|
|
|
---|---|---|
![]() ![]() ![]() |
||
..ডালিম বলছি | ||
..যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি | ||
..জীবন বৃত্তান্ত | ||
.. জিয়া থেকে খালেদা অতঃপর | ||
..সমসাময়িক ভাবনা | ||
..প্রকাশিত বইসমগ্র | ||
..কিছু কথা কিছু ব্যাথা | ||
..ইংরেজী ভার্সন | ||
মৃত্যুর মুখোমুখি |
||
জুলাই এর শেষ। পাথারিয়া হিলস, জুড়ি, বরলেখা, বিয়ানী বাজার, শেওলা উপত্যাকার বেশিরভাগ অংশ এমনকি লাঠিটিলার অধিকাংশ মুক্তি বাহিনী দখল করে নিয়েছে। কিছুদিন আগে লাঠিটিলা বিওপি-তে প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়েছিল বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তাদের আক্রমণের প্রচণ্ডতার মুখে পাক বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। হঠাৎ গাইড শামছু মিঞা খবর নিয়ে এল, কুলাউড়া থেকে বিপুল সংখ্যক খানসেনা ও সাজোঁয়া বহর এনে জড়ো করা হয়েছে জুড়িতে। বুঝতে অসুবিধা হল না কিছুদিন আগে লাঠিটিলার যুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর হাতে অপদস্থ হয়ে পিছু হটার গ্লানি থেকে মুক্তি পাবার জন্য খানসেনাদের রি-ইনফোর্সমেন্ট ডেকে পাঠানো হয়েছে মুক্তিফৌজের দাতভাঙ্গা জবাব দেবার জন্য। খবরটা শোনার পরপরই শামছু মিঞার সাথে আমি নিজেই ছদ্মবেশে গেলাম রেকি করার জন্য। খবরটা সত্যি। প্রায় দু’টো নতুন ব্যাটালিয়ন ও এক স্কোয়াড্রন ট্যাঙ্ক আনানো হয়েছে। জুড়ি বাজারের প্রান্ত ঘেসেঁ তাবু গেড়েছে ওরা। ওখান থেকেই সুযোগ বুঝে আঘাত হানা হবে মুক্তি বাহিনীর অবস্থানের উপর। পাক বাহিনীর হামলার ব্যাপক প্রস্তুতি দেখে চিন্তিত হয়ে উঠলাম। তাদের বিশাল এ শক্তির মোকাবেলা করে সম্মুখ সমরে টিকে থাকা মুক্তি বাহিনীর জন্য হবে প্রায় অসম্ভব। ফিরে এসে সবাইকে ডেকে অবস্থার ব্যাখা দিয়ে কি করা উচিৎ সে ব্যাপারে তাদের অভিমত চাইলাম। নিজেদের অবস্থান ছেড়ে যেতে চাইল না কেউ। সবার এক কথা। প্রাণ দিতে রাজি কিন্তু পিছু হটবো না। কোন যুক্তি দিয়েই ওদের বোঝাতে পারলাম না খানসেনাদের শক্তিশালী আক্রমণের মোকাবেলা করা আমাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব নয়। সেক্টর হেডকোয়াটার্সে অবস্থার বিবরণ পাঠিয়ে দিলাম। ওখান থেকে হুকুম এল - স্থানীয় কমাণ্ডার হিসেবে অবস্থার পর্যালোচনা করে আমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রয়োজনে পিছনে হটে আসার সম্মতি দেয়া হল হেডকোয়াটার্স থেকে। কিন্তু আমার সমস্যা হল মুক্তি ফৌজের দামাল যোদ্ধাদের নিয়ে। খানসেনাদের সম্মুখ সমরে পরাজিত করে যে জায়গা তারা দখল করেছে সে জায়গা কিছুতেই ছেড়ে পিছু হটবে না তারা। তাদের মনোবল ও চারিত্রিক দৃঢ়তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলাম আমি। কিন্তু একজন অভিজ্ঞ কমাণ্ডার হিসেবে তাদের আবেগের জোয়ারে ভেসে গেলে চলবে না। যে করেই হোক খানসেনাদের আক্রমণের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেবার রাস্তা খুজেঁ বের করতেই হবে আমাকে। অনেক চিন্তার পর ঠিক করলাম পাক বাহিনীর আক্রমণের আগেই ওদের উপর আচমকা আক্রমণ চালিয়ে ওদের ছত্রভঙ্গ করে দিতে হবে Assembly Area -তেই। এ ধরণের অতর্কিত আক্রমণকে বলা হয় Spoiling Attack । ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে তুলানামূলক বৃহৎ শক্তির আক্রমণের হাত থেকে নিজেদের অবস্থানকে বাচাঁনোর জন্য এ ধরণের অভিযান পরিচালনার বিধান রয়েছে যুদ্ধশাস্ত্রে। Spoiling Attack -ই করতে হবে আমাকে। রেকি থেকে ফিরেই সিদ্ধান্ত নিলাম ছেলেদের সাথে আলোচনার পর। হেডকোয়াটার্স এর মাধ্যমে মিত্র বাহিনীর আর্টিলারী কভারের অনুরোধ পাঠালাম। জবাবে বলা হল, মাউন্টেন আর্টিলারীর রেঞ্জের বাইরে টার্গেট বিধায় কভারিং ফায়ার পাওয়া যাবে না। এ জবাব পাবার পর অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য নিজেদের কাছে যা আছে তা নিয়েই প্রস্তুতি পর্ব শুরু করলাম। ভারী হাতিয়ারের মাঝে আমাদের কাছে রয়েছে পাক বাহিনী থেকে captured কয়েকটি ৩˝ মর্টার ও কয়েকটি .৩০ ভারী মেশিনগান। চাচামিয়া হিসেবে পরিচিত কুকিতল ক্যাম্পের বিডিআর-এর নায়েব সুবেদার মতিউর রহমান বিশেষ অভিজ্ঞ ব্যক্তি। ৩˝ মর্টার ও .৩০ ভারী মেশিনগানের উপর প্রশিক্ষন নেয়া ছিল তার। ছেলেদের মাঝ থেকে বেছে বেছে শিক্ষিতদের নিয়ে দু’টো ডিটাচমেন্ট তৈরি করে তাদের প্রশিক্ষন দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হল ফ্লাইট ল্যাফট্যানান্ট কাদের ও চাচামিয়ার উপর। সময় মাত্র একরাত। এর মধ্যেই লেয়িং, ফায়ারিং, ডাটা প্রসেসিং এর সব কাজ শিখে নিতে হবে ওদের। ঠিক করলাম আমাদের ডিফেন্সেই স্থাপিত হবে Gun position । সেখান থেকে প্রায় ১মাইল এগিয়ে গিয়ে স্থাপন করা হবে Ovservation Post (OP)। Ovservation Post এবং Gun position এর মধ্যে তার বিছিয়ে কমিউনিকেশন লাইন স্থাপন করা হবে। টেলিফোনের মাধ্যমে ফায়ার পরিচালনা করতে হবে গোপনীয়তা বজিয়ে রাখার সার্থে। সিদ্ধান্ত নেয়া হল, অবজারভার হবো স্বয়ং আমি। মর্টার ফায়ারের সাথে সাথে বাবু ও খোকনের নেতৃত্বে দু’টো কোম্পানী শত্রুপক্ষকে আঘাত হানবে দুই ফ্ল্যাংক থেকে। জুড়ি ও কুলাউড়া সড়কে এ্যাম্বুস লে করবে মাসুক ও ফারুক তৃতীয় কোম্পানী নিয়ে। তাদের কাজ হবে পলায়নরত খানসেনাদের নিধন করা এবং একইসাথে কুলাউড়া থেকে যেকোন খানসেনাদের জুড়িতে আসতে বাধা দেয়া। সন্ধ্যার পর আমি, শামছু মিঞা ও কটুইমনা একটি ছোট্ট Protection Party নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম OP নির্ধারন করতে। পাহাড়ি জঙ্গলে একটি বড় গাছের উপর OP -এর জায়গা নির্ধারন করা হল। গাছটার সঙ্গে বাশেঁর সাথে বাশঁ জোড়া দিয়ে উঠার ব্যবস্থা করা হল। সেখান থেকে Gun position পর্যন্ত টেলিফোনের তার লে করা হল। সমস্ত ব্যবস্থা সম্পন্ন করে ফিরে এলাম আমরা। অতি প্রত্যুষে আমাদের আক্রমণ শুরু হবে। রাতেই সবাই চলে গেল যার যার অবস্থানে। শেষ রাতে আমি, কটুইমনা এবং আতিকের কমাণ্ডে ছোট্ট একটা Protection Party নিয়ে পৌছালাম OP -তে। গাছে উঠে বসলাম আমি ও কটুইমনা। সেদিন সে শুধু আমাদের গাইডই নয়; টেলিফোন অপারেটরের দায়িত্বও পালন করেছিল। গাছে উঠে দু’জনে পাশাপাশি বসলাম। ও আমার ডানদিকে। মাঝে একটা বড় মোটা ডাল। টেলিফোনের বোঝাটা ওর পিঠে আর আমার হাতে রিসিভার। হাজার দুই গজ দুরত্বে শত্রুপক্ষের Assembly Line। আমাদের অবস্থান থেকে পরিষ্কার দেখা যায় বাইনোকুলারের সাহায্যে। টেলিফোনের connection check করলাম। নির্জন রাতে পাথারিয়া হিলস এর গভীর জঙ্গলে উচুঁ গাছের মগডালে বসে নিশি রাতের ঘুমন্ত প্রকৃতির শোভা দেখে দেখে সময় কাটাচ্ছিলাম। বর্ষাকাল। চারিদিকে ভেজা মাটির গন্ধের সাথে একটা গুমোটভাব। আকাশজুড়ে ভাসমান মেঘের টুকরোগুলো ইতঃস্তত ভেসে বেড়াচ্ছে। মেঘের ফাঁকে ঊকি দিয়ে আছে কৃষ্ণপক্ষের একফালি বাকা চাঁদ। মৃদুমন্দ হাওয়ার ঝাপটায় হিল্লোলিত বাশেঁর ঝাড় ও গাছের পাতায় আওয়াজ হচ্ছে। চারিদিকে চাঁপ চাঁপ গারো অন্ধকার। অন্ধকারের বুক চিরে ছোট্ট একটা পাহাড়ি ছড়ার পারে জ্বলছে আর নিভছে একঝাঁক জোনাকী। একটানা শোনা যাচ্ছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক। মাঝেমধ্যে শুনতে পাচ্ছিলাম বেসুরো ব্যাঙের ডাক। হঠাৎ করে ডানা ঝাপটা দিয়ে উড়ে যাচ্ছে নিশাচর নাম না জানা কোন পাখি। সবকিছু মিলিয়ে নিরেট স্তব্দতা। সবাই নিজ নিজ অবস্থানে চুপচাপ বসেছিলাম। হঠাৎ পূব আকাশে প্রথম ঊষার আলো দেখা দিল। ক্রমশঃ অন্ধকার ফিকে হয়ে এল চারিদিকে। আমাদের টিলার সামনেই ছোট্ট একটি টিলার উপর একটি বাংলো। চা বাগানের কোন বাবু থাকেন সে বাংলোয়। সমস্ত বাংলোটাই অঘোর ঘুমে অচেতন। দূরে শত্রুপক্ষের Assembly Area । বাইনোকুলার চোখে লাগিয়ে দেখলাম পুরো এলাকা ছেয়ে আছে তাবুতে। একপাশে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয়েছে চারটি ট্যাংক। নির্ধারিত সময় হয়ে এল। শেষবারের মত প্রয়োজনীয় চেকআপ সম্পন্ন করে টেলিফোন সেট হাতে তুলে নিলাম। মুক্তিযোদ্ধা বাচ্চু গামছা দিয়ে আমার কাধঁ চেপে ধরে আছে। নিমিষেই ভিজে যাচ্ছে গামছা, গরম রক্তের প্রবাহে। সেটাকে চিপে নিয়ে আবার সে চেপে ধরছে আমার ক্ষতে। রক্তক্ষরণ বন্ধ হবার কোন লক্ষণই নেই। এমন জায়গায় ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে যে শক্ত করে বেঁধে রক্তক্ষরণ বন্ধ করার কোন উপায় নেই। একজন মুক্তিযোদ্ধা আমি। সবকিছু সহ্য করে মনোবল ঠিক রাখতে হবে। বাচ্চুর কোলে মাথা রেখে চোখ বুঝে আল্লাহ্তা’য়ালার করুণা ভিক্ষা করছিলাম। সে পরিস্থিতিতে এক আল্লাহ্ ছাড়া আর কারো কিছু করার ছিল না। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলাম। হঠাৎ লোকজনদের শোরগোল শুনতে পেলাম। মুক্তিযোদ্ধারা সতর্ক হয়ে উঠল। নাহ্। খানসেনারা নয়। আতিক ফিরেছে ৫/৬ জন লোক ও একটি মই নিয়ে। এরা সবাই কৃষক। ক্ষেতে কাজ করছিল। গোলাগুলি শুরু হতেই বাংকারে অবস্থান নিয়েছিল। মুক্ত এলাকায় জনগণকে নিরাপদ রাখার এ ব্যবস্থা সম্পর্কে আমরাই ওদের শিক্ষিত করে তুলেছিলাম। কারণ এ ধরণের গোলাগুলি বর্ডার সংলগ্ন এলাকায় প্রায় নৈত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। মইটিকে স্ট্রেচার বানানো হল। আমাকে সেটায় শুইয়ে দিয়ে ওরা মইটাকে কাধেঁ তুলে নিয়ে রওয়ানা হল। পদযাত্রার ঝাকুঁনিতে ভিষণ ব্যথা হচ্ছিল। মাঝেমাঝে মনে হচ্ছিল প্রাণটা বোধ হয় এক্ষুণি বেরিয়ে যাবে। কিন্তু কিছু করার ছিল না সবকিছু মুখ বুঝে সহ্য করে নেয়া ছাড়া। কোন এক পর্যায়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। যখন জ্ঞান হল তখন আমি কুকিতল টি গার্ডেনের ডিসপেনসারিতে। আমার ক্যাম্পের কম্পাউন্ডার ও গার্ডেনের ডাক্তার সুই-সূতা দিয়ে আমার ক্ষতের মুখ বন্ধ করে রক্তক্ষরণ কমাবার চেষ্টা করছে। তাদের সুই এর খোচাঁতেই জ্ঞান ফিরে পেয়েছিলাম। সেখান থেকে আমাকে নিয়ে যেতে হবে ৯০ মাইল দূরে অবস্থিত মাসিমপুর ভারতীয় সেনাবাহিনীর সিএমএইচ-এ। যেতে হবে গাড়ি করে। কিন্তু রাস্তার যে অবস্থা তাতে জিপে করে আমাকে নেয়া সম্ভব হবে না। গাড়ির ঝাকুনি সহ্য করার মত শারীরিক অবস্থা তখন আমার নেই। সবাই ঠিক করল বাগানের ম্যানেজার মিঃ ঘোষের প্রাইভেট কারটা চেয়ে নিতে হবে আমাকে বহন করার জন্য। ভদ্রলোক বাঙ্গালী। সানন্দে রাজি হলের তার গাড়ি দিতে। শুধু তাই নয়; তিনি নিজেই আমাকে নিয়ে যাবেন গাড়ি চালিয়ে। গাড়ির সামনের সিট খুলে জায়গা করা হল; যাতে আমাকে শুইয়ে নেয়া যায়। গাড়ির ভেতর যতটুকু সম্ভব আরামদায়ক শয্যা পেতে আমাকে শুইয়ে দেয়া হল। আতিক বসল আমার মাথা কোলে নিয়ে। ডাক্তার ও কম্পাউন্ডার রইল সাথে। মিষ্টার ঘোষ গাড়ির ষ্টিয়ারিং এ বসে গাড়ি ছেড়ে দিলেন। অভিজ্ঞ চালক তিনি। রাস্তার প্রতিটি বাঁক তার নখদর্পণে। অতি সতর্কতার সাথে উল্কাবেগে গাড়ি চালাচ্ছিলেন মিঃ ঘোষ। আমি অসাড় হয়ে শুয়েছিলাম। ডাক্তার সাহেব ও কম্পাউন্ডার ক্ষতের উপর কাপড় চেপে ধরেছিলেন। কাপড় ভিজে উঠলে সেটা চিপে নিচ্ছিলেন সাথে রাখা বালতিতে। রাস্তা যেন কিছুতেই শেষ হচ্ছিল না। এক একবার মনে হচ্ছিল আর হয়তো বা বাচঁবো না। চোখের কোন থেকে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রুধারা। আতিক বিড়বিড় করে পড়ছিল দোয়া-কালাম। অবচেতন মনে হঠাৎ করে ভেসে উঠল আমার আম্মার প্রতিচ্ছবি। তিনি যেন জীবন্ত হয়ে সামনে এসে দাড়ালেন! আমাকে বললেন, “তুই ঘাবড়াসনে; কিচ্ছু হবে না তোর। আল্লাহ্ তোকে নিশ্চয়ই সুস্থ্য করে তোলবেন। একটুখানি সবুর কর। মনে নেই ডাক্তার সাহেব তোকে কি বলেছিল, রক্তক্ষরণে সহজে মৃত্যু হবে না তোর।” এ কথা বলেই তিনি আমার বুকে ফুঁ দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেলেন। আচমকা আমি ডেকে উঠলাম, “আম্মা”। আমার অস্ফুট কন্ঠস্বরে আতিক মাথা ঝুঁকে আমায় শুধালো, তার আশ্বাসবাণীতে আমার মনোবল অনেক বেড়ে গেল। কেমন যেন একটা দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গেল আমি কিছুতেই এভাবে মরতে পারি না। আমাকে বাচঁতে হবে। আমি বাচঁবোই। মৃত্যুর মুখোমুখি যমে-মানুষে টানাটানির মধ্যে একসময় পথ ফুরিয়ে এল। পৌছে গেলাম মাসিমপুর সিএমএইচ। পূর্বেই খবর দেয়া ছিল। লোকাল ভারতীয় বাহিনীর counterpart ব্রিগেডিয়ার ভড্কে ও সিএমএইচ-এর পদস্থ কর্তাব্যক্তিরা সবাই আমার আগমণ প্রতিক্ষায় তৈরি ছিলেন। আমরা পৌছার সাথে সাথেই সোজা আমাকে নিয়ে যাওয়া হল অপারেশন থিয়েটারে। এ্যানেস্থেসিয়ার প্রভাবে জ্ঞান হারালাম আমি। যখন জ্ঞান ফিরল তখন আমি হাসপাতালের VIP কেবিনে। আমাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে বাবু, আতিক, খোকন, মাসুক, ফারুক, মাহবুব, জহির, ফ্ল্যাইট ল্যাফট্যানান্ট কাদের প্রমুখ, আমার প্রিয় সহযোদ্ধারা। জ্ঞান ফেরার সংবাদ পেয়ে অল্পক্ষণের মধ্যেই এসে পৌছালেন মেজর দত্ত, ক্যাপ্টেন রব, মেজর দাস, ব্রিগেডিয়ার ভড্কে, ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জী, কর্নেল বাগ্চী প্রমুখ। এরা সবাই আমাকে অত্যন্ত ভালবাসতেন। তাদের আন্তরিকতার প্লাবনে সেদিন বিদেশের মাটিতে আত্মীয়-পরিজনহীন অবস্থায়ও নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব বোধ করিনি এতটুকুও। আহত হয়ে হাসপাতালে থাকাকালীন অবস্থায় শ্রীমতী ভড্কের কাছ থেকে পেয়েছিলাম মাতৃসুলভ মমতা আর বাৎসল্য। কয়েকদিনের মধ্যেই আমার হাসপাতালের ক্যাবিনটাই হয়ে উঠেছিল অপারেশন হেডকোয়াটার্স। সেখান থেকে বিছানায় আধশোয়া অবস্থাতেই পরিচালনা করতে হচ্ছিল বিভিন্ন সাব-সেক্টরের যুদ্ধ প্রক্রিয়া। অল্প কিছুদিনের মধ্যে কিছুটা সুস্থ্য হয়েই হাতের প্লাষ্টার নিয়ে ফিরে গিয়েছিলাম রনাঙ্গনে। মনে তখন একই চিন্তা, একই ধ্যান- যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে হবে দ্রুতগতিতে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছিনিয়ে আনতে হবে স্বাধীনতার সূর্য। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ। এটাই ছিল ’৭১ এর চেতনা। |
||