বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জমির এলেন সস্ত্রীক

দু’দিনের মাথায় ত্রিপোলি থেকে এসে পৌছালো জমির দম্পতি। সবার সাথে আলাপ পরিচয়ের পর জমির জানালো, অনেক আগেই তার আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। এখন নাকি তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে নিয়মিত আমাদের দেখাশোনা করার জন্য। জিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রতিজনকে ১০০ দিনার করে মাসিক ভাতা দেবার। এটা থেকেই কিছুটা আভাস পাওয়া গেলো আমাদের লিবিয়াতে অবস্থানের সময়টা প্রলম্বিত হতে পারে। জমির ও জেরিন দম্পতি দেখতে ভালো এবং মার্জিত রুচিশীল। অল্প সময়েই আপন করে নিলো সবাইকে। দুপরের খাওয়া সেরে সবাই বসলাম গল্পের আসর জমাতে। লিবিয়াতে পান পাওয়া যায় না, তবে লন্ডন থেকে পানের সব সরঞ্জাম আনানোর ব্যবস্থা করে নিয়েছে ইতিমধ্যে মেয়েরা সালেমের মাধ্যমে। পানের ডালি দেখে জমির দম্পতির চক্ষু চড়কগাছ! আপনারাতো বাদশাহী স্টাইলেই আছেন দেখছি।

যা দেখছেন সব কিছুই রাব্বুল আলামিনের কৃপায় আর মোয়াম্মরের বদান্যতায়। কেউ একজন বলে উঠলো

জমির ভাই, বলেন দেশের খবরাখবর কি? আপনাদের সাথে দেশের যোগাযোগ নেই? মেহমান হয়ে এতদূর থেকে কতুকুই বা জানা সম্ভব।

তা বটে। আমি আপনাদের আমার জানামতো গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো জানাচ্ছি। ফিরে গিয়ে আমি দেশের খবরের কাগজ পাঠাবার ব্যবস্থা করব। পাশা ও নূরের সাথে চোখাচোখি হলে দুইজনই স্মিত হেসে পাশা সিগারেট ধরাতে আর নূর তার পাইপে তামাক ঠেসে অগ্নিসংযোগে মন দিয়ে জমিরের কথা শোনার জন্য তৈরি হল। ভায়রা দুইজনই বিদায় নিয়ে নির্বিকারভাবে বেরিয়ে গেলো। জমির শুরু করলেন

জাস্টিস সায়েমকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়া নিজেই এখন চীফ মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটরের দায়িত্ব পালন করছেন। কর্নেল তাহের এবং তার তিন ভাইসহ জাসদের শীর্ষপর্যায়ের নেতৃবৃন্দকে বন্দী করা হয়েছে। দেশের সামরিক বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা, অফিসার নিধন আর ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনের উপর সশস্ত্র হামলার দায়ে কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছে। স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত অফিসার জেনারেল জিয়ার কোর্সমেট ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দারকে। মনে করা হচ্ছে, তাহেরের ফাঁসি হবে আর অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদের সাজা হবে। ক্ষণে ক্ষণে ক্যাণ্টনমেন্টে বিস্ফোরণ ঘটছে। জিয়া সে সবের মোকাবেলা করছেন দৃঢ়হস্তে। বিশৃঙ্খলাকারীরা সবাই কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য।

পাঠকদের এখানে ভাবতে হবে, কর্নেল তাহেরের গোপন সংগঠনের মোকাবেলা জিয়া করছিলেন কাদের সমর্থনে? জবাবটা অতি স্বচ্ছ, বিদেশে অবস্থিত সেনা পরিষদের নেতাদের নির্দেশেই জিয়াকে সর্বাত্মক সাহায্য এবং সহযোগিতা করে চলেছিলো সেনা পরিষদের সদস্যরা। বিষয়টি সেই সময় জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল শিশু ছাড়া অন্য কেউই জানতো না। কর্নেল রশিদ এবং কর্নেল ফারুকও না। ঢাকার সাথে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। দেশের সেনা পরিষদের অফিসার এবং সৈনিকরা অধীর অপেক্ষায় অস্থির হয়ে পড়েছে কবে জিয়া তার ওয়াদা মোতাবেক আমাদের ফিরিয়ে আনবেন! আমরা তাদের একনাগাড়ে বুঝিয়ে চলেছি, জেনারেল জিয়া আমাদেরই একজন এবং সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত নেতা। তাই তার কথার বরখেলাপ তিনি করবেন না। প্রতিজ্ঞা তিনি অবশ্যই রক্ষা করবেন। বর্তমানের বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবেলায় সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে সুশৃঙ্খল করে তোলার স্বার্থে কিছু অসুবিধার কারণে তিনি নিজেই আমাদের অনুরোধ করেছেন কিছুদিন বাইরে থাকার জন্য। আমরা তার অনুরোধ যুক্তিসঙ্গত মনে করেই বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচলিত হবার কিংবা তার নিয়ত সম্পর্কে সন্দিহান হওয়ার কোনও কারণ নেই। সবাইকে ধৈর্যের সাথে আন্তরিকভাবে তাকে সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে সেনা পরিষদকে। ফিরে চলি জমিরের কথায়। জমির জানালেন জিয়ার ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ছক কাটার দায়িত্ব বর্তমানে পালন করছেন জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু মানে আমাদের শিশুভাই। তিনিই সব কলকাঠি নাড়ছেন জিয়ার একান্ত বিশ্বাসভাজন হিসাবে। এর ফলেই নাকি রাজনৈতিক মহলে ইতিমধ্যেই তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ‘রাজপুতিন’ হিসাবে। তার এই বক্তব্যে আমরা সবাই কৌতুক অনুভব করছিলাম। দেশবাসী না জানলেও আমরা সবাই জানতাম শিশুভাই যুদ্ধকালীন সময় থেকেই আর্মির চাকুরি ছেড়ে বিদেশে চলে যাবার চেষ্টা করে আসছেন। রাজনীতিতেও তার কোনও আগ্রহ নেই। শিশুভাই আজ বাংলাদেশের ‘রাজপুতিন!’ তিনি ঢাকার ছেলে বিধায় সবমহলেই তার কিছুটা পরিচিতি আছে। তাছাড়া তিনি আর জিয়া একই সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ISI-তে চাকুরী করেছেন। জন্মলগ্ন থেকেই ISI পাকিস্তানের রাজনীতিকে কন্ট্রোল করে এসেছে। সেই ফর্মুলাই জিয়া কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। তবে আমরা যততুকু তাকে জানি তাতে শর্ত সাপেক্ষেই তিনি সাময়িকভাবে এই দায়িত্ব অনন্যোপায় হয়ে গ্রহণ করেছেন সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সময়েতে সেটাই প্রমাণিত হবে। প্রথম সাক্ষাতের পর জমির সস্ত্রীক প্রায়ই আসতে থাকেুন। বেশীরভাগ সময় সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো জমির দম্পতি কাটাতো আমাদের সাথে। ইতিমধ্যে ত্রিপোলিতে মোয়াম্মর গাদ্দাফি, জাল্লুদসহ অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সাথে আমাদের সাক্ষাত হয়েছে বেশ কয়েকবার। সাক্ষাতকার হতো খুবই আন্তরিক পরিবেশে। তার গ্রীনবুকসহ রাজনৈতিক দর্শন, প্রগতিশীল রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সুষম সমাজ ব্যবস্থা, চলমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আধিপত্যবাদী আগ্রাসন এবং চাপের মুখে অনুন্নত দেশগুলো নিজেদের স্বকীয়তা রক্ষা করে কি করে উন্নতির পথে এগুতে পারে, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে কি করে ঐক্য এবং সংহতি গড়ে তোলা যায় সেই বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন তরুণ বিপ্লবী নেতা গাদ্দাফি আলোচনাকালে। আমরাও দ্বিধাহীনভাবেই সংলাপে অংশগ্রহণ করতাম। আফ্রিকাসহ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি কোনরূপ ভয়-ভীতির তোয়াক্কা না করে তার আন্তরিক সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতার ইতিহাস ছিল নির্দ্বিধায় প্রশংসনীয়। মুসলিম বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রবর্তিত রাজতন্ত্র এবং আমীরতন্ত্রের প্রকাশ্য সমালোচনা করতেন বিশাল সম্পদশালী দেশের রাষ্ট্রনায়ক গাদ্দাফি। তার মতে মুসলিম বিশ্বের বিভাজনের জন্য মূলত দায়ী এই রাজতন্ত্র এবং আমীরতন্ত্র। তার বিশ্বাস এই ফিতনাগুলোকে শেষ না করা পর্যন্ত বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হবে না। মিসরের নাসের এর ‘Pan Arabism’ এর চেয়ে ‘Pan Islamism’ এর প্রতিই তার আকর্ষণ ছিল বেশী। তার মতে প্রকৃত ইসলামে, জাত, গোত্র ও বর্ণের কোনও স্থান নেই। মোয়াম্মর গাদ্দাফিকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার পর তাকে একজন জনদরদি, প্রগতিশীল এবং বিশ্বমানবতাবাদী হিসাবেই শ্রদ্ধার সাথেই গ্রহণ করেছিলাম আমরা অনেক বিষয়েই তার সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও। আমাদের জানানো হয়, পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক দেশগুলো প্রথম দিন থেকেই সেপ্টেম্বর বিপ্লবকে ইতিবাচক ভাবে না দেখে নিজেদের স্বার্থে বিরূপ প্রচারণায় সোচ্চার হয়ে ওঠে। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার সাথে সাথে বিভিন্ন চক্রান্তমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গাদ্দাফির বৈপ্লবিক সরকারকে উৎখাতের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। লিবিয়াবাসীদের মধ্যে কায়েমী স্বার্থবাদীদের উস্কে দিয়ে নাশকতামূলক তৎপরতার মাধ্যমে Revolutionary Command Council কে অকার্যকর করে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিপ্লবী নেতা গাদ্দাফির প্রাণনাশের চেষ্টাও করা হচ্ছে একই সাথে। এইসব হীনচক্রান্তের নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের দোসর যুক্তরাজ্য। এ ধরনের আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মোকাবেলার স্বার্থেই বাধ্য হয়ে গাদ্দাফিকে সোভিয়েত বলয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে হয় মিসরের নাসের এবং ইরাকের সাদ্দামের মতো। তার বৈপ্লবিক এবং প্রগতিশীল নীতি-আদর্শের জন্য মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রের বেশিরভাগ রাষ্ট্রপতিরাও ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর চাপে তাকে আপন করে নিতে নারাজ যদিও সেই সমস্ত দেশের নিপীড়িত জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে একজন সাহসী নেতা হিসাবে। নিরাপত্তার বিষয়টাই মুখ্য হওয়া সত্ত্বেও চলমান বিশ্বের প্রতি প্রান্তে যে সমস্ত সংগঠনই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিয়োজিত তাদের প্রতি একাত্মতা জানিয়ে সব ঝুঁকি মাথায় নিয়েও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করছেন না তরুণ বিপ্লবী নেতা গাদ্দাফি ও তার সাথী বিপ্লবীরা। তাদের সেই সাহসী উদ্যোগ এবং অবদানের ফসল আজ বিশ্বের অনেক দেশের জনগণই ভোগ করছে।

ইতিমধ্যে আমরা হোটেল ছেরে চলে এসেছি। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সাগরের কোল ঘেঁষে মরূদ্যানের মধ্যে অবস্থিত একটি ৪ তলা বিশাল অট্টালিকায়। সেখানে বিশটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ফ্ল্যাট রয়েছে। সার্বিক ব্যবস্থা নিখুঁত। উঁচু প্রাচীরে ঘেরা সুরক্ষিত পুরো ভবনটি। চারিদিকে সুন্দর বাগান। টেলিফোন ইন্টারকম ব্যবস্থাও রয়েছে যোগাযোগের সুবিধার্থে। বাহির থেকে ভেতরের পরিবেশ কিছুই বোঝার উপায় নেই। সমুদ্রের ভেতরে অনেকদূর পর্যন্ত একটা সরু রাস্তা বানানো হয়েছে, মাঝে মধ্যে বসার বেঞ্চ। এটাকে Walking/Jogging Track হিসাবে ব্যবহার করা চলে। ন্যাপকিন থেকে সবকিছুই বদলে দিয়ে যায় House Keeping, গেইটে রয়েছে সার্বক্ষণিক সশস্ত্র গার্ড। পারকিং এ গাড়ীর বহর। সবার ফর্দ অনুযায়ী সব সামগ্রী চাওয়া মাত্রই পৌঁছে দেয়া হয়। আমাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে মাঝে মধ্যে বাজারে গিয়ে ইচ্ছে মত মাছ, মাংস, শাক-সবজি এবং মশলাপাতি কিনে এনে পছন্দসই রান্না করে খাওয়া। সমস্ত বিল্ডিংটাই Centrally Air Conditioned.আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি আরামদায়ক বাসস্থান। কোনও বিষয়েই কার্পণ্য নেই লিবীয় সরকারের পক্ষ থেকে। সালেমের জন্যও রয়েছে একটি ফ্ল্যাট। সেখানে অবস্থান করেই সালেম সব কিছুর তদারকি করছেন। আমাদের সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছে। সালেম বিবাহিত এবং পিতাও বটে। তাই আমরা প্রায়ই ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেই জোর করে। বিশেষ করে Week Ends গুলোতে, কারণ প্রায় প্রতি Week End এ আসে জমির দম্পতি। তাদের সাথে হৈ-হল্লা করে আমাদের সময় কেটে যায়। ইতিমধ্যে কয়েকজন পাকিস্তানি ডাক্তার ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত পরিবারের সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে বাজারে। ওরা প্রায়ই আমাদের দাওয়াত করে খাওয়ান, আমরাও তাদের ডাকি পাল্টা দাওয়াতে। এই সব ব্যাপারে রশিদ আর ফারুকের তেমন উষ্ণতা পরিলক্ষিত হয় না। এই দুই ভায়রা ওদের মতই থাকে। বিদেশে এই পাকিস্তানি পরিবারগুলোই হয়ে উঠেছিলো অতি আপনজন। ঢাকার সাথে আমাদের রয়েছে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। এ ছাড়াও লন্ডন, কানাডা, আমেরিকাতে বসবাসকারী আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথেও কথা হয় প্রায়ই। জমির নিয়মিত পাঠাচ্ছিলেন বাংলাদেশী পত্রপত্রিকা, বিদেশের নামিদামি পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন। তাই দেশ-বিদেশের সব খবরাখবর ও জানা সম্ভব হচ্ছিলো। তাছারা, প্রতিটি ফ্ল্যাটেই রয়েছে ডিশ টিভি। মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশগুলোর মতো লিবিয়াতেও ভারতীয় হিন্দি ছবি খুবই জনপ্রিয়। মেয়েরা সহ আমরা সবাই পছন্দমতো ছবি সিনেমা হলে দলবেঁধে গিয়ে দেখি। অত্যন্ত আনন্দমুখর পরিবেশে কাটছিল আমাদের প্রবাস জীবন। রাষ্ট্রীয় অতিথিই শুধু নয়, একজন বিপ্লবী নেতার বিপ্লবী অতিথি আমরা। তাই অন্যান্য রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সাথে আমাদের প্রচুর ব্যবধান অনুভব করছি। মনোরম পরিবেশে আলিশান বিলাসিতায় সময় কাটলেও মন আমাদের পড়ে আছে সুদূর বাংলাদেশে। ফ্ল্যাটের নতুন আবাসিক স্থানে Shift করার পর শুরু হল Revolutionary Command Council এর সাথে আমাদের serious আলোচনা। শুরুতেই গাদ্দাফির সাথে আমাদের পরিচয় ও কয়েক দফা বিভিন্ন বিষয়ে সংক্ষিপ্ত মতামত বিনিময়ের পর Revolutionary Command Council এর তাত্ত্বিক গুরুদের সাথে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা শুরু হল। আলোচনার বিষয় শুধুমাত্র গাদ্দাফির গ্রীনবুক নিয়েই নয়, এর পরিধি ব্যাপক। সমগ্র বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, দীর্ঘকালীন সংগ্রামের পর গণচীনের অভ্যুত্থান, আঞ্চলিক সমসা, প্যান এরাবিজম, প্যান ইস্লামিজম, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফিলিস্তিন, ইসরাইল, বৈরুত, বিশ্ব উম্মাহর একত্রীকরণ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন, সঠিক পথ, তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশসমূহ, মুসলমান অধ্যুষিত প্রাকৃতিক সম্পদের বিশাল ভান্ডারের মালিক দেশগুলোর উপর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যবাদী নিয়ন্ত্রণ এবং আগ্রাসন, লিবিয়ার সেপ্টেম্বর বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশের রাজনীতি এবং পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, চলমান রাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের মধ্যে বিস্তারিতভাবে মত বিনিময় হয় যুক্তি ও তথ্যভিত্তিক। আরব বিশ্বে গাদ্দাফি এক বিতর্কিত ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রনায়ক। তার রাজনৈতিক দর্শনের মূল হল ইসলামিক সমাজতন্ত্র। জামাল নাসের তখন আরব জাহানের সবচেয়ে বিচক্ষণ নেতা এবং মিসর তুলনামূলক ভাবে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ না হলেও সামরিক এবং জনশক্তির দিক দিয়ে ছিল একটি প্রভাবশালী দেশ। ‘প্যান এরাবিজম’ এর রাজনৈতিক দর্শনের রূপকার ছিলেন নাসের। তার উদ্দেশ্য ছিল, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী আরব দেশগুলোকে একত্রিত করে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আধিপত্য খর্ব করা। গাদ্দাফি ছিলেন তার অনুসারী। তাই তিনিও প্রাথমিক ভাবে নাসেরের এই দর্শনের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেন। সেপ্টেম্বর বিপ্লবের পর ‘প্যান এরাবিজম’-এর আলোকে নাসের এবং গাদ্দাফির চেষ্টায় লিবিয়া, মিসর, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো এবং সিরিয়াকে মিলিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা ব্যর্থ হবার সাথে নাসেরের ‘প্যান এরাবিজম’ তত্ত্বের অসারত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর নাসেরের সাথে গাদ্দাফির ‘প্যান এরাবিজম’ এর ব্যাপারে মতপার্থক্য দেখা দেয়। এরপর গাদ্দাফি ঝুঁকে পরেন ‘প্যান ইস্লামিজম’ এবং সারাবিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের দিকে। তার ‘গ্রীনবুক’ আর চেয়ারম্যান মাও এর ‘লাল পুস্তিকা’-এর মধ্যে মূলত একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ছাড়া অনান্য বিষয় তেমন কোনও পার্থক্য ছিল না। তার তাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করতেন, মোয়াম্মর যেভাবে মার্ক্সসীয় রাজনৈতিক দর্শনকে ইসলামের সম্পূরক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন সেটাই এক যুগান্তকারী সৃজনশীলতা রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে। তাদের মতে, গাদ্দাফির আবিষ্কৃত এই অভিনব দর্শনই বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাসীকে সার্বিকভাবে মুক্ত করতে পারে প্রচলিত সব রকমের আগ্রাসন, শোষণ এবং অপশাসনের নিগড় থেকে। গাদ্দাফির রাজনৈতিক দর্শনের বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমরা তার সাথে সীমিত পর্যায়ে বিতর্কে যেতাম। কারণ, দুই একটা বৈঠকের পরই আমরা উপলব্ধি করেছিলাম, গাদ্দাফি কিছুটা গোঁয়ার প্রকৃতির আর তার মধ্যে সহিষ্ণুতার কিছুটা অভাব রয়েছে। তবে তার তাত্ত্বিকদের বেশিরভাগই ছিলেন বেশ receptive. তাদের নীতি-আদর্শ এবং দর্শন বিষয়ে স্ব-বিরোধী দ্বন্দ্ব যৌক্তিকতার সাথে উপস্থাপন করলে তারা সেটা মেনে নিতেন। সালেমসহ অন্যরা অকাট যুক্তিগুলো আন্তরিকতার সাথেই মেনে নিতে কার্পণ্য করতেন না। আজ মোয়াম্মর গাদ্দাফি আন্তর্জাতিক চক্রান্তে বেঁচে নেই। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে। দোষে-গুণেই মানুষ। গাদ্দাফিও ছিলেন একজন মানুষ মাত্র, অতিমানব নন। তারপরও পৃথিবীর অগুনতি মানুষের মনে চিরজাগরূক হয়ে থাকবেন শহীদ বিপ্লবী নেতা মোয়াম্মর গাদ্দাফি। অনেকেই আজ পশ্চিমা বিশ্বের প্রচারণার সাথে সুর মিলিয়ে বলে থাকেন গাদ্দাফি নাকি ছিলেন একজন নিষ্ঠুর রক্তপিপাসু জল্লাদ! গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী এক স্বৈরশাসক! যারা ঐ ধরণের বুলি কপচে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন অর্ধ কিংবা অশিক্ষিত জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য সেটার পেছনে কোনও স্বার্থ কার্যকরী সেই বিতর্কে না গিয়ে পাঠকদের কাছে কিছু চিন্তার খোরাক তুলে ধরছি তাদের বিচার বিবেচনা এবং বিশ্লেষণের জন্য। নামীদামী অনেক দার্শনিক, রাষ্ট্র ও সমাজ বিজ্ঞানী এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের অনেকেই বলেছেন, কোনও একটি দেশের রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ সেখানে যত সফলই হউক না কেনো, সেটাকে অন্য কোনও রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর উপর হুবহু চাপিয়ে দিলে একই রকমের ফল লাভ করা সম্ভব হয় না। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে প্রচলিত গণতন্ত্রের সবক শিখে যে সমস্ত পণ্ডিত সেই ফরমুলা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে চাপিয়ে দেন, তারা কিন্তু একটি অতি সাধারণ কথা সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে ভুলে যান যে ঐ সমস্ত উন্নত দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা এক নয়। তাদের মননশীলতা, ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধেও রয়েছে আসমান-জমিনের ফারাক। তাই আজ পর্যন্ত ধার করা ঔপনিবেশিক ধাঁচের গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের কোনও দেশের জনগোষ্ঠীরই ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। যা দেখা যায় সেটা হল, গণতন্ত্রের ধূম্রজালে জনগণকে আচ্ছন্ন রেখে জাতিকে বিভক্ত করে গড়ে তোলা হয়েছে একটি ক্ষুদ্র কিন্তু অসীম শক্তিশালী কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী। জনগণের ২% এই গোষ্ঠীর অবৈধ কব্জায় রয়েছে জাতীয় সম্পদের ৯০%। ফলে তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, প্রশাসন, আইন বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং দেশের সামরিক বাহিনী। অর্থবল ও পেশীশক্তির জোরে তারাই সমাজপতি। অবশ্য জাতীয় সম্পদের সিংহভাগই নিয়ে যাচ্ছে বিদেশী প্রভুরা। তাদের পদলেহী এই তল্পিবাহক গোষ্ঠী যাদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল বিদেশী মুরুব্বীদের উপর, তারা ঢেকুর তুলে সন্তুষ্ট থাকছেন উচ্ছিষ্ট পকেটস্থ করেই। এভাবেই একটি স্বাধীন দেশের ৯৮% নাগরিককে কৌশলে পরিণত করা হয়েছে এই ২% কায়েমী স্বার্থবাদী শাসক ও শোষণকারী গোষ্ঠীর গোলামে। কারণ, তাদের অস্তিত্বই নির্ভর করে ঐ গোষ্ঠীর করুণা এবং দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর। সার্বিকভাবে পরনির্ভরশীল, নিপীড়িত, বঞ্চিত, অসহায়, অশিক্ষিত জনগণ কখনোই নিজেদের ন্যায্য অধিকারের জন্য মেরুদণ্ড সোজা করে প্রতিবাদী হতে পারে না। তারা অর্ধমৃত অবস্থায় ভেন্টিলেটারের সাহায্যে ধুঁকছে সর্বখানে যদিও তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ প্রচুর প্রাকৃতিক, খনিজ ও মানব সম্পদের অধিকারী। বন্ধকী সত্তার পক্ষে স্বাধীন চিন্তা এবং বিবেচনার কোনও অবকাশ থাকে না। এই বাস্তবতার নিরিখে, পরাধীনতার শেকলে বাধা ব্যক্তির পক্ষে স্বাধীনভাবে চিন্তা করা কিংবা ভোট দেয়া কি করে সম্ভব? দেশে দেশে গণতন্ত্রের লেবাসে চলছে কায়েমী স্বার্থবাদীদের ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ পালা বদলের রাজনীতির নাগরদোলায়। ফলে প্রায় সব কয়টি দেশ হয়ে উঠছে ভঙ্গুর আর জনগণ হারাচ্ছে প্রাণশক্তি। কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী মনিবদের স্বার্থরক্ষার্থে যেখানে প্রচলিত গণতান্ত্রিক এবং সিভিল মিলিটারি স্বৈরশাসন অকেজো হয়ে পড়ছে সেখানে এই সুতিকাগার থেকে প্রসূত হচ্ছে গোষ্ঠীতন্ত্রের চেয়েও ভয়ানক বিভীষিকাময় পরিবারতন্ত্র। এ ধরনের গণতন্ত্রে অবশ্যই বিশ্বাসী ছিলেন না প্রগতিশীল বিপ্লবী নেতা গাদ্দাফি। এখানে বর্তমান বিশ্বের উদীয়মান আণবিক শক্তিধর দেশ গণচীনের রূপকার চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর একটা উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘বিপ্লব রঙিন সুতোয় কাপড়ে নকশা আঁকার মতো সরল বিষয় নয়। বিপ্লব একটি জটিল প্রক্রিয়া। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, অনেক ত্যাগের বিনিময়েই বৈপ্লবিক স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব। অনেক রক্তের বিনিময়ে সফলতা পায় বিপ্লব।’ তার এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলো চৈনিক জাতি। তাই একদা আফিমখোর জাতি হিসাবে পরিচিত চৈনিক জাতিগোষ্ঠী আজ সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে বিশ্বের অন্যতম উদীয়মান অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি হিসেবে। সিঙ্গাপুরের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জনাব লি কুয়ান ইউ-এর সাথে লেখকের গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো এক বৈঠকে। বর্তমানের সিঙ্গাপুরের রূপকার এবং অভিজ্ঞ বিপ্লবী এই নেতার সাথে খোলাখুলি আলাপ করার সুযোগ পেয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম

এক্সেলেন্সি, আপনি দীর্ঘ ২৮ বছরেরও বেশি সময় দোর্দণ্ডপ্রতাপে দেশ শাসন করে এখন অবসর নিয়েছেন। যেদিন আপনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বাধীন সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন সেই দিন পরাজিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আপনার সরকারের পতন ঘটানোর জন্য সিঙ্গাপুরে জাতিগত রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ এক দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়। কিন্তু আপনি সেই দাঙ্গা কঠোর হস্তে দমন করেন। আপনার বিপ্লবী বাহিনীর হাতে নিহত হয় ১০ হাজারেরও বেশি সব জাতিগোষ্ঠীর দাঙ্গাকারীরা। এরপর আপনি কঠোর ভাষায় সবার উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি জারি করে বলেছিলেন, আজ থেকে যারাই সিঙ্গাপুরে বসবাস করবে তাদের জাতিগত পরিচিতি হবে সিঙ্গাপুরীয়ান। এটা যাদের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয় তাদের জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় দেয়া হল সিঙ্গাপুর ছেড়ে চলে যাবার জন্য। আপনার এই ঘোষণার পর অবশ্য খুব কম সংখ্যক লোকই সিঙ্গাপুর ছেড়ে গিয়েছিলো। শুধু তাই নয়, এরপর আজঅব্দি সিঙ্গাপুরে কোনও জাতিগত দাঙ্গা হয়নি। কিন্তু এরপরও পশ্চিমা অনেক দেশ এবং মানবতাবাদী সংগঠন সেই দিনটিকে এখনো ‘Black Day’ হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকে। আপনার বিরুদ্ধে তাদের প্রচারণায় বলা হয়, আপনি বর্তমান আধুনিক বিশ্বের এক চরম গণতন্ত্রবিরোধী অত্যাচারী স্বৈরশাসক। পাঠকদের নিশ্চযই জানা আছে সিঙ্গাপুরে তিনটি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। মালয়ী, চৈনিক এবং দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগত উপমহাদেশীয়রা। এই বিষয়ে আমি তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে, বর্ষীয়ান নেতা বলেছিলেন

সেই দিন আমি যেই পদক্ষেপই গ্রহণ করেছিলাম সেটা ছিল সুচিন্তিত এবং জাতীয় স্বার্থে। এ নিয়ে অন্যরা কি মনে করছে না করছে সেটা ধর্তব্যের বিষয় নয়। বাকি থাকে গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্র প্রসঙ্গ। এই দুইটিই এক ধরনের অনুভূতি বা চেতনা, যা পৃথিবীর সব জাতিসত্তাতেই আদিকাল থেকেই বর্তমান। তবে এই অনুভূতি বা চেতনা সব জাতিসত্তার ক্ষেত্রে হুবহু একই রকম হতে হবে এমন ধারণা যুক্তিসঙ্গত নয়। তাই ঐ শব্দ দুইটির পশ্চিমা জগতের আভিধানিক অর্থকেই যে সর্বজনীনভাবে মেনে নিতে হবে সেটাও অযৌক্তিক। আমার শাসনকালের সার্টিফিকেট দেবার একমাত্র অধিকার রয়েছে আমার দেশবাসীর। আমি যদি কোনও অন্যায় করে থাকি সিঙ্গাপুরের অধিবাসীর যে কেউই প্রচলিত আইন অনুযায়ী আমাকে কাঠগড়ায় দাড় করাবার অধিকার রাখেন। অন্যদের সার্টিফিকেট আমার কাছে সম্পূর্ণভাবে মূল্যহীন। আলোচনা শেষ করার আগে তিনি একটি অতি মূল্যবান কথা বলেছিলেন
নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক, দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ, বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের অধীন কঠোর পরিশ্রমকারী জাতিকে কোনও অপশক্তিই দাবিয়ে রাখতে পারে না। স্বকীয় প্রতিভা এবং কর্মদক্ষতা তাদের উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেবেই। তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ আজকের সিঙ্গাপুর। অবসর গ্রহণের পর তিনি সস্ত্রীক সরকার প্রদত্ত দুই কামরা বিশিষ্ট একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসবাস করছিলেন। অবসর ভাতাই ছিল তাদের একমাত্র আর্থিক সঙ্গতি। তার মতো নেতাকেও কিন্তু ‘জাতির পিতা’ হিসাবে আখ্যায়িত করার কোনও প্রচেষ্টা কিংবা উদ্যোগ কখনোই নেয়া হয়নি। বিদায় নিয়ে ফেরার পথে ভাবছিলাম, আমাদের দেশে কি কখনো জন্ম নেবে এমন একজন লি কুয়ান ইউ! লি কুয়ান ইউ বর্তমানে গণচীনের অবিশ্বাস্য প্রগতির একজন রূপকারও বটে। এ ছাড়া শুধু অনুন্নত বিশ্বের দেশগুলোই নয় উন্নত বিশ্বের অনেক দেশও তার বাস্তব জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য। আর একজন দূরদর্শী নেতা যাকে বলা হয়ে থাকে আধুনিক চীনের visionary. কমরেড দেং শিয়াও পিং। এক সাক্ষাতকালে সুযোগ পেয়ে লেখক তাকে প্রশ্ন করেছিল

মাননীয় কমরেড, আপনি যেভাবে চীনের দরজা অবারিতভাবে খুলে দিচ্ছেন পশ্চিমা শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোকে পুঁজি এবং প্রযুক্তি বিনিয়োগের আকর্ষণ সৃষ্টির চেষ্টায় যাতে করে গণচীন অতি অল্প সময়ের মধ্যে একটি অত্যাধুনিক রাষ্ট্র এবং শক্তিধর দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হয়। আপনার একটা উক্তি আজকাল প্রায় প্রতিটি চীনবাসীর মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে, ‘It does not matter whether the cat is white or black as long as it catches the mice.’ কিন্তু আপনি কি মনে করেন না এতে চীনের রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক কাঠামোতে অবক্ষয় দেখা দেবে? কারণ আর একটা প্রচলিত উক্তিও আছে, ‘Money does not come alone but with many vices.’ Long march veteran, যিনি গণচীনের ক্ষমতা বলয়ের নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায় থেকে ছিটকে পড়ে পরে তৃতীয় বার ক্ষমতার শীর্ষে অলৌকিক ভাবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন সেই বর্ষীয়ান নাতিদীর্ঘ নেতা দেং শিয়াও পিং সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে জবাব দিয়েছিলেন

তেমন সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে। তবে সে সব দোষ থেকে দেশ ও জাতীয় চরিত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ব্যবস্থাও আমরা করে রেখেছি। যেকোনো পর্যায়ে যখনই কোনও পচন পরিলক্ষিত হবে তক্ষুনি তা কেটে ফেলা হবে পচন ছড়িয়ে পরার আগেই। প্রক্রিয়াটাকে বলা যেতে পারে ‘Continuous Rectification Campaign.’ তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের ঘটনা সম্পর্কে আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন বলেই আমার ধারণা। চক্রান্তের জাল সর্বকালেই ছিল, থাকবেও আগামীতে। প্রয়োজনীয় আত্মত্যাগের জন্য যতদিন জাতি এবং নেতৃত্ব তৈরি থাকবে ততদিন সব চক্রান্তের মোকাবেলা করা সম্ভব।

এ থেকেই পাঠক বুঝতে পারবেন তিনি কত বড় মাপের নেতা। তার দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, প্রত্যয় ও জ্ঞানের পরিমাপ কতখানি। একবার বিশ্ববরেণ্য নেতা মাহাথির মোহাম্মদ এর সাথে এক সেমিনারে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিলো। তাকে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম

এক্সেলেন্সি, আজকের বিশ্বব্যবস্থায় কোনও অনুন্নত দেশের পক্ষে কি স্বনির্ভরতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা সম্ভব? জবাবে তিনি বলেছিলেন

অবশ্যই সম্ভব। তবে এর পূর্বশর্ত হচ্ছে, জাতীয় নেতৃত্বকে হতে হবে সম্পূর্ণভাবে নিঃস্বার্থ এবং দুর্নীতিমুক্ত। বিশেষভাবে পরিচিত এবং বিশ্ববাসীর কাছে শান্তির প্রতীক হিসাবে স্বীকৃত নেলসন ম্যান্ডেলাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো

তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর প্রায় প্রতিটি দেশই প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা অর্থনৈতিক ভাবে ক্রমান্বয়ে দেউলিয়া এবং পরভৃৎ হয়ে উঠছে কেনো? জবাবে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন

দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে, দেশগুলোতে নেতা নয়, শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ দেখছেন তিনি। রাজনীতিবিদদের দৃষ্টির প্রসারতা শুধুমাত্র নির্বাচন পর্যন্ত, নেতার দৃষ্টি প্রসারিত থাকে আগামী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর পর্যন্ত।

এদের বক্তব্যে অনেক চিন্তার খোরাক রয়েছে নতুন প্রজন্মের জন্য যারা সব রকমের অন্যায় এবং শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে মুক্তিসংগ্রামে ব্রতী হতে আগ্রহী। জিয়ার সাথেও কথা হচ্ছে মাঝেমধ্যে। শিশুভাই এবং টনি ভাবীও প্রায়ই ফোন করে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। ব্যাচেলররা আমাদের সাথেই খাওয়া দাওয়া করছে, কখনো নিজেরাও রান্নাবান্না করছে। আমাদের দাওয়াতও করছে। আমরা সবাই মিলে একটি বড় পরিবার। ব্যতিক্রম শুধু দুই ভায়রা। তারা সবার সাথে সহজভাবে মিশতে পারছে না। তাই কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছে। তাদের এই ব্যবহারটা অদ্ভুত হলেও সবারই গা সহা হয়ে গেছে। এই ধরনের ব্যবহার কিছুটা দৃষ্টিকটু হলেও কেউই তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না। আমাদের মতোই তারাও তাদের পরিচিত লোকজনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে খবরাখবর নিচ্ছে। প্রয়োজনমতো আমাদের সাথে শেয়ারও করছে। তবে আমাদের যোগাযোগের গণ্ডি তাদের চেয়ে অনেক বড় এবং বিস্তৃত। সমগ্র সামরিক বাহিনী জুড়ে রয়েছে আমাদের সংগঠন সেনা পরিষদ। রাজনৈতিক মহলের সমমনা নেতানেত্রি এবং বিভিন্ন মহলেও রয়েছে আমাদের যোগাযোগ।