দেশে ফিরলাম

ফিরে এলাম দেশে। সুদীর্ঘ সময় প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে নিজেকে পুনরায় পুনর্বাসিত করার চেষ্টার সাথে সাথে দেশের চলমান সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে থাকলাম। সম্মানের সাথে সাধারণভাবে বেঁচে থাকার আর্থিক সঙ্গতি অর্জনের জন্য কারো দ্বারস্থ না হয়ে স্বাধীনভাবে কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই যথাসম্ভব সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আমার একমাত্র শ্যালক বাপ্পি বছর খানেক আগেই গুলশান দুই নম্বরে আমার একটা প্লটে ‘সোনা ঝরা’ নামে একটি মাল্টি স্টোরিড ফ্ল্যাট বানানোর কাজ শুরু করেছিল। আমি তার সাথেই যোগ দিলাম। উদ্দেশ্য ছিল যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রজেক্টটা শেষ করে ৮টি ফ্ল্যাটের ৬টি ভাড়া দিয়ে সংসারের খরচ মেটাবো আর ২টা ফ্ল্যাটকে একত্রিত করে একটা ডুপ্লেক্স বানিয়ে সেখানে সপরিবারে নিজে থাকবো। প্লটটির অবস্থান ছিল বিশেষ পছন্দের। পেছনে লেক আর সামনে গুলশানের সর্ববৃহৎ আজাদ মসজিদ।

ইচ্ছে ছিল ধানমণ্ডির পৈতৃক বাড়িটাকে একটি ট্রাস্টের অধীনে পরিণত করবো বাংলাদেশের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটা গবেষণাগারে, সাথে থাকবে একটা পাঠাগার। আমার নিজের কালেকশনে বিভিন্ন বিষয়ের উপর দুর্লভ প্রায় ৩০০০-এরও বেশি বই ছিল। তার সাথে যোগ করা হবে পারিবারিক সূত্রে সংগ্রহীত পুরনো আরও প্রায় ১০০০ বই। সেই আশা অপূর্ণই রয়ে গেলো আজঅব্দি প্রতিকূল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে! রাব্বুল আলামিনের কাছে আমার সেই সময়কার পরিকল্পনা সঠিক বিবেচিত হয়নি তাই শুকরিয়ার সাথেই তার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি।

দেশের মাটিতে পা দিয়েই আঁচ করতে পেরেছিলাম ঝড়ের পূর্বাভাস। দেখলাম রাজনৈতিক আকাশের ঈশানকোণে জমে উঠেছে কালো মেঘ। ক্রমান্বয়ে খালেদার সরকার দুর্বল হয়ে পড়ছে। একই মাত্রায় খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় ধস এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও স্বচ্ছতার ব্যাপারে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। হতাশাগ্রস্ত দেশবাসী!

আওয়ামী জোট, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির মূল দুইটি ইস্যু ছাড়াও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-নেত্রী এবং জিয়া পরিবারের দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এবং বিচার বিভাগে অবাধ দলীয়করণ, যুবদল-ছাত্রদলের লাগামহীন হারমাদি, চাঁদাবাজি ও বিরোধী দলসমূহের উপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন সরকার বিরোধী আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছে। এরই মধ্যে ম খা আলমগীরের নেতৃত্বে সরকারি আমলা এবং পেশাজীবীদের নিয়ে গঠিত ‘জনতার মঞ্চ’ সরকার বিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা সৃষ্টি করায় টালমাটাল হয়ে পড়েছে খালেদা সরকারের প্রশাসন। ‘জিয়ার ভাঙ্গা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জির’ প্রচারণা লজ্জাকর তামাশায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই তারই পরিবারের সদস্যদের এবং প্রতিষ্ঠিত দলের নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতি ও অপকর্মকাণ্ডের ফলে।

দলীয় কোন্দল এবং ‘হাওয়া ভবনের’ দোর্দণ্ডপ্রতাপ এবং একচোখা পক্ষপাতিত্বের কারণে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা ক্ষোভে এবং হতাশায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন মন্ত্রীরা নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে। জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী নিশ্চুপ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যাদের ভোটে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসতে সক্ষম হয়েছিল তাদের বৃহদংশই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে খালেদা জিয়ার জোটের তরফ থেকে ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী এবং দলীয় স্বার্থে অস্বচ্ছ রাষ্ট্রপরিচালনা এবং শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ার কারণে। তাদের সব প্রত্যাশাই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে শাসকগোষ্ঠীর লোভ লালসা এবং অপশাসনের যাঁতাকলে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদের জীবন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ক্রমবর্ধমান মূল্য পেশাদার চাকুরিজীবী এবং মেহনতি মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাওয়ায় তারা দিশেহারা। এই অবস্থায়, আগামী নির্বাচনে খালেদার জোট ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে না, সেটা ছিল নিশ্চিত ভবিতব্য। হয়েছিলো তাই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, সবকিছুই ঘটছিলো খালেদার নাকের নিচেই, কিন্তু ঝড়ের পূর্বাভাস আঁচ করতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন খালেদা জিয়া! পরিবার পরিজন ও চাটুকারদের বলয়ে তখন ক্ষমতা উপভোগ করে চলেছিলেন তিনি নির্বোধ উটপাখির মতো অন্ধ সেজে।