মেজর ডালিম বাংলাদেশের ইতিহাসের না বলা সত্যকে জানুন

 

 

 
 
..ডালিম বলছি
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি
..জীবন বৃত্তান্ত
.. জিয়া   থেকে   খালেদা   অতঃপর
..সমসাময়িক ভাবনা
..প্রকাশিত বইসমগ্র
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা
..ইংরেজী ভার্সন    
 
মাইক তোমাকে ভুলব না
 
   
 

জুড়ি উপত্যাকার ধামাই টি ষ্টেটের গা ঘেষে লাঠিটিলা বিওপি। তারপর পাথারিয়া হিলসের ঘন সবুজ বন। ঠিক তার বিপরীতে মাইল ৩/৪ দূরত্বে কুকিতল। মুক্তিবাহিনীর একটি ক্যাম্প। পরন্ত দুপুরের রোদের আমেজ উপভোগ করছিলাম তাবুর বাইরে একটি চেয়ার টেনে নিয়ে। চারিদিকে ছোট-বড় টিলার আবর্তে ঘেরা কুকিতল ক্যাম্প। প্রায় সাড়ে চারশত মুক্তিযোদ্ধা রয়েছে এ ক্যাম্পে। ক্যাম্পের প্রায় মাঝখানের টিলাটাতেই আমার তাবু। যখনই এখানে আসি এ তাবুটাতেই থাকি আমি। অন্যসময় খালি থাকে আমার এ তাবুটা। সেদিন সারা ক্যাম্প জুড়ে নিঃশব্দ ব্যস্ততা। রাতে শেওলার কাছাকাছি একটি গুরুত্বপূর্ণ রেল সেতু ধ্বংস করার অপারেশন করা হবে। প্ল্যান চুড়ান্ত করা হয়ে গেছে। এখন  সবাই যার যার দায়িত্ব সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করে নিতে ব্যস্ত। গ্রুপ কমান্ডাররা সমস্ত প্রস্তুতির তদারকি করছে। আমি বসে বসে সব দেখছিলাম, হাতে ছিল গেরিলা যুদ্ধের উপর জেনারেল গিয়াপ এর একটা বই। ছেলেদের প্রস্তুতির তৎপরতা দেখতে দেখতে একসময় বইটিতে ডুবে গিয়েছিলাম।
-হক ভাই, আপনার চা। বই থেকে মুখ তুলে চেয়ে দেখি মাইক ধূমায়িঁত এক কাপ চা আমার সামনে ছোট্ট একটি টেবিলে রেখে দাড়িয়ে। ১৪/১৫ বৎসরের এই বালক এ ক্যাম্পে আমি এলে আমার তদারকির কাজ করে। আমার থাকা-খাওয়া সব দায়িত্বই পড়ে তার উপর। এমনকি আমার নিরাপত্তার ব্যাপারে ওই কর্তা হয়ে উঠে। ছেলেটি কুমিল্লার ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার এক গৃহস্ত পরিবারের ছেলে। দেখতে বেশ ফুটফুটে। ঘন একরাশ লম্বা চুল তাকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। তখনকার দিনে ঘাড় অব্দি লম্বা চুলের ফ্যাশন। বয়স অল্প হলেও বেশ উপস্থিত বুদ্ধি ছিল ছেলেটার। চটপটে তড়িৎকর্মা ছেলেটাকে সবাই ভালবাসতো। আমারও বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছিল ছেলেটি।
 
সংগ্রামের প্রথমার্ধেই খানসেনারা তাদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। তাদের হানায় ওর পরিবারের সবাই প্রাণ হারায়। ওই একমাত্র বেচেঁ যায় হায়েনাদের কবল থেকে। খানসেনাদের হাত থেকে প্রাণে বেচেঁ গিয়ে এসে যোগ দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধে। প্রাথমিক ট্রেনিং এর পর থেকেই রয়েছে কুকিতল ক্যাম্পে। প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি চঞ্চলতার মুর্তপ্রতীক মাইক। বয়সে ছোট; তাছাড়া আমার দেখাশুনা করে তাই কোন অপারেশনে যাবার সুযোগ হয়নি তার। এ নিয়ে ও ক্যাম্পের বিভিন্ন কমান্ডারদের কাছে অনেকবার আবদার তুলেছে। কিন্তু সবাই তাকে বুঝিয়ে বলেছে,
-তুই হক ভাইয়ের সাথে থাকিস। সেটা কি কম বড় কথা। হক ভাই তোকে বিশেষভাবে স্নেহ করেন সেক্ষেত্রে তোর অপারেশনে যাবার কোন প্রয়োজন নেই। হক ভাইয়ের খেয়াল রাখাই তোর দায়িত্ব।
এরপর ওর আর কিছুই বলার থাকে না। তাদের আদেশ মান্য করে আমার সাথেই রয়েছে সে।
-ভাই, একটা কথা।
-কি, বল?
-আপনে যদি বাবু ভাইরে কইয়া দেন তবে আমি আইজ অপারেশনে যাইতে পারি।
একরাশ মিনতি ঝরে পড়ছে তার দু’চোখে। কি জানি মনে হল, এতই যখন ওর ইচ্ছে যাক আজ ও অপারেশনে।
-ঠিক আছে, ডাক বাবুকে।
আমার জবাবটা তার জন্য বোধ হয় অপ্রত্যাশিত ছিল। প্রথমটায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল মাইক কিন্তু পরমুহুর্তেই দৌড়ে চলে গেল বাবুকে ডেকে আনতে। অল্পক্ষণ পরেই বাবুকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এল সে।
-হক ভাই, আমাকে ডেকেছেন?
-হ্যাঁ দেখতো মাইককে তোমাদের সাথে নেয়া যায় কিনা আজ রাতে?
-আপনি যখন হুকুম দিলেন তখন আরতো কিছু বলা যায় না। ঠিক আছে ওকে আমার সেকশনেই include করে নেব।
বুদ্ধিমান মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বাবু বুঝে ফেলেছিল মাইক যে করেই হউক আমাকে রাজি করিয়ে নিয়েছে আজ।
-হ্যাঁ তাই কর।
আমি বাবুকে জবাব দিয়ে আবার বইতে মনোযোগ দিলাম। বাবু মাইককে নিয়ে চলে গেল।
এরপর ডুবে গিয়েছিলাম বইতে। কিছুক্ষণ পর চোখ তুলে তাকাতেই নজরে পড়ল মাইক। ওর অনেকদিনের না বলা ইচ্ছে আজ পূর্ণ হতে যাচ্ছে সেই খুশিতে ওকে দেখলাম একটা হরিণ ছানার মত সমস্ত ক্যাম্পে দৌড়ে কি যেন করছে। রাতে খাবার নিয়ে তাবুতে এল ও।
-কি রে? কি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তোকে?
-এক্সপ্লোসিভ বইতে হইবো আমার; বাবু ভাই কইছে। জবাব দিল মাইক। এক্সপ্লোসিভ বহন করার দায়িত্ব পেয়েই ও ভিষণ খুশি। চোখেমুখে সেটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। জিঙ্গেস করলাম,
-কি খুশি তো?
-হ।
রাতের খাওয়ার পর অপারেশনে যাবার সবাই তৈরি হয়ে Fall in হল। আমি ওদের কমান্ডারদের কাছ থেকে প্রস্তুতির রিপোর্ট নিয়ে শেষ নির্দেশ দিলাম। টার্গেটের কাছে RV -তে পৌছে Assault party আচমকা চার্জ করে পাহারাদারদের কাবু করে সংকেত দেবার পর Explosive party গিয়ে তাদের কাজ করবে। কভারিং পার্টি কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাহারা দেবে operation site এবং বন্দি প্রহরীদেরকে একইসাথে তৈরি থাকবে যেকোন re-enforcement এর মোকাবেলা করার জন্য। বরলেখা থেকে খানসেনাদের re-enforce পাঠাবার সম্ভাবনা রয়েছে।
 
যাত্রা হল শুরু। সময়মতই টার্গেটের কাছে RV -তে পৌছে গেলাম। নিঃশব্দে এগিয়ে গেল Assault Gp. আচমকা হামলায় ব্রিজের প্রহরীরা প্রথমে বাধাঁ দেবার চেষ্টা করল। কিন্তু দুর্ধর্ষ গেরিলাদের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে পাহারারত খান সেনারা অল্পসময়েই আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হল। গোলাগুলির শব্দে বরলেখা থেকে ভারী ১২০ মিমি মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু হল। প্রতিপক্ষের strong position থেকে গোলাগুলো বিক্ষিপ্তভাবে প্রচন্ড শব্দে ফেটে পড়ছে ব্রিজের চারদিকে। এর মাঝেই জানবাজ গেরিলারা explosive charge লাগিয়ে উড়িয়ে দিল ব্রিজটা। একটা প্রচন্ড শব্দের সাথে সাথে ব্রিজটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ল নদী বক্ষে। একরাশ কালো ধূয়াঁ ও অগ্নিকুন্ড দিগন্তে উঠে সমস্ত জায়গাটাকে হঠাৎ করে আলোকিত করে আবার নিমিষেই নিভে গেল। বাতাস ভারি হয়ে উঠল পোরা বারুদের গন্ধে।  ব্রিজের কিছু অংশ তখনও জ্বলছে দাউদাউ করে। যার যার দায়িত্ব শেষ করে সবাই পূর্ব নির্ধারিত RV -তে এসে একত্রিত হল। Fall in করে কমান্ডাররা যার যার ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট দিচ্ছে। বাবুর সেকশন থেকে রিপোর্ট হল। দু’জন আহত হয়েছে; গোলার স্প্লিটারে একজন missing
-Who is missing?? আমার প্রশ্নের তাৎক্ষণিক জবাব পেলাম না। আবার প্রশ্ন করলাম,
-বাবু, Who is missing??
-মাইক, স্যার।
স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! রাতের নিঃস্তব্দতা ক্ষণিকের জন্য আমাকে যেন চেপে ধরল। ভেসে উঠল মাইকের প্রাণোচ্ছল হাসিখুশি মুখটা। অনেক অনুনয় অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আজ ওকে অপারেশন এ আনার অনুমতি দিয়েছিলাম। কেমন যেন নিজেকেই ওর মৃত্যুর জন্য দায়ি মনে হচ্ছিল। বুকটা ভারী হয়ে উঠল। নিজের অজান্তেই দু’চোখ ফেটে পানির বন্যা নেমে এল। দূরে তখনও মর্টারের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ঐ মর্টারের শেল স্প্লিন্টারেই মৃত্যু হয়েছে মাইকের। ভরা নদী ভাসিয়ে নিয়ে গেছে তাকে। খুজেঁ পাওয়া অসম্ভব তার মৃতদেহ। কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিলাম না।
-হক ভাই, ভারী গলায় বাবু আমায় সম্বোধন করল।
- Yes. মুখ তুলে চাইলাম ওর দিকে। আমার চোখে পানি দেখে ও আমাকে জড়িয়ে ধরল। ক্রন্দনরত বাবুর শরীরটাও কাপঁছে অনুভব করলাম। নিজেকে শক্ত করে নিয়ে বলে উঠলাম,
- Take it easy. Prepare to move.
আমার হুকুম পেয়ে সবাই যাত্রা শুরু করল। বাবু আর আমি সবার পেছনে। ফিরে এলাম ক্যাম্পে। শুধু ফিরল না সবার প্রিয় মাইক। ফেরার পর সে রাতটা ব্যথাতুর মন নিয়ে জেগে রইলাম। কখন ভোর হয়ে গেল টের পেলাম না।
-হক ভাই চা! না মাইক নয়, সামনে দাড়িয়ে খোকন। আমার মনের অবস্থা বুঝে কোন কথা না বলে চায়ের পেয়ালা টেবিলে রেখে নিঃশব্দে দাড়িয়ে কাদঁতে লাগল খোকন। ওকে শান্তনা দিয়ে আদেশ দিলাম, ফজরের নামাজের জামাতের বন্দোবস্ত করতে। ও আদেশ পেয়ে বেরিয়ে গেল। ক্যাম্পের সবাই জামাতে ফজরের নামাজ পড়ে মাইকের গায়েবী জানাজা পড়লাম।

দেশকে স্বাধীন করার জন্য হাজারও শহীদের সাথে মাইকও তার রক্ত স্বেচ্ছায় হাসিমুখে দিয়ে গেল দান। মাইক তার জীবন আহুতি দিয়ে আমাদের উপর দায়িত্ব দিয়ে গেল তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের; সুখী স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করার। এ দায়িত্ব কতটুকু সম্পন্ন করতে পেরেছি এ প্রশ্নের সঠিক জবাব খুজেঁ বেড়াচ্ছি আজো। উত্তর মেলেনি। মাইকের মত লাখো শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করার যে গুরু দায়িত্ব রয়েছে আমাদের উপর সেই দায়িত্ব থেকে মুক্তি পাবো কবে? এ প্রশ্নের জবাব খুজেঁ পেতে হবে আজ বেচেঁ থাকা প্রতিটি মুক্তিসংগ্রামীকে।