রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে লিবিয়ার পথে

একদিন রাষ্ট্রদূত হন্তদন্ত হয়ে সাতসকালে এসে হাজির। স্যার, আপনাদের লিবিয়াতে পাঠানোর সব বন্দোবস্ত করার হুকুম এসেছে সেনা সদর থেকে। আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আপনাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে আপনাদের সুবিধা মতো সব ব্যবস্থা করতে। আমাকে যখনই জানাবেন কবে যাবেন আপনারা, আমি সেই মতোই সব ঠিক করে ফেলবো।

সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ঠিক করে ফেলুন। তাই হবে স্যার, বলে ফিরে গেলেন রাষ্ট্রদূত। সব ব্যবস্থা করে এক রাতে আল ইটালিয়ার একটি ফ্লাইটে এথেন্সের উদ্দেশে আমাদের তুলে দিয়ে বিদায় জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রদূত। এথেন্স থেকে লিবিয়ান এয়ার লাইনের একটি স্পেশাল ফ্লাইটে আমরা পৌঁছাবো গন্তব্যস্থল বেনগাজীতে। তখনো সামরিক বাহিনীতে ষড়যন্ত্রমূলক নিধনযজ্ঞ শুরু করা হয়নি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে। দূরপাল্লার যাত্রায় আমাদের বহনকারী DC-10 বিমানটি নির্ধারিত সময় আকাশে উড়লো। অজানার উদ্দেশে যাত্রা! আমাদের দূরে সরিয়ে দিতে পারায় জেনারেল জিয়া অনেকটা নিশ্চিন্ত হবেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রাতের আঁধার ভেদ করে শোঁ শোঁ শব্দে উড়ে চলেছে যান্ত্রিক বলাকা। যাত্রীরা খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে কম্বল-বালিশ নিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করছে সবাই। ফার্স্ট ক্লাসের পুরো কেবিনের যাত্রী আমরাই। পাশের সিটে নিম্মি ঘুমিয়ে পড়েছে। ফার্স্ট ক্লাশের সিট রিক্লাইন করে নিলে সহজেই আরামদায়ক বিছানায় বদলে যায় সিটটা। আমার মাথায় তখন নানা ধরনের চিন্তা বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবছি, অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে। আইলের এর বিপরীতে পাশেই বসেছে পাশা। লিজি দুধের শিশুমেয়ে লীরাকে বুকে জড়িয়ে দুটো সিটে বিছানা পেতে ঘুমোচ্ছে। আগের দিকে জায়গা করে নিয়েছে রশিদ, ফারুক আর তাদের পরিবার। পেছনে শাহরিয়ার নব দম্পতিকে নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে ব্যাচেলর অফিসাররা। হাসি ঠাট্টা, তামাশায় জমজমাট অবস্থা। গালগল্পও চলছে সাথে। পাশা চেইন স্মোকার। নিরবে সিগারেট ফুঁকে চলেছে। ব্যাচেলর খাইরুজ্জামান, কিসমত আর নাজমুল সুন্দরী বিমানবালাদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। পাশা উঠে কাছে এসে বললো

স্যার, আমারও ঘুম আসছে না। অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছি আপনি নিমগ্ন হয়ে কিছু ভাবছেন। চলুন না এই হৈ-হুল্লোড় থেকে একটু নিরিবিলিতে গিয়ে বসি।

বেশ চলো। দু’জনে ফার্স্ট ক্লাশের পেছনের স্মোকিং কেবিনের নিরিবিলি যায়গাতে দুটো খালি সিট খুঁজে নিয়ে বসলাম। একটি সিগারেট ধরিয়ে পাশা বললো

স্যার, আমি যা ভাবছি আপনিও কি তাই ভাবছেন?

কি ভাবছো তুমি সেটা না জেনে বলি কি করে!

ভাবছি we have lost the game but that’s not a big deal. What is bothering me most is the treachery of Zia. এমন বিশ্বাসঘাতকতা জিয়া করতে পারেন সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বিস্ময়, কল্পনার বাইরে! আমি এখনো এটাকে মেনে নিতে পারছি না। আমরা সবাই এভাবে তাকে চিনতে ব্যর্থ হলাম! Truth is stranger than fiction! ঠিক তোমার মতো না হলেও আমিও কিন্তু প্রায় একই বিষয়ে ভাবছিলাম। পরাজিতরাই দেশান্তরী হয়, কিন্তু বিজেতারাও যে দেশান্তরী হতে পারে সেটা ইতিহাসে কোথাও চোখে পড়েনি। আমার জন্য সবচেয়ে চিন্তনীয় এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হল জেনারেল জিয়াকে তো আমরা পুরোধায় রেখেই সঠিক রাজনৈতিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম আন্তরিকভাবেই। সেইক্ষেত্রে জিয়া আমাদের সাথে সব সম্পর্ক অস্বীকার করে ভিন্ন পথে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিপথগামী হলেন কেনো! তবে একটা কথা জেনে রাখো তার এই সিদ্ধান্তের পরিণাম হবে ভয়ংকর।
এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাকে চরম মূল্য দিতে হবে। জানি রশিদ-ফারুকের ব্যাপারে তার তেমন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কিন্তু তার তো জানা ছিল অভ্যুত্থানের মূলশক্তি সুসংগঠিত সেনা পরিষদ। ওরা যে ছিল সহায়ক শক্তি সেটাও জিয়া ভালভাবেই জানতেন। আমরা তাকে শুধু সেনা পরিষদের নেতাই নয়, জাতির নেতা বানাতে চেয়েছিলাম সেখানে হঠাৎ করে তার ভোল পালটানোর আসল কারণটা কি! জিয়া হয়ত বুঝেছিলেন, নীতি-আদর্শের ব্যাপারে সেনা পরিষদ বিন্দুমাত্র আপোষ করবে না। সেইক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্ণধার হবার পরও তার পক্ষে এককভাবে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে না। কারণ, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা সেনা পরিষদের একটি মৌলিক নীতি। আর একটি কারণ হতে পারে, সুযোগ বুঝে ক্ষমতা লোলুপ জিয়া আমাদের বলয় থেকে বের হয়ে বিশ্ববাসীকে চতুরতার সাথে জানান দিচ্ছেন উগ্রপন্থীদের সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি বুঝতে পেরেছেন, পশ্চিমা শক্তিধর দেশগুলো, তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহ-আমীরদের কাছে প্রকৃত জাতীয়তাবাদী এবং প্রগতিশীল বিপ্লবীদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাদের কাছে শুধুমাত্র ঐ সমস্ত বিপ্লবীরাই গ্রহণযোগ্যতা পায় যাদের তারাই মাঠে নামায় নিজেদের স্বার্থেই। সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে, তিনি নিজেকে মুজিব হত্যার সাথে জড়াতে চাচ্ছেন না ভারতের অনুকম্পা পাবার জন্য। তার মানে তিনি ভারতের প্রতিনিধি আওয়ামী-বাকশালীদের সাথে সমঝোতা করবেন সেটা অবধারিত। সেইক্ষেত্রে যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন রাজনৈতিক অঙ্গনে আমাদের কিংবা মোশতাকের কোন ঠাঁই হবে না। তথাকথিত ইসলামিস্টদের নিয়ে টানাটানি করবে দুইপক্ষই। তারাও দর কষাকষির রাজনীতি করবে বিশ্ব মোড়লদের দাবার ছকের দায়রার মধ্যে থেকেই। তাই কোনও সমস্যা হবে না কারো জন্যই।

১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব সম্পর্কে ভারত, আমেরিকাসহ সারা দুনিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রয়েছে অন্ধকারে। বিশেষ করে আমাদের মতো চাকুরিচ্যুত কিছু সেনা অফিসারের নেতৃতে এমন দুইটি যুগান্তকারী অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেলো আর সমগ্র দেশবাসী সেই বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানালো সেটাও তাদের জন্য বিস্ময়কর! যারা তাদের নাকের ডগার উপর দিয়ে এমন কাজ করতে পারে তাদের সেবাদাস বানানো যাবে না সেটাই হলো তাদের মাথাব্যথা। এই ধরণের চরিত্রের অধিকারীদের তারা বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না, তাদের গ্রহণযোগ্যতাও তাদের জন্য হয়ে পড়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তাদের সর্বদা সন্দেহের চোখেই দেখা হয়। আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে আজকের জিয়া যেভাবে ভারতসহ বিভিন্ন দূতাবাসে ধর্না দিয়ে সবাইকে বোঝাতে প্রাণপাত করছেন যে ঐ সব ঘটনার সাথে তার কোনও সম্পৃক্ততা নেই, তিনি বিপ্লবী নন- শুধুমাত্র একজন গণতন্ত্রমনা পেশাদার সৈনিক তাতে কিছুটা হলেও কাজ হয়েছে। অবশ্য এটা প্রমাণ করতে ভবিষ্যতে তাকে আরও অনেক কিছুই করতে হবে। তিনি অচিরেই সেনা পরিষদের সদস্য এবং বিপ্লবীদের উপর খড়গহস্ত হয়ে উঠবেন নিজের গ্রহণযোগ্যতা পাকাপোক্ত করতে। তবে সবচেয়ে মারাত্মক হবে যদি জিয়া মনে করে থাকেন যে ভারতের আশির্বাদ ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবেনা তাই সমঝোতার মাধ্যমে তিনি যদি আওয়ামী-বাকশালীদের জাতীয় রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে ফেলেন। সেইক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বপ্নের বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, ক্রমান্বয়ে দেশের অরক্ষিত স্বাধীনতা সময়েতে রূপান্তরিত হবে পরাধীনতায়। দেশের ৮-১০ কোটি মুসলমান আবার পরিণত হবে ভারতীয় চাণক্যদের গোলামে ঠিক যেমনটি হয়েছিল শিখণ্ডি মীরজাফরের পলাশির বিশ্বাসঘাতকতায়।

আপনার চিন্তাভাবনা ও আশঙ্কা খুবই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে।

বলো।

মুজিবের পতনের পর আমেরিকা, গণচীন, সৌদি আরবসহ মুসলিম জাহানের দেশগুলো এবং প্রায় পুরো পশ্চিমা বিশ্বই তো পটপরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবে স্বাগত জানিয়েছিল। সেটা কেন?

প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ, তবে জবাবটা খুবই সোজা।

দুই মেরুতে বিভক্ত বিশ্বে সৃষ্টিকাল থেকে বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হয় রুশ-ভারত বলয়ে। ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করাটা ছিল আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব, মুসলিম জাহান এমনকি গণচীনের স্বার্থের পরিপন্থী। তাই মুজিবের পতনের পর খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হওয়ায় সবাই বুঝতে পারে বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন-ভারত বলয়ের বাইরে আসার চেষ্টা করবে। মোশতাকের প্রেসিডেন্ট হওয়াটাই ছিল তার সব চেয়ে বড় ইঙ্গিত। এরপর তিনি জিয়াকে চীফ বানানোর পর বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। খন্দকার মোশতাকের জায়গায় যদি আমাদের মতো অজানা অজ্ঞাত কেউ রাষ্ট্রপতি হতো তাহলে ঐ ধরনের গ্রহণযোগ্যতা এত তাড়াতাড়ি পাওয়া সম্ভব হতো না। খন্দকার মোশতাক জেনারেল জিয়াকে চীফ বানালেন সেটাই সবাই দেখল। পেছনে কার কি ভূমিকা ছিল সেটা ধর্তব্যের বিষয় ছিল না। কারণ আমরা সবাই ছিলাম ছায়া, কায়া নই। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমদ এবং জেনারেল জিয়ার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ছিল বিপ্লবীদের। সেটাই দেখলো দেশ এবং বিশ্ববাসী। ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর মোশতাকের জাতির উদ্দেশ্যে যুক্তিসঙ্গত ভাষণের পর চীফের পদে জেনারেল জিয়াকে অধিষ্ঠিত দেখতে পেয়ে তাকেই ক্ষমতা বলয়ের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হিসাবে দেখতে থাকে দেশ ও বিদেশে সবাই।দেশে-বিদেশে ধারণা জন্মালো পটপরিবর্তনের মূলে ছিলেন মোশতাক এবং জিয়া। সেনা পরিষদ একটি গোপন সংগঠন। তাই তাদের ভূমিকা সম্পর্কে আপামর জনগণ এবং বহির্জগত কিছুই জানতে পারেনি এখনও। যদিও আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত তবুও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে দেশবাসী এবং বহির্বিশ্বকে সেনা পরিষদ এবং স্বাধীনতার যুদ্ধকাল থেকে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে এই সংগঠনের নিঃস্বার্থ কঠিন সংগ্রাম এবং অবদান সম্পর্কে অবহিত করা যাতে যথাসময়ে ঐতিহাসিকগণ সেনা পরিষদ এবং সংগঠনের নিবেদিতপ্রাণ বিপ্লবীদের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেন। এমনকি সামরিক বাহিনীর শুধুমাত্র সংগঠনের সদস্যরা ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে বে-খবর। সামরিক বাহিনীতে কর্নেল তাহের সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সেল তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন সেটা মোটামুটি প্রায় সর্বমহলেই জানা ছিল। কিন্তু তার কার্যকলাপ ছিল এতই সীমিত যেকারণে কোনও মহলেই তার উদ্যোগ গুরুত্ব পায়নি। বিশেষ করে বেসামরিক এবং সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে। তাহেরের ব্যর্থতার একটি প্রধান কারণ ছিল চাকুরি ছাড়ার পর একজন অবসর প্রাপ্ত অফিসার হিসাবে তার পক্ষে সামরিক বাহিনীতে অনুপ্রবেশের স্কোপ ছিল খুবই সীমিত। পক্ষান্তরে যেহেতু আমরা সেনা পরিষদের বীজ রোপণ করেছিলাম যুদ্ধকালীন সময়েই সেজন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পরবর্তী সময়ে চাকুরিতে থাকা অবস্থায় সেনা পরিষদ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিলো সহজেই। রিক্রুটিং অফিসার হিসাবে আমরা প্রায় ১৫ হাজারের উপর পরীক্ষিত এবং আমাদের অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধাকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করেছিলাম। তাছাড়া কর্নেল তাহেরের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র আদর্শের চেয়ে আমাদের আদর্শের গ্রহণযোগ্যতা দেশপ্রেমিক সকল মহলে ছিল অনেক বেশি। তাই আমাদের সংগঠন অতি দ্রুত গড়ে তুলতে পেরেছিলাম ব্যাপক পরিসরে। কিন্তু আমাদের সংগঠনের অবস্থান পর্দার আড়ালে থাকায় এবং জেনারেল জিয়াকে চিনতে ভুল করাটাই আজ আমাদের জন্য কাল হয়ে উঠেছে। বিশ্বাসঘাতকতার যূপকাষ্ঠে আজ আমরা পরাস্ত, এই সাময়িক বাস্তবতাটাকে আমাদের মেনে নিতেই হবে সাময়িক ভাবে। সাময়িক এ জন্য বললাম, আমাদের নীতি-আদর্শ সঠিক। একমাত্র এই নীতি-আদর্শের বলেই বাংলাদেশ তার স্বকীয়তা বজায় রেখে প্রগতির পথে এগুতে পারবে। এর কোনও বিকল্প নেই সেটা বুঝতে দেশবাসীর খুব বেশি সময় লাগবে না। আজ যারা রাজনীতির মাঠে জেঁকে বসেছে তারা যে সব জাতীয় স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন বহিঃশক্তির তল্পিবাহক সেবাদাস সেটা প্রমাণিত হবে তাদের নিজস্ব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই। তাই বর্তমানে আমরা একেবারে অস্তিত্বহীন কিংবা অপাংক্তেয় হয়ে গেছি তেমনটি ভাবা যুক্তিসঙ্গত নয়। আমাদের প্রয়োজনীয়তাও যে চিরকালের জন্য ফুরিয়ে গেছে সেটাও ভাবার অবকাশ নেই। আমাদের নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, দেশ ও জনগণের স্বার্থে আপোষহীন দুঃসাহসিক সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ এর সঠিক মূল্যায়ন এক সময় নিশ্চয় হবে। সত্য একদিন উদ্ভাসিত হবেই প্রাকৃতিক নিয়মে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের ক্ষেত্রে তেমনটির ব্যত্যয় হবে না রাব্বুল আলামিনের রহমতে ইন শা আল্লাহ্। কি জানো পাশা, দুই নৌকাতে পা দিয়ে বেশিদূর এগুনো সম্ভব নয়। তাই অচিরেই জেনারেল জিয়াকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি কাদের উপর নির্ভর করে রাজনীতি করবেন। বর্তমানে সেনা পরিষদের কাছ থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন যারা তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসিয়েছে। অন্যদিকে তিনি তার চারপাশে জড়ো করছেন সব বাস্তুঘুঘুদের। ভাবছেন, এদের মাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন মধ্যপন্থী শক্তিধর ব্যক্তি হিসাবে দেশে-বিদেশে প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন। এখন এই মাকড়সার জালে আটকে পড়া জিয়া তাদের উপর নির্ভর করেই চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হবে না। সময় সুযোগ মতো তার ঘরের শত্রু বিভীষণরাই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। জিয়ার মাধ্যমে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী-বাকশালীদের পুনর্বাসন, খন্দকার মোশতাক এবং সেনা পরিষদকে শক্তিহীন করার পরই জিয়াকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ফেলার ঘটনাটা ঘটানো হবে বলেই আমার ধারণা। ইতিমধ্যেই ঘোষণা করা হল প্লেন বম্বে অবতরণ করছে। তাই, আমরা নিজ নিজ আসনে ফিরে গেলাম। কয়েকজন যাত্রী ওঠানামা করল। কিছুক্ষণ পর আবার আকাশে উড়ল আমাদের প্লেন। কিছু হাল্কা খাবার খেয়ে আবার আমরা পেছনের খালি জায়গাতে গিয়ে বসলাম। অনেকেই দুই তিনটা সিট এক করে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছে, নাকও ডাকাচ্ছে কেউ কেউ।

স্যার, আপনার কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। আর একটু খোলাসা করে বলেন তো আপনি কি করে ভাবলেন জিয়া ইতিমধ্যেই চক্রান্তের জালে নিজেকে আটকে ফেলেছেন ক্ষমতার খেলা শুরু না হতেই?

একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য ব্যাপারটা বোঝার জন্য। খন্দকার মোশতাকের তরফ থেকেই এসেছিলেন জনাব ইস্পাহানি। তার কথাবার্তা থেকে কিন্তু আমার মনে হয়নি তিনি আসার আগে জেনারেল জিয়ার সাথে দেখা করে এসেছেন।

আপনার এমন ধারণা আরও রহস্যের জন্ম দিচ্ছে, তার বক্তব্যের কন কথায় এমন ইঙ্গিত পেলেন আপনি?

পাকিস্তানের ২২ টি বহুল আলোচিত পরিবারের মধ্যে দুইটি সবচেয়ে ধনী পরিবার হচ্ছে ইস্পাহানী এবং হারুন পরিবার। এই দুই পরিবারের সাথেই শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এই দুইটি পরিবারই আমেরিকা এবং ব্রিটেনের ক্ষমতা বলয়ে বিশেষভাবে পরিচিত। হারুন পরিবার দৈনিক ডন পত্রিকার মালিক। এছাড়া শিপিং ও ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় শীর্ষস্থানে তাদের অবস্থান। তামাকের চাষ, সিগারেটের ব্যাবসা, টেক্সটাইল ক্ষেত্রেও তাদের আধিপত্য সর্বজন বিদিত। ইস্পাহানিদের রয়েছে পাট, চা, নানা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানে একচেটিয়া প্রাধান্য। পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হবার পর থেকেই আর্থিকভাবে তারা মুজিবকে লালন পালন করে এসেছে। নামেমাত্র পদ সৃষ্টি করে আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে মুজিবকে নিয়মিত মোটা অংকের মাসোহারা দেয়া হতো। ইস্পাহানী পরিবারের প্রভাবে মুজিবকে পাকিস্তানের টি বোর্ডের কর্তাব্যক্তি হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। মূলত, তাদের আর্থিক যোগানের উপর ভিত্তি করেই মুজিব রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। পরে অবশ্য প্রাদেশিক সরকারের শিল্পমন্ত্রী হয়ে এই দুইটি পরিবারের বিনিয়োগ সুদে আসলে পুষিয়ে দিয়েছিলো শেখ মুজিব। তিনি খন্দকার মোশতাকের দূত হয়েই এসেছিলেন যদিও তার মাধ্যমে পাঠানো বার্তার সারবস্তু আমরা আগেই জানতে পারি জনাব মোশতাকের সাথে টেলিফোনে আলাপের সময়।

কিন্তু জিয়ার সাথে আলাপ না করে তিনি কি করে মত প্রকাশ করলেন, যে জিয়া আমাদের ফেরত নিতে ইচ্ছুক নন? কিছুটা হলেও তার নিশ্চই জানা আছে যে জিয়ার সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

একজন বহুল পরিচিত ব্যক্তি হিসাবে জনাব ইস্পাহানীর অনেক নির্ভরশীল সোর্স আছে। হয়তো আমেরিকান রাষ্ট্রদূত কিংবা ব্রিটিশ হাই কমিশনারের কাছ থেকেই খবরটা পেয়েছেন।

ঠিক বলেছেন, এটা সম্ভব।

তিনি আর একটা মূল্যবান খবর দিয়ে গেলেন লক্ষ্য করেছ কিনা জানিনা। তিনি বলে গেলেন গ্রহণযোগ্যতার জন্য ইতিমধ্যেই জিয়া ভারতকে বলেছেন মুজিব হত্যার সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই। প্রয়োজনে এটা প্রমাণ করতে তিনি আরও ছাড় দেবেন ভারতকে। এই বক্তব্যটি কিসের ইঙ্গিত বহন করে? এর মানে জিয়ার খড়গ অবশ্যই পড়বে আমাদের এবং সেনা পরিষদের উপর। I strongly feel now, Zia had been highly ambitious person all through but never believed in pro-people politics. Mind set wise, he believes in politics of power only, compromising and sharing with the vested interested different quarters. The war of independence could not bring any change in his mind set. He shall never do the politics for the majority downtrodden and persecuted lot who had been deprived from their legitimate rights since ages. He shall never take any revolutionary steps regarding the socio economic sectors to establish a just and fair Bangladesh, where every citizen would be treated equally and given equal opportunity, there shall be no fair distribution of resources as well. In short, his politics shall be just politics for power sake like most of the despotic authoritarians of the 3rd world countries having legacy like vestiges of colonialism. পাশার প্রশ্ন

তাহলে তিনি আমাদের নীতি-আদর্শে বিশ্বাস করে শপথ নিয়েছিলেন কেন?

ভারত এবং প্রবাসী সরকারতো যুদ্ধের প্রারম্ভেই সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে অপসারিত করে মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা থেকে উপড়ে ফেলে কোলকাতায় এনে ডাম্প করে কোণঠাসা করে রেখেছিলো জেনারেল জিয়াকে। সেই অবস্থায় তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার অন্য কোনও পথ খোলা ছিল না ক্ষমতার কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছাবার জন্য। তাই সুযোগ পেয়ে তিনি আমাদের ব্যবহার করেছিলেন। তিনি অন্তর থেকে নয়, শুধুমাত্র মৌখিকভাবেই আমাদের নীতি-আদর্শের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তার এই চাতুর্য আমরা বুঝতে পারিনি। প্লেনটি ইতিমধ্যে দুবাইতে টেকনিক্যাল ল্যান্ডিং করেছিলো তেল ভরে নিতে। এই প্রেক্ষিতেই আমার মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে খন্দকার মোশতাক কিংবা আমাদের রাজনৈতিকভাবে জিয়ার মোকাবেলা করা অতি সহজ হবে না। আর একটি বিষয়ে আমি প্রায় নিশ্চিত. জিয়ার খড়গ মোশতাক এবং সেনা পরিষদের নেতাদের উপর নেমে আসবেই এই দুই প্রতিপক্ষকে শক্তিহীন করার জন্য। এছাড়া তার পক্ষে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করা কিছুতেই সম্ভব হবে না সেটা জিয়া ভালভাবেই বুঝে নিয়েছেন। তাই এখন থেকে আমাদের জিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ দেখতে হবে, বুঝতে হবে তার ভবিষ্যতের প্রতিটি পদক্ষেপ। তার উপরেই নির্ভর করবে আমাদের ভবিষ্যৎ করণীয়।

আপনার বিচার বিশ্লেষণের গভীরতা খুবই যুক্তিসঙ্গত। আমার মনে হয় এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের মানে সেনা পরিষদের সদস্যদের মাঝে একটা বিস্তারিত আলোচনা হওয়া উচিত।

যথাসময়ে প্রয়োজনে করবো নিশ্চয়ই।

কিছুক্ষণ পর ঘোষণা করা হল প্লেন জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে অবতরণ করছে। ভোর হয়ে গেছে। যাত্রীরা সবাই প্রাতঃক্রিয়া শেষ করে ফ্রেশ হয়ে যার যার আসনে বসতে শুরু করেছেন। আমরাও হাত-মুখ ধুয়ে বেশভূষা ঠিকঠাক করে নিলাম। এতে লম্বা সফরের ক্লান্তি কিছুটা দূরীভূত হল। পরই আসবে আমাদের গন্তব্যস্থল এথেন্স। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই আমাদের প্লেন অবতরণ করল এথেন্স বিমান বন্দরে। দরজা খোলার পর একজন নাতিদীর্ঘ গড়নের নাদুস-নুদুস ফর্সা ভদ্রলোক আল ইটালিয়ার গ্রাউন্ড স্টাফ আর এয়ারপোর্টের কয়েকজন কর্তাব্যক্তিকে নিয়ে প্লেনের ভেতরে প্রবেশ করলেন। মাইকে ঘোষিত হল আমার আর রশিদের নাম। অনুরোধ জানানো হল দরজার কাছে এগিয়ে আসার জন্য। আমরা এগিয়ে গেলাম। অন্য যাত্রীদের অনুরোধ জানিয়ে স্বস্থানে বসে থাকতে বলা হল। দরজার কাছে পৌঁছে দেখলাম স্যুট পরিহিত ঐ ভদ্রলোক হাসিমুখে আমাদের আরবী কায়দায় অভ্যর্থনা জানিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন লেফটেন্যান্ট সালেম বলে। তিনি নেতা মোয়াম্মর গাদ্দাফির তরফ থেকে আমাদের নিয়ে যাবার জন্য একটি বিশেষ বিমান নিয়ে এসেছেন। এরপর আমাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলো ভিআইপি লাউঞ্জে। সেখানে আমাদের পরিচয় পর্ব শেষ হল। মালপত্র সনাক্ত করে ওঠানো হল লিবিয়ান এয়ার লাইনসের প্লেনটিতে। অল্পক্ষণের মধ্যেই বোয়িং ৭২৭ বিমানটা গর্জে উঠে আকাশে উড়লো। গন্তব্যস্থল লিবিয়ার বৃহত্তম শহর বেনগাজী। স্মিতভাষী সালেম হাসিমুখে ইংরেজিতে আমাদের সুবিধা-অসুবিধার খবরাখবর নিচ্ছিলেন। ভূমধ্যসাগরের এক তীরে অবস্থিত এথেন্স ছেড়ে সাগর পাড়ি দিয়ে মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের বহনকারী যান্ত্রিক বলাকা ছুটে চলেছে অপরকূলে অবস্থিত বেনগাজীর উদ্দেশে। পৃথিবীর সব মহাসাগর-উপসাগরের রঙের মধ্যে রয়েছে স্বকীয় বৈচিত্র্য। ভূমধ্য সাগরেরও রয়েছে নিজস্ব বৈচিত্র্য। নীল-সবুজের সংমিশ্রণের সফেন তরঙ্গের উপর সূর্যের কিরণ পড়ায় এক অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছিলাম উইন্ডো দিয়ে। জেনারেল জিয়ার মনোভাব এবং খন্দকার মোশতাকের সিদ্ধান্ত অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, প্রশ্নগুলো জটিল। এসব নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ করেও আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি সত্যিই কি জেনারেল জিয়া আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চলেছেন! রশিদ এবং ফারুকের মনে ইতিমধ্যেই বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে জিয়া আগস্ট বিপ্লবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাদের চেতনা এবং স্বপ্নকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এখনই জিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে। তাদের এই ধরনের বিবেচনাকে একদম নাকচ না করে আমরা তাদের বোঝাতে চেষ্টা করছি এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য আমাদের আরও কিছু সময় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। এর পেছনে আমাদের দুটো জোরালো যুক্তি রয়েছে

১। খালেদ-চক্রকে পরাস্ত করে জিয়াকে মুক্ত করেছে সেনা পরিষদ। জিয়া জানতে পারেন মুক্তির পর সেনা পরিষদই ছিল ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের অগ্রণী এবং মূল চালিকা শক্তি। তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ছিল সহায়ক শক্তিমাত্র। এর প্রমাণ তিনি পেয়েছিলেন যখন তাহেরের ধৃষ্টতার মোকাবেলায় সেনা পরিষদের নেতৃবৃন্দ কঠিন অবস্থান নিয়ে তাহেরকে ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করেন।
২। শিশুভাই-এর সাথে আমাদের যে ধরনের ঘনিষ্ঠতা সেই পরিপ্রেক্ষিতে জিয়ার কাছের লোক হলেও তাকে সম্পূর্ণভাবে অবিশ্বাস্য মনে করাটাও যুক্তিসঙ্গত নয়। তিনি বলেছেন, আমাদের এই প্রবাস জীবন সাময়িক এবং জিয়া কিছুদিন সময় চেয়েছেন মাত্র। নি এই বিষয়ে যাই বলেছেন সেটা জিয়ার ভাষ্য এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ৩রা নভেম্বর আমরা খালেদচক্রের সাথে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে না গিয়ে খালেদ বিরোধী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে দেশ ছেড়ে ছিলাম সার্বিকভাবে প্রস্তুত আগ্রাসী ভারত যাতে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ না পায়। ঠিক এই মুহূর্তে জিয়া বিরোধী কোন সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সেই সুযোগটাই করে দেয়া হবে। আমাদের বুঝতে হবে, এ ধরনের যেকোনো সংঘর্ষ জাতি এবং সামরিক বাহিনীতে শুধু বিভ্রান্তির সৃষ্টিই করবে তা নয়, দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ারও আশংকা রয়েছে। কারণ, এখন পর্যন্ত সবারই ধারণা জিয়া আমাদেরই একজন। আমাদের যুক্তি খণ্ডাতে না পারলেও তাদের মনে সন্দেহ থেকেই যায়। তাই আমরা তাদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে নজর রাখছিলাম তাদের গতিবিধির উপর যাতে তারা কোনও হঠকারি পদক্ষেপ নিতে না পারে। এ সমস্তই ভাবছিলাম। হঠাৎ জানালা দিয়ে বাইরে নজর পড়লো। সমুদ্রের অপর পার দেখা যাচ্ছে। সমুদ্র সৈকত থেকেই শুরু হয়েছে সাহারা মরুভূমি। সাহারার পরিধি এক মহাসমুদ্রের মতোই। সূর্যের আলো আর উত্তাপে লালচে রঙে রঞ্জিত বিস্তীর্ণ মরু সাহারা দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত। এতেও দেখতে পেলাম ঢেউ এর সমারোহ, তবে সেগুলো পানির নয়- বালির। তার মাঝেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গুচ্ছগ্রাম, লোকালয়, ছোটবড় শহর এবং জলাশয় ঘিরে মরূদ্যান। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমি আফ্রিকার প্রায় অর্ধেকটাই জুড়ে বিস্তৃত। বাইরের শোভা উপভোগ করছিলাম আর ভাবছিলাম, সাগরের সাথে মিল থাকাতেই বোধকরি উটকে বলা হয় মরুভূমির জাহাজ! সেইক্ষণে পাশা এসে পাশে বসলো। তরুণরা নববঁধু সালেমকে নিয়ে আসর জমিয়ে বসেছে। চুটিয়ে আড্ডা দেয়া হচ্ছে। সেই জটলা থেকেই অনুমতি নিয়ে উঠে এসেছে পাশা। অন্যদিকে মেয়েরা আপন মনে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, গল্প-গুজবে মশগুল। অদ্ভুত চরিত্রের এই তরুণ-তরুণীরা! অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউই কিছু ভাবছে না, শংকিতও নয় কেউই।

স্যার, যদি অনুমতি দেন তবে একটা শলাকা ধরাই।

ধরাও।

সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে বললো

একা বসে বাইরে তাকিয়ে কি দেখছিলেন?

বালির মহাসাগর। আচ্ছা পাশা, একটা সাধারণ বিষয়ে তোমার অভিমত চাই যদিও বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই আগে কারো সাথেই আলাপ করিনি। বলুন। ঘটনা ঘটেছিল বঙ্গভবনে। একদিন আমাদের পুনর্নিয়োগের আদেশ জারির আগে ড্রাফটটা দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। জেনারেল ওসমানী, জেনারেল জিয়া, জেনারেল খলিল সবাই উপস্থিত ছিলেন। সেটা দেখে কিছু আলাপ সেরে বেরিয়ে আসছিলাম। পথে মেজর আমিন, প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি আমাকে পাকড়াও করে বললো, এম আর সিদ্দিকি তার রুমে আমার অপেক্ষায় বসে আছেন অনেকক্ষণ যাবত। বিষয়টা কি সেটা তার জানা নেই। ইতিমধ্যে জনাব সিদ্দিকিকে জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ দান করা হয়েছে। ভাবলাম হয়তো সেই বিষয়েই কিছু বলতে চান। আমিনকে বললাম, কাটিয়ে দে দোস্ত। আজ দুপুরের খাওয়া বাসায় খেতে হুকুমজারি করেছে নিম্মি, না গেলে রক্ষে নেই বুঝতেই তো পারছিস। এমনিতেই বাসায় যাওয়া হয়ে ওঠে না, নিম্মিও বঙ্গভবনে আসতে চায় না। কিন্তু হঠাৎ সিদ্দিকি সাহেবের এমন কি প্রয়োজন হল ঠিক বুঝতে পারছিনা! হঠাৎ করে নয়, বেশ কয়দিন যাবত তিনি আমার অফিসে ধর্না দিচ্ছেন যাতে করে আমি তোর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেই। আমি তাকে বলেছি, ও কখন বঙ্গভবনে আসে যায় সেটা কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। তাছাড়া ও বেশির ভাগ সময় বঙ্গভবনের বাইরেই থাকে। কোথায় যায় কি করে বলা মুশকিল। তবে আজ বলে ফেলেছি তুই প্রেসিডেন্ট, জেনারেল ওসমানী আর চীফের সাথে মিটিং করছিস। অপেক্ষা করলে ধরা যেতে পারে, সেই আশাতেই বেচারা বসে আছেন। তাহলে চল, বলে গিয়ে উপস্থিত হলাম আমিনের অফিসে। সালাম কুশলাদি বিনিময়ের পর সিদ্দিকি সাহেব একটু ইতস্তত ভাবেই বললেন, তিনি একান্তে কিছু আলাপ করতে চান। আমিনের ইশারায় পাশের ঘরে দুইজনে গিয়ে ঢুকলাম। একটা কারণে আপনার সাথে কয়েকদিন ধরে দেখা করার চেষ্টা করছি। কি ব্যাপার? না, তেমন বিশেষ কিছু নয়, চা কিংবা ডিনারে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আপনাকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ করতে চাচ্ছেন আপনাদের সুবিধে মতো। ব্যাপারটা ব্যতিক্রমধর্মী নয় কি?

তা ঠিক, তবে এটা একটা সৌজন্য সাক্ষাতের বেশি আর কিছু নয়।

শুধু সৌজন্য সাক্ষাত হলে অসুবিধে নেই, উপেক্ষাটা অশোভন হবে। ঠিক আছে, বিকেল পাঁচটায় ঘণ্টাখানেকের জন্য যেতে পারি। তবে নিম্মি যেতে পারবে না। ওখান থেকেই আমাকে আরেকটা মিটিং-এ যেতে হবে। আমি এখুনি সব ব্যবস্থা করছি। আপনি কি নিজেই আসবেন?

বর্তমানে কোথায় থাকেন তিনি, গুলশানে নাকি ধানমণ্ডিতে?

ধানমণ্ডিতে।

তাহলে সংসদ ভবনের সামনে আমরা ৪টা ১৫মিনিটে মিলিত হবো।

ঠিক আছে।

সময় মতো সংসদ ভবনের সামনে পৌঁছে তার গাড়ীতে বসেই উপস্থিত হলাম রাষ্ট্রদূত জনাব বোস্টারের বাসভবনে। তিনি সস্ত্রীক অভ্যর্থনা জানিয়ে ড্রইংরুমে নিয়ে বসালেন। জনাব সিদ্দিকি বোস্টার দম্পতির সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি বিনয়ের সাথে জানালাম, বিশেষ কারণে নিম্মির পক্ষে আসা সম্ভব হয়নি। মিসেস বোস্টার মৃদু হেসে বললেন

আপনি এসেছেন সময় করে তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। কিছুক্ষণের মধ্যেই কুশলাদি বিনিময় পর্ব শেষ করে মিসেস বোস্টার ভেতরে চলে গেলেন। এটাই আমার তার সাথে প্রথম এবং শেষ সাক্ষাত।

তাহলে আপনিই দেশ খ্যাত মেজর ডালিম? জবাব নিষ্প্রয়োজন, তাই পরের প্রশ্নের অপেক্ষায় থাকলাম।

মুজিব সরকারের পতন এবং তার মৃত্যুর খবর যখন রেডিওতে ঘোষণা করছিলেন তখন কি ভেবেছিলেন এর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? হেসেই জবাবে বলেছিলাম

এক্সেলেন্সি, প্রতিক্রিয়ায় আপনি স্লিপিং স্যুট পরা অবস্থায় রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে, আমার অবস্থাটা ঠিক তেমনটি ছিল না। আপনি ভালো করেই অবগত এই ধরনের ঘটনা সবদিক ভেবেচিন্তেই পরিকল্পিতভাবে করা হয়ে থাকে, তাই নয় কি? জবাবটা শুনে তিনি কিছুক্ষণ তীক্ষ্নদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থেকে বললেন সেটা ঠিক। ইতিমধ্যে চা-নাস্তা পরিবেশন করে গেল বেয়ারা।

Anyway, what is next?

এক্সেলেন্সি, জবাব দেবার আগে প্রশ্নটা পরিষ্কার ভাবে বোঝা দরকার।

রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আপনাদের পরিকল্পনা কি?

আমরা সবাই ফিরে যাচ্ছি আমাদের কর্মস্থলে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন সংবিধান সম্মত রাষ্ট্রপতি, তার সরকারের মন্ত্রীপরিষদ এবং সংসদ। ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট ও তার সরকার আগামীতে মানবাধিকার, আইনের শাসন, বাক স্বাধীনতা, রাজবন্দীদের মুক্তি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনঃর্প্রতিষ্ঠার দিনক্ষণসহ জাতির উদ্দেশে তাঁর ভাষণে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। আমার ধারণা তাঁর সেই ভাষণ সম্পর্কে আপনিও অবগত আছেন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রত্যাশাই তার ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছে। আপনি কি মনে করেন এক্সেলেন্সি?

হ্যাঁ, তার সেই ভাষণ আমি শুনেছি। খুবই আশাপ্রদ।

আমাদের দায়িত্ব ছিল শ্বাসরুদ্ধকর একদলীয় স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে জাতিকে মুক্ত করে মানবিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার রুদ্ধদ্বার খুলে দেয়া। এ দায়িত্ব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পালন করা উচিৎ ছিল। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে শেখ মুজিবের স্বৈরসরকার কি করে বিলীন করে ফেলেছিল সেটাতো আপনার ভালোভাবেই জানা আছে। আমরা সফলতার সাথেই আমাদের লক্ষ অর্জন করেছি। এরপর আমাদের আর কোনও দায়িত্ব থাকতে পারে না রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে। আমি আমার বক্তব্য শেষ করার আগে আপনাকে পরিষ্কারভাবে কিছু কথা জানিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশের জনগণের রক্তে স্বাধীনতার চেতনা এবং গণতন্ত্র মিশে আছে। ইতিহাস কিন্তু সেই সাক্ষ্যই দেয়, জনাব রাষ্ট্রদূত।

আচ্ছা, আপনারা জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধান বানালেন কেনো?

এক্সেলেন্সি, তাকে সেনাপ্রধান বানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট তার সাংবিধানিক ক্ষমতা অনুযায়ী। এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাদের কথা আসছে কেনো সেটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না? দেখলাম তার প্রশ্নগুলোর জবাব পাল্টা প্রশ্নের মাধ্যমে দেয়ায়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেও জনাব বোস্টার বেশ কিছুটা লালচে হয়ে উঠেছেন, মুখমণ্ডলেও জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তাই ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনি সেটা লক্ষ করেই বললেন

আপনার নিশ্চয়ই কোনও ব্যস্ততা রয়েছে?

হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন- বলে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। তিনি স্বয়ং গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন।

পুরোটা সময় জনাব সিদ্দিকি ছিলেন নীরব দর্শক। পাশা সব শুনে সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে সিটের হাতলের এ্যাসট্রেতে বাটটা ফেলে দিয়ে বললো

এ ভাবেই বিদেশী শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ক্ষমতাবলয়ের সবাইকে যাচাই বাছাই করে থাকে। আপনাদের বৈঠকটি সেই প্রক্রিয়ারই একটা পর্ব। তবে আপনার জবাবগুলো শোনার পর তিনি আপনার বিষয়ে আরও খোঁজ খবর নেবার চেষ্টা করবেন। আপনার সম্পর্কে আগ্রহ বাড়বে এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। তাই সুধী সাবধান! উচ্চস্বরে হেসে উঠল পাশা, আমিও হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। X-Ray করা হয়েছে কিন্তু Report টা পরিষ্কার নয়। এই উপসংহারেই পৌঁছলাম দু’জনেই। উচ্চপর্যায়ের কোনও কূটনীতিকের সাথে স্বাধীনতার পর একজন সৈনিক হিসাবে সেটাই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাতকার। তাই মানসপটে স্মরণীয় হয়ে আছে স্মৃতিটা। এ ধরনের বৈঠকের তাৎপর্য কিংবা গুরুত্ব কতটুকু সেই সময় সেটা ঠিক বুঝতে পারিনি, কিন্তু পরবর্তীকালে দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি সময় কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি এ ধরনের বৈঠকের মর্মকথা। তাই বিষয়টি উল্লেখ করলাম। দু‘জনই চুপচাপ বসে বাইরে ভেসে যাওয়া পেঁজা তুলোর মতো মেঘের খণ্ডগুলোর দিকে চেয়ে দেখছিলাম। মাঝে মাঝে খণ্ডগুলো প্লেনের গায়ে এসে লাগায় মৃদু ঝাঁকুনি অনুভূত হচ্ছিল। যান্ত্রিক বলাকা আমাদের পেটে ধরে ছুটে চলেছে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে। হঠাৎ পাশা বলে উঠল

স্যার, আমাদের কাউকে কিছু না বলে রশিদ আর ফারুক ব্যাংকক এর দূতাবাসে হাজির হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে বিফল হয়ে একটা প্রেস কনফারেন্স করে বসল কেনও, এর পেছনে কি যুক্তি থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

উদ্যোগটা হঠকারি হলেও যুক্তি একটা আছে। ওরা খন্দকার মোশতাকের সাথে আলাপ করে যখন জানতে পারল, মোশতাক জিয়ার অনুরোধে আবার রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন না এবং পরিষ্কার জানালেন তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হবেন তখন তারা বুঝতে পেরেছিলো তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পরেছে। মোশতাক আরো যখন জানান জিয়া এবং তাহেরের দ্বন্দ্ব সামরিক বাহিনীকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে যদিও সামরিক বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে তিনি তাহেরকে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়েছেন কিন্তু অবস্থা তখনও তরল। তার এই বক্তব্যের পর জিয়ার উপর তাদের অনাস্থা বেড়ে যায়। মোশতাক অবশ্যি কিছুই জানতেন না যে, তাহেরকে পরাস্ত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল সেনা পরিষদ। সামরিক বাহিনীতে সেনা পরিষদ নামের কোনও সংগঠন সম্পর্কে আংশিক ভাবে রশিদ আর ফারুক জানলেও মোশতাকের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। কিন্তু আমরা জানতাম, সেই সন্ধিক্ষণে জিয়ার পেছনের মূলশক্তি ছিল সেনা পরিষদ। জিয়াও বিষয়টি ভালোভাবেই জানতেন। সেনা পরিষদের সাথে সম্পর্ক না থাকায় মোশতাকের মতো রশিদ আর ফারুকও বিচলিত হয়ে ওঠে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই তারা ছুটে গিয়েছিলো দূতাবাসে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি, বাংলাদেশে তখন জিয়াকেই প্রায় সব বিদেশী শক্তি তাদের ভবিষ্যতের ক্রীড়নক হিসাবে দেখতে শুরু করে দিয়েছে ভারতসহ। সেক্ষেত্রে রশিদ আর ফারুককে স্বাভাবিকভাবেই উপেক্ষা করেছে আমেরিকান দূতাবাস। কারণ, জিয়াকে যেখানে তারা বাংলাদেশে তাদের প্রধান খেলোয়াড় বলে মনে করতে শুরু করেছে সেখানে জিয়ার অভিপ্রায় না জেনে ব্যাংককের আমেরিকান দূতাবাস কেনো, কোথাও কোনও দেশের দূতাবাসই আমাদের বা তাদের এই ধরনের আবেদন মঞ্জু্র করবে না সেটাই স্বাভাবিক। প্রেস কনফারেন্সের কারণ ছিল ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা। এরা ভবিষ্যতেও এ ধরনের অযৌক্তিক আরও অনেক কিছুই হয়তো করবে। তাই বাদ দাও ওদের কথা। চলো, জিয়াকে নিয়েই আলোচনায় ফিরে যাই। আমার মনে হয় ইতিমধ্যেই জিয়া ভারত এবং বিদেশের শক্তিধর দেশগুলোকে বোঝাতে চেষ্টা করে অনেকটাই সফল হয়েছেন যে তিনি সবার সাথে আপোষ করেই রাজনীতিতে এগুবেন। যুক্তি হিসাবে তিনি দেশবাসীকে বোঝাবেন জাতীয় ঐক্য এবং গণতন্ত্রের প্রয়োজনেই তিনি সেটা করছেন। ভারত বিরোধী জনগণের মনোভাব এবং বৃহত্তর মুসলমান জনগোষ্ঠী এবং তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ধর্মীয় চেতনা বুঝে রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য তিনি বাহ্যিকভাবে ভারত বিরোধী শ্লোগান তুলবেন। একই সাথে বকধার্মিকও সাজবেন। মুজিব ও আওয়ামী-বাকশালীরা রুশ-ভারত বলয়ের তাবেদার হয়ে রাজনীতি করেছে কিন্তু জিয়ার রাজনীতি হবে সবাইকে খুশি করে ক্ষমতার রাজনীতি। ডান, বাম, মধ্যপন্থীদের সমন্বয়ে যে সংমিশ্রণের রাজনীতি তিনি করতে চলেছেন তার নব্য পরামর্শদাতাদের প্ররোচনায় সেই ঘূর্ণিপাকেই একদিন তার করুণ পরিণতি ঘটবে। নীতি-আদর্শের রাজনীতি করার জন্যই আমরা দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে গড়ে তুলেছিলাম সামরিক বাহিনীতে মজবুত সংগঠন সেনা পরিষদ। একই সাথে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে পরীক্ষিত সমমনা নেতা-কর্মীদের একত্রিত করে শক্ত ভিত্তির উপর একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে আপোষহীন বৈপ্লবিক পদক্ষেপের মাধমে ‘৭১ এর চেতনা আর স্বপ্নকে ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত করে তুলতে চেয়েছিলাম জিয়ার নেতৃত্বে তারই সম্মতিক্রমে। কিন্তু আমাদের সব ত্যাগ-তিতিক্ষার পিঠে ছোরা মেরে ভুলপথে চলেছেন আজকের জিয়া। তুমি দেখবে, তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য তিনি বাধ্য হয়েই রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে দুর্নীতির প্রচলন করবেন যাতে তার নানা মতের নানা মুনিদের বেশিরভাগ পদলেহী ‘জি হুজুরে’ পরিণত হতে বাধ্য হয়। জিয়ার সব অন্যায়কে মেনে নিয়ে কান ধরে ওঠবস করবে ঐ সব চাটার দল প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে। ঠিক যেমনটি করেছিলো জেনারেল আইয়ুব খান, ভুট্টো, সুহার্তো, রেজা শাহ্‌ পেহলভী, মবুতু, পিনোচেট, মারকোস-এর মতো Despotic নেতারা। অবশ্য তিনি নিজের ইমেজ বানিয়ে রাখবেন ধোয়া তুলসী পাতা করে। কি জানো পাশা, স্বচ্ছ রাজনৈতিক আদর্শ, সর্বত্যাগী নেতৃত্বের অধীনস্থ একটি সুশৃঙ্খল শক্তিশালী দল এবং পরীক্ষিত কর্মীবাহিনী ছাড়া দেশ ও জাতীয় স্বার্থে কোনও মহৎ কল্যাণকর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। তিনি যদি তার ওয়াদার বরখেলাপ না করে আমাদের সঙ্গেই থাকতেন তাহলে আল্লাহ্‌র রহমতে আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে পারতাম। জিয়ার আগামী দিনের রাজনীতিতে এই তিনটি উপাদানের একটিও থাকবে না, থাকা সম্ভব নয়। কারণ করাচীতে বড় হয়ে ওঠা জিয়ার সাথে বাংলাদেশের মাটি-মানুষের কোনও সম্পর্ক কখনোই গড়ে ওঠেনি। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির ধারাবাহিকতার সাথে সম্পৃক্ততা তো দূরের কথা, তিনি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া একজন সন্তান হিসাবে রাজনীতি থেকে নিজেকে সযত্নে সরিয়ে রেখেছেন বরাবর নিজের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের কথা স্মরণে রেখে। পরে হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর অফিসার।

বিপরীতে আমরা সবাই কমবেশি ছাত্রজীবন থেকেই জাতীয় এবং ছাত্র রাজনীতির সাথে ছিলাম এবং জড়িত। আমাদের অনেকেরই জন্ম হয়েছে রাজনৈতিক, সচ্ছল বনেদী পরিবারে। ‘৭১ সালে কালুরঘাট থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণার আগ পর্যন্ত জিয়ার তেমন কোনও পরিচিতি ছিল না সামাজিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের কাছে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে যোগদানের আগেই আমাদের কমবেশি একটা পরিচিতি সমাজের সব মহলেই রয়েছে। তাছাড়া আমাদের উপর নির্ভর করে তাকে রাজনীতি করতে হবে এটাও তার জন্য হীনমন্যতার একটি কারণ হলেও হতে পারে।

অবশ্যই হতে পারে। শিশুভাই আমাদের সবারই প্রিয়জন, কিন্তু তিনি আমাদের ফিরিয়ে নেবার জন্য জিয়ার কেনো আরও কিছু সময় প্রয়োজন সে সম্পর্কে যেই যুক্তিটা দিলেন তাতে আমি কিন্তু খুব একটা convinced হতে পারিনি। তিনি বললেন, এই মুহূর্তে আমাদের ফিরিয়ে নিতে হলে রশিদ আর ফারুককেও ফিরিয়ে নিতে হবে। যেহেতু তারা দুইজনই সেনা পরিষদের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয় সেইক্ষেত্রে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। তাই অল্প কিছুদিনের মধ্যে জিয়া নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার পর তাদের বিচ্ছিন্ন করে তিনি আমাদের ফিরিয়ে নেবেন।

হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলছ। এটা একটি খোঁড়া যুক্তি। কারণ, রশিদ আর ফারুক কিন্তু কখনোই বলেনি তারা জিয়া বা আমাদের সাথে রাজনীতি করবে না। তবে শিশুভাই কিন্তু শুরুতেই বলেছিলেন, জিয়া আমাদের কি বলতে বলেছেন তিনি ঠিক তাই বলবেন সেটা যাতে আমরা তার নিজস্ব ভাষ্য বলে ভুল না করি। এখনঅব্দি যা কিছুই আমরা আলাপ করলাম তার সঠিকতা কতটুকু সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে ধৈর্যের সাথে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবো বেনগাজী। ইতিমধ্যেই তরুণরা আর মেয়েরা বিমানবালাদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক কায়েম করে ফেলেছে। তারা ককপিটে নির্দ্বিধায় যাওয়া আসা করছে। দুই তরফ থেকেই সাধারণভাবে ব্যবহৃত কিছু শব্দ ও বাক্য শেখাবার চেষ্টা চলছে। অন্তরঙ্গ পরিবেশে চলেছি অজানার উদ্দেশ্যে। অল্পক্ষণ পরেই পাইলট জানান দিল, ১০ মিনিটের মধ্যেই আমরা বেনগাজী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করবো। পুরো সফরকালে ক্যাপ্টেনসহ ককপিট এবং কেবিন ক্রুরা ক্ষণে ক্ষণে এসে খোঁজ নিচ্ছিলেন কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা। বিমানক্রুরা সবাই সালেমকে বিশেষ সমীহের সাথেই সম্মান দেখাচ্ছিলেন। তাদের ব্যবহার থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল পদমর্যাদায় সালেম একজন লেফটেন্যান্ট হলেও তার আসল ওজনটা ঐ পদবির চেয়ে অনেক বেশি। প্লেন ল্যান্ড করলো।

বেনগাজী বিমানবন্দরটি বেশ বড়, আধুনিক এবং পরিষ্কার পরিছন্ন। ট্যাক্সিং এর সময় যায়গায় যায়গায় বেশ কয়েটি জঙ্গিবিমান দেখলাম কংক্রিটের হ্যাঙ্গারে রাখা রয়েছে। সবই প্রায় রাশিয়ার মিগ গোত্রের। বেশ কয়েকটা হেলিকপটার গানশিপও দেখলাম ক্যামোফ্লেজড অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উড়ো জাহাজ থেকেই দেখতে পেলাম রাষ্ট্রীয় অতিথিদের উষ্ণ সম্বর্ধনা দেবার জন্য লাল গালিচা বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আর্মি ব্যান্ড, গার্ড অফ অনার দেবার জন্য চৌকস একটি সেনা Contingent সারিবদ্ধ অবস্থায় দাড়িয়ে আছে টারম্যাকে। অতিথিদের মোয়াম্মর গাদ্দাফির তরফ থেকে স্বাগত জানাবার জন্য স্বয়ং উপস্থিত হয়েছেন মেজর সুলাইমান। তিনি বেনগাজি এলাকার প্রজাতন্ত্রের Revolutionary Command Council এর সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি। সালেম জানালেন, ‘মোয়াম্মর’ মানে ‘প্রিয় নেতা।’ জাতির প্রিয় নেতার সামরিক পদবি কর্নেল, ফলে লিবিয়া প্রজাতন্ত্রে অন্য সবার সর্বোচ্চ পদবি মেজর অব্দি। সালেম আরও জানালেন, ক্ষমতার শীর্ষে মোয়াম্মর গাদ্দাফির পরেই দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছেন মেজর সুলাইমান। Revolutionary Command Council এ কর্নেল মোয়াম্মর গাদ্দাফির পরই তার স্থান। তিনি বেনগাজীর গভর্নর এবং সামরিক বাহিনী প্রধান। ত্রিপলি দেশের রাজধানী হলেও বেনগাজী শহর শুধু বৃহত্তমই নয়, সব বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজধানীতে প্রচুর বিদেশীদের অবস্থান, তাছাড়া সব দূতাবাসও সেই শহরে অবস্থিত বিধায় নিরাপত্তার জন্যই বেনগাজীতেই আমাদের রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমাদের প্লেনটি পূর্বনির্ধারিত স্থানে এসে দাড়াল। প্লেনের দরজা খোলার পর প্লেনের দরজা থেকে টারম্যাক-এ বিছানো লালগালিচা পর্যন্ত আর একটা লাল কার্পেট বিছিয়ে দেয়া হল। নিচে চৌকস সেনা Contingent, সামনে মেজর সুলাইমানের পাশে পদবী অনুযায়ী আরও ৮-১০ জন সেনাসদস্য ও বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তারা সারিবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে। মেজর সুলাইমানের ইশারায় ক্ষুদে ছেলেমেয়েদের একটি দল হাতে ফুলের স্তবক নিয়ে এসে দাড়ালো সিঁড়ির কাছে সুশৃঙ্খল ভাবে সারিবদ্ধ হয়ে। এরই মধ্যে সালেম সিভিল ড্রেস পাল্টে আর্মি ইউনিফর্ম পরে নিয়েছেন। তিনিই প্রথমে নেমে মেজর সুলাইমানকে স্যালুট করে কচি-কাঁচাদের দলের পুরোভাগে অবস্থান নিলেন। এরপর তার ইশারায় আমরা একে একে অবতরণ করলাম। প্রতেকের হাতে একটি করে ফুলের তোড়া দিয়ে সালাম জানিয়ে স্বাগত জানাল লিবিয়ার ভবিষ্যতের ক্ষুদে নাগরিকরা। সালেম, মেজর সুলাইমান এবং তার সাথীদের সাথে আমাদের প্রত্যেককে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাই আরবি কায়দায় আমাদের বুকে বুক মিলিয়ে অভিবাদন জানালেন। এরপর আমরা সবাই যার যার জায়গাতে অবস্থান নেবার পর Contingent Commander এর নির্দেশে গার্ড অফ অনারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমাদের স্বাগত জানানো হল। ব্যান্ডে বেজে উঠল বাংলাদেশের এবং লিবিয়ার জাতীয় সঙ্গীত। আমরা প্রথা মতো অভিবাদন গ্রহণ করলাম। যখন জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল ব্যান্ডে, এক অপূর্ব মূর্ছনায় পুলকিত হয়ে উঠেছিল আমাদের মন। মার্চপাস্ট করে চলে গেল Contingent এবং ব্যান্ডপার্টি। সঙ্গেসঙ্গেই একটি গাড়ীর বহর এসে উপস্থিত হল আউট রাইডার সহ। সব কয়টাই মারসেডিজ বেঞ্জ। সামনে পেছনে BMW মোটর সাইকেল এর আউট রাইডারস এবং এস্করট। নিখুঁত ব্যবস্থা। গাড়ীর বহর ধীরগতিতে এগিয়ে চললো এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল ওমর খৈয়ামের উদ্দেশ্যে। সেটাই ছিল তখন বেনগাজীর একমাত্র পাঁচ তারকা বিশিষ্ট হোটেল। সেখানেই প্রাথমিকভাবে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, জানিয়েছিলেন সালেম। হোটেলকে আরবি ভাষায় বলা হয় ‘ফন্দুক।’ ভূমধ্যসাগরের কোল ঘেঁষে অতি মনোরম পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী হোটেল ওমর খৈয়াম। সর্বোচ্চ দু‘টি তলা আমাদের জন্য সুরক্ষিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথিদের নিরাপত্তা ও আনুষঙ্গিক অন্যসবও নিখুঁত ভাবেই করা হয়েছে আর্মির তত্ত্বাবধানে। মেজর সুলাইমানের আগমনে হোটেল কর্তৃপক্ষ তটস্থ হয়ে পরলো। সুলাইমান ম্যানেজারের সাথে ঘুরে সব ব্যবস্থা পরিদর্শন করে আমাদের সাথে এসে যোগ দিলেন চা-নাস্তার বিশেষ আয়োজনে।তিনি আশা প্রকাশ করে বললেন, আমাদের অবস্থান সফল এবং আনন্দদায়ক হউক। অতি বিনীতভাবে বললেন, আমরা যেন লিবিয়াকে নিজের দেশ বলেই আপন করে নেই। অতি স্বল্পভাষী এত বড় মাপের নেতার বিনয় এবং আন্তরিক উষ্ণতা আমাদের মন ছুঁয়ে গেল। পরে গণচীনেও অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যিনি যত বড় মাপের নেতা ততই তিনি বিনয়ী। চা পর্ব শেষে ফিরে যাবার সময় তিনি বললেন, সালেম এখন থেকে আমাদের দেখাশোনার জন্য ২৪ ঘন্টাই আমাদের সাথেই থাকবেন। তিনি আরও জানালেন, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের উপযুক্ত বাসস্থানে স্থানান্তরিত করা হবে। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মেজর সুলাইমান। এরপর ম্যানেজার ও তার স্টাফরা আমাদের পূর্বনির্ধারিত স্যুইটগুলোতে নিয়ে গেলেন। সালেমের জন্যও একটি স্যুইট বরাদ্দ করা হয়েছে। তিনি বললেন, সন্ধ্যার পর আমাদের তিনি শপিং-এ নিয়ে যাবেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য। এখন আমাদের দীর্ঘ সফরের পর বিশ্রাম প্রয়োজন। বিশাল আফ্রিকা মহাদেশের দু‘টি মুসলিম অধ্যুষিত বৃহত্তম দেশ সুদান এবং লিবিয়া। তেল, গ্যাস ছাড়াও মূল্যবান খনিজ ও ধাতব সম্পদের ভাণ্ডার দেশ দু’টি। তাই পশ্চিমা শক্তিগুলোর শ্যেনদৃষ্টি দেশ দু’টির উপর বিশেষ করে লিবিয়ার উপর। কারণ, বিপ্লবী নেতা মোয়াম্মর গাদ্দাফি পাশবিক শক্তির দম্ভে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বজোড়া নিষ্পেষণ ও শোষণের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে সোচ্চার। একই ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের বিদেশী অপশক্তিগুলোর তল্পিবাহক বাদশাহী এবং আমিরাতির কঠোর সমালোচক বিধায় পশ্চিমা জগতের চক্ষুশূল। তাছাড়া এই বিপ্লবী নেতা পৃথিবীর যেকোনো জাতির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুক্তিসংগ্রামে তাদের পাশে নির্ভীক ভাবে দাড়ান সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতার হাত বারিয়ে। এটাও আগ্রাসী লোভী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর গাত্র জ্বালা। তাই তার বিরুদ্ধে করা হয় ঐক্যবদ্ধ অপপ্রচার এবং প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র। কিন্তু সাহসী এই বিপ্লবী বীর সবকিছুর মোকাবেলা করেই তার নীতি-আদর্শে অটল থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। সুদান, কেনিয়া, চাদ, নাইজেরিয়া, মরক্কো, ইথিওপিয়া, মোজাম্বিক, ক্যামেরুন, ইরিত্রিয়া, ইয়েমেন, কঙ্গো, লেবানন, ফিলিস্তিন, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাম্বিয়া, উগান্ডা, বসনিয়া, চেচনিয়া, সোমালিয়া, আলজেরিয়া, ইরিত্রিয়া, আয়ারল্যান্ড, মিন্দানাও, মোজাম্বিক-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে গাদ্দাফির অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বিশ্বের মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে। এই সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী অনেক নেতার সাথেই ঘনিষ্ঠতা এবং বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো লেখকের। মুসলিম জাহানের দুর্নীতি পরায়ণ আমীর-বাদশাহদের কাছেও তার প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ছিল ভীতির কারণ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সক্রিয় সাহায্যে ফিকরাবাজির সৃষ্টি করে মুসলিম বিশ্বের বিভক্তিকরণের ষড়যন্ত্রের ঘোর বিরোধী গাদ্দাফি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সারা দুনিয়ার মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার। সেই উদ্যোগও গ্রহণযোগ্য ছিল না পশ্চিমা শক্তিগুলোর উপর নির্ভরশীল স্বৈরশাসক আমীর-বাদশাহদের কাছে। পাকিস্তান কোন দিনই পারমাণবিক শক্তি হতে পারতো না যদি মোয়াম্মর গাদ্দাফি মুক্ত হস্তে আর্থিক সাহায্য না করতেন। মরু অঞ্চলের দেশগুলোতে প্রচণ্ড তাপদাহে দিনের বেলায় রাস্তাঘাটে, বাজারে এমনকি অফিস আদালতেও তেমন একটা লোক সমাগম হয় না। শহর জীবন্ত হয়ে ওঠে আসরের পর। ঝিমিয়ে থাকা শহর পড়ন্ত বিকেল থেকেই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সব কিছুই খোলা থাকে রাত ১০-১২টা পর্যন্ত। আমাদের প্রতিটি স্যুইট থেকেই দেখা যায় Outer anchorage এ নোঙ্গর করা বিভিন্ন আকারের সামুদ্রিক জাহাজগুলো। এত বড় অভাবনীয় সম্পদের অধিকারী দেশ লিবিয়ার লোকসংখ্যা তখন ছিল মাত্র ২০ লক্ষ। তাই প্রতিটি নাগরিকের চাহিদা অতি হজেই মিটিয়ে চলেছিল বিপ্লবী সরকার। জনগণ ছিল খুশি এবং সন্তুষ্ট। কাছেই শহরের সবচেয়ে বড় Shopping Mall. আরবী ভাষায় ‘সুখ’। যথাসময় সালেম এসে গেলো। আমরাও তৈরি হয়েই ছিলাম। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি বিশ্রাম নেয়ায় কেটে গেছে, সবাই ফ্রেশ। গাড়ীর বহরে গিয়ে বসলাম সবাই। সাথে এস্করট। পথ দেখিয়ে চলেছে আউট রাইডারস। প্রশস্ত আধুনিক হাইওয়ে, স্কাই স্ক্র্যাপারস, দোকানপাট, অফিস আদালত, বাড়িঘর সবি প্ল্যানড। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে পুরো শহর। Shopping Mall গুলোর সব দোকানেই রয়েছে বিশ্বের নামিদামি বুটিক। কার পার্কিং-এ দেখলাম সব নামিদামি গাড়ীর সারি। তবে লক্ষ করলাম স্থানীয় পুরুষ বাসিন্দাদের বেশিরভাগের পরনে ‘তুপ।’ বাংলায় যাকে বলা চলে আলখাল্লাহ। এই লেবাস সমস্ত আরবদেশের অধিবাসীদের মধ্যেই পরার চল রয়েছে। মেয়েরা ফ্যাশনেবল বোরকা পরিহিত। কেউ আবার নামিদামি বুটিকের শালীন ড্রেসের সাথে মাথায় ম্যাচিং স্কার্ফ পরে চলাফেরা করছে। অশ্লীল কাপড় পরা কোনও মেয়ে কিংবা মহিলা চোখে পরলো না। সালেম বললেন, প্রয়োজন আর পছন্দমত কাপড়-চোপড় এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিন সবাই। কেনাকাটার খোলা ছুট দেয়া হলেও আমরা সংযতভাবেই সবাই ন্যূনতম যা কিছু প্রয়োজন তাই পছন্দ করে কিনলাম। কেনাকাটা শেষে ফিরে এলাম হোটেলে। ফেরার পর সালেমের অনুরোধে সবাই এক বৈঠকে বসলাম। প্রথমেই সালেম আমাদের প্রত্যেককে একটি কাগজের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে লিবিয়ার ইতিহাস তুলে ধরলেন আমাদের অবগতির জন্য। প্রাচীন ইতিহাসে দেখা যায়, লিবিয়া সুদীর্কাল বিভিন্ন শক্তির দ্বারা শাসিত হয়েছে। ১৫৫১ সাল থেকে দেশটি অটোম্যান শাসনাধীনে ছিল। তুরস্ক দুর্বল হয়ে পড়ার সুযোগে ১৯১১ সালে ইতালি লিবিয়ার এক অংশ দখল করে। ঔপনিবেশিক দখলদারির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম লিবিয়ার এক নেতা ওমর মোখতার বিদ্রোহ করেন। তিনি ছিলেন কুরআন শিক্ষক, কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী। ২০ বছর ইতালির বিরুদ্ধে লড়াই করেন তিনি। কয়েকটি যুদ্ধে ইতালীয়রা তাঁর কাছে পরাজিত হয়। এক যুদ্ধে তিনি আহত হওয়ার পর ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইতালীয়রা তাঁকে আটক করতে সক্ষম হয়। তড়িঘড়ি করে আয়োজিত প্রহসনের বিচারের পর ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁকে তারা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির পরাজয়ের পর লিবিয়া ব্রিটিশ ও ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৯৫১ সালের ২৪ ডিসেম্বর লিবিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। ক্ষমতায় আসেন বাদশাহ ইদ্রিস। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাদশাহ ইদ্রিস লিবিয়াতে সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করেন। এর অনেক বছর পর লিবীয় সামরিক বাহিনীর কিছু তরুণ অফিসার ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৬৯, মোয়াম্মর গাদ্দাফির নেতৃত্বে এক সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রী লিবিয়া কায়েম করে। এরপর থেকে দেশ পরিচালিত হচ্ছে Revolutionary Command Council এর নেতৃত্বে। ওমর মোখতারকে লিবিয়ার ‘জাতীয় বীর’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তার নামে মুদ্রা ও ডাকটিকেট ছাপা হয়। আজঅব্দি লিবিয়াবাসী শ্রদ্ধার সাথে তাকে স্মরণ করে থাকে। দেখি, আমাদেরকে দেয়া কাগজের মোড়কে মোয়াম্মর গাদ্দাফির লেখা সারাবিশ্বে বহুল ভাবে পরিচিত এবং পঠিত ‘গ্রীনবুক’ এর দুটি খণ্ড রয়েছে। এতে তিনি সংক্ষিপ্তভাবে বিপ্লবের পটভূমি, নীতি-আদর্শ, বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বীরগাথা, লক্ষ্য, কি করে লিবিয়াকে একটি স্বনির্ভর, আত্মমর্যাদাশীল দেশ ও জাতি হিসাবে প্রগতির পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে নেয়া সম্ভব তার কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত কিন্তু অতি সরলভাবে লিখেছেন। মোটকথা, এই গ্রীনবুকের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলের রাজনৈতিক দর্শন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আদর্শিক সমন্বয়, রাষ্ট্র এবং দেশবাসীর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং দায়িত্বের বিষয়ের সবকিছুর সারবস্তু। সালেম জানাল

গ্রীনবুক এর খন্ড দুটো পড়ার পর আমরা এই বইয়ের বিষয়বস্তু এবং বাংলাদেশ এবং আপনাদের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে মতবিনিময় করতে ইচ্ছুক যদি আপনারা সম্মত থাকেন।

অতি উত্তম প্রস্তাব, আমরাও দ্বিপাক্ষিক অভিজ্ঞতা নিয়ে মত বিনিময় করতে একই ভাবে উদগ্রীব।

বৈঠক শেষে তিনি বিদায় নেবার আগে আশা প্রকাশ করে জানালেন, এক সপ্তাহের আগেই সম্ভবত আমরা সুরক্ষিত এলাকাতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফ্ল্যাটে চলে যেতে পারবো। সালেম চলে যাবার পর প্যাকেট খুলে দেখলাম গণচীনের বিপ্লবের পর ছাপা চেয়ারম্যান মাও সে তুং- এর লেখা চীন বিপ্লবের নির্যাস হিসাবে প্রকাশিত ‘রেডবুক’ এর মতো প্রায় একই সাইজে ছাপানো হয়েছে গাদ্দাফির দুই খণ্ডের গ্রীনবুক। সাথে একটি চিরকুট আর কিছু দিনার। চিরকুটে লেখা রয়েছে, প্রতিজন প্রাপ্ত বয়স্কের জন্য মাসিক ২০০ আর বাচ্চাদের জন্য ১০০ দিনার দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে হাত খরচার জন্য, গ্রহণ করে বাধিত করবেন। সেই সময়, ১ লিবিয়ান দিনারের মূল্য ৪ ব্রিটিশ পাউন্ডেরও উপর। মানে, দিনারের উপর মুদ্রিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর মোখতারের ছবির দাম ছিল ব্রিটিশ পাউন্ডে অংকিত রানীমাতার ছবির চেয়ে তিনগুণেরও বেশি। যেখানে সব কিছুই ফ্রি সেখানে এই পরিমাণ হাত খরচা যথেষ্ট। হোটেলের অবসর জীবন, হাতে প্রচুর সময়। তাই মেয়েরাসহ যুগপৎ সিদ্ধান্ত নিলাম গ্রীনবুকের খণ্ড দু’টি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পড়ে নিতে হবে, সাথে নোটও নিতে হবে আলোচনার সুবিধার্থে। আলোচনাকালেই গাদ্দাফির মন-মানুশিকতা, রাজনৈতিক দর্শন, মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে তার মূল্যায়ন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আগ্রাসন, নিয়ন্ত্রণ, শোষণ থেকে তৃতীয় বিশ্বের জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম এবং মুক্তি বিশেষ করে মুসলিম জাহানের পশ্চাদপদ রাষ্ট্রসমূহ এবং জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে কিনা এ সমস্ত বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা করে নেয়া সম্ভব হবে।

সেই কালে কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা এবং আলজেরিয়ার বেন বেল্লাকে হত্যা করার পর এই তরুণ নেতার মধ্যেই বৈপ্লবিক ধ্যান ধারণার উপসর্গ পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ইরাকের সাদ্দাম হুসেনের তুলনায় মোয়াম্মর গাদ্দাফি ছিলেন Comparatively more radical. তার উপর মিসরের জামাল নাসেরের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। বাকিরা ছিল দ্বিমেরু কেন্দ্রিক কোনও না কোনও বলয়ের তল্পিবাহক। পুঁজিবাদী বলয়ের মোড়ল আমেরিকা, সমাজতান্ত্রিক বলয়ের মোড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন। গাদ্দাফির রাজনৈতিক দর্শন মূলত ছিল ‘ইসলামিক রাষ্ট্র এবং বৈপ্লবিক সমাজ ব্যবস্থা।’ বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি কর্তা আল্লাহ্‌ই সর্বশক্তিমান এবং সার্বভৌম। সৃষ্টিকর্তার নির্দিষ্ট জীবন বিধানই সর্বোত্তম দর্শন ইহকাল এবং পরকালের পরিপ্রেক্ষিতে। তার মতে, মানুষের পক্ষে সৃষ্টির জ্ঞান এবং চিন্তাশক্তি কখনই স্রষ্টার সমতুল্য হতে পারে না যুক্তিসঙ্গত ভাবেই। তার মতে, ধনতন্ত্র এবং মার্ক্সসীয় সমাজতন্ত্রের মধ্যে মূলত কোনও পার্থক্য নেই। কারণ, এই দুইটি দর্শনই প্রতিক্রিয়াশীল এবং বস্তুবাদ ভিত্তিক। সমাজতন্ত্রীরা নাস্তিক আর ধনতন্ত্রীরা পথভ্রষ্ট আস্তিক। তাদের সব চিন্তা-চেতনা খুবই সীমিত। ইহজাগতিক জীবনের রিপু ভিত্তিক চাহিদাই তাদের দর্শনের ভিত্তি। আত্মিক বিষয়ে তার এই দৃঢ়বিশ্বাস ছাড়া চেয়ারম্যান মাও-এর রেডবুক এবং গাদ্দাফির গ্রীনবুকের বর্ণিত আর্থ-সামাজিক, প্রগতিশীল রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, আইন বিভাগ, প্রশাসন, গণতান্ত্রিককেন্দ্রিকতার নীতি ভিত্তিক তৃণমূল পর্যন্ত প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকতার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, বিপ্লবী দল এবং কর্মীবাহিনী গঠন এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে একটি আধুনিক সুশৃঙ্খল সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশব্যাপী সমর্থ তরুণ-তরুণীদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের বিষয়ে তেমন কোন বিশেষ পার্থক্য ছিল না। সাম্যবাদের দর্শনে প্রতিটি নর ও নারীর যোগ্যতা এবং কর্মক্ষমতার বিচারে সমান পরিগণিত করা এবং ধনতান্ত্রিক দর্শনে বিশাল ব্যবধানের ব্যাখ্যা কিছুটা অস্বচ্ছ ভাবেই বর্ণিত হয়েছে গ্রীন বুকে। ধনতান্ত্রিক সমাজে মানুষকে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে প্রগতির নামে আর সাম্যবাদের বুলির আড়ালে মানুষকে পরিণত করা হয়েছে যন্ত্রে। এই ধরনের আদর্শিক কলুষতার সমালোচনা করা হয়েছে প্রচণ্ড ভাবে গ্রীনবুকে। প্রথম মহাযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সাইকস-পিকোট চুক্তির মাধ্যমে অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিশাল অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। তারপর নিজেদের স্বার্থে তারা পাল্টে দেয় মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র। সৃষ্টি করে ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল তেল ও গ্যাসের ভাণ্ডার নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য মূলত ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো একদিকে সৃষ্টি করে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইলকে, অন্যদিকে কয়েকটি আশ্রিত ছোট ও মাঝারি রাজ্যকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করে রাজতন্ত্র এবং আমীরতন্ত্র কায়েম করে তাদের তল্পিবাহক কিছু বেদুঈন গোত্রকে ক্ষমতায় বসিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ মজবুত করে তোলে। শুধু তাই নয়, সেই সমস্ত দেশগুলোতে ফিকরাবাজি উস্কে দিয়ে রাষ্ট্রগুলোকে দুর্বল করে ক্ষমতাসীনদের সম্পূর্ণভাবে তাদের উপর নির্ভরশীল করে রাখে। এরপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও পাকাপোক্ত করার জন্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে দ্বিখণ্ডিত করে ইসরাইল নামে একটি ধর্মভিত্তিক ইহুদী রাষ্ট্র কায়েম করে। পশ্চিমা শক্তির উপর নির্ভরশীল আঞ্চলিক রাষ্ট্রপতিরা এর বিরোধিতা না করে নীরবে ইসরাইলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়। এই বিষফোঁড়া সৃষ্টির একটি মাত্র কারণ ছিল গোপনে ইসরাইলকে পারমাণবিক শক্তিধর একটি রাষ্ট্রে পরিণত করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমাদের স্বার্থের অনুকূলে পদানত করে রাখা। আমেরিকাই ইসরাইলকে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেছিলো। ফিলিস্তিনি জনগণ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রায় এককভাবেই স্বাধীনতার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। গত শতকে ‘৪০, ‘৬০ ও ‘৭০-এর দশকে ইসরাইলের সাথে আরবদের তিনটি যুদ্ধ হয়। এরপরই মধ্যপ্রাচ্যের জনগোষ্ঠী বুঝতে পারে যতদিন ইসরাইল নামক বিষফোঁড়াকে উৎপাটন করা সম্ভব না হবে ততদিন এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আসবে না এবং এই অঞ্চলের বিশাল খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার পশ্চিমাদের কব্জা থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনাও সম্ভব হবে না। পারমাণবিক প্রযুক্তির অধিকারী তখন মাত্র ৪ টি দেশ। আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। পারমাণবিক প্রযুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশকেই দিতে অসম্মতি জানায় ৪ টি দেশই। গণচীনের নেতা চেয়ারম্যান মাও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পারমাণবিক প্রযুক্তি চেয়ে ব্যর্থ হবার পর সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসাবে আখ্যায়িত করেন এবং গণচীন ‘কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ থেকে বেরিয়ে আসার ফলে বিশ্বজোড়া কম্যুনিস্ট আন্দোলনও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।পরে ১৯৬৪ সালে চীন পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়। এদিকে ‘৭০ দশকের গোড়ায় পাকিস্তানের জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল, ইরানের রেজা শাহ পেহলভি এবং লিবিয়ার মোয়াম্মর গাদ্দাফিকে প্রস্তাব দেন যে প্রয়োজনীয় আর্থিক যোগান পেলে পাকিস্তান সারাবিশ্বের চোখে ধুলো দিয়ে মুসলিম জাহানের স্বার্থে পারমাণবিক প্রযুক্তি হাসিল করে ‘ইসলামিক বম্ব’ বানাতে সক্ষম। তার ঐ প্রস্তাবে তিনজনই আকৃষ্ট হন। তবে গাদ্দাফিই সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত হয়ে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর্থিক সহযোগিতা নিশ্চিতকরণের পরই পাকিস্তান গোপনে আণবিক বোমা তৈরির কর্মসূচি গ্রহণ করে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, অনেক আত্মত্যাগের পর পরিশেষে যখন চিরশত্রু ভারত পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সদম্ভে জানান দেয় যে ভারত একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ তখন জবাবে পাকিস্তানও সমস্ত পৃথিবীকে চমকে দিয়ে নিজেকে একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় সফল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। একই সাথে পাকিস্তান ঘোষণা করে, পাকিস্তান শুধু পারমাণবিক শক্তির অধিকারীই নয়, বিভিন্ন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রেরও অধিকারী। জনাব ভুট্টোর জাতীয় রাজনীতির সাফল্য এবং ব্যর্থতার বিষয়টি বিতর্কিত হলেও একটি সত্য মানতেই হবে- সেটা হল ‘ইসলামিক বম্ব’-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো। তবে অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, যে সমস্ত দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান একটি পারমাণবিক শক্তির অধিকারী রাষ্ট্র হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় তারা পরবর্তীকালে বিভিন্ন কাকতালীয় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। ভুট্টোকে ঝুলতে হয় ফাঁসিকাষ্ঠে, বাদশাহ ফয়সল নিজের দরবারে তার ভাতুষ্পুত্রের গুলিতে নিহত হন, শাহ পেহলভিকে করুণ ভাবে দেশান্তরিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়। সর্বশেষে, লিবিয়ার বিক্ষুব্ধ জনতা নৃশংসভাবে হত্যা করে মোয়াম্মর গাদ্দাফিকে। বিশ্ব মোড়লরা কখনোই এই ধরনের ধৃষ্টতা মাফ করে না পোষ্য পদলেহিদেরও। বিশ্বের আবিষ্কৃত এবং অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদের দুই তৃতীয়াংশই রয়েছে মুসলিম অধ্যুষিত অনুন্নত দেশগুলোর মাটির নিচে। সেক্ষেত্রে বিশ্ব এবং আঞ্চলিক মোড়লরা শংকিত হয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে পাকিস্তান নামক দেশটিকে ধ্বংস করার এক সুদূর প্রসারী নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। এই বাস্তবতার মোকাবেলা পাকিস্তান কি করে করবে সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। এক সময় সালেম জানিয়ে গেলেন দু’ একদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের চার্জ দ্য এফেয়ারস জমির, বাংলাদেশ সরকারের হুকুমে সস্ত্রীক ত্রিপলি থেকে আসছেন আমাদের সাথে দেখা করে খোঁজ-খবর নিতে। জমির এবং তার স্ত্রী আমার ও নিম্মির পূর্বপরিচিত হলেও তেমন কোনও ঘনিষ্ঠতা ছিল না। সালেম আরও জানালেন, আমাদের শিফটিং এর পরই দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে লিবিয়ার বিপ্লব, গাদ্দাফির নীতি-আদর্শের আলোকে কি করে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে Revolutionary Command Council-এর নেতৃত্বে এই সব বিষয়ে মত বিনিময় হবে। বাংলাদেশ সম্পর্কেও তারা বিস্তারিত জানতে চান। পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে বিশ্ব উম্মাহর সম্পর্ক বিশেষ করে ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ লিবিয়া এবং বাংলাদেশের মধ্যে কি করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত ভাবে গড়ে তোলা যায় সেই বিষয়টি আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। তাছাড়া, বাংলাদেশের বিপ্লবী ভাইরা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবছেন, সেই ব্যাপারেও লিবীয় নেতৃত্বের আগ্রহ রয়েছে যথেষ্ট। সালেমের বক্তব্যে যথেষ্ট আন্তরিক উষ্ণতা উপলব্ধি করলাম। গাদ্দাফি ইতিমধ্যেই শুধুমাত্র আরব কিংবা মুসলিম বিশ্বেই নয়, সারা দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, নিপীড়ন, একই সাথে রাজতন্ত্র এবং আমিরাত-তন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিপ্লবী হিসাবে পৃথিবীর প্রতি প্রান্তেই এক আলোচ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তার এই বৈপ্লবিক চরিত্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের এবং তাদের পদলেহী বাদশাহ, আমীর এবং রাষ্ট্রনায়কদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। জামাল নাসেরের ধ্যান-ধারণার চেয়ে গাদ্দাফির বৈপ্লবিক চেতনা শুধু মুসলিম জগতকেই যে প্রভাবিত করেছিল তাই নয়, তৃতীয় বিশ্বের চলমান জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতার সংগ্রামগুলোও তার পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্বার হয়ে উঠতে থাকে। এই কারণেই তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রচার মাধ্যম তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে অপপ্রচারণা চালাতে থাকে। বিশ্বমোড়ল এবং তার সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর সুতার টানে পরিচালিত বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর কাছে গাদ্দাফি হয়ে ওঠেন এক বিপদজনক চরমপন্থী সন্ত্রাসী, বিপরীতে বৈষম্যমূলক বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিশ্ব-বিপ্লবের একজন নির্ভীক প্রতীক।