মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
.. জিয়া   থেকে   খালেদা   অতঃপর
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 
আব্বা আপনাকে সালাম
 
   

মরহুম আলহাজ্ব শামছুল হক আমাদের শ্রদ্ধেয় আব্বাজান ঢাকার কেরানীগঞ্জে এক বর্ধিষ্ণু শিক্ষিত পরিবারে বিশের দশকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমার দাদা আলহাজ্ব মৌলভী শরাফত আলী আমাদের এলাকায় আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম গ্রাজুয়েট।

আব্বা মেধাবী ছাত্র হিসেবে বৃত্তি পেয়ে পড়াশুনা করেছেন স্কুল জীবন থেকেই। স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি জীবনে ডিবেট, খেলাধুলায় যথেষ্ট নাম ছিল তার। ছাত্র জীবনেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। ১৯৪৪-৪৬ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের সাধারণ সম্পাদকের পদে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পূর্ব বাংলার মুসলমান ছাত্র সমাজ ঐতিহ্যগত কারণেই পাকিস্তানের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিল। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে আব্বা সরকারি চাকুরীতে যোগ দেন। দেশ বিভক্তির পর ১৯৪৭ সাল থেকেই ফিশারিজ ডিপার্টমেন্টের একজন প্রতিষ্ঠাতা কর্মকর্তা হিসাবে ঐ ডিপার্টমেন্ট এর সাংগঠনিক দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন তিনি।

ধর্মীয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আব্বা। তাই স্বাভাবিক কারণেই ধর্মের প্রতি অটল বিশ্বাস গড়ে উঠেছিল তার ছোটকাল থেকেই। ধর্মীয় বিষয়ে প্রচুর জ্ঞানের অধিকারী হয়েছিলেন বিস্তর পড়াশুনা করে। কিন্তু ধর্মীয় গোড়ামি তাকে স্পর্শ করতে পারেনি কখনো। ৭/৮ বছর বয়স থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এক ওয়াক্ত নামাজ কাজা করেননি তিনি। ইসলামী জীবনাদর্শকে সার্বজনীনভাবে গ্রহণ করেছিলেন আব্বা। জীবন সর্ম্পকে তার দৃষ্টিভঙ্গী ছিল অতি আধুনিক ও যুক্তিসঙ্গত। বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকে তিনি আল্লাহ্‌র অসীম নিয়ামত মনে করতেন। অত্যন্ত স্পর্শকাতর উদারপন্থী এবং জনদরদী ছিলেন আব্বা। জীবনের সব অবস্থানে থাকাকালীন অবস্থায় মানুষের কল্যানার্থে বিশেষ করে আমাদের এলাকার অনগ্রসর জনসমষ্টির কল্যান প্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন আমার দাদা এবং আব্বা। তাদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য আজীবন সচেষ্ট থেকেছেন তারা নিঃসার্থভাবে। তাদের প্রচেষ্টায় আমাদের এলাকার প্রায় প্রতিটি পরিবার কোন না কোনভাবে উপকৃত হয়েছে। আব্বার দ্বার অবারিত থাকত সবার জন্য। গ্রামের সবাই তাদের সুখ-দুঃখে তার শরণাপন্ন হতে পারতো র্নিদ্ধিধায়। সরকারি পদস্থ অফিসার হয়েও জাতীয় রাজনীতি সম্পর্কে তিনি ছিলেন সর্বদাই সচেতন। ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে জড়িত তৎকালিন প্রথম সারির ছাত্রনেতা জনাব সাদেক খান, আলাউদ্দিন আল আজাদসহ আরো অনেকেই হুলিয়া, পুলিশি নির্যাতন ও হয়রানির হাত থেকে বাচাঁর জন্য আমাদের মালিবাগের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে লুকিয়ে থেকেছেন মাসের পর মাস। তাদের সংগ্রামে আব্বা ও আম্মাকে দেখেছি বিভিন্নভাবে সাহায্য করতে। সেকালে পদস্থ একজন সরকারি চাকুরের জন্য এ ধরণের কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকা ছিল অত্যন্ত ঝুকিঁপূর্ণ।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথমার্ধে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে আমি মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি। আমার ছোট ভাই কামরুল হক (স্বপন) বীর বিক্রম ছাত্রাবস্থায় যোগ দেয় স্বাধীনতা সংগ্রামে। আমাদের দুই ভাইয়ের দেশদ্রোহিতার খেসারত দিতে হয়েছিল আব্বাকে। নানাভাবে তাকে হেস্তনেস্ত করা হয়েছিল। কিন্তু সমস্ত কিছুই মুখবুঝে সহ্য করেছিলেন আব্বা। ক্যান্টনমেন্টের সামরিক কর্মকর্তাদের মোকাবেলা করেছিলেন অতি সাহসিকতার সাথে। আমাদের মালিবাগের বাসা তখন ঢাকা শহরে মুক্তিফৌজদের একটি বিশেষ ঘাঁটি ও অস্ত্রাগার। কিন্তু দৃঢ় চরিত্রের আব্বার কাছ থেকে এ সমস্ত ব্যাপারে খানসেনারা কোন তথ্যই সংগ্রহ করতে পারেনি। তার প্রতিজ্ঞায় তিনি অটল। চাপের মুখে মচ্‌কাবেন না কখনও, এতে মৃত্যু হয় হউক। আমার কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি জবাব দিতেন, “আমার ছেলে পশ্চিম পাকিস্তানে চাকুরী করছে সেটাই আমি জানি। তোমাদেরই বলা উচিত সে কোথায় এবং কি অবস্থায় আছে? ওর সম্পর্কে আমাকে প্রশ্ন করছো কোন যৌক্তিকতায়?” স্বপন সম্পর্কে আব্বা বলতেন, “স্বপন সাবালক। তার গতিবিধির উপর আমার কোন নিয়ন্ত্রন নেই।” তবুও শেষ রক্ষা হল না। আমাদের পরিবারের উপর বিপর্যয় নেমে এল।

২৯শে আগষ্ট ১৯৭১। কিছুদিন যাবত বেশ বৃষ্টি হচ্ছে। রাজধানী ঢাকায় স্বপনদের গেরিলা তৎপরতা বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে। একের পর এক গুলবাগ পাওয়ার ষ্টেশন, ফার্মগেট অপারেশন, যাত্রাবাড়ি অপারেশন, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে বিষ্ফোরন, সিদ্ধিরগঞ্জ অপারেশন ও গ্রীণরোডের সাড়া জাগানো অপারেশনের ফলে স্বপনরা খানসেনাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছে।

এই অবস্থায় আরো বড় আকারের অপারেশন পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ওরা। এর জন্য সাচো মানে বিচিত্রার শাহদাত চৌধুরী ও আলমকে পাঠানো হয়েছে মেলাঘরে মেজর খালেদ ও ক্যাপ্টেন হায়দারকে বুঝিয়ে রাজি করে কিছু ভারী হাতিয়ার ও বেশি পরিমাণে এক্সপ্লোসিভ আনার জন্য। ওরা ফিরে না আসা পর্যন্ত স্বপনরা সবাই যাত্রাবাড়ি বেই্‌সক্যাম্প-এ অবস্থান করবে এটাই ঠিক করা হয়। বেই্‌সক্যাম্প-এ যাবার আগের রাত মানে ২৯শে আগষ্ট ওরা সবাই যার যার পরিবারের সাথে রাত্রি কাটাবার সিদ্ধান্ত নেয়।

কাজি, সামাদ, জুয়েল, আজাদ, রুমি ওরা সবাই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সে রাতে যার যার বাসায় অবস্থান করছে। স্বপনও এসেছে মালিবাগে রাত কাটাতে। স্বপনের আসার খবর পেয়ে আমার দুই ফুফাতো বোন বুলু ও মুন্নিও এসেছে আমাদের বাসায় মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনার নেশায়।

সেদিন দুপুরেই জনাব জিল্লুর রহমানের (বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাধারণ  সম্পাদক) শ্যালক ফরিদের বিশ্বাসঘাতকতায় বদি ফরিদদের বাসা থেকে অপ্রত্যাশিতভাবে গ্রেফতার হয়ে যায়। ধরা পরে সামাদও। এ খবর বাকি কেউই জানতে পারেনি। ওদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে খানসেনারা জানতে পারে সে রাতে দলের সবাই যার যার বাড়িতে রাত কাটাবার সিদ্ধান্ত। 

স্বাধীন বাংলাদেশের নব্য মীরজাফদের জ্বলন্ত উদাহরণ- ফরিদ। তার ন্যক্কারজনক বিশ্বাসঘাতকতায় আল্লাহর আরশও কেপে উঠেছিল। স্বাধীনতার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অত্যধিক মদ্যপান এবং উঃশৃঙ্খলতার জন্য অতি করুণভাবে মৃত্যু ঘটেছিল ফরিদের।

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। বিকেল থেকেই বৃষ্টি ঝড়ছে একনাগাড়ে। বাসার লনে পানি জমে গেছে। সবার সাথে গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গেছে। আব্বা বললেন, “রাত অনেক হয়েছে। স্বপনকে বিশ্রাম করতে দাও।” সবাই আব্বার আদেশে শুতে চলে গেল। স্বপন তার নিজের ঘরে না গিয়ে ড্রইং রুমে কি কারণে কার্পেটেই শুয়ে পড়ল। রাত প্রায় ১টা কি ২টা হবে হঠাৎ ভারী জুতোর আওয়াজে আব্বার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আন্টিও জেগে উঠলেন। বাড়ির চারদিকে কারা যেন হেটে বেড়াচ্ছে। জানালার পর্দা ফাঁক করে আব্বা দেখলেন পুরো বাড়ি আর্মিতে ভরা। মুহুর্তে তিনি বুঝতে পারলেন, বাড়ি রেইড করা হয়েছে স্বপনকে ধরার জন্য। তিনি আন্টিকে বললেন, “জলদি স্বপনকে জাগিয়ে তাকে বের করার বন্দোবস্ত কর। আমি যতক্ষণ পারি ওদের বাসার ভেতর প্রবেশ পথে বাধাঁর সৃষ্টি করছি।” তড়িৎ গতিতে আন্টি ড্রইং রুমে ছুটে গেলেন। ইতিমধ্যে দরজায় মুহুমুহু আঘাত পড়তে শুরু করেছে, কেউ একজন চিৎকার করে বলছে - “দরওয়াজা খোলো”। হৈচৈ শুনে স্বপনও জেগে উঠেছে। অবস্থার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় স্বপন বিছানায় বসে ভাবছে কি করা উচিত? আন্টি এসে জানালো আর্মি রেইড করেছে। সারা বাড়ি ছেয়ে গেছে খানসেনায়। তিনি স্বপনের হাত ধরে তার বেডরুমের এটাচড বাথরুম এর পেছনের দরজা খুলে দিয়ে বললেন, “পালিয়ে যাও।”

স্বপনের পরনে লুঙ্গি আর গায়ে লাল কুর্তা। এক মুহুর্তের ইতঃস্ততা। স্বপন ভাবলো সে পালিয়ে গেলে বাড়ির অন্য সবার কি হবে? আন্টি তার মনের কথা বুঝি বুঝতে পারলেন! বললেন, “পালিয়ে যাও। আমরা ম্যানেজ করব।” তার কথায় স্বপন এক দৌড়ে পাচিঁল টপকে অন্ধকারে মিশে গেল। তাকে পালাতে দেখে আর্মি এলোপাথারী ফায়ারিং শুরু করল। কিন্তু স্বপন গুলি ও খানসেনাদের বেষ্টনী ভেদ করে অন্ধকারে বাসার পেছনের বস্তিতে পালিয়ে যেতে পেরেছে ততক্ষণে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

স্বপনের চলে যাবার পর আব্বা দরজা খুলে দিলেন। ঢুকল একজন ক্যাপ্টেন ও কয়েকজন বন্দুকধারী খানসেনা। ভেতরে ঢুকেই ক্ষুধার্ত হায়নার মত প্রতিটি ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাবার চেষ্টা করল স্বপনকে। কিন্তু কোথাও নেই স্বপন! এটা কি করে সম্ভব!
-স্বপন কিধার হ্যায়? রাগে ফেটে পড়ল একজন। আব্বা বললেন,
-স্বপন এখানে নেই।
-ও লাল কুর্তাওয়ালা কোউন থা? প্রশ্ন আবার।
-কোউন লাল কুর্তাওয়ালা? পাল্টা প্রশ্ন করলেন আব্বা।
-ওহি যো ভাগগিয়া। চুপ করে রইলেন আব্বা।
-ওহি স্বপন থা। বলল একজন। কে একজন হঠাৎ আন্টিকে দেখিয়ে বলে উঠল,
-ইয়ে অওরাত উস্‌ লাল কুর্তাওয়ালাকো ভাগা দিয়া।
-কিউ ভাগা দিয়া তুমনে উস্‌কো? ও কোন থা? তার হুংকারে সবাই ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু আন্টি ঘাবড়ালেন না এতটুকু।
-ও মেরা ল্যারকা থা। আগার উস্‌কো ভাগা দিয়া তো মা হোকে ম্যায়নে ঠিকই কিয়া। আন্টির এই জবাব শুনে থমকে গেল সবাই। সাহস কত মেয়ে লোকটার! বলছে কিনা ভাগিয়ে দিয়ে ঠিকই করেছে। হঠাৎ ক্যাপ্টেন ড্রইংরুমে ষ্ট্যান্ড এ রাখা আমার ইউনিফর্ম পরিহিত একটি ছবি তুলে নিয়ে আব্বাকে বলল,
-এটা কার ছবি? আব্বা বললেন,
-আমার বড় ছেলের। মুহুর্তে সমস্ত অবস্থাই গেল পাল্টে। ক্যাপ্টেন ঘর থেকে সমস্ত খানসেনাদের বাইরে যাবার হুকুম দিল। সবাই চলে গেলে ও আব্বাকে বলল,
-চাচাজান, শরিফ অর ম্যায় কোর্সমেট হু। PMA মে একই কোম্পানী মে থে হাম দোনো। মুঝে পাতা নেহি থা স্বপন উস্‌কা ভাই হ্যায়। যো হোগিয়া ওতো হোগিয়া। লেকিন আব আপ বেফিকির রাহিয়ে। আপ লোকগো কুচ নেহি হোগা। লেকিন চাচাজান আপ অর বাকি male members of the house কো মেরা সাথ ক্যান্টনমেন্ট যানা পারেগা।
একথা শুনে আমার বোনেরা সবাই ডুকরে কেঁদে উঠল। ক্যান্টনমেন্ট যাওয়া মানে নির্ঘাত মৃত্যু। তাদের শান্তনা দিয়ে ক্যাপ্টেন কাইউম কেয়া, মহুয়াদের বলল,
-বেহেনা রোনা নেহি, রোও মাত। চাচাজানকো কুচ নেহি হোগা; ম্যায় ওয়াদা কারতাহু। লেকিন উন্‌কো লেযানা বহুত জরুরী হ্যায়। সবাই বুঝলো এ ব্যাপারে আর কিছুই করার নেই। কাইউম আব্বা ও অন্যান্য পুরুষদের সবাইকে নিয়ে চলে গেল।

ক্যান্টনমেন্টে গোয়েন্দা বিভাগের কর্নেল তাজ ও কর্নেল হেজাজী অধীর অপেক্ষায় ছিলেন। কাইউম পৌছাতেই প্রশ্ন করলেন,
-স্বপন কিধার হ্যায়? ক্যাপ্টেন কাইউম জবাব দিল,
-স্বপন মিলা নেহি।
- what? গর্জে উঠলেন কর্নেল তাজ।
-স্বপন ঘরপর নেহি থা। কাইউম মিথ্যে জবাব দিল। বন্দি সবার দিকে চোখ ঘুরিয়ে কর্নেল হেজাজী ক্যাপ্টেন কাইউমকে বলল,

-Where are the daughters? Why did you not bring them?

-Well, that was not my order Sir. জবাব দিল কাইউম।
- Go and get them all. হুকুম দিলেন কর্নেল তাজ। আব্বা নিশ্চুপ দাড়িয়ে সবকিছুই দেখছিলেন ও শুনছিলেন। প্রমাদ গুনলেন তিনি। এখন কি হবে? কি করে মেয়েদের বাচাঁনো যায়। তার কিছুই করার ক্ষমতা নেই। অসহায় আব্বার দু’চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছিল। মনে মনে আল্লাহর স্মরনাপন্ন হলেন তিনি। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত ঘটল। ক্যাপ্টেন কাইউম কর্নেল তাজকে লক্ষ্য করে দৃঢ়তার সাথে বলে উঠল,

-Sir I can’t do this job. Please send somebody else.

-You are disobeying order.  গর্জে উঠে রাগে ফেটে পড়লেন কর্নেল তাজ।
-Well, in whatever way you may take it, I can’t go to get the daughters. I am sorry sir.  বলল কাইউম। কথা কাটাকাটি চরমে পৌছার আগেই কর্নেল হেজাজী বলে উঠলেন,
-Nevermind, Taj we shall find someone else to do the job, that’s no problem. তাজের কথার জবাব দিয়ে বিদায় নিয়ে ক্যাপ্টেন কাইউম ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বেরিয়ে গিয়েই ফোন করে বাসায় জানিয়ে দিল খানসেনারা আসছে মেয়েদের ধরে নিয়ে যেতে। অতএব কালবিলম্ব না করে সবাই যেন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। কাইউমের কাছ থেকে টেলিফোন পেয়ে সেই মুহুর্তেই বাড়ির সবাই পালিয়ে গেল।

ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আর্মির দুই ট্রাক ভর্তি সৈন্য এল মালিবাগের বাসায়। কিন্তু বাসায় তখন কেউই নেই। কাউকে না পেয়ে তারা সমস্ত বাড়ি লুট করে ফিরে গেল। গাড়ি থেকে শুরু করে জানালার পর্দা পর্যন্ত কিছুই বাদ পরলো না। ঝাড়বাতিগুলো পর্যন্ত খুলে নিয়ে গিয়েছিল তারা। যা কিছু নেয়া সম্ভব হয়নি সেগুলো ভেঙ্গেচুড়ে আক্রোশ মিটিয়ে নিয়েছিল হিংস্র হায়নার দল।

কিন্তু পাকিস্তান আর্মির সবাই একরকম ছিল না। ক্যাপ্টেন কাইউমের বিবেকের তাড়না ও মানবিক চেতনা বাচিঁয়ে দিয়েছিল আমার মা-বোনদের ইজ্জত। তার বন্ধুত্বের এ ঋণ শোধ দেবার সুযোগ হয়ত কখনোই পাব না আমি। তবে আল্লাহ্‌পাকের কাছে আমরা সবাই সর্বদাই দোয়া করি, “আল্লাহ যেন তাকে এবং তার পরিবারকে হেফাজতে রেখে তাদের মঙ্গল করেন।” ক্যাপ্টেন কাইউম যেখানে যে অবস্থাতে থাকুক না কেন তার প্রতি আমার ও আমার পরিবারের প্রতিটি সদস্যের দোয়া থাকবে আজীবন।

মানুষের প্রতি আব্বার আন্তরিক বাৎসল্য ও সেবার প্রতিদান আমাদের এলাকাবাসী দিয়েছিল প্রতিদানে। ১৯৭৯ সালে তৎকালিন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সবিশেষ অনুরোধে তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন। কেরানীগঞ্জ থেকে সংসদ প্রার্থী হয়ে নির্বাচনেও অংশগ্রহণ করেন। তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের মত দলও তাদের প্রার্থী প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়েছিল নিজেদের মুখ বাচাঁবার জন্য। নির্বাচনের কয়েকদিন আগে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। হাসপাতালে অসুস্থ অবস্থায় থাকাকালীন সময় সংগঠিত হয়েছিল নির্বাচন। কোনপ্রকার নির্বাচনী প্রচারণা ছাড়াই তিনি কেরানীগঞ্জ থেকে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হন। ব্যাক্তিগতভাবে তিনি সর্বোচ্চ ভোটে জয়ী হয়েছিলেন।

বাংলাদেশের মানুষ গরীব হতে পারে; তারা অশিক্ষিত হতে পারে কিন্তু তারা অবশ্যই সচেতন। সত্যা-মিথ্যার যাচাঁই তারা অবশ্যই করতে পারে। যারা তাদের অবহেলা করে অবজ্ঞাভরে বলে বেড়ায় - বাংলাদেশের মানুষ অসৎ কিংবা পচেঁ গেছে তারা অবশ্যই গণমানুষের কথা বলে না। কারণ আপামর জনসাধারণের সাথে তাদের কোন সম্পর্কই নেই। তারা বলে থাকে পরিবেষ্টিত টাউট-বাটপারদের, ফরিয়া-দালালদের কথা। এরা সবাই সমাজের পরগাছা। স্বর্ণলতিকার মত সমাজের উচুস্তরে অবস্থিত এ সমস্ত পরগাছাদের জঞ্জাল সমূলে উৎপাটন করে সুস্থ ও সমৃদ্ধ জাতি এবং দেশ গড়ে তোলাই আজ আমাদের প্রতিটি সচেতন দেশপ্রেমিক নাগরিকের পবিত্র দায়িত্ব। আমাদের এ দায়িত্ব নিঃস্বার্থহীনভাবে যেকোন ঝুঁকির বিনিময়ে কতটুকু করতে পারব তার উপরেই নির্ভর করবে আমাদের আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যত। এ কঠিন বাস্তবতার কোন বিকল্প নেই।