“সংঘর্ষের পথে জিয়া”

সর্বত্র শান্তি বিরাজমান। এবার শুরু হল চক্রান্তবাজ স্বার্থান্বেষী অফিসারদের আসল খেলা।

জিয়াউর রহমানের মাথায় ঢুকানো হল ভিন্ন চিন্তা। ১২ দফার সৈন্যদের এখনই শায়েস্তা করতে হবে তা না হলে আবার তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আবার বিদ্রোহ করতে পারে। এদের শক্তি এখনি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তার পাশে এখন জড়ো হয়েছেন তারই নির্বাচিত পেপার টাইগার উপদেষ্টাগণ। এসেছেন যশোহর থেকে মীর শওকত আলী। তিনি ইতিমধ্যেই রাজধানী ঢাকায় নবম ডিভিশন গঠন করে হয়েছেন মেজর জেনারেল। দিল্লী থেকে উড়ে এসেছেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনিও প্রমোশন নিয়ে এখন মেজর জেনারেল ও ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ। এসেছেন দিল্লী থেকে ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর। বার্মা থেকে ডেকে পাঠিয়ে আনা হয়েছে ব্রিগেডিয়ার নুরুল ইসলাম শিশুকে। CMH থেকে ভাঙ্গা পা নিয়েও উঠে এলেন কর্নেল মইনুল হোসেন। তারা সবাই জেঁকে ধরেছেন জিয়াকে। হালুয়া-রুটি নিয়ে কাড়াকাড়ির ধুম! জিয়াউর রহমান অনেক অপমান সহ্য করেছেন। চাপের মুখে তাকে সৈনিকদের তরফ থেকে ১২ দফায় সই করতে বাধ্য করা হয়েছে। এরই মধ্যে চাপ সৃষ্টি করে ব্যাটম্যান প্রথাসহ বেশ কিছু সুবিধা আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর নয়। এবার ১২ দফার দাবিদারদের শায়েস্তা করার পালা। ডেপুটি চীফ ও নবম ডিভিশন কমান্ডার মীর শওকত আলী এখন তাঁর প্রধান উপদেষ্টা। তাদের যাঁতাকলে আবদ্ধ জিয়া। তাদের কথামতই ওঠেন বসেন জিয়াউর রহমান। তারা নিজস্বার্থেই জিয়াকে দ্রুত বিপ্লবী সৈনিকদের সাথে সংঘর্ষের পথে ঠেলে দিচ্ছে। একদিন জিয়া বললেন, ‘আমি ঢাকা থেকে সিগন্যাল ইউনিটকে সরাতে চাই, এরা বেশি শিক্ষিত হয়ে উঠেছে। আমি বুঝিয়েছিলাম, এরকম করাটা এখন ঠিক হবে না। অসন্তোষ বাড়বে। তিনি কিছুই শুনলেন না বললেন, “দেখো কি ভাবে আমি তাদের শায়েস্তা করি”। আর্মি হেড কোয়ার্টারের হুকুমে তাদের কুমিল্লায় যেতে হলো। এ নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হল। প্রথমে তারা যেতে অস্বীকার করলো তবে শেষপর্যন্ত সুকৌশলে কাজ সেরে নেয়া হলো। তারা অসন্তুষ্ট হলেও জিয়ার নির্দেশ মেনে নিলো। সৈনিকরা জিয়ার মতিগতি নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠলো। ২০শে নভেম্বর ছিল জিয়াকে নিয়ে আমার বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিট ভিজিট করার পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রাম। আমি ১৯ তারিখে দুপুরে জিয়াকে ভিজিটের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি বললেন, “আমি ঐ বেয়াদপ ট্যাঙ্কওয়ালাদের ভিজিট করবো না।”আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেনো কি হয়ে গেলো? এটাতো নির্ধারিত প্রোগ্রাম। তিনি বললেন, বেঙ্গল ল্যান্সার সবচেয়ে উচ্ছৃংখল ইউনিট। এদের আমি ঢাকা থেকে বগুড়া পাঠাবো। তুমি মঞ্জুরের সাথে কথা বলো, ও ব্যবস্থা নিচ্ছে। স্পষ্ট বুঝলাম, ঊর্ধ্বমার্গে নতুন চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। বললাম, এদের এখন মুভ করানো ঠিক হবে না। তারা রিঅ্যাক্ট করবে। জিয়া রেগে গেলেন। বললেন, জানি you are trying to be popular. আমি সব বুঝি, কিন্তু তারা যাবেই। আমি বললাম,তাহলে লগ এরিয়া কমান্ড থেকে এই ইউনিটটি সরিয়ে নেন। আমি তাদের এই অর্ডার দিতে পারবো না। কারণ, আমি জানি এতে একটা গণ্ডগোল বাধবেই। জিয়া বললেন,হামিদ আমি সব বুঝি, সব খবর রাখি। Okay. আজ থেকে বেঙ্গল ল্যান্সার তোমার কমান্ডে নয়। আর্মি হেডকোয়ার্টারের সরাসরি কমান্ডে আসলো। তুমি চিঠি পেয়ে যাবে। পর দিনই চিঠি পেলাম। মঞ্জুর ফোন করে রসিকতা করে বললো, দাদা আপনার ঘাড়ের বোঝা কিছুটা হালকা করে দিলাম। তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ব্যাপারটা আমি জানি। Thank you and wishing you best of luck with the Tankers. খুব সম্ভব মঞ্জুরের সাথে সেটাই ছিল আমার শেষ বাক্যালাপ। পরবর্তী কালে মঞ্জুর চট্টগ্রামে সেনা অভ্যুত্থানে নির্মমভাবে নিহত হন। যাই হউক, এখন শক্ত এ্যাকশন নেবার পালা। তাদের নির্দেশ দেয়া হলো ঢাকা ত্যাগ করে বগুড়ায় মুভ করার জন্য। বলা হলো, এটা ট্যাকটিকাল মুভ। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য বুঝতে ল্যান্সারের সৈনিকদের বুঝতে কষ্ট হয়েনি। তারা জিয়ার আদেশ মানতে সরাসরি অস্বীকার করলো। শুরু হলো নতুন করে হট্টগোল।ল্যান্সার এর সৈনিকরা আবার অস্ত্র হাতে গর্জে উঠল। ট্যাংকগুলো সচল করে তারা আবার লড়াই এর জন্য তৈরি হয়ে গেলো। তারা জিয়ার সেনাসদরের বাস্তিল দুর্গ গুঁড়িয়ে দেবে।২২শে নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা খুবই নাজুক ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। যেকোনো মুহূর্তে গোলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে। আবার মহাসংকটে জিয়া। এই সংকট থেকে তাকে উদ্ধার করার জন্য মেজর মহিউদ্দিন, সুবেদার মেজর আনিস এবং রিসালদার সারোয়ারের শরণাপন্ন হতে হয় জিয়াকে। তারাই তাদের সাথী বিপ্লবী ভাইদের বুঝিয়ে শান্ত করে চীফের নির্দেশ পালনে রাজি করালো।”

পাঠকদের অবগতির জন্য যেটা সম্পর্কে কর্নেল হামিদ বা অন্য কেউ অবগত ছিলেন না সেটা লিখতে বাধ্য হলাম সত্যের খাতিরেই। এই সংকট দেখা দিলে জেনারেল জিয়া যখন মেজর মহিউদ্দিনের সাহায্য প্রার্থনা করেন, তখন মেজর মহিউদ্দিন জিয়াকে ব্যাংককে অবস্থিত সেনা পরিষদের শীর্ষনেতাদের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলো,

সেখান থেকে যেই নির্দেশই আসবে সেটাই কার্যকর করা হবে। জিয়াকে সেই পরামর্শ দিয়ে মেজর মহিউদ্দিন ব্যাংককে সেনা পরিষদের নেতাদের সাথে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে নির্দেশ চায়। সার্বিক বিবেচনায় জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে তখন জিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষমতার লড়াই যুক্তিসঙ্গত হবে না বলে অভিমত জানিয়ে মেজর মহিউদ্দিনকে অবস্থা স্বাভাবিক করে তুলতে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন ব্যাংককে অবস্থানরত নেতারা। এভাবেই তারা অবস্থাকে সামাল দিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়াকে রিষ্কারভাবে ব্যাংকক থেকে জানানো হয়েছিলো, তার স্বার্থে নয়- জাতীয়স্বার্থেই ল্যান্সারের বিপ্লবীরা তার নির্দেশ মেনে নেবে। তবে তার জানা উচিত, ইতিমধ্যে সেনা পরিষদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে ক্ষমতালোভীদের খপ্পরে পড়ে বিদেশী পশ্চিমা শক্তিধর দেশসমুহ আর ভারতের সাথে আপোষ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজের মুঠোয় কুক্ষিগত করার জাতীয় স্বার্থবিরোধী এবং আত্মঘাতী যে খেলায় তিনি মেতেছেন তার পরিণতির সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব শুধুমাত্র তাকেই বহন করতে হবে।

তাকে আরও বলা হয়েছিলো যাদের ত্যাগের ফলে আজ তিনি ডাস্টবিন থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত তাদের ত্যাজ্য বিবেচনা করার পরেও শক্তিশালী সেনা পরিষদ দেশের স্বার্থে কখনোই আজকের জিয়ার সাথে ক্ষমতার লড়াই করবে না আগ্রাসী ভারতকে সুযোগ করে দিতে যাতে করে বাংলাদেশকে আর একটি সিকিম কিংবা ভুটানে পরিণত হতে হয়। এ বিষয়ে জিয়া নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। কথোপকথন শেষ করার আগে জেনারেল জিয়াকে সতর্ক করে বলা হয়েছিলো তার পথ তাকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটা যথা সময়ে দেশবাসী দেখবে। তবে তার জেনে রাখা উচিত সেনা পরিষদ কখনো কোনও কারণেই তাদের নীতি-আদর্শের সাথে বেঈমানি করবে না।

নিশ্চুপ থেকে কথাগুলো শুনে জিয়ার কালো মুখটা হয়তোবা আরো একটু বেশি কালো হয়ে উঠেছিলো এই ভেবে যে বিদেশে থেকেও তার ক্ষমতালিপ্সা, কূটচাল, ছলচাতুরি এবং মোনাফেকির সব গোপন খবর সম্পর্কে আমরা অনেকটাই অবগত। ফিরে চলি কর্নেল হামিদের লেখায়।

‘‘২৩শে নভেম্বর ল্যান্সারের একটি স্কোয়াড্রন সাভারে রেখে বাকি সবাই বগুড়ায় চলে যায়। সেনা সদরের কাগুজে বাঘরা হাঁপ ছেঁড়ে বাঁচলো, জিয়ার মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। এবার ক্যান্টনমেন্টে জিয়ার পূর্ণকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। তাকে চ্যালেঞ্জ করার আর কেউ রইলো না। এই সময় ক্ষমতার আবর্তে জিয়া গভীরভাবে আটকা পড়েন। ক্ষমতায় বসেও শান্তিতে নেই জিয়া। চারিদিকে বিপ্লবী সৈনিকদের বিরুদ্ধাচরণ। ক্ষমতা নিরংকুশ করতে পাগল হয়ে উঠলেন জিয়া। তার অবস্থা ভালো করে বুঝতে পারে চতুর পরামর্শকরা। তারা বুঝতে পারে তার দিন ঘনিয়ে আসছে। ক্ষমতার মসনদ থেকে যেকোনো মুহূর্তে তিনি ছিটকে পড়তে পারেন। তারপর কে, কে? সেই সন্ধিক্ষণে জিয়ার পাদপার্শে থেকে এরশাদ ও মঞ্জুর ভয়ানক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মেতে ওঠে। দুইপক্ষেই ইন্ধন যোগাতে থাকে শওকত। প্রদীপের নীচেই চলে গোপন খেলা। জিয়া যতই ক্ষমতা নিরংকুশ করতে কঠোর হচ্ছিলো তারা তাকে ততই চরম পরিণতির দিকে ঠেলতে থাকে। তিন খলিফার মধ্যে নেপথ্যে ক্ষমতার লড়াই চলে নিরবে অতি সন্তর্পণে। জিয়া কালো চশমার আড়াল থেকে ব্যাপারটা কিছুটা অনুধাবন করলেও তখন তেমন পাত্তা দেননি। জিয়া ভেবেছিলেন, তিনি এখন শক্ত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। বিপ্লবীদের সাথে কোনও আপোষ নয়।বিগড়ে গেলে জিয়া নিষ্ঠুর ভয়ংকর!

জিয়ার সাথে বিপ্লবীদের আলোচনা ভেঙ্গে যায়। তাদের ভাষায়, জিয়া তাদের সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকলেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। জিয়ার পরামর্শ দাতারা তাকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, দাণ্ডাতেই ঠাণ্ডা হবে সব তাই জিয়া কঠোরভাবে বিপ্লবীদের দমন করার নির্দেশ দেন। এ ব্যাপারে আমি পরে বিশদ আরও নাজানা কথা লিখব। ফিরে চলা যাক কর্নেল হামিদের লেখায়।

‘‘জিয়া তখন অস্থির এবং হিংস্র। বাছবিচার না করেই ঢালাও ভাবে বিপ্লবীদের শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর। তার হাতে লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দেয় তার নিয়োজিত DGFI কোর্সমেট জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী। জিয়া তখন বাঘের পিঠে সওয়ার। আমি কিন্তু তার কথায় অধীনস্থ অফিসার এবং সৈনিকদের বিরুদ্ধে গণ চার্জসীট তৈরি করে শাস্তি প্রদানের ঘোর বিরোধী ছিলাম। বাছবিচার না করে ঢালাওভাবে বিপ্লবীদের খতম করতে জিয়া তখন বদ্ধপরিকর। তাকে শান্ত করার কেউই ছিল না বরং চতুর পার্শ্বচররা তার মেজাজ বুঝে তাকে ক্ষেপিয়েই দিলো। কারণ, এই সমস্ত অফিসারদের মনে এমনকি জিয়ার মনেও বিপ্লবীদের প্রতি কোনও শ্রদ্ধা ছিল না, ইতিমধ্যে আমার চেয়ে জুনিয়র অনেককেই জিয়া পদোন্নতি দিলো। আমার প্রমোশন আটকে দেয়া হলো এরশাদ আর শওকতের কানকথায়। কানকথায় প্রভাবিত হওয়া বড় রকমের স্বভাবগত দোষ ছিল জিয়ার। পদত্যাগ পত্র নিয়ে আমি তার সাথে শেষ দেখা করতে গেলাম। সামনে পদত্যাগ পত্র রেখে সোজাসুজি বললাম, জিয়া যে আর্মিতে ইনসাফ নেই, আইনের শাসন নেই, চক্রান্তের শেষ নেই, যে আর্মি চীফ অফ স্টাফ অবিচার করে, বিশ্বাসের মর্যাদা দেয় না, নিজের স্বার্থকেই বড় করে দেখে, উপকারীর উপকার স্বীকার করে না, নিজের ক্ষমতার স্বার্থে রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিতে পারে, যোগ্যতার মর্যাদা দেয় না, কান কথায় চলে সে আর্মিতে আমি আর চাকুরী করবো না।

Look Hamid, এইসব সেন্টিমেন্টাল কথা রাখো।

না জিয়া, প্রমোশন তোমার কাছে ভিক্ষা চাইতে আসিনি। If I am fit, I get it or I don’t. আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। জিয়া বিগড়ে গেলো। সেও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। চিৎকার করে বললো, আমার বিশ্বস্ত অফিসাররা প্রমাণসহ বলেছে, তুমি জোয়ানদের কাছে পপুলার হওয়ার চেষ্টা করছো। তোমার সৈনিকগুলিই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে বাধা দিচ্ছে। তুমি কোনও এ্যাকশন নিচ্ছো না। শুধু প্রশ্রয় দিচ্ছো। আমি বিনীতভাবে বললাম,

দোস্ত! তুমি তোমার এসব বিশ্বস্ত অফিসারদের নিয়েই সুখে থাকো। আমাকে রেহাই দাও। তবে আমার শেষ কথাটি মনে রেখো, যারা হঠাৎ করে উড়ে এসে তোমাকে ঘিরে ধরেছে, তারাই একদিন তোমাকে ফিনিশ করবে। পদত্যাগ পত্র ছিঁড়ে ফেলেছো, আমি অফিসে ফিরে গিয়ে আবার পাঠাচ্ছি, প্লিজ গ্রহণ কোরো। শুধু আমার প্রাপ্য পেনশনটা দিয়ো।

পদত্যাগের পর আমার জীবনধারা কঠিন হয়ে পড়লো। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এর আগে আরো অনেক অফিসার প্রতিবাদ করেন। তাদেরকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। আমিই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম অফিসার যে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে সরকারী চাকুরি ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। বাইরেও আমি নিরাপদ ছিলাম না। আমাকে কড়া মূল্য দিতে হয়েছিলো। এরশাদ-শওকত চক্র আমাকে বিপদে ফেলতে বহুদিন সক্রিয় থাকে। দেখলাম, এই দেশে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিপদসংকুল। তার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের মন জুগিয়ে চলাতেই ফায়দা বেশী। এতে ক্ষমতাসীনদের চক্ষুশূল হতে হয় না। নিরাপত্তা, প্রোমোশন ও অন্যান্য সুখ-সুবিধা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে, ক্ষমতাবানদের মন জুগিয়ে বন্ধু হয়ে নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে বসবাস করা যায়। দরকার শুধু স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দেওয়া। অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসার সাথে সাথে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিপ্লবী চেতনায় প্রভাবিত সৈনিক ও অফিসারদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত নির্মম ব্যবস্থা গ্রহণ করা শুরু হল। বহিষ্কার, ট্রান্সফার ও বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হলেন তারা। ঢাকা থেকে সব বিপ্লবী অফিসার এবং সৈনিকদের বাইরে পাঠানো হল। যদিও ঐসব বিপ্লবীদের দ্বারাই জিয়া ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।

এ সমস্ত নির্যাতনমূলক ব্যাবস্থার প্রেক্ষিতে আবার ধীরে ধীরে ধূমায়িত হতে থাকে সেনা অসন্তোষ। দুর্ভাগ্যবশত এই সময় জিয়া এমন সব সিনিয়র অফিসারদের দ্বারা প্রভাবিত হন, যাদের মনে কস্মিনকালেও বৈপ্লবিক চিন্তাচেতনা এবং বিপ্লবী সেনাদের স্বার্থ স্থান পায়নি। বিপ্লবী সৈনিকদের বুক নিংড়ানো ভালবাসা এবং বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে জিয়ার উত্থান ঘটলেও ৭ই নভেম্বরের পর থেকে জিয়া তার অভিজাত পারিষদবর্গ পরিবেষ্টিত হয়ে অতিদ্রুত বিপ্লবীদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন। বিপ্লবীদের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলেন বিপ্লবীদের প্রিয় সেনাপতি। অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠল বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে।
সিগন্যাল রেজিমেন্টকে ঢাকার বাইরে পাঠানো হল। বেঙ্গল ল্যান্সারকে বগুড়ায়। ৩৮তম লাইট অ্যাকঅ্যাক এবং অন্যান্য ইউনিটগুলোর প্রতি একই রকমের অবিচার করা হল। এভাবেই ঢাকার বিপ্লবীদের বাইরে সরিয়ে দেয়া হল। ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর এর সাথে যারা জড়িত ছিল হয়রানির শিকার হল তারাই। যে সব বিপ্লবী অফিসার ও সৈনিকদের বলে জিয়ার পক্ষে ক্ষমতায় আসীন হওয়া সম্ভব হয়েছিলো তাদের উপরেই নেমে এলো খড়গ! তখন যে সব অফিসারদের জিয়া বিশ্বস্ত মনে করতো তারা অন্তর থেকে কখনই মেনে নিতে পারেনি বিপ্লবীদের কিংবা তাদের দাবি-দাওয়াকে।যদিও ১৫ই আগস্ট কিংবা ৭ই নভেম্বরের ভয়াবহ অভ্যুত্থান দিবসের সামান্যতম আঁচড়ও তাদের গায়ে লাগেনি। সর্বত্র সংগঠিত হতে দেখা গেল প্রহসনমূলক সেনাবিদ্রোহ।বিপ্লবীরা তাদের প্রিয় জেনারেলকে গদীতে সমাসীন করার পর এ ধরনের প্রায় ১৮ টি ছোট বড় সেনাবিদ্রোহের খবর প্রচারিত হল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোহর, রংপুর, সৈয়দপুর, বগুড়া কোন সেনানিবাসই বাদ পড়লো না।

কতজন প্রাণ হারালো, ফাঁসিতে ঝুললো, জেলে গেলো, গুমখুন হল, আততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করলো তার কোনও হিসাব নেই। শত শত পরিবারে কান্নার রোল। দেশের প্রতিটি ইউনিট কমান্ডিং অফিসার থেকে বিভিন্ন র‌্যাঙ্কের ২০ থেকে ৩০ জনের নাম চেয়ে পাঠানোর নির্দেশ জারি করা হয়েছিলো সেনাসদর থেকে জিয়ার সম্মতিক্রমে। যাদের বিনাবিচারে ফায়ারিং স্কোয়াডে নৃশংসভাবে গুলি করে কিংবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। এই নির্দেশ পাঠানোর নাটের গুরুরা জিয়াকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলো এই যুক্তি উপস্থাপন করে যে, এ ধরনের নিষ্ঠুরতায় যে ধরনের লোমহর্ষক শক ওয়েভের সৃষ্টি হবে তাতে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কথায় আছে, ডাণ্ডাতে ঠাণ্ডা। সেনাবাহিনীর সদস্যদের মাথা থেকে বিপ্লবী চেতনা চিরতরে উধাও হয়ে যাবে। প্রাণের দায়ে ভয়ে তারা শংকিত হয়ে ভাববে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। কিন্তু ইতিহাস কি সেই সাক্ষ্য বহন করে? এ ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল বর্বরতাকে সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করেই দেশীবিদেশী ক্ষমতালিপ্সু আস্তিনের শ্বাপদের ষড়যন্ত্রে জেনারেল জিয়া ও তার ঘনিষ্ঠ অনেকজনকে নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছিলো একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পাতানো খেলায়। আগুন নিয়ে খেলতে গিয়ে নিজের প্রজ্জ্বলিত অনলেই পুড়ে মরতে হয়েছিলো প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াকে। ষড়যন্ত্রমূলক চক্রান্তে জিয়ার মৃত্যু হলেও একটি সত্য মানতেই হবে, হত্যাকারীদের সুযোগ করে দিয়েছিলেন স্বয়ং জিয়া নিজেই বিপ্লবীদের সাথে তার আত্মঘাতী বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে। কর্নেল হামিদ আরও লিখেছেন

ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার পর বিপ্লবীদের দেয়া কোনও প্রতিশ্রুতিই জেনারেল জিয়া রাখেননি এবং বাস্তবায়িত করলেন না কোনও দাবি। পরিবর্তে তাদের উপর চলে দমন নীতির স্টিমরোলার। বিদ্রোহী সেনা সদস্যদের পাকড়াও করে তাদের নির্মমভাবে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হল। সংক্ষিপ্ত বিচারের সুবিধার্থে মার্শাল ল’ আইনে বিশেষ সামরিক আদালত গঠন করা হল। এই সময় জেনারেল এরশাদ ছিলেন ডেপুটি চীফ। তারই তত্ত্বাবধানে এসব সংক্ষিপ্ত বিচার দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়। শুরু হল ত্বরিত গতিতে বিচারের প্রহসনের পালা। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে কয়েক শত সেনা এবং বিমানবাহিনীর সদস্যদের ফাঁসির আদেশ দেয়া হল। সামরিক বাহিনীর আইন-কানুন এ ক্ষেত্রে মেনে চলা হয়নি। দেশের পাঁচটি কারাগারে প্রতিদিন একসাথে ৮/১০ জনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। ফাঁসি ছাড়াও এলোপাথাড়ি ফায়ারিং এ মারা হয় শত শত। ফায়ারিং স্কোয়াডেও বহুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া, ঢালাও ভাবে গ্রেফতারের পর বহু সৈনিকের মৃত্যু ঘটে অমানবিক নির্যাতনে। ৩ থেকে ৫ই অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিরাতে ব্যারাক থেকে সেনা এবং বিমান বাহিনীর সদস্যদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো নির্যাতন ক্যাম্পে। তাদের কেউই আর ফিরে আসতো না। সব সেনানিবাসে বিদেহী আত্মার হাহাকার, বাতাসে বারুদ আর রক্তের মিলিত নোনা গন্ধ, সাথে পেছনে পড়ে থাকা প্রিয়জনদের বুক ফাটানো মাতমের সাথে আল্লাহ্‌র কাছে বিচার প্রার্থনা! ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে দুই হাজারেরও বেশি বিপ্লবী সেনা সদস্যকে হত্যা করেছিলেন জেনারেল জিয়া তার দোসরদের কুপরামর্শে। সরকারি ভাষ্যমতে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার দুই মাসের মধ্যেই ফাঁসিতে লটকানো হয়েছিলো বিভিন্ন র‌্যাঙ্কের ১১৪৩ জন সেনাসদস্যকে। বিমান বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যা ছিল ৫৬১ জন। ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যা করা সদস্যদের সঠিক সংখ্যা আজঅব্দি জানা যায়নি। জেল-জুলুম আর চাকুরিচ্যুতি ঘটে আরও কয়েক হাজার সদস্যের। আবেগময় বৈপ্লবিক ধারায় সামরিক বাহিনীর দেশপ্রেমিক এবং বিপ্লবী অফিসার ও সৈনিক, যারা জীবন বাজি রেখে জিয়াকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল পরিণামে তাদের ভাগ্যে জুটলো প্রতারণা, অনাচার, অবিচার, জেল, জুলুম, ফাঁসি, গুপ্ত হত্যা এবং চাকুরিচ্যুতি! হতভাগ্যদের লাশ পর্যন্ত তাদের আত্মীয়-স্বজনদের দেয়া হয়নি। তারা আজো খুঁজে ফেরে তাদের প্রিয়জনদের। কোথায় যে এতো লাশ মাটি চাপা দেয়া হল তাও এক রহস্য! অনেকেরই ধারণা এটা ছিল পরিকল্পিত একটি নিধনযজ্ঞ। দেশের সব সেনানিবাসে সেনা সদস্যদের মেরে শহীদ করার পর জানাজার ব্যবস্থাও করা হয়েনি ধর্মীয় বিধিমতো। বুলডোজার দিয়ে বড় বড় গণকবরে ইউনিফর্ম এবং বুট পরিহিত অবস্থায়ই মৃতদেহগুলো মাটি চাপা দেয়া হয়। তাদের স্বজনরা আজো খুঁজে ফেরে প্রিয়জনদের লাশ। কেউ শোনেনি তাদের ফরিয়াদ। তারা পায়নি বিচার।”

হায়! লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে বন্ধ হয়নি রক্তের হলি খেলা। ক্ষমতার ব্যবসায়ীদের বীরদর্পে পদদলিত হয় মানবতা, দুর্বলের আর্তনাদ। এই দেশেতেই কেঁদে মরে বিচারের বাণী। এমন দেশই কি চেয়েছিল দেশবাসী, ঘোর আধারে তলিয়ে যাবে দেশ ও গোটা জাতি? একটি ফুলকে বাঁচাবার অন্য কোনও বিকল্প কি নেই? এই সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে হবে সবাইকে সঠিক পথের সন্ধানে। ফিরে চলা যাক ব্যাংককে।

সেনাকুঞ্জের বিব্রতকর দরবারের পর হঠাৎ জিয়া জানালেন শীঘ্রই তিনি জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুকে ব্যাংকক পাঠাচ্ছেন খবরাখবর নিতে আর আলোচনার জন্য। শিশুভাই আমাদের সবার কাছেই বিশেষভাবে পরিচিত এবং প্রিয়। যুদ্ধকাল থেকেই তার সাথে সবার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠলেও তার সাথে আমার পারিবারিক পুরনো ঘনিষ্ঠতা। তার ছোট ভাই কায়সারের সাথেও আমার ও স্বপনের ওঠাবসা রয়েছে। ষাটের দশকের প্রারম্ভে ক্যাপ্টেন মীর শওকত, ক্যাপ্টেন খালেদ মোশাররফ, লেফটেন্যান্ট শিশু যখন তরুণ অফিসার হিসাবে কুমিল্লায় পোস্টেড তখন আমিও ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। গান-বাজনা, নাটক, খেলাধুলা, সমাজসেবা, রাজনীতি, মাস্তানি সবখানেই আমাদের প্রাধান্য।

কর্নেল জলিল তখন কুমিল্লাতেই কোনও একটা বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার। তার স্ত্রী আম্মার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। সেই সুবাদে ওরা সবাই প্রায়ই আসতেন আমাদের বাসায় ঘরোয়া জলসায় কিংবা দাওয়াতে। ছুটি-ছাটায় হরহামেশাই তারা আসতেন আমাদের সাথে আনন্দমুখর পরিবেশে সময় কাটাতে। পরবর্তীকালে আবার দেখা মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে। সেখানে ঘনিষ্ঠতা আরও গভীর হয়ে ওঠে। শিশুভাই ছিলেন প্রাণবন্ত এবং Happy go lucky type officer, তাই সবাই পছন্দ করত তাকে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই একদিন শিশুভাই সেক্টর থেকে ৮নং থিয়েটার রোডের হেডকোয়ার্টারে এসে উপস্থিত। যুদ্ধের বিভৎসতা ও বাস্তবতার কারণে তার ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেছে সাথে প্যালপিটেশন মানে বুক ধড়ফড়ানি। তাই তিনি কর্নেল ওসমানীকে অনুরোধ জানালেন, তাকে যেনো হেডকোয়ার্টারেই স্টাফ অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় এতে করে তিনি তার চিকিৎসাটাও চালিয়ে যেতে পারবেন। এরপর থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি ৮নং থিয়েটার রোডেই অবস্থান করেন। সেই সময় এলাজকালে হাসপাতালের এক নার্সের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো যা নিয়ে আমরা হাসি তামাশা করতাম। সেটা ছিল একটা মুখরোচক বিষয়। যুদ্ধ শেষে সেনাসদর সর্বপ্রথম স্থাপিত হয় ২৭নং মিন্টু রোডের একটি সরকারি দ্বিতল ভবনে জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে। শিশু ভাইও সেখানে একজন PSO (Personal Staff Officer). ক্যাপ্টেন নূর ও মেজর সালাহউদ্দিনও তখন সেখানে জেনারেল ওসমানীর সাথে অবস্থান করছে। স্বাধীনতার পর একদিন গোয়েন্দাপ্রধান বন্ধুবর মেজর সালাহউদ্দিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো আমার বাসায়। বললো, শিশুভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না। লাপাত্তা হয়ে গেছেন আমাদের নাবালক ভাই কয়েকদিন ধরে। জেনারেল ওসমানী ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছেন তার এই ধরনের হঠকারিতায়। হুকুম দিয়েছেন, যেভাবেই হউক না কেনো, শিশুভাইকে তার সামনে পেশ করতেই হবে। আমরা সবাই পুরো ঢাকা তন্নতন্ন করে গরু খোঁজা খুঁজেও পেলাম না তাকে। হঠাৎ মনে পড়ল কোলকাতায় চলে যাননি তো তার বান্ধবীর কাছে! ফোন করা মাত্রই জানতে পারলাম সেখানেই তিনি আত্মগোপন করে আছেন। অনেক বুঝিয়ে তাকে ফিরিয়ে এনেছিলাম। তার এক কথা, তিনি সেনাবাহিনীতে আর চাকুরি করতে চান না কিন্তু পাপা টাইগার তাকে রেহাই দিচ্ছেন না। তার যুক্তি, সদ্যস্বাধীন দেশে একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত অফিসার নেই, তাই শিশুকে এখন অবসরে পাঠানো সম্ভব নয়। তার এই সিদ্ধান্তের পর আমরাই শিশুভাইকে বলেছিলাম, সময় মতো ওসমানীকে বুঝিয়ে তার সমস্যার সমাধান করে দেবো। পরে তাকেই কর্নেল পদে পদোন্নতি দিয়ে জিয়ার জায়গাতে বার্মায় মিলিটারি এটাচি করে পাঠানোর ব্যাবস্থা করা হয় সেনা পরিষদের নেতাদের প্রচেষ্টায়। জিয়ার আমলে তিনি জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হয়ে তার রাজনৈতিক গুরু হিসাবে ‘‘রাজপুতিন‘ নামে আখ্যায়িত হয়েছিলেন দেশের রাজনৈতিক মহলে। আমাদের সবার প্রিয়পাত্র শিশুভাই ব্যাংককের পথে রেঙ্গুন এয়ারপোর্টে যাত্রা বিরতি কালে টনি ভাবীকে নিয়ে এসেছিলেন। তখনই আমি তাকে সংক্ষেপে বলেছিলাম জিয়া মুক্ত হলে আপনার ডাক পড়বে, আপনি তৈরি থাকবেন।

আমার সাথে শিশুভাই এবং টনি ভাবীর ঘনিষ্ঠতা পারবারিক পর্যায়ের। স্বাধীনতার পর কুমিল্লাতে যখন একসাথে ছিলাম তখন তার দুই মেয়ে লাজু আর কাজু প্রায় সারা দিনরাত আমাদের বাসাতেই থাকতো। তখনো সস্তির জন্ম হয়নি, তাই নিম্মিকে নিয়েই ছিল লাজু-কাজুর স্বর্গ। সাপ্তাহিক ছুটিতে ঢাকায় এলে পাক মোটরস-এ নিজেদের বাড়িতে না থেকে আমাদের মালিবাগের বাসাতেই থাকতেন শিশু পরিবার। পারিবারিক সম্পর্কের আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল। শিশুভাই ২য় ইস্ট বেঙ্গলের সাথে যখন বিদ্রোহ করেন তখন তার স্ত্রী টনি ভাবীও বাচ্চাদের সাথে খালেদা জিয়ার মতো খানসেনাদের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছিলেন। পরে কামরুল হক স্বপন বীরবিক্রম (আমার একমাত্র ছোট ভাই) এবং বন্ধু কাজি কামাল বীরবিক্রম এর নেতৃত্বে এক দুর্ধর্ষ গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে খালেদ ভাবী এবং শিশু ভাবীদের বাচ্চাসহ মুক্ত করে বর্ডারের ওপারে তাদেরকে শিশু ও খালেদ ভাইয়ের কাছে পৌছে দিয়েছিলো। গভীর এই ঘনিষ্ঠতার পরিপ্রেক্ষিতেই জিয়া তাকেই পাঠাচ্ছেন আমাদের সাথে আলোচনার জন্য। চাতুর্যের আর এক নমুনা!

৭ই নভেম্বরের সফল বিপ্লবের পর অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলী আমাদের ভীষণ ভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের দিগন্তে এক অশনি শংকেত! কর্নেল তাহেরের হঠকারিতা, জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা এবং সেনা পরিষদের সাথে জিয়ার ষম্যমূলক আচরণের ফলে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান অসন্তোষকে বাড়িয়েই তুলছে। চরিত্রহীন, লম্পট এবং ধুরন্ধর নামে পরিচিত সমস্ত অফিসারদের পাশে জড়ো করে তিনি সেনাসদরকে বাস্তিল দুর্গে পরিণত করে নিজের খোলস থেকে যে ভাবে স্বরূপে প্রকাশিত হচ্ছেন তাতে সেনা পরিষদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দানা বেধে উঠছে।মেজর মহিউদ্দিন, সুবেদার মেজর আনিস, রিসালদার সারওয়ার, সুবেদার মেজর ওহাব, ফ্লাইট সার্জেন্ট আবসারদের মতো পরীক্ষিত বিপ্লবী নেতাদের এড়িয়ে চলেছেন জিয়া। এতে করে হাজারো প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে। এ সমস্ত প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। জিয়ার অপ্রত্যাশিত কার্যকলাপের ফলে যে মৌলিক প্রশ্নগুলো দেখা দিচ্ছে সেগুলো হলঃ

১। এ কোন জিয়া?

২। জিয়ার অনুরোধে জনাব মোশতাক কেন পুনরায় রাষ্ট্রপতি হতে রাজি হননি তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি আমাদের কাছে একটা প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, জিয়া সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে বাহ্যিক জিয়া আর ভেতরের জিয়া কি একই ব্যক্তিত্ব নাকি তার চরিত্রে রয়েছে দ্বৈততা?

এ সমস্ত নিয়ে আমরা ভীষণ অস্বস্তিকর এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর চিন্তায় সারাক্ষণ ডুবে থাকতাম।

সৎ নীতিবান একজন সহযোদ্ধা হিসাবেইতো তিনি যুদ্ধকালীন সময় কোরআন শপথ নিয়ে সেনা পরিষদের নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচি মেনে নিয়েই একাত্ম হয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদ এবং ভাগ্যাহত, বঞ্চিত গণমানুষের সামাজিক বিপ্লবের জন্য নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন যার জন্যই তাকেই মধ্যমণি করে সব প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করে আমরা এগিয়ে চলেছিলাম স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। তিলে তিলে গড়ে তোলা সেনা পরিষদ অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে যখন তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসাল তখনই তিনি ভোল পাল্টে ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে উঠলেন এটা বিশ্বাস করতে মন চাইছিলো না। কিন্তু সেটাই বর্তমান বাস্তবতা। তাই সেটা অস্বীকার করারও উপায় নেই।

দেশ থেকে ক্রমাগত অনুরোধ জানানো হচ্ছে, জিয়ার ডাকের অপেক্ষা না করে আমাদের অনতিবিলম্বে নিজেদের উদ্যোগে দেশে ফেরা উচিৎ।সবাই সন্দেহ পোষণ করছে, নিজের আসন পাকাপোক্ত করার পর তিনি আমাদের কখনোই দেশে ফিরতে দেবেন না। সেই অবস্থায় সেনা পরিষদ ও বিপ্লবীদের কি হবে সেটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেছিলো তার অশুভ বাস্তিল দুর্গ এখনি গুঁড়িয়ে দিতে হবে, তা না হলে দেরি হয়ে যাবে আর বিফল হবে এতদিনের ত্যাগ এবং তিতিক্ষা।

যেভাবে জিয়া সেনাপরিষদের আন্তরিকতার সুযোগ নিয়ে তাদের কাঁধে বন্দুক রেখে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে নির্মূল করেছেন বলির পাঁঠা করে ঠিক সেইভাবেই জিয়া সেনা পরিষদ এবং এই সংগঠনের বিপ্লবীদের শিকড় উপড়ে ফেলার জন্যই এখন তৈরি করেছেন তার বাস্তিল দুর্গ। ঐ দুর্গে তারই জড়ো করা নীতিবিবর্জিত চরিত্রহীন সুযোগ সন্ধানী অফিসাররা চক্রান্তের মাকড়সার জালে আটকে ফেলেছে জিয়াকে। এদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারতের দালাল এরশাদ এবং চরিত্রহীন লম্পট দুর্নীতিবাজ মীর শওকত। তাদের কথায় এখন জিয়া উঠছেন আর বসছেন। অবিলম্বে যদি নেতারা দেশে ফিরে জিয়াসহ চক্রান্তকারীদের পরাস্ত না করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে।

এই ক্রান্তিকালে আমরা যে প্রশ্ন নিয়ে ভাবছিলাম সেটা হল, বর্তমান সংকটের সমাধান আমরা করতে পারবো নাকি আমাদের প্রত্যাবর্তন সংকটকে আরও জটিল করে তুলবে যার ফলে দেশ এবং জাতির হবে সমূহ ক্ষতি।

জিয়ার উপর কোনও জবরদস্তি ছিল না। শপথও তিনি নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। সেই সময় থেকে আমাদের তরফ থেকে ওয়াদার খেলাপ হয়নি। তাহলে তিনি প্রতারণা করলেন কেনো?

অবশ্য তখনই শিশুভাই আমাদের তার চরিত্র সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আমরা যুক্তিসাপেক্ষে তার অভিমত নাকচ করে দিয়েছিলাম। বিচক্ষণ রাজনীতিক খন্দকার মোশতাক আহমেদ জিয়ার চারিত্রিক দ্বৈততা বুঝতে পেরে চতুরতার সাথেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।কিন্তু সমস্যা হল দেশবাসী এবং সাধারণ সেনা সদস্যরা জিয়াকে বিপ্লবীদেরই একজন বলে মনে করছে সেই ক্ষেত্রে জিয়ার বিরুদ্ধে কোনও সশস্ত্র বিরোধিতাকে ক্ষমতার লড়াই হিসাবেই দেখা হবে যুক্তিসঙ্গতভাবেই। ফলে সামরিক বাহিনী এবং জাতি হয়ে পড়বে দ্বিধাবিভক্ত। সেই সুযোগটা ভারত কিছুতেই হাত ছাড়া করবে না। দ্বিধাবিভক্ত জাতি আর সামরিক বাহিনীকে সম্বল করে সেনা পরিষদের পক্ষে কি সম্ভব হবে ভারত বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলে আগ্রাসী শক্তিকে পরাস্ত করা? বাস্তব ভিত্তিক জবাব হচ্ছে- না।

তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জিয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেশে ফিরবো না দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে। দূর থেকেই জিয়া সম্পর্কে আমাদের ভাবতে হবে আর বুঝতে হবে তার উদ্দেশ্য আর খেলা। যদিও শিশুভাই আসছেন জিয়ার দূত হয়ে কিন্তু আমরা নিশ্চিত ছিলাম, শিশুভাই তার দায়িত্ব অবশ্যই পালন করবেন। তবে আমাদের কোন প্রশ্ন থাকলে সত্য এবং সঠিক জবাবই দিবেন। আর কোন বিষয়ে তার নিজস্ব অভিমত জানতে চাইলে অতি আন্তরিকভাবেই সেটা অকপটে তিনি আমাদের জানাবেন। তাই তার উপস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবো আমরা। আমাদের আলোচনাও হবে খোলাখুলিভাবে। তাই তার সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানালাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাংককে পৌঁছনোর জন্য। শিশুভাই দিলখোলা হাসিখুশি মানুষ, কিন্তু তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী। জটিল বিষয়ে তার বিচার বিশ্লেষণ সেই স্বাক্ষরই বহন করে। ঠিক হল তার কাছ থেকে প্রশ্নগুলোর জবাব জেনে নেবার চেষ্টা করবো আমরা।

যুদ্ধকালিন সময় ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং বৃহত্তর বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আর্থ-সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য সুচিন্তিত নীতি-আদর্শ ভিত্তিক কর্মসূচির উপর সংগঠিত করা হচ্ছিলো গোপন সংগঠন। সেই সময় জিয়া সব শুনে বুঝেই স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমাদের সংগঠনের একজন হয়ে কাজ করতে। সেই সময় শিশুভাই যখন আমাদের জিয়া চরিত্র সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার চেষ্টা করেছিলেন, আমিই তখন তাকে বলেছিলাম শিশুভাই, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনেকের মধ্যেই পরিবর্তন এনেছে বিশেষ করে দেশ ও দেশবাসী সম্পর্কে বেশি করে বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে। রাজনৈতিক ভাবেও সচেতন করে তুলেছে বয়সের তুলনায় অনেক বেশি। তেমনটি যে জিয়ার ক্ষেত্রে অসম্ভব সেটা যুক্তিসঙ্গত নয় বলা চলে কি?

তিনি আমার জবাব শুনে আর কিছুই বলেননি। আমরা তো তাকে নির্দিষ্টস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেই এগুতে চেয়েছিলাম। তবে কেনো জাতি এবং গণমানুষের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হয়েই সব নীতি-আদর্শ বর্জন করে কিছু সুযোগ সন্ধানী সুবিধাবাদী অমানুষদের পরামর্শে আইয়ুব খানের মতো দেশ ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী গোষ্ঠী স্বার্থের রাজনীতি শুরু করার চেষ্টা চালাচ্ছেন জিয়া? যাদের আত্মত্যাগের বদৌলতে তিনি আজ ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে তাদের শবের উপর উপবিষ্ট হয়ে শিবের গাজন গাইছেন, তাতে তার কি পরিণতি হতে পারে সেটাও কি তিনি বুঝতে পারছেন না? আমাদের মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেলো কি কারণে? আমাদের ধ্যান-ধারণা, চাওয়া-পাওয়া ছিল এক ও অভিন্ন। তবে আজ কেনো আমরাই তার প্রতিপক্ষ হয়ে গেলাম! আমাদের নিঃস্বার্থ আন্তরিকতায় কি কোনও ঘাটতি ছিল?

আমরা অজান্তেই তার এতটাই চক্ষুশূল হয়ে উঠলাম যাতে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে দেশের মাটিতে পা রাখাও সম্ভব হবে না! আমরা কি এতই অপাংক্তেয়? এই অবস্থায় কি করা উচিৎ!

প্রতিদিনই দেশ থেকে হতাশাব্যঞ্জক খবর আসছে। প্রতিটি খবরের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করে যথা সম্ভব সেনা পরিষদের সদস্যদের মনোবল বজায় রাখার চেষ্টা করছিলাম। এমনই পরিস্থিতিতে এক রাতে নিজেদের একটি বৈঠক শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎ জিয়ার সাথে আমার একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গোপন বৈঠকের কথা স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠল।

৮নং থিয়েটার রোডের হেডকোয়ার্টারের অধীন কোলকাতার উপকণ্ঠে কল্যাণীর নিরিবিলি পরিবেশে ভারতীয় সরকার আমাদের ব্যবহার করার জন্য কয়েকটি সেফ হাউস দিয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধারা কোলকাতায় এলে প্রয়োজন মতো হেডকোয়ার্টার- এর অনুমতি নিয়ে সেগুলো ব্যবহার করতো। জিয়াকে ১নং সেক্টর এর কমান্ড থেকে হেডকোয়ার্টারে আনার পর তাকে কল্যাণীতেই একটি সেফ হাউসে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কোলকাতায় এলেই তার সাথে দেখা করতে যেতাম গোপনে। সেদিনও গিয়েছিলাম। প্রবাসী সরকার এবং ভারতীয় সরকারের সুনজরে নেই তখন জিয়া, তাই অনেকেই তাকে তখন এড়িয়ে চলতো। নিয়মিত ব্রিগেড গড়ে তোলার কথা চলছে সেই সময়।

স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করার সুদুরপ্রসারী ভারতীয় নীলনকশা এবং তার বিরুদ্ধে সত্যিকারের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সুখী-সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের কি করা উচিৎ সেই সমস্ত বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ আগেই হয়েছে। সব বুঝে শুনেই তিনি আমাদের সাথে একাত্ম হয়ে সেই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে প্রেক্ষিতেই আজ আমি এসেছি তার শপথ গ্রহণ করাতে। একই সাথে তাকে জানাতে, শফিউল্লাহ আর খালেদের নেতৃত্বে যদি ‘এস’ এবং ‘কে’ ফোর্স নামে দুইটি ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তবে প্রবাসী সরকারকে বাধ্য করবে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা ‘জেড’ ফোর্স নামে আর একটি ব্রিগেড গঠন করতে তার অধীনে। শপথ গ্রহণের পর বিদায় নেয়ার আগে আমি তাকে বললাম স্যার, ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে আপনার সাথে স্বাভাবিক কারণেই দেখাসাক্ষাত কমে যাবে। আমাদের অনেককেই প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো মুক্তিফৌজ ছেড়ে ঐ নিয়মিত ব্রিগেডগুলোতে যোগদান করতে। কিন্তু আমরা তাতে রাজি হইনি একটি মাত্র কারণে। সেটা হল, পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের আমাদের নীতি-আদর্শের আলোকে উজ্জীবিত করে সাংগঠনিক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী তৈরি করা। যেকোনো দীর্ঘমেয়াদী বিপ্লবকে সফল করে তোলার জন্য তিনটি উপাদান অত্যাবশ্যকীয়-

১। সুচিন্তিত নীতি-আদর্শ ভিত্তিক কর্মসূচি যার ভিত্তি হবে মূলত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা, চাহিদা ও দেশের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের উপর।

২। দৃঢ়চেতা আত্মত্যাগী নেতৃত্বের অধীনস্থ একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন।

৩। একটি পরীক্ষিত নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন কর্মীবাহিনী।

এদের নিয়েই স্বাধীনতার পর জাতির মেরুদণ্ড সামরিক বাহিনীতে গড়ে তুলবো গোপন সংগঠন সেনা পরিষদ। আপনিই হবেন সেই সংগঠনের মধ্যমণি।

সব শুনে, জিয়া আমাকে উষ্ণ আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কিছুক্ষণের জন্য আমাদের দুটো মনে একই প্রত্যয় প্রাণ পেয়েছিলো।

আমি বেরিয়ে আসছিলাম সেই সময় জিয়া বললেন

ডালিম, একটা অনুরোধ। সংগঠনের স্বার্থেই আমাকে কথা দিয়ে যাও, আমি যে তোমাদেরই একজন সেটা উপযুক্ত সময় না আসা পর্যন্ত গোপন রাখা হবে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, আমার প্রতি ভারত এবং আওয়ামীলীগ সরকারের যে মনোভাব তাতে কোনও পরিবর্তন হবে না স্বাধীনতার পরও। তাই আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে অতি সতর্কতার সাথে। ঘুণাক্ষরেও যদি আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে কোনও সন্দেহের সৃষ্টি হয় তাহলে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে এবং সেনা পরিষদকে অঙ্কুরেই শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করা হবে। তার বক্তব্যে জোরালো যুক্তি রয়েছে তাই তাকে আশ্বস্ত করে বেরুবার আগে বলেছিলাম

স্যার, একটা কথা জেনে রাখুন। আমরা বেঁচে থাকতে আপনার গায়ে কেউই হাত দিতে পারবে না, সরকারও না। আল্লাহর রহমতে আমরা আপনাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসাবোই দেশবাসীর দোয়াতেই ইন শা আল্লাহ্‌।

স্বাধীনতার পর জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরানোর জন্য মুজিবের পুতুল সরকার কয়েকবার চেষ্টা চালায়। কিন্তু সেইসব চেষ্টাই ব্যর্থ করে দিয়েছিলো সেনা পরিষদ।

সেনাবাহিনী গঠনের প্রাথমিক পর্যায় সেনা পরিষদের তরফ থেকে আমি এবং নূরই তার সাথে যোগাযোগ করে চলতাম। জিয়াকে জেনারেল পদে উন্নীত করে ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ পদে নিয়োগ দেবার পর, ক্যাপ্টেন নূরকে তার এডিসি এবং মেজর হাফিজকে এইডডিকম হিসাবে নিয়োগ দেবার ফলে যোগাযোগে বিশেষ সুবিধা হয়েছিলো।

আল্লাহ্‌পাকের নামে শপথ গ্রহণের পর সেনা পরিষদের সদস্যরা সর্বান্তকরণে তাকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করেছিলো। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত স্বপ্ন বাংলাদেশে বাস্তবায়নে জেনারেল জিয়াকে জাতীয় নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্রতী ছিল সেনা পরিষদ। তাহলে কেনো এই গাদ্দারি! ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এক সময় নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছিলাম নিজের অজান্তেই।