|
|
|
---|---|---|
..ডালিম বলছি | ||
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি | ||
..জীবন বৃত্তান্ত | ||
..সমসাময়িক ভাবনা | ||
..প্রকাশিত বইসমগ্র | ||
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা | ||
..ইংরেজী ভার্সন | ||
জাতীয় বিপ্লব এবং সংহতি দিবস ৭ই নভেম্বর ১৯৭৫ |
||
এই অবিস্মরনীয় দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি লাভ করেছিল জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে। তখন থেকেই দেশবাসী শ্রদ্ধার সাথে এই দিনটি উদযাপন করে আসছেন। শুধুমাত্র শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী-বাকশালীরা দিনটিকে যথাযথ মর্যাদায় পালন করতে অস্বীকার করে আসছেন বোধগম্য কারণে। এমনটি করলে তাদের অতীত ঐতিহাসিক ব্যর্থতাকে মেনে নিতে হয়। তেমন ঔদার্য্য দেখানো শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা কখনোই সম্ভব নয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের প্রাক্কালে হিজাব ধারণ করে, হাতে তাসবিহ্ নিয়ে নিজেদের অতীত ভুলভ্রান্তির জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করে দেশবাসীর কাছে ভোট ভিক্ষা করেন শেখ হাসিনা। ছলনাময়ী আচড়ন, অস্থায়ী সরকারাধীন প্রশাসনের দুর্রনীতিবাজ সুযোগ সন্ধানী একটি গোষ্ঠীর চক্রান্তের পরও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে না পেরে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হতে সমর্থ হন হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ; দীর্ঘ ২১ বছর পর। কিন্তু ক্ষমতায় বসার পরমুহুর্তেই হিজাব ও তাসবিহ্ এর লেবাস পরিত্যাগ করে অল্প সময়ের মধ্যেই জনসম্মুখে শেখ হাসিনা এবং তার সহচরগণ স্বরুপে নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটান। জনগণ বুঝতে পারেন আওয়ামী লীগে কোন পরিবর্তন তো হয়নিই বরং জিঘাংসা ও প্রতিহিংসা চিরতার্থ করার জন্য তারা জলার পেত্নীর চেয়েও আরো বেশি হিংস্র ও ভয়ংকর মহিরুহতে পরিণত হয়েছে। যার ফলে ২০০১ সালের নির্বাচনে ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে তাদের রাহুগ্রাস থেকে দেশ ও নিজেদের বাচাঁবার জন্য জাতি আওয়ামী লীগকে ছুড়ে ফেলে দেয় ইতিহাসের আস্তাকুড়ে। শোচনীয় পরাজয় ঘটে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগের। ক্ষমতা গ্রহণের পরেই জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসকে উদযাপনের জন্য ঘোষিত সরকারি ছুটির দিন বাতিল করে দেয় আওয়ামী সরকার। সংবিধানের তোয়াক্কা না করে অবৈধভাবে ১৫ই আগষ্টের জনসমর্থিত সফল বিপ্লবের নায়কদের বিরুদ্ধে শুরু করা হয় ‘মুজিব হত্যা’ ও ‘জেল হত্যা’ বিচারের প্রহসন। ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় একটা বিরল ঘটনা। এমন ঘটনা জাতীয় ইতিহাসে ঘটে বিশেষ কোনো ক্রান্তিলগ্নে বিশেষ এক পটভূমিকায়। আজ অব্দি ৭ই নভেম্বর নিয়ে নানা ধরণের বক্তৃতা-বিবৃতি ও প্রচারণা করা হলেও কি ছিল এর পটভূমি? কোন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, কিসের বিরুদ্ধে, কাদের নেতৃত্বে ঘটেছিল এই অভ্যুত্থান সেই সর্ম্পকে কিছুই বলা হয়না। দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবি মহলও এই বিষয়টিকে রহস্যজনকভাবে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছেন সতর্কতার সাথে। ৭ই নভেম্বরের তাৎপর্য্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে হলে দেশবাসী বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মকে অবশ্যই পরিষ্কারভাবে জানতে হবে কয়েকটি প্রশ্নের জবাব :- এই প্রশ্নগুলির জবাব খুঁজে না পেলে জাতীয় সংহতি দিবস শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিকতাই হয়ে থাকবে। জাতীয় চরিত্রে এর মুল্যবোধকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা কখনোই সম্ভব হবে না। ৭ই নভেম্বরের চেতনা ও উদ্দেশ্য সর্ম্পকে জানতে হলে ’৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকেই শুরু করতে হয়। ২৫শে মার্চ ’৭১ এর কালরাত্রিতে তদানীন্তন পাকিস্তানের অর্বাচীন সামরিক জান্তার নির্দেশে সামরিক বাহিনী যখন হায়নার মত নজিরবিহীন পাশবিক বর্বরতায় পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর সর্বশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল তখন প্রস্তুতিহীন জাতিকে তোপের মুখে অসহায় অবস্থায় ফেলে রেখে শীর্ষ নেতা শেখ মুজিবর রহমান স্বেচ্ছায় বন্দীত্ব বরণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের নিরাপদ আস্তানায় পাড়ি জমান। যাওয়ার প্রাক্কালে তিনি ছাত্র সমাজ ও আপামর জনগণের সব মিনতি ও অনুরোধ উপেক্ষা করে তার দলীয় নেতাদের প্রাণ বাচানোর জন্য পালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে যান। জাতীয় প্রতিরোধ সংগ্রামে নেতৃত্ত্ব দেবার আকুতিকে শেখ মুজিব খারিজ করে দিয়েছিলেন এই বলে যে বন্দুকের রাজনীতিতে তিনি বিশ্বাস করেন না। শেখ মুজিবের স্ত্রী এবং পরিবারের সদস্যগণ হলেন সরকারী অতিথি। তার এই ধরণের কাপুরুষোচিত বিশ্বাসঘতকতায় জাতি ক্ষণিকের জন্য দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ঠিক সেই সন্ধিক্ষনে সেনাবাহিনীর এক অজ্ঞাত তরুণ অফিসার মেজর জিয়াউর রহমান দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আরো কয়েকজন সমমনা তরুণ সহকর্মীদের পরামর্শে ও সহযোগিতায় চট্টলার কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে জনগণের উদ্দেশ্যে ঘোষণা দিলেন স্বাধীনতার। জাতির প্রতি আহ্বান জানালেন প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার। তার সেই দিক নির্দেশিকার ফলেই সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা, আনসার-মুজাহিদ বাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যদের কেন্দ্র করে সকল স্তরের জনগণ গড়ে তুলেছিলেন দেশব্যাপী জাতীয় প্রতিরোধ। তারই পরিণতিতে গড়ে উঠে স্বাধীনতার সংগ্রাম। কিন্তু আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রামের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে ভারতের কর্ণধার চানক্য গোষ্ঠি। বন্ধুত্বের আবরণে দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন চিরতার্থ করার জন্য প্রণয়ন করে সুদুরপ্রসারী এক নীলনকশা। মূল লক্ষ্য তাদের পরম শত্রু পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করে তার শক্তির ভিতকে দূর্বল করে ‘অখন্ড ভারত’ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চিরন্তন খায়েশ কায়েমের পরিকল্পনাকে আরো একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। একই সাথে স্বাধীন বাংলাদেশকে তাদের করদ রাজ্যে পরিণত করা। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সব কৃতিত্বের একক দাবিদার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানোর ভারতীয় সমর্থন ও অঙ্গিকারের পরিপ্রেক্ষিতে তদকালীন কোলকাতা নিবাসী অস্থায়ী প্রবাসী সরকার এবং পরবর্তীকালে মুজিব সরকার ভারতের সেবাদাসের ভূমিকা পালনের দাসখত লিখে দেয়। শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতে এবং লাখো শহীদের রক্ত ও হাজারো মা-বোনের ইজ্জতের সাথে বেঈমানী করতে এতটুকু দ্বিধাবোধ করেননি শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ। শুধু কি তাই? ’৭১ থেকে আজাব্দি জাতিয় মুক্তি সংগ্রামের একচ্ছত্র দাবিদার বনবার র্নিলজ্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কব্জা করে দেশকে পৈত্রিক সম্পত্তিতে পরিণত করল মুজিব সরকার। মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এবং বাকশালী একদলীয় স্বৈরশাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি এবং বিভিষিকায় আজো আতংকগ্রস্ত হয়ে উঠে বাংলার মানুষ। শেখ মুজিবের উত্তরসূরী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ তাদের বিগত ৫ বছরের অপশাসন ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে মুজিব আমলের সেই বিভিষিকাময় ইতিহাসকেই বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে বর্তমান প্রজন্মের কাছে। ১। তিনি ভারতীয় শাসনতন্ত্রের চারটি নীতিকে আমাদের শাসনতন্ত্রের মূল স্তম্ভে প্রতিষ্টিত করলেন। হিটলারের ‘মেইন ক্যাম্ফ’ এর অনুকরনে ‘মুজিববাদ’ নামক এক উদ্ভট রাজনৈতিক দর্শণ উদভাবন করলেন। দেশবরেন্য রাজনীতি বিশারদ এবং চিন্তাবাদীদের কেউই তার সেই উদভট সৃষ্টিকে রাজনৈতিক দর্শণ হিসাবে স্বীকৃতি দিলেন না। বরং তারা ‘মুজিববাদ’ এর মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক এক নায়কত্বেরই পূর্বাভাষ দেখতে পান। ২। তিনি ভারতীয় জাতীয় সঙ্গিত রচয়িতার একটি কবিতাকেই পছন্দ করে সেটাকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গিতের মর্যাদা দিলেন। এ ধরনের হঠকারিতা কার পক্ষে সম্ভব; একজন দেশ প্রেমিক না একজন দেশদ্রোহীর? এ বিচারের ভার থাকল স্বদেশবাসীর উপরই। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই চানক্যদের ওই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলন নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই। তাদের পক্ষে প্রবাসী সরকার ও শেখ মুজিবের সেবা দাসত্ব মেনে নেয়া সম্ভব হয়নি। তারা কখনোই শুধুমাত্র ভৌগলিক স্বাধীনতার নামে ইসলামাবাদের গোলামীর পরিবর্তে দিল্লীর দাসত্ব মেনে নিতে পারেননি। তাদের চেতনা ছিলো সত্যিকার অর্থে স্বাধীন, সমৃদ্ধ, সূখী এক বাংলাদেশ। তাই স্বাধীনতা উত্তরকালে তারাই আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে গড়ে তোলেন সংগঠিত প্রতিরোধ সংগ্রাম। কিন্তু রাষ্ট্রীয় শ্বেত সন্ত্রাসের জাতাকলে প্রতিপক্ষের শক্তিকে ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ করে দেয়া হয়েছিল সুপরিকল্পিতভাবে। তাদের বেশির ভাগই ছিল জানবাজ মুক্তিযোদ্ধা। স্বাধীনতার পর মুজিব সরকার অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাধ্য হয় জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী গড়ে তুলতে। স্বৈরশাসনের স্বার্থে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে মুজিব সরকার এবং আওয়ামী লীগ কখনোই জনগণের বিরুদ্ধে দলীয় লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করতে পারেনি। এর মূল কারণ; বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী গঠিত হয়েছিল পরিক্ষিত জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান থেকে দীর্ঘ কারা নির্যাতন ভোগকারী সেনা সদস্যদের সমন্বয়ে। তাই যুক্তিগত কারণেই বিশ্বের অন্য কোন পেশাদার সামরিক বাহিনী থেকে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর চরিত্র হল ভিন্ন প্রকৃতির। দেশ ও জনগণের স্বার্থই তাদের কাছে মুখ্য; কোন ব্যক্ত্যি, গোষ্ঠি কিংবা দলের কায়েমী স্বার্থ নয়। এর ফলে সামরিক বাহিনীকেও পরতে হয় মুজিব সরকারের রোষানলে। পরিণামে সেনাবাহিনীতেও সময়ের প্রয়োজনে গড়ে ওঠে দুটি গোপন সংগঠন। ‘সেনা পরিষদ’ ও ‘গণবাহিনী’। জাতীয়তাবাদ ও দেশেপ্রেমের প্রশ্নে এই দুটি সংগঠন এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের দেশপ্রেমিক, প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী অন্যান্য সংগঠন-গ্রুপগুলোর অঙ্গীকার ছিল এক ও অভিন্ন। পার্থক্য ছিলো নীতি আদর্শের। সেনা পরিষদের আদর্শ ছিলো দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। গণবাহিনীর আদর্শ ছিলো বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। আওয়ামী-বাকশাল শাসনামল ছিল বর্বরতার নজীরে পূর্ণ। হাজারো পৃষ্ঠায় তার বিবরণ শেষ হবার নয়। তবুও স্বৈরশাসনের একটি সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হল। আওয়ামী-বাকশালী শাসনকাল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব গণতন্ত্রকে গলা টিপে হত্যা করেন। জাতির কাঁধে চাপিয়ে দেন স্বৈরতান্ত্রিক এক দলীয় বাকশালী শাসনের জোঁয়াল। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বাক স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকারসহ সকল রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। সরকারি নিয়ন্ত্রনে মাত্র ৪টি দৈনিক রেখে বাকি সব প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। বিচার বিভাগের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়ে বিচার বিভাগকে প্রশাসনের অধিনস্থ করা হয়। এভাবেই আইনের শাসনের কবর রচিত হয়। আওয়ামী-বাকশালী শাসনামল ছিল মূলতঃ হত্যার ইতিহাস, নারী নির্যাতনের ইতিহাস, লুণ্ঠনের ইতিহাস, শোষণের ইতিহাস, চোরাচালানের ইতিহাস, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের পায়ের তলায় লুটিয়ে দেবার ইতিহাস, জাতীয় অর্থনীতিকে বিকিয়ে দেবার ইতিহাস, রক্ষীবাহিনীর শ্বেত সন্ত্রাসের ইতিহাস, স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ও লাখো শহীদের রক্তের সাথে বেঈমানীর ইতিহাস। রাষ্ট্রীয়করণের নামে আওয়ামী লীগ ব্যাংক, বীমা, মিল, কল-কারখানায় হরিলুট করেছিল। দেশে সম্পদ পাচাঁর করার জন্য সীমান্তকে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল। আওয়ামী শাসনামলে অবাধ লুটপাটের ফলে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে ‘তলাহীন ঝুড়ি’ আখ্যা পেয়েছিল। আওয়ামী লীগের আমলে বিদেশী সাহায্যের বেশিরভাগ মালই ভারতের কোলকাতা ও বিশাখা পাট্টম বন্দরে খালাস পেতো। একাত্তরের যুদ্ধ আর ধ্বংসযজ্ঞের পর বাহাত্তরে কোন দুর্ভিক্ষ না হয়ে আওয়ামী লীগের শাসন ও শোষণের ফলে ’৭৪-এ দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও বাকশাল সরকার তাদের শাসনামলে এ দেশের জনগণকে গণতন্ত্রের নামে দিয়েছিল স্বৈরাচার; সমাজতন্ত্রের নামে শুরু করেছিল সামাজিক অনাচার; বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের নামে জাতিকে করেছিল বিভক্ত; আর ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যুগিয়েছিল ধর্মহীনতার ইনদ্ধন। এভাবে স্বৈর সন্ত্রাসের নাগপাশে সমগ্র জাতিকে আবদ্ধ করে শ্বাসরুদ্ধকর অসহায় অবস্থায় রাষ্টীয় সন্ত্রসের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে সরকার বিরোধীদের সব শক্তি শেষ করে দেয়া হয়েছিল। সাংবিধানিক এবং গনতান্ত্রিক উপায়ে সরকার পরিবর্তনের সব পথ বন্ধ করে দেয়ার লক্ষেই এসমস্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল। এভাবেই জাতির জীবনে নেমে আসে এক চরম হতাশা। চারিদিকে দেখা দেয় ঘোর অন্ধকার। প্রানভরে শ্বাস নিতেও আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পরেছিল সাধারন জনগণ। সেই সন্ধিক্ষনে আবারো শেখ মুজিবের জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতার প্রতি সোচ্চার হয়ে উঠেন সেনাবাহিনীর আরেক তরুণ অফিসার বঙ্গ সার্দুল কর্ণেল জিয়াউদ্দিন। ১৯৭২ সালের গ্রীষ্মকালে সাপ্তাহিক হলিডে-তে কর্নেল জিয়াউদ্দিন তার সাড়া জাগানো নিবন্ধ প্রকাশ করেন। এ নিবন্ধের মাধ্যমে তিনি সরাসরি জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতি ক্ষমতাসীনদের বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ আনেন। তিনি তার নিবন্ধে লেখেন, “Independence has become an agony for the people of this country. Stand on the street and you see purposeless, spiritless, lifeless faces going through the mechanics of life. Generally, after a liberation war, the new spirit carries through and the country builds itself out of nothing. In Bangladesh, the story is simply other way round. The whole of Bangladesh is either begging or singing sad songs or shouting without awareness. The hungry and poor are totally lost. The country is on the verge of falling into the abyss.” নির্ভিক এই মুক্তিযোদ্ধা এই নিবন্ধে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে পঁচিশ বছরের গোপন চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশের দাবি সর্বপ্রথম তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমানের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ১৫ই আগষ্টের বৈপ্লবিক পরিবর্তন যদি না হত তাহলে গণতন্ত্রের বধ্যভূমিতে আজকের শতাধিক রাজনৈতিক দলকে একদলীয় বাকশালের ধ্বজা বহন করেই বেড়াতে হত। এমনকি আওয়ামী লীগ নামক কোন দলেরও পুনর্জন্ম হত না। আওয়ামী-বাকশালীদের অনাসৃষ্টির জন্য বিধ্বস্ত সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার ঘানি দেশবাসীকে অনির্দিষ্টকালের জন্য টানতে হত। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর হাজার হাজার কোটি টাকার অস্ত্র, গোলাবারুদ, স্বর্ণ, মূল্যবান ধাতু, যানবাহন, মিল-কারখানার মেশিনপত্র, কাঁচামাল ভারতের হাতে তুলে দিয়ে আওয়ামী লীগ সমগ্র জাতিকে প্রতিপক্ষ মনে করতে থাকে। এসমস্ত কিছুর পরও আওয়ামী লীগ নিজেদের স্বাধীনতার সোল এজেন্ট বানাবার চেষ্টা করে আসছে র্নিলজ্জভাবে। এসবের প্রতিবাদ করতে যাওয়ায় দেশমাতৃকার অন্যতম সেরা সন্তান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর জলিল বীর উত্তম কে গ্রেফতার করা হয়েছিল; প্রাণ হারাতে হয়েছিল বিপ্লবী সিরাজ সিকদার ও হাজারো মুক্তিযোদ্ধাকে। লাঞ্ছণার শিকারে পরিণত হতে হয় অনেক দেশপ্রেমিককে। ২৫ বছরের দীর্ঘমেয়াদী অসম চুক্তির মাধ্যমে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বন্ধক রেখেছিল আওয়ামী লীগই। লালবাহিনী, নীলবাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, রক্ষীবাহিনীসহ ইত্যাকার নানা রকমের বাহিনী গঠনের দ্বারা দুঃসহ নৈরাজ্য সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে বিনা বিচারে চল্লিশ হাজার রাজনৈতিক কর্মীর প্রাণ সংহার করার কালো ইতিহাস আওয়ামী-বাকশালীদের দ্বারাই সৃষ্টি হয়েছিল। বন্দী অবস্থায় রাজনৈতিক নেতা জনাব সিরাজ সিকদারকে নির্মমভাবে পাশবিক অত্যাচার করে হত্যা করার পর শেখ মুজিব স্বয়ং সংসদ অধিবেশনে ক্ষমতার দম্ভে বলেছিলেন, “কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?” ২৩/১/১৯৯২ তারিখে জাতীয় সংসদের অধিবেশনে ’৭২ থেকে ’৭৫ সালের আওয়ামী-বাকশালী দুঃশাসন প্রসঙ্গে জনাব মওদুদ আহমেদ বলেন, জাতির আশা আকাংখাকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার উদ্দেশ্যে যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়, সে ব্যবস্থা টিতে থাকেতে পারে না। জনসমর্থন ছাড়া কোন ব্যবস্থাই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। জাতীয় বেঈমান ও বিশ্বাসঘাতকরা যখন জাতির কাঁধে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরাতন্ত্রের বোঝা চাপিয়ে দেয়, জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেয়, ব্যক্তি ও গোষ্ঠি স্বার্থ হাসিলের জন্য মীরজাফর বা রাজাকার-আলবদরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তখন তাদের অন্যায়-অত্যাচার, শোষণ, নির্যাতন থেকে জাতিকে বাঁচানোর তাগিদে, তাদের দুঃশাসন উৎখাত করার জন্য দেশপ্রেমিকদের বিপ্লবের পথ অবলম্বন করতে হয়েছে যুগে যুগে। একই যুক্তিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট বিপ্লব সংগঠিত করা হয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশের নেতৃত্ত্বে। সেই বিপ্লব ছিল একটি সফল অভ্যুত্থান। দেশ ও জাতি মুক্তি পেয়েছিল দাসত্বের নাগপাশ ও স্বৈরশাসনের শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে। বাকশাল সরকারের উৎখাত ও মোশতাক সরকারের প্রতি জনগণের স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন এ কথাই প্রমাণ করেছিল জনগণের আশা আকাংখার সাথে বাকশালের কোন সম্পর্ক ছিল না। একদলীয় শাসন ব্যবস্থার প্রতি জনসমর্থনও ছিল না। এমনকি আওয়ামী লীগের বৃহদাংশেরও সমর্থন ছিল না শেখ মুজিবর রহমানের একদলীয় স্বৈরশাসনের প্রতি। ১৫ই আগষ্টের অভ্যুত্থান স্বতঃস্ফুর্ত জনসমর্থন পেয়ে একটি জনপ্রিয় বিপ্লবে পরিণত হয়। ১৪ই আগষ্ট রাতে ঢাকা বিগ্রেডের নাইট প্যারেড তাই ১৫ই আগষ্ট সুবেহ্ সাদেক বিপ্লবের দিন ঠিক করা হল। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলছে। বিপ্লবের শেষ পর্যায়ের সব প্রস্তুতি শেষ করে আল্লাহ্তা’য়ালার নাম নিয়েই বিপ্লব শুরু করা হল, প্রভাতের প্রথম প্রহরে সমগ্র জাতি তখন গভীর নিদ্রায় নিমজ্জিত। সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু করা হল প্রথম প্রতিপক্ষের তরফ থেকেই। গুলিতে তিনজন বিপ্লবী শহীদ হলেন। শুরু হল পাল্টা আক্রমন। অল্প সময়ের মধ্যে সফল অভ্যুত্থানে ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন ঘটল। রেডিও বাংলাদেশের মাধ্যমে দেশবাসীকে জানানো হল, শেখ মুজিব সরকারের পতনের কথা। একই সাথে ঘোষণা করা হল, খন্দোকার মোশতাক আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন। কারফিউ জারি করা হল দেশের বৃহত্তর স্বার্থে। জনগণের কাছে আবেদন জানানো হল, বিপ্লবের সমর্থনে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার কাজে সেনাবাহিনীকে সাহায্য করার জন্য। স্বৈরাচারী মুজিব সরকারের পতন ঘটেছে জানতে পেরে সমগ্র জাতি সেদিন স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিপ্লবকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। আনন্দের আতিশয্যে ঢাকার রাস্তায় লোকের ঢল নেমেছিল। জনগণ সারাদেশ জুড়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলন স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে মুক্তি পেয়ে। মসজিদে মসজিদে লোকজন সেদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যদের জন্য বিশেষ দোয়া ও মিলাদের আয়োজন করেছিলেন। মিষ্টি বিতরণের ধুম পড়ে গিয়েছিল মহল্লায় মহল্লায়। শেখ মুজিব ও তার দোসরদের জন্য সেদিন বাংলাদেশের জনগণ ‘ইন্নালিল্লাহে ----- রাজেউন’ পড়তেও ভুলে গিয়েছিলেন। সবারই এক কথা, ‘দেশ জালিমের হাত থেকে বেঁচে গেছে।’ বাকশালী শাসনে জনগণ ছিলেন অতিষ্ঠ। কিন্তু আওয়ামী-বাকশালী গোষ্ঠি যে এতটা ধিকৃত হয়ে উঠেছিল জনগণের কাছে সেটা উপলব্দি করতে পারা গিয়েছিল বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পর জনগণের অভূতপূর্ব ও স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থনের বহিঃপ্রকাশে। বাংলাদেশের মানুষ জাতির ক্রানি-লগ্নে অতীতে সবসময় সঠিক রায় দিয়ে এসেছেন সেটাই তারা আরেকবার প্রমাণ করলেন ১৫ই আগষ্টের বিপ্লবকে সমর্থন জানিয়ে। আগষ্ট বিপ্লবের নৈতিক বৈধতার প্রমান দেশবাসীর স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন। ১৯৭৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল জাতীয় সংসদে মরহুম শেখ মুজিবের উপর একটি শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। তখন দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মরহুম জিয়াউর রহমান এবং স্পীকার ছিলেন মির্জা গোলাম হাফিজ। কোন মৃত ব্যক্তির উপর রাষ্ট্রীয়ভাবে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করতে গেলে প্রথাগতভাবে তার জীবন বৃত্তান্ত পড়ে শোনানো হয় এবং সংসদের কার্যবিবরণীতে তা লিপিবদ্ধ করা হয়। ১৯৭৯ সালের ৪ঠা এপ্রিল শেখ মুজিবের উপর যে শোক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় তা উত্থাপন করেন স্বয়ং মীর্জা গোলাম হাফিজ। তার পঠিত শেখ মুজিবের জীবন বৃত্তান্তের শেষ লাইনে বলা হয়, “১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট এক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে তিনি মৃত্যুমুখে পতিত হন।”( সংসদ কার্যবিবরণীর সংরক্ষিত দলিল।) এটাই মূল কথা। শেখ মুজিবের মৃত্যু একটি সাধারণ হত্যাকান্ড নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু হয়েছিল রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের প্রক্রিয়ায়। একই দিনে শেখ মুজিবের পতনের রাজনৈতিক দিকটি খুব পরিষ্কার ও স্বচ্ছ করে ব্যাখ্যা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শাহ আজিজুর রহমান। সেটা তিনি করেছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অনুমোদনক্রমে। তিনি বলেছিলেন, একই অধিবেশনে পরে তিনি ইনডেমনিটি বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। বিলটি ২৪১ ভোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ হয়ে আইনে পরিনত হয়। ফলে ইনডেমনিটি আইন পঞ্চম সংশোধনী হিসেবে সংবিধানের অংশে পরিণত হয়। এভাবেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান ও নির্বাচিত সাংসদরা ১৫ই আগষ্টের বিপ্লবের স্বপক্ষে চূড়ান্ত ফয়সালা করে বিপ্লব ও বিপ্লব সংগঠনকারীদের সাংবিধানিক বৈধতা দান করেছিলেন। আজঅব্দি অতিত এবং বর্তমান সরকার প্রদত্ত ইনডেমনিটিগুলোর সাংবিধানিক বৈধতা দান করার বিষয় সম্পর্কে অনেক বক্তৃতা বিবৃতি এবং লিখিত প্রতিবেদন জনগনের সম্মুখে পেশ করা হয়েছে, পক্ষে ও বিপক্ষে। এর বেশিরভাগই অস্বচ্ছ এবং প্রশ্নবোধক। এইসব আইন প্রণয়নের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার দেখা যায় আওয়ামী লীগকে। বিশেষ করে দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়ে অতিমাত্রায় বিশেষভাবে বিষেদ্গার করে চলেছেন। আওয়ামীপন্থী কিছু চিহ্নিত বুদ্ধিজীবিও ঐ কোরাসে একই সুরে তান তুলেছেন। একজন সচেতন নাগরিক এবং মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে এই বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে ইনডেমনিটি সম্পর্কে কিছু বিস্তারিত তথ্য পাঠকদের সম্মুখে তুলে ধরছি যুক্তিসঙ্গত কারণেই। কিছুটা হলেও এই তথ্যসমূহ জনমনে ধুম্রজাল সৃষ্টি করার যে অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে স্বাধীনতার প্রাক্কাল থেকেই জাতীয় রাজনৈতিক প্রবাহে ঘটিত বিশেষ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোকে নিয়ে; সেই কথার মারপ্যাঁচের আচ্ছাদনের ভেতর থেকে সত্যকে উপলদ্ধি করতে পারেন সেই প্রত্যাশায়। এই ধরনের ইনডেমনিটি প্রদানের নৈতিক ভিত্তি হচ্ছে বৃহত্তর রাষ্ট্রিয় এবং জাতীয় স্বার্থ যথা: - একনায়কত্ব, স্বৈরশাসনের অবসান, বর্হিশক্তির আগ্রাসন থেকে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা, মানবাধিকার, আইনের শাসন, গণতন্ত্র, বাক স্বাধীনতা, সুশীল সমাজের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। এই প্রেক্ষাপটে দৃষ্টি ফেরানো যাক বাংলাদেশের প্রতি। বাংলাদেশে সর্বপ্রথম মরহুম শেখ মুজিবর রহমানের সরকারই ইনডেমনিটি প্রবর্তনের ইতিহাস সৃষ্টি করে। ১৯৭২ সালে সরকারি এক অধ্যাদেশ জারি করে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সব কর্মকান্ড, ঘটনাবলী এবং যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবিশেষদের ইনডেমনিটি দেয়া হয়। এই আইন পাশ করানোর যুক্তিও ছিল রাষ্ট্রিয় এবং জনস্বার্থ। সামরিক স্বৈরশাসন, অন্যায়, অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামকে আইনী বৈধতা দান করা হয়েছিল ঐ আইনের মাধ্যমে। ৬ই মে ১৯৭৪ শেখ মুজিবর রহমানের সরকার দ্বিতীয় ইনডেমনিটি আইন পাশ করেন কুখ্যাত রক্ষীবাহিনী এবং তাদের সমস্ত পাশবিক কার্যক্রমকে আইনি বৈধতা দান করে। শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ সরকার প্রদত্ত প্রথম ইনডেমনিটির বিষয়ে জনাব আবদুল জলিল সাধারন সম্পাদক আওয়ামী লীগ বলেছেন, “১৯৭১ এর ১৬ই ডিসেম্বর থেকে ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত একটি ইনডেমনিটি আওয়ামী লীগ সরকার জারি করেছিল।” (দৈনিক যুগান্তর ১৩ই মার্চ ২০০৩)। বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা ও এই সত্যতা সংসদে স্বীকার করেছেন ১১ই মার্চ ২০০৩ প্রধাণমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্যের বিরোধিতা করতে গিয়ে। কিন্তু তারা দুজনই রক্ষীবাহিনীকে দেয়া ইনডেমনিটি বিষয়টির ব্যপারে নিঃশ্চুপ থাকেন। তৃতীয়বার ইনডেমনিটি জারি করা হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট জনপ্রিয় বিপ্লবের পর। ১৫ই আগষ্ট ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর দেশে সাময়িকভাবে জরুরি অবস্থা এবং মার্শাল ল’ জারি করা হয় ফলে রাষ্ট্রপতি খন্দোকার মোশতাক আহমদ ১৫ই আগষ্টের ঘটনাবলী এবং বিপ্লবের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবিশেষদের এক অর্ডিনেন্স জারির মাধ্যমে ইনডেমনিটি প্রদান করেন। এই অর্ডিনেন্স জারি করার যুক্তিও ছিল জাতীয় ও জনস্বার্থ। এক দলীয় বাকশালী স্বৈরশাসনের নাগপাশে আবদ্ধ শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ থেকে জাতিকে মুক্ত করে দেশে মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন পূণঃ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষেই সংগঠিত হয়েছিল ১৫ই আগষ্টের বিপ্লব। এরই ধারাবাহিকতায় ৩রা নভেম্বর জাতীয় স্বার্থ বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এক ক্যু’ ঘটায়। বন্দী করা হয় আগষ্ট বিপ্লবের পর সেনা পরিষদের প্রতিনিধি এবং প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমদ কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং পদত্যাগের পর প্রেসিডেন্ট খন্দোকার মোশতাক আহমদকেও। এই প্রতি বিপ্লবী ক্যু’ দাতার উদ্দেশ্য ছিল দেশ ও জাতিকে ১৫ই আগষ্টের বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পূর্ব্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে বাকশালী স্বৈরশাসনের পুনঃ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে চক্রান্তকারীদের সব প্রচেষ্টাকে নস্যাৎ করে দেয় ৭ই নভেম্বরের মহান সিপাহী-জনতার বিপ্লব। চক্রান্তকারী নেতাদের কয়েকজনের মৃত্যু ঘটে ক্ষিপ্ত সিপাহী-জনতার হাতে। অন্যদের বন্দী করা হয়। ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবে অগ্রণীর ভূমিকায় ছিলেন ১৫ই আগষ্ট বিপ্লবের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যরাও। যার ফলে যুক্তিগত কারণেই সাধারণ নির্বাচনের পর সংসদে প্রেসিডেন্ট খন্দোকার মোশতাক আহমদের জারিকৃত ইমডেমনিটি অধ্যাদেশের পরিসীমা বর্ধিত করে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত সমস্ত কার্যক্রম ও তৎপরতার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবিশেষদের স্বার্থে দুই তৃতীয়াংশ ভোটে সংশোধিত ইনডেমনিটি বিলটি সংসদে পাশ করানোর ফলে উক্ত ইনডেমনিটি আইন হিসাবে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর অংশে পরিগনিত হয় ১৯৭৯ সালে। এই ঐতিহাসিক আইনটি প্রণয়ন করেছিল শহীদ জিয়ার নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত তৎকালিন বি.এন.পি সরকার। ২০০১ সালের নির্বাচনে দুই তৃতীয়াংশের ও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে বি.এন.পি এর নেতৃত্বে জোট সরকার দেশের শাসনভার গ্রহণ করে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সৃষ্ট সার্বিক নৈরাজ্য ও ভেঙ্গে পড়া আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি বেসামরিক প্রশাসনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রনে আনতে ব্যর্থ হয়ে জাতির প্রতি অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যে জোট সরকার সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে পরিক্ষিত দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে নিয়োগ করে ‘অপারেশন ক্লিনহার্ট’ পরিচালনা করার জন্য। ফলে অতি অল্প সময়ে সারা দেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটে। যার ফলে শান্তিপ্রিয় আপামর জনসাধারন অভিনন্দন জানান ‘ অপারেশন ক্লিনহার্ট’-কে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বর্তমান সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাশ করিয়ে আইনে পরিনত করা হয়েছে তৃতীয় ইনডেমনিটি বিলটি। এ ক্ষেত্রেও প্রেক্ষাপট জাতীয় এবং জনস্বার্থ। দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠি ইনডেমনিটি বিলটির বিষয়ে উচ্চবাচ্য না করলেও প্রথম এবং দ্বিতীয় ইনডেমনিটি সর্ম্পকে নিশ্চুপ থেকে তৃতীয় এবং চতুর্থ ইনডেমনিটি আইন দুইটির বিরুদ্ধে জোর গলায় সোচ্চার হয়ে নানা ধরনের উদ্ভট অযৌক্তিক প্রচারনায় মেতে উঠেছে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা বি. এন. পি নেতৃত্তাধীন জোট সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যে। শুধু কি তাই? এরপর আদালত এই বিষয়ে আর কোন যুক্তিতর্ক শুনতে রাজি হয়নি। হঠকারি উন্নাসিকতার এক অদ্ভুত নিদর্শন! কোন আইনের ব্যাখ্যা সংবিধানের বিধান অনুযায়ি অবশ্যই আদালত দিতে পারেন। কিন্তু আইনজিবীদের দ্বারা শুধুমাত্র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে কোন আইন বাতিল করা কিংবা কোন সাংবিধানিক পরিবর্তন করার সরকারি সিদ্ধান্তকে সঠিক বলানো শুধু যে সংবিধানের অবমাননা তাই নয়, এ ধরনের আচরন সমস্ত নৈতিক এবং মানবিক মূল্যবোধ ও নীতি-আদর্শ যার উপর সামাজিক আইন প্রতিষ্ঠিত তার মূলেই কুঠারাঘাতের শামিল। সরকারি চাঁপের মুখেই হউক, আর লাঠির ভয়েই হউক, কিংবা ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের জন্যই হউক, যে সমস্ত আইনজীবি নৈতিকতা এবং পেশাগত দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে সরকারের তাঁবেদারী করে আইন বিভাগের সুনাম ক্ষুন্ন করেছেন তাদের স্থান হবে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে; জনধিকৃত, বিবেকবর্জিত আইন লঙ্ঘনকারী হিসাবে। তাদের এই ধরনের হঠকারিতা ক্ষমার অযোগ্য হয়ে থাকবে চিরকাল। দায়মুক্তি সর্ম্পকে তিনি বলেন, তার এই যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতেই বলা চলে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট এবং ৭ই নভেম্বর সম্পর্কে প্রদত্ব দায়মুক্তি আইনটি শুধুমাত্র একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বাতিল করে বিচারের প্রহসন করার অধিকার ও আওয়ামী লীগের ছিল না। এই বিষয়ে কিন্তু মহামান্য মন্ত্রী তার বিবৃতিতে কিছুই উল্লেখ করলেন না। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে এ বিষয়টি এড়িয়ে গিয়েছেন কিনা সেটা সময়তেই পরিষ্কার হয়ে উঠবে। যাই হউক না কেন, তার এই একই যুক্তির ভিত্তিতে জনগণের প্রশ্ন: - বর্তমান জোট সরকারের কাছে দেশপ্রেমিক, সচেতন জনগনের প্রত্যাশা: - ইনডেমনিটির বিষয়ে প্রয়োজনে এমন শক্ত আইন প্রণয়ন করা হউক যাতে করে দেশ ও জাতিয় স্বার্থবিরোধী কোন অপশক্তিই ভবিষ্যতে কখনোই সংবিধানের অবমাননা করার ধৃষ্টতা দেখাতে সক্ষম না হয়। একইসাথে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার অসংবিধানিকভাবে জিয়া সরকারের প্রদত্ব ইনডেমনিটি আইনটি বাতিল করে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ’৭৫ এর নিঃস্বার্থ সূর্য্য সন্তানদের বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে কারা প্রকোষ্ঠে তিলে তিলে মারার যে হীন পরিকল্পনা করেছিল; আইনগতভাবে সেই পরিকল্পনাকে অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষিত করা হউক। এটা সত্যিই এক নির্মম পরিহাস! জাতীয় বীররা এখনো কারা প্রকোষ্ঠে মৃত্যুর দিন গুনছে জোট সরকারের আমলেও! জনমনের সব সন্দেহের অবসান ঘটানোর জন্য বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের উচিত কালবিলম্ব না কর্বে তাদের মুক্তি দান করে এবং যারা বিদেশে নির্বাসিত অবস্থায় রয়েছেন তাদের দেশে ফেরার পথ সুগম করে দিয়ে জনগণের কাছে প্রমাণ করা যে, জোট সরকার সংবিধানের পবিত্রতা বজিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর। একটি সত্য আজ সবাইকেই বুঝতে হবে জাতির গৌরব আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে হেয় প্রতিপন্ন করার সুযোগ কারোর জন্যই সৃষ্টি করার কোন অবকাশ নেই। কারণ জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা এবং অস্তিত্ব কায়েম রাখার শেষ আধার তারাই। ব্যক্তিগতভাবে বর্তমান জোট সরকারের নেত্রী শহীদ জিয়ার যোগ্য উত্তরশুরী সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে আপোষহীন হিসাবে বিশেষভাবে শ্রদ্ধেয়। তাঁর এই ইমেজকে আরো দৃঢ়ভাবে জনগনের মনে প্রথিত করতে হবে যাতে করে আগামীতে যে কোন ক্রান্তিলগ্নে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী এবং অকৃত্রিম জাতীয়তাবাদীরা তাঁর উপর নিরংকুশ বিশ্বাস এবং আস্থা রেখে তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে চিহ্নিত জাতিয় বিশ্বাসঘাতক এবং তাদের দোসর এবং বিদেশী প্রভুদের দেশ ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী সব চক্রান্তের বিরুদ্ধে এক অপরাজয়ী শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হতে পারে। বিভিন্নমুখী চক্রান্তের হাত থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করতে হলে শুধুমাত্র দল বা জোট নয়; সেনাবাহিনী এবং জনগনের আস্থা ও শক্তির উপরেই শুধুমাত্র বর্তমান জোট সরকারকেই নয় আগামীতেও যে সমস্ত সরকার নিজেদের জাতীয়তাবাদী ও দেশপ্রেমিক হিসাবে দাবী করবেন তাদের সবাইকেই নির্ভরশীল হতে হবে। কারো পক্ষেই অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই যে জাতীয় রাজনীতির ধারা প্রবাহে এই প্রপঞ্চটি একটি ঐতিহাসিক সত্য হিসাবেই প্রমানিত। দুঃখজনক-শক্তিহীন নেতিবাচক মানসিকতার শিকড় জাতীয় পরিসরে প্রথিত হবার আগেই এর আশু প্রতিবিধান একটি অত্যাবশ্যিক করণীয়। বর্তমানে প্রচলিত যে আইন ও সংবিধানীক বিধিবিধান রয়েছে তাকে আরো জোরদার করতে হবে। নিচ্ছিদ্র করতে হবে আইনকে সব ফাঁক ও চোরা গলিগুলো বন্ধ করে দিয়ে। প্রয়োজনে প্রণয়ন করতে হবে নতুন আইন এবং সংবিধানিক বিধিবিধানে এই বিষয়ে এমনভাবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে যাতে সেনাবাহিনী ও জাতীয়তাবাদীদের কে কেউই ভবিষ্যতে যেন আর কখনোই কাঠগড়ায় টেনে নিয়ে যাবার সাহস না পায় জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে সংকট মোকাবেলার দায়িত্ব পালন এবং কৃতকর্মের জন্য। এই ধরনের ঔদ্ধ্যত্ত্ব তাদের জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের প্রকাশ্য অপমান বিধায় অসহনীয় এবং সম্পূর্ণরুপে অগ্রহনীয়। শুধুমাত্র এ ধরনের ফলপ্রসু আইন এবং সংবিধানিক বিধিবিধানের পরিবর্তনই হতে পারে বর্তমান ও ভবিষ্যত বাংলাদেশের একমাত্র রক্ষাকবচ। শুধু তাই নয় সর্বকালের জন্য বাংলাদেশ পরিনত হতে পারে এক র্দুজয় ঘাঁটিতে। যত সত্বর শুভ বুদ্ধির উদয় হবে জনগণ ও নেতা নেত্রীদের মানসিকতায় এবং উপরে যা লিপিবদ্ধ করা হল তারা এর গুরুত্ত্ব অনুধাবন করতে সক্ষম হবেন ততই মঙ্গল হবে দেশ ও জাতির। ফিরে যাওয়া যাক ১৫ই আগষ্ট বিপ্লবত্তোর ধারাবাহিকতায়। জনগণ জাতীয় বেঈমানদের খুঁজে বের করে ধরিয়ে দিতে থাকেন আইন শৃঙ্খলা পালনকারী কর্তৃপক্ষের কাছে। এ অবস্থায় বাকশালী চক্রের যে সমস্ত নেতা জান বাচাবার চেষ্টায় গা ঢাকা দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই জনগণের কাছ থেকে কোন সাহায্য সহযোগিতা না পেয়ে উপায়হীন হয়ে স্বেচ্ছায় সরকারের কাছে আত্মসমর্পন করেছিলেন। জনাব তোফায়েল আহমেদ এবং জনাব আব্দুর রাজ্জাক তাদের মধ্যে অন্যতম। জনাব কাদের সিদ্দিকী টাঙ্গাইল থেকে একটি টেলিগ্রাম করে জানান, তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে আত্মসমর্পন করতে চান। এ টেলিগ্রামের কোন জবাব না পেয়ে প্রাণের ভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং পরে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও সরকারের হাতে ক্রীড়নক হয়ে দেশ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হন। ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর সহযোগিতায় তার দ্বারা পরিচালিত এক সশস্ত্র হামলার মোকাবেলা করতে গিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এক তরুণ অফিসার ও চারজন সৈনিক শহীদ হয়েছিলেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জিয়া সরকার দেশদ্রোহিতার অভিযোগে তার বিচার করে। বিচারে আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে দীর্ঘমেয়াদী সাজা প্রদান করে। তখন থেকেই রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করে ভারতে দীর্ঘ সময় অবস্থান করে হালে বাংলাদেশে ফিরে এসে রাজনীতিতে আবার পুনর্বাসিত হয়েছেন সেই কাদের সিদ্দিকী! অপারেশন শেষ। রেডিওতে সরকার পতন ও শেখ মুজিবের নিহত হবার খবর ঘোষিত হয়েছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই কর্নেল (অবঃ) তাহের, কর্নেল (অবঃ) আকবর হোসেন, মেজর (অবঃ) শাহজাহান ওমর, মেজর (অবঃ) জিয়াউদ্দিন, মেজর (অবঃ) রহমতউল্লাহ, ক্যাপ্টেন (অবঃ) মাজেদ এবং এক্স পিএমএ ক্যাডেট মোস্তাক ও সরাফত এসে হাজির হল রেডিও বাংলাদেশে। ঘোষণা শুনেই এসেছেন তারা বিপ্লবের প্রতি তাদের সমর্থন ও অভিনন্দন জানাতে। খবর এল পরিকল্পনা অনুযায়ী মেজর আমিন আহমদ চৌধুরী ইতিমধ্যেই সাভারে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পকে নিরস্ত্র করে তাদের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। লেঃ কর্নেল রশিদ চলে গেছে জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদকে নিয়ে আসার জন্য আর আমি গেলাম মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও বাহিনী প্রধানদের নিয়ে আসতে। ঘটনাগুলো ঘটছিল অতি তরিৎ গতিতে। ঢাকা সেনানিবাস তখন সম্পুর্ণভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে। খুশির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে সারা ক্যান্টনমেন্টে। অতি প্রত্যুষে বিপ্লবের খবর পেয়ে জেনারেল শফিউল্লাহ ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে ফোনে নির্দেশ দিয়েছিলেন বিপ্লবকে প্রতিহত করার জন্য। কিন্তু ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলের পক্ষে তখন কিছুই করা সম্ভব ছিল না। তিনি ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন বটে কিন্তু তার অধীনস্থ রেজিমেন্ট ও ব্যাটালিয়নগুলো সবই তখন সেনা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে, বৈপ্লবিক অভুত্থানের স্বপক্ষে। শাফায়াত জামিলের কাছ থেকে নিরাশ হয়ে জেনারেল শফিউল্লাহ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ (চীফ অফ জেনারেল ষ্টাফ) কে অনুরোধ জানান কিছু করার জন্য। ব্রিগেডিয়ার খালেদ জবাবে তাকে জানান, “Bangabandhu is dead. The army has revolted and whole army has celebrated.”এ পরিস্থিতিতে কারো কিছু করার নেই। ঘন্টাখানেকের মধ্যেই আমি জেনারেল শফিউল্লাহ, জেনারেল জিয়াউর রহমান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল খন্দোকার, নৌবাহিনী প্রধান এমএইচ খানকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলাম রেডিও বাংলাদেশে। রশিদ ফিরে এল জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমেদকে নিয়ে। আমিন ফিরে এল তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত রক্ষীবাহিনী প্রধান কর্নেল আবুল হাসানকে সঙ্গে নিয়ে। বিডিআর প্রধান এবং পুলিশ প্রধানকেও ডেকে আনা হল। রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমদ রেডিও-তে জাতির প্রতি তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানরা সবাই রাষ্ট্রপ্রধান খন্দোকার মোশতাক আহমদের আনুগত্য প্রকাশ করে বৈপ্লবিক অভুত্থানের স্বপক্ষে ভাষণ দিলেন রেডিওতে। কয়েক ঘন্টার মধ্যে আওয়ামী-বাকশালী নেতারা অনেকেই গ্রেফতার হন। ঐ দিনই জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ এক অনাড়ম্ভর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করেন। অস্থায়ী বিচারপতি সৈয়দ এ বি মাহমুদ হোসেন এই অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। একই দিন উপ-রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন জনাব মোহাম্মদুল্লাহ। মন্ত্রী পরিষদও গঠিত হয় সেদিনই। মূলত এরা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগ ওবাকশালের সদস্য এবং নির্বাচিত সাংসদ। মন্ত্রীসভার সদস্যবৃন্দ: প্রতিমন্ত্রীঃ খন্দোকার মোশতাক আহমেদ ধারনার চেয়েও নিজেকে বড় প্রমাণিত করলেন। বাকশাল সরকারের ১৮জন মন্ত্রীর ১০জন এবং ৯জন প্রতিমন্ত্রীর ৮জনই মোশতাক সরকারে যোগদান করেছিলেন ১৫ই আগষ্ট বৈপ্লবকে অভ্যুত্থানকে সমর্থন জানিয়ে। ১৫ই আগষ্ট বিপ্লবের দিন বাকশালের একজন শীর্ষ নেতা জনাব আবদুল মালেক উকিল লন্ডনে অবস্থান করছিলেন। সাংবাদিকরা শেখ মুজিবের মৃত্যুতে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “বাংলাদেশে ফেরাউনের পতন ঘটেছে।” জনাব মহিউদ্দিন আহমদ আর একজন শীর্ষ স্থানীয় বাকশালী নেতা প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমদের বিশেষ দূত হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নে গিয়েছিলেন ক্রেমলিনের নেতৃবর্গকে ১৫ই আগষ্টের যৈাক্তিকতা বোঝানোর জন্য। অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাইদ চৌধুরী সেচ্ছায় প্রথমত প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমদের ভ্রাম্যমান দূত পরে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ গ্রহন করে জাতিসংঘ এবং পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর নেতাদের ১৫ই আগষ্টের বিপ্লব ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের যৌক্তিকতা সর্ম্পকে অবগত করার দায়িত্ব পালন করেন। রেডক্রসের চেয়্যারম্যান পদ থেকে কুখ্যাত গাজী গোলাম মোস্তফাকে অপসারিত করে বিচারপতি বি.এ সিদ্দিককে তার পদে নিযুক্ত করা হয়। রাষ্ট্রপতির ৯নং আদেশ বাতিল করা হয়। রাষ্ট্রপতি মোশতাক এক অধ্যাদেশ জারি করে একদলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থার বিলুপ্তি ঘোষণা করে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার ঘোষণা করেন। মুজিব কর্তৃক দেশকে ৬১টি জেলায় বিভক্ত করে গভর্ণর নিয়োগের পরিকল্পনা বাতিল করা হয়। দেশের ১৯টি জেলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে জেলা প্রশাসকদের হাতে প্রশাসনের দায়িত্ব দেয়া হয়। দুর্নীতি ও ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি, মুজিব সরকারের ৬জন মন্ত্রী, ১০জন সংসদ সদস্য, ৪জন আমলা এবং ১২জন ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের বিচারের জন্য দু’টো বিশেষ আদালত গঠিত হয়। সামরিক বাহিনীর ৩৬ জন দুর্নীতিপরায়ন অফিসারের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া হয়। রাজবন্দীদের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য বিলুপ্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সহযোগিতার আবেদন জানানো হয়। সরকারি আদেশে মশিউর রহমান এবং অলি আহাদকে বিনাশর্তে মুক্তি দান করা হয় ২৫শে আগষ্ট। একই দিনে বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানীকে রাষ্ট্রপতির নয়া সামরিক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ করা হয়। মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে জয়েন্ট চীফ অব ডিফেন্স ষ্টাফ হিসাবে এবং মেজর জেনারেল শফিউল্লাহর স্থানে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে আর্মি চীফ অফ ষ্টাফ হিসাবে নিয়োগ করা হয়। বিমান বাহিনীর চীফ অফ ষ্টাফ হিসাবে নিযুক্ত হন এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব। দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকা দুইটি মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়। ১৬ই আগষ্ট মজলুম নেতা মাওলানা ভাসানী নয়া সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে এক বার্তা পাঠান। দেশের প্রায় সমস্ত জাতীয়তাবাদী এবং গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল, নেতা এবং গণসংগঠনেরও সমর্থন লাভ করতে সমর্থ হয় নতুন সরকার। তারা সবাই দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে তাদের সাহসী পদক্ষেপের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানান। ৩রা অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মোশতাক ঘোষণা করেন, ১৯৭৬ সালের ১৫ই আগষ্ট হতে দেশে বহুদলীয় অবাধ রাজনীতি পুনরায় চালু করা হবে এবং ১৯৭৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারী দেশে সাধারণ নির্বাচন সংগঠিত করা হবে। এভাবেই উল্লেখিত পদক্ষেপগুলো নেবার ফলে দেশের সার্বিক অবস্থা অতি অল্প সময়ে শুধুমাত্র স্বাভাবিকই হয়ে উঠেছিল তাই নয়; দেশের আইন শৃঙ্খলা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং কল কারখানার উৎপাদনেও অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয়। বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমে যায়। দেশে চুরি ডাকাতি ও চোরাচালানের মাত্রা কমে যায় বহুলাংশে। দেশে স্থিতিশীলতা ফিরে আসে পূর্ণমাত্রায়। দেশে বিদেশে অস্থায়ী সরকারের নীতিসমূহ ও পদক্ষেপগুলো প্রশংসিত হয়। ১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক পট পরিবর্তনের উপরে বর্ণিত বিশদ বিবরনের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ কোন যুক্তিতে শেখ মুজিবের স্বৈরশাসনের অবসানকে শুধুমাত্র একটি মামুলি ‘হত্যাকান্ড’ হিসেবে জোর গলায় প্রলাপ বকে চলেছেন? তাদের মতে ঐ ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন এর সাথে জড়িত ছিল কিছু সংখ্যক ‘ উচ্ছৃংখল-বিপথগামী ’ তরুণ সামরিক অফিসার! যদি তাই হয়ে থাকতো তবে এই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করে দেশের সামরিক বাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, অন্যান্য আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী সংগঠন, আইন বিভাগ, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এমনকি জাতীয় রক্ষীবাহিনী প্রধানগণ জাতির উদ্দেশ্যে প্রচারিত তাদের ভাষণে ১৫ই আগষ্ট বিপ্লবকে সমর্থন করে বিবৃতি প্রদান করেছিলেন কেন? শুধু কি তাই? আওয়ামী-বাকশালীদের নেতা ও সাংসদদের অনেকেই কি করে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগদান করেছিলেন? কেনই বা সেদিন কারফিউ জারি করা সত্ত্বেও ঢাকাসহ দেশের সর্বপ্রান্তে বিপ্লবের সমর্থনে বাধভাঙ্গা আনন্দ-উচ্ছাসে রাস্তায় নেমেছিল জনতার ঢল? এতেই প্রমাণিত হয় ১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক বিপ্লবের অগ্রণী হিসেবে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর তরুন সদস্যরা দয়িত্ব পালন করলেও এই বিপ্লবের মূল শক্তি ছিল দেশের জাগ্রত জনতা। বস্তুতঃ শেখ মুজিব তার নিজের ও পরিবারের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী একটা ভিত্তি দেয়ার লক্ষ্যেই বাকশালী স্বৈরাচার কায়েম করেছিলেন। এভাবেই যুগযুগ ধরে স্বৈরাচারী শাসকরা আর্বিভুত হন। এরা একই নিয়মে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন। জামার্নীর হিটলারের উত্থান ঘটেছিল এভাবেই। নাৎসী পার্টি তাকে ‘মহামানব’ আখ্যায়িত করেছিল। বাকশালীরাও শ্লোগান তুলেছিল, সার্বিক অবস্থা স্বাভাবিকরণের পর সেনা পরিষদ বিপ্লবের অবশিষ্ট উদ্দেশ্যাবলী বাস্তবায়নের প্রচেষ্টায় ব্রতী হয়। লোকচক্ষুর অন্তরালে রাত-দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছিল তাদের লক্ষ্য অর্জনের প্রচেষ্টায়। পর্বত সমান প্রতিবন্ধকতার মুখে কাজ করতে হচ্ছিল সেনা পরিষদকে। ১৫ই আগষ্টের পট পরিবর্তনের পর কেটে যায় ঘোর অন্ধকার। নবপ্রভাতের সূচনা ঘটে জাতীয় জীবনে। উম্মোচিত হয় মানবিক অধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার রুদ্ধ দুয়ার। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সৃষ্টি হয় এক নতুন ধারার। ফলে প্রাণ ফিরে পায় নির্জীব, অসহায় দেশবাসী। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৫ই আগষ্টের ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন, ৩রা নভেম্বরের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদাতা এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবে অগ্রণীর ভুমিকায় ছিলো দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী। ঘটনাগুলো তাই একই সূত্রে গাথা। বিশেষ করে ১৫ই আগষ্ট ও ৭ই নভেম্বরের মধ্যে রয়েছে এক অবিচ্ছেদ্য যোগসুত্র। এই দুটি যুগান্তকারী অভ্যুত্থানের পেছনে কাজ করেছে একই চেতনা, একই শক্তি। ব্যতিক্রম শুধু ৭ই নভেম্বরে সেনা পরিষদ ও অন্যান্য দেশপ্রেমিক দল এবং গ্রুপের সাথে যোগ দিয়েছিল কর্ণেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন গণবাহিনী। বিচ্ছিন্নভাবে ১৫ই আগষ্ট ও ৭ই নভেম্বরের কোন একটি বিশেষ ঘটনার একক মূল্যায়ন এবং স্বীকৃতি ‘জাতীয় বিপ্লব এবং সংহতি দিবস’ এর মহাত্ম, তাৎপর্য্য এবং চেতনা অনুধাবন এবং এর মূল্যবোধ জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠার জন্য যথেষ্ট নয়। জাতিয় বৃহত্তর স্বার্থে আত্মত্যাগে নবীন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করতে হলে এই দুটি সফল অভ্যুত্থানকে জাতীয় পর্যায়ে সমমর্যাদা ও স্বীকৃতি অবশ্যই দিতে হবে। এই যুক্তির বাস্তবতা বুঝার জন্য প্রয়োজন ১৫ই আগষ্টের সফল পট পরিবর্তনের পর লোকচক্ষুর অন্তরালে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত কি ঘটেছিল সে সর্ম্পকে সত্যকে জানা। এই লক্ষ্যেই দেশবাসীর বিশেষ করে বর্তমান প্রজন্মের অবগতির জন্য সেই সময়ের প্রাসঙ্গিক ঘটনাপ্রবাহের ধারা বিবরনী নিচে তুলে ধরা হল। ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বিজয়কে আপামর দেশবাসী স্বতঃস্ফুর্তভাবে অভিনন্দন জানালেও পরাজিত বাকশালী চক্র ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী মহল সহজে এই পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারছিল না। তারা জনসমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যক্ষভাবে এই বিপ্লবের বিরোধিতা করতে না পেরে গোপনে তাদের হারানো স্বর্গ ফিরে পাবার আশায় তাদের বিদেশী প্রভুদের যোগসাজসে চক্রান্তের জাল বুনতে শুরু করে বিপ্লবের পরমুহূর্ত থেকেই। তাদের এ ধরণের তৎপরতা সম্পর্কে আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হচ্ছিল। বিপ্লবের পর পরাজিত শক্তিকে সমূলে বাংলাদেশের মাটি থেকে উপড়ে ফেলার জন্য আমরা সচেষ্ট ছিলাম। সর্বদলীয় সরকার কায়েম করে তার তত্ত্বাবধানে যতশীঘ্র সম্ভব নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আমরা নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। একই সাথে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল জাতীয় রক্ষীবাহিনীকে proper screening এর পর সেনাবাহিনীর সাথে একত্রীভূত করে এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর পুর্নগঠন করে বিপ্লবের স্বপক্ষ শক্তিকে সুসঙ্গবদ্ধ করার। সেনা পরিষদের পক্ষ থেকে এই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। বিপ্লবের প্রতি পূর্ণ সমর্থন দানকারী জেনারেল ওসমানীর মূল দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের উপেক্ষিত সামরিক বাহিনীর সার্বিক কাঠামো নতুন করে জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ধাঁচে গড়ে তোলা। সেনা বাহিনীর পুর্নগঠনের কাজটি তখনকার প্রেক্ষাপটে ছিল খুবই জটিল এবং দূরহ্ একটি কাজ। রক্ষীবাহিনীর সদস্যদের বাছাই করে তাদের সেনাবাহিনীতে নিয়োগ করার কাজটি ছিল বিশেষভাবে জটিল। সেনাবাহিনী থেকে বাকশালীমনা, দুনীতিপরায়ন এবং উচ্চাভিলাসীদের বের করে দিতে হবে। প্রয়োজনমত ইউনিটগুলোর পুনর্বিন্যাস করতে হবে। কমান্ড স্ট্রাকচারে প্রচুর রদবদল করতে হবে। সর্বোপরি সেনাবাহিনীর প্রতিটি সৈনিককে বিপ্লবের লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যাবলী সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। এ সমস্ত কাজে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের সেনা পরিষদের সদস্যরাই ছিল জেনারেল জিয়ার মূল শক্তি। তাদের সার্বিক সাহায্যের উপর ভিত্তি করেই জেনারেল জিয়া তার দায়িত্ব পালন করে চলেছিলেন। আওয়ামী-বাকশালী আমলে অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত অফিসারদের সামরিক বাহিনীতে পুনর্বহালের নীতিগত সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় এবং এই নীতি কার্যকরী করার দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল জেনারেল জিয়াউর রহমানকে। তিনি প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তার দায়িত্ব পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। একই সাথে আমরা তখন দেশের দেশপ্রেমিক-জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল, গ্রুপ এবং ব্যক্তিবর্গের সাথে দেশের ভবিষ্যত রাজনৈতিক কাঠামো, জাতীয় সরকার, নির্বাচন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে মত বিনিময় করছিলাম। এই প্রক্রিয়াটাও ছিল ভীষণ জটিল। বিগত ঐক্য প্রক্রিয়ার মত এ সমস্ত বিষয়ে আলোচনাকালে সব রাজনৈতিক দলই তাদের দলীয় স্বার্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছিলো। এমনকি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবটি খন্দোকার মোশতাক আহমদও প্রথমে মেনে নিতে চাচ্ছিলেন না। তিনি চাইছিলেন সরকার প্রধান থেকে একটি নিজস্ব দল গঠন করে তার অধীনস্থ অস্থায়ী সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে। কিন্তু আমাদের জোরালো যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে তাকে মেনে নিতে হয়েছিল জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব। যে সংসদ গণতন্ত্র বলি দিয়ে বাকশাল কায়েম করেছিল তার মাধ্যমেই গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার পর মোশতাক সরকার ও গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম আমরা। বামপন্থী রাজনৈতিক অনেক দলই বিশেষ করে জাসদ চাচ্ছিল একটি বিপ্লবী সরকার কায়েম করে তাদের দলীয় কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হউক। কিন্তু তাদের সেইসব প্রস্তাব নাকচ করে দিয়ে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করার কোন ইচ্ছা নেই আমাদের, এমনকি রাজনীতিতে সরাসরিভাবে সেনাবাহিনীর অংশ গ্রহণের বিরুদ্ধে সেনা পরিষদ। জাতীয় কিংবা নির্দলীয় সরকার গঠন করা হবে কোন বিশেষ দলের কর্মসূচী কার্যকরী করার জন্য নয়। তাদের দায়িত্ব হবে দেশে একটি সুষ্ঠ ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। দলীয় কর্মসূচী বাস্তবায়নের অধিকার অর্জন করবে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত রাজনৈতিক দল। কিছুদিন পর একদিন জেনারেল জিয়া জানালেন, তার কাজে অন্তরায় সৃষ্টি করছেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল। তাদের সাথে হাত মিলিয়েছেন কিছু বাকশালপন্থী অফিসার। ব্রিগেডিয়ার খালেদ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা কিন্তু ভীষণ উচ্চাভিলাসী। তার উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করার জন্য অতি কৌশলে যুদ্ধের সময় থেকেই তিনি তার শক্তি এবং প্রভাব বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা করে আসছিলেন। মুজিব সরকার ও বাকশালীদের সহানুভূতিও ছিল তার প্রতি। আচমকা বাকশালী সরকারের পতনের ফলে তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তাই তিনি মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন যে কোন উপায়েই নিজস্ব পরিকল্পনা কার্যকরী করে তার উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করতে। তার এই হীন চক্রান্তমূলক কার্যকলাপ থেকে তাকে কিছুতেই নিরস্ত্র করতে পারছিলেন না জেনারেল জিয়াউর রহমান। ক্ষমতার প্রতি ব্রিগেডিয়ার খালেদের এই দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করেছিল বাকশালী চক্র এবং তাদের মুরুব্বী সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং তাদের দোসর ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ। ১৫ই আগষ্ট পরবর্তী ঘটনা প্রবাহের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে আগষ্ট বিপ্লবের পূর্ব অবস্থায় দেশকে নিয়ে যাবার এক গভীর ষড়যন্ত্রের সূচনা ঘটানো হল ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মাধ্যমে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর রির্পোটেও এই ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে তথ্য পাওয়া যেতে লাগল। ব্রিগেডিয়ার খালেদের প্রধান উস্কানিদাতা ছিল কর্নেল শাফায়াত। শেখ মুজিবের প্রতি অন্ধ এই অফিসার কিছুতেই বাকশালী সরকারের পতনকে মেনে নিতে পারছিলেন না। কুখ্যাত আত্রাই অপারেশনের চ্যাম্পিয়ন কর্নেল শাফায়াত জামিল যাকে পরে ঢাকায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে নিয়োগ করে শেখ মুজিব পুরস্কৃত করেছিলেন; সেই শাফায়াত জামিলের অধীনস্থ ঢাকা ব্রিগেডই মুজিব সরকারের পতন ঘটাল এই humiliation তার পক্ষে কিছুতেই সহ্য করা সম্ভব হচ্ছিল না। ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে এই গ্লানি তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। এর জন্যই তিনি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে মোশতাক সরকার এবং জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে উস্কে দিয়ে তাকে বাকশালী চক্র ও তাদের বিদেশী প্রভুদের ক্রীড়নকে পরিণত করেছিলেন। তাদের সাথে জোট বেধেছিলন রক্ষীবাহিনীর কয়েকজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং আগরতলা মামলার আসামীদের কয়েকজন অফিসার। প্রথমত: আমরা এবং জেনারেল ওসমানী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এ ধরণের আত্মঘাতী এবং জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ডে লিপ্ত হতে পারেন সেটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু ক্রমে যখন বিভিন্ন সেনা নিবাসগুলো থেকে সেনা পরিষদের সদস্যরাও একই ধরণের খবর পাঠাতে লাগল তখন বিষয়টি চিন্তার কারণ হয়ে উঠল। বোঝা যাচ্ছিল সংকট ঘনিয়ে আসছে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফকে এ ধরণের সর্বনাশা চক্রান্ত থেকে সরে দাড়াবার জন্য ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও বিশেষ ফল হল না। প্রত্যেকবারই সম্মুখে সবকিছুই অস্বীকার করেছিলেন খালেদ ভাই। বুঝলাম, ক্ষমতার লোভে অন্ধ হয়ে গেছেন তিনি। তার কর্মকান্ডের গুরুত্ব এবং পরিণাম কি হতে পারে সেটাও বোধ করি তিনি উপলব্ধি করতে পারছিলেন না। জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চক্রান্তের ক্রীড়নক হয়ে কোন অঘটন ঘটালে এর পরিণাম হবে ভয়ঙ্কর এবং জনগণ তাকে চিহ্নিত করবে জাতীয় বেঈমান হিসাবে। সেটা হবে অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়। এ মুহূর্তে জাতীয় স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য সামরিক বাহিনী বিশেষ করে আর্মির মধ্যে ঐক্য একান্তভাবে প্রয়োজন। জেনারেল জিয়াকেও কার্যকরী করে তুলতে হবে তা না হলে আগষ্ট বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জন করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। পর্দার আড়ালে যে চক্রান্তের বীজ দানা বেঁধে উঠছে তার কবল থেকে দেশ ও জাতিকে কী করে বাচানো যায় সেটাই অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে চিন্তা ভাবনা করতে হচ্ছিল আমাদের। তাদের কাজ কর্মে কোন পরিবর্তন হল না। পরিশেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হল, ব্রিগেডিয়ার খালেদ, কর্নেল শাফায়াত এবং তাদের সহযোগিদের অবিলম্বে সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কার করতে হবে। দেশ এবং জাতিকে দাসত্বের হাত থেকে বাঁচানোর আর কোন উপায়ই ছিল না। কাজটি ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ; কারণ স্বাধীনতা সংগ্রামের সব যোগ্য কমান্ডারদের প্রতি একটা বিশেষ আকর্ষন এবং আনুগত্য ছিল তাদের অধীনস্থ যোদ্ধাদের। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল শাফায়াতকে চাকুরিচ্যুত করলে সেনাবাহিনীতে একটা প্রতিক্রিয়া হতে পারে কিন্তু আমরা নিশ্চিত ছিলাম ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার দোসরদের চক্রান্তের আসল উদ্দেশ্য সৈনিকদের সামনে তুলে ধরলে ব্যক্তিগত আনুগত্য যাদের আছে তারাও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী হীন চক্রান্তকে সমর্থন করবে না। আমাদের তরফ থেকে সিদ্ধান্তের কথাটা জেনারেল জিয়াই জেনারেল ওসমানীকে জানালেন। সব শুনে তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। গোয়েন্দা বিভাগীয় প্রধানরা যখন বিস্তারিত রির্পোট তার সামনে পেশ করলেন তখন অসহায় আক্ষেপে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলেন তিনি। গোয়েন্দা রির্পোটগুলো থেকে পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল, এই চক্রান্তে হাত রয়েছে বাকশালীদের একটি চক্র এবং তাদের সার্বিকভাবে মদদ যোগাচ্ছিল প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন চেষ্টা চালাচ্ছে আর্মির মধ্যে কিছু লোকের মাধ্যমে একটা প্রতি বিপ্লবী ঘটনা ঘটিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভক্তি সৃষ্টি করে দেশকে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়ে ২৫ বছরের আওতায় বাংলাদেশে সরাসরিভাবে হস্তক্ষেপ করে জনাব তাজুদ্দিনের নেতৃত্বে একটি অনুগত সরকার গঠন করে বাংলাদেশকে আবার একটি করদ রাজ্যে পরিণত করা। রিপোর্ট থেকে আরও জানা গেল, এই নীলনকশা বাস্তবায়নে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং বাংলাদেশে অবস্থত ভারতীয় ও সোভিয়েত ইউনিয়ন দূতাবাস যৌথভাবে অত্যাধিক মাত্রায় তৎপর রয়েছে। তাদের পরামর্শে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ভাই সাংসদ বাকশালী নেতা জনাব রাশেদ মোশাররফ সংশ্লিষ্ট মহল এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এই চক্রান্ত সম্পর্কে পরবর্তিকালে জনাব এনায়েতউল্লাহ খানের পত্রিকা সাপ্তাহিক হলিযে-তে এক বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। ‘Bangladesh The Unfinished Revolution’ গ্রন্থে জনাব লিফ্স্যুলজ লিখেছেন, “রয়টার সংবাদদাতা জনাব আতিকুল আলমের হাতে ভারতীয় হাই কমিশনার জনাব সমর সেনের কাছে অভ্যুত্থান বিষয়ক জনাব তাজুদ্দিনের স্বহস্তে লিখিত একটি চিঠি পৌঁছেছিল।” জনাব জিল্লুর রহমান খান '‘Leadership crisis in Bangladesh’ গ্রন্থে লিখেছেন, “খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানের বিষয়ে জেলে চার নেতা অবহিত ছিলেন। এটা ছিল একটি মুজিবপন্থী পাল্টা অভ্যুত্থান। কারণ চার নেতা বীরদর্পে জেল থেকে বের হয়ে এসে সরকার গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।” সর্বমোট ৩৬ জন অফিসারকে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। একই সাথে মুজিব আমলে অন্যায়ভাবে চাকুরিচ্যুত অফিসারদের পুনর্বহালের প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করার জন্য জেনারেল জিয়াকে অনুরোধ জানানো হয়। এর কয়েকদিন পরেই আমরা চাকুরিতে পুনর্বহাল হই। এতে করে সেনাবাহিনীতে বিপ্লবের স্বপক্ষ শক্তি বৃদ্ধি পায়। জেনারেল জিয়ার হাতও এতে করে তুলনামূলকভাবে বেশি শক্তিশালী হয়ে উঠে। জেনারেল জিয়া অবিলম্বে আমাদের সবাইকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোতে নিয়োগ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। আমাদের সেনাবাহিনীতে পুনর্বাসনের ফলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ ও তার সমর্থকরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। তারা বুঝতে পারেন, সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসলে তাদের কোন ষড়যন্ত্রই কার্যকর করা সম্ভব হবে না। তারা এটাও বুঝতে পারলেন যে, তাদের দিন ফুরিয়ে এসেছে। তাই তারা অস্থির হয়ে উঠলেন মরণ কামড় দেবার জন্য। ঐ সময়ে একদিন জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্ট মোশতাকের কাছ থেকে কর্নেল রউফ (শেখ মুজিবের আমলে তার বিশেষ আস্থাভাজন সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা প্রধান) এবং কর্নেল মালেকের চাকুরিচ্যুতির ফাইল সই করিয়ে নিয়ে সেনাবাহিনী থেকে তাদের অবসর প্রদানের আদেশ জারি করলেন। ব্যাপারটা জানতে পেরেই আমি শংকিত হয়ে পড়লাম। ছুটে গেলাম জেনারেল জিয়ার কাছে। স্যার, এটা আপনি কি করলেন! কথা ছিল ৩৬জনকে একই সাথে অবসর প্রদান করা হবে। সেটা না করে মাত্র দু’জনকে অবসর প্রদান করে বাকি ষড়যন্ত্রকারীদের হুশিঁয়ার করে দিলেন আপনি। এটা কি ঠিক হল? জবাবে জেনারেল জিয়া আমাকে বললেন, Don’t worry; let me move step by step. Things would be all right. Let me handle the affairs in my own way. তার যুক্তিতে মন সায় দিল না। কিন্তু কিছুই করার নেই। তিনি আমাদেরই একজন। তার কর্মপদ্ধতির উপর দখলদারী করাটা যুক্তিসঙ্গত তো নয়ই; সেটা উচিতও নয়। তবু বেশ কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই ফিরে এলাম। ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার চামচারা তখন সেনাবাহিনীতে জোর প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে। তাদের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, জেনারেল জিয়া যোগ্য বিপ্লবী নন; তার দ্বারা আগষ্ট বিপ্লবের উদ্দেশ্যাবলীর বাস্তবায়নও সম্ভব নয়। তিনি সর্বোময় ক্ষমতাশালী হওয়ার জন্য বিপ্লবের বিরুদ্ধে কারসাজি করে চলেছেন অতি ধূর্ততার সাথে। এক্ষেত্রে সবাইকে তার বিকল্পের কথা ভাবতে হবে। সাধারণ সৈনিকদের কাছে জিয়া ছিলেন আদর্শের প্রতীক। সততার জন্য তার জনপ্রিয়তাও ছিল যথেষ্ট। কিন্তু তারই সহযোদ্ধা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একটি অংশের বিরূপ প্রচারণা সেনাবাহিনীর সদস্যদের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করল। ফলে পরিস্থিতি হয়ে উঠল আরও ঘোলাটে। একসাথে ৩৬জন অফিসারকে চাকুরি থেকে অব্যাহতি না দেবার কারণেই এ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিল চক্রান্তকারীরা। অবস্থার কতটুকু অবনতি ঘটেছে তার হদিস পেলাম সেই দিন যেদিন আমাদেরই দুইজন অফিসার মেজর হাফিজ এবং ক্যাপ্টেন ইকবাল এক বৈঠকে জেনারেল জিয়ার যোগ্যতা সর্ম্পকে সন্দেহ প্রকাশ করল। জেনারেল জিয়ার প্রতি অনাস্থাই শুধু প্রকাশ করেনি তারা। তারা প্রস্তাব রেখেছিল, “যেহেতু জেনারেল জিয়া তার উপর প্রদত্ত দায়িত্ব আশানুরূপভাবে পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছেন তাই প্রয়োজনের খাতিরেই বিকল্প হিসাবে আরো যোগ্য কাউকে চীফ বানাবার কথা ভাবতে হবে তা না হলে অবস্থা সামলানো যাবে না। রাগ এবং হতাশায় কথাচ্ছলে তারা এমনও বলেছিল, “ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফতো আমাদের অনেক তোষামোদ করেছিলেন তাকে চীফ বানাবার জন্য। আমাদের সব শর্ত মেনে নেয়ার জন্যও রাজি ছিলেন তিনি। তার খায়েশ মিটিয়ে দিলে জিয়ার তুলনায় তার কাছ থেকে অনেক বেশি কাজ আদায় করে নিতে পারতাম আমরা। বর্তমানে সেনাবাহিনীতে যে জটিল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তার জন্য সম্পূর্ণভাবে দায়ী জেনারেল জিয়ার ভুল পদক্ষেপ এবং তার আস্তে চলার নীতি।” ব্রিগেডিয়ার খালেদের প্রসঙ্গে তাদের সেসব উক্তিকে শুধুমাত্র ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ মনে করে উপস্থিত কেউই তেমন একটা গুরুত্ব দেয়নি সেই সময়। জেনারেল জিয়ার প্রতি তাদের অভিযোগের অনেকটাই সত্য হলেও তাদের সেই প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি বৈঠকে। বেশিরভাগ সদস্যদের অভিমত ছিল, “জেনারেল জিয়া আমাদেরই একজন এবং আমরাই তাকে মনোনীত করেছি সেনাপ্রধান হিসাবে। বিপ্লবের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যাবলীর বাস্তবায়নের ব্যাপারে তিনি আমাদের সাথে সম্পূর্ণভাবে একমত। সিদ্ধান্ত বাস্তাবায়নের ক্ষেত্রে কিছুটা ত্রুটি বিচ্যুতি থাকলেও বিপ্লবের পরিপন্থী কোন কিছু তিনি করেননি যাতে করে তাকে সন্দেহ করা চলে। এ অবস্থায় আমাদের উচিত হবে ধৈর্য্য ধারণ করে তার shortcomings and omissions সম্পর্কে তাকে সচেতন করে তুলে তাকে সর্বাত্মকভাবে সাহায্য করা; যাতে করে খালেদ চক্রের চক্রান্তকে নস্যাৎ করা সম্ভব হয়। কোনক্রমেই বর্তমান পরিসি'তিতে এর পরিপন্থী অন্য কিছু চিন্তা করা উচিত হবে না। Implementation process এ তার ভুলভ্রান্তি অবশ্যই আমরা তার সামনে তুলে ধরব। এভাবেই সব সমস্যার সমাধান করে এগুতে হবে আমাদের। সেনাবাহিনীর মধ্যে ধূঁমায়িত হয়ে উঠা এই Explosive situation সম্পর্কে দেশবাসী কিন্তু তেমন কিছুই একটা জানতে পারেননি। সবকিছুই ঘটছিলো পর্দার অন্তরালে। সেই সময় সেনাবাহিনীর ভিতরে প্রতিবিপ্লবী চক্রান্ত, রাজনৈতিক আলোচনার জটিলতা সবকিছু মিলিয়ে সংকট যখন বেশ গভীর হয়ে উঠল তখন সেনা পরিষদের একাংশ অভিমত প্রকাশ করলেন যে, অস্থায়ী জাতীয় কিংবা র্নিদলীয় সরকারের পরিবর্তে জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে Revolutionary Council গঠন করে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সেনা পরিষদকে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় হওয়া উচিত বর্তমান বাস্তব অবস্থার মোকাবেলা করার জন্য। এই অভিমতের বিরুদ্ধে নেতৃত্বের বেশিরভাগ সদস্যই সোচ্চার হয়ে উঠেন। তারা বিপ্লবের মূল আদর্শের প্রতি অটল থেকে মত প্রকাশ করেছিলেন; ক্ষমতা দখল কিংবা সামরিক বাহিনীকে সরাসরিভাবে রাজনীতিতে জড়িত করা আগষ্ট বিপ্লবের উদ্দেশ্য নয়। গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে সুষ্ঠু জাতীয়তাবাদী রাজনীতির বিকাশ ঘটানোই হচ্ছে আগষ্ট বিপ্লবের মূল লক্ষ্য। কোন অবস্থাতেই আগষ্ট বিপ্লবের এই মহান চেতনা থেকে আমাদের সরে দাড়ানো উচিত হবে না। নিজেদের হাতে ক্ষমতা নিলে আগষ্ট বিপ্লবকেও তৃতীয় বিশ্বের অন্য যেকোন দেশে ক্যু’র মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের একটি অপপ্রয়াস হিসাবেই মনে করবে দেশ ও বিশ্ববাসী। এতে করে নিজেরাই যে শুধুমাত্র ক্ষমতালোভী হিসাবে প্রতিপন্ন হব তাই নয়; বাংলাদেশের সেনাবাহিনী দেশপ্রেমিক সেই ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হবে। জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের রক্ষক এবং গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী হিসাবে বহু কষ্টে অর্জিত এই ভাবমূর্তি যেকোন মূল্যেই বজায়ে রাখতে হবে আমাদের। নিজেদের জীবনের বিনিময়েও আগষ্ট বিপ্লবের চেতনাকে সমুন্নত রাখতেই হবে সেনা পরিষদকে। এভাবেই সার্বিক কিংবা আংশিকভাবে ক্ষমতা গ্রহণের প্রস্তাব নাকচ হয়ে গিয়েছিল। পক্ষান্তরে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে নতুন অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম আমরা। যেকোন ত্যাগের বিনিময়েই আগষ্ট বিপ্লবের লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য সর্বাত্মক আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে আমাদের প্রত্যেককেই। সময়ের সাথে জেনারের জিয়া এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদের দ্বন্দ্ব তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠল। প্রায় প্রতিদিন রাতেই আমি ছুটে যাচ্ছি সেনা নিবাসে তাদের বিরোধে মধ্যস্থতা করার জন্য। মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে ব্যক্তিগতভাবে আমাদের সবার মধ্যেই পারস্পরিক সম্পর্ক ছিল খুবই Close and informal. নীতি-আদর্শ, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং পদ মর্যাদার ভেদাভেদ এসব কিছুর উর্ধ্বে ছিল সেই সম্পর্ক। যুদ্ধের সময় থেকেই আমাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল একের প্রতি অপরের অদ্ভুত নির্ভরশীলতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা। সেই সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতেই আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছিলাম খালেদ ভাই এবং কর্নেল শাফায়াতকে বোঝাতে; কিন্তু আমাদের সেই প্রচেষ্টাতে তেমন কোন লাভ হচ্ছিল না। শেষ চেষ্টা হিসাবে হুদা ভাইকে অনুরোধ জানালাম ঢাকায় আসার জন্য। কর্নেল হুদা তখন রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার। হুদা ভাই এবং খালেদ ভাই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একেবারে হরিহর আত্মা। হুদা ভাই ছিলেন রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত সচেতন, জ্ঞানী, ন্যয়পরায়ন, স্পষ্ট বক্তা, সৎ এবং উদারপন্থী চরিত্রের। এধরণের চরিত্রের লোক ছিলেন বলেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার একজন হয়েও এবং শেখ মুজিবের প্রতি অন্ধভক্তি থাকা সত্যেও দেশ স্বাধীন হওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আওয়ামী লীগ সরকার সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন তিনি। তার সচেতন মন কিছুতেই আওয়ামী দুঃশাসনকে মেনে নিতে পারেনি। এর ফলেই কুমিল্লায় ব্রিগেড কমান্ডার থাকাকালে আমাদের সাথে একাত্ম হয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে উঠেছিলেন হুদা ভাই। ভেবেছিলাম হুদা ভাইকে দিয়ে খালেদ ভাইকে বোঝালে তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলেও হতে পারে। জিয়া বিরোধী চক্রান্ত থেকে নিরস্ত করার এটাই হবে আমাদের শেষ চেষ্টা। খবর পেয়েই হুদা ভাই এলেন ঢাকায়। তার সাথে আমার বিস্তারিত খোলাখুলি আলাপ হল। সবকিছু শোনার পর হুদা ভাই কথা দিলেন সাধ্যমত চেষ্টা করবেন তিনি ব্রিগেডিয়ার খালেদকে বোঝাতে। পরপর দু’দিন বৈঠক করলেন তিনি খালেদ ভাই এর সাথে। কিন্তু তার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। কোন যুক্তি দিয়েই তাকে বোঝাতে সক্ষম হলেন না হুদা ভাই। সেই রাতের কথা ভোলার নয়। ব্রিগেডিয়ার খালেদের সাথে শেষ বৈঠক করে তিনি আমাকে ডেকে পাঠালেন তার ভাই কে কিউ হুদার বনানীর বাসায়। সন্ধ্যায় আমি গিয়ে উপস্থিত হলাম বনানীতে। অত্যন্ত বিমর্ষ দেখাচ্ছিল হুদা ভাইকে। গম্ভীরভাবে বসে ছিলেন হুদা ভাই আমার অপেক্ষায়। আমি পৌঁছাতেই আমাকে নিয়ে গেলেন ভিতরের একটা ঘরে। ডালিম, খালেদ ভীষণভাবে হতাশ করেছে আমাকে। ও কিছুতেই বুঝল না। জেনারেল জিয়ার ব্যাপারে কোন আপোষ করতে রাজী নয় খালেদ। তার মতে জিয়া আগষ্ট বিপ্লবের উদ্দেশ্যাবলীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেই ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করে চলেছে যেটা তোমরাও নাকি বুঝতে পারছ না। তার এধরণের চিন্তা এবং একগুঁয়েমির পরিণাম কি হতে পারে সেটা ভাবতেও গা শিঁউরে উঠছে আমার। শুধু তাই নয় জিয়ার বিরুদ্ধে আমার সমর্থনও চেয়েছে খালেদ। আমি তার কথা শুনে স্তম্বিত হয়ে গিয়েছিলাম। প্রশ্ন করলাম, এই অবস্থায় কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন স্যার? ঠিক বুঝতে পারছি না to be honest. চিন্তিতভাবে জবাব দিয়েছিলেন হুদা ভাই। এরপর কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে বসে ছিলাম আমরা। খালেদকে বোঝাতে না পারলেও কাছে থাকলে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করা যেত। By the way I don’t know whether you know about this or not, Brigadier Nuruzzaman is also with Khaled. খালেদের অনুরোধ আমার পক্ষে সরাসরিভাবে উপেক্ষা করাটাও would be very difficult because of our relation. You know how close we are. তা জানি। কিন্তু এতো জেনেশুনে আগুনে ঝাঁপ দেবার মত ব্যাপার স্যার। ঠিকই বলেছ তুমি। আমি কি করব সেটা জানি না তবে খালেদকে আমি পরিষ্কারভাবেই বলেছি এই মুহূর্তে যেকোন কারণেই হোক না কেন জেনারেল জিয়া অথবা মোশতাক সরকারের বিরুদ্ধে কোন পদক্ষেপ জাতীয় স্বার্থবিরোধী বলেই পরিগণিত হবে এবং জনগণ ও সৈনিকরা সেটা কিছুতেই মেনে নেবে না। তাছাড়া জেনারেল জিয়া সেনা পরিষদের মনোনীত সেনাপ্রধান; সেক্ষেত্রে তার ব্যাপারে কোন সমস্যা থাকলে সেটা আলাপ আলোচনার মাধ্যমে নিরসনে বাধা কোথায়? I think he has been intrigued and is being used by some unknown quarters. শেষের কথাগুলো অনেকটা স্বগতোক্তির মতই বললেন হুদা ভাই। চক্রান্ত সম্পর্কে অনেক খবরাখবরই আমাদের জানা আছে; সে বিষয়ে কোন আলাপ না করে আমি শুধু বলেছিলাম, Well Sir, decision is yours. আপনি একজন বিবেকবান পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক এবং মনেপ্রাণে জাতীয়তাবাদী; তাই যা ভালো বুঝবেন তাই করবেন ভবিষ্যতে। অতীতের মত ভবিষ্যতেও ব্যক্তি সম্পর্কের থেকে জাতীয় স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দিবেন আপনি সে প্রত্যশাই করব আমি। দেখা যাক কি হয়? আল্লাহ ভরসা। সবকিছুইতো পরিষ্কার বুঝে গেলেন। আমি যোগাযোগ রাখব। আমার অনুরোধ রক্ষা করে রংপুর থেকে ছুটে এসেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। ফিরে গিয়ে নীলু ভাবীকে আমার সালাম জানাবেন। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম তখন হঠাৎ করে হুদা ভাই বললেন, যাবার আগে একটা কথা শুনে যাও ডালিম। তোমার নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম এবং আন্তরিকতাকে শ্রদ্ধা করি আমি মনেপ্রাণে। সেটাই ছিল কর্নেল হুদার সাথে আমার শেষ দেখা। সেদিন গভীর রাত করে ফিরেছিলাম এক অজানা আশঙ্কা ও একরাশ চিন্তা মাথায় করে। বুঝতে পেরেছিলাম চক্রান্তের জাল ছড়িয়ে পড়েছে অনেক দূর। সারাটা পথ শুধু একটা কথাই মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল; শেষ রক্ষা বুঝি আর করা যাবে না! সময় কেটে যাচ্ছে। রঙ্গমঞ্চের সব খেলোয়াড়রাই যার যার খেলায় মত্ত। কিন্তু পর্দার অন্তরালে যে অশনি সংকেত দেখা দিয়েছে সে সম্পর্কে কেউই কিছু বুঝতে পারছে না শুধু আমরা কয়েকজন ছাড়া। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলের ঔদ্ধত্য মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। জেনারেল জিয়ার প্রায় সব নির্দেশই উপেক্ষা করে চলেছেন তারা। প্রতি রাতেই মধ্যস্থতার জন্য ছুটে যেতে হচ্ছে তাদের বিরোধের মীমাংসা করার জন্য। সামরিক বাহিনীর আভ্যন্তরীন অবস্থাকে ভীষণভাবে অস্থিতিশীল করে তুলেছেন তারা। একদিন সন্ধ্যায় জেনারেল জিয়া আমাকে জরুরী তলব করে পাঠালেন। খবর পেয়েই গেলাম তার বাসায়। অত্যন্ত বিমর্ষ দেখাচ্ছিল তাকে। ক্ষমতার লোভে খালেদ মরিয়া হয়ে উঠেছে। We have got to do some thing about it before it is too late. সব প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব ও ক্ষমতা রয়েছে আপনার। সেক্ষেত্রে যা কিছু করার সেটাতো আপনাকেই করতে হবে স্যার। You are right. ঠিক বলেছ তুমি। জবাবটা দিয়ে চুপ করে কি যেন ভেবে নিচ্ছিলেন জেনারেল জিয়া। ঠিক করেছি তালিকাভুক্ত অফিসারদের চাকুরিচ্যুতির ফাইল নিয়ে যাব প্রেসিডেন্টের কাছে। আর দেরি করা উচিত হবে না। এই কাজটা আরো অনেক আগেই করা উচিত ছিল স্যার। however it is always better to be late than never. ১ম ফিল্ড রেজিমেন্ট এবং ৮ম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঢাকায় আনার ব্যাপারে কতটুকু কি করলেন? আমার প্রশ্নের জবাবে চীফ বললেন, খালেদ এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। সেটাইতো স্বাভাবিক! তিনি ভাল করেই জানেন এই দু’টো ইউনিটকে ঢাকায় আনলে তার পক্ষে রাজধানীতে কিছুই করা সম্ভব হবে না। এ ব্যপারে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে ব্রিগেডিয়ার খালেদের মতকে উপেক্ষা করেই আপনাকে ইউনিট দু’টোকে অতিসত্ত্বর ঢাকায় নিয়ে আসতে হবে। আমাদের পোষ্টিং এর ব্যাপারেও আর দেরি করা উচিত হবে না। পোষ্টিং অর্ডারটা বেরোলে আমরাও তখন প্রত্যক্ষভাবে আপনার পাশে থেকে আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারব। জেনারেল জিয়া আমার কথাগুলো নিশ্চুপ বসে শুনছিলেন আর ভাবছিলেন। আমাদের এই আলোচনার দু’দিন পর জেনারেল জিয়া প্রেসিডেন্টের কাছে ফাইলটি উপস্থাপন করেন। প্রেসিডেন্ট তক্ষুণি ফাইলে সই না করে বলেছিলেন যে, এ ব্যাপারে জেনারেল ওসমানীর মতামত নেবার পরই তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। প্রেসিডেন্টের অভিপ্রায় জেনারেল জিয়ার কাছ থেকে জানার পর জেনারেল ওসমানীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ফাইলটির ব্যাপারে। তিনি পরিষ্কার কোন জবাব না দিয়ে বলেছিলেন, বিষয়টি তার ও প্রেসিডেন্টের বিবেচনাধীন রয়েছে। তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছেন। যেকোন কারণেই হোক ফাইলটা চাপা পড়ে থাকলো। ব্যাপারটা বেশ রহস্যজনক ঠেকলো। কিছুটা দুর্বোধ্যও। ভাবলাম, দেখা যাক কয়েকটা দিন অপেক্ষা করে কি হয়। এদিকে কর্নেল ফারুক ও কর্নেল রশিদের আচরণে সেনাবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের একাংশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন বলে একটা রটনা রটে। এই সামান্য বিষয় টিকে সুযোগ হিসাবে ব্যবহার করতেও ছাড়লেন না ব্রিগেডিয়ার খালেদ-কর্নেল শাফায়াত এবং তাদের দোসররা। নানা ধরণের কুৎসা রটনা করতে লাগলেন তারা। তাদের মিথ্যা প্রচারণা আগুনে ঘি ঢালার মতই সার্বিক পরিস্থিতিকে আরো ঘোলাটে করে তুললো। ক্রমান্বয়ে আর্মির চেইন অব কমান্ডকে অকেজো করে তুলেছে CGS ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল। জেনারেল জিয়া তাদের হাতে প্রায় জিম্মী হয়ে পড়লেন। চীফ অফ আর্মি ষ্টাফ হিসাবে তার দৈনন্দিন কার্যক্রমেও তারা বাধাঁর সৃষ্টি করতে লাগলেন। অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলাম; যেকোন প্রতিবিপ্লবের মোকাবেলা করার জন্য বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জাতীয়তাবাদী এবং দেশপ্রেমিক সব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করা উচিত। আলোচনা হল। সোভিয়েত-ভারত মদদপুষ্ট যেকোন প্রতিবিপ্লবী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন সবাই। সব কিছু জানার পর কর্নেল তাহের বলেছিলেন, এই মুহূর্তে জেনারেল জিয়ার বিরোধিতা করা দেশদ্রোহিতারই সমান। কারণ, বর্তমান অবস্থায় সেনাবাহিনীর পুনর্গঠন এবং ঐক্যের প্রয়োজনে জেনারেল জিয়ার কোন বিকল্প নাই। তাছাড়া যেকোন বৈদেশিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলার জন্য জিয়ার ভাবমূর্তি ও ব্যক্তিত্ব বিশেষভাবে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। তাই জিয়াকে আমাদের যে করেই হোক না কেন; বাঁচিয়ে রাখতে হবে বিপ্লবের স্বার্থে, জাতীয় স্বার্থে। তিনি দ্ব্যার্থহীনভাবে আরো বলেছিলেন, অবশেষে খালেদ যদি সত্যিই জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবিপ্লবী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তবে তার নেতৃত্বাধীন গণবাহিনী সেনা পরিষদের সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে সেই চক্রান্তের বিরোধিতা করবে। আবার আমরা শুরু করব সমাজ পরিবর্তনের অসমাপ্ত বিপ্লব। বিদেশী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার স্বার্থে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করতে হবে অন্যান্য সব জাতীয়তাবাদী এবং প্রগতিশীল দল ও গ্রুপগুলোর সাথে। এ ব্যাপারে আমাদের বিভিন্ন মহলের সাথে আলোচনার কথা শুনে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। সে দিন আমাদের আলাপ হচ্ছিল পুরনো বন্ধুত্বের পরিপ্রেক্ষিতে। একান্ত বিশ্বাস এবং নির্ভরশীলতার সাথে আলোচনা করেছিলাম আমরা। সেদিন কোন বিশেষ দলের নেতা হিসাবে কথা বলছিলেন না কর্নেল তাহের। তার অঙ্গীকারে খুঁজে পেয়েছিলাম নিষ্কলুশ-নিবেদিত প্রাণ, দেশপ্রেমিক একজন সাচ্চা মুক্তিযোদ্ধার আন্তরিক উৎকন্ঠা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে একদিন কোয়েটা থেকে একত্রে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা প্রণয়নে নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম আমাদের অনুপ্রাণিত করেছিল সেই একই অনুপ্রেরণায় আজ আবার জাতির এক মহা ক্রান্তিলগ্নে আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ হলাম জাতীয় স্বার্থবিরোধী যেকোন চক্রান্তের মোকাবেলা করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। দেশ ও জাতীয় স্বার্থের প্রশ্নে আমরা এক ও অভিন্ন। সিদ্ধান্ত নেয়া হল, যেকোন হুমকির মোকাবেলা করার জন্য সেনা পরিষদ এবং গণবাহিনীকে যৌথভাবে প্রস্তুত করে তুলতে হবে অতি সতর্কতার সাথে। কর্নেল তাহের এবং আমাদের মাঝে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের বন্দোবস্ত করা হল। এদিকে আমাদের চাকুরিতে পুনর্বহালের গেজেট নোটিফিকেশন বেরুলেও পোষ্টিং অর্ডার তখন পর্যন্ত বেরোয়নি। লিষ্টেড অফিসারদের চাকুরিচ্যুতির ফাইলটিও সই হয়ে আসেনি প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে। বুঝতে পারলাম বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের কূটচালের পরিপ্রেক্ষিতেই এই দু’টো বিষয়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বিলম্বিত হচ্ছে। গলদটা যে কোথায় সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেও কোন হদিস পেলাম না আমলাতান্ত্রিক মারপ্যাঁচের গোলক ধাঁধাঁয়। সংকট ঘণীভূত হতে থাকল। সেপ্টেম্বরের শেষে এক দুপুরে মেজর নূর এসে উপস্থিত হল আমার ঘরে। নূরের সাথে আলাপের পর সেদিনই ছুটে গিয়েছিলাম জেনারেল জিয়ার কাছে। তার বাসার লনে বসেই কথা হচ্ছিল, ২রা নভেম্বর ১৯৭৫ সাল। গত বেশ কয়েকদিন কাজের চাপে বাসায় যাওয়া হয়নি। ঠিক করলাম দুপুরের পর কিছু সময়ের জন্য বাসায় যাব। প্ল্যান মাফিক লাঞ্চের পর এক ফাঁকে চলে এলাম মালিবাগে। বেশ কয়েকদিন বিরতির পর হঠাৎ আমার আগমনে বাসার সবাই খুব খুশী হল। সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া, হৈ হুল্লোড় করা হল আনন্দঘন পরিবেশে। সন্ধ্যায় নিম্মীকে নিয়ে গেলাম মিনু ফুপ্পুর বাসায়। রাতের খাওয়া ওখানেই খেতে হল। বেশ রাত অব্দি গল্প গুজব করে আমি আর নিম্মী ফিরছিলাম মালিবাগে। হঠাৎ নিম্মী বলল, আমরা জিপে করে গিয়ে উপস্থিত হলাম ফুলার রোডে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের বাসায়। ওখানে তখন মহুয়া এবং লিটু থাকত। উদ্দেশ্য খাকি পোষাক বদলে সাধারণ কাপড় পরে নেবো। ঘুম থেকে মহুয়াদের ডেকে তুললাম। সংক্ষেপে মহুয়া এবং লিটুকে অবস্থা বুঝিয়ে লিটুর কয়েকপ্রস্ত কাপড় চেয়ে নিয়ে আমরা সবাই ড্রেস পরিবর্তন করে নিলাম। মহুয়া জিজ্ঞেস করল, শাহরিয়ারের ওখান থেকে বেরিয়ে সোজা চললাম ক্যান্টনমেন্টের দিকে। এয়ারর্পোট ছাড়িয়ে একটু এগুতেই দুই ট্রাক সৈনিক দেখতে পেলাম মাউন্টেড অবস্থায়। কাছে যেতেই দেখলাম তারা ৪র্থ ইষ্টবেঙ্গলের। contingent commander কে জিজ্ঞাসা করলাম, তার বাসাতেই গেলাম প্রথম। বাসায় তাকে পাওয়া গেল না। বাসা থেকে বলা হল, তিনি সেনা সদরে গেছেন। পৌঁছালাম সেনা সদরে। সেখানেও কেউ নেই। সেন্ট্রি, ডিউটি অফিসার ও ক্লার্ক ছাড়া পুরো সেনা সদরটা নিস্তব্ধ। সেখান থেকে গেলাম মেজর হাফিজের বাসায়। হাফিজ বাসায় নেই। ইকবালের খোঁজ করে তাকেও পাওয়া গেল না। এরপর গেলাম কর্নেল শাফায়াত জামিলের বাসায়। সেখান থেকে জানানো হল তিনি ব্রিগেড হেডকোয়াটার্সে গেছেন। সেখান থেকে ব্রিগেড হেডকোয়াটার্সে যাবার পথে দেখলাম জেনারেল জিয়ার বাসার সামনে অস্বাভাবিক কিছুই নেই। ডিউটিরত গার্ডসরা তাদের দায়িত্ব পালন করছে। ব্রিগেড হেডকোয়াটার্সেও নেই তারা। সেখান থেকে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টের গেইট দিয়ে ঢুকতেই দেখি ট্রুপসরা সেখানে সব stand to অবস্থায় পজিশন নিয়ে আছে। এ ধরণের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কেন জানতে চাইলে আমাদের বলা হল যে, সন্ধ্যার পর রাতের আঁধারে ৪র্থ বেঙ্গল ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টের দিকে তাক করে তাদের RR (recoilless rifle) এবং সৈন্য মোতায়েন করেছে; তাই তারাও পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ৪র্থ বেঙ্গল এবং ২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট পাশাপাশি দু’টি ইউনিট। তাদের মধ্যে এ ধরণের উত্তেজনা যেকোন সময় বিষ্ফোরন ঘটাতে পারে। উত্তেজনা কমানোর জন্য সেনা পরিষদের সদস্যদের সার্বিক অবস্থা বুঝিয়ে তাদের বললাম, এই অবস্থায় সতর্ক অবশ্যই থাকতে হবে সবাইকে। আরো জানালাম, আমরা ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল শাফায়াতকে খুঁজছি। ওদের পেলেই উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ৪র্থ বেঙ্গলের উস্কানিমূলক কার্যক্রম বন্ধ করার বন্দোবস্ত করব। সেখানেই জানতে পারলাম মহারথীরা সব ৪র্থ বেঙ্গল হেডকোয়াটার্সে রয়েছেন। ৪র্থ বেঙ্গলের গেইট দিয়ে ঢুকতেই নজরে পড়ল সাজ সাজ রব। ভীষণ ব্যস্ততা! সৈনিকদের রনসজ্জায় সজ্জিত করে রাখা হয়েছে। কিছুদূর এগুতেই ক্যাপ্টেন কবিরের দেখা পেলাম। একটি এসএমজি কাধে ঝুলিয়ে সে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে। আমাকে দেখে এগিয়ে এল কবির। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি অযৌক্তিকভাবেই সব ঘটনার জন্য আমাকেই দোষারোপ করছ। যা ঘটেছে তার জন্য শুধুমাত্র একা আমি দায়ী নই। জিয়ার বিরুদ্ধে তরুণ অফিসাররা অসন্তুষ্ট। তারা বুঝতে পেরেছে কোন বিপ্লবের নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা তার নেই। মোশতাক এবং জিয়ার উপর বিতশ্রদ্ধ; তাই তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছে এদের বিরুদ্ধে। বলেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ কর্নেল শাফায়াত, মেজর হাফিজ, ক্যাপ্টেন ইকবাল, ক্যাপ্টেন নাসের, ক্যাপ্টেন কবির প্রমুখের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন। এদের অনুরোধেই আমাকে এখানে আসতে হয়েছে। বুঝলাম, তীক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী চতুর ব্রিগেডিয়ার খালেদ অতি কৌশলে গা বাঁচিয়ে অন্যদের কাঁধে বন্দুক রেখে নিজের উচ্চাভিলাস চরিতার্থ করার উদ্যোগ নিয়েছেন। আসার পথে দেখলাম রাস্তাঘাটে মানুষজন র্নিলিপ্তভাবে চলাফেরা করছে। স্বাভাবিক অবস্থায় ঢাকা শহর কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছে। স্বাভাবিক অবস্থার আড়ালে কি ভীষণ বিষ্ফোরন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে সে বিষয়ে জনগণ এখন পর্যন্ত বেখবর। অন্যান্য দিনের মতই আজও তারা বেরিয়ে পড়েছে জীবিকার তাড়নায়। বঙ্গভবনের গেটেই নজরে পড়ল বিডিআর-এর সশস্ত্র সৈনিকরা পজিশন নিয়ে আছে। মিলিটারি সেক্রেটারীর কামরায় কর্নেল মান্নাফ ও মেজর মালেককে বসিয়ে আমি ও নূর গিয়ে ঢুকলাম প্রেসিডেন্টের কামরায়। সেখানে প্রেসিডেন্টের সাথে জেনারেল ওসমানী ও কর্নেল রশিদকে আলাপরত অবস্থায় পেলাম। হুদা ব্যস্ত ছিল নোট নেয়ায়। আমরা ঢুকতেই তারা জানতে চাইলেন, ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা কি? আমি বিস্তারিত সবকিছু খুলে বলে জানালাম, ব্রিগেডিয়ার খালেদের নেতৃত্বেই ঘটেছে সব কিছু। তাদের সবার তরফ থেকে চারটি দাবি নিয়ে এসেছেন কর্নেল মান্নাফ এবং মেজর মালেক। এরা দু’জনেই জেনারেল ওসমানীর কাছে বিশেষভাবে পরিচিত; তাই নাম শুনতেই ক্রোধে ফেটে পড়লেন, প্রেসিডেন্টের জবাব শুনার পর কর্নেল মান্নাফ এবং মেজর মালেকের সঙ্গে ফিরে এলাম ৪র্থ বেঙ্গল হেডকোয়ার্টাস। ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং অন্যান্য সবাই আমাদের ফিরে আসার প্রতীক্ষায় উদ্গ্রীব হয়ে ছিলেন। কর্নেল মান্নাফ সবার উপস্থিতিতে প্রেসিডেন্টের বক্তব্য হুবহু তুলে ধরলেন। প্রেসিডেন্টের বক্তব্য শুনে ব্রিগেডিয়ার খালেদ বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। তিনি বুঝতে পারলেন, খন্দোকার মোশতাকের কাঁধে বন্দুক রেখে তার অভিসন্ধি হাসিল করা সম্ভব হবে না। ব্রিগেডিয়ার খালেদের চাল যে করেই হোক না কেন তীক্ষ্ম বুদ্ধির অধিকারী জনাব মোশতাক ধরে ফেলেছেন এবং তাই তিনি তার ফাঁদে পা দিতে অস্বীকার করেছেন। মুহুর্তে চাঁপা আক্রোশে ফেটে পড়ল সবাই। কর্নেল শাফায়াত ক্ষোভে বলে উঠলেন, এভাবেই ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার সহযোগিদের সাথে বোঝাপড়া শেষ করে বঙ্গভবনে ফিরে এলাম। সঙ্গে এসেছিলেন তাদের দুই প্রতিনিধি কর্নেল মান্নাফ এবং মেজর মালেক। পথে নূর আমায় বলল, ৩রা নভেম্বর অতি প্রত্যুষে ব্রীগেডিয়ার খালেদ ক্যাপটেন নাসের এবং রক্ষী বাহিনীর এক লিডারকে সবার অজ্ঞাতে পাঠান মেজর মোমেনকে তার বাসা থেকে ধরে নিয়ে আসার জন্য। নির্দেশ পালনকারীরা তাকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে আসে। মেজর মোমেন তখন বেঙ্গল ল্যান্সারস এর অধিনায়ক। কোথায় তাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জিজ্ঞেস করা সত্ত্বেও তারা মিসেস মোমেনকে কিছুই বলেনি। এতে ভাবী শংকিত হয়ে তক্ষুনি বঙ্গভবনে মেজর হুদার কাছে বিষয়টি জানান। সব শুনে মজর হুদা অতি সহজেই বুঝতে পারে এর পেছনে কোন অশুভ ইংগিত রয়েছে। অবিলম্বে মেজর হুদা ল্যেফটেনেন্ট কিসমত হাসেমকে বিষয়টি জানিয়ে তাকে সতর্ক অবস্থায় থাকার নির্দেশ দেয়। ল্যেফটেনেন্ট কিসমত হাশেম তখন বালুর ঘাটে ট্যাংক স্কোয়াড্রনগুলোর অধিনায়ক। ঢাকা সেনানিবাস ঘিরে ডেপ্লয়েড ট্যাংকগুলোর তত্ত্বাবধানের দায়িত্বও ছিল তার উপর। মেজর হুদার কাছ থেকে বিস্তারিত সবকিছু জানার পর ল্যেফটেনন্ট কিসমতও অতি সহযেই বুঝতে পারে যে, মেজর মোমেন কে জিম্মি হিসাবেই বন্দী করে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন ব্রিগেডিয়ার খালেদ বালুর ঘাটের হেডকোর্য়াটার্স এর অধিনস্থ ট্যাংক স্কোয়াড্রনগুলোকে কব্জা করার চেষ্টা অবশ্যই করবেন। কারন এই ট্যাংকগুলোই তখন ক্ষমতার ভারসম্যে ছিল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। সার্বিক অবস্থার বিশ্লেষনের পর ল্যেফটেনেন্ট কিসমত অবিলম্বে যথাযত ব্যাবস্থা গ্রহণ করে। ল্যেফটেনেন্ট কিসমতের ধারনা সঠিক প্রমানিত হল। অল্প সময়ের ব্যাবধানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ রক্ষীবাহিনীর লিডার শরিফকে পাঠালেন বালুর ঘাটে। শরিফের পরনে ছিল সেনাবাহিনীর পোষাক ও ল্যেফটেনেন্ট এর ব্যাজ। শরিফের আগমনে ল্যেফটেনেন্ট কিসমতের বুঝতে অসুবিধা হল না যে এটা ব্রিগেডিয়ার খালেদের প্রথম চাল। পরবর্তিতে আরও চাল চালা হবে। হলও ঠিক তাই। কিছুক্ষন পরই কোথা থেকে হটাৎ ক্যাপটেন নাসের ও দফাদার মুজিব একদা পি.এম.এ তে কিসমতের ড্রিল শিক্ষক, হেডকোয়র্টার্স এ ল্যেফটেনেন্ট কিসমতের সামনে এসে হাজির হল। প্রথা অনুযায়ী কুশলাদি বিনিময়ের পর হঠৎ করে ক্যাপটেন নাসের জানতে চাইল রেজিমেন্টে কোন কোন অফিসার উপস্থিত আছে। একই সাথে দফাদার মুজিব ল্যেফটেনেন্ট কিসমতকে ক্যাপটেন নাসেরকে কমান্ড হস্তান্তরের অনুরোধ জানাল। ‘আকলমন্দ কি লিয়ে ইশারাই কাফি’, ল্যেফটেনেন্ট কিসমত বুঝে ফেললো আসল মতলব। কোন জবাব কিংবা কোন প্রতিক্রিয়ার সুযোগ না দিয়ে ল্যেফটেনেন্ট কিসমত ইশারায় ডিউটিরত গার্ডদের নির্দেশ দিল দুজনকেই কোর্য়াটার গার্ডে বন্দী করে রাখতে। রক্ষী লিডার শরিফকেও নির্দেশ দেয়া হল রেজিমেন্ট ছেড়ে না যাওয়ার জন্য। কিসমতের এই তরিৎ পদক্ষেপ এবং সিদ্ধান্তে সম্পূর্ণরূপে মূষিকে পরিণত হল রক্ষী লিডার শরিফ। কড়া নজরদারীর পরিপ্রেক্ষিতে শুধুমাত্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা ছাড়া অসহায় শরিফের কিছুই করার থাকল না। খবরটা ব্রিগেডিয়ার খালেদের কাছে পৌঁছানোর পর মুহুর্তেই ল্যেফটেনেন্ট কিসমতের কাছে ফোন এল। অপর প্রান্তে মেজর মোমেন। তিনি কিসমতকে অনুরোধ জানালেন গ্রেফতারকৃত ক্যাপটেন নাসের ও রক্ষী লিডার শরিফকে ছেড়ে দিতে। তার কথা বলার ধরনই স্পষ্ট প্রমাণ করছিল চাপের মুখেই তিনি অনুরোধ জানাচ্ছিলেন। তবুও একজন ডিসিপ্লিনড অফিসার হিসাবে মেজর মোমেনের অনুরোধ উপেক্ষা করার কাজটি সহজ ছিল না। কিন্তু সেই ক্রান্তিলগ্নে ল্যেফটেনেন্ট কিসমত তার স্বত্তার প্রকাশ ঘটালো। সব দ্বিধা কাটিয়ে দৃঢ়তার সাথে জবাব দিল, যতক্ষনঅব্দি মেজর মোমেন রেজিমেন্টাল হেডকোয়র্টাস এ না ফিরবেন সে বন্দীদের মুক্ত করবে না। ল্যেফটেনেন্ট কিসমতের জবাব জানতে পেরে ব্রিগেডিয়ার খালেদ বুঝতে পারলেন তার কূটচাল কার্যকারি হবার আর কোন সম্ভাবনাই নেই। তার জাড়িজুড়ি ধরা পরে গেছে। অগত্যা বাধ্য হয়ে তিনি বন্দী বিনিময় করতে রাজি হলেন। মেজর মোমেন এসে পৌঁছালেন হেডকোয়র্টাস এ, পরিবর্তে দুই বন্দীকে মুক্তি দিয়ে ফেরত পাঠানো হল। মেজর হুদার সময়মতো খবর পৌঁছানো এবং ল্যেফটেনেন্ট কিসমতের একজন সাচ্চা বিপ্লবীর মতো অবস্থার যোগ্য মোকাবেলার পরিপ্রেক্ষিতে চক্রান্তকারীদের আর একটি দুরভিসন্ধি বানচাল হয়ে গেল। ফিরে এসে মেজর মোমেন ল্যেফটেনেন্ট কিসমতকে তিরস্কারের পরিবর্তে বরং তার অনুরোধ উপেক্ষা করার সাহসিকতা এবং উপস্থিত বুদ্ধির মাধ্যমে তাকে বাচানোর জন্য কৃতজ্ঞতাই জানিয়েছিলেন। এ ধরনের ন্যক্কারজনক প্রতারনামূলক পদক্ষেপ এটাই প্রমাণ করে যে স্বীয় উচ্চাভিলাষ চিরতার্থে করার লক্ষে ক্ষমতা পাওয়ার জন্য কতটুকু মাতাল হয়ে উঠেছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। যাই হউক আমি প্রেসিডেন্টকে জানালাম, চক্রান্তকারীরা জাষ্টিস সায়েমের মাধ্যমে ক্ষমতা পুনর্দখলের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। সব শুনে প্রেসিডেন্ট মোশতাক জাষ্টিস সায়েমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তার এ সিদ্ধান্তের কথা জেনে নিয়ে কর্নেল মান্নাফ এবং মেজর মালেক বঙ্গভবন থেকে ফিরে যান। প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তের পর সেনা পরিষদের কার্যনিবাহী কমিটির উপস্থিত সদস্যদের নিয়ে এক জরুরী বৈঠক হয়। বৈঠকে বাস্তব অবস্থার পর্যালোচনার পর সিদ্ধান্ত গৃহিত হয় যে, শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের exposed নেতারা কৌশলগত কারণে দেশ ত্যাগ করে দেশের কাছাকাছি কোন রাষ্ট্রে সাময়িকভাবে অবস্থান নেবে। সার্বিক বিবেচনায় ব্যাংকককেই সর্বত্তোম জায়গা হিসাবে বিবেচিত করা হয়। এরপর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, কি করে খালেদ চক্রের পতন ঘটাতে হবে সেই বিষয়ে। জাতীয় বেঈমান পরাজিত আওয়ামী-বাকশালী গোষ্ঠি এবং তাদের মুরুব্বী ভারতের হাতে ক্রীড়নক খালেদ চক্রকে উৎখাত করার জন্য সেনা পরিষদ কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন গণবাহিনী এবং জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক অন্যান্য দল ও গ্রুপ নূন্যতম কর্মসূচীর ভিত্তিতে খালেদ চক্রের মুখোশ উন্মোচিত হবার পর উপযুক্ত সময়ে ঐক্যবদ্ধভাবে আর একটি অভ্যুত্থান ঘটাবে সেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ঐ বৈঠকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল সেটা ছিল প্রেসিডেন্ট মোশতাক এবং জেনারেল জিয়াউর রহমান সম্পর্কে। সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খালেদ চক্রের পতনের পর সর্বপ্রথম কাজ হবে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে তাকে আবার সেনা প্রধান হিসাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। নিজ পদে অধিষ্ঠিত হবার পর জেনারেল জিয়াউর রহমান জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার আহবান জানাবেন। আরো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, নেতৃবৃন্দের যে অংশ ব্যাংককে অবস্থান করবে তারা প্রয়োজনমত যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে সেনা পরিষদ ও কর্নেল তাহেরের সাথে। জরুরী বৈঠকের সিদ্ধান্তগুলো বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টের ইউনিটগুলোকে জানিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হয়। কর্নেল তাহেরও তখন বঙ্গভবনে উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে তিনি বঙ্গভবন ত্যাগ করেন। বৈঠক যখন শেষ হয় তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যাংককে যাবার সব ব্যবস্থা করার জন্য প্রেসিডেন্ট সেক্রেটারিয়েট থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্দেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্রিগেডিয়ার খালেদকে আমাদের দেশ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত জানাবার জন্য ফোন করলাম। তা যাই হউক না কেন সত্য কথাটি হল দেশ ও জাতিকে একটি সম্ভাব্য আত্মঘাতী রক্ত ক্ষরন থেকে বাঁচানোর লক্ষে কৌশলগত কারণেই ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ সাল রাত সাড়ে দশটায় বিমানের একটি স্পেশাল ফ্লাইটে আমরা দেশ ছেড়ে চলে এসেছিলাম ব্যংককে। ঐ ধরনের রক্ত ক্ষরনের পরিনাম শুধু যে বিভিৎস হত তাই নয়; জাতিকে হারাতে হত ১৫ই আগষ্ট বিপ্লবের মাধ্যমে সদ্যলব্ধ পুনঃঅর্জিত মুক্তি। আমাদের দেশ ত্যাগের মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে মূলতঃ সেনা পরিষদ এবং কর্নেল তাহেরের অধীনস্থ গণবাহিনীর যৌথ নেতৃত্বে সংঘটিত হয় ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক সিপাহী জনতার বিপ্লব। ক্ষমতাচ্যুত হয় খালেদ চক্র। জাতীয় বেঈমান ও তাদের বিদেশী প্রভুদের সব চক্রান্তের জাল ছিন্নভিন্ন করে দেয় অকুতোভয় দেশপ্রেমিক সৈনিকেরা। দেশের আপামর জনসাধারণ ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবকে স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন জানিয়ে সেনাবাহিনীর বীর জোয়ানদের সাথে যোগ দেয় ঠিক একইভাবে যেভাবে তারা সমর্থন জানিয়েছিল আগষ্ট বিপ্লবকে। এই দুই ঐতিহাসিক দিনে জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্ভুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের সর্বত্র সংগ্রামী জনতার ঢল নেমেছিল পথে প্রান্তরে, অলিতে গলিতে, শহরে গ্রামে। সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ এবং জনগণের একাত্মতায় সৃষ্টি হয়েছিল এক র্দুভেদ্য জাতীয় ঐক্য। সেই দুই ক্রান্তিলগ্নে সম্মিলিতভাবে তারা বাংলাদেশকে পরিণত করেছিল এক দুর্জয় ঘাঁটিতে। সমগ্র জাতি প্রস্তত ছিল জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যে কোন আগ্রাসন কিংবা হুমকির বিরোধিতা করার জন্য। সফল বিপ্লবের পর কুচক্রীদের নেতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং তার কয়েকজন ঘনিষ্ট সহযোগী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে বিপ্লবীদের হাতে নিহত হন। কর্নেল শাফায়াত জামিল ও অন্যান্যদের বন্দী করা হয়। পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে আবার তাকে আর্মি চীফ অফ স্টাফের পদে অধিষ্ঠিত করা হয়। তিনি জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার আবেদন জানান। কিন্তু জনাব খন্দোকার মোশতাক আহমদ জেনারেল জিয়াউর রহমানের আবেদনে পুনরায় রাষ্ট্রপতি হতে অসম্মতি প্রকাশ করেন। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ না করার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি ঐদিনই জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণ দান করে ৭ই নভেম্বরের ইতহাসিক সিপাহী-জনতার বিপ্লবের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানান। ১৫ই আগষ্ট এবং ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক ঘটনা দুইটি বিচ্ছিন্ন নয়। ঘটনা দুইটি একই সূত্রে বাঁধা। একই চেতনায় উদ্ভুদ্ধ সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যগন অগ্রনী হয়ে সংঘটিত করেছিলেন এই দুইটি জনপ্রিয় সফল বিপ্লব। ১৫ই আগষ্ট অগ্রণীর ভূমিকায় ছিল সেনা পরিষদ আর ৭ই নভেম্বর একই দায়িত্ব যৌথভাবে পালন করেছিল সেনা পরিষদ এবং কর্নেল তাহেরের অধীনস্থ গণবাহিনী। এই দুইটি ঐতিহাসিক জনপ্রিয় বিপ্লবের চেতনা ছিল জাতীয় অস্তিত্ব রক্ষার চেতনা, গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার চেতনা, ইন্দো-সোভিয়েত বলয়ের নাগপাশ ছিন্ন করে জাতীয় স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার চেতনা, স্বৈরশাসন ও একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে শ্বাসরূদ্ধকর অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করার চেতনা, এক কথায় বলতে গেলে ’৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ৩রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বর এই সময়ের আমার এ ঘটনা বিবরণের স্বপক্ষে প্রমাণ হয়ে আছে ৭ই নভেম্বর সফল বিপ্লবের পর সৈনিক জনতার মুখে ধ্বনিত শ্লোগানগুলো। সেদিন ঢাকার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছিল গগনবিদারী শ্লোগানে: - ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্টের বিপ্লব দেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিল। সমসাময়িক দেশ বিদেশের প্রতিক্রিয়াতেই তা লেখা রয়েছে। ইতিহাসেও তা থাকবে। আজ আর একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, স্বাধীনতার যাত্রাকাল থেকে ক্ষমতাসীনরা যদি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করত, যদি সুষ্ঠু বিচার ব্যবস্থা থাকত, যদি বেঁচে থাকার মৌলিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক কার্যক্রম ও সংগঠনের স্বাধীনতা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকত, যদি অন্যায়, অত্যাচার, হত্যা, নির্যাতন না হত, যদি সরকার পরিবর্তনের নিয়মতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বহাল থাকত তাহলে দুর্বিষহ যন্ত্রণা থেকে নাজাত পাওয়ার জন্য ’৭৫ এর ১৫ই আগষ্ট বিপ্লবের প্রয়োজন হত না। ১৬ই আগষ্ট ১৯৭৫ দৈনিক ইত্তেফাকে ‘ঐতিহাসিক নবযাত্রা’ নামে সম্পাদকীয়ের অংশবিশেষ পাঠকদের জন্য তুলে ধরছি: - ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ এর সফল বিপ্লব বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণের গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ইতিহাসে একটি মাইলফলক হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। অম্লান হয়ে থাকবে নিজ মহিমায়। সেদিন আগষ্ট বিপ্লবের ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের মাটি থেকে স্বৈরশাসনের একনায়কত্ব ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থার পতন ঘটেছিল এবং উম্মোচিত হয়েছিল বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার দ্বার। আগষ্ট বিপ্লব বাকশালী কালো অধ্যায়ের অবসান ঘটিয়ে রাজনীতিতে গতিশীলতার সৃষ্টি করে সূচনা করে এক নতুন দিগন্তের। ১৫ই আগষ্ট বিপ্লব ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর যে জাতীয়তাবাদী চেতনা ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির উন্মেষ ঘটেছিল জাতীয় জীবনের প্রতিক্ষেত্রে তারই ধারা আজও দুর্বার গতিতে বয়ে চলেছে। নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম ও জাতীয় মুক্তির প্রতীক ১৫ই আগষ্টের সফল বিপ্লব ও তার চেতনা সর্বকালে সর্বযুগে এদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক ও সচেতন নাগরিক ও ভবিষ্যত প্রজন্মকে প্রেরণা যোগাবে নব্য সৃষ্ট মীরজাফর ও জাতীয় বেঈমানদের উৎখাত করতে। জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করার জ্বলন্ত নিদর্শন ১৫ই আগষ্টের মহান বিপ্লব। এই সত্যের পরিপ্রেক্ষিতে ১৫ই আগষ্ট কে অবহেলা করে শুধুমাত্র ৭ই নভেম্বর কে এককভাবে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ হিসাবে স্বীকৃতি দেবার যৌক্তিকতা কি বাস্তব সম্মত? ইতিহাসের যুগান-কারি এই দুইটি বিপ্লব কি সম মর্যাদার দাবীদার নয়? এর মূল্যায়নের দায়িত্বভার পরিশেষে প্রিয় দেশবাসীর বিবেকের উপরই ন্যাস্ত থাকলো। |
||