বৈপ্লবিক জীবনের উত্থান-পতনের এক চরম দৃষ্টান্ত!

দীর্ঘ তিনদশক পার হবার পরও ঐতিহাসিক ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সব শীর্ষস্থানীয় নেতারাই হাসিনার সৌজন্যে ‘খুনের আসামী’ হিসাবে আসামীর কাঠগড়ায়!

কোথাও নেই কোনও প্রতিবাদ! জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ধ্বজাধারী রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াত জোট কোনও প্রতিবাদ কিংবা উচ্চবাচ্য না করে নিশ্চুপ হয়ে ক্যাঙ্গারু কোর্টে বিচারের প্রহসন দেখছিল উপভোগও করে থাকবেন। সত্যিই বিচিত্র এইসব দল, তাদের নীতি-আদর্শ এবং দলীয় নেতৃত্বের চরম মোনাফেকি এবং সুবিধাবাদিতার রাজনীতি। তাদের জন্য রাজনীতি শুধুই ধর্মপ্রাণ নিরীহ জনগণকে চটকদার কথায় ভুলিয়ে নিজেদের স্বার্থ এবং ভাগ্য উন্নয়নের পন্থা মাত্র।

বীর মুক্তিযোদ্ধা যারা জীবনবাজি রেখে দেশ স্বাধীন করলো, পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরশাসনের যূপকাষ্ঠের নিগড় থেকে নিজেদের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিয়েছিল মানবিক অধিকার, গণতন্ত্র এবং বাক স্বাধীনতা, যারা যুদ্ধকালীন সময় থেকেই একনিষ্ঠ নিরলস সংগ্রামে ব্রতী হয়েছিল স্বাধীনতার পর জনগণের মনে লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে গড়ে তুলতে প্রগতিশীল এবং আত্মসম্মানে বলীয়ান সুখী, সমৃদ্ধশালী এক নতুন বাংলাদেশ এবং ন্যায়ভিত্তিক সুষম সমাজব্যবস্থা যেখানে থাকবে প্রতিটি নাগরিকের নিজস্ব মেধা, প্রতিভা, যোগ্যতা এবং সৃজনশীলতা প্রকাশের সমঅধিকার। যেখানে থাকবে না শোষকের পৈশাচিক অট্টহাসি আর শোষিতের হাহাকার। এইসব মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যরা স্বাধীনতার পর সব প্রলোভন পদদলিত করে নিজেদের ব্রতে অটল থেকে ভারতের পুতুল সরকারের বরকন্দাজ না হয়ে প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে নির্ভীক ভাবে জনস্বার্থের সাথেই একাত্মতা প্রকাশ করে নিজেদের নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখে এসেছে, সেই ইতিহাস মুছে যাবার নয়। তারপরও তাদেরকেই দেশবাসী দেখলো সাজানো মামলার আসামি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশেষ আদালতের কাঠগড়ায়!

যখন ভারতের পদলেহি এবং নব্য পুঁজিপতি কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী একজোটে ক্ষমতার স্বার্থে সংবিধান লঙ্ঘন করে আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চক্রান্ত মূলক বিচারের প্রহসনের স্পর্ধা দেখাচ্ছিলো তখন জনগণের বৃহদাংশের ভোটে জেতা বিরোধীদলগুলোর সাংসদরা উটপাখি সেজে নীরব থেকেছিলেন আওয়ামীলীগ ও ভারতকে খুশি রাখার জন্যই, এই বিশ্বাসঘাতকতা যে একদিন তাদের জন্যই কাল হয়ে উঠবে সেটা না বুঝেই। সম্প্রসারণবাদী ভারত-প্রীতিতে আওয়ামী-বাকশালী সরকারকে পরোক্ষ সমর্থন প্রদান জনগণের সার্বিক মুক্তির স্বপ্নকেই শুধু বিলীন করেই দিয়েছিল তাই নয়, এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে পড়বে সেটাই হয়ে উঠল হতাশা বেঞ্জক বাস্তবতা! জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর গড়ে ওঠা স্বকীয় ঐতিহ্যকে সমূলে বাংলাদেশের মাটি থেকে উপড়ে ফেলে দেশটাকে রূপান্তরিত করা হবে ভারতের সুদূরপ্রসারী নীলনকশা অনুযায়ী একটি করদ রাজ্যে কিংবা অঙ্গরাজ্যে, দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করেই আমাদের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব সেটাই আমরা অতিতের মতই ভবিষ্যতেও করবো সব প্রতিকূলতার মকাবেলা করেই সেই সিদ্ধান্তই গৃহীত হল।

সর্বসম্মতি সাপেক্ষে, আমি বিদেশ থেকেই নিম্মির সাথে যোগাযোগ করে তাকে বললাম, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন-এর সাথে দেখা করে আইনি সাহায্য চাইতে। নিম্মি তার সাথে দেখা করেছিল পারিবারিক ভাবে ঘনিষ্ঠতার কারণে। ন্যায়নিষ্ঠ প্রখ্যাত এই আইনজীবী নিম্মিকে অকপটে জানিয়েছিলেন এটা কোনও মামলাই নয়, বিচারের প্রহসন মাত্র। হাসিনার জালে হাসিনাকে জড়িত করে অনায়াসেই তার সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব। এর জন্য তারাও প্রস্তুত। কিন্তু পথের কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছেন স্বয়ং খালেদা জিয়া। তিনি চাচ্ছেন না, এই বিচার প্রক্রিয়ার সাথে বিএনপির কোনও প্রকার সম্পৃক্ততা কিংবা বিরোধী জোটের প্রতি সহানুভূতিশীল আইনজীবীরা এই বিচারে আসামী পক্ষে ওকালতি করুক। সব শুনে নিম্মি প্রশ্ন তুলেছিল মইনুল ভাই, আপনারা তো পেশাদার আইনজীবী। সেই সুবাদে এই কেসটা গ্রহণ করে আসামী পক্ষে আইনি লড়াই লড়তে পারেন না কি? ভাবী, আপনাকে বলতে বাধা নেই, সংসদে যখন সাংবিধানিক বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে হাসিনার সরকার একক সংখ্যা গরিষ্ঠতায় ইনডেমনিটি এ্যাক্ট বাতিল করে মামলা দায়ের করে, তখনই আমরা খালেদা জিয়াকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম সরকারের পতন ঘটানোর এই মোক্ষম সুযোগটা হাতছাড়া করা উচিৎ হবে না। তিনি আমাদের পরামর্শে কর্ণপাত না করে শুধু বললেন

আপনারা এই মামলা থেকে দূরে থাকবেন। পার্টিপ্রধানের এহেন নির্দেশে হতবাক হয়ে বিবেক বিসর্জন দিয়ে নিরুপায় হয়ে পড়েছি আমরা। যদি সম্ভব হয়, আপনি তার তরফ থেকে একটি ইশারার ব্যবস্থা করুন, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, বিনা খরচায় আমি ও সমমনা দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীদের অনেকেই স্বেচ্ছায় আসামীদের পক্ষে এই কেস লড়তে রাজি হবেন।

তার সাথে সাক্ষাতের পর নিম্মি বিশ্বস্তজনদের সাথেও এই প্রসঙ্গে আলাপ করে জানাতে পেরেছিল খালেদা জিয়া কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাচ্ছেন, তাই সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন কেসটা থেকে দূরে থাকতে। অতএব বিএনপি-জামায়াত জোট থেকে কোনও রকম সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যাবে না আইনি লড়াই লড়তে। রাজনৈতিক ভাবেও আগস্ট বিপ্লবীদের বিচারের পক্ষে দাড়াবে না তারা। খালেদা জিয়া আরও ভাবছেন, তাদের এই মৌন সমর্থনে হাসিনা সরকার এবং ভারত তাদের পক্ষে নমনীয় থাকবে। লেনদেনের এক অভাবনীয় সমীকরণ!

ইতিমধ্যে, অন্যান্য সাথী ভাইদের কাছে দেশে ফিরে যাবার নির্দেশ পৌঁছালো। নির্দেশ পাবার পর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই গোপনে যার যার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলো।

জানতে পারলাম, দেশে অবস্থানরত আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের বন্দী করার সাথে সাথেই বিদেশ থেকে কূটনৈতিক দায়িত্বে নিয়োজিত নেতারা দেশে না ফেরায় তাদেরকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করে তাদের নামেও গ্রেফতারি পরওয়ানা এবং ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্ট জারি করেছে হাসিনা সরকার। ডিবি-এর আওয়ামী লীগ অনুগত সাবেক কর্মকর্তা আবদুল কাহহার আকন্দের নেতৃত্বে তল্লাশির নামে সবার বাড়িঘর তছনচ করে ফেলা হয়েছে। আমার বইগুলোও রেহাই পায়নি। নিম্মি আর সস্তির পাসপোর্ট জব্দ করে তাদের গৃহবন্দী করে রাখা হল।

নিকট আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতেও চালানো হয় একই তাণ্ডব। বাজেয়াপ্ত করার সমন জারি করা হল সরকারের তরফ থেকে আমাদের নামে স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি এবং ব্যাংক একাউন্ট।

ছোটভাই স্বপনকে বন্দী করে নিক্ষেপ করা হল কারাগারে এই সন্দেহে, যে স্বপন আমাকে এবং আমার পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করে থাকে। রিমান্ডে নিয়ে তার উপর চালানো হয় পাশবিক অত্যাচার। দীর্ঘ দু’ বছর আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বেইল পেলে, স্বপন সপরিবারে আমেরিকাতে পালিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তার ব্যবসা-বাণিজ্য লুটপাট করে নেয় সরকারী দলের ক্ষমতাশালী লুটেরারা, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় তার সবগুলো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন শুরু হয়েছে নতুন এক তামাশা।

সংরক্ষিত মহিলা আসনের ভাগ-বাটোয়ারার পর আওয়ামী লীগের কাছে জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া মাত্র তাদের ব্যবহৃত টিস্যু পেপারের মত ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয় আঁস্তাকুড়ে।

১৯৯৬-এর নির্বাচনে জামায়াতের সিটের সংখ্যা ১৭ থেকে উদ্দেগজনক ভাবে কমে আসায় জামায়াত বুঝতে পারে বাংলাদেশে ভারত ঘেঁষা রাজনীতি করে কোনও দলের পক্ষেই জনপ্রিয়তা লাভ করা সম্ভব নয়।তাই দল হিসাবে রাজনীতির ব্যবসা চালিয়ে যেতে হলে স্বর্ণলতিকার মতো বাহ্যিক ভাবে ‘ভারত বিরধি’ বিএনপিকেই অবলম্বন করা ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প তাদের নেই। অন্যদিকে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিএনপিও বুঝতে পারে সমঝোতা ও সুবিধাবাদের রাজনীতিতে একগুয়েমি এবং স্বেচ্ছাচারিতা বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেলো হিসাব। তাই আবার বিএনপিএবং জামায়াতের গাঁটছড়ার উদয় হল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।

বাংলাদেশের জনগণের সত্তায় মিশে আছে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদের চেতনা। প্রাচীনকাল থেকেই এই দু’টি চেতনার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে আমাদের স্বকীয় পরিচিতি। ১৯৪৭ সালেও ভারত বিভক্ত করে দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তান নামের রাষ্ট্রের বাস্তবতাকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকেও মেনে নিতে হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় সত্তার সাথে সামঞ্জস্যহীন ভারতের সংবিধানের চার নীতির উপর দেশের সংবিধান গড়ে জাতিকে বিভক্ত করার চক্রান্ত করা হল শুরুতেই আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে। পরিণতিতে সৃষ্টি হল রাজনীতির মূলধারায় দুইটি তথাকথিত বিপরীতমুখী রাজনৈতিক ধারা। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হল, বিগত চার দশকের বেশি সময় ধরে এই দুইটি শক্তিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখার পরই দেশবাসী বুঝতে পারলেন কাগুজে ভাবে এদের নীতি-আদর্শে ব্যবধান থাকলেও এদের চরিত্র এক। দুইটি রাজনৈতিক শক্তিই একই গোষ্ঠীস্বার্থের প্রতিভূ। জনগণের প্রত্যাশার বিরুদ্ধেই তাদের অবস্থান। অন্যদিকে তথাকথিত যারা ধর্মের ঠিকাদার, তাদের চেহারাতেও কোনও ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হল না।

তাই আজ হয়তো জনগণ বুঝতে পারছে পরীক্ষিত বিকল্প নেতৃত্ব ছাড়া দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

কিন্তু জাতীয় কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী প্রভুরা তৃতীয় বিশ্বের সম্পদশালী সম্ভাবনাময় কোনও দেশেই চায় না সেখানে জাতীয় স্বার্থে দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হউক দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। তাই সে ধরনের যেকোনো প্রচেষ্টাকে অংকুরেই বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে বিনাশ করে দেয়া হয় ছলেবলে কৌশলে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, সেই ধরণের প্রকৃত অর্থে ঐক্যবদ্ধ ধর্মীয় এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় শাণিত শক্তি এবং নেতৃত্ব শুধুমাত্র গড়ে তোলা সম্ভব আপোষহীন অন্যায়, অপশাসন ও শোষণ বিরোধী কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমেই। এর জন্য চাই সাহসী এবং সচেতন মানুষ।

যুক্তিসঙ্গত কারণেই এই সংগ্রামে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করতে হবে দেশের তরুণ প্রজন্মকেই সব প্রলোভন এবং ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে। তারাই হচ্ছে যেকোনো দেশের দুর্বার এবং নির্ভীক চালিকা শক্তি। যেকোনো দেশ এবং জাতির ইতিহাস সৃষ্টির মুখ্য উপাদান এবং মেরুদণ্ড এই টগবগে তারুণ্য। এদের সংঘবদ্ধ জাগরণে হৃৎকম্পনের সৃষ্টি হয় দেশীয় ও কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী শক্তিধর মুরুব্বীদের। তখনই সুযোগ হয় দেশ ও জাতীয় স্বার্থে নতুন সমীকরণ সৃষ্টির।

নিম্ন আদালতে গোপালগঞ্জের জজ গোলাম রসুল তার ক্যাঙ্গারু কোর্টে বিচারের নামে তামাশা করে হাসিনার দয়াও করুণা পাবার জন্য আইনে কনও বিধি না থাকা সত্ত্বেও সদর্পে অপরাধীদের ‘ফায়ারিং স্কোয়াডে’ গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করার রায় দেয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। এই রায় দেবার পরও খালেদা জিয়ার জোট মুখে কুলুপ এঁটে নিশ্চুপ থাকে।

এরপর বিবাদী পক্ষের সব রিট এবং রিভিউ পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টে দায়সারা গোছের বিচার প্রক্রিয়া  পরিচালিত হয় সরকারি প্রশাসনের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে।

স্মরণ রাখতে হবে, এই মামলা চলাকালে উচ্চ আদালতের ৮ জন বিবেকবান বিচারক বিব্রতবোধ করে বিচার কার্যক্রম থেকে সরে এসেছিলেন। সুপ্রিমকোর্টের তিনজন বিচারপতি বিবেকের তাড়নায় এই বিচারের রিভিউ বেঞ্চে বসতে বিব্রত বোধ করেছিলেন।
এই পুরোটা সময় উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের সরকারি চাপ, ক্ষমতাসীন দলের তরফ থেকে প্রাণনাশসহ বিভিন্ন ধরনের ধমক-ধামকি এবং হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তৎকালীনস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম এবং মায়ার নেতৃত্বে লাঠি ও চাপাতি মিছিল বের করা হয়েছিলো। সেই মিছিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং সদম্ভে বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন বিচারের রায় যদি জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী না হয় তবে সেই প্রত্যাশিত রায় কি করে আদায় করতে হয় সেটা আওয়ামীলীগের ভাল করেই জানা আছে। এরপরও হাসিনা সরকারের পক্ষে সেই টার্মে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।

২০০১ সালের নির্বাচনী নাগরদোলায় স্বজনপ্রীতি, পুকুরচুরি, জাতীয় সম্পদের হরিলুট, মানুষ খুন, অন্যায়-অবিচার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দলীয় মাস্তানি, গুমখুন, জবরদখল, চাঁদাবাজির প্রচণ্ডতায় শাসরুদ্ধকর অবস্থা, একই সাথে ভারত তোষণ নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ নিরুপায় হয়ে আবার খালেদা জিয়ার জোটকেই ভোটের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে। নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি স্বীকার করে নিয়ে জনগণের ভোট প্রার্থনা করায় জনগণ তাদের বিশ্বাস করেছিল অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না এবারের জোট সরকার। আমরাও ভেবেছিলাম এবার হয়তো খালেদা জিয়ার জোট সরকার অন্যায়ভাবে বাতিলকৃত ইনডেমনিটি এ্যাক্টটি আবার সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর অংশ হিসাবে পুনর্বহাল করবে এবং আইনগত ভাবেই আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা‘খুনের মামলা’ দুটো খারিজ হয়ে যাবে, মুক্তি পাবে সবাই মানবেতর বন্দী অবস্থা থেকে। নির্বাসিত নেতারাও স্বাধীনভাবে দেশে ফিরতে পারবে। কিন্তু জনগণ হতবাক হয়ে দেখলো, নবনির্বাচিত খালেদা জিয়ার সরকার সেই পথে এগুলো না সংসদে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও। যদিও সংবিধান লঙ্ঘিত বেআইনি ভাবে ক্যাঙ্গারু কোর্টের প্রহসন মূলক এই বিচারের বিরুদ্ধে তখন বিশ্বজনমত তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাজ্য, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ছাড়া বিশ্বের আরও অনেক দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা এই বিচার প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা করে সরকারকে ইনডেমনিটি এ্যাক্ট পুনর্বহাল করে এই বিচার বন্ধের আবেদনও জানিয়েছিল।

বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছিল কয়েকটি ভাতৃপ্রতিম দেশ, যাদের বিভিন্ন প্রকারের সাহায্য-সহযোগিতা খালেদা জিয়ার জোটকে ২০০১ সালের নির্বাচনী বৈতরণী পার করাতে বিশেষ অবদান রেখেছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মতোই। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি যথাসময়ে সেই উদ্দগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু তার পাঁচ বছরের শাসনকালের মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে তিনি রহস্যজনকভাবে বিরত থাকেন। শুধু তাই নয়, কারাবন্দীদের ‘কন্ডেম সেল’-এর মানবেতর অবস্থা থেকে ক্লাস দেবার উচ্চ আদালতের রায়ের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কোনও প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে খালেদা জিয়ার জোট সরকার।

এভাবেই স্বীয় স্বার্থ এবং ভারতের চাণক্যপুরি এবং তাদের প্রতিভু আওয়ামীলীগকে খুশি করার লক্ষেই আগামিতে আসামীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করার পথটি অতি নিষ্ঠুরতার সাথে খোলা রেখেই ক্ষমতা ছেড়েছিলেন খালেদা জিয়া এবং তার জোট সরকার। এই সুযোগের পূর্ণ দ্ব্যবহার করতে সক্ষম হয় আওয়ামীলীগ।

২০০৮ সালের নির্বাচনে জরুরী অবস্থায় ‘উদ্দিনদের’ সরকারের সহযোগিতায় ডিজিটাল কারচুপির মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যা গরিষ্ঠতায় আওয়ামীলীগকে জিতিয়ে ক্ষমতায় বসায় ইন্দো-আমেরিকান বলয়। তাদের বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক পরিবর্তন আনার জন্যই দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জেতানো হয়েছিল আওয়ামীলীগ জোটকে। অতি চতুরতার সাথে বিদেশী দূতিয়ালির মাধ্যমে নির্বাচনী ফাঁদে ফেলা হয়েছিলো খালেদার জোটকে। দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসক ভারতের হাতের পুতুল আশিত্তোর এরশাদ বুড়ো বয়সে জেলের ভাত না গেলার স্বার্থে ভারতের সুতোর টানে হাসিনার পেটিকোটের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ক্ষমতাসীন হয়েই তড়িঘড়ি করে জ্যেষ্ঠতার রীতি উপেক্ষা করে পছন্দমতো বিচারকদের সুপ্রিমকোর্টে নিয়োগদান করে ৫ সদস্যের মনপছন্দ একটি বেঞ্চ গঠন করে হাসিনার আওয়ামীলীগ মহাজোট সরকার। বেঞ্চের দুইজনই ছিলেন সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের বিচারপতি। তাদেরই একজন ছিলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সেই বেঞ্চ ফাঁসির চূড়ান্ত রায় দান করে বন্দী পাঁচজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জনদরদী সেনা অফিসারের বিরুদ্ধে তাদের নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের প্রতিদানে। সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রদান এবং মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য আইনগতভাবে যে সময় দেবার রীতি সেটা থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিলো জাতীয় বীরদের। যদিও বীরদের সবাই ক্ষমা প্রার্থনা না করার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছিলেন স্বেচ্ছায় তবুও আইন অনুযায়ী সময় না দেয়াটা ছিল বেআইনি হঠকারিতা। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গুলি হেলনে জেলকর্তৃপক্ষ রায় ঘোষিত হবার পর, তাড়াহুড়ো করে জাতীয় বীরদের নিকট আত্মীয়-স্বজনকে কড়া নিরাপত্তার সাথে কারাগারে এনে তাদের সাথে শেষ সাক্ষাৎকরিয়ে প্রত্যুষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং মেজর হুদার গলায় ছুরি চালিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় নির্ভীক, নিঃস্বার্থ, দেশপ্রেমিক বীরদের।