লন্ডন হয়ে ফিরলাম বেনগাজীতে

লন্ডনের ফ্লাইটে উড়ে চলেছি। এয়ারপোর্টে আব্বা, মিনু ফুপ্পু, বাপ্পি, স্বপন, মহুয়া, কেয়া, সঙ্গিতা আর সার্বক্ষণিক সঙ্গী মাহবুব এসেছিল বিদায় জানাতে। এসেছিল সামরিক বাহিনীর আরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাথী। উড়ন্ত যান্ত্রিক বলাকায় বসে ভাবছিলাম ঢাকায় পা দেবার পর থেকে প্রতিটি ঘটনাবহুল মুহূর্তগুলো নিয়ে। একসময় নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। পুরো সফরকালে বিমানের ক্যাপ্টেন থেকে ক্যাবিন ক্রুদের আন্তরিক সেবাযত্নের কমতি ছিল না। সবকিছুই তারা করছিলেন স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়েই। কারণ পদমর্যাদায় আমি বিশেষ কোন ব্যক্তি ছিলাম না, অন্য সবার মতই ছিলাম একজন যাত্রী। যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরে। খালাম্মা, নিম্মি আর মানু এসেছে আমাকে নিয়ে যেতে। নিম্মি জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। মানু ছলছল চোখে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলো। খালাম্মা মাথায় হাত রেখে স্বাগত জানালেন। লন্ডনে মানুই ড্রাইভ করে। লন্ডনে আসলে মানুই হয় আমাদের গাইড এবং ড্রাইভার। ছোটবেলা থেকেই লন্ডনে মানুষ। লন্ডন শহরের অলিগলি ওর নখদর্পণে। সিদ্ধ চালকও বটে। আমরা বাসায় পৌঁছে গেলাম। পথে টুকটাক কথা-বার্তার মাধ্যমে সবার কুশল জেনে নিল নিম্মি। লন্ডন পৌঁছেই বেনগাজীতে জানিয়ে দিলাম লন্ডনে পৌঁছে গেছি, সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই বেনগাজীতে নিম্মিসহ ফিরবো ইন শাহ আল্লাহ্। পাশা জানালো, দেশ থেকে বেনগাজীতে ফেরার পর থেকে দুই ভায়রা নিজেদের ফ্ল্যাটেই রুদ্ধদ্বার হয়ে রয়েছে। শুনে বললাম অসুবিধে নেই, ফেরার পর রুদ্ধদুয়ার খুলে যাবে। সপ্তাহখানেক সময় লন্ডনে আরামে আপনজনদের উষ্ণ সান্নিধ্যে কাটিয়ে ফিরে এলাম বেনগাজীতে। আমাদের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে পেয়ে সবাই আনন্দে উদ্বেলিত। দিন দুয়েক পর আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসলাম। ঢাকা থেকে ফোনে বিস্তারিত যা তাদের বলতে পারিনি সেগুলো বিস্তারিত বললাম সবাইকে। বিশেষ করে, শিশুভাই এর আন্তরিকতা আর আসার আগমুহূর্তে জেনারেল মঞ্জুর অপ্রত্যাশিতভাবে স্বেচ্ছায় ডেকে আমার সাথে যা কিছু আলাপ করেছিলেন সেই সম্পর্কেও তাদের খুলে বললাম। তার ঐ ধরনের উদ্যোগে সবাই কিছুটা বিস্মিত হল।

জিয়ার ভবিষ্যৎ রাজনীতি সম্পর্কে বললাম যদিও জেনারেল জিয়া ফারুক আর রশিদকে কথা দিয়েছেন দেশে বহুদলীয় রাজনীতি শুরু হওয়ার পর তাদের দেশে ফিরে রাজনীতি করার সুযোগ দেবেন, কিন্তু আমার মনে হয় এই বিষয়ে তিনি সময়মত কথার বরখেলাপ করবেন। জোর করে দেশে ফিরতে চাইলে কঠোর প্রতিবন্ধকতার চেষ্টাও করতে পারেন যদিও রশিদ, ফারুকের জন্য আমাদের বাদ দিয়ে রাজনীতি করাটা তার জন্য কোনও হুমকি হবে না। তিনি যদি এই বিষয়ে আন্তরিক হতেন, তবে আমাদের একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে জেনেও আমাদেরকে তো তেমন কোন সুযোগ দেবার কথা মুখেও আনেননি। দেশে ১৫ই আগস্টের কারণে জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে রাজনৈতিকভাবে জিয়ার মোকাবেলা করা সম্ভব খন্দকার মোশতাকের পক্ষে আর আমাদের পক্ষে, তাই তিনি আমাকে এই ব্যাপারে একদম এড়িয়ে গিয়েছেন। ফারুক আর রশিদ অবশ্য খন্দকার মোশতাকের সাথে মিলে রাজনীতি করতে পারে। কিন্তু জিয়া ভাল করে বুঝে নিয়েছেন আমাদের ছাড়া রশিদ আর ফারুকের তেমন কোনও মূল্য থাকবে না খন্দকার মোশতাকের কাছে। আমার মনে হয়, জিয়া কিছুতেই খন্দকার মোশতাকের দল ডেমোক্রেটিকলীগকে তার বিপক্ষে দাড়াতে দেবে না ভারতের সাথে সমঝোতার পর। শিশুভাইকে আমি সরাসরি আমার অনুমানটা জানিয়ে এই বিষয়ে তার অভিমত জানতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে কিছু না বলে তিনি নিশ্চুপ থেকেছিলেন। আমি তার সেই নীরবতা ‘মৌনং সম্মতি লক্ষণং’ হিসাবেই ধরে নিয়ে তাকে আর বিব্রত করতে চাইনি। তবে মাহবুব আমার সাথে একমত প্রকাশ করেছে। সবাই খুবই মনোযোগের সাথে আমার কথা শুনছিলো। বক্তব্য শেষ হতেই হুদা বলে উঠলো

ধূর্ত শৃগাল বাঘের বেশে বিপদসংকুল খেলা খেলছে, এর পরিণাম তার জন্য ভাল হবে না, দেশের জন্যও হবে ভয়াবহ।

জিয়ার কি হবে না হবে সেটা এখন আমাদের ভাবনার বিষয় নয়। ভাবতে হবে আমাদের ভবিষ্যতের সিদ্ধান্ত কি হবে? জিয়ার প্রস্তাব আমরা গ্রহণ করবো কি করবো না। স্যারের বক্তব্য শোনার পর আমার সিদ্ধান্তের সার সংকলন সবার জন্য তুলে ধরতে চাই। পাশা তার জ্বলন্ত সিগারেটটা এ্যাশট্রেতে নিভিয়ে রাখায় সবাই নড়েচড়ে বসলো। পাশা বলা শুরু করলো

১। জিয়া সাময়িক ভাবে নয়, চিরস্থায়ী ভাবেই আমাদের বিদেশে রাখার এমন একটা ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছেন যাতে আমরা তার রাডারের বাইরে না থাকি। আমরা একসাথে কোন নিরাপদ আশ্রয়ে থাকি সেটাও জিয়ার মনঃপুত নয়।

২। মুখে বললেও তিনি আমাদের আর কোনও দিনই সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেবেন না, আমাদের নিয়ে তার পক্ষে রাজনীতি করাও সম্ভব নয় ভারত আর আওয়ামীলীগের সাথে বোঝাপড়ার পর।

৩। তিনি যেখানে ভারত আর আওয়ামীলীগের সাথে মিলে রাজনীতি করবেন সেখানে আমরা যদি তার প্রস্তাব প্রত্যাখান করে দেশে ফিরে আলাদা ভাবে রাজনীতি করার চেষ্টা করি তবে আমাদের পরিণতি মুজিব আমলের জাসদ কিংবা সর্বহারা পার্টির চেয়েও করুণ হবে। খন্দকার মোশতাক এবং তার প্রতিষ্ঠিত ডেমোক্রেটিকলীগের পরিণতি আমার এই ভবিষ্যৎবাণীর যৌক্তিকতা প্রমাণ করবে। খন্দকার মোশতাকের পেছনে মধ্যপ্রাচ্য এবং আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন থাকলেও তাদের কাছে জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা বেশি। কারণ, জিয়া বর্তমানে তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশের মতো বাংলাদেশের ‘স্ট্রং ম্যান’ এবং ক্ষমতার উৎস সামরিক বাহিনীর নিয়ন্ত্রক।

৪। আমাদের গাদ্দাফি যেভাবে স্বাগতম জানিয়েছেন সেভাবে বিশ্বের অন্য কোনও দেশের শাসক যারা প্রায় সবাই আপোষের রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তারা আমাদের সেইভাবে স্বাগত জানাবে, সেটা আমি মনে করিনা। কোনও কম্যুনিস্ট দেশেও আমাদের পক্ষে আশ্রয় নেয়া সম্ভব হবে না। আমরা কেউই কম্যুনিস্ট না, যদিও রশিদ আর ফারুক অর্বাচীনের মতো গাদাফিকে বোঝাতে চেষ্টা করছে আমরা সবাই কম্যুনিস্ট।

৫। এখানে থাকতে হলে দুই ভায়রা ভাইয়ের সাথে সহাবস্থানই করতে হবে। এরা ইতিমধ্যে তাদের একক উদ্যোগে এমন সব ঘটনা ঘটিয়ে বসেছে, ভবিষ্যতেও হয়তো আরও ঘটাবে যার ফলে আমাদের ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তাই এখানেও বেশীদিন আমাদের থাকা সম্ভব হবে না। তাছাড়া আমাদের নীতি-আদর্শের সাথে তাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাতেও রয়েছে বিস্তর ব্যবধান। এইসব বিবেচনা করার পর জিয়ার প্রস্তাব মেনে নেয়া ছাড়া আমাদের অন্য কোনও বিকল্প আছে বলে আমি মনে করিনা। এই প্রস্তাব মেনে নিলে নিজেদের নিরাপত্তা কিছুটা হলেও নিশ্চিত হবে। একই সাথে দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে কিছু কাজও করা সম্ভব হবে। সবচেয়ে বড় কথা হল, দেশের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতেও সুবিধা হবে। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সাথেও আমরা ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবো এবং বিশ্ব রাজনীতি সম্পর্কেও আমরা আমাদের জ্ঞানকে পরিপক্ক করে তোলার সুযোগ পাবো।

আজকের দুনিয়াকে বল প্রয়োগে পরিণত করা হয়েছে একটি ভঙ্গুর ‘Global Village’-এ। সুতরাং ভবিষ্যতে রাজনীতি করার সুযোগ পেলে চলমান বিশ্বের খবরাখবর সম্পর্কেও আমাদের জানতে হবে। কূটনীতিকের দায়িত্ব গ্রহণের পর শুধু ‘Dinning and Wining’ এ নিজেদের সীমাবদ্ধ না রেখে বিশ্বের প্রতিপ্রান্তে প্রবহমান ঘটনাবলি, current and cross current, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে স্বার্থজনিত বিরোধ-মিমাংসা, বিভিন্ন রূপের আগ্রাসন, স্বার্থের খাতিরে নীতি-বিবর্জিত লেনদেন এবং সহাবস্থান, বিপরীতধর্মী শক্তিগুলোর মধ্যে সমীকরণ ইত্যাদির মধ্যে বাংলাদেশের স্বার্থ কি করে হাসিল করা সম্ভব সেসব সম্পর্কে জ্ঞান লাভের এই সুযোগের পূর্ণ দ্ব্যবহার যদি আমরা করি তাহলে আল্লাহ্ যদি কোনোদিন আমাদের আবার জাতীয় সংগ্রামে নেতৃত্বের সুযোগ দেন তখন ‘৭১ এর আদর্শ এবং স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার রাজনীতিতে অনেক বেশি পরিপক্ব নেতৃত্ব দিতে পারবো আমরা। পাশার বক্তব্যের বিরুদ্ধে কেউ কিছুই বলল না, সবাই বরং সমর্থনই জানালো। তাই সিদ্ধান্ত গৃহীত হল রশিদ, ফারুক চাকুরি গ্রহণ না করে লিবিয়াতে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেও আমরা জিয়ার প্রস্তাব মেনে কূটনীতিকের দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে চলে যাবো। সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের তরফ থেকে জেনারেল জিয়াকে জানিয়ে দেয়া হল রশিদ আর ফারুক বাদে বাকি সবাই তার প্রস্তাব মেনে নিয়ে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করতে রাজি। আমরা জানতাম, জবাব জানার পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জিয়া আমাদের নিয়োগপত্র পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবেন। তাই বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হল, চলে যাবার আগে ভায়রা ভাইদের সাথে খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে কতগুলো বিষয় পরিষ্কার করে নেয়া উচিৎ। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা একত্রিত হলাম আলোচনার জন্য।
আমার উপরেই দায়িত্ব দেয়া হল আমাদের সিদ্ধান্ত এবং অন্যান্য বিষয়ে কথা বলার। তাই আমিই শুরু করলাম

আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি জিয়ার প্রস্তাব মেনে নিয়ে কূটনীতিক হিসাবে যোগ দেবো। সিদ্ধান্তটা তাকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তুই আর ফারুক ঠিক করেছিস এখানে থাকার। তাই চলে যাবার আগে তোদের দুইজনকে কিছু কথা আমাদের তরফ থেকে জানিয়ে যাওয়া দরকার বোধ করছি। আমরা কেনো চলে যাচ্ছি আর কেনো তোরা থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলি এই বিষয়ে কোনও ব্যাখ্যার বা তর্কের প্রয়োজন নেই। আমরা যুদ্ধকাল থেকেই একটি নীতি-আদর্শ ভিত্তিক সংগঠনের সদস্য। আমাদের রয়েছে একটি স্বপ্ন এবং লক্ষ্য অর্জনের স্পষ্ট সুচিন্তিত কর্মসূচি যার সাথে তোদের কোনও সম্পর্ক নেই। তবুও আমরা একসাথে ১৫ই আগস্টের ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলাম ঐক্যবদ্ধভাবে ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে। আমাদের একতার ভিত্তি ছিল দেশপ্রেম এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর শত বছরের ঐতিহাসিক ধারায় গড়ে ওঠা আমাদের স্বতন্ত্র চেতনা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এটাই ছিল মূলত ’৭১-এর চেতনা। এই চেতনাকে অস্বীকার করে ভারতীয় চাণক্যরা যখন দেশীয় ক্ষমতালিপ্সু পদলেহি গোষ্ঠীর সহযোগিতায় বাংলাদেশকে তাদের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করার সুদূরপ্রসারী নীলনকশা প্রণয়ন করে তখনই আমরা ও সমমনা সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা তাদের সেই চক্রান্তের বিরুদ্ধে লড়াই-এর জন্য গড়ে তুলেছিলাম একটি গোপন সংগঠন মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে। তোদের ধ্যান-ধারণা রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনার সাথে আমাদের অনেক ফারাক আছে সেটা দেশবাসী অবগত নয়। তারা আমাদের সবাইকে একইভাবে দেখছে। কিন্তু ১৫ই আগস্টের পর তোরা এককভাবে কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছিস যার ফলে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। হুট করে কাউকে কিছু না জানিয়ে তোরা দুইজন ব্যাংককে আমেরিকান দূতাবাসে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে বসলি ভূত-ভবিষ্যৎ চিন্তা না করেই। এরপর BBC তে উদ্ভট ইন্টারভিউ, এইবার ঢাকায় গিয়ে যে তামাশা করে এলি তুই আর ফারুক তাতে কি অর্জন হল? হয়তো এই হঠকারি পদক্ষেপের ফলে আরও কিছু দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যকে জিয়ার হাতে বলির পাঁঠা হতে হবে। বর্তমানে জিয়া যেই অবস্থানেই রয়েছে, ধোঁকাবাজির মাধ্যমে আমাদেরকে সিঁড়ি বানিয়েই সেখানে উঠেছে জিয়া। দুঃখজনক, সেটা সাধারণ মানুষ জানে না। সে যে একজন মুনাফিক সেটাও দেশবাসীর কাছে বলে বোঝাবার কোনও উপায় আমাদের নেই। সুতরাং তার মোকাবেলা করার একমাত্র পথ হল উপযুক্ত সময় রাজনৈতিক ভাবে তার মুখোশ উন্মোচিত এবং স্বরূপ উদ্ঘাটন করে মোকাবেলা করা। যদিও জিয়া ফারুককে দেশ ছাড়ার আগে কথা দিয়েছেন দেশে রাজনীতি শুরু করা হলে তোদেরকেও রাজনীতি করার সুযোগ দেয়া হবে, তবে আমাদের ধারণা সেই সুযোগ জিয়া তোদের দেবেন না। একই সাথে খন্দকার মোশতাককেও তিনি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসাবে দাড়াতে দেবেন না। সে যাই হউক, যা এখনঅব্দি করেছিস সেটা ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তবে আমাদের অনুরোধ, ভবিষ্যতে এ ধরণের হঠকারি উদ্যোগ নিয়ে নিজেদের তামাশার বস্তু বানাসনে। তোদের নামের সাথে আমাদের নামগুলিও জড়িত। তাই এতটুকু অনুরোধ জানানোর অধিকার নিশ্চয় আমাদের আছে। বর্তমানে Silence would be virtue. রাজনৈতিক ভাবে জিয়ার মোকাবেলা করার কোনও চিন্তা-ভাবনা যদি কখনও মাথায় আসে তখন প্রয়োজন বোধে আমাদের সাথে যোগাযোগের দ্বার তোদের জন্য খোলা থাকবে ভবিষ্যতে। যাবার আগে কৃতজ্ঞতার সাথে মোয়াম্মর গাদ্দাফিকে যুক্তি দিয়েই আমরা বুঝিয়ে যাবো কেনো আমরা এই সিদ্ধান্ত নিলাম। আর একটি কথা। রশিদকে বলতে বাধ্য হচ্ছি, কর্নেল তাহের, কর্নেল জিয়াউদ্দিন, মেজর জলিল কিংবা সিরাজ সিকদারের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকলেই যে আমরা সবাই কম্যুনিস্ট তেমনটি ভাবাটাও কিন্তু ঠিক নয়। এই কথাটা কেনো বললাম তুই সেটা ভালো করেই বুঝতে পারছিস।

ঢাকা থেকে ফিরে রশিদ গাদ্দাফিকে বুঝিয়েছিল ফারুকের মিশন সফল না হওয়ার জন্য আমরাই দায়ী। কারণ, আমরা সবাই নাকি কম্যুনিস্ট। যুক্তি হিসাবে সে বলেছিল, আমাদের সাথে দেশের কর্নেল তাহের, কর্নেল জিয়াউদ্দিন, মেজর জলিল, সিরাজ সিকদারসহ সব বামপন্থী রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের সাথে যোগাযোগ রয়েছে। আমি কম্যুনিস্ট, তাই নাকি গণচীনে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করায় জিয়া আমাকে বেইজিং-এ পোস্টিং দিয়েছেন। ‘পাগলে কি না বলে আর ছাগলে কি না খায়’! তার যুক্তিগুলো ছিল অনেকটা সেই প্রবাদের মতোই। যাই হউক, আবার বলা শুরু করলাম

মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তোরা মুজিব নগরে এসে পৌছেছিলি। তাই স্বাভাবিক কারণেই যুদ্ধকালের অনেক কিছুই তোদের জানা নেই। সেটাও তোদের ভাল করে জানতে হবে ভবিষ্যতে যদি রাজনৈতিকভাবে এগুতে চাস। আর একটি বিষয় চিন্তার খোরাক হিসাবে বলে যেতে চাই। গাদ্দাফি নাসেরের আর্মির সাহায্যে যেভাবে বাদশাহ ইদ্রিসকে ক্ষমতাচ্যুত করেছিল সেপ্টেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে তেমন ভাবে মিলিয়নস ডলার খরচ করেও বর্তমানে জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হবে না। একমাত্র দেশজুড়ে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তুলে জনগণের সম্মুখে জিয়াকে বে-নেকাব করতে পারলেই সম্ভব হবে তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। জনগণকে বোঝাতে হবে ভারতসহ জাতীয় কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীদের সাথে জেনারেল জিয়া শুধুমাত্র ক্ষমতার রাজনীতিই করছেন। দেশ ও জাতীয় স্বার্থ এই অপরাজনীতির মাধ্যমে কিছুই অর্জন করা কোনোক্রমেই সম্ভব নয়। ভাঙ্গা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি পরে কোদাল কাঁধে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়ানোটা তার নিজস্ব জনপ্রিয়তা বাড়ানোর একটা সস্তা চমক মাত্র। অসুস্থ রাজনীতির যে বিষবৃক্ষের বীজ জিয়া সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বপন করছেন তার পরিণাম দেশ ও জাতিকে ঠেলে দেবে এক ঘোর অমানিশার দিকে, আর সেই সুযোগ গ্রহণ করে ভারত ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে পরিণত করবে তাদের একটি করদ রাজ্যে। এভাবেই বাস্তবায়িত হবে তাদের ‘৭১-এ প্রণীত নীলনকশা। আমাদের সব শ্রমের ফসল তুলে নিয়েছেন জেনারেল জিয়া। এর পরিণামে বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনও শর্টকাটের আর অবকাশ নেই এই সত্যিটাও আমাদের বুঝতে হবে। আগামী দিনের রাজনীতির গতিধারা বুঝে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার প্রজ্ঞা ও যোগ্যতা যারা রাখবে সেই সমস্ত নেতা-কর্মীরাই পারবে দেশ এবং জাতির ভাগ্যে যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে। বক্তব্য শেষে উপস্থিত সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম কারো কোনও প্রশ্ন আছে কিনা। কেউ কোনও প্রশ্ন না করায় সভার সমাপ্তি ঘোষণা করা হল।

রশিদ, ফারুক ফিরে গেল তাদের ফ্ল্যাটে। আমরা রিল্যাক্সড মুডে আড্ডায় মশগুল হলাম। নিম্মি, রানু, লিজি, লিলি, হেনারাও এসে যোগ দিলো। ঢাকা থেকে খবর এলো লেফটেন্যান্ট শমসের মুবিন চৌধুরী (ডাক নাম সেরু) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের পোস্টিং অর্ডার নিয়ে আসছে। ছোটকাল থেকে আমরা একসাথেই বড় হয়েছি। স্বপনের সমবয়সী। ওর বড়ভাই নাস্রুল মুবিন চৌধুরী ছিল আমার সমবয়সী। ‘৭১ সালে জিয়ার সাথে একই রেজিমেন্ট-এর অফিসার ছিল সেরু। কালুরঘাটের যুদ্ধে গুরুতরভাবে আহত হয়ে পাক বাহিনীর হাতে বন্দি হয়ে CMH এই কাটাতে হয়েছিল স্বাধীনতা পর্যন্ত পুরোটা সময়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা একসাথেই GDR গিয়েছিলাম চিকিৎসার জন্য। ফেরার পর শারীরিক অক্ষমতার কারণে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় তার অনুরোধ ক্রমেই। কালুরঘাটের যুদ্ধের পর জিয়া, খালেদ, শফিউল্লাহ এবং অন্যসব কমান্ডাররা সবাই বুঝতে পারেন সম্মুখ যুদ্ধে পাকবাহিনীর মোকাবেলা করে দেশ স্বাধীন করা সম্ভব হবে না। তাই তারা সবাই তাদের অধীনস্থ সেনা সদস্যদের নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেবার জন্য তেলিয়াপারায় একত্রিত হন। ইতিমধ্যে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথপুরে ভারত সরকারের সাথে বোঝাপড়া এবং ৭ দফা চুক্তি স্বাক্ষরের পর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের LFO অধীন অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার সাথে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দের জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদ, জনাব তাজুদ্দিন আহমেদ, জনাব কামরুজ্জামান, জনাব মনসুর আলী প্রমুখ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন করার সিদ্ধান্ত নেন। ঐ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসাবে জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী হিসাবে জনাব তাজুদ্দিন আহমেদ এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন এবং শপথ গ্রহণ করেন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায়। এরপর বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় মুজিব নগর। কিন্তু সদ্য গঠিত প্রবাসী সরকারের পীঠস্থান স্থাপিত হয় ৫৮নং বালিগঞ্জের একটি দ্বিতল বাড়ীতে। পরবর্তীতে সেখান থেকে এসে তেলিয়াপারার বৈঠকে যোগ দেন সাংসদ কর্নেল ওসমানী। সেই বৈঠকে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বৈঠকে কর্নেল ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক (Commander in Chief) এবং সাংসদ অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল রবকে চীফ অফ স্টাফ (Chief of staff) হিসেবে সর্বসম্মতিক্রমে ঘোষণা করা হয়। একই বৈঠকে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানকে অন্তর্বর্তীকালীন ভাবে কয়েকটি সেক্টরে বিভক্ত করে সেক্টর কমান্ডারও নিয়োগ করা হয়। সাময়িকভাবে গেরিলাযুদ্ধের রণকৌশল নিয়েও কিছু সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যত শীঘ্র সম্ভব কোলকাতায় ফিরে কর্নেল ওসমানী প্রবাসী এবং ভারতীয় সরকারের সাথে আলোচনার পর সেক্টর কমান্ডারদের একটি মিটিং ডাকবেন। সেই মিটিংয়েই মুক্তিযুদ্ধের পরিকল্পনা এবং রণকৌশল সম্পর্কে বিশদ আলোচনার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। সেই মিটিং-এর আগেই আমি লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান এবং সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট নূর চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সর্বপ্রথম পালিয়ে দিল্লী হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে সক্ষম হয়েছিলাম। এইসব বিষয়ে ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ তে বিস্তারিত লিখেছি। বইটির ইংরেজি টাইটেল হচ্ছে ‘Untold Facts’. সেরুর আগমনের আগেই মোয়াম্মর গাদ্দাফি এবং তার রেভ্যুলুশনারি কমান্ড কাউন্সিল-এর ঘনিষ্ঠ সজ্জনদের সাথে বিদায় সাক্ষাত করলাম। কুশলাদি বিনিময়ের পর গাদ্দাফি বললেন

আপনারা লিবিয়া ছেড়ে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন কেনো? এখানে থেকেই তো বাংলাদেশে ঐক্যবদ্ধভাবে বিপ্লব ঘটাতে পারতেন। আমিও যথাসাধ্য সাহায্য করতে পারতাম। ধন্যবাদ জানিয়েই আমি সবার তরফ থেকে কিছু বক্তব্য রাখার অনুমতি চাইলাম।

বলুন, অনুমতি দিলেন মোয়াম্মর গাদ্দাফি।

মিশরে নাসেরের ছত্রছায়ায় থেকে তার শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সাহায্যে আপনারা যেভাবে বাদশাহ ইদ্রিসকে বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করেছিলেন ঠিক সেভাবে বর্তমানে জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতা থেকে সরানো সম্ভব নয় সেটা রশিদ, ফারুক এবার দেশে গিয়ে নিশ্চয় ভাল করেই বুঝে এসেছে আশা করি। যদিও জেনারেল জিয়া আজ আমাদের জন্যই ক্ষমতার কেন্দ্রে তবুও বাস্তবতা হচ্ছে তিনি আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজের পথে চলেছেন। কিন্তু সেটা সামরিক বাহিনীর সাধারণ সদস্য এবং জনগণের অজানা। তাই তারা জেনারেল জিয়াকে এখনও আমাদেরই একজন ভাবছেন। সেটাই অবস্থাকে জটিল করে তুলেছে, আর সেই সুযোগটি জেনারেল জিয়া অতি চতুরতার সাথে কাজে লাগিয়ে নিজের অবস্থানকে সুসংহত করতে উদ্যোগী হয়েছেন। এই অবস্থায় তার বিরুদ্ধে কোনও সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হলেও ভারতীয় আগ্রাসনকে ঠেকানো সম্ভব হবে না বিভক্ত সামরিক বাহিনী ও জাতিকে নিয়ে। তাই রাজনৈতিক ভাবেই জিয়ার মোকাবেলা করে জনগণের কাছে তার আসল রূপটা উন্মোচিত করতে হবে। এরপরই কোনও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ সফল করা সম্ভব হবে। এর আগে নয়। বিপ্লবের মূলশক্তি এবং রণকৌশল প্রতিটি দেশে একই প্রকার হতে হবে তেমন কোনও কথা নেই। যেমন, শিল্পোন্নত রাশিয়ায় বিপ্লবের মূলশক্তি ছিল শ্রমিক। কিন্তু গণচীনে বিপ্লবের মূলশক্তি ছিল কৃষক সম্প্রদায়। আমাদের বিপ্লবের মূলশক্তি ছিল পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গড়ে তোলা সামরিক বাহিনীর মধ্যে একটি গোপন সংগঠন। জেনারেল জিয়া নিজেও সেই সংগঠনের একজন হয়ে কাজ করতে রাজি হওয়ায় তাকে আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে চলেছিলাম। কিন্তু তাকে যখন আমরা ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত করি তখন তিনি সুযোগ বুঝে আমাদের কাছ থেকে সরে গিয়ে নিজের পথে চলার সিদ্ধান্ত নেন। শুধু তাই নয়, তিনি আমাদের সাংগঠনিক শক্তিকেও অনেকখানি দুর্বল করে ফেলেছেন বিভিন্ন ভাবে ভারতের সাথে সমঝোতার কারণে। অথচ দেশবাসী এখনো মনে করে তিনি আমাদেরই একজন। এই অবস্থায় আমি আবারও বলছি, আমাদের সর্বপ্রথম কাজটি হবে তার স্বরূপ জনগণের কাছে প্রকাশ করা আর সেই কাজটা করতে হবে রাজনৈতিক ভাবে। এরপরই সম্ভব হবে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার কোনও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা। তবে সেই সুযোগটা ঠিক এই মুহূর্তে জেনারেল জিয়া আমাদের দেবেন না কোনোক্রমেই। সুতরাং আমাদের অপেক্ষা করতে হবে উপযুক্ত সময়ের জন্য। সেই ধৈর্যের অভাবে শক্তির অপচয়ই হবে, হাসিল করা সম্ভব হবে না কিছুই। তিনি বুঝতে পারছেন বর্তমানে আমরাই তার প্রধান প্রতিপক্ষ। তাই আপনার দেশে আমরা যদি একত্রে থাকি তবে তিনি আমাদের গতিবিধি সন্দেহের চোখে দেখবেন এবং দেশের সাথে যোগাযোগের বিষয়ে বিশেষ ভাবে সতর্কতা অবলম্বন করে চলবেন। পক্ষান্তরে, তার প্রস্তাব মেনে কূটনৈতিক দায়িত্ব নিয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে যোগদান করলে তিনি স্বস্তিবোধ করবেন আর আমাদের সুবিধা হবে দেশের বিভিন্ন মহলের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলায়। যদিও তিনি রশিদ এবং ফারুককে কথা দিয়েছেন দেশে বহুদলীয় রাজনীতি চালু হলে তিনি তাদের রাজনীতি করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন না তবে আমাদের ধারণা তিনি অবশ্যই সেটা করবেন। আমরা মনে করি তিনি খন্দকার মোশতাক এবং তার রাজনৈতিক দলকেও তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দাড়াতে দেবেন না। মোয়াম্মর, আপনার ‘গ্রীনবুক’, মাও সে তুং-এর ‘লালবই’ এর সারবস্তুর মধ্যে তেমন কোনও বিশেষ তফাৎ নেই। একটিই মৌলিক তফাৎ, সেটা হল ‘আল্লাহ্ই সার্বভৌম’। আপনি বুঝতে সক্ষম হয়েছেন যদিও বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠী মুসলমান কিন্তু তারা আজ শুধুমাত্র জন্মসূত্রে নামে মুসলমান কাজে নয়। তাই আপনি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছেন যাতে করে তারা কাজে মুসলমান হয়ে ইসলামের হৃত ঐতিহ্য, গৌরব এবং সত্যকে বিশ্ব পরিসরে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারে। একইসাথে বিশ্বের নিপীড়িত জনগণকে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন এবং তাদের তল্পিবাহক কায়েমী স্বার্থবাদী শাসক শোষক গোষ্ঠীর অপশাসন এবং নিপীড়ন থেকে মুক্তির সংগ্রামে আপনি একজন বিপ্লবী হয়ে সার্বিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করে চলেছেন। এটাও প্রশংসনীয়। আমরাও কিন্তু আপনার মতোই বিশ্বাস করি, সৃষ্টিকর্তার বিধানের মাধ্যমেই সম্ভব বিশ্বমানবতার সার্বিক মুক্তি। আত্মিক এবং জাগতিক দুই ক্ষেত্রেই। একমাত্র তার বিধান মেনে চললেই প্রতিটি মানুষ নিজেকে তার খলিফা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হবে। যার জন্য আমাদেরকে এই পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। আমি কেন গণচীনে যাচ্ছি তার সাথে একটা ঘটনা জড়িত। পাকিস্তানের সাথে গণচীনের বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর জেনারেল আইয়ুব খান একটা ডেলিগেশন পাঠিয়েছিলেন পীর পাগারোর নেতৃত্বে। তাতে সদস্য ছিলেন মাওলানা ভাসানী। ফিরে এসে তিনি আমাকে বলেছিলেন, চীন সফরের পর নাকি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কেন আমাদের মহানবী(সাঃ) জ্ঞান অর্জনের জন্য চীনে যেতে বলেছিলেন। যুক্তি হিসাবে বলেছিলেন প্রথা অনুযায়ী অতিথিদের দেশের কয়েকটি প্রদেশ ঘুরিয়ে বিদায়ের আগে তাদের চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। সাক্ষাত কালে চেয়ারম্যান মাও প্রতিনিধি দলকে বলেছিলেন-দীর্ঘকালীন যুদ্ধে বিধ্বস্ত একটি দেশ ও জাতিকে নতুন চেতনায় নিজের পায়ে স্বনির্ভর ভাবে দাড়াবার জন্য চীনের নেতৃবর্গ জনগণের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাতদিন পরিশ্রম করে চলেছে। কারণ, তারা বিশ্বাস করেন পরভৃত হয়ে কোনও জাতি বা দেশ মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারে না। পারে না বিপ্লবের সুফল উপভোগ করতে। তাই দেশের আবাল বৃদ্ধ বণিতা যার যার সাধ্যমতো ঐক্যবদ্ধভাবে নিরলস পরিশ্রম করে চলেছে নিজেদের সম্বলের উপর ভিত্তি করেই। আমাদের এই যাত্রা সুদূর প্রসারী। এবার বলুন, আপনাদের কেমন লাগলো আমাদের দেশ ও জনগণ? জবাবে পীর পাগারো বললেন

সুবহানআল্লাহ! আপনাদের দেশ ঘুরে যা দেখলাম তাতে আমার মনে হয়েছে, একমাত্র ঈমানের বিষয়টি ছাড়া কোরআন আর আমার প্রিয় রসুলের (সাঃ) হাদিসে যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আপনি যেন সেইসব নির্দেশই বাস্তবে পরিণত করার চেষ্টা করছেন দেশ ও জাতির কল্যাণে। জবাবে চেয়ারম্যান মাও বললেন

মহতারেম মওলানা, আমি কোরআন-হাদিস পড়েছি শ্রদ্ধার সাথে এবং অনেক কিছুই আমি শিখেছি। তারই যতটুকু সম্ভব আমি বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করছি মানুষের কল্যাণে। আর ঈমানের প্রসঙ্গে বলতে চাই, কে প্রকৃত ঈমানদার আর কে নয় তার বিচার করার এক্তিয়ার রয়েছে শুধুমাত্র আল্লাহর, কোনও মানুষের নয়। মাও সে তুং-এর এই জবাব শুনে বুজর্গরা সবাই নাকি মাথা হেঁট করে বসেছিলেন। তখন থেকেই আমার একটা ইচ্ছে ছিল সুযোগ পেলে চীনে যাবার। তাই জিয়ার দেয়া সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না। আপনি একান্ত আন্তরিকতার সাথে আমাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন, আমরাও আপনাকে শুধু লিবিয়াবাসীর ভাগ্যোন্নয়নের জন্যই নয় পৃথিবীর সব প্রান্তের মুসলমান জনগোষ্ঠী এবং নিপীড়িত জনগণের মুক্তিসংগ্রামে নিবেদিত প্রাণ একজন বিরল বিপ্লবী নেতা হিসাবে যে সাহসিকতার সাথে সাহায্য করে চলেছেন পশ্চিমাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার জন্য আন্তরিক ভাবেই শ্রদ্ধা করি। সেই সুবাদে আপনার কাছে কয়েকটা প্রশ্ন চিন্তার খোরাক হিসাবে রেখে যেতে চাই। সারা বিশ্বে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে হাজার হাজার গরীব বাচ্চাদের দু‘বেলার অন্ন এবং বাসস্থানের সংস্থান করে বিভিন্ন ফিকরার মাদ্রাসাগুলোতে কোরআনে হাফেজ বানানো হচ্ছে আপনার মতো অনান্য তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশগুলোর আর্থিক জোগানে, মসজিদও গড়ে তোলা হচ্ছে। এটা অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ, তবে তাদের মধ্যে প্রকৃত ইসলামের মর্মবাণী ও সারবস্তু সাম্যবাদ, মানবিক মূল্যবোধ, ঈমানী ঐক্য, হক এবং বাতিলের সংঘর্ষ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আর ন্যায়ের পক্ষে সোচ্চার হওয়ার মতো সাহসিকতা, ভাতৃত্ববোধ, সমাজ এবং রাষ্ট্র সম্পর্কে সচেতনা, আধিপত্যবাদ, শোষণ, বঞ্চনা, অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনার উন্মেষ ঘটানো হচ্ছে কি? বিশ্বমানবতার কল্যাণে ইসলামের সর্বজনীন প্রয়োজনীয়তার সত্যকে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেবার মতো যোগ্য সৈনিক কতজন সৃষ্টি করা হচ্ছে? আমি নিজে অনেক মাদ্রাসাতে গিয়ে তাদের প্রধানদের কাছে এইসব প্রশ্ন করে সদুত্তর পাইনি। রাষ্ট্র এবং রাজনীতির সাথে তাদের কোনও সম্পর্ক নেই, তাদের প্রধান কাজ হচ্ছে ভাল মুসলমান গড়ে ইসলামের হেফাজত করা! আমি তাদের এই অদ্ভুত জবাব শুনে প্রশ্ন করেছি, রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সমাজ ব্যবস্থা এবং রাজনীতি প্রমুখ বিষয়গুলো যা জনগোষ্ঠীর সাথে সম্পৃক্ত, তা যদি ইসলামের আওতায় না পড়ে তাহলে ইসলামকে পূর্ণাঙ্গ একটি জীবনবিধান হিসাবে কি করে গ্রহণ করা সম্ভব? তারপরও কথা থাকে। বিষয়গুলো যদি ইসলামের আওতায় নাই পড়ে তাহলে শেষনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লেল্লাহু আলাইহি ওয়াস সাল্লাম কেনো মদিনায় একটি আদর্শ ইসলামিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করে সেখানে প্রকৃত ইসলামের আলোকে গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রবর্তন করেছিলেন? জাগতিক জীবনকে বাদ দিয়ে তো ইসলাম নয়, বরং আত্মিক এবং জাগতিক জীবনে কি করে সফল হওয়া যায় সেটারই সঠিক পথ নির্দেশক হচ্ছে ইসলাম। এসব প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত জবাব দিতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রায় সব জ্ঞানী বলে প্রতিষ্ঠিত আলেম-ওলেমারা। তাদের অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন, সবাই যখন ভাল মুসলমান হয়ে যাবে তখন রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থাও ঠিক হয়ে যাবে। আমার কাছে যুক্তিটি একটা খোঁড়া যুক্তি মনে হওয়ায় বলেছিলাম, রসুল(সাঃ) কিন্তু মদিনাবাসীদের সবাই মুসলমান হয়ে যাবে তারপরই ইসলামিক রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার অপেক্ষায় বসে থাকেননি। তিনি যখন মদিনাতে ইসলামিক রাষ্ট্র, শাসন এবং সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করেন তখন মদিনাবাসীর অনেকেই ইসলাম ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেনি। পরিশেষে তাদের বলেছিলাম, এতবড় মুসলিম বিশ্বে দারুল ইসলাম কোনটি সেটা আমাকে বুঝিয়ে দিন। তারা সবাই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে নিশ্চুপ হয়ে ছিলেন।

ইসলামের পুনর্জাগরণের জন্য যারাই ব্রতী তাদের সবাইকেই এইসব প্রশ্নগুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে, কেনো আজ মুসলিম জাহান বিশ্বপরিসরে শতধা বিভক্ত? কেনো জন্ম নিচ্ছে ফিকরাবাজির নামে বিভিন্ন প্রকারের ইসলাম? কাদের স্বার্থে এই আত্মঘাতী বিভাজন? বিশ্বনবীর জীবনকালে তো এ ধরনের কোনও ফিকরার জন্ম হয়নি, অস্তিত্বও ছিল না। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তার মৃত্যুর পরলগ্ন থেকেই এইসব বিভাজন সৃষ্টির উদ্দেশ্য, কারণ, উপাদান এবং ষড়যন্ত্র সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে বর্তমানের আত্মঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত শতধা বিভক্ত মুসলিম উম্মাহকে একই ঈমানে বলিয়ান করে একটি ইস্পাত কঠিন ঐক্যবদ্ধ উম্মাহ্তে রূপান্তর করা কি করে সম্ভব? মানুষ প্রণোদিত শাস্ত্র এবং দর্শনে বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিভিন্ন ফিকরা কিংবা তরিকার উদ্ভাবন সম্ভব, কিন্তু কোরআন ঐশ্বরিক বিধান, এক ও অভিন্ন। তাই এখানে কোনও ফিকরা বা তরিকার অবকাশ নেই। আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি এই বিভাজনের উৎপত্তি ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থেকে। সময়ের ঘটনা প্রবাহে এই ধারণাটা প্রায় সত্যে পরিণত হচ্ছে সর্বত্র। যতদিন সত্যকে মেনে নিয়ে মদিনার চেতনায় মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ না হবে ততদিন পর্যন্ত ইসলামের পুনর্জাগরণ সম্ভব হবে না। আর এই ঐক্য প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত হচ্ছে সম্পদ আর বিত্তশালী দেশগুলোর ইসলাম বিরোধী শক্তিগুলোর তল্পিবাহক ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী, যারা ইসলামের নামে ইসলামের অপরিমেয় ক্ষতিসাধন করছে তাদের প্রথমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে অপসারিত করা। নিজেদের দুর্গই যদি মজবুত না হয় তবে বহিঃশক্তির সাথে লড়াই করে জেতা সম্ভব হবে কি করে? বিজ্ঞজনরা বলেন, শিক্ষিত মানুষ নাকি অশিক্ষিতের চেয়ে বেশি বিপদজনক। এই আত্মঘাতী বিভাজনের ভয়াবহ পরিণাম কি আজকের দুনিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোতে পরিলক্ষিত হচ্ছে না? বিভিন্ন দেশের কিছু ব্যক্তি এবং পরিবার ধর্মীয় ঠিকাদার হয়ে বৈদেশিক অর্থের লোভে দেশীয় কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী যারা ন্যূনতম অস্তিত্বের জন্য তাদের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল তাদেরকে মূলধন করে খোলাখুলিভাবে ক্ষমতার অংশীদারিত্ব পাবার জন্য ধর্মের ব্যবসা করে চলেছে না? স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা সহিংসতা, দাঙ্গা ফ্যাসাদ করতেও দ্বিধা বোধ করছে না। স্বীয় স্বার্থে, বিদেশী পে-মাস্টারদের উস্কানিতে কিংবা অন্য যেকোনো কারণেই হউক, আজ এইসব ধর্মের ধ্বজাধারী কুপমন্ডুকেরা সব মুসলিম দেশেই বিভক্তি সৃষ্টি করে চলেছে। ধর্মীয় গোঁড়ামির মাধ্যমে অস্থিতিশীল করে তুলে প্রায় সব কয়টি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ও জাতিকে পশ্চাদপদতার দিকে ধাবিত করছে। অপমানজনক উদ্ভট ফতোয়ার মাধ্যমে ইসলামকে হেয় প্রতিপন্ন করছে। এইসব গদ্দিনশিন সারশূন্য নামসর্বস্ব আলেম-ওলেমারা তাদের খানকা আর মাদ্রাসার বয়াতিদের প্রয়োজনে বিদেশী প্রভুদের অঙ্গুলি হেলনে রক্তপিপাসু হায়েনার মতো লেলিয়ে দিচ্ছে সাধারণ নিরীহ জনগণের মৌলিক ইস্যুগুলো নিয়ে সোচ্চার প্রতিবাদী কণ্ঠগুলোকে রোধ করে জনগণের ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামগুলোকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে। কিন্তু এ সমস্ত বাস্তঘুঘুদেরই খয়রাত দিয়ে চলেছেন ধনী মুসলিম দেশগুলোর শাসকগোষ্ঠী। এতে কি ইসলামের অগ্রগতি হচ্ছে? এভাবে যদি মুসলমানদেরকেই মুসলমানদের শত্রু করে তোলা সম্ভব হয় তাহলে একসময় বহিঃশক্তির প্রয়োজন হবে কি? একই ভাবে তারাই সৃষ্টি করছে নিজেদের এবং তাদের বিদেশী মোড়লদের বিশেষ স্বার্থে বিভিন্ন জঙ্গিবাদী ও সন্ত্রাসী গ্রুপ বা দল। স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন ভাবে। ক্ষেত্রবিশেষে তাদের মাধ্যমে চালানো হয় প্রক্সি ওয়ার কিংবা দু একটি নাশকতামূলক ঘটনা ঘটিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রিত বিশ্ব মিডিয়ার মাধ্যমে জোর প্রচারণা চালিয়ে তাদের পরিচিত করা হচ্ছে বিশ্ব ব্যবস্থা এবং শান্তির প্রতি হুমকি স্বরূপ লোমহর্ষক সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হিসাবে। এইভাবেই বিশ্বজনমত গড়ে তুলে তারা জোটবদ্ধ হয়ে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী যেকোনো দেশে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পদশালী দুর্বল দেশ কব্জা করে নিচ্ছে অথবা সম্ভাবনাময় জাতি-রাষ্ট্রগুলোকে ধ্বংস করে দিয়ে তাদের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল করে তুলছে বিশ্বশান্তি এবং বিশ্ব নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ধুয়া তুলে। শুধু সম্পদ লোটার স্বার্থ হাসিলই নয়, একই সাথে প্রচারণা চালানো হয়, ইসলাম মানেই হচ্ছে মানবতা বিরোধী, জঙ্গিবাদী, সন্ত্রাসবাদী, পশ্চাদপদ এক উদ্ভট জীবন দর্শন। শান্তি ও সাম্যের প্রতীক ঐশ্বরিক বিধানের এই মিথ্যা এবং বিকৃত রূপ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অপচেষ্টায় আমাদের দায়-দায়িত্ব কতখানি সেটার সঠিক মূল্যায়নও সময়ের দাবি। এক্ষেত্রে সাহসী যৌক্তিক পদক্ষেপ না নিয়ে উটপাখির মতো বালির ঢিবিতে মুখ লুকিয়ে নিজেদের ধোয়া তুলসিপাতা বানিয়ে রাখার অবকাশ নেই। নিজেদেরকে সব লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে উঠিয়ে অতীতের সব ভুল কার্যক্রমকে শুধরে নিতে হবে সবাইকে। তা নাহলে অচিরেই আমরা সবাই ইহকাল এবং পরকাল দুটোই হারাবো উম্মতে মোহাম্মদী হয়েও। অবশ্য আমরা আমাদের কর্তব্যে ব্যর্থ হলে আল্লাহ্ই তার দ্বীনকে নিজেই জয়ী করাবেন। এটা আল্লাহ্ই নিজে বলেছেন কোরআনে। এই বৈঠকের মাধ্যমে আমাদের লিবিয়ায় থাকার অধ্যায় শেষ হল।