হংকং হয়ে বেইজিং

যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম হংকং, থাই-এরই একটি ফ্লাইটে। হংকং অতি পরিচিত শহর। পরদিন দুপুরের পর CAAC এর একটি ফ্লাইটে গুয়াংজুয়ো বুকিং দিলাম। পেনিনসুলায় গিয়ে উঠলাম।

কয়েক বছর হংকংএ ‘Doyen of the Diplomatic Corps’ হিসেবে কাটিয়ে গেছি বিধায় এখানকার সব কয়টি নামীদামী হোটেলের ম্যানেজমেন্ট-এর সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলাম। সুতরাং আগাম বুকিং ছারাও রুম পেতে অসুবিধে হল না। পেনিনসুর একটা লিমুজিন করেই কাইট্যাক বিমানবন্দর থেকে হোটেলে গিয়ে পৌঁছালাম। রুমে ঢুকেই শাওয়ার নিয়ে সটান বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সকালে উঠে প্রথমেই কমরেড লামকে ফোন করলাম। চৈনিক বন্ধুরাই হংকং-এর একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কমরেড লামের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। এরপর চলার পথে লামের সাথে পারিবারিক পর্যায়ে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লামকে ডেকে পাঠালাম হোটেলে। এরপর কয়েকজন পুরনো বন্ধু-বান্ধবীকে ফোন করলাম। সবাই দেখা করে পুরনো বন্ধুকে আপ্যায়ন করতে চায়। তাদের বললাম

আমি বিশেষ কাজে বেইজিং যাচ্ছি। ফেরার পথে লিন্ডাকে বলবো, Hong Kong Country Club -এ সব ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবীদের একটা Get-together-এর আয়োজন করতে। বেইজিং ছাড়ার আগেই লিন্ডাকে ফোনে আমি যোগাযোগ করে সুবিধে মতো দিনক্ষণ ঠিক করে দেবো। লিন্ডাই তোমাদের সাথে এই ব্যাপারে যোগাযোগ কোরবে। এতে সবাই একমত হল।

লিন্ডাকে ফোন করলাম। অনেক দিন পর হঠাৎ আমার ফোন পেয়ে কিছুটা অবাক হল লিন্ডা।

কখন এলে? গতরাতে। শোনো, আজ বিশেষ কাজে বেইজিং যাচ্ছি। বেইজিং থেকে ফোনে বিস্তারিত আলাপ করবো।ফিরতি পথে দেখা করতে চাই পুরনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবদের সাথে, বিশেষ করে তোমার সাথে। তোমাকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে প্রিয়ে! একটা জরুরী মিটিং আছে। তাই মন না চাইলেও ফোন রাখতে হচ্ছে।

আমি বেইজিং থেকে তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো। চমৎকার! বলে ফোন রেখে দিলাম। কথা শেষে অপেক্ষা করছিলাম লামের আগমনের। অল্পসময়ের মধ্যেই লাম এসে উপস্থিত হল।সংক্ষেপে তাকে আমার সফরের উদ্দেশ্য বয়ান করতেই লাম পরামর্শ দিলো ক্যান্টনে কমরেড লাই-এর সাথে ফোনে কথা বলতে। ফোন করলাম কমরেড লাইকে। তাকে বললাম, সময়ের অভাবে আগাম কোনও খবর না দিয়ে আজই বিকেলে পৌঁছাচ্ছি ক্যান্টন। লাম আমার পাশেই রয়েছে।

কোনও সমস্যা নেই, কমরেড উ স্বয়ং তোমাকে এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা জানাবে। লাম তোমাকে CAAC এর ফ্লাইটে বসিয়ে দেবে। তুমি লামকে ফোনটা দাও, আমি ওকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।

লাম কমরেড লাইকে আমার ফ্লাইট ডিটেলস জানিয়ে দিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে ফোন রেখে বললো

আমি তাহলে এখন যাই। সব ব্যবস্থা করে সময়মত তোমাকে হোটেল থেকে নিয়ে প্লেনে তুলে দিয়ে আসবো। তুমি তৈরি থেকো।  চলে গেলো বিদায় নিয়ে পুরনো বন্ধু কমরেড লাম। আমিও বেরুলাম টুকটাক কিছু কেনাকাটার জন্য। যথাসময়ে লাম এসে আমাকে নিয়ে গিয়ে প্লেনে তুলে দিয়ে বিদায় নিলো। সময়মত আকাশে উড়াল দিলো প্লেন।

গুওয়াংচাও (ক্যান্টন) পৌঁছার পর প্লেনের দরজা খুলতেই দেখি সহাস্য বদনে ভেতরে এসে ঢুকলো কমরেড উ ও সাথে তার দুই সহচর। সহাস্যে জড়িয়ে ধরে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে বললো

চলো।
আমরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা গাড়িতে করে VIP Room-এ এসে পৌঁছালাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই সব ফরমালিটিজ শেষ করে লাগেজ নিয়ে ফিরে এলো উর একজন সহকর্মী। আমরা বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্ট থেকে। একটা মারসিডিজ-৬০০ এ বসলাম আমি এবং উ। পেছনে আরেকটা একই রকমের গাড়িতে উঠে বসলো উ-র দুইজন সহকর্মী আমার লাগেজ নিয়ে।
উ বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্সিটিউট থেকে ইংরেজি ভাষায় দোভাষীর ডিগ্রী নিয়েছে। তাই Fluent in English both in speaking and writing. উচ্চপদস্থ নেতাদের সাথে বিদেশী নেতাদের মিটিং-এ কমরেড উ প্রায়ই দোভাষীর ভূমিকা পালন করে। অল্পক্ষণেই পৌঁছে গেলাম অতি পরিচিত স্টেট গেস্টহাউসে। সেখানে কমরেড ইউ ই এবং কমরেড লাই আমাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বেশ অনেকদিন পর পুরানো বন্ধুদের মিলন মেলা। কমরেড মা’কে দেখতে না পেয়ে কিছুটা বিস্মিত হয়ে লাইকে জিজ্ঞেস করলাম কমরেড মা কোথায়? জবাব দিলো পরম বন্ধু ইউ ই

কমরেড মা বর্তমানে কম্যুনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ কমিটির মেম্বর পদে নির্বাচিত হয়ে বেইজিং-এ চলে গেছেন। খুবই খুশি হলাম সুখবরটা শুনে। রাতের খাবারের পর সবাই বসলাম আলোচনায়। এবারের সফরের উদ্দেশ্য এবং এজেন্ডা সম্পর্কে সবকিছু খুলে বললাম। এজেন্ডাটা কামাল সিদ্দিকিই খালেদা জিয়ার সাথে আলাপ করে চূড়ান্ত করে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলো আসার আগে। সব শুনে কমরেড ইউ ই এবং কমরেড লাই অভিমত প্রকাশ করলো আগামীকাল কমরেড উকে সাথে করে আমাকে বেইজিং যেতে হবে। সেখানে কমরেড মা আমাকে জানাবেন কোন পথে এগুতে হবে এবং তিনি স্বয়ং সচেষ্ট থাকবেন যাতে আমার সফর ফলপ্রসূ হয়। আমরা আজই তাকে তোমার আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সব জানিয়ে দেবো।তুমি উ কে সঙ্গে করে আগামীকাল সকালে বেইজিং পৌঁছাচ্ছো। এরপর উ বলল তুমি একটু বিশ্রাম করো। আমরা ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসছি। বুঝতে পারলাম কমরেড মা’র সাথে আলাপ করে সব ব্যবস্থা করার জন্য তারা চলে যেতে চাচ্ছে।

গণচীনের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সাথে আমি দীর্ঘদিন যাবত অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশা করে আসছি। পুরো জাতির চারিত্রিক গুণাবলির মধ্যে যেগুলো আমাকে বিশেষভাবে অভিভূত করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তাদের শৃঙ্খলাবোধ, আন্তরিকতা, একাগ্রতা, কর্মনিষ্ঠা, সময়জ্ঞান এবং বন্ধু-বাৎসল্য। প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে, ‘চৈনিকদের বন্ধু হওয়া খুবই কষ্টসাধ্য, কিন্তু কাউকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করলে চৈনিকরা সেই বন্ধুত্বকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বজায় রাখার চেষ্টা করে থাকে।’ আমার বিশ্বাস, এই চারিত্রিক গুণাবলী ছাড়া কোনও জাতিই আত্মমর্যাদা বজায় রেখে প্রগতির পথে এগুতে পারে না। কমরেডরা সবাই ফিরে এলো। লাই বললো

সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কমরেড মা নিজে তোমাকে বেইজিং-এ অভ্যর্থনা জানাতে এয়ারপোর্টে আসবেন। আমরা মনে করি এই যাত্রা তোমার শুভ এবং সার্থক হবে। কারণ কমরেড মা’র বিশেষ বন্ধু ও অতিথি হিসাবেই এবার তুমি বেইজিং যাচ্ছো। কথাচ্ছলে লাই জানতে চাইলো তোমার অনুরোধে আমরা তোমার বন্ধু ডঃ কামাল সিদ্দিকি এবং তার পরিবারের জন্য একটা ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিলাম পিকিং দূতাবাসে তার চাকুরি শেষে দেশে ফেরার আগে। ও কেমন আছে?

কামাল ও তার পরিবার অত্যন্ত খুশি হয়েছিল তোমাদের আয়োজিত সেই বিলাসবহুল ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে। ওতো এখন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব। মানে সরকারের মধ্যে সবচাইতে ক্ষমতাধর আমলা। আসার আগে ও আমাকে বিশেষ ভাবে নুরোধ করেছে যাতে আমি ওদের তরফ থেকে আবারও তোমাদের সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। তাই নাকি? এত খুবই সুখবর! হংকং এ আমার সাথে ৩ বছর দূতাবাসে প্রথম সচিব হিসাবে কাজ করা অফিসার সাব্বিহউদ্দিন এখন খালেদা জিয়ার পিএস।
এতো দেখছি অদ্ভুত সংযোগ! বলে উঠল উ। কমরেড উ সাব্বিকে হংকং মিশনে দেখেছে, কথাবার্তাও হয়েছে উর সাথে। তবে উর আসল পরিচয়টি জানতে পারেনি সাব্বি। সাব্বি জানতো, উ ছিল আমার ব্যক্তিগত বন্ধু, হংকং-এর একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। লামের পরিচয়টাও ছিল একজন ব্যবসায়ী বন্ধু হিসেবে। বন্ধুরা সবাই কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল কেনও আমি নিম্মি এবং সস্তিকে সাথে আনিনি। আমি বন্ধুদের বুঝিয়ে বলেছিলাম, এবারের সফরটা গোপন রাখা হয়েছে আমার অনুরোধেই। সে জন্য তাদের ঢাকাতেই রেখে আসতে হয়েছে।

পরদিন সময় মতো বন্ধুরা আমাদের প্লেনে তুলে দিলো। আমি ও উ বেইজিং এর উদ্দেশে আকাশে উড়লাম। আমরা বেইজিং পৌঁছে গেলাম। কমরেড মা ও তার সাথীরা প্লেন থেকে আমাদের উষ্ণ আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গেল ভি আই পি রুমে। বিদ্যুৎ গতিতে সব ফর্মালিটিজ শেষ করে আমরা বেরিয়ে এলাম। নতুন বিশাল অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক মানের এয়ারপোর্ট দেখে হতবাক হলাম! যাত্রা পথে রাস্তাঘাট এবং মহাসড়কের ব্যাপকতা এবং দুই পাশের আধুনিক আকাশচুম্বী দালানকোঠা আমাকে বিস্মিত করল। আমার জানা পুরানো শহর বেইজিংকে চিনতেই পারছিলাম না। আমাদের কাফেলা স্টেট গেস্টহাউসের একটি অট্টালিকার সামনে এসে থামলো। এই অভিজাত ঐতিহ্যবাহী এলাকাটাতে তেমন কোনও পরিবর্তন করা হয়নি। সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্যই এই এলাকাটাকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যেমন ছিল ঠিক তেমনই রাখা হয়েছে। সেখানে পরিচারক-পরিচারিকারা সবাই আমাদের আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল। পৌঁছানো মাত্র তারা সব মালপত্র নিয়ে গেলো। কমরেড মা আমাকে আর উ কে একটা বসার ঘরে নিয়ে গেলেন।

বলো বন্ধু, তুমি কেমন আছো? নিম্মি এবং সস্তি কেমন আছে? ওদের নিয়ে না আসার যুক্তিসঙ্গত কারণটা লাই জানিয়েছে। অনেকদিন ওদের এখানে আসা হয়নি। তাই যখনই সম্ভব হবে তাদের নিয়ে একবার ঘুরে যাবে সেটাই প্রত্যাশা করবো।
নিশ্চয়ই নিয়ে আসবো।

সব কিছুই লাই এবং ইউ ই আমাকে বুঝিয়ে বলেছে। তাই তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। তুমি শুধু লিখিত এজেন্ডাটা দাও। আমি নোট ভারবাল আর এজেন্ডাটার লেফাফাটা মা’র হাতে তুলে দিয়ে বললাম

বন্ধু, তোমাদের সিদ্ধান্ত যাই হউক না কেনও, সেটা যত সত্বর সম্ভব আমি জেনে ফিরে যেতে চাই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে চৈনিক রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সফরের আবেদন জানিয়ে আশাপ্রদ সাড়া না পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত অনুরোধেই আমাকে আসতে হয়েছে অনেকটা অপারগ হয়েই। বন্ধু ডঃ কামাল সিদ্দিকি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব। আমার বিশ্বাস কামালই প্রধানমন্ত্রীকে বলে থাকবে যদি তিনি আমাকে রাজি করিয়ে তার বিশেষ দূত হিসাবে চীনে পাঠাতে পারেন তবে রাষ্ট্রীয় সফরের ব্যবস্থাটা হলেও হতে পারে। এখন সবকিছুই তোমাদের হাতে। বিষয়টি কিছুটা বিব্রতকর। ঠিক যেমনটি হয়েছিল জিয়ার সময়। তাকে তোমরা বাঁচিয়েছিলে CMLA হিসাবেই চীন সফরে আমন্ত্রণ করে। এবার তারই স্ত্রীকে সম্ভব হলে বাঁচাতে হবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিমন্ত্রণ করে যাতে তাকে ভারত যাত্রা দিয়ে বিদেশ ভ্রমণ শুরু করতে না হয়।

জানিনা সব বিবেচনায় এত অল্প সময়ে তাকে নিমন্ত্রণ জানানো সম্ভব হবে কিনা। তবে কমরেড, আমার মনে হয় খালেদার বর্তমান সমস্যাটার একটা ইতিবাচক সমাধান করা যদি সম্ভব হয় তবে এই বিষয়টি বাংলাদেশ গণচীন সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে অবশ্যই একটা সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলবে। স্মিত হেসে বন্ধু মা বলল তুমি আমাদের বিশ্বস্ত পরীক্ষিত বন্ধু। তোমার উপস্থাপনা সর্বপর্যায়ে অবশ্যই গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হবে এই বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আগামী কাল সকাল ১১ টায় তোমার সাথে সাক্ষাত করবেন কমরেড শু শিং। তিনি একই সাথে সেন্ট্রাল কমিটি এবং মিলিটারি কমিশন-এর সদস্য। বর্তমানে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ এবং Foreign Relation Department of PLA এর নেতৃত্বও দিচ্ছেন তিনি। আমি নোট ভারবাল আর এজেন্ডাটা নিয়ে যাচ্ছি।সময়ের স্বল্পতার কারণে চেষ্টা করবো কমরেড শু শিং-ই যাতে সাক্ষাতের সময় তোমাকে সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দিতে পারেন।

তিনি মিটিং-এর পর তোমাকে এক মধ্যাহ্ন প্রীতিভোজে আপ্যায়ন করবেন। সব পাট চুকিয়ে কালই তুমি যাতে গুওয়াংচাও ফিরে যেতে পারো সেই চেষ্টাই আন্তরিকভাবে করা হবে সর্বস্তরে। আমাকে বিশ্রাম করার পরামর্শ দিয়ে যেতে যেতে কমরেড মা বললেন, আগামীকাল তোমার এক পুরনো বন্ধু আসবে দেখা করতে। সে কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ঘুরে এসেছে। আরও কয়েকজন পুরানো বন্ধু প্রীতিভোজে আমন্ত্রিত হয়ে আসবেন তাদের প্রিয় বন্ধু জনাব হকের সাথে দেখা করতে।

চলে গেলেন কমরেড মা কমরেড উ কে সাথে নিয়ে।আমিও রাতের খাবার খেয়ে বিছানা নিলাম। একজন পরিচারিকাকে অনুরোধ জানালাম যাতে আমাকে সকাল ৭ টায় জাগিয়ে দেয়া হয়। কঠিন থেকে কঠিনতর সমস্যার নিরসনের গৃহীত সিদ্ধান্ত ত্বরিতগতিতে কার্যকর করার উপযুক্ত ব্যবস্থাও এই বিশাল দেশ জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে যা শুধু বিস্ময়করই নয়, অভাবনীয়ও বটে। অবাক হতে হয় প্রশাসনের দক্ষতা এবং স্বচ্ছতা দেখে। এখানে লালফিতার দৌরাত্মের বালাই নেই, যেমনটি তৃতীয় বিশ্বে তো বটেই উন্নত দেশগুলোতেও পরিলক্ষিত হয়। এখানে পদভারে বোঝা যায় না শক্তির পরিমাপ। তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু কোথায়, কারা প্রকৃত অর্থে ক্ষমতাবান- সেটা এক কুহেলিকা যার রহস্য আজঅব্দি ভেদ করা সম্ভব হয়নি কারো পক্ষে।
ঐতিহাসিক তিয়ান আন মেন স্কোয়ারের ঘটনার সময় আমি হংকং-এ। মূলত হংকং থেকেই আমেরিকা, ব্রিটিশসহ তাদের সহযোগী পশ্চিমা শক্তিগুলো একযোগে বহু সময় ধরে প্রচুর টাকাকড়ি খরচ করে গণচীনের ভেতরে শহর ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠিত করে মানবাধিকার এবং অবাধ গণতন্ত্রের দাবিতে প্রায় হাজার পনেরো-বিশেক তরুণ-তরুণীকে সমবেত করে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শানবাধানো স্কোয়ার ‘তিয়ান আন মেন স্কোয়ার’-এ এক বিক্ষোভ ধর্মঘটের আদলে। এই ধর্মঘটে চীনের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতা-নেত্রীর সন্তান-সন্ততিও অংশগ্রহণ করেছিল। প্রথমে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের স্কোয়ার ছেড়ে চলে যাবার আবেদন জানানো হয় সময় বেধে দিয়ে। সরকারী সেই সিদ্ধান্তে কর্ণপাত না করায় বেধে দেয়া সময় শেষে একরাতে প্রায় বারো হাজার অবাধ্য তরুণ-তরুণীকে মেরে ফেলা হয় এক ঝটিকা অপারেশন চালিয়ে রাজধানীতে অরাজকতা সৃষ্টির দায়ে।
যেমনটি করেছিলেন সিঙ্গাপুরের বিপ্লবী নেতা লি কুয়ান ইউ স্বাধীন সিঙ্গাপুরের ক্ষমতা গ্রহণের পর যখন উপনিবেশবাদী পরাজিত ব্রিটিশ সরকার সিঙ্গাপুরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে এক রক্তাক্ত নৃতাত্ত্বিক দাঙ্গা বাধিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা লি কুয়ান ইউ কঠোর হস্তে এক রাতে সেই দাঙ্গার সাথে জড়িত প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি দাঙ্গাকারীকে নিধন করে সিঙ্গাপুরের স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছিলেন। দাঙ্গা বন্ধ করে তিনি ঘোষণা দেন, স্বাধীন সিঙ্গাপুরে প্রতিটি নাগরিকের একমাত্র পরিচয় হবে সিঙ্গাপুরী, অন্য কিছু নয়। যারা এটা মেনে নিতে পারবে না তাদের ৪৮ ঘণ্টা সময় দেয়া হল সিঙ্গাপুর ত্যাগ করার জন্য। এরপরও চক্রান্তকারীদের কেউ যদি থেকে যাবার চেষ্টা করে তবে তাদেরকেও একই ভাবে সমূলে উৎপাটন করা হবে। এ ধরনের দৃঢ়চেতা সাহসী নেতৃত্ব ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের কোনও দেশের পক্ষেই প্রগতি এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ঘটনার পর দিনই বেইজিংসহ সারা দেশে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। গণচীনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার এই ব্যর্থ অপচেষ্টার পর একদিন আমি আমেরিকার একজন বিশিষ্ট চিন্তাবীদ এবং নীতি নির্ধারক মহলে একজন প্রতিষ্ঠিত চীনা বিশারদ হিসাবে স্বীকৃত বন্ধুবর বার্ট লেভিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম দীর্ঘদিন ধরে অনেক টাকা খরচ করে এবং গোপন তৎপরতা চালিয়ে অসন্তোষের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হল তিয়ান আন মেন স্কোয়ারে বিক্ষোভকারীদের জমায়েত করে। কিন্তু এক রাতেই সেই বিক্ষোভকারীদের কঠোর হস্তে দমন করে পরদিন থেকেই সারাদেশের জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক করে তুলতে সমর্থ হলো চৈনিক নেতৃবৃন্দ। শুধু তাই নয়, বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতায় তৈরি করা চিহ্নিত নাটের গুরু এবং ক্রিয়ানকদের তাদের বিদেশী প্রভুদের হাতে তুলে দিয়ে তাদের নিয়ে যেতে বাধ্য করা হল অতি অনায়াসেই! সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একটা পরাশক্তিকে তোমরা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিতে সক্ষম হলে, কিন্তু তার চেয়ে অনেক কম শক্তিধর চীনের ক্ষেত্রে প্রায় সব চালই ব্যর্থ হচ্ছ কেনও? এর মূল কারণটা কি বলো তো বন্ধু?
বার্ট লেভিন জবাবে বলেছিলো

আজঅব্দি চীনে একজন গর্বাচভ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। গণচীনের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলয়, পিএলএ এবং পার্টির সংগঠনে ক্ষমতার স্তম্ভগুলো এতোই সুরক্ষিত যে সেই লৌহকঠিন বর্ম ভেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। আগামী কাল কমরেড শু শিং বৈঠকে আমাকে চীন সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন, অথচ আমার নিজের দেশে সামান্য কোনও বিষয়েও সময় মতো সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না কোনও পর্যায়েই। এর প্রধান কারণ ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রণীত রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা কোনও স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য কার্যকর হতে পারে না। এই ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছিল ঔপনিবেশিক দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার্থে, দাসদের প্রগতি কিংবা আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির জন্য নয়। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো ধ্বসে পড়ে তখন ওই সমস্ত অপশক্তি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশিরভাগ উপনিবেশকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। বোঝাপড়ার মাধ্যমে সামন্তবাদের অবশেষ এবং মুৎসুদ্দি শ্রেণীর সমন্বয়ে তাদেরই গড়ে তোলা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীকে বসিয়ে দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তারা ঔপনিবেশিক প্রভুদের বরকন্দাজ হয়ে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে প্রভুদের সুতোর টানেই দেশ শাসন করে চলেছে স্বাধীনতার পরও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, আইন বিভাগ, প্রশাসনিক যন্ত্র, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা এবং জাতীয় রাজনীতি নিজেদের মুঠোয় কুক্ষিগত করে। যার ফলে, বেশির ভাগ সদ্য স্বাধীন দেশগুলোতে বদলায়নি কিছুই, বদলিয়েছে শুধু শোষক এবং শাসকগোষ্ঠীর খোলস। সাদা সাহেবদের জায়গাতে আসীন হয়েছে তাদেরই লালিত পালিত ব্রাউন সাহেবরা। এই পরভৃত শ্রেণি প্রয়োজন মতো কখনো স্বৈরশাসন কখনো গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাদের হাতেই ধরে রাখছে জনস্বার্থের বিরুদ্ধে। জনগণের ১-২ শতাংশ এই শ্রেণিই নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্র ও সমাজ। কব্জা করে নিয়েছে জাতীয় সম্পদের ৮০ শতাংশের উপর। জনশক্তির ৯৮-৯৯ শতাংশ মূলত ঐ ১-২ শতাংশের অপশাসন এবং শোষণের স্টিম রোলারের নিচে পিষ্ট দাসে পরিণত হয়ে আছে। তাদের জন্য স্বাধীনতার মানে হচ্ছে একটি জাতীয় পতাকা এবং একটি জাতীয় সঙ্গীত। তৃতীয় বিশ্বের এই ধরনের তথাকথিত স্বাধীন দেশগুলোর বাস্তবতা বর্ণনা করতে গিয়ে মুক্তিকামী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন-অনুন্নত এবং পশ্চাদপদ বেশিরভাগ তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোতে তিনি শুধু রাজনীতিবিদই দেখতে পান, কিন্তু নেতা দেখতে পান না। তার এই মন্তব্য শুনে সাংবাদিকরা তাকে রাজনীতিবিদ এবং নেতার মধ্যে পার্থক্য কি তার ব্যাখ্যা জানতে চাইলেম্যান্ডেলা বলেছিলেন রাজনীতিবিদরা শুধুমাত্র নিজেদের কায়েমী স্বার্থের খাতিরেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হতে আগ্রহী। ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক অবকাঠামো বজায় রেখে তারা শুধু নিজেদের কায়েমী স্বার্থ বৃদ্ধি করায় ব্রতী হয়। তাদের দৃষ্টির পরিসীমা শুধুমাত্র নির্বাচন অব্দি। আর নেতারা হচ্ছে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এমন ব্যক্তিবর্গ যাদের রয়েছে দেশের জনগণের প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পর্যায়ক্রমে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কোনও লক্ষে পৌঁছানো হবে সে সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা। একইসাথে সেই লক্ষে পৌঁছানোর জন্য যে পথকেই বাস্তবতার নিরিখে সর্ব-উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হবে, সেই পথে এগিয়ে চলার মতো দৃঢ় প্রত্যয়, সাহস এবং আপোষহীন কমিটমেন্ট থাকবে তাদের। বর্তমান আর আগামী প্রজন্মের সাহসী মুক্তিযোদ্ধা যারা জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে দেশ এবং জাতিকে পংকিল চোরাবালিতে নিমজ্জিত অবস্থা থেকে উদ্ধার করার সংগ্রামে ব্রতী তাদের জন্য নেলসন ম্যান্ডেলার এই অভিমত সঠিক পথের সন্ধানে আলোকবর্তিকা হিসাবে কাজ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। অভিজ্ঞ এই বর্ষীয়ান নেতার বক্তব্যের আলোকে বলা চলে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় বেশিরভাগ অনুন্নত দেশগুলোর প্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে সে সমস্ত দেশের ঘুণেধরা ক্ষয়িষ্ণু রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা যাকে বলা হয়ে থাকে ‘Status Quo’. প্রকৃত স্বাধীনতা এবং স্বনির্ভর উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য বর্তমান ব্যবস্থার ত্বরিত আমূল পরিবর্তন করে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে গড়ে তুলতে হবে দেশবাসীর প্রত্যাশার নিরিখে যুগোপযোগী নতুন এক প্রগতিশীল রাষ্ট্রীয়, আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এ ধরনের পদক্ষেপকে যদি বিপ্লব বলা হয় তবে তাতে সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু এ ধরনের আমূল পরিবর্তন ছাড়া বিদেশীদের দ্বারা সৃষ্ট কায়েমী স্বার্থবাদী ক্ষমতাধর ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাত থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুক্তির কোনও সম্ভাবনাই নেই। তাছাড়া বৃহত্তর জনগণের মেধা, সৃজনশীল কর্মক্ষমতা এবং পেশাগত দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবার সমসুযোগ যেই সমাজে অবর্তমান সেই সমাজ কখনোই প্রগতির পথে এগুতে পারে না। সেই জাতির ভাগ্যোন্নয়নও সম্ভব নয়।
অনেক রাজনৈতিক নেতা প্রচলিত ‘Status Quo’ বজায় রেখে Evolutionary Process-এর মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে প্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা প্রচার করে থাকেন। এমন প্রচারণা বিভ্রান্তিকর এবং অযৌক্তিক। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই বহন করে।

পৃথিবীর সব জাতিরই রয়েছে নিজস্ব জীবন ধারা, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, আশা এবং আকাঙ্ক্ষার উপর গড়ে ওঠা পৃথক পরিচিতি। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ধার করে আনা কোনও দর্শন বলপূর্বক কোনও জাতির উপর চাপিয়ে দিলে সেটা কখনোই সুফল বয়ে আনতে পারে না বরং এ ধরণের প্রচেষ্টা হয়ে ওঠে আত্মঘাতী। একমাত্র নিজস্ব মূল্যবোধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সম্পদ এবং জনগণের মেধা ও সৃজনশীল কর্মক্ষমতার উপর নির্ভর করেই গড়ে তোলা সম্ভব একটি আত্মনির্ভরশীল স্বাধীন রাষ্ট্র আর আত্মমর্যাদাশীল গর্বিত জাতি।কমরেড শু শিং একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি হলেও খালেদা জিয়ার সফর সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের পেছনে আরো অদৃশ্য শক্তিধর নীতি নির্ধারকরা রয়েছেন সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তরের চৈনিক নেতৃবৃন্দের সাথে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা আমাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে। এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে বেড সাইড টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে ওঠায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। অপরপ্রান্ত থেকে মিষ্টি গলায় এক তরুণী জানালো, সকাল ৭ টা বাজে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম নির্ধারিত সময়েই জাগিয়ে তোলা হয়েছে। বেড টি নিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো এক সুদর্শনা তরুণী। টেবিলের উপর সযত্নে ট্রে টা রেখে বললো স্যার, আপনার বেড টি, ভালো ঘুম হয়েছে তো? কয় চামচ চিনি জেনে নিয়ে চা বানাতে বানাতে মেয়েটি জানতে চাইলো নাস্তা কখন নিয়ে আসবে। বললাম, ৯ টায়। চলে গেলো মৃদু হেসে প্রিয়দর্শিনী পরিচারিকা। বেড টি শেষে প্রাতঃক্রিয়া সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। টেবিলের উপর থেকে দৈনিক পিপলস ডেইলিটা তুলে চোখ বুলাচ্ছিলাম। ঠিক ৯ টায় তরুণী নাস্তার ট্রলি নিয়ে ঘরে ঢুকলো এবং নাস্তা পরিবেশন করলো। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে আস্তে ধীরে নাস্তা পর্ব শেষ করলাম। ঠিক পৌনে ১১ টায় এলো কমরেড উ। কুশলাদি বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করলো, ঘুম ভালো হয়েছে কিনা। জানতে চাইলো অন্য কোনও অসুবিধে হয়েছে কিনা। জবাবে বললাম
যেই রাজকীয় অবস্থায় রেখেছো তাতে কোনও অসুবিধে হবার কারণ থাকতে পারে কি? আরামের সাথে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে ফ্রেশ হয়ে উঠেছি। আমার রসিকতায় হেসে উঠল পুরনো বন্ধু উ। আমাকে মিটিং রুমে নিয়ে গিয়ে উ জানালো, মিটিং-এ শুধুমাত্র কমরেড শু শিং এবং কমরেড মা থাকবেন। সে থাকবে দোভাষী হিসাবে।

ঠিক ১১ টায় উপস্থিত হলেন কমরেড শু শিং কমরেড মাকে সঙ্গে নিয়ে। ঘরে ঢুকে বন্ধুবর মা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় পর্বের শেষে কমরেড শু শিং আমাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে বললেন

আমাদের পরীক্ষিত বন্ধুকে চৈনিক নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে স্বাগতম জানাচ্ছি। আপনার সাথে আগে দেখা না হলেও আপনি আমার কাছে অপরিচিত নন। তার এই ছোট্ট মন্তব্যটা অর্থবহ। এরপর আমরা নিজেদের নির্ধারিত আসনে বসলাম। মিটিং শুরু হল। পুরনো বিশ্বস্ত বন্ধু হিসাবে আমাদের আলোচনা হবে খোলাখুলিভাবে কোনও রাখঢাক না রেখেই, এতে আপনার কোনও আপত্তি নেইতো?

এক্সেলেন্সি, আপনার এই ধরনের প্রস্তাবনা শুধু প্রশংসনীয়ই নয়, হৃদয়স্পর্শীও বটে। আপনার এবারের সফরের লক্ষ এবং এজেন্ডা নিয়ে যথাযথ আলোচনার পর চীন সরকারের সিদ্ধান্তটা আপনাকে জানিয়ে দেবার দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে। সেটা জানানোর আগে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছু কথা আমি বলতে চাই।

চীন-বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে সুপ্রাচীন। বহু যুগ আগে শ্রী অতীশ দীপংকর নামের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রাচীন বঙ্গ থেকে চীনে এসে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু করেন। এই ধর্মের বাণীকে গ্রহণ করে লক্ষকোটি চীনাবাসী। এরপর ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ২৯ জন ধর্ম প্রচারককে চীনে পাঠিয়েছিলেন হযরত শাহজালাল(রঃ) আদিবঙ্গ থেকেই। ইসলাম ধর্মের জীবন দর্শন এবং মূল্যবোধে আকৃষ্ট হয়ে এদেশের কোটি কোটি মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে মুসলমান হয়েছিলো। আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪০ কোটিরও বেশি চীনের বিভিন্ন প্রদেশের নারী-পুরুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলো। শ্রী অতীশ দীপংকরের দেহাবশেষ অতি শ্রদ্ধার সাথেই তিব্বতের পোতলা প্যালেস-এ সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। বর্তমানের বাংলাদেশকে গণচীন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫-এর সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরই স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর বাংলাদেশের সরকারের অনুরোধে জেনারেল জিয়ার শাসনকালে সেই সংরক্ষিত দেহাবশেষ বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এই বিষয়ে আপনিও অবদান রেখেছেন। ২৯ জন মুসলিম প্রচারকের সমাধিগুলো ক্যান্টনের মসজিদের পরিসীমার মধ্যে সুরক্ষিত রয়েছে সেটা আপনি স্বচক্ষে পরিদর্শন করেছেন। বেইজিং-এ অবস্থান কালে আপনার উদ্দগে বেইজিং-এ অবস্থিত সব মুসলিম দেশগুলোর দূতাবাসের কূটনীতিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল চৈনিক কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করে প্রস্তাব করেছিলেন, বেইজিং-এর জামে মসজিদসহ দেশের সব মসজিদে নামাজ আদায়ের অনুমতি প্রদান এবং নামাজের জন্য আজান দেবার রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে। আপনাদের সেই প্রস্তাব গণচীন সরকার মেনে নিয়ে সবরকম কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল আপনার বেইজিং এ থাকাকালীন সময়েই। এই মহৎ উদ্দগের পেছনে আপনার ব্যক্তিগত অবদান কতটুকু সেটাও আমাদের অজানা নয়। প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেবার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করে গণচীন।

যথা, একে অপরের প্রতি সমতা ভিত্তিক আচরণ, ধর্মীয় বিশাস, মূল্যবোধ, জীবনধারা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। এ ছাড়াও বন্ধুত্বের সম্পর্ককে দৃঢ় ভিত্তির উপর গড়ে তোলার জন্য তিন পর্যায়ে বন্ধুত্বের শেকড় প্রোথিত করা অত্যন্ত আবশ্যকীয়।
প্রথমতঃ জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ক। দ্বিতীয়তঃ সমমনা রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিজ্ঞজন এবং বুদ্ধিজীবীদের সাথে সম্পর্ক। তৃতীয়তঃ সরকারের সাথে সম্পর্ক। চার হাজার বছরের বেশি সময়ের চৈনিক জাতির সুরক্ষিত লিখিত ইতিহাস আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। এই তিন পর্যায়ে বন্ধুপ্রতিম সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সমপরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন চৈনিক নেতৃবৃন্দ। বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই নীতি মেনে চলেছে গণচীন। সরকারের রদবদলে এই মৌলিক নীতিতে হেরফের হয় না কখনোই। ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত, চীন সম্প্রসারণবাদে বিশ্বাসী নয়। বৈদেশিক সম্পর্ক, বিশেষ করে বন্ধুপ্রতিম কোনও রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সরকার বদল বা অন্য যেকোনো কারণে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে সেই প্রতিকূল অবস্থাকে অনুকূলে কি করে আনা সম্ভব সেই প্রজ্ঞাও আমরা রপ্ত করেছি আমাদের ইতিহাস থেকেই। পাকিস্তানে যখন কম্যুনিস্ট পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তখনও চীন তার নীতিতে অটল থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে চলে।
‘৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা জটিল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মুজিবের অসহযোগের ডাক দেবার পর সেই জটিলতা আরও ঘনীভূত হয়।

সেই সংকট কালে জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো সামরিক জান্তা প্রধান প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসাবে এক প্রতিনিধি দলের নেতা হয়ে গণচীনে এসেছিলেন পাকিস্তানের চলমান সংকট নিয়ে আলোচনা করার জন্য। বৈঠকে তিনি রাজনৈতিক সংকটের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেছিলেন

পূর্ব পাকিস্তানের একছত্র নেতা শেখ মুজিবর রহমান এবং তার দল আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক এজেন্ডা হচ্ছে মূলত বিচ্ছিন্নতাবাদ, আর এইএজেন্ডা বাস্তবায়নে ইন্ধন যোগাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। এই বাস্তবতায় রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বজায় রাখার স্বার্থে দেশের সামরিক জান্তা এবং পাকিস্তানের অন্যান্য দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত্য হয়েছে, যেকোনো পদক্ষেপের মাধ্যমেই হউক না কেনও বর্তমানের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করে দেশের অখণ্ডতা বজায় রাখতে হবে। সমস্যা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সোভিয়েত সমর্থিত ভারতীয় যেকোনো প্রকার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বন্ধুপ্রতিম দেশ গণচীন পাশে থাকবে এটাই পাকিস্তান সরকারের প্রত্যাশা। এ বিষয়ে চীনা নেতৃবৃন্দের পূর্ণ সমর্থনের অঙ্গীকার নিয়ে ফিরে যেতে চান জনাব ভুট্টো। তার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অভিমত তাকে পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো। আমাদের তরফ থেকে তাকে বলা হয়-

পাকিস্তানকে বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবেই গণ্য করে গণচীন। বিধায়, পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে গণচীনও উদ্বিগ্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশকে খণ্ডিত করে পাকিস্তান আর হিন্দুস্তান নামের দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই হিন্দুস্তানের কর্ণধারেরা ভারতমাতার এই বিভক্তি মেনে নিতে পারেনি। আজ অবধি সেটা স্পষ্টভাবে লিখিত হয়ে আছে ‘নেহরু ডক্ট্রিন’-এর পাতায়। তাই যেকোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিলীন করায় ব্রতী হবে ভারত, এটা একটা বাস্তবতা। এই বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। তবে দুঃখজনক হলেও আমরা মনে করি, বহুজাতিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদ দৃঢ় ভিত্তির উপর গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন সামন্তবাদী এবং মুৎসুদ্দি শ্রেণীর প্রতিভূ বেসামরিক-সামরিক শাসকগোষ্ঠী যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়ে আছেন জন্মলগ্ন থেকে বিগত ২৫ বছর ধরে। অপশাসন, শোষণ, বঞ্চনা এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠার ফলেই জাতীয়তাবাদ দুর্বল হয়ে পড়ে, আর আঞ্চলিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ সমাজে শিকড় গাড়ে। এ দু’টি সর্বনাশা আলামত কম-বেশি পাকিস্তানের প্রায় সব কয়টি প্রদেশেই বিরাজমান। বর্তমানের সংকট হচ্ছে কেন্দ্রের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত দ্বন্দ্বগুলোর রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশ। বন্ধুরাষ্ট্র পাকিস্তানের স্বার্থেই আমাদের অভিমত হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সমস্যাটা সার্বিক বিবেচনায় একটি রাজনৈতিক সমস্যা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে এবং রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান একমাত্র রাজনৈতিক ভাবেই বের করার উদ্দগ নিতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশা-প্রত্যাশার আলোকে। অস্ত্রবলে বর্তমান সংকটের সমাধান করার যেকোনো প্রয়াস হবে আত্মঘাতী। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আলোচনার মাধ্যমে সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের সময় এখনও পেরিয়ে যায়নি। আমাদের অভিমত শুনে ফিরে গিয়ে জনাব ভুট্টো জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে আমাদের বক্তব্যের ঠিক উল্টোটাই বলেছিলেন। তিনি তাকে বুঝিয়েছিলেন অভ্যন্তরীণ অরাজকতা এবং অস্থিতিশীলতার হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যদি কঠিন কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তবে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাবে গণচীন সরকার। শুধু তাই নয়, তিনি আরও বলেন, কঠিন কোনও পদক্ষেপ গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত যদি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে সেই সময় গণচীন পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রয়োজনে ভারতের বিরুদ্ধ্বে যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত থাকবে সেই অঙ্গীকারও আদায় করে ফিরেছেন তিনি।

এ ধরনের মিথ্যাচার কোনও জাতীয় পর্যায়ের নেতার পক্ষে করা সম্ভব এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। ভুট্টোর এহেন মিথ্যাচারে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার সামরিক জান্তা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সামরিক শ্বেত-সন্ত্রাসের মাধ্যমে নিরসন করার জন্য বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন। তারা ভেবেছিলেন,পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালালে যদি সেই সুযোগে রুশ-ভারত অক্ষশক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় সেই ক্ষেত্রে গণচীন সহ আমেরিকা, তাদের দোসর ইউরোপীয় শক্তিগুলো এবং সারা মুসলিম জাহান পাকিস্তানের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। এই ধরনের সমীকরণের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় ঘটবে রুশ-ভারত অক্ষশক্তির। পরাজিত এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত ভারতকে খণ্ডিত করে কাশ্মীর দখলসহ ভারতীয় ইউনিয়নকে খণ্ডিত করে এর বিলুপ্তি ঘটানো যাবে। এতে চাণক্যদের ‘অখণ্ড ভারত’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন চিরতরে নস্যাৎ করাও সম্ভব হবে। একই সাথে পাকিস্তান বিশ্বপরিসরে স্বীকৃতি লাভ করবে দক্ষিণ এশিয়ার একচ্ছত্র আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে।

এ ধরনের চিন্তা-ভাবনাকে দিবাস্বপ্নই বলা চলে! জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো সম্পর্কে চৈনিক নেতৃবৃন্দের একজন ক্ষমতাধর প্রবীণ নেতার বিবরণ শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম! কেনও এই প্রসঙ্গে এত বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলেন ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী ক্ষমতাধর প্রবীণ এই নেতা! কারণটা সুস্পষ্ট। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে গণচীনের ভূমিকা সম্পর্কে অনেক মিথ্যা অপ-প্রচার চালানো হয়েছে আওয়ামী-বাকশালী আমলে এবং যুদ্ধকালীন সময় থেকেই। ঐ সমস্ত বিরূপ প্রচারণা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে সক্ষমও হয়েছে। সেই বিভ্রান্তি দূর করার প্রয়াসেই এই প্রসঙ্গটা তুলেছিলেন কমরেড শু শিং চৈনিক নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে। এরপর খালেদা জিয়ার চীন সফর এবং তার এজেন্ডা সম্পর্কে ফিরে এলেন কমরেড শু শিং। তিনি জানালেন

খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্রীয় সফরের নিমন্ত্রণ জানাবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তিনি নিজের সুবিধা মতো যেকোনো দিন চীন সফরে আসতে পারেন। দিনক্ষণ ঠিক করে ঢাকায় অবস্থানকারী রাষ্ট্রদূতকে জানালেই রাষ্ট্রীয় সফরের সব আয়োজন করা হবে এই প্রান্তে। এজেন্ডা সম্পর্কে তিনি জানালেন, সফরকালে খালেদা জিয়াকে এজেন্ডার বিষয়গুলো সম্পর্কে ইতিবাচক সিদ্ধান্তই জানানো হবে চীন সরকারের পক্ষ থেকে। এভাবেই মিটিং শেষে মধ্যাহ্ন ভোজের নিমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন লং মার্চ ভেটারান কমরেড শু শিং বন্ধু মা-কে সঙ্গে নিয়ে। উ-কে সঙ্গে নিয়ে আমার ঘরে ফিরে এলাম আমি।

কিছুটা টেনশনে ছিলাম, কিন্তু বৈঠক সফল হওয়ায় সব টেনশন কেটে গেলো। রিল্যাক্সড মুডে বসলাম দুই বন্ধু। আমি দুইটি কাপে জেসমিন সবুজ চা ঢেলে একটি কাপ উ-র হাতে তুলে দিয়ে নিজেরটা হাতে নিয়ে বসলাম মুখোমুখি। উ হঠাৎবলে উঠলো প্রিয়বন্ধু, তুমি জানো না, আমরা সবাই তোমাকে কতটুকু ভালোবাসি আর শ্রদ্ধা করি। কারণটা কি শুনবে নও?

কেনো?
সারা বিশ্বের প্রতিপ্রান্তে আমাদের অনেক বন্ধু ছড়িয়ে আছে। কিন্তু তুমি তাদেরই একজন হয়েও কিছুটা ভিন্ন। তোমার মধ্যে আমরা খুঁজে পেয়েছি কিছু দুর্লভ বৈশিষ্ট্য। তুমি একজন নিঃস্বার্থ জনদরদী সাচ্চা দেশপ্রেমিক। তোমার রাজনৈতিক সচেতনতা, দূরদর্শী বিচক্ষণতা এবং বর্তমান বিশ্বের চলমান ধারা সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি বিস্ময়কর! তুমি স্পষ্টবাদী, নির্ভীক এক সত্য সন্ধানী। জাগতিক সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে তুমি এক বিরল ব্যক্তিত্ব। বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ এক যোদ্ধা তুমি।  জেসমিন টি পান করতে করতে অতি আন্তরিকতার সাথেই কথাগুলো বলছিল পুরনো বন্ধু উ। আমি নিঃশব্দে চা পান করছিলাম আর তার বক্তব্য শুনছিলাম।

পয়গাম নিয়ে হাসি মুখে তরুণী পরিচারিকা এসে জানালো খাবারের সময় হয়েছে। আমাদের পথ দেখিয়ে খাবারের ঘরে নিয়ে গেলো পরিচারিকা। ঘরে প্রবেশ করার দরজায় দেখি কমরেড শু শিং এবং কমরেড মা আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য দাড়িয়ে। তাদের পেছনে দাড়িয়ে আছে PLA এর পুরনো বন্ধু কমিসার কমরেড ফু এবং উর্দি পরিহিত সুদর্শন যুবক কমরেড হং।

আমি যখন বেইজিং-এ ছিলাম তখন হং PLA এর Foreign Relation Department এ দোভাষীর দায়িত্ব পালন করতো উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকগুলোতে। তার কাধে দেখলাম ফুল কর্নেলের ব্যাজ। উ জানালো, ইতিমধ্যে হং বাংলাদেশ সফর করে এসেছে। আমি এসেছি জানতে পেরে ফু এবং হং তাদের পুরনো বন্ধুর সাথে মিলিত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করায় তাদেরকেও আজকের মধ্যাহ্ন ভোজে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। নিখুঁতভাবে সাজানো রিভলভিং গোল টেবিল। প্রতিটি নির্ধারিত চেয়ারের সামনে মেনুর সাথে নামের কার্ড। সবাই যার যার আসনে বসে পড়লাম। মেনুটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়েই বুঝতে পারলাম বিখ্যাত ‘পিকিং ডাক’ ভিত্তিক খাবার পরিবেশিত হবে। এই খাবারের বৈশিষ্ট হল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কয়টি ব্যঞ্জন তৈরি করা হবে পিকিং ডাকের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দিয়ে। খাবার পরিবেশনার অনুমতি নিয়ে প্রশিক্ষিত চৌকস পরিচারিকারা হসিমুখে পরিচর্যা এবং পরিবেশনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। খাবারের সাথে টুকটাক কথাবার্তা এবং রসিকতাও চলছিল। এক সময় কমরেড শু শিং বললেন

যদিও তোমার একান্ত সাথী এবং সহযোদ্ধাদের কারও সাথেই আমাদের তেমন ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার সুযোগ হয়নি তবে তাদের প্রতিও আমাদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা রয়েছে। আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, পংকিলতার মাঝেও পদ্মফুল যেভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে ঠিক তেমনি সত্যিও সব অপচেষ্টা বাধা-বিপত্তি উৎরে দেশবাসীর কাছে উন্মোচিত হবেই একদিন। আর তখনই তোমার মতো নেতাদের জনগণ খুঁজে নেবে জাতীয়মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দান করার জন্য। আমরাও সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকবো। আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে ধৈর্য ধরে থাকো বন্ধু, ডাক একদিন আসবেই।

কমরেড, আপনি বর্ষীয়ান অভিজ্ঞ একজন নেতা। আপনার মতো একজন বিচক্ষণ এবং প্রাজ্ঞ নেতার মূল্যায়ন আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। জেনে রাখুন শ্রদ্ধেয় কমরেড, জীবদ্দশায় সেই ডাক যদি নাও আসে তবুও আমাদের লাখো শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের ইতিকথা রেখে যাবো বর্তমান আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যাতে সেই স্বপ্নকে একদিন তারা বাংলাদেশে বাস্তবে পরিণত করতে সক্ষম হয়। কাজটি দুষ্কর হলেও অসম্ভব নয়, সেই শিক্ষাই গণচীনের ইতিহাস থেকে আমি পেয়েছি। প্রথা অনুযায়ী খাওয়া শেষে হোস্ট কমরেড শু শিং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ছোট্ট করে তার বক্তব্য পেশ করার জন্য।

বন্ধুবর হকের সম্মানে আয়োজিত আজকের ভোজসভায় উপস্থিত সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শুরু করছি। তিনি উপস্থিত সবার কাছেই বিশেষভাবে পরিচিত। তার নিজ দেশে তিনি একজন বহুল পরিচিত বিপ্লবী নেতা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাই শুধু নন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে জোরদার করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ বিশ্বস্ত কর্মীও বটে। এর স্বাক্ষর চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিহাস বহন করবে। তিনি এবার দেশের নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ দূত হিসাবে এক গোপন সফরে এসেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য এবং এজেন্ডা নিয়ে। আজ আমরা সবাই খুশি, আমাদের পরমবন্ধু আজই ফিরে যাচ্ছেন সফলতা অর্জন করে। ভবিষ্যতে তিনি এবং তার সাথী ভাইরা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আরও বড় অবদান রাখবেন সেই প্রত্যাশায় তার সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমি উপস্থিত সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি এক টোষ্টে আমার সাথে যোগদান করুন। তার কথা শেষে সবাই পানীয়র গ্লাস হাতে উঠে দাড়ালেন, আমিও তাই করলাম। কমরেড শু উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, ‘কাম্বে’ এবং গ্লাসটা খালি করলেন, আমরা সবাই তাঁর অনুকরণ করলাম। এবার গেস্ট অফ অনার হিসাবে তার বক্তব্যের জবাবে আমাকে কিছু বলতে হবে তাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম।

মাননীয় কমরেড শু শিং এবং উপস্থিত বন্ধুগণ, অনেকদিন পর আপনাদের সাথে মিলিত হতে পেরে আমি আনন্দিত। কমরেড শু, আপনি গণচীনের একজন বর্ষীয়ান অভিজ্ঞ এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়েও আমার মতো একজন অতি সাধারণ ব্যক্তির জন্য আজকের এই ভোজসভার আয়োজন করে আমাকে যে সম্মান প্রদর্শন করলেন সেটা আমার মনে থাকবে চিরদিন। আজকের ভোজসভায় এমন কয়েকজন পুরনো বন্ধুদের একত্রিত করেছেন যাদের মুখচ্ছবি চীন ছেড়ে যাবার পরও আমার স্মৃতির পর্দায় জাগরূক হয়ে আছে। এর জন্য আপনাকে বিশেষভাবে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। মাননীয় কমরেড বলেছেন, আজ আমি সফলতার সাথে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আমি জানি, এই সফলতা অর্জনের পেছনে আমার বন্ধুদের প্রচেষ্টাটাই মুখ্য। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছাড়া এই সাফল্য আমার একক প্রচেষ্টায় কিছুতেই অর্জন করা সম্ভব হতো না। তাই কমরেড শু শিং-এর সাথে আমি বন্ধুদের সুস্বাস্থ্য কামনা করে একটি টোস্টে আপনাদের সবাইকে যোগদান করার আবেদন জানাচ্ছি, এরপর ‘কাম্বে’ বলে পানীয়র গ্লাসটি খালি করলাম। সাথে সবাই আমার অনুকরণ করলো। ভোজসভা শেষ হল। এরপর কমরেড শু শিং সহ সবাই একে একে চলে গেলেন।

কমরেড মা উর কাছ থেকে জানতে চাইলেন ফিরতি যাত্রার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে কিনা।

হ্যাঁ, অপরাহ্ণের একটি ফ্লাইটে ফিরে যাবেন হক। হংকং-এ রাত্রি যাপনের সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন কমরেড লাম। আগামীকালই তার দেশে ফেরার সব ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সময় মতো আমি নিজেই তাকে এয়ারপোর্টে বিদায় জানিয়ে আসবো। অতি উত্তম। এরপর মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল বন্ধু, বিশেষ জরুরী কিছু কাজে আটকে পড়ায় আমি এয়ারপোর্টে তোমাকে বিদায় জানাতে যেতে পারছি না। তবে তাতে তোমার কোনও অসুবিধে হবে না। কমরেড উ তো রয়েছেই। তোমার, আমাদের প্রিয় ভাবী নিম্মি এবং সস্তির জন্য সামান্য কিছু উপহার তোমার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন কমরেড শু শিং আমাদের তরফ থেকে। তাদের আমাদের আশির্বাদ ও শুভেচ্ছা জানাবে। পরের বার ওদের অবশ্যই সাথে নিয়ে আসবে। তুমি ভাল থেকো, আসি এবার। আমি সবকিছুর জন্য তাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মা। যাবার আগে ফিসফিসিয়ে জানিয়ে গেলেন চোখ টিপে, এজেন্ডার সব কয়টি প্রস্তাবই অনুমোদিত হয়েছে অর্থের সংকুলান সহ।

ঘরে ফিরলাম উকে সঙ্গে নিয়ে। লিন্ডাকে ফোন করে জানালাম বিকেলে ফিরছি। আজ রাতটাই হাতে আছে, কাল ঢাকার পথে রওনা হতে হবে। তাই সম্ভব হলে বন্ধু-বান্ধবদের যাদেরকেই পাওয়া যায় তাদের জড়ো করতে পারলে মিলন মেলাটা বসাতে পারো কান্ট্রি ক্লাবে। আমি পেনিনসুলাতেই থাকবো। পৌঁছেই তোমার সাথে যোগাযোগ করবো।