মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

চীনাজোক কড়চা

 
   

অনেক যুগ আগে গ্রীক সম্রাট আলেকজান্ডার এই উপমহাদেশ আক্রমন করলে শাসককুল যখন বিনা যুদ্ধে বশ্যতা স্বীকার করে তার কৃপা ভিক্ষা করে নিজেদের শৌর্য্য-বির্যের পরিচয় দিয়েছিল তখন বীর সম্রাট স্তম্ভিত হয়ে আক্ষেপ এবং বিরক্তি প্রকাশ করে বলেছিলেন, “বিচিত্র এই দেশ!”

বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনের গুঞ্জন শুনে তার সেই ক্ষেদ উক্তিই মনে পড়ছে। প্রেক্ষাপট তথাকথিত বিত্তশালী সমাজের থুড়ি! সুশীল সমাজের রথি-মহারথিদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা কতগুলো শব্দ। প্রথমতঃ তৃতীয় শক্তি পরে থুক্কু দিয়ে ভিন্ন ধারা ইত্যাদি। যদিও পরিষ্কার করে বলা হচ্ছে না বর্তমান শক্তিসমূহ এবং ধারা থেকে তারা কী ভাবে ভিন্ন। বলবেই বা কি করে? চলমান রাজনীতিতে যে শক্তি কিংবা ধারাতেই যারা আজ বিরাজমান তারা এবং তাদের নাটের গুরুরাতো সবাই একই গোত্রীয়। তবে কেন হৈচৈ করা হচ্ছে ঐ সমস্ত বিভাজনমূলক শব্দগুলোকে নিয়ে? উদ্দেশ্য অতি পরিষ্কার; নতুন আঙ্গিকে সমগোত্রীয়দের হাতে রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার কৌশল হিসাবেই উচ্চারিত হচ্ছে ঐ সমস্ত শব্দগুলো। পাঠককুলের সুবিধার্থে একটু খোলসা করেই বলি।
 
দেশের স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই যে সমস্ত শক্তি ও ধারা ক্ষমতায় থেকে জাতীয় সম্পদ চুষে জনগণের  জীবন র্দুবিষহ করে তুলেছে, পুরো দেশকে করে ফেলেছে খোকলা এবং জাতিকে করে তুলেছে বিত্তহীন; তারা আজ জনসম্মুখে চীনাজোক হিসাবেই পরিচিত। দীর্ঘ ৩৫ বৎসর লাগাতার শোষণের ফলে এই শাসককুল গায়ে গতরে এতটাই ফুলে ফেঁপে উঠেছে যে ক্ষমতার নেশায় আজ তারা নিজেদের ভারসাম্যতা হারিয়ে ফেলেছে। বিচার বিশ্লেষনের চিন্তাশক্তিও লোপ পেয়েছে তাদের। তাই আজ বাস্তবতাকে অনুধাবন করতে ব্যর্থ হচ্ছে ক্ষমতাভোগী চীনাজোক পরিবার। স্বাধীনতার পর থেকে শেখ মুজিবকে সামনে রেখে দেশকে চুষে আসছে আওয়ামী লীগ; আর জিয়ার ভাঙ্গা স্যুটকেস এর তামাশা করে বি.এন.পির নেতা-নেত্রী-কর্মীরা হয়ে উঠেছে উঠতি শিল্পপতি ও নব্য পুঁজিপতি। শুধুমাত্র নেতা-নেত্রীরাই নয়; তাদের পরিবারের সব সদস্যই চীনাজোকের কাতারে আজ একইভাবে সামিল। এই সত্য আজ দিবালোকের মতই পরিষ্কার। হাতির দুই দাত দেখিয়ে সবকিছু সাবাড় করে দেয়ার মতই পুরো ব্যাপারটা। জাতীয় পার্টি প্রধাণের চরিত্রহীনতা এবং দুর্নীতি সর্বজনবিধিত বিধায় এই দলটি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা নিঃপ্রয়োজন।
 
জনসম্মুখে আজ দেশীয় রাজনীতির মূলধারার সবকয়টি দলই নিজেদের প্রমাণ করেছে মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এই দুঃসময়ে ক্ষমতাভোগীদের কয়েকজন ময়দানে পৈতা ছেড়ে গিরগিটির মতো ভোল পাল্টাবার প্রচেষ্টায় মাঠে নেমেছে গোষ্ঠিস্বার্থ রক্ষার তাগিদে। পৈতা ছাড়লেও তারাতো সবাই চেনা বামুন। তারাই কপচাচ্ছে ঐ শব্দগুলো - যদি জনগণকে মাদারীর তামাশায় আবারও বোকা বানানো যায়! আশ্চর্য্য স্পর্ধা আর প্রত্যাশা! গিরগিটিরা আওয়াজ তুলেছে সুশীল সমাজের!!

বাংলাদেশে সুশীল সমাজের পরিচয়টা কি? অবস্থানটাই বা কোথায়? যদি বারিধারা, গুলশান, ধানমন্ডি, বনানী, উত্তরাসহ দেশের অন্যান্য অভিজাত পাড়ার অধিবাসীদের বোঝানো হয় তবে বলতে কোন কুন্ঠা নেই যে, স্বাধীনতার পর থেকে আজঅব্দি যারা হাটি হাটি পা পা করে ঐ সমস্ত অভিজাত এলাকায় এসে জাঁকিয়ে বসেছে কে তারা? কি তাদের পরিচয়? এদের সিংহভাগই তো ক্ষমতাভোগী গোষ্ঠির সদস্য। ক্ষমতার হালুয়ারুটি ভাগবাটোয়ারার মাধ্যমেই তো ঐসব চীনাজোকেরা হঠাৎ করে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে বিত্তশালী সমাজপতি রূপে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। এরাইতো আজ ধোপদুরস্ত পোষাকের আবরণে কেতারদুরস্ত হয়ে তথাকথিত সুশীল সমাজের মাথা সেজে বসেছে। তাদের নিরিখে ‘বোকা জনগণ’কিন্তু আজ আর ততটা বোকা নন। তথ্য প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতির ফলে তারা বর্তমানে ঠিকই বুঝতে পারছেন বর্ণচোরাদের ভোল পাল্টানোর জারিজুরী।

ঐ সমস্ত বক্তাদের দুই মহারথী হলেন ডঃ কামাল হোসেন এবং বি.চৌধুরি। এদের অতীতের দিকে একটু দৃষ্টিপাত করলেই সবকিছু আয়নার মতোই সাফ হয়ে যায়। ফোর্ড ফাউন্ডেসনের ভাড়া করা কয়েকজন মার্কিন অর্থবিদের ৬ দফা প্রণয়নে জোগালীর ভূমিকা পালনকারী এই ডঃ কামাল হোসেন মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই পশ্চিম পাকিস্তানে শ্বশুর বাড়িতে জামাই আদরে পুরো ৯টি মাস কাটিয়ে স্বাধীনতার পর বসন্তের কোকিল হয়ে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। দেশে ফিরে ভারতীয় সরকারের চাপিয়ে দেয়া ভারতীয় সংবিধানের ৪টি নীতিকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের চার স্তম্ভে রূপান্তরিত করার কাজটি শেখ মুজিবের নির্দেশে অতি দক্ষতার সাথে সম্পন্ন করেছিলেন ডঃ কামাল হোসেন। তার দক্ষতায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বসানো হয়েছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটিতে যাতে করে ইন্দো-আমেরিকান অক্ষশক্তির স্বার্থে সদ্যপ্রসূত বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারিত হতে পারে। সর্বোপরি সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করে একদলীয় বাকশালী শাসনের জোয়াল জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা এবং শেখ মুজিবকে স্বৈরশাসক হওয়ার রাস্তাটাও করে দিয়েছিলেন এই কামাল হোসেনই। পরবর্তীতে ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালের বৈপ্লবিক পট পরিবর্তনের পর যখন অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আওয়ামী লীগের পূর্নঃজন্ম ঘটে তখন তিনি আবার সক্রিয় হয়ে ওঠেন। চেষ্টা চালান দলের শীর্ষ পদটি দখল করতে কিন্তু তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয় দলীয় কোন্দলের মুখে। সেই ক্রান্তিলগ্নে দলের উপর নিজ প্রভাব বজিয়ে রাখার জন্য মুরুব্বিদের অঙ্গুলী হেলনে ভারতে আশ্রিতা শেখ হাসিনাকে তড়িঘড়ি করে নিয়ে এসে দলীয় সভানেত্রীর পদে বসালেন ডঃ কামাল হোসেন। কিন্তু সে গুড়েও পড়ল বালি! দলীয় নেত্রী হয়ে চাচার মুরুব্বিয়ানা বরদাস্ত করলোনা ভাতিজি। পরিণামে গোস্বা করে দল ছেড়ে গঠন করলেন গণফোরাম। এ ক্ষেত্রেও বিধি বাম। পালে হাওয়া ধরলো না। মনোকষ্টে বিদেশী বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর এজেন্ট হয়ে বিদেশেই কাটাচ্ছিলেন বেশিরভাগ সময়। অধুনা বসন্তের কোকিল রাজনীতিতে আবার সরব হয়ে উঠেছে!!

ডাক্তার বি. চৌধুরি। এককালের কট্টর রুশপন্থী কম্যুনিষ্ট বিধায় ভারতের কংগ্রেস ও সি.পি.আই দলের সাথে অনেক দিনের হৃদ্যতা। পরবর্তিতে জিয়ার জাতীয়তাবাদী আদর্শের ধ্বজা ধরে রাষ্ট্রিয় মর্য্যদায় শীর্ষ পদের অধিকারী হওয়ার পর বি.এন.পির নীতি-আদর্শ বিরোধী কার্য্যকলাপের জন্য দল থেকে লজ্জাষ্করভাবে বহিঃস্কৃত। যখন তাকে নেহায়েত অপমানজনকভাবে গদি ছাড়তে বাধ্য করা হয় সেদিন তার বিরুদ্ধে আনা কোন অভিযোগের বিরোধিতা না করে মুখে কুলুপ এটে নেহায়েত কাপুরুষের মতোই বঙ্গভবন থেকে শুড় শুড় করে বেরিয়ে এসেছিলেন এই বি. চৌধুরি। রাজনীতি থেকে চির বিদায় নিয়েছেন বক্তব্য দিয়ে রবীন্দ্রভক্ত এই ব্যাক্তিটি ডাক্তারি পেশায় মনোনিবেশ করেছিলেন। হঠাৎ করেই সেই ব্যাক্তি কোন যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় আবার তথাকথিত সুশীল সমাজের উপর ভর করে রাজনৈতিক অঙ্গন গরম করার চেষ্টায় অবতীর্ন হয়েছেন কোন উদ্দেশ্যে সময়তেই সেটা বোঝা যাবে। তার সাথে গাটছড়া বেধেছে বসন্তের কোকিল। কল্পনায় রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে কোকিলের কাকলির একটা সামঞ্জস্য থাকলেও থাকতে পারে কিন্তু রাজনীতির ক্ষেত্রে এই সখ্যতা যে খুব বেশিদূর এগুবে না সেটা প্রায় নিশ্চিত। কারণ এই দুই ব্যক্তিই যার যার হাতে সাড়ে তিন হাত, ফলে এক ঘরে সহঅবস্থান প্রায় অসম্ভব। তাছাড়া দুজনেরই অভিষ্ট লক্ষ্য এক; ক্ষমতার শীর্ষে আরোহন করা। যেখানে দুজনেই চাইবেন কে কার ঘাড়ে পা রেখে অভিষ্ট লক্ষ্য পৌঁছাতে পারেন সে ক্ষেত্রে এক পর্যায়ে সখ্যতার পরিবর্তে মল্ল যুদ্ধের সম্ভাবনাই বেশি। কান্ডারীদের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষনের পর কিছু কথা বলতে হয়, যে বাহনে তারা ভর করে আগুয়ান হচ্ছেন সেই বিষয়ে। তথাকথিত সুশীল সমাজ।

সুশীল সমাজের আভিধানিক যে অর্থ তার কিছুটাও যদি বাংলাদেশে আজ থাকতো তবে সমাজের প্রতি ক্ষেত্রে, প্রতি স্তরে, রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে, প্রশাসনে এমন ধ্বস ও নৈরাজ্য কখনই এত কদর্য্যভাবে দানা বেধে উঠতে পারতো না। মানবিক মূল্যবোধের অবলুপ্তি ঘটিয়ে অবক্ষয়ের ক্যান্সারের ব্যাপকতা ছড়িয়ে পরত না সমাজের পরতে পরতে। সন্ত্রাসী, লুটেরা, ঘুষখোর, চোর-বাটপার ও মাস্তান-চাঁদাবাজদের অভয় অরন্যে পরিণত হতো না সারা দেশ। আজ যে হাঁকডাক শোনা যাচ্ছে সেটা এই ভক্ষকগোষ্ঠির স্বার্থেই উচ্চারিত হচ্ছে ভিন্ন আঙ্গিকে। এই ভোগীগোষ্ঠির ধারক-বাহকরা যে বুঝতে পারছে না তাদের হাঁকডাকে সাড়া দেবার লোক দেশের ১৪ কোটি জনসংখ্যার ১% ও না তা নয়। সব বুঝেও খেলারামরা খেলছে শুধুমাত্র বিদেশী প্রভুদের মদদ আর নিজেদের কালো টাকা ও পেশী শক্তির জোরেই। সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করছে জনগণের দারিদ্রতার। একই গোত্রের করায়ত্ব প্রচার মিডিয়া জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে তাদের মদদ যোগাচ্ছে। কিন্তু দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতির সাথে পরিবর্তন ঘটছে দেশের মানুষের মন মানসিকতায়, তাই নিশ্চিতভাবে বলা চলে যত গর্জাচ্ছে তত বর্ষাবে না। বাংলায় প্রচলিত একটা প্রবাদ রয়েছে, ‘বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান এইবার ঘুঘু তোমার বধিব পরান।’ চীনাজোকদের জন্য সময় ফুরিয়ে আসছে। অদূর ভবিষ্যতেই এই প্রবাদ তাদের জন্য বাস্তব বিভীষিকা হয়ে উঠার আলামত ইতিমধ্যেই দেখা যাচ্ছে।

দেশের জনগণের পিঠ আজ দেয়ালে ঠেকে গেছে দীর্ঘদিনের লাগাতার শোষন আর নিঃস্পেষনে। গুটিকতক লোকের সবকিছু গিলে খাওয়ার র্নিলজ্জ লোভ ও স্বার্থপরতা সম্পর্কে আজ তারা অনেক বেশি সচেতন। তারা মুখবুজে ধৈর্যের সাথে আশায় বুক বেধে ছিলেন এতদিন। কিন্তু তাদের সব আশা আজ নিরাশায় পর্য্যবশিত। তারা বুঝতে পারছেন চীনাজোকদের কাছ থেকে ভাগ্য পরিবর্তনের আশা মরিচিকা মাত্র। শাসকগোষ্ঠির প্রতি ক্ষোভ ও ঘৃণা আজ প্রতিটি বঞ্চিত মানুষের মনে আগুনের মতো জ্বলছে, দেশ তাই আজ অগ্নিগর্ভা। সেই দিন বেশি দূরে নয় যখন দেখা যাবে বিক্ষুদ্ধ জনতার ঢল নেমেছে দেশ জুড়ে, মনের সুপ্ত অগ্নিশিখার প্রকাশ ঘটেছে দাবানল হয়ে, ছুড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে চীনাজোক গোষ্ঠীকে ক্ষমতাচ্যুত করে ঐ অনলে। পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে পচনশীল সমাজ ব্যবস্থার সব সমীকরণ। এভাবেই গণ বিষ্ফোরনের মাধ্যমে সৃষ্টি হবে সত্যিকার অর্থে বিকল্প নেতৃত্ত্বের যারা বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে উপহার দিতে সক্ষম হবে এক সমৃদ্ধশালী প্রগতিশীল বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠিত হবে এক গণতান্ত্রিক সুশীল সমাজ ব্যবস্থা। সুস্থ্য পরিবেশে প্রানভরে শ্বাস নিতে তারা সক্ষম হবেন সুখে শান্তিতে বসবাস করতে নিজ বাসভূমিতে এক সম্ভাবনাময় উজ্জল ভবিষ্যতের প্রত্যয় নিয়ে।

 

সমাপ্ত
সময়কাল-২০০৪