বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস

আমাদের দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর ইতিহাস তৃতীয় বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের সামরিক বাহিনীর মতো নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সামরিক বাহিনী গঠন করা হয় মূলত পরীক্ষিত জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। পরে তাতে যোগদান করেন মুক্তিপ্রাপ্ত প্রত্যাগত সেনা অফিসার আর সৈনিকরা। ফলে দেশের সামরিক বাহিনীর গুণগত মান ও শক্তি বৃদ্ধি পায়। প্রত্যাগতদের বেশিরভাগ সদস্যরাও ছিলেন জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী। এই পরিপ্রেক্ষিতে অতি সহজেই সেনা পরিষদকে একটি নীতি-আদর্শ ভিত্তিক সংগঠন হিসাবে গড়ে তুলতে আমাদের বেগ পেতে হয়নি। একই ভাবে জাতীয় পরিসরে সামরিক বাহিনী তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলতে সক্ষম হয় প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে। প্রতিবারই সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত না হয়ে জনগণের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থকেই সমর্থন করে এসেছিলো সাহসিকতার সাথে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। এই সাহসের উৎস ছিল নৈতিকতা এবং নিঃস্বার্থ নিখাদ দেশপ্রেম এবং জনদরদী মানসিকতা, ক্ষমতার লোভ নয়। দেশ ও জনকল্যাণের প্রশ্নে দেশের সামরিক বাহিনী ছিল আপোষহীন। তাই মুজিব সরকার ব্যর্থ হয়েছিলো সামরিক বাহিনীকে নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করতে। মেজর জলিলকে যখন অন্যায় ভাবে গ্রেফতার করা হয় তখন অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে সেনাবাহিনী। জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে যখন বের করে দেবার চেষ্টা করা হয় সেই ষড়যন্ত্রকেও রুখে দেয় সচেতন সেনাসদস্যরা। এরপর জিয়ার বয়োজ্যেষ্ঠতার রখেলাপ করে যখন শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান বানায় মুজিব সরকার তখনও গর্জে ওঠে সেনাবাহিনী সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তীব্র উষ্মাকে প্রশমিত করার জন্য লেখকের মাধ্যমেই একটা সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান। সেনাবাহিনীর প্রস্তাবকে মেনে নিয়ে সরকারকে সৃষ্টি করতে হয়েছিল DCOAS পোস্ট আর তাতে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার জেনারেল জিয়াকে শফিউল্লাহর সম পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী কথা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন শফিউল্লাহর দুই বছরের টার্ম শেষে জিয়াকেই আর্মি চীফের পদে অধিষ্ঠিত করা হবে। এর ফলেই, জিয়াকে শফিউল্লাহর অধীনস্থ স্টাফ অফিসারে পরিণত করার সরকারের অভীষ্ট লক্ষ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। জেনারেল জিয়া তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সেনাবাহিনীতে বহাল থাকতে সমর্থ হন সময়ের প্রতীক্ষায়। বিনীতভাবে উল্লেখ করছি, লেখক সেনা পরিষদের একজন নেতা হিসাবে এইক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিলো।

চোরাচালান রোধ, অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা অবস্থার স্বাভাবিকীকরণ, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য যখনই বেসামরিক সরকারের সাহায্যে সামরিক বাহিনীকে সরকার তলব করে পাঠিয়েছে, প্রতিবারই নিরপেক্ষ কঠোর সাঁড়াশি অভিযানে সব অপকর্মের মূল অপরাধী হিসাবে ধরা পড়ে সরকার এবং সরকারী দলের প্রভাবশালী নেতা-নেত্রী, রুই-কাতলা এবং চাঁইরা। ফলে দলীয় চাপে সামরিক বাহিনীকে সফল অভিযানের পরও মাঝপথেই তাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার অপচেষ্টা করতে হয়েছিলো প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রীকে। পক্ষান্তরে সামরিক বাহিনীর গণমুখী দেশপ্রেম প্রমাণিত হয় দেশবাসীর কাছে। লাগামহীন দুর্নীতির ফলে তারা বুঝতে পারেন ‘শেয়ালের কাছে মুরগি বাকি’ পড়াতেই বিশ্বপরিসরে বাংলাদেশের পরিচয় হয়ে উঠেছিলো ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসাবে। নৈতিক চরিত্রে বলিয়ান জাতীয় সামরিক বাহিনীকে বিশ্বাসযোগ্য না মনে করেই ভারতের প্ররোচনায় ভীত সন্ত্রস্ত মুজিব সরকার ভারতের সাহায্যে সামরিক বাহিনীর বিকল্প হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন তার রাজনৈতিক ক্যাডার, কাদেরিয়া বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে কুখ্যাত ‘জাতীয় রক্ষীবাহিনী’। এ সমস্ত সত্যগুলো সম্পর্কে জানতে হবে বর্তমান এবং ভবিষৎ প্রজন্মকে। ইতিহাস বিশারদের জন্যও প্রয়োজন এই সমস্ত বস্তুনিষ্ঠ উপাদানগুলো যাতে করে তারা বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস লিখতে পারেন। সত্যভিত্তিক ইতিহাস এবং ঐতিহ্যই হচ্ছে যেকোনো জাতির অগ্রযাত্রার দিকনির্দেশক এবং প্রাণশক্তির উৎস। ১ম এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর সব কয়টি সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তি ধ্বংসের পর্যায়ে পৌঁছানোর পর পৃথিবীর প্রতি প্রান্তে স্বাধীনতার দাবি প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে যা দমানোর মতো শক্তি এবং সামর্থ তাদের ছিল না। সেই প্রেক্ষাপটে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদেরই সৃষ্ট স্থানীয় কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিত্বকারীদের স্বাধীনতার চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে তাদের মাধ্যমে দাসখত লিখিয়ে নিয়ে নব্যস্বাধীন দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে বিদায় নেয়। তাদের প্রভুদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জাতীয় শাসকগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং আর্থসামাজিক ক্ষেত্রের সর্বস্তরে তাদের দোসরদের নিয়োগ করে দেশ ও জাতীয় সম্পদের ৯০% এর বেশি এবং উৎপাদনের উপাদানসমূহ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। ফলে এই শাসক ও শোষকগোষ্ঠী দেশের জনগোষ্ঠীর ১ থেকে ২ শতাংশের বেশি না হওয়া সত্ত্বেও আজঅব্দি তারাই হয়ে আছে দেশ ও জাতির কর্ণধার আর ৯৮% তাদের আর্থ-সামাজিক নাগপাশের নিষ্পেষণে পরিণত হয়ে রয়েছে বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত দাসে। এই সব রক্তচোষাদের অপশাসন, অবাধ দুর্নীতি, শোষণ এবং ক্ষমতার লোভে অসম চুক্তির মাধ্যমে জাতীয় সম্পদ বিদেশী প্রভুদের হাতে তুলে দিয়ে দেশগুলোকে শুধু দেউলিয়াই করে তোলা হচ্ছে তাই নয়, ক্রমান্বয়ে জাতির মেরুদণ্ডও ভেঙ্গে ফেলে দেশ এবং জাতিকে করে তোলা হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে পরনির্ভরশীল। নিজস্ব সত্তা বিলীন হওয়ার চক্রান্তে জনগণের পক্ষে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না এই দেশদ্রোহী গোষ্ঠীর বিপক্ষে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাতানো খেলার নির্বাচনের প্রহসন মূলক প্রক্রিয়ায় দেশ এবং জাতীয় উন্নয়নের কথা যারা সরবে উচ্চারণ করেন তারা সবাই ঐ গোষ্ঠীরই সমগোত্রীয় সেটা বলাই বাহুল্য। শেখ মুজিব প্রণীত ভাষাভিত্তিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের দ্বারা জাতির মধ্যে সৃষ্টি করা হল বিভক্তি। সমাজতন্ত্রের ধুয়া তুলে রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়া হল দলীয় করণ ও অবাধ লুটপাটের জোয়ারে। গণতন্ত্রের বুলির আড়ালে ক্রমান্বয়ে মানবিক অধিকার, বাক-স্বাধীনতা, প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে টুঁটি চেপে হত্যা করা হল সাংবিধানিক আইন তৈরির মাধ্যমে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য আশাতীত আন্তর্জাতিক অনুদান এবং সাহায্য সহযোগিতার পরও মুজিবের স্বল্পকালীন শাসন আমলেই বাংলাদেশ বিশ্বপরিসরে ‘তলা বিহীন ঝুড়ি’ খেতাবে ভূষিত হয়। ১৯৭৪-এর লুটেরাদের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারাতে হয়েছিল অগুণতি অসহায় আবাল, বৃদ্ধ, বণিতাকে। বাসন্তীকে লজ্জা নিবারণ করতে হয়েছিলো মাছ ধরার জাল দিয়ে। দলীয়করণের ফলে নির্জীব হয়ে ভেঙ্গে পরে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সমাজে ধর্মহীনতার বীজরোপণ করে নৈতিকতার অবক্ষয়ের আত্মঘাতী সর্বনাশ ঘটিয়েছিলেন শেখ মুজিব। এই সমস্ত দেশ ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপের ফলে দেশ জুড়ে সৃষ্টি হয় এক সর্বনাশা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। মুজিবের কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতি। এমনই ‘সোনার বাংলা’ই উপহার দিয়েছিলেন মুজিব জাতিকে তার শাসনকালে। এরপরও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে দেশে প্রবর্তন করেন একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক বাকশাল। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের পরিবর্তে দেশে চালু করেন প্রেসিডেন্সিয়াল ফর্মের গভর্নমেন্ট আর নিজেকে দেশের আজীবন রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষিত করার উদ্যোগ নেন। সেনা পরিষদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের দেশপ্রেমিক নেতাকর্মী এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও উচ্চপর্যায়ের সরকারি আমলা, সমাজপতিদের অনেকের কাছেই তারা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। বিশ্বস্তজনদের সাথে আলোচনা করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের মনোভাব, বিশ্লেষণ এবং সরকার এবং সরকারী দলের অভ্যন্তরীণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর এবং তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন সেনা পরিষদের নেতৃবৃন্দ। শুধু তাই নয়, আলোচনাকালে বেশিরভাগ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের বিশ্বস্ত নেতা-কর্মীরা অকপটে বলেছিলেন, এই স্বৈরতান্ত্রিক বাকশালী সরকারের পতন ঘটানোর দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবে বর্তায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উপর দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে। কিন্তু সেই সময়ের বাস্তবতায় যেভাবে নৃশংসতার সাথে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নিষ্পেষণে সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে শক্তিহীন করে ফেলা হয়েছিলো সেই পরিপ্রেক্ষিতে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ও তখনকার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তারা বলেছিলেন, এই অবস্থায় একটি মাত্র পথেই বাকশাল সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব যদি সামরিক বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যরা দেশ ও জাতীয় স্বার্থে কোনও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন তবে তাদের সেই উদ্যোগকে শুধু জাতীয়তাবাদী বিরোধী রাজনৈতিক দল, সংগঠন, গ্রুপই নয়, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন জানাবেন। সেনা পরিষদের নেতারা গণসংযোগ করছিলেন বিশেষ সতর্কতা এবং গোপনীয়তা রক্ষা করে। এইভাবে অর্জিত তথ্য ও খবরাখবরের চুলচেরা বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করেই সেনা পরিষদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল ১৫ই আগস্টের সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করে মুজিব প্রণীত এক দলীয় বাকশালী স্বৈরশাসনের নাগপাশে আবদ্ধ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে জাতিকে মুক্ত করা। উন্মোচিত হয়েছিলো ‘৭১ এর চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের রুদ্ধ দুয়ার। সেই উন্মোচিত দুয়ারকে পুনরায় বন্ধ করে দেবার জন্যই ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল শাফায়াতকে ছকের গুঁটি হিসাবে ব্যবহার করে ভারতীয় ষড়যন্ত্রে ঘটানো হয়েছিলো ২-৩ নভেম্বরের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’দাতা। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্রকেও ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছিলো ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এই বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানেও অগ্রণী এবং মূলশক্তি ছিল সেনা পরিষদ। ৭ই নভেম্বরের সফল বিপ্লব দ্বিতীয় বারের মতো রুদ্ধদ্বার পুনরায় খুলে যায়। ধাপে ধাপে সেনা পরিষদের নীতি-আদর্শের আলোকে প্রণীত কর্মসূচির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয় আল্লাহ্তালার অসীম করুণায়। আমরা ভেবেছিলাম, দুর্গম চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অনেক ত্যাগের মাধ্যমে বিপ্লবের পথে পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা শেখ মুজিবের স্বৈরচারী সরকার এবং কুচক্রী খালেদগংদের ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনা পরিষদ যখন তাদের উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছে তখন বাকি কর্মসূচি অতি সহজেই কার্যকরী করতে পারা যাবে। আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করে তার ফসল পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে ৮ কোটি বাংলাদেশী নাগরিকের ঘরে ঘরে। এই সার্থকতায় শহীদ সহযোদ্ধাদের কাছে করা ওয়াদা পূরণ করাও সম্ভব হবে আমাদের পক্ষে।

কিন্তু জেনারেল জিয়ার অবিশ্বাস্য বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ৭ই নভেম্বরের বিজয়ের পরই সেই আশা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মতোই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়! জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসানোর পরে তিনি শুধু সেনা পরিষদের বৈপ্লবিক নীতি-আদর্শের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করলেন তা নয়, তিনি আমাদের সাথে তার যে সম্পর্ক ছিল সেটাও অস্বীকার করতে কুণ্ঠিত হলেন না সমঝোতার রাজনীতির স্বার্থে। রাজনীতি এবং সমাজ বিজ্ঞানের ন্যূনতম জ্ঞানের অভাবে অর্বাচীন জেনারেল জিয়া এবং তার পরামর্শদাতারা ভেবেছিলেন কয়েক হাজার বিপ্লবী সেনা সদস্যদের হত্যা করলেই বৈপ্লবিক নীতি-আদর্শের মৃত্যু ঘটবে! বিপ্লবীরা মারা যায়, কিন্তু বিপ্লব মৃত্যুঞ্জয়ী, চিরঞ্জীব। রাজনৈতিক শাস্ত্রের এই প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কেও তিনি ও তার দোসররা ছিলেন অজ্ঞ। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো বজায় রেখে এবং তার সৃষ্ট কায়েমী স্বার্থবাদীদের সাথে সমঝোতা করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধন করা কোনও কালেই সম্ভব হয়নি। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর পতনের পর স্বাধীনতা প্রাপ্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে কয়েকটি রাষ্ট্রের জনগণ সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে সক্ষম হয়েছেন তার মূল কারণ হচ্ছে, ঐ সমস্ত সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো পরিচালনা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন বলিষ্ঠ, পরীক্ষিত জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদবুদ্ধ আত্মত্যাগী দেশপ্রেমিক বিপ্লবীরা। তারা আপোষহীন বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে ঘুণে ধরা রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোকে সময়োপযোগী করে ঢেলে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তুলেছিলেন সামন্তবাদের অবশেষ এবং মুৎসুদ্দিগোষ্ঠীকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে। একইভাবে তারা রাষ্ট্র এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নিয়ে আসেন বৈপ্লবিক আমূল পরিবর্তন যাতে প্রতিফলিত হয় দেশবাসীর আশা আকাঙ্ক্ষার। এরই ফলে প্রতিটি নাগরিক সক্ষম হন প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে নিজস্ব মেধা এবং কর্মদক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবার সমঅধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত করণের মাধ্যমে। এভাবেই স্বাধীনতা হয়ে ওঠে অর্থবহ এবং একই সাথে ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদের শিকড় প্রোথিত হয় সমাজের সর্বস্তরে।

বাংলাদেশের জনগণের জন্য সেই সম্ভাবনার দ্বার আমরা উন্মোচিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম সব বাধা পেরিয়ে কিন্তু চূড়ান্ত ভাবে বিপ্লবকে বিজয়ী করতে ব্যর্থ হলাম! যেদিন বাংলাদেশের সত্য ইতিহাস লেখা হবে, সেদিন ইতিহাসবিদরা বস্তুনিষ্ঠ তথ্য যাচাই করে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন সেই পরাজয়ের জন্য দায়ী জেনারেল জিয়া। যুদ্ধকাল থেকে অপাংক্তেয় এবং অবহেলিত স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াকে যেই বৈপ্লবিক শক্তি স্বাধীনতার পর সব প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে যেই ধারায় জেনারেল জিয়াকে আর্মি চীফ হিসেবে ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলো সেই ধারা সৃষ্টিকারী সহ-বিপ্লবীদের সাথে করা ওয়াদার বরখেলাপ না করে তাদের সাথে একাত্ম হয়ে নির্ধারিত নীতি-আদর্শ ভিত্তিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে যদি তিনি আগুয়ান হতেন তবে বিপ্লবের লক্ষ্য হাসিল করার সম্ভাবনা ছিল সুনিশ্চিত। কিন্তু সঠিক পথ থেকে স্বেচ্ছায় জিয়া যখন নিজেকে সরিয়ে নিয়ে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জাতীয় শত্রুদের সাথে সমঝোতার অসৎ রাজনীতির সূত্রপাত ঘটিয়ে ভুলপথে চলতে থাকলেন তখনই সাময়িকভাবে পরাজিত হল বিপ্লব এবং বিপ্লবীরা। দেশের মানুষকে বঞ্চিত করা হল সত্যিকারের স্বাধীনতার ফল ভোগ করার নিশ্চিত সম্ভাবনা থেকে। দেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের মানসকন্যা শেখ হাসিনা কিন্তু রাজনীতিতে আসার আগেই দুনিয়াকে জানান দিয়ে এসেছিলেন, ‘আমি রাজনীতিকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে ঘৃণা করি, তারপরও আমি রাজনীতি করতে যাচ্ছি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য’।

রক্তপিপাসু শেখ হাসিনা সেই প্রতিহিংসা সংবিধান এবং আইন বহির্ভূতভাবে মেটাতে সক্ষম হয়েছিলেন ২৮শে জানুয়ারী ২০১০ সালে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বিপ্লবের নেতৃস্থানীয় ৫ জন বীরসেনানী কর্নেল ফারুক, কর্নেল শাহরিয়ার, কর্নেল মহিউদ্দিন, কর্নেল একেএম মহিউদ্দিনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং মেজর হুদাকে নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করে। এদের সবাই ছিল অসীম সাহসী অকুতোভয় দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। বিশ্ববিবেকের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে হাসিনার পক্ষে এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিলো খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোটের পরোক্ষ সমর্থনের কারণে। হাসিনার সেই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংসদে বসে থাকে জাতীয়তাবাদের চ্যাম্পিয়ন বিএনপি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ধ্বজাধারী জামায়াতে ইসলামী ১২০ টিরও বেশি সিট নিয়ে এবং সংসদ থেকে কোন প্রতিবাদ না করে বেরিয়ে আসে। তারা বোধ করি ভুলে গিয়ে ছিল, নেকড়ে বাঘ আর ছাগল ছানাদের গল্পটি। এরপরও কথা থাকে। ২০০১ সালে দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি সিটে জিতে ক্ষমতা গ্রহণ করে খালেদা জিয়ার জোট সরকার ‘অপারেশান ক্লিন হার্ট’ এর ব্যাপারে একটি সাংবিধানিক অব্যাহতি আইন পাস করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর বিপ্লব সম্পর্কে যে সাংবিধানিক অব্যাহতি আইন পাস করা হয়েছিলো জেনারেল জিয়ার আমলের সংসদে যেটা ১৯৯৬ এর নির্বাচনে জিতে হাসিনার সরকার বেআইনি ভাবে বাতিল করে সফল বিপ্লবের নেতাদের বিরুদ্ধে ‘খুনের’ মামলা দায়ের ও প্রহসনমূলক বিচার শুরু করে যার ১নং আসামী ছিলেন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং ২নং আসামী ছিলেন জেনারেল জিয়া, সেই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ না করে উল্লেখিত অব্যাহতি আইনটি পুনর্বহাল করা থেকেও বিরত থাকে বেগম খালেদা জিয়ার জোট সরকার।

এরপরও প্রশ্ন থাকে, BDR Massacre-এর পর তাদের ভূমিকা কি ছিল? সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই ধরণের হত্যাযজ্ঞের পর কেনো এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সরকার পতনের দুর্বার গণ আন্দোলন গড়ে তোলা হল না? একিভাবে খালেদার জোট নীরব ছিল বিডিআর হত্যাযজ্ঞের পরও তাই এখন যখন হিংস্র ও প্রতিহিংসা পরায়ণ হাসিনা এক স্বৈরতান্ত্রিক নায়িকাতন্ত্র কায়েম করে তাদের সমূলে উপড়ে ফেলার চেষ্টায় ভারতের সাহায্যে নির্দ্বিধায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন এবং বিভিন্ন অঘোষিত চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে প্রায় পরিণত করে ফেলার শেষপর্যায়ে পৌঁছেছেন তখন তারা ভারত সহ বিশ্ব দরবার এবং জনগণের কাছে নাকি কান্না কেঁদে তাদের বাঁচাতে আকুতি মিনতি করছেন, এমনকি দেশের সামরিক বাহিনীকেও মিনতি জানাচ্ছেন আকারে ইঙ্গিতে তাদের চামড়া বাঁচানোর জন্য। কিন্তু না জনগণ না দেশের সামরিক বাহিনী কিংবা ভারত এবং বিশ্ব মোড়লরা তাদের আবেদনে সাড়া দিচ্ছেন। এর কারণ হচ্ছে, আজ সবার কাছেই এইসব বর্ণচোরাদের আসল রূপ ধরা পড়ে গেছে। তারা এদেরকে ‘সিক্কার এপিঠ আর ওপিঠ’ ভাবছেন। এটাই হচ্ছে আল্লাহ্-র বিধান। যিনি জাতীয় শত্রু শেখ হাসিনাকে সমাদর করে দেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন, সেই জেনারেল জিয়া ভুলের মাশুল গুণে হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার মাত্র ১৩-১৪ দিনের মাথায় কবরে চলে যান মর্মান্তিক ভাবে। তার অনুসারী দোসররাও আজ সেই পথেরই পথিক। ব্যক্তি বিশেষের ভুলের মাশুল সবাইকেই দিতে হয়। কিন্তু ব্যক্তির ভুলের মাশুল আজ দিতে হচ্ছে পুরো দেশ আর জাতিকে এটাই প্রণিধানযোগ্য। এ প্রসঙ্গে ইতি টানার আগে একটি কথা পাঠকদের বলতে চাই, সাধারণ ভাবে বলা হয় বা প্রচারণা চালানো হয়ে থাকে, বিপ্লব মানে- বিদ্বেষ, হিংসা, সহিংসতা, মারামারি, কাটাকাটি, প্রতিহিংসামূলক রক্তক্ষরণ ইত্যাদি। কিন্তু বিপ্লবের আসল মানেটা তা নয়। বিপ্লবের মানে হচ্ছে, আপোষহীন ত্বরিত পরিবর্তন। আর সাচ্চা বিপ্লবীরা হচ্ছে সেই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার কর্ণধার এবং ক্রিয়ানক।