দ্বিতীয় বৈঠক

আমরা তার স্যুইটে গিয়ে গতরাতের মতোই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসলাম। বুঝতে কষ্ট হল না, তিনি আজ গোপন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ করবেন। গতকালের মতোই চা পরিবেশিত হল। তিনি নিজেই চা বানিয়ে একটি কাপ আমার হাতে দিয়ে নিজের কাপটি হাতে তুলে নিয়ে মুখোমুখি বসলেন।

চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী ও বন্ধুত্ব দৃঢ় করার জন্য তোমার প্রচেষ্টা সম্পর্কে গতকাল খোদ জনাব দেং শিয়াও পিং যে ভাবে প্রশংসা করলেন সেটা আমারও গর্ব। এমনটিই ছিল আমার প্রত্যাশা। জবাবে বললাম

আমার প্রচেষ্টার চেয়ে চীনাদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং তাদের নীতিভিত্তিক আগ্রহটাই এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে অবদান রেখেছে। আমি আমার সাধ্যমতো আন্তরিক ভাবে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য সুদূর প্রসারী চীন-বাংলাদেশের বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। আর একটি বিষয় আমি তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি ভারতের শ্যেনদৃষ্টি এবং করাল থাবা থেকে বাংলাদেশের স্বকীয় স্বাধীন সত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চীনের সাথে বহুমাত্রিক বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা দুই পক্ষের জন্যই অপরিহার্য।

শোনো ডালিম, আমি অস্বীকার করবো না, যুদ্ধকালে তুমি যখন গোপনে কল্যাণীতে এসে আমার সাথে চাণক্যদের সুদূরপ্রসারী নীলনকশার বিরোধিতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে তোমাদের গোপন সংগঠন এবং তার ভিত্তিতে স্বাধীনতার পর সেনা পরিষদ এর প্রয়োজনীয়তা এবং ভবিষ্যতে এই সংগঠনের নীতি-আদর্শ, কর্মসূচী এবং রাজনীতির রূপরেখা সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছিলে তখন আমি ভেবেচিন্তেই তোমাদের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করে যাবার শপথ নিয়েছিলাম। কিন্তু ৭ই নভেম্বরে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যার ফলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আমাকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে আমি এখনো তোমাদের নীতি-আদর্শের ভিত্তিতেই রাজনীতি করার চেষ্টা করছি। তার প্রমাণ আমার ১৯ দফা কর্মসূচি। এটাতো সেনা পরিষদের নীতি-আদর্শ অনুযায়ী প্রণীত বর্তমানে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় পরিস্থিতির বাস্তবতায় আমাকে একটু ভিন্নপথে এগুতে হচ্ছে কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি আমার কিছু পদক্ষেপ সেনাবাহিনীতে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। সেনাবাহিনীই আমার ক্ষমতার উৎস। সেইখানেই যদি আমি বিতর্কিত ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত হই আর আমার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে জাতীয় রাজনীতিতে আমি এগুবো কি করে? মুখে কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারছি তোমরা ক্রমশঃ আমার কাছ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছো কেনো! চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নিশ্চুপ হয়ে জিয়ার সাজানো বুলিগুলো শুনছিলাম আর ভাবছিলাম তিনি আসলে কি জানতে চাইছেন! চোখ তুলতেই দেখলাম জিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন জবাবের প্রতীক্ষায়। পুরানো কাসুন্দি ঘাটছেন জিয়া তার সাফাই দিতে। আমার ঠিক প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না, তবুও জবাব দিতে হবে। তাই বললাম

স্যার, আপনার বক্তব্যটা সঠিক নয়। আমরা নিজেদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছি না, পরিকল্পিত ভাবে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কোলকাতায় যখন আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করি তখনই বুঝতে পারি আপনার জনযুদ্ধ এবং রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই আপনাকে প্রকারান্তরে কিছুটা জ্ঞান দিতে চেষ্টা করতাম। এখন আপনি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং রাজনীতিও করছেন। তারপরও মনে হচ্ছে আপনার রাজনৈতিক জ্ঞানে কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে। আজ তাই কিছু কথা বলতে চাই যদি অনুমতি দেন।

বলো।

‘রাজনীতি’ কথাটাকে দুই ভাবে রাজনৈতিক দর্শন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দেখা হয়। ‘রাজার নীতি’ মানে ক্ষমতার রাজনীতি। ‘নীতির রাজা’ মানে শোষিত এবং নিপীড়িত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রাজনীতি। আপনি যখন পাকিস্তান আর্মির ইন্টেলিজেন্স স্কুলে পড়েন তখন পাঠ্য তালিকায় একটা চটি বই ছিল। বইটি লিখেছিলেন ম্যাকিয়াভেলি। নাম ‘প্রিন্স’। ক্ষমতার রাজনীতির বাইবেল এই বইটি আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন, তাই ক্ষমতার রাজনীতি সম্পর্কে আপনাকে জ্ঞান দান করার কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করিনা। কিন্তু মনে হয়, নীতির রাজা-রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞানের কিছুটা অভাব আপনার রয়েছে। তাই সেই সম্পর্কেই বলতে চাই অবশ্য যদি আপনি এর প্রয়োজন অনুভব করেন। আমি চাইছিলাম প্রসঙ্গ পাল্টাতে। গম্ভীর জিয়া বুঝেই হউক আর না বুঝেই হউক জবাবে বললেন, তিনি জানতে ইচ্ছুক।

স্যার, আপনাকে বুঝতে হবে দেশ ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে রাজনীতিকে সফল করে তোলার জন্য তিনটি উপাদান মুখ্য।

১। নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ ভিত্তিক একটি সঠিক রাজনৈতিক দর্শন ভিত্তিক দল যাতে প্রতিফলিত হতে হবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা এবং প্রত্যাশা।

২। পরীক্ষিত, নিঃস্বার্থ নিবেদিতপ্রাণ একটি নেতৃত্ব।

৩। সমাজের সব স্তর আর ক্ষেত্র থেকে তৈরি করা একদল প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী যারা জনগণের মাঝে মিশে পার্টির নীতি-আদর্শ কর্মসূচীকে যুক্তিসঙ্গত ভাবে প্রচার করে জনসমর্থন অর্জন করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে বিপ্লবের পক্ষে।এই তিনটি উপাদান অর্জন করতে হয় সংগ্রামের মাধ্যমে। ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করে এই তিনটি উপাদানের কোনোটাই হাসিল করা সম্ভব নয়। কারণ, ক্ষমতাধর ব্যক্তির আশেপাশে যারা ভিড় করে ক্ষমতা বলয়ে অন্তর্ভুক্ত হবার প্রত্যাশায়, তারা সবাই সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তির নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচির সমর্থনে মুখে ফেনা তুলে ফেলার ক্ষেত্রে জঘন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় বাহ্যিকভাবে কিন্তু তাদের বেশিরভাগই হয়ে থাকে বাস্তুঘুঘু, স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী, ধূর্ত শৃগাল আর হায়নার প্রতিভূ।

ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর তারা অতিসহজেই ‘নীতির রাজা’ রাজনীতিটাকে পালটে ফেলে ‘রাজার নীতি’ মানে ক্ষমতার রাজনীতিতে।

এই ধরনের রক্তচোষাদের কূটচক্রান্তে অনেক আন্তরিক ভাবে নীতি-আদর্শবান নেতাকে চরম মাশুল দিতে হয়েছে ইতিহাসে। সুতরাং যত বড় মাপের নেতাই হউন না কেনো, সবাইকে খুশি করে কেউই কখনো তার অভীষ্ট লক্ষ্য হাসিল করতে পারেননি। তাই সার্থক নেতা-নেত্রীদের সবাই সর্বদা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে নিজেদেরকে সার্থক জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্মানিত নেতা-নেত্রী হবার সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছেন। শত্রুমিত্রের বাছ-বিচার না করে সহবাস করা আর পানিতে নেমে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করার পরিণামটা হয় একই রকম। সেনাবাহিনীতে আপনার অবস্থান কি সে সম্পর্কে আমাদের তো কিছু জানার কথা নয়। সে সম্পর্কে আপনি নিজেই সবচেয়ে বেশি জানেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলছুট এবং বিভিন্ন মত ও পথের লোকদের জুটিয়ে যে দল আপনি বানিয়েছেন সেখানে স্বার্থের অন্তর্দ্বন্দ্ব একটি চিরস্থায়ী বাস্তবতা। সেই বিচারে আপনার দলটি কখনোই আপনার নিজস্ব নীতি-আদর্শ সেটা যাই হউক না কেনো, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে দৃঢ়ভাবে শিকড় গাড়তে আন্তরিক হবে না। অবশ্য আপনার জনপ্রিয়তাকে কি করে ভাঙ্গিয়ে নিজেদের ভাগ্য ফেরানো যায় সেই বিষয়ে তারা হবে খুবই তৎপর, যতদিন আপনার জনপ্রিয়তা থাকবে। অতিদুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে স্যার, আইয়ুব, ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতার রাজনীতির শোচনীয় পরিণতি যার ফলে একটি সম্ভাবনাময় মুসলিম দেশ ভাগ হয়ে গেলো, সেটা দেখার পরও আপনি সেই পথের অনুকরণ করে চলেছেন। এর পরিণতিটা কি হতে পারে সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা আপনার আছে। তাই এ বিষয়ে জ্ঞানদান নিষ্প্রয়োজন। কাদের পরামর্শ আর উৎসাহে আপনি এই পথ বেছে নিয়েছেন জানিনা তবে এতটুকু বুঝি এর সব দায়-দায়িত্ব একান্তভাবে আপনাকেই নিতে হবে। ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করে না। জিয়াকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। মুখায়বে তার ছাপ স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছিলো।

আচ্ছা, জেনারেল এরশাদ সম্পর্কে তোমার কি ধারণা ?

স্যার, প্রশ্নটা আমাকে করায় কিছুটা বিস্মিত হলাম। আপনারা দু’জনই বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সমসাময়িক অফিসার। অনেক বছর এক সাথেই চাকুরি করেছেন। তিনি আপনার পছন্দের নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান, তার সম্পর্কে তো আপনারই ভালো জানার কথা। আমার সাথে তার তেমন কোনও ঘনিষ্ঠতা ছিল না পাকিস্তান আমলে। ১৯৭১ সালে আমরা যখন যুদ্ধে যোগদানের জন্য পালিয়ে আসি তখন তিনি পেশাওয়ারে ৬ষ্ঠ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন এটাই জানতে পেরেছিলাম। এরপর প্রত্যাগত অফিসার হিসাবে দেখা সাক্ষাৎ হতো মাঝে মধ্যে সেনাসদরে যখন ঢাকায় আসতাম। তার ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি তার চেয়ে বেশি না হলেও আপনি কম জানেন না। স্যার, আপনি গোয়েন্দা সংস্থা ISI-তে চাকুরি করেছেন। আমি কিন্তু কোন গোয়েন্দা সংস্থাতে কখনোই কাজ করিনি। আপনি রাষ্ট্রপতি হবার পর জেনারেল এরশাদ যখন ভারতে NDC Course করছিলেন তখনই প্রথা বহির্ভূতভাবে তাকে ডবল প্রমোশন দিয়ে পরে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন। বিশদ বিচার-বিবেচনার পরই আপনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তেমনটি ধরে নেয়া অযৌক্তিক হবে না নিশ্চয়ই? যাই হউক, তার সম্পর্কে কিছু উড়ো কথা কানে এসেছে। সেটা শুনতে চাইলে বলতে পারি। অবশ্য কথাগুলো ইতিমধ্যে আপনার কানেও এসে থাকতে পারে।

আমি শুনতে চাই, তুমি বলো।

জেনারেল জিয়ার প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়ার উৎসুক্য দেখে শিশু ভাইয়ের একটা কথা মনে পরে গেলো। তিনি বলেছিলেন, যারা গোয়েন্দা সংগঠনে কাজ করে তাদের চরিত্রে সন্দেহ প্রবণতা এবং কান কথায় বিশ্বাস করার পবৃত্তি বাসা বাধে। পরে তার কোর্সমেট কর্নেল হামিদের লেখা বইতে জিয়া সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন সেটা শিশু ভাইয়ের বক্তব্যকেই সমর্থন করে। জিয়ার চরিত্র সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘জিয়া ছিলেন সন্দেহপ্রবণ মনের অধিকারী এবং কানকথায় বিশ্বাসী’। তাই কিছুটা সতর্কতার সাথেই বলা শুরু করলাম।

গুজবে প্রকাশ, এরশাদ যখন ইন্ডিয়াতে NDC করছিলেন তখন বিচক্ষণ ঝানু এক কূটনীতিক মুচকুন্দ দুবের সাথে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। ওই ব্যক্তিও তার সাথেই NDC করছিলেন। তার মাধ্যমে কোর্সকালীন সময় এরশাদের সাথে সাউথ ব্লকের ভারতীয় ক্ষমতা বলয়ের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। দুষ্ট লোকেরা বলে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW এবং South Block-এর শীর্ষস্থানীয় কিছু সংখ্যক ক্ষমতাধর ব্যক্তির সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন জনাব মুচকুন্দ দুবে যখন জানা গেলো দেশে ফিরে তিনি সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে যাচ্ছেন। তাদের বদৌলতে আমোদ-ফূর্তি করেই কোর্স শেষে এরশাদ দেশে ফেরার পর আপনি তাকে সেনাপ্রধানের পদে নিয়োগ প্রদান করেন। আমার কথাগুলো জিয়া শুনছিলেন আর গভীর ভাবে কি যেন ভাবছিলেন। সেনাবাহিনীতেও জিয়া Divide and Rule নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এর ফল যে তার জন্য বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে সেটা চিন্তা করেই হয়েতো বা তার মুখটা একটু বেশি কালো দেখাচ্ছিল। কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই জেনারেল জিয়া এরপর জিজ্ঞেস করলেন

আচ্ছা, জেনারেল মঞ্জুর সম্পর্কে তোমার ধারণা কি?

স্যার, এ ধরণের প্রশ্নের জবাব আমার চেয়ে শতগুণ বেশি আপনারই জানার কথা। সেই ক্ষেত্রে আমার মতামত জানতে চাচ্ছেন কেনো? তার সম্পর্কে আপনি যতটুকু জানেন তার চেয়ে বেশি কিছু আমার পক্ষে কি করে জানা সম্ভব! তবে Freedom Fighters এবং Repatriates দের মধ্যে ভারসম্যতা রক্ষার জন্য যে Divide and Rule নীতির প্রবর্তন আপনি করেছেন তার ফলে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটা দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আর এর পরিণতি কি হতে পারে সেটাও আপনার বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। একটা বাস্তবতা আপনাকে জানাচ্ছি। এতে আপনার কোনও সুবিধা হবে কিনা জানি না।

দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সদস্যরাই সামরিক বাহিনীতে বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেক্ষেত্রে তাদের হীনমন্য এবং দুর্বল করাটা যুক্তিসঙ্গত নয় বলেই আমি মনে করি। জেনারেল পদে উন্নতি প্রদান করে এরশাদকে সেনাপ্রধান বানানোর আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে সেটাও হয়তো বা বেশিরভাগ সেনাসদস্য এবং অফিসাররা মনে করছেন না বলেই আমার ধারণা। এই প্রসঙ্গে সত্যটা জানার জন্য আপনাকেই চেষ্টা করতে হবে। কারণ, এর চেয়ে বেশি কিছু আমার জানা নেই।

জেনারেল জিয়া বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও অনুরোধ করলেন, সবার সাথে আলাপ আলোচনার পর তার প্রস্তাব সম্পর্কে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবার জন্য আমি যাতে ঢাকায় গিয়ে সরেজমিনে সবকিছু দেখেশুনে তার সাথে দেখা করে আমাদের সিদ্ধান্তটা তাকে জানাই। এভাবেই ৪৮ ঘণ্টার সফরকালে দুই রাতে প্রায় ৫ ঘণ্টার উপর তিনি আমার সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন। তার এই বৈঠকের কারণটা ঠিক বোঝা না গেলেও তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যে অশনি সংকেত ঘনীভূত হচ্ছে সেটা পরিষ্কার বোঝা গেলো। বাসায় ফিরে এলাম।

পরদিন তিনি তার সফর সঙ্গীদের নিয়ে উত্তর কোরিয়া সফরের উদ্দেশ্যে পিয়ং ইয়ং গিয়েছিলেন। সফরটি ছিল রাষ্ট্রীয় সফর। গ্রেট লিডার কিম ইল সুং এর সাথে সাক্ষাতের পর কয়েকটা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই সফরে আমার পূর্ব নির্ধারিত সফরের অজুহাত তুলে সঙ্গী না হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে জিয়া সেটা মেনে নিয়েছিলেন। এই সফরের পর জিয়ার অনুরোধে আমি বিভিন্ন দেশে অবস্থিত সহযোদ্ধাদের সাথে দেখা করি। কর্নেল রশিদ, কর্নেল ফারুক এবং মোয়াম্মর গাদ্দাফির প্রতিনিধি লেফটেন্যান্ট সালেমের সাথেও কয়েক দফা বৈঠক হয়। কর্নেল শাহরিয়ার তার এই প্রস্তাবকে একটি কূটচাল বলে অভিমত প্রকাশ করলো। তার ধারণা, মেজর হাফিজ, ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর, লেফটেন্যান্ট ইকবাল প্রমুখদের যেভাবে তিনি নিজের মুঠিতে পুরেছেন ঠিক সেইভাবেই তিনি আমাদেরকেও তার মুঠিতে পুরে বেঁচে থাকা সেনা পরিষদের সদস্য এবং অফিসার আর সৈনিকদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি, জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা ধ্বংস করে দিতে চাইছেন যাতে আমরা ভবিষ্যতে আমাদের নিজস্ব রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়াতে না পারি। অন্যান্যদের অভিমত, বর্তমানে জেনারেল জিয়ার অবস্থান সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে তার কৃতকর্মের ফলেই। সেইক্ষেত্রে তার মতো একজন প্রতারকের পাশে সেনা পরিষদের নেতাদের দাড়ানোটা হবে আত্মহত্যার সামিল। কারণ, এতে সেনা পরিষদ সহ সামরিক বাহিনীতে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলবো। এতে ইতি টানা হবে আমাদের এতদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের সম্ভাবনা। স্বল্পভাষী মেজর নূর বললো

জেনারেল জিয়া ভরাডুবির আগে আমাদেরও শেষ করে দিতে চাইছেন। আমাদের আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছেন জিয়া এমনটি ভাবার কোনও যুক্তি নেই। তাছাড়া চাইলেও যেভাবে তিনি সেনা পরিষদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, অতি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন তিন হাজারেরও অধিক সহবিপ্লবীদের, তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে জিয়াকে বাঁচানোর কোনও দায়-দায়িত্ব আমাদের পক্ষে নেয়া কোনও কারণেই ন্যায়সঙ্গত ভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হতে পারে না। তাই আমি মনে করি, যে উদ্দেশ্যেই জিয়া এই প্রস্তাব দিয়ে থাক না কেনো, এ নিয়ে আমাদের এতোটা বিচার-বিশ্লেষণের কোনও প্রয়োজন নেই। সে আরও বললো, আমি তার সাথে আলাপ করে ভালোই করেছি। তবে একই সাথে নূর অভিমত প্রকাশ করলো, এবার ঢাকাতে গিয়ে আমাকে খুবই সতর্কতার সাথে চলতে হবে। কারণ, সে আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তিত। কিন্তু এরপরও আমাকে ঢাকায় যেতেই হবে এই ঝুঁকিটা নিয়েই তা না হলে জিয়া ভাববেন, তার বিরুদ্ধে যে অসন্তোষের ধূম্রজাল ঘনীভূত হচ্ছে সেখানেও সেনা পরিষদের সমর্থন রয়েছে। সন্দেহ প্রবণ মনের অধিকারী জিয়া ইতিমধ্যে এমনটি ভেবেও থাকেতে পারেন। যদি ভেবে থাকেন তাহলে এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই।

আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হল, আমরা আমাদের পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল থেকে রাজনৈতিক ভাবেই জিয়ার মোকাবেলা করে যাবো। সবাই একবাক্যে অভিমত জানালো, জেনারেল জিয়ার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আমি সবাইকে একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলেছিলাম, আমাদের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর জিয়া আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে যেকোনো হঠকারী উদ্যোগ নিতে পারেন। তার জন্য সবাইকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাকে তো যেতেই হবে, তবে নিরাপত্তার কারণে আমি এবার বেশি দিন ঢাকায় থাকব না। জিয়াকে রিয়েক্সন টাইম না দিয়েই ফিরে আসবো। আর যদি একান্তই আমি ফিরতে না পারি তবে বাকি সবাই মিলে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তবে দেশে কেউই ফিরবে না ডাক আসলেও। সবাই এই ব্যাপারে একমত হল। সাথী সহযোদ্ধা ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনার পর তাদের মতামত জেনে আমি ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করলাম।

সেনা পরিষদের বেছে নেয়া নেতা-সদস্য ছাড়াও অন্যান্য মহলের পরিচিত বিশ্বস্তজনদের সাথে দুই একদিনের দেখা সাক্ষাতের পরই আমার কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেলো। ভারতের কাছে জিয়ার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর মধ্যেও তার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে দ্রুত। যদিও সাধারণ জনগণের কাছে তার সস্তা জনপ্রিয়তায় তখনও তেমন ধস নামেনি তবুও ক্ষমতার ষড়যন্ত্রে তার পর্বের সমাপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি এই সুযোগে প্রগশের সাংগঠনিক অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করে নিশ্চিত হলাম আমাদের টাইম ফ্রেম মোতাবেক প্রগশ জাতীয় রাজনীতির মূলধারায় সহসাই আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হবে তৃতীয় শক্তি হিসাবে। সব দেখেশুনে ও বুঝে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়ার সাথে দেখা করে তাকে জানিয়ে দিলাম, সেনা পরিষদের বিদেশে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনকারী নেতারা মনে করছেন, তার প্রস্তাব মেনে নিয়ে তার সাথে একাত্ম হয়ে রাজনীতি করা এখন আর তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সেইদিনই কাউকে না জানিয়েই ফিরে এলাম নিজ কর্মস্থল বেইজিং-এ। এরপর বেশ কয়েকটা বেসামরিক, সামরিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল চীন সফরে আসে। প্রতিনিধি দলের প্রায় সব সদস্যরাই পরিচিত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সফরটি ছিল দেশের নব নিযুক্ত আর্মি চীফ জেনারেল এরশাদের সফর।