মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
.. জিয়া   থেকে   খালেদা   অতঃপর
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 

বীরাঙ্গনা কোহিনূর

 
   
 

৪ নং সেক্টরের ফুলতলা ক্যাম্প। প্রায় শ’তিনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে সেই ক্যাম্পে। ক্যাম্প পরিদর্শনে এসেছি। দুপুরের খাওয়ার পর্ব শেষ। তাবুতে বিছানায় শুয়ে অলস দুপুরে সময় কাটাচ্ছিলাম।
- May I come in Sir?     
-কে? জিজ্ঞাসা করতে তাবুতে ঢুকল ফারুক।
-কি ব্যাপার ফারুক, কিছু বলবে?
-হক ভাই, কয়েকদিন ধরে জহির দু’দিনের জন্য ছুটি চাচ্ছে। সাথে তিনটি গ্রেনেড নিয়ে যেতে চায়।

জহির একজন সেকশন কমান্ডার। সাহসী গেরিলা। ছুটিতে যাবে তাতে আপত্তি নেই কিন্তু সাধারণ নিয়মে কেউ ছুটিতে গেলে তাকে কোন হাতিয়ার দেবার নিয়ম নেই। সব জেনে জহির গ্রেনেড চাচ্ছে কেন? আমার আদেশ ছাড়া জহিরকে গ্রেনেড দিয়ে ছুটিতে পাঠানো সম্ভব নয় বলেই ফারুক কথাটা আমার কাছে তুলেছে। আমিও কিছুটা আশ্চর্য্য হয়ে ভাবলাম জহিরের মত দায়িত্ববান ছেলে সব নিয়ম জেনেও গ্রেনেড নিয়ে যেতে চাচ্ছে কেন? বললাম,
-জহিরকে পাঠিয়ে দাও। অল্পক্ষণ পরেই এসে হাজির হলো জহির।
-কি ব্যাপার জহির? গ্রেনেড নিয়ে ছুটিতে যেতে চাচ্ছ কেন?
-স্যার, ভাবছিলাম ছুটিতে গিয়ে একটা অপারেশন করে ফিরব।

জহির অত্যন্ত দায়িত্ববান ছেলে। অনেক অপারেশনে সে তার যোগ্যতা প্রমাণ করেছে। তাকে সব ব্যাপারেই বিশ্বাস করা চলে। স্বল্পভাষী জহির। বিয়ানী বাজার শেওলার মাঝখানে তাদের গ্রাম। নিশ্চয়ই কোন টার্গেটের সন্ধান পেয়েছে ও। সাধারণতঃ মুক্তিযোদ্ধাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই তাদের আমরা ছুটিতে যাবার সময় কোন হাতিয়ার সঙ্গে নিতে দেই না।
-টার্গেটটা কি? জিজ্ঞাসা করলাম জহিরকে।
-খানসেনাদের আড্ডা। এর বেশি বিস্তারিত এই মুহুর্তে আপনাকে কিছু বলতে পারব না, স্যার। অপারেশন সফল হলে সবকিছু ফিরে এসে বলব।

কিছুদিন আগে জহির আর একবার ছুটিতে গিয়েছিল দেশের বাড়িতে। সে সময়ই ও নিশ্চয়ই কোন খবর সংগ্রহ করে ফিরে এসেছে; আমি ভাবলাম।
-ঠিক আছে তুমি যেতে পার গ্রেনেড নিয়ে। তবে খুব সাবধানে থাকবে। আমি দু’দিন পর আবার আসব তোমার অপারেশনের ফলাফল জানতে। ফারুককে ডেকে জহিরকে গ্রেনেড সরবরাহ করে দু’দিনের জন্য ছুটি মঞ্জুর করে দেবার নির্দেশ দিয়ে চলে এসেছিলাম ফুলতলা থেকে।

ঠিক দু’দিন পর ফুলতলায় আসা হল না কাজের চাপে। এলাম কয়েকদিন পর। ক্যাম্পে এসে পৌছতেই ক্যাম্প ইনচার্জ ফারুক এসে বলল,
-হক ভাই, জহির ভিষণ অসুস্থ। ফিরে আসার পর থেকেই ভিষণ জ্বর। মানসিকভাবেও অপ্রকৃতস্থ।
-কি ব্যাপার, কি হয়েছে, খুলে বলতো? আমার প্রশ্নে ফারুক কেমন যেন অস্বাভাবিক গম্ভীর হয়ে চুপ করে কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল জহিরের অপারেশনের কথা।

খানসেনাদের ক্র্যাকডাউনের পরপরই জহির মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। পাক বাহিনী তাদের গ্রামে হানা দিলে স্থানীয় দালালদের কাছ থেকে ওরা জহিরের মুক্তি বাহিনীতে যোগদানের কথা জানতে পারে। তারা প্রতিশোধ নেবার জন্য তাদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে জহিরের বাবা ও মাকে নির্মম নিষ্ঠুরতায় হত্যা করে। হত্যা করে তার ছোট ছোট দুই ভাইকে। বাপ-মায়ের সামনেই শিশুদের হত্যা করে জল্লাদেরা। তার একমাত্র বোন কোহিনূরের ইজ্জত হরণ করে। তাদের সবাইকে গুলি করে মেরে যুবতি কোহিনূরকে বাচিঁয়ে রাখে তাদের পশু প্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য। এরপর থেকে প্রায় রাতেই এক সুবেদার তার সাঙ্গপাঙ্গদের সাথে করে আসে জহিরদের বাড়িতে; আনন্দ-ফুর্তি করার জন্য। অকথ্য নির্যাতনের শিকারে পরিণত হতে হয় কোহিনূরকে প্রায় প্রতি রাতে খানসেনাদের যৌন চাহিদা মেটাতে। গতবার ছুটিতে গিয়ে বোনের কাছ থেকে সবকিছু জানতে পারে জহির। সবকিছু শুনে জহির বোনের কাছে প্রস্তাব রেখেছিল তার সঙ্গে চলে আসার। রাজি হয়নি কোহিনূর। সে এই অত্যাচারের প্রতিশোধ নিতে চায়। এ কাজে জহিরের সাহায্য প্রার্থনা করে কোহিনূর। কোহিনূরের পরিকল্পনা কোন একটি নির্দিষ্ট রাতে ও সুবেদার সাহেবকে ডেকে পাঠাবে। ওরা এলে তাদের খতম করতে হবে জহিরকে। কি সাংঘাতিক প্রস্তাব! এতে কোহিনূরেরও জীবনের ঝুঁকি রয়েছে। বোনের আবেদন মেনে নিতে চায়নি জহির। কিন্তু কোহিনূর তার সিদ্ধান্তে অটল। তার এক কথা, জহির তার প্রতিশোধ পরিকল্পনায় সাহায্য না করলে ও আত্মহত্যা করবে কিন্তু জহিরের সাথে বর্ডার পেরিয়ে পালাবে না। তার দৃঢ় প্রতিজ্ঞায় অনেকটা বাধ্য হয়েই জহির রাজি হয় কোহিনূরের পরিকল্পনায় সাহায্য করতে। বোনকে কথা দিয়ে ফিরে এসেই গ্রেনেড নিয়ে ছুটিতে যাবার প্রস্তাব করে জহির। পরিকল্পনার কথা কাউকেই বলেনি জহির। শুধু বলেছে খানসেনাদের একটি আড্ডা তার টার্গেট। ও জানতো ওদের পরিকল্পনার পক্ষে আমি কিংবা ক্যাম্পের কেউ মত দেবে না। তাই সে বিস্তারিত কিছুই বলেনি কাউকে। গ্রেনেড নিয়ে ফিরে যায় জহির। ওর বোনের সাথে গোপনে সাক্ষাত করার পর সেদিন রাতেই সুবেদার সাহেবকে ডেকে পাঠায় কোহিনূর। ঠিক হয়, খানসেনারা এলে কোহিনূর ঘরের জানালা খুলে দেবে। ওরা পানাহার শেষে আমোদ-ফুর্তিতে যখন ব্যস্ত হয়ে পড়বে তখন আচমকা জহির বাইরে থেকেই ঘরের মধ্যে ছুড়ে মারবে গ্রেনেড। কী সাংঘাতিক আত্মঘাতী পরিকল্পনা! কোহিনূরের প্ল্যান কার্যকরী হলে খানসেনাদের সাথে কোহিনূরেরও জীবন যাবে। জহিরের বিবেক কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না নিজ হাতে বোনের জীবন নিতে। কিন্তু কোন যুক্তিই শুনতে রাজি নয় কোহিনূর। জীবন দিয়ে হলেও তার জিঘাংসা চরিতার্থ করবেই উপযুক্ত প্রতিশোধ নিয়ে। অটল সে তার প্রতিজ্ঞায়। অনেক চেষ্টা করেও জহির কোহিনূরকে এতটুকুও নড়াতে পারেনি তার অটল সিদ্ধান্ত থেকে। কোহিনুরের দৃঢ়তার কাছে আত্মসমর্পণ করে জহির বাধ্য হয়েছে বোনের পরিকল্পনা মেনে নিতে। সন্ধ্যার একটু পরেই সুবেদার সাহেব তার চারজন সঙ্গী নিয়ে এলো জহিরদের বাড়িতে। কোহিনূর ভালো খাবার-দাবারের বন্দোবস্ত করেছে। সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ ঘরের পেছনে অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা জহিরের মনকে অশান্ত করে তুলল। এক অজানা বেদনায় জহির তখন সম্মোহিত। আকাশ-পাতাল ভাবছে সে বাশেঁর ঝাড়ে গোপনে বসে বসে। হঠাৎ করে ঘরের জানালাটা খুলে দিয়ে একমুহুর্তের জন্য দাড়াল কোহিনূর। জহির জানালা খোলার শব্দে মুখ তুলে দেখল কোহিনূরকে। তার একমাত্র আদরের বোন। অদ্ভুত সুন্দর দেখাচ্ছে কোহিনুরের কচিঁ মুখটা। সে চেহারায় কলংকের কোন কালিমা নেই। পবিত্রতার স্নিগ্ধতায় ঐশ্বরিক এক সৌন্দর্যের ছাপ তার মুখায়বে। তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে জহিরের দু’চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এল। ক্ষণিকের জন্য জানালায় সে মুখ ভেসে থেকে মিলিয়ে গেল। ঘরের ভেতর তখন চলছে এক নারকীয় উল্লাসপর্ব। একটিমাত্র ছোট বোন। জহিরের কোলে পিঠে করে মানুষ হয়েছে কোহিনুর। কত টুকরো টুকরো অতীত স্মৃতি এসে ভীড় করছে জহিরের বেদনাবিধুর মনে। বেশকিছু সময় কেটে গেল। জহির ডুবে ছিল অতীত স্মৃতিতে। হঠাৎ রাতজাগা একটি পাখির ডাকে অতীত স্মৃতির জগৎ থেকে বর্তমানে ফিরে এল জহির। হাত ঘড়িতে রাত তখন প্রায় দশটা। গ্রামাঞ্চল। মনে হচ্ছে গভীর রাত। আশেপাশের বাড়িগুলোতে নেমে এসেছে রাতের নিঃস্তব্দতা। চারিদিকে নিবিড় অন্ধকার। রাতের স্তব্দতা ভেঙ্গে দিচ্ছে খানসেনাদের বেসামাল ফুর্তির হৈহুল্লরে। বাশঁ ঝাড়ের গা ঘেষে ছোট্ট পুকুরটার এক কোনে জ্বলছে একঝাক জোনাকি। নিজেকে সামলে নিল জহির। অপারেশন এখনই শুরু করতে হবে।

পায়ে পায়ে শিকারী বেড়ালের মত ক্রলিং করে জানালার ঠিক নিচে পৌছে গেল জহির। কোমরের গামছার বাধঁন খুলে বের করল দু’টো তাজা গ্রেনেড। খানসেনাদের গলার সাথে ভেসে এল কোহিনূরের চাপাঁ হাসির শব্দ। থমকে গেল জহির; কিন্তু ভেঙ্গে পড়ল না। মনকে শক্ত করে নিয়ে সে খুলে ফেলল গ্রেনেড দু’টোর ‘সেফটি পিন’। এক.. দুই.. তিন.. চার ছুড়ে দিল গ্রেনেডগুলো খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতরে। পরমুহুর্তেই গড়িয়ে কভার নিল পুকুরের খাঁদে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার। মাটি কাপাঁনো আওয়াজের সাথে সাথে শোনা গেল মৃত্যুপথযাত্রী লোকদের আর্তনাদ। কোহিনুরের গলাও শুনতে পেল জহির পশুদের আর্তনাদের সাথে। ত্রস্তে উঠে দাড়াল জহির। এগিয়ে গিয়ে জানালা দিয়ে ভেতরে দৃষ্টি দিতেই চোখে পড়ল ক্ষতবিক্ষত পাচঁটা পুরুষ ও একটা নারী দেহের অবশিষ্ট ছড়িয়ে আছে ঘরের মেঝেতে। দূরে কিছু লোকজনের আওয়াজ শোনা গেল। প্রচন্ড বিষ্ফোরণের আওয়াজে জেগে উঠেছে ঘুমন্ত গ্রামবাসী। পালাতে হবে জহিরকে। একমুহুর্তও আর থাকা নিরাপদ নয়। ছুটে পালিয়ে এল মুক্তিযোদ্ধা জহির তার একমাত্র ছোট বোনের শেষ ইচ্ছা পূরণ করে। মোহগ্রস্ত অবস্থায় ক্যাম্পে ফিরে এল জহির। ক্যাম্পে ফিরেই সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়ে সে। ফারুককে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে অসীম সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধা অপ্রকৃতস্থ জহির। সবকিছুই খুলে বলে ফারুককে, “পারলাম না ফারুক বোনকে নিরস্ত্র করতে। তার শেষ ইচ্ছা আমাকে পূরণ করতেই হল।”
তখন থেকেই ভিষণ অসুস্থ হয়ে পড়েছে জহির। প্রচন্ড জ্বর সাথে এলোমেলো প্রলাপ বকে চলেছে জ্বরের ঘোরে অবিশ্রান্ত।

সবকিছু শুনে স্তব্দ হয়ে গিয়েছিলাম আমি। কী অদ্ভুত সাংঘাতিক ঘটনা! মাথা নিচু করে ভাবছিলাম আত্মত্যাগী কোহিনূরের কথা - যে স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করে নিয়েছিল দেশের শত্রুদের খতম করার জিঘাংসায়। ভাবছিলাম জহিরের কথা। কী ইষ্পাত কঠিন চরিত্রের অধিকারী ছেলে জহির। হায়নাদের নিধণ করতে গিয়ে নিজের একমাত্র ছোট বোনের আহুতি দিতে এতটুকুও কাপেঁনি তার মন। কোহিনূরের জীবনাহুতি, জহিরের ত্যাগের কতটুকু প্রতিদান দিতে পেরেছি আমরা স্বাধীন জাতি হিসেবে? কি স্বীকৃতি দিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ তাঁদের আত্মত্যাগের???