নিউইয়র্কের পথে জেনারেল এরশাদের সাথে লন্ডনে সাক্ষা

ক্ষমতা দখলের কিছুদিন পর রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ নিউইয়র্ক এ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের পথে লন্ডনে যাত্রা বিরতিকালে আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। হাই কমিশনারকে নির্দেশ দেয়া হয় সব ব্যবস্থা পাকাপাকি করে রাখার জন্য। তিনিই ঠিক করলেন, যে দিন প্রেসিডেন্ট লন্ডন পৌঁছাবেন তার পরদিন সকালে হিলটনে তার স্যুইটেই প্রাতঃরাশে আমাকে যেতে হবে। কারণ, মিটিং-এর পরই তাকে রওনা হতে হবে নিউইয়র্কের উদ্দেশে।

নির্ধারিত দিনের দিবাগত রাতে প্রেসিডেন্ট এসে পৌঁছালেন লন্ডনে। পরদিন হাই কমিশনার সকালে গাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। পৌঁছালাম তার হোটেল স্যুইটে। ঢুকেই দেখি পায়জামা-পাঞ্জাবী পড়ে জায়নামাজে বসে তসবিহ হাতে ওজিফায় তন্ময় জেনারেল এরশাদ। সামনেই রাখা মাঝারি আকারের একটা কোরআন শরিফ। আমার রুমে প্রবেশের শব্দে উঠে দাড়িয়ে তসবিহ হাতেই এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণ সম্বর্ধনা জানালেন। এখানেই নাস্তা করতে করতে আমরা আলাপ করবো বলেই ADC-কে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে তিনি আমাকে নিয়ে বসলেন। বললেন চীন সফরকালে তুমি যা বলেছিলে সেটাই সত্যে পরিণত হল আল্লাহ্‌র অসীম করুণায়। মঞ্জুরের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশ পরিচালনার দায় আমার উপরই এসে পড়লো! স্যার, পড়লো না বলে আপনার বলা উচিৎ ছিল দায়-দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হল। তুমি হয়তো বা ঠিকই বলছো! তবে ক্ষমতার লোভে নয়, দেশের সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। যাক, বলো কেমন আছ তোমরা সবাই?

আল্লাহ্‌র অসীম কৃপায় বেঁচে আছি।

জিয়া দেশটাকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো। শুধু তাই নয়, তিনি তোমাদের উপরও অত্যন্ত অবিচার করেছেন। আমি দেশে ফিরেই এর প্রতিকার করবো ইন শা আল্লাহ্‌। তোমাদের সবাইকে চাকুরিতে পুনর্বহাল করবো বিগত দুই বছরের প্রাপ্য সব বেনিফিটস সহ।

স্যার, এই সংবাদটা জানাবার জন্যই কি আপনি আমাকে নাস্তা খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়ে সাতসকালে ডেকে পাঠিয়েছেন?

ঠিক তা নয়। তোমাদের চাকুরিতে পুনর্বহাল করাটা আমার নৈতিক দায়িত্ব, সেটা জানানোর জন্য তোমাকে ডেকে পাঠাইনি আমি। অতীতে তুমি আমাকে যেভাবে সাহায্য কোরেছ তার পটভূমিতে আগামীতেও আমার রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তোমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমাকে একই ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করবে সেই প্রত্যাশাটাই তোমাকে ডেকে পাঠানোর মুখ্য উদ্দেশ্য।

স্যার, আমরা সবাই ব্যক্তিগত সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। দেশ ও জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে নিজেদের উৎসর্গকরে দিয়েছি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্তের সাথে সাথেই। আমরা যেখানে যেই অবস্থাতেই থাকি না কেনো আমাদের বাঁচার প্রেরণা মাত্র একটাই।
‘৭১-এর চেতনা ভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। জিয়ার মতোই আপনি বাঙ্গালীহয়েওদেশও মাটির সাথে তেমনভাবে পরিচিত নন। তাই, অতি সহজ ভাবেই বলা চলে জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতি করা ছাড়া আপনার অন্য কোনও উপায় নেই। জিয়ার উপরে আপনার একটাই প্লাস পয়েন্ট রয়েছে। জেনারেল জিয়া বুঝেই হউক আর না বুঝেই হউক সামরিক বাহিনীতে যে বিভাজন নীতি অবলম্বন করে চলেছিলেন সেটা আপনার অনুসরণ করার প্রয়োজন আর নেই। মুঞ্জুরের হঠকারিতার সুযোগে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্বটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে। নীতি-আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতিতে যে সমস্ত সেনা সদস্যরা বিশ্বাস করতো তাদের শিকড় উপড়ে ফেলে দিয়েছিলেন প্রয়াত জেনারেল জিয়া। তাই বর্তমান সেনাবাহিনীকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে আপনার পক্ষে কষ্টকর হবে না। সুশৃঙ্খল অধীনস্থ সেনাবাহিনী আপনার জন্য হবে স্বস্তিকর। এ বিষয় আমাদের তেমন কিছু করণীয় নেই। রাজনীতির ক্ষেত্রেও আমাদের একসাথে কাজ করাটা কোনও পক্ষের জন্যই সম্ভব কিংবা লাভজনক হবে না। তবে দেশও জাতীয় স্বার্থে কোনও ক্রান্তিলগ্নে যদি কিছু করার থাকে সেটা অবশ্যই আমরা বিবেচনা কোরবো, তাতে যদি আপনি ব্যক্তিগত ভাবে লাভবান হন তার প্রতিদানে আপনার কাছ থেকে আমরা কিছুই চাইবো না। এবার আপনার দোষ-গুণ সম্পর্কে কিছু বলবো যেহেতু আপনি অস্ত্রের মুখে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছেন। এই অবস্থায় আপনাকে ব্যক্তিগত চারিত্র সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। চারিত্রিক দুর্বলতাগুলো পরিত্যাগ করতে পারলে ঐ দায়ভারটা কিছুটা কমতে পারে। আপনার সাথে আমাদের সম্পর্ক বজায় রাখাটাও সহজ হবে ভবিষ্যতে। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে চারিত্রিক ভাবে জনগণ আপনাকে সর্বদাই জেনারেল জিয়ার সাথেই তুলনা করবে। এবার রাজনীতি সম্পর্কে কয়েকটি কথা, স্যার। অবশ্যই।

রাজনৈতিক কোনও ফায়দার জন্য ধর্মীয় ব্যবসায়ীদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধবেন না, এরা শুধু ইসলামের শত্রুই নয়, দেশ ও জাতীয় শত্রুও বটে। সঠিক ইসলামিক মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনাই হওয়া উচিৎ আপনার আগামী দিনের রাজনীতির প্রেরণা এবং চালিকা শক্তি কিন্তু এইভাবে রাজনীতি আপনার পক্ষে আদও সম্ভব হবে কিনা সেটা আপনাকেই ভাবতে হবে। আমার পক্ষে ধারনা করা ঠিক হবে না। তবে অভিজ্ঞতা থেকে একটা দ্রুব সত্য কথা আমি বলবোই সেটা আপনার কাছে গ্রহণীয় না হলেও।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা, প্রগতি, অর্থনৈতিক সঙ্গতির প্রতি হুমকি হয়ে থাকবে প্রতিবেশি ভারত।স্বনির্ভর দেশ হিসাবে গড়ে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ভারত। যতদিন ভারতীয় ইউনিয়ন খণ্ডিত না হয়, ততদিন ভারত চাইবে না এই অঞ্চলের ছোট ছোট স্বাধীন দেশগুলো স্বনির্ভরতার উপর ভিত্তি করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাক। কারণ, তাতে ভারতীয় ইউনিয়নের খণ্ডিতকরণ ত্বরান্বিত হবে। এটাও প্রমাণিত হবে, চলমান বিভিন্ন জাতির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলে তারাও নিজেদের প্রগতিশীলএবং সমৃদ্ধশালী জাতি এবং রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষমহবে না। আগ্রাসী ভারতের হুমকির মোকাবেলায় ভারসাম্যতার প্রয়োজনেই আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল হতে হবে গণচীন কেন্দ্রিক, এই কথাটা আপনি ইতিমধ্যেই চৈনিক নেতৃবৃন্দকে বলে এসেছেন। তাই নয় কি স্যার?

আমার কথায় জেনারেল এরশাদ বুঝতে পারলেন গণচীনে তার গোপন বৈঠকে আলোচিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমি অবগত। আমার বিশ্বাস একটি টার্ম আপনি আওয়ামীলীগের সহযোগিতায় ক্ষমতা উপভোগ করতে পারবেন। তারপর আপনাকে হাসিনার পেটিকোটের নিচে বসিয়ে ভারত হাসিনাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। এর আগেই সম্ভব হলে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে আপনার অবসর নেয়ার সিদ্ধান্তই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। হাসিনার পেটিকোটের নিচে বসে ভারতের সেবাদাস হয়ে কাজ করে নিজেকে জাতীয় বেঈমান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাটা সঠিক হবে বলে আমি মনে করিনা। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে তো একদিন আপনাকেও যাচাই করা হবে।

এ ভাবেই শেষ হয়েছিল প্রাতঃরাশ বৈঠক। দেশে ফিরে প্রেসিডেন্ট এরশাদ তার কথামতো আমাদের সবাইকে আবার চাকুরিতে পুনর্নিয়োগ প্রদান করেন এবং আবার আমরা কূটনীতিক হিসেবে বিদেশে বিভিন্ন বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগদান করি।