুর্নীতি আবার দেখা দেয়। এমনকি আইয়ূবের আত্মীয়-স্বজনরাও এতে জড়িয়ে পড়ে। বস্তুতঃ ‘দ্বিতীয় বিপ্লবের’ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতিক্রিয়া এত সামান্য যে চাউলের দাম বেড়েই চলেছে। ‘শোষিতের গণতন্ত্র’-কে কোন সুযোগ না দিতে অনিচ্ছুক আইয়ূব-মুজিব চরিত্রের সাদৃশ্য সঠিকভাবে ফুটে উঠেছে জনৈক মধ্যবিত্ত শ্রেণীর এক বুদ্ধিজীবির মন্তব্যে। তিনি বলেন,‘আইয়ূব যে ভুল করেছিলেন শেখও ঠিক সেই ভুলই করছেন। আইয়ূব বিশ্বাস করতেন যে জনসাধারণ কেবলমাত্র অর্থেনৈতিক উন্নতিই চায়। তাই তিনি মানবাধিকারের বিনিময়ে অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পেছনে ছুটলেন। এর ফলেই মুজিব আন্দোলনের মওকা পেয়ে গেলেন। শেখ সে কথা ভুলে গেছেন অথবা ভাবেন তিনি তা ভুলে যেতে পারেন।’ বৃটিশ আমলে প্রশাসনিক দিক দিয়ে পূর্ববঙ্গ ছিল উপেক্ষিত। দেশ বিভাগের সময় ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে বাঙ্গালীর সংখ্যা এক হাতের আঙ্গুলে গোনা যেত। ফলে পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের আমদানি হল। বাংলাদেশীরাও আজ খোলাখুলি স্বীকার করছেন যে, স্বাধীনতার পর কয়েকটি অত্যাবশ্যক সার্ভিসের বিশেষ করে রেলওয়ে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি ঘটেছে। আগে প্রধানতঃ বিহারীরাই এসব সার্ভিস চালাতো। এখন ওরা আর চাকুরিতে নেই। 

কোন কোন দেশে ব্যক্তি স্বাধীনতা বিরোধী শাসন পদ্ধতি অধিকতর কার্যদক্ষতা অর্জন করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে তা সম্ভব হবে কি না গভীর সন্দেহ রয়েছে। রাজনৈতিক দিক দিয়ে বাংলাদেশের নতুন শাসন পদ্ধতি সবকিছু প্রেসিডেন্টের হাতে অতিরিক্ত মাত্রায় কেন্দ্রীভূত করে চলেছে। সুকার্নো পাশ্চাত্য সাহায্যকারী দেশগুলোকে তীব্র র্ভৎসনা করেছিলেন। ইলাষ্ট্রেটেড উইকলি অফ ইন্ডিয়ার সাথে এক সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে শেখও অনূরূপভাবে পশ্চিমা জগতের সংবাদপত্রগুলোকে ঘা মেরেছেন। ‘বাংলাদেশ ধ্বসে পড়বে’ বিদেশী পত্রিকার এ ধরণের ভবিষ্যতবাণী সম্পর্কে তার অভিমত জানতে চাইলে শেখ জবাব দেন, ‘তাদের গোল্লায় যেতে বলে দিন। আমার শাসন নয়, তাদেরই বুদ্ধিমত্তা ধ্বসে পড়বে। পাশ্চাত্যের সংবাদপত্রগুলি শুধু সমালোচনা করছে আর উপদেশ দিচ্ছে। ১৯৭১ সালেও তারা তাই করেছিল। এখনো আবার করছে।’ এই উক্তিগুলো কৌতুহলজনক। কেননা, মুক্তি সংগ্রামের সময় বিদেশী সংবাদপত্রের ভূমিকা বাংলাদেশ এখনও পর্যন্ত প্রশংসাই করে এসেছে।”

 
 
 
     
     
  Design & Developed By: Hemu
All Rights Reserved 2008 @www.majordalimbangla.net