ব্যাংকক ট্রানজিট লাউঞ্জে
ব্যাংকক এয়ারপোর্টে ট্রানজিট লাউঞ্জে রুমে বসে বই পড়ে সময় কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হল, থাইল্যান্ডের ডেপুটি ফরেন মিনিস্টার রাজপরিবারের সদস্য জনাব শ্রী কাসম শ্রী এবং তার স্ত্রীর সাথে কুশল বিনিময় করি। আমরা একসাথে পিকিং-এ ছিলাম। সেই সময় গণচীনে আমেরিকান এম্ব্যাসেডর ছিলেন সিনিয়র জর্জ বুশ, ব্রিটিশ এম্ব্যাসেডর ছিলেন স্যার এডওয়ার্ড ইয়্যুদ, ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন দাক্ষিণাত্যের একজন দার্শনিক গোছের চিন্তাবিদ। নামটা সঠিক মনে পরছে নয়া তবে রামা স্বামী ভেংকট রমন হতে পারে। এই ভদ্রলোক ছিলেন তামিল বংশোদ্ভূত নিম্নবর্ণের হিন্দু তবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, উদার প্রকৃতির লেখক, দার্শনিক এবং রাজনীতি বিশারদ। একবার চৈনিক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত বাৎসরিক ভ্রমণে আমরা প্রায় ১০/১২ দিন একসাথে কাটিয়েছিলাম। সেই সময় এই বিদ্বান মানুষটির সাথে ভারতের ইতিহাস, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি, জাতিগত সংঘাত, সংস্কৃতি, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা আলাপ-আলোচনার সুযোগ হয়েছিলো। এ ছাড়া ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিলো আমেরিকান দূতাবাসের Covered Job এ নিয়োজিত বিল গিলিল্যান্ড, ব্রিটিশ এমব্যাসির পলিটিকাল উইং-এর হেড রিচার্ড, পাকিস্তান এমব্যাসির মিলিটারি এটাচি গ্রুপ ক্যাপ্টেন সানি, এবং কূটনীতিক নিজামী ও বাসারত-এর সাথে। নিজামী পরে বাংলাদেশেও এসেছিলেন পোস্টেড হয়ে। আমরা সবাই ছিলাম টেনিস পাগল, তাই প্রতিদিন বিকেলে ডিপ্লোমেটিক ক্লাবে একত্রিত হতাম। খেলার সাথে চলতো সব রকম বিষয়েই আলাপ-আলোচনা। পরবর্তী পর্যায়ে জর্জ বুশ এবং ভেংকট রমন যার যার দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। স্যার এডওয়ার্ড ইয়্যুদ নিয়োগ প্রাপ্ত হন হংকং এর শেষ গভর্নর এবং একই সাথে ব্রিটিশ এবং চীন সরকারের মধ্যে হংকং-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার চীফ নেগোশিয়েটর হিসাবে। আমিও তখন হংকং-এই পোস্টেড ছিলাম।
লিজ শেষ হবার পর ইতিমধ্যেই ম্যাকাওকে পর্তুগিজ সরকার চীনকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কারণ, চীন লিজ বাড়াতে রাজি হয়নি। কিন্তু হংকং-এর বিষয়টি বেশ জটিল। ৯৯ বছরের লিজের আওতায় ব্রিটিশ এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা হংকং-এ গড়ে তোলে পুঁজিবাদী এক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। ফলে হংকং-এর বিত্তবান এবং সাধারণ চৈনিকদের মধ্যে কম্যুনিজম সম্পর্কে রয়েছে স্বাভাবিক, দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভয় ভীতি। এই ভয়-ভীতির অজুহাতে ব্রিটিশ সরকার চাচ্ছে, হয় লিজ বাড়িয়ে দেয়া হউক কিংবা হংকংকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হউক। এর দুটোর কোনটাই গণচীন সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের অবস্থান হচ্ছে, লিজ শেষে গণচীনের সার্বভৌমত্ব কায়েম করা হবে হংকং-এর উপর এবং সেখানে চালু করা হবে ‘One Country Two System’. এই দর-কষাকষির সময় ঘটে যায় ‘ফকল্যান্ড ওয়ার’।
ঐ যুদ্ধে আর্জেন্টিনা পরাজিত হয় ব্রিটেনের কাছে। এই অসম যুদ্ধে বিজয়িনী রানী এলিজাবেথ পিকিং সফরে এসেছিলেন শেষবারের মতো চেষ্টা করে দেখতে, আধুনিক গণচীনের রূপকার এবং শীর্ষ নেতা দেং শিয়াও পিং এবং অন্যদেরকে হংকং-এর বিষয়ে তাদের অবস্থান থেকে সরানো যায় কিনা সেই প্রচেষ্টায়। ‘গ্রেট হল অফ দি পিপলস’-এ বৈঠক বসেছে। একদিকে রানী ও তার সফর সঙ্গীরা অন্যদিকে দেং শিয়াও পিং এবং তার সাথীরা। বিজয়িনী রানী কিছুটা গর্বের সাথেই তার বক্তব্য শুরু করলেন। প্রায় একনাগাড়ে তিনি ২০-২৫ মিনিট বলে গেলেন। কিন্তু দেং শিয়াও পিং-এর কাছ থেকে তিনি কোনও প্রতিক্রিয়াই পেলেন না। তিনি তার অভ্যাস মতো একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকছিলেন। সার্বিক বিবেচনায় বিষয়টা কিছুটা একতরফা এবং দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছিলো বিধায় চৈনিক দোভাষী দেং শিয়াও পিং-এর কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে বলেছিল নেতা, আপনার কিছু বলা উচিত। এর জবাবে দেং দোভাষীকে বলেছিলেন
আমি কি বলবো? ইতিহাস সম্পর্কে মূর্খ মহিলা ভুল সবক দিচ্ছেন।
তাদের কথোপকথন রানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করায় পাশে বসা চীনা ভাষায় রপ্ত স্যার ইয়্যুদ থেকে তিনি জানতে চান, দোভাষী এবং দেং শিয়াও পিং-এর মধ্যে নিচু স্বরে কি কথা হচ্ছিলো। জবাবটা সেই মুহূর্তে চেপে যান স্যার ইয়্যুদ। যাই হোক, সেই একপেশে বৈঠক ও নৈশভোজের পর বিদায় লগ্নে রানী পুনরায় সেই প্রসঙ্গে স্যার ইয়্যুদের কাছে জানতে চাইলে, অনেকটা অনিচ্ছাকৃত ভাবেই স্যার ইয়্যুদ সত্য কথাটাই রানীকে বলেছিলেন। স্যার ইয়্যুদের বয়ান শুনে রানী নাকি সিঁড়িতেই ভিরমি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। কেউ একজন ধরে ফেলায় তিনি সেই যাত্রায় রক্ষে পান। একান্ত এক ডিনারে স্যার ইয়্যুদ নিজেই আমাকে এবং নিম্মিকে এই কাহিনীটি শুনিয়েছিলেন। দর-কষাকষির শেষপ্রান্তে একদিন সকালে অফিসে যাচ্ছি, হঠাৎ গাড়ীর রেডিওতে শুনলাম, কিছুক্ষণ আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন বন্ধুপ্রতিম গভর্নর স্যার ইয়্যুদ। অপ্রত্যাশিত খবরটা শুনেই মর্মাহত অবস্থায় ড্রাইভার মিস্টার চেনকে বললাম বাসায় ফিরে যেতে। সেখান থেকে নিম্মিকে সাথে নিয়ে গিয়ে পৌঁছালাম গভর্নর হাউসে। আমার গাড়ীটি গভর্নর হাউসের স্টাফদের কাছে বিশেষ ভাবে পরিচিত। কারণ প্রায়ই তিনি পুরনো বন্ধু হিসাবে আমাকে ডেকে পাঠাতেন কিংবা যুগলে আমাকে আর নিম্মিকে দাওয়াত করতেন।
ভেতরে পৌঁছে দেখি মিডিয়া থেকে আগত সাংবাদিক এবং ভাষ্যকারদের একটা জটলা। গাড়ী থেকে নামতেই এক তরুণী সাংবাদিক এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল তার জানা আছে, স্যার ইয়্যুদ পরিবারের সাথে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের কথা। তাই গভর্নর স্যার ইয়্যুদের আকস্মিক মৃত্যুতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কি? সংক্ষেপে জবাব দিলাম
গভর্নর স্যার ইয়্যুদের আকস্মিক মৃত্যুতে আমি এবং আমার স্ত্রী একজন আন্তরিক বন্ধুকে হারালাম! স্যার ইয়্যুদ দম্পতির বৈশিষ্ট্য হল তারা অকৃত্রিম, অমায়িক এবং আন্তরিকভাবে বন্ধুবৎসল। স্যার ইয়্যুদ ছিলেন একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন জ্ঞানী এবং ঝানু কূটনীতিক।
ভেতরে নিয়ে গেলো অতি পরিচিত কম্পত্রোলার। আমরা স্যার ইয়্যুদ পরিবারের ব্যক্তিগত বন্ধুই শুধু ছিলাম তা নয় আমি তখন হংকং এর ডিপ্লোম্যাটিক কোরের ডয়ানও বটে।
শোক বইতে সাক্ষর দান করে তার স্ত্রীকে সমবেদনা জানিয়ে ফিরে এলাম আমি ও নিম্মি।
ক্ষণিকের এই পার্থিব জীবনে অনেক সম্পর্কই গড়ে ওঠে কিন্তু তার বেশিরভাগই হারিয়ে যায়। তবে কিছু সম্পর্ক অম্লান হয়ে থাকে, স্যার ইয়্যুদ এবং লেডি ইয়্যুদ আমাদের জন্য ছিলেন তেমনই এক দম্পতি।
ফিরে চলি ব্যাংকক এয়ারপোর্টের ভি আই পি রুমে। বাসায় ফোন করতেই পেয়ে গেলাম শ্রী কাসম শ্রীকে। অনেকদিন পর অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার ফোন পেয়ে আনন্দিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছ তুমি? কোথা থেকে বলছো? ব্যাংকক এয়ারপোর্টের ভিআইপি রুম থেকে। কোথায় চলেছো? গণচীনের পথে,বর্তমান প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিশেষ দূত হিসাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে। এতো খুবই সুখবর! ওখানে পুরনো বন্ধুদের কারো সাথে দেখা হলে আমার শুভেচ্ছা জানিও। স্যার ইয়্যুদের আকস্মিক মৃত্যুর পর তোমার ছোট্ট একটি প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম TV-তে। যেভাবে তোমরা বেইজিং ত্যাগ করেছিলে, তাতে প্রথমে সবাই আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পরে সব জানার পর তোমাদের নিয়ে আমরা সবাই বিশেষ ভাবে চিন্তিত ছিলাম। সেনা অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আমরা মানে Common Friends রা তোমাদের নিয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। পরে তুমি হংকং এ পোস্টেড হয়ে আসাতে আমরা সবাই দুঃশ্চিন্তামুক্ত হই। কতদিনের সফর? অনেক দিন দেখা সাক্ষাত নেই। তাই অনুরোধ করছি, সম্ভব হলে ফেরার পথে দেখা করে গেলে আমরা খুবই খুশি হবো। দু’চারদিনের মধ্যেই ফিরে আসতে পারবো আশা করছি। আসার আগে আমাকে একটা ফোন করে দিয়ো। তাহলে এখানে আমার মেহমান হয়ে থাকার সব ব্যবস্থা করে রাখবো। আর পিচাইকে বলবো তোমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করার জন্য। সাথে নিম্মি আছে নাকি? না এক্সেলেন্সি, ওকে ঢাকায় রেখে এসেছি।No problem, there can always be a next time. Wish you all the best and success in your mission. Thanks a lot Your Excellency, do convey our warm regards and best of wishes to Madame. Its boarding time now, so must say good bye. বলেই ফোন রেখে দিলাম।