খালেদা জিয়া হলেন বিএনপির চেয়ার পার্সন

জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপিকে সাংগঠনিক ভাবেএকটি নীতি-আদর্শ ভিত্তিক দল হিসাবে গঠন করে তোলার কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেননি জেনারেল জিয়া। নানামতের আর দলছুট সুযোগ সন্ধানী সুবিধাবাদীদের নিয়ে দুর্নীতির অবাধ রাস্তা খুলে দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে এক ঝাঁক পোষা ‘ইয়েস ম্যান’তৈরি করা সম্ভব- কিন্তু একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠন করা সম্ভব হয় না। পরিণামে জিয়ার তিরোধানের পর জিয়া সর্বস্ব দলটিতে নেতৃত্বের কোন্দল, উপদলীয় বিভাজন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।

সেই জটিল অবস্থা শারীরিক ভাবে অসুস্থ বর্ষীয়ান নেতা জাস্টিস সাত্তারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ফলে CMH-এ চিকিৎ সাধীন থাকা কালেই ক্ষমতাধর জেনারেল এরশাদ অতি সহজেই তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি বিএনপির সব ব্যাংক একাউন্ট বাজেয়াপ্ত করে ফেলার হুকুম জারি করেন। এরপর পার্টির সব কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।

পার্টির শোচনীয় অবস্থায় জেনারেল এরশাদের ঘোষিত জাতীয়পার্টিতে যোগদানের হিড়িক পরে যায় বিএনপির নেতাদের। ফলে পার্টি হিসাবে বিএনপির অস্তিত্বই প্রায় বিলীন হবার উপক্রম হয়। সেই সন্ধিক্ষণে জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর মধ্যস্থতায় গুটিকয়েক সিনিয়র নেতা, ছাত্রদল এবং যুবদলের কিছু ত্যাগী তরুণ নেতা-কর্মী গৃহবধূ খালেদা জিয়াকে অনেক চেষ্টা করে পার্টির চেয়ারপার্সন বানাতে রাজি করাতে সক্ষম হয়। এতে পার্টির অস্তিত্ব টিকে যায়। পার্টিকে পুনর্গঠনের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়। শিশুভাই জেনারেল এরশাদ সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত ছিলেন বিধায় হয়তো মনে করেছিলেন জাতীয় স্বার্থে তার সিদ্ধান্তই ছিল মন্দের ভালো। মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ কয়েকটি দেশের কর্ণধারেরা জিয়ার সাথে তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবাদে তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে কিছুটা আর্থিক সাহায্য ছাড়াও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।তারা জেনারেল এরশাদকেও হেদায়েত প্রদান করেন যাতে জিয়ার দলের উপর অন্যায় অবিচার এবং জোর জুলুম না করা হয়।

সেই সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল বিধায় তাদের হেদায়েত অনিচ্ছা সত্ত্বেও জেনারেল এরশাদকে মেনে নিতে হয়। পর্যায়ক্রমে বিএনপির ব্যাংক একাউন্টগুলোও খুলে দিতে হয়েছিলো প্রেসিডেন্ট এরশাদকে। এ সবের পরও ভারত জেনারেল এরশাদকে আশ্বস্ত করেছিলো, যে আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগের সহযোগিতা এবং সমর্থনে এরশাদ অবশ্যই প্রেসিডেন্সিয়াল এবং পার্লামেন্টারি নির্বাচনে জিতবেন। খালেদা জিয়া কিছুতেই এতো অল্পসময়ে ঘর সামলে জেনারেল এরশাদ এবং আওয়ামীলীগের মোকাবেলা করতে সমর্থ হবেন না। এরপরও জেনারেল এরশাদ আশ্বস্ত হতে পারছিলেন না তার ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়ে। কারণ, জেনারেল মঞ্জুরের হঠকারি অভ্যুত্থান এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর সুবাদে কারাপ্রকোষ্ঠে তড়িঘড়ি করে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারের ক্যামেরা ট্রায়াল সেরে তাদের ফাঁসি দেয়া এবং বিনাবিচারে জেনারেল মঞ্জুরকে বন্দী অবস্থায় সুচিন্তিত ভাবে হত্যার ফলে সামরিক বাহিনী এবং জনগণের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এবং ধূমায়িত ক্রোধক্রমশদানাবেঁধেউঠতে থাকে। সেটাই ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত জেনারেল এরশাদের মাথাব্যথার প্রধান কারণ।

তাই, তার আমাদের মতো মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের সাহায্যের প্রয়োজন। আমার কাছ থেকে তেমন কোনও সাড়া না পেয়ে জেনারেল একটা কূটচাল চাললেন। তিনি কর্নেল রশিদ আর কর্নেল ফারুক-এর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে একটা মুলো ঝুলিয়ে দিলেন তাদের নাকের ডগায়। তিনি তাদের বললেন, আগামীতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কর্নেল ফারুক যদি অংশগ্রহণ করতে রাজি থাকে তবে তিনি বিদেশে অবস্থানকারী আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের দেশে ফিরে নিজেদের দল গঠন করে জাতীয় রাজনীতি এবং সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেবেন। তবে শর্ত একটাই, নির্বাচন পর্যন্ত কর্নেল ডালিম, কর্নেল পাশা, কর্নেল শাহরিয়ার এবং কর্নেল নূর দেশে ফিরবে না। নির্বাচনের পর অবশ্যই তারা দেশে ফিরতে পারবে। মুলোটা গিলে ফেললো দুই ভায়রা।

এর মূল কারণ ছিল দুইজনই এর মধ্যে বুঝে নিয়েছে, শুধু টাকার জোরে কিংবা আগস্ট বিপ্লবীদের একজন হয়েই দলীয় নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হবার কোন অবকাশ নেই প্রগশে। এখানে নেতৃত্বে কার কি অবস্থান হবে সেটা নির্ধারিত হবে যোগ্যতা এবংগণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে। আদর্শভিত্তিক দল প্রগশে ব্যক্তিগত প্রভাব, পারিবারিক আভিজাত্য, প্রতিপত্তি কিংবা অর্থবল দিয়ে নেতা কর্মীদের মূল্যায়নের কোন বিধান নেই পার্টি ম্যানিফেস্টোতে।