প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে খালেদা জিয়ার সরকারের পাশে সেনা পরিষদ
বিএনপি জোট সরকার গঠনের পরপরই এক প্রলংকারি ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পরলো উপকূলীয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল উড়ির চর অঞ্চল। টেলিযোগাযোগ সহ সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে পরেছে। ঢাকার সাথে বহির্বিশ্বের কোনও যোগাযোগ নেই। বাংলাদেশের সরকারের কাছে ত্রাণকার্য পরিচালনা করার মতো কোনও সঙ্গতিও নেই। অগুন্তি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, বাস্তুহারা অবস্থায় জলবন্দী হয়ে পরেছে হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশুসহ আবাল বৃদ্ধ বণিতা। এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করা নবগঠিত সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দেখা দিলো। দিশাহারা সরকার! এই বিপর্যয়ের হাত থেকে দুর্গতদের উদ্ধার করতে না পারলে পতন অবধারিত। খালেদা সরকারের অবস্থা টালমাটাল, আতংকগ্রস্ত সমগ্র দেশবাসী। অপ্রত্যাশিত ভাবে কামাল সিদ্দিকি আমাদের বাসায় সশরীরে এসে উপস্থিত হয়ে জানালো প্রধানমন্ত্রী আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন বিশেষ জরুরী প্রয়োজনে। যেহেতু টেলিফোন কাজ করছে না তাই তাকে এভাবে নিজেকেই আসতে হয়েছে। কোথায় যেতে হবে?
সুগন্ধায় তার কার্যালয়ে, তিনি অধীর অপেক্ষায় রয়েছেন।
এত জরুরী তলব কেনো, বিষয়টা কি? সেটা তার মুখ থেকেই শুনবি, চল। তা না হয় শুনবো, কিন্তু সুগন্ধায় মৌমাছির মতো ভনভন করা নানা বর্ণের নানা ধরণের লোকজনদের ভিড় ঠেলে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে যেতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছি।
অস্বস্তির কারণটা ঠিক বুঝতে পারছিনা। সেটা তুই বুঝবিও না, চল।
পৌঁছালাম সুগন্ধায়। রানী এলিজাবেথ যখন পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন তখনএই মনোরম ভবনটি রাণীর থাকার জন্য বিশেষ ভাবে বানানো হয়েছিলো মানুষে গিজগিজ করছে সুগন্ধা।কামালের গাড়ী গিয়ে থামলো পোর্টিকোতে। গাড়ী থেকে নেমে ত্বরিত ঢুকে পড়লাম সুগন্ধার ভেতরে। কামাল আমাকে নিয়ে একটি ঘরে গিয়ে ঢুকল, পথে অনেকেই সালাম ঠুকল। ঘরে অপেক্ষায় ছিল সাব্বিহউদ্দিন। ম্যাডামকে খবর দাও। তিনি অপেক্ষাতেই আছেন। চলুন।বলে সাব্বি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল যেখানে খালেদা জিয়া অবস্থান করছিলেন। আমরা প্রবেশ করতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সালাম জানাতেই তিনি একটা সোফায় বসে ইশারায় আমাকে পাশের সোফাটাতে বসতে বললেন। পাশেই রাখা দু’টি ভিক্টোরিয়ান চেয়ারে বসল কামাল ও সাব্বি। গুরুগম্ভীর পরিবেশ। ছুটিতে ভাগ্যিস আপনি ঢাকার বাইরে যাননি, তাহলে তো আপনার সাথে যোগাযোগই করা সম্ভব হতো না। ভূমিকার পর আসল বক্তব্য শুরু করলেন প্রধানমন্ত্রী সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় সরকারের জন্য এমন এক সমস্যার সৃষ্টি করেছে যার সমাধানের সামর্থ সরকারের নেই। পুরো দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরেছে। এই অবস্থায় সরকার যদি ত্রাণকাজ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যর্থ হয় তাহলে সরকারের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পরবে। আমাদের বিমান বাহিনী এবং সেনা বাহিনীর কাছে যেসব হেলিকপ্টার রয়েছে সেগুলো বিধ্বস্ত এলাকায় যেতেই পারছে না। এই অবস্থায় কামাল আর সাব্বির পরামর্শ অনুযায়ী আপনাকে ডেকে এনেছি। ভাই, আমি আকুল আবেদন জানাচ্ছি আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করে দেখুন যদি কোনও উপায় বের করা যায়।
আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছেন না, সেইক্ষেত্রে আমার মতো একজন অতি সাধারণ মানুষের পক্ষে কি করা সম্ভব সেটা ঠিক বুঝতে পারছিনা ভাবী!
আমি জানতে পেরেছি বিদেশে আপনার অনেক ক্ষমতাশালী বন্ধুবান্ধব আছেন, তাদের মাধ্যমে কোনও রাস্তা বের করা সম্ভব নয় কি? আমি চুপ করে আছি দেখে বেগম জিয়া আবারও অনুরোধ জানালেন প্লিজ ভাই, চেষ্টা করে দেখুন। শুধু সরকারের জন্য নয়, অসহায় ক্ষতিগ্রস্তদের স্বার্থে! কিন্তু ভাবী, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে অকেজো হয়ে পরেছে সেক্ষেত্রে এখান থেকে বিদেশে যোগাযোগ করাও তো সম্ভব নয়। আপনার সুবিধা মতো বাইরে যেকোনো দেশে গিয়ে যোগাযোগ করুন। আজই বেরিয়ে পড়ুন। কামাল, আপনি সব বন্দোবস্ত করে দিন।
আপনার অনুরোধ রক্ষা করে আমি আমার সাধ্যমত সর্বাত্মক চেষ্টা করবো, কিন্তু ফলাফল কি হবে সে সম্পর্কে আমি কিছুই বলতে পারছি না। তবে আপনাকে কথা দিতে হবে, আপনি যে আমাকে এমন একটি স্পর্শকাতর গুরু দায়িত্ব দিচ্ছেন এই কথাটা আমাদের চারজন ছাড়া অন্য কেউ কখনো জানতে পারবে না। ফলাফল যাই হউক না কেনো।
কথা দিলাম। ধন্যবাদ। এবার তাহলে আসি। যদি সম্ভব হয় চেষ্টা করবো আজই বেরিয়ে পড়তে।
বিদায় নিয়ে তিনজনই এসে বসলাম কামালের ঘরে। আচ্ছা কামাল, এ সমস্তের মানে কি? প্রধানমন্ত্রীর কাছে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছিস তোরা, সারা বিশ্ব আমার ইচ্ছামত চলছে? প্রধানমন্ত্রীকে এ ধরনের পড়া পড়িয়ে আমাকে বিব্রত করে বন্ধুত্বের ভালোই প্রতিদান দিচ্ছিস কিছুটা রেগেই বললাম। সাব্বি মাথা নিচু করে এমন ভাবে নিশ্চুপ বসেছিল যেনো চোর ধরা পড়ে গেছে। ইতিমধ্যে বেয়ারা এসে চা-নাস্তা পরিবেশন কোরল। সাব্বি বললো
কামাল ভাই, আমার এক বন্ধুর ট্রাভেল এজেন্সি আছে। তার কাছে লোক পাঠালে হয়তো আজই ব্যাংকক পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেখান থেকে তিনি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারবেন।
হ্যাঁ, তুমি নিজেই যাও। সাব্বি বেরিয়ে যাবার আগে জানতে চাইল টিকেটটা কি সঙ্গে করেই নিয়ে আসবো? অবশ্যই, যদি সম্ভব হয়। সাব্বি চলে যাবার পর ঘরে রইলাম শুধু আমরা দু’জন। কামাল ইন্টারকমে কাকে যেন হুকুম দিল যতক্ষণ তার রুমে গেস্ট রয়েছেন ততক্ষণ তার রুমে কাউকে যেন ঢুকতে না দেয়া হয়। বন্ধু, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে নির্বাচন পর্যন্ত পর্দার অন্তরালে তুই যে ভূমিকা রেখেছিস সে সম্পর্কে ম্যাডাম ছাড়া অন্য কেউই অবগত নয়। তবে তার কিছুটা আমি আন্দাজ করতে পেরেছি। রসিকতা করে বললাম
পিটার কুস্টার কানে কানে কিছু বলেছে নাকি? দু’জনেই হেসে উঠলাম।
কত টাকার দরকার?
কিছু ক্যাশ ডলার দিয়ে দে, তাতে না কুলোলে Credit Card ব্যবহার করবো। ফিরে এসে সব হিসাব তোকে কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দেবো। That’s not important really. To be honest, আমাকে তোরা বিশেষ করে তুই বিস্মিত করেছিস।
কেনও?
১৫ই আগস্ট বিপ্লবের চেতনা ও তোদের প্রতি যে ধরনের নিষ্ঠুর অবিচার এবং বিশ্বাসঘাতকতা জিয়া করেছেন এরপরও তোরা জাতির প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে নিঃস্বার্থ ভাবে সাধ্যমতো ইতিবাচক অবদান রেখে যাচ্ছিস কোনও প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়াই। এই নিঃস্বার্থ ত্যাগের সঠিক মূল্যায়ন কি এই দুর্ভাগা জাতি করবে কখনো!
ভুল বললি। প্রতিদানের প্রত্যাশা অবশ্যই আছে। সেটা হল, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের যে শপথ আমরা নিয়েছিলাম সেই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেই সংগ্রামে নিজেকে আহূতি দিতে কুণ্ঠিত হব না যতদিন বেঁচে থাকবো। সংঘটিত ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর-এর ঐতিহাসিক সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর সেনা পরিষদের নেতৃত্ব জেনারেল জিয়াকে পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত করে। সেই জিয়াই পরে সামরিক বাহিনীতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ধুয়া তুলে সেনা পরিষদের নিবেদিতপ্রাণ,পরীক্ষিত তিন হাজারেরও বেশী দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যকে ষড়যন্ত্রমূলক নারকীয় হত্যাযজ্ঞে যেভাবে হত্যা করেন সেটাই আমার বক্তব্যের পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ নয় কি? সেনা পরিষদের সাথে যে অন্যায় জিয়া করেছিলেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লক্ষে তার শাস্তি তো তিনি এড়াতে পারেননি যদিও পরকালের বিচারটা এখনও বাকি রয়েছে। আর একটা কথা তোকে বলতে চাই,
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি মোনাফেকি, প্রতিহিংসা পরায়ণতা এবং মিথ্যাচারের উপর ভিত্তি করে কোনও রাজনীতিই বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। মিথ্যার বেসাতি সাময়িক চমক সৃষ্টি করতে পারে বটে, কিন্তু অল্প সময়েই সেটা ফিকে হয়ে যায়। অন্যদিকে সত্য চিরভাস্বর।
ডালিম, তুই তো সব সময় বলে থাকিস অতীতের দিকে না চেয়ে ভবিষ্যতের দিকে দেখা উচিৎ। তাহলে চীন সফরকালে জিয়া চাচার(আমার আব্বা) উপস্থিতিতে তোকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘Let us forget and forgive and start afresh’ তার সেই প্রস্তাব তোরা প্রত্যাখ্যান করলি কেনো?
অতীত নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা আমাদের অভ্যাস নয় ঠিকই, তবে অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা না নিলে ভবিষ্যতে সঠিক পথে এগুনো কিভাবে সম্ভব? তার উক্তি ‘Let us forget and forgive and start afresh’, ছিল বর্ণচোরার আর একটা কুটিল চাল আমাদের ফাঁদে ফেলার। আগস্ট আর নভেম্বরের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর জাতীয়শত্রু আওয়ামী-বাকশালী চক্র যখন বিলুপ্তির পথে তখন ভারতের সাথে সমঝোতার পর তাদের মানসকন্যা হাসিনাকে ভারত থেকে সসম্মানে ফিরিয়ে এনে তার নেতৃত্বে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করে জাতীয় রাজনীতিতে মৃতপ্রায় আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করে সহ-অবস্থানের রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জেনারেল জিয়া। সেই বাস্তবতার নিরিখে আমাদের পক্ষে তার সাথে নতুন করে কি শুরু করা সম্ভব হতো? কিছু মনে করিসনে, তুইও একজন দেশপ্রেমিক তবে তোর আর আমাদের মধ্যে একটু ফারাক আছে দোস্ত। তুই হলি চোখ-কান খোলা রেখে চলায় অভ্যস্ত একজন দেশপ্রেমিক, আর আমরা হচ্ছি ‘৭১-এরস্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আপোষহীন নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক। আমার কথায় কামাল বিব্রত বোধ করছিলো। তাই সান্ত্বনা দিতে বললাম এটাও আমাদের জানা আছে তুই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন, বুদ্ধিমান, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একজন চৌকস আমলা। তাই তুই দেশি-বিদেশী বিভিন্ন মহলের সুনজরে রয়েছিস।
আমাদের তোর মতো Credentials নাই ভাই। তাই আমাদের একমাত্র নিজেদের সীমিত বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করেই বাঁচতে হচ্ছে এবং হবে। Actually, Zia was highly ambitious but had over estimated himself at times. His offer was a very foolish bait to allure us within his fold and crush at his will. Because, he had been under continuous threat and fear that it is only we and no one else who could unmask his dirty face and duality of his character to the people if need be. Therefore, how could we offer ourselves to be entrapped? Hope, I have made myself clear. You are smart enough to fathom the rest. তাহলে খালেদা জিয়াকে সাহায্য করছিস কেনো? জবাবটা তো তোর ম্যাডামই দিয়ে দিয়েছিলেন আজকের আলাপ কালে, দেশ এবং দেশবাসীর স্বার্থে। মন দিয়ে শুনিসনি বোধহয়। হাসতে হাসতে আরও বললাম, খালেদার প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি যখন হতে পেরেছিস তখন ভেতরের খেলার অনেক কিছুই সময়মতো জানতে পারবি। But, I must say it’s a very smart move. This has removed many misgivings all around. At the same time this would also give you the opportunity to be one of Khaleda’s most close trusted confidant. With time you would also become a sought for blue eyed boy in the capitals of may powerful countries particularly in the West due to your credentials, character traits and brilliant track record. পক্ষান্তরে আমরা তো বর্তমানে সবক্ষেত্রেই অপাংক্তেয়। কোথাও তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতাও নেই। সবখানেই বর্জনীয়। কামাল আমার কথাগুলো খুবই মনোযোগের সাথে শুনে বললো
তোর প্রতিটি কথা গুরুত্বপূর্ণ। তোদের সাথে আমার এবং আমার মতো অন্য কারো কোনও তুলনাই হয় না। একসময় একজন স্টাফ এসে কামালকে একটা এনভেলাপ দিলো, সেটা কামাল আমাকে দিয়ে বলল এখানে পথে খরচের জন্য কিছু বৈদেশিক মুদ্রা আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাব্বি ফিরে এসে জানালো-আজ রাতেই থাই এর ফ্লাইটে আমার ব্যাংকক যাবার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। টিকেটটা আমাকে দিয়ে কামাল বললো
তুই বাসায় চলে যা, সময়মত আমার এক অফিসার তোকে বাসা থেকে নিয়ে ফ্লাইটে তুলে দিয়ে আসবে। চল, তোকে গাড়ীঅব্দি পৌঁছে দিয়ে আসি। বাসায় ফিরে নিম্মিকে জানালাম, কয়েকদিনের জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে সেই সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে বৈঠকে। আজ রাতেই যাবার ব্যবস্থা হয়েছে। আমার স্যুট ক্যারিয়ার আর হ্যান্ডব্যাগটাতে প্রয়োজনীয় সবকিছু গোছগাছ করে দাও। সময় মতো কামালের প্রটোকল অফিসার এসে আমাকে নিয়ে যাবে। কোথায় যাচ্ছো? নিম্মি খানিকটা উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো।
প্রথমে ব্যাংকক। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করো, বেশি সময় নেই, তাই ঝটপট তৈরি হয়ে নিতে হবে।
সময়মত প্রটোকল অফিসার গাড়ী নিয়ে উপস্থিত হলেন। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। সাথে নিম্মি এবং মহুয়া এসেছে।গাড়ী থেকে নামতেই দেখি এয়ারপোর্ট-এর সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অপেক্ষা করছেন। বুঝতে পারলাম, প্রাইম মিনিস্টারের অফিস থেকে নির্দেশ পাঠান হয়েছে। তারা আমাদের VIP Lounge-এর একটা কামরায় নিয়ে গেলেন। খাতির যত্নের আতিশয্য চোখে পরার মতো। প্রটোকল অফিসার জানালেন, Flight on time. তিনি আমার মালপত্র, টিকেট আর পাসপোর্ট নিয়ে এয়ারপোর্টের কর্মকর্তাদের সাথে বেরিয়ে গেলেন। একজন তদারককারিকে রেখে গেলেন যাতে আমাদের কোনও অসুবিধে না হয়। আমরা চা নাস্তা খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলছিলাম। এরই মধ্যে একজন উর্দি পরা অফিসার এসে কাঁচুমাচু হয়ে আমাকে অনুরোধ করলেন স্যার, আমার একজন সিনিয়র অফিসার বিশেষভাবে আমাকে পাঠিয়েছেন, তিনি আপনার সাথে সাক্ষাত করে সালাম জানাতে ইচ্ছুক।
বেশতো, নিয়ে আসুন তাকে। সম্মতি পেয়ে অফিসার ছুটে বেরিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক বেরিয়ে যাবার পর আমি নিম্মি এবং মহুয়াকে লক্ষ্য করে বললাম কি ব্যাপার বল তো? জানা ছিল অদ্ভুত জীবজন্তু দেখার জন্য উৎসুক লোকজন চিড়িয়াখানায় যায়, আমিও কি সেই পর্যায়ে পরলাম নাকি! মহুয়া জবাব দিল ভাইয়া, তোমার উপস্থিতিটা জানাজানি হলে এয়ারপোর্টের পাবলিক হুমড়ি খেয়ে পরতো মেজর ডালিমকে এক নজর দেখার জন্য। তোমাকে নিয়ে সব মহলেই এত বেশি কৌতূহল যা দেখে আমরাও হতবাক হয়ে যাই। তুমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে কিংবদন্তির এক রহস্য নায়ক। তাই নাকি, ভাববার কথা! ভদ্রলোকটি একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে হাজির হলেন। জানলাম, পদবীতে তিনি সিভিল এভিয়েশনের ডেপুটি ডিরেক্টর এয়ারপোর্ট ইন চার্জ। সালাম ও কুশলাদি বিনিময়ের পর তিনি জানালেন প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিশেষ নির্দেশ দেয়া হয়েছে আপনার উপস্থিতিটা যাতে গোপন রাখা হয়। সেক্ষেত্রে আপনার সাথে দেখা করার অনুরোধ জানানোটা আপনি কিভাবে গ্রহণ করবেন সেটা বিবেচনায় না এনেই আবেগের তাড়নায় অনুরোধটা করেই ফেললাম। আপনি কিছু মনে করেননি তো, স্যার? আরে না না এতে মনে করার কিছুই নেই আপনি বসুন।
পাশের একটা সোফায় বসলেন ভদ্রলোক।চাচলবে?বলেই ইশারায় পরিচারককে চা পরিবেশন করতে বললাম। স্যার, সারা দেশবাসী বুড়ো থেকে বাচ্চারাও আপনার নাম জানে। কিন্তু স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য খুব অল্পজনেরই হয়েছে। ১৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আমি আপনার ঘোষণা শুনে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আপনাদের জন্য দোয়া করেছি। আপনারা সবাই জাতীয় বীর। তখন থেকেই চাক্ষুষ আপনাকে দেখার একটা বাসনা মনে মনে লালন করে এসেছি, আল্লাহ্পাক আজ আমার সেই মনোবাসনা পূরণ করলেন। আমি মন থেকে দোয়া করছি, আপনি দীর্ঘজীবী হউন। আপনাদের মতো কৃতী নির্ভীক সন্তানরাই দেশকে প্রগতি এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে নিয়ে যেতে পারে। এটা শুধু আমার বিশ্বাসই নয়, দেশের অধিকাংশ মানুষেরও কথা। ভদ্রলোকের চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়ছিল কথা বলতে বলতে। বয়স্ক একজন ইমানদার নামাজি ভদ্রলোক নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিলেন না। সব শুনে আমি বললাম আপনার দোয়াতে আমাদের স্মরণ রাখবেন। আপনাদের দোয়াই আমাদের মনোবল, প্রত্যয় আরও সবল করে তুলবে বৃহত্তর দেশ ও জাতীয় স্বার্থে কাজ করে যাবার জন্য। আমি আসি স্যার, সাক্ষাৎ দিতে সম্মত হওয়ায় অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম আপনার মতো একজন বুজুর্গ-এর সাথে মিলিত হয়ে দোয়া নিতে পেরে আমি নিজেকেই ধন্য মনে করছি। সালাম জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন দু’জনই। ভাইয়া,দেখলেতো? চিড়িয়াখানায় অদ্ভুত জন্তু-জানোয়ার দেখে আবেগ বিহ্বলতায় কারো চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে না নিশ্চয়ই! আমি আগে যা বলেছিলাম, সেটাই প্রমাণ করে গেলেন এক বর্ষীয়ান পরহেজগার ভদ্রলোক। মহুয়ার কথার কোনও জবাব না দিয়ে মনে মনে আল্লাহ্পাকের হাজার শুক্রিয়া আদায় করছিলাম। এত অপপ্রচার ও নিষ্পেষণের পরও এখনো দেশবাসীর মনে আমাদের জন্য দোয়া এবং ভালোবাসা রয়েছে! রয়েছে অনেক প্রত্যাশা! একসময় এনাউন্সমেন্ট হল বোর্ডিং শুরু হয়েছে। এরপরও ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, প্রথা অনুযায়ী সব যাত্রী প্লেনে ওঠার পরই VIP Passengers are taken for boarding যাতে তাদের লাইন-এ দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করতে না হয়। যথাসময়ে প্রটোকল অফিসার এসে বললেন
চলুন স্যার, ভাবী, আপা আপনারাও চলুন।
নিম্মি, মহুয়াসহ আমরা প্লেনের ভেতর ঢুকতেই স্মিতহাস্যে এক বিমানবালা আমাদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে আমাকে আমার নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে দিলো। VIP কোনও যাত্রী থাকলে নিয়ম অনুযায়ী এয়ারপোর্ট অথরিটি আগেই ককপিট এবং ক্যাবিন ক্রুদের জানিয়ে দেয় Special handling-এর জন্য। নিম্মি বলল যেখানেই থাকো টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক হলে ফোন কোরো। নিশ্চয়ই। প্রটোকল অফিসারকে বললাম, আপনি অনেক কষ্ট করলেন ভাই তার জন্য ধন্যবাদ। মোটেও নয়, স্যার। আমারই সৌভাগ্য আপনাকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম কামাল স্যারের সৌজন্যে। আমি ভাবীদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে ফিরবো। তারা সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেল। সাথে সাথেই প্লেনের দরজা বন্ধ করে দেয়া হল। এক সময় প্লেন আকাশে উড়াল দিলো। আমি ব্যাগ থেকে নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনের উপর সদ্য প্রকাশিত বইটি বের করে তাতে মনঃসংযোগ করলাম। এক সময় বিমানবালা খাবারের মেন্যু রেখে গেলো। মিয়ানমার থেকে ফিলিপিনস পর্যন্ত খাবারের মধ্যে ফ্লেভারে বেশ কিছুটা মিল রয়েছে। থাইফুড এর মেন্যু থেকে পছন্দের খাবারের কয়েকটা আইটেম বেছে নিলাম। সিট বেল্ট খোলার ঘোষণা হতেই কেবিন ক্রুরা খাবার পরিবেশনায় ব্যস্ত হয়ে পরলো।
নেলসন ম্যান্ডেলা, রবার্ট মুগাবে, জমু কেনিয়াটা, জুলিয়াস নায়ারে, আরাপ মই, ইদি আমিন, আল বশির, তোরাবি, মুসেবেনি, জর্জ গারাং, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, আইদিত, মোয়াম্মর গাদ্দাফি, নুরি মিজরি, আয়াতুল্লাহ খোমেনি, লি কুয়ান ইউ, মাহাথির মোহাম্মাদ, দেং শিয়াও পিং, হুয়ো গুয়ো ফেং, প্রিন্স সিহানুক,মারকোস, কোরাজন আকিনো,ইয়াসির আরাফাত ছাড়াও অনেক সংগ্রামী নেতার সাথে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে।
বইটাতে ডুবে ছিলাম। খাবারের ট্রলি নিয়ে হাসি মুখে একজন বিমানবালা খাবার পরিবেশন করে ড্রিংকসের ট্রলির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল What would you like, Sir?
Just a glass of plain water please. বিমানবালা গ্লাসে পানি ঢেলে দিলো। Thanks. You are most welcome, বলে চলে গেলো বিমানবালা। খাবারের সাথে বই পড়তে পড়তেই সময় কেটে গেলো, পৌঁছে গেলাম ব্যাংকক। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল দুসিথানীতে একটা রুমের বুকিং দিয়ে হোটেলের ট্যাক্সি নিয়েই পৌঁছালাম দুসিথানীতে। ওটাই তখনকার দিনে ব্যাংককের সবচেয়ে আধুনিক এবং নামিদামি হোটেল।
রিসেপশন-এচেক-ইন করে কামরায় ঢুকলাম। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। ফজরের পরই সাধারণত আমি শুয়ে থাকি। ছোটকাল থেকেই রাত জাগার অভ্যাস। শাওয়ার নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ঘুম ভাঙল সকাল এগারোটার দিকে। ওয়াশিংটনে তখন সাতসকাল। এই সময়টাতেই গঙ্গাভাইকে সহজে পাওয়া যায়। অতি প্রত্যুষে জেগে ওঠার অভ্যাস তার। রাত জাগার অভ্যাস নেই। প্রাতঃক্রিয়া শেষে ঘরেই নাস্তা সেরে ফোন করলাম।
হ্যালো।
অপর প্রান্তে গঙ্গাভাই।
কোথা থেকে বলছেন?
আমি ব্যাংকক থেকে বলছি, গত রাতে ঢাকা থেকে এসে পৌঁছেছি। প্রলয়ংকরী সাইক্লোনের খবর এখানের টিভিতে দেখেই নাইরোবিতে ফোন করে জানলাম, ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ। আপনি তখনো সপরিবারে ঢাকায়। সেখানে যোগাযোগের চেষ্টা করে জানলাম টেলিকম্যুনিকেশন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে, তাই যোগাযোগ সম্ভব নয়। ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখে ভীষণভাবে চিন্তিত হয়েই আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করার জন্য উতলা হয়ে পরেছিলাম।
সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভাই, টিভিতে যা দেখেছেন বা শুনেছেন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি। বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বাকি দুনিয়া থেকে। হাজার হাজার লোক মারা গেছে। লক্ষ লক্ষ লোক জলবন্দী হয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে উপদ্রুত এলাকায়। অনাহারে, মহামারী, রোগে, শোকে খোলা আকাশের নিচে মৃত্যুর দিন গুনছে। এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করার সামর্থ নেই বাংলাদেশের সরকারের।পরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পরায় উপদ্রুত এলাকাতে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। আপনি তো অবগত আছেন বিগত নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পর রোষ সামলাতে না পেরে হাসিনা প্রেস কনফারেন্স করে দাবি করেছে, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে বিধায় খালেদা সরকারকে এক মুহূর্তের জন্যও স্বস্তিতে থাকতে দেয়া হবে না। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এবং জলবন্দী মানুষের জীবন বাঁচাতে না পারলে সরকারের পতন অনিবার্য! এর সাথে আমাদের বিগত দিনের সব শ্রমও পণ্ড হয়ে যাবে। রুশ-ভারত চক্রের গোলামির শেকলে বাধা পরবে দেশ ও জাতি। সাহায্যের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর দূতাবাসগুলোতে সরকার পক্ষ থেকে আকুল আবেদন জানানো হয়েছে অফিসিয়াল চ্যানেলের মাধ্যমে। কিন্তু তেমন কোনও আশাপ্রদ সাড়া মেলেনি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জবাব দিয়েছেন, তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টে আবেদন লিপি পাঠিয়ে দেবেন জরুরী ভিত্তিতে। ব্যস এতটুকুই।
এই বেসামাল অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডঃ কামাল সিদ্দিকি এবং পিএস সাব্বিউদ্দিন আহমেদ যে আমার সাথে হংকং এ তিন বছর প্রথম সচিব হিসাবে কাজ করেছে তারা একত্রে খালেদা জিয়াকে বুঝিয়েছে অফিসিয়াল চ্যানেলে কোনও দেশ থেকেই সাহায্য সহযোগিতার ত্বরিত প্রতিক্রিয়ায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত অবস্থা সামাল দেবার সঙ্গতি পাওয়া সম্ভব নয়। আমরা জানি, রাষ্ট্রদূত হক পৃথিবীর অনেক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের ক্ষমতাবলয় এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অদৃশ্য শক্তিধর ব্যক্তিবর্গের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বসুলভ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন বিগত ২০ বছরের দীর্ঘ কূটনৈতিক কর্মজীবনে। তিনি তো এখনো দেশেই রয়েছেন, আপনি তাকে ডেকে অনুরোধ করে দেখুন ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি কিছু কোরতে পারেন কিনা। দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে তিনি আপনার অনুরোধ মেনে নিলেও নিতে পারেন। আমরাও তাকে বিশেষ ভাবে বুঝিয়ে বলবো।
তাদের পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে ব্যক্তিগত চেষ্টায় কোনও কিছু করা সম্ভব হয় কিনা সেই প্রচেষ্টা করার জন্য ব্যাংককে প্রায় জোর করেই পাঠিয়ে দিলেন। আপনি এবং আমেরিকান ক্ষমতাশালী বন্ধুরা কি এই সরকারকে বাঁচানোর জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে কোনও কিছু করতে পারবেন? উদ্ধারকার্য, ত্রাণ এবং একই সাথে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য স্পেসিফিক কি ধরনের সাহায্য সহযোগিতা চাচ্ছেন সেটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন। গঙ্গাভাই, স্থলভিত্তিক কোনও কিছুই বর্তমান অবস্থায় করা সম্ভব নয়। কারণ, স্থলপথে উপদ্রুত এলাকায় যাবার কোনো উপায় নেই। একমাত্র নৌবহর ভিত্তিক অপারেশন-এর মাধ্যমেই ফলপ্রসূ উদ্ধার কাজ এবং পুনর্বাসন তৎপরতা চালানো সম্ভব।এধরনের ‘Sea Born Operation’ 7th Fleet-এর মতো শক্তিশালী নৌবহরের পক্ষেইকরা সম্ভব। আমার জানা মতে, বর্তমানে 7th Fleet প্যাসিফিক-এর পথে রয়েছে। যদি সম্ভব হয় 7th Fleet-কেই চট্টগ্রাম সংলগ্ন উপকূলে ডাইভার্ট করে উড়িরচরসহ বিধ্বস্ত অন্যান্য এলাকায় উদ্ধার, ত্রাণকার্য্ এবং পুনর্বাসন একই সাথে করা সম্ভব।এ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প নেই।
বন্ধুরা যদি এই যাত্রায় খালেদার সরকারকে বাঁচিয়ে দেন, তাহলে খালেদা জিয়াই শুধু কৃতার্থই হবেন তাই নয়, বাংলাদেশের জনগণের কাছে ‘৭১-এর শেষ পর্যায়ে আমেরিকান সরকারের সিদ্ধান্তে 7th Fleet সম্পর্কে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল যার রাজনৈতিক ফায়দা রুশ-ভারত চক্র নিয়ে চলেছে আজ অবধি সেই ধারণা শুধু মুছেই যাবে না জনগণের মন থেকে, আমেরিকা সম্পর্কে অভিমত পাল্টে যাবে সম্পূর্ণভাবে। ত্রাণকর্তা এবং বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকার ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে দেশবাসীর কাছে। তবে গঙ্গাভাই, সময়টাই এখানে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য বিষয়। ঠিক আছে, আমি সবকিছুই পরিষ্কার ভাবে বুঝে নিয়েছি। এখনি আমি Capitol Hill এ যাচ্ছি জিমের কাছে। তাকে সব বুঝিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়েই অন্য সবার সাথে আলোচনা করবো। এই বিষয়ে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত সরাসরি ভাবে আদায় করার যোগ্যতা আছে শুধু একজনেরই, বন্ধুবর জেসির।
ঠিক বলেছেন। গঙ্গাভাই, আমাদের সবার স্বার্থে যে করেই হউক এই অনুমতিটা আপনাকে জেসির মাধ্যমে আদায় করে নিতেই হবে। চেষ্টার ত্রুটি হবে না।
আপনি কিন্তু আগামী ২-৩ দিন টেলিফোনের কাছেই থাকবেন।আমার বিশ্বাস, এর মধ্যেই সিদ্ধান্ত একটা হয়েই যাবে। আমাদের দায়িত্ব সাধ্যমতো চেষ্টা করা, ফল দেবার মালিক রব। ফোন ছাড়ার আগে গঙ্গাভাইকে জানালাম, আমি অধীর অপেক্ষায় থাকবো। সময় সময় আমাকে জানাবেন কি ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে।
অবশ্যই জানাবো। একটা পরামর্শ দিচ্ছি, আপনিও স্বয়ং এখনই জিমকে ফোন করে সবকিছু বুঝিয়ে বলে ওকেও জানিয়ে দিন বিস্তারিত ভাবে বাস্তব অবস্থা এবং করণীয় সম্পর্কে। একই সাথে বলবেন, আপনিই আমাকে তার সাথে দেখা করার অনুরোধ জানিয়েছেন এবং আমি খুব শীঘ্রই হিলে এসে পৌঁছাচ্ছি। ঠিক আছে, আমি এক্ষুনি জিমের সাথে যোগাযোগ করছি।
জিমকে ফোনে সবকিছু বুঝিয়ে দিলাম। তাকে বললাম, শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কই নয় হাজারো মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্যই এই প্ল্যানটা যেভাবেই হউক কার্যকরী করতে হবে। মানবিকতা এবং নিপীড়নের ঘোর বিরোধী ব্যক্তি হিসাবে জিম Capitol Hill এ বিশেষ ভাবে পরিচিত। দীর্ঘ ৪০ বছরের বেশি সময় তিনি কংগ্রেস সদস্য হিসাবে তার এলাকাবাসীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হয়ে নিজস্ব চারিত্রিক গুণাবলীর মহিমাতেই। তার কাছে জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম কিংবা বর্ণ কোনও মানে রাখে না। সবাইকে তিনি একই মানদণ্ডে বিচার করেন। মানবতাবাদী জনাব জিম করম্যান ন্যায় এবং সত্যের প্রতীক। তাই ক্ষমতা বলয়ে একজন বিশেষভাবে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।এই সম্মান তিনি অর্জন করেছেন দীর্ঘ কর্মজীবনে সততা, দক্ষতা এবং জনস্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ এক কর্মী হিসেবে। শুরু হল এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার প্রক্রিয়া। আমাকে দু’তিনদিন ফোনের পাশেই বসে থাকতে হবে, সেই সময় আমার সঙ্গী হিসাবে থাকবে ম্যান্ডেলার উপর বইটি। Lunch brake-এরসময় জিম ফোন করলো।
জরুরী ভিত্তিতে আমরা একত্রিত হয়েছি। গঙ্গাভাইও সাথে রয়েছেন। বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সব তথ্যের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের পর প্রতিবেদন তৈরি করে সেটা সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকের কাছে উত্থাপন করতে রাজি হয়েছেন জেসি। যুক্তিসঙ্গত কারণেই আশা করা যায়, তার উদ্যোগ ব্যর্থ হবে না। আজ-কালের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। আশাব্যঞ্জক খবর পেয়ে জিমকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আমি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত জানার অপেক্ষায় থাকবো। মধ্যরাতের কিছু পূর্বে জিম আবার ফোন করলো
আন্তরিক অভিনন্দন বন্ধু, তোমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন রাষ্ট্রপতি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে Pacific Command-কে হুকুম দেয়া হয়েছে 7th Fleet কে চট্টগ্রাম উপকূলে Divert করে উদ্ধার, ত্রাণকার্য এবং গৃহহীনদের পুনর্বাসনে বাংলাদেশের সরকারকে সার্বিক ভাবে সাহায্য সহযোগিতাকরার জন্য। আনুষঙ্গিক সব রিলিফ সামগ্রীর ব্যবস্থাও করবে আমেরিকা অগ্রণী হয়ে। এই অপারেশনের নাম হবে ‘Operation Sea Angels’. নামটা আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি, কেমন হয়েছে? তুমি ফিরে গিয়ে এই সিদ্ধান্তের সুখবরটা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিতে পারো। প্রোটোকল অনুযায়ী এই সিদ্ধান্তের খবর ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত আনুষ্ঠানিকভাবে যথাসময়ে প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন।
অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন প্রিয় বন্ধুরা যৌথ প্রচেষ্টায়। জিমকে জানালাম তাদের এই অবদানের জন্য যত সত্বর সম্ভব প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে আমি আসবো কৃতজ্ঞতা জানাতে। সেই সফরকালে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থে আরও কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করবো। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ক্ষেত্রবিশেষে অসাধ্য সাধন কোরতে পারে এই শিক্ষাই পেলাম এই সফরে। You are always most welcome. গঙ্গাভাই এর সাথেও আলাপ হল। তাকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললাম, Next Flight -এই আমি ফিরে যাচ্ছি।
Reception এ খবর নিয়ে জানতে পারলাম ঢাকার সাথে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।পরদিন সকালে থাই-এর ফ্লাইটে সিট Confirm করে কামালকে ফোন করে Flight details জানিয়ে অনুরোধ করলাম আমার পৌঁছানোর সংবাদটা নিম্মিকে জানিয়ে দিতে।
অবশ্যই সেটা জানাবো।এয়ারপোর্টে আমার লোক থাকবে তোকে রিসিভ করার জন্য। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে আসবি মইনুল রোডের বাড়ীতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার জন্য। আমি সেখানেই থাকবো। ঠিক আছে। Flight was on time. যথাসময় ঢাকায় পৌঁছে গেলাম। দরজা খুলতেই পূর্বপরিচিত সেই প্রটোকল অফিসার হাসি মুখে ভেতরে এলেন আমাকে স্বাগত জানাতে। প্রধানমন্ত্রীর বাসায় পৌঁছানোর পর কামাল আমাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে জিজ্ঞেস করল সফরের ফলাফল কি?
এতো উতলা হচ্ছিস কেনো? প্রধানমন্ত্রীর সামনেই সবশুনবি। তবে এতটুকু বলতে পারি এ যাত্রায় তোর ম্যাডাম বেঁচে গেলেন! হেসে কামাল বলল তুই সারা জীবন রহস্য পুরুষ হয়েই থাকবি! মনে আছে, টার্মশেষে বেইজিং থেকে ফেরার সময় দূতাবাসের Economic Minister হওয়া সত্ত্বেও তুইই আমাদের সপরিবারে চীন সফরের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলি তোর বন্ধুদের মাধ্যমে। এমন বিলাসবহুল ভ্রমণের সুযোগ ও ব্যবস্থা বোধ করি কনও VIP-এর ভাগ্যেও জোটে না। সেই সফরের কথা জীবনে ভোলার নয়। সফরকালে চৈনিক বন্ধুরা যেভাবে তোর প্রশংসা করছিল তাতে মনে হচ্ছিল তোর কাছে কোনও জিয়নকাঠি আছে যার পরশে তুই সবাইকেই বশ করে নিতে সক্ষম!
কেনো বন্ধু! বশীকরণ বিদ্যায় তুইতো আমার চেয়ে আরও বেশি পারদর্শী। তানাহলে এতো আমলা থাকতে খালেদা জিয়া তোকেই তার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হিসেবে বেছে নিলেন জানার পরও যে ৭ই নভেম্বর বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় তার স্বামী জেনারেল জিয়া তোকে জেলবন্দী করে রেখেছিলেন? সাথে করে পরিবারের সবার প্রিয় ম্যাঙ্গস্টিন, রাম্বুথান আর সফেদার তিনটি ক্রেট নিয়ে এসেছি। কামাল নিম্মিকে ফোন করে জানাল ডালিম পৌঁছে গেছে। ঘণ্টা দু’একের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিটিং, এরপর বাসায় আসছে।ইতিমধ্যে তোমাদের প্রিয় ফলের তিনটি ক্রেট আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু আমার ভাগটার কি হইবো বইন? সেটা, আপনার গাড়ীতেই থাকবে। চিন্তার কোনও কারণ নেই। কিন্তু বদ্দা, আপনার ব্যাপার-স্যাপার খুব একটা সুবিধাজনক লাগতাছে না। আপনিও শেষকালে আপনার বন্ধুরে সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করতাছেন, এটা কিন্তু কখনোই আমি ভাবতে পারি নাই। যাক, আপনাদের ব্যাপার আপনারাই ভাল বুঝবেন। বলে নিম্মি ফোন রেখে দিলো। কামাল নিম্মির কথা শুনে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পর বেগম জিয়া এসে উপস্থিত হলেন আমাদের কামরায়। আমরা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম ও কুশল বিনিময় করলাম। তার সাজ পোশাক দেখে মনে হচ্ছিলো তিনি বেরুবার জন্যই তৈরি হয়ে এসেছেন।আমাদের ইঙ্গিতে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলেন
বলুন, কেমন আছেন? সফর কেমন হল?দু‘দিন কিছুটা টেনশনে কেটেছে, তবে সুখবর নিয়েই ফিরেছি। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের হুকুমে 7th Fleet প্যাসিফিক থেকে চট্টগ্রাম উপকূলে Divert করা হয়েছে উড়ির চর এবং অন্যান্য উপদ্রুত এলাকাতে উদ্ধার, ত্রাণকার্য এবং পুনর্বাসনের কাজে আপনার সরকারকে সার্বিক ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য।7th Fleet will be launching sea born operation. এর জন্য প্রয়োজনীয় সব ত্রাণসামগ্রীও আমেরিকা সরকারই অগ্রণী হয়ে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করবে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে 7th Fleet চট্টগ্রামের উপকূলে।পৌঁছামাত্রইশুরু হবে ‘Operation Sea Angels’.যথাসময়ে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত formally পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আপনার সাথে দেখা করে সিদ্ধান্তটি আপনাকে জানিয়ে যাবেন।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন বেগম খালেদা জিয়া এবং কামাল সিদ্দিকি! তারা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না আমার বক্তব্যকে। আমি কিছুটা ক্লান্ত, তাই যদি অনুমতি দেন তবে আজকের মতো উঠতে চাই। তবে ভাবী, আমি আপনাকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত আনুষ্ঠানিকভাবে খবরটা আপনাকে না দিচ্ছেন, সেই সময় পর্যন্ত এই ব্যাপারে আপনি নিশ্চুপ থাকবেন। আপনি কথা দিয়েছিলেন যাবার প্রাক্কালে কে কি করলো, কি ভাবে, কি করে সব হল সেই বিষয়টিও গোপন রাখবেন। আমি তাহলে চলি। বলে উঠে দাড়ালাম।
দু‘দিনের ধকলে সত্যি ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত বোধ করছিলাম।
হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আপনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনার বিশ্রাম দরকার। রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাতের পর আমি কিন্তু আপনাকে আবার সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠাবো ভাই। একান্তে কিছু আলাপ আছে।অবশ্যই ডেকে পাঠাবেন তবে বৈঠকটা সুগন্ধায় না হয়ে এখানে বাসায় হলে আমার পক্ষে সুবিধা হয়।
তাই হবে। আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবারও ছোট করবো না। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন খালেদা জিয়া। কামালের গাড়ী ইতিমধ্যেই বাসায় ফলের ক্রেট এবং আমার লাগেজ পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসেছে। কামাল বেগম জিয়াকে বলল ডালিমকে বাসায় নামিয়ে দিয়েই আমি সুগন্ধায় আসছি। পথে নিশ্চুপ ছিল কামাল। হয়তো নিজেকে ধাতস্থ করে নিচ্ছিলো। বাসায় পৌঁছে গাড়ী থেকে নেমে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল Incredible! Simply incredible!
গাড়ীর শব্দে নিম্মিরা সবাই বেরিয়ে এসে কামালকে ভেতরে যাবার অনুরোধ জানালো কিন্তু কামাল সবাইকে সস্নেহে বুঝিয়ে বললো, ম্যাডাম অফিসে চলে গেছেন। তাই তাকেও এক্ষুনি চলে যেতে হবে। নিম্মিকে ইশারায় কাছে ডেকে নিচু স্বরে বললো আদরের বইন তুমিতো জানোনা, কি অবিশ্বাস্য অসাধারণ কাজ বিগত দুইদিনে ও করে এসেছে। ডালিমের এই অবদানের স্বীকৃতি দেশবাসী একদিন দেবেই। বেচারা ভীষণ ক্লান্ত। বিগত দুইদিন দুইরাত্রি ভীষণ টেনশনে থাকতে হয়েছে ওকে। জানি, সবাই আসবে কিন্তু তুমি ওকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। প্রয়োজনে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে। চলে গেলো কামাল বিদায় নিয়ে।
নিম্মি বললো ফ্রেশ হয়ে নাও সবাই আসার আগে। হ্যাঁ, বলে শাওয়ার নিয়ে কাপড়-চোপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলাম। ফিরে এসেছি শুনে ভাইবোনেরা বাচ্চাদের নিয়ে উপস্থিত হলো।
মিনু ফুপ্পু সবার জন্য রান্না করেই রাখেন। আমরা এলে বাড়িটা সবসময় গমগম করতে থাকে। দুপুরের খাওয়া শেষে ভেতরের বারান্দায় শীতের মিষ্টি রোদের আমেজে পানের আসর উপভোগ করছিলাম। একটুখানি ঝিমুনি এসেছিল রোদের আমেজে। ঝিমুতে দেখে নিম্মি বললো
চলো ঘরে, একটু ঘুমিয়ে নাও। এরা কেউই চলে যাবে না। নিম্মির কথায় সবাই সায় দিয়ে বলল হ্যাঁ ভাইয়া, একটু ঘুমিয়ে নাও। তা নাহলে রাতের আড্ডাটা মাটি হয়ে যাবে। আজ রাতে Royal Orchid-এ ডিনারে যাবো আমরা। মহুয়া বললো। ঠিক আছে, বলে শোবার ঘরে চলে এলাম। নিম্মি এলো সাথে। পর্দা টেনে দিয়ে বললো তুমি শুয়ে পর, আমিও একটু গড়িয়ে নেই। দুপুরে একটু গড়িয়ে নেবার অভ্যাস নিম্মির। নিমেষেই গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম। নিম্মি কখন উঠে গেছে টেরও পাইনি। মাগরিবের আজানে ঘুম ভাঙল। নামাজ পড়ে বসার ঘরে পৌঁছাতেই মানু, সফু, কেয়া চা নাস্তা পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পরল। মোস্তাফিজ কাকু ইতিমধ্যেই অফিস থেকে ফিরে জাঁকিয়ে বসে রসের হাঁড়ি ভেঙ্গে সবাইকে হাসিয়ে চলেছেন। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন কি মিয়া লম্বা ঘুম দিয়া উঠলা, এইডা কি ব্যাংককের আছর নাকি? ঐখানে তো রাইতে ঘুমানোর রেওয়াজ নাই। ঠিকই কইছেন কাকু, তবে এই যাত্রায় দুই দিন দুই রাত কাজের চাপে নাভিশ্বাস উঠে গেছে। টেনশনে কিছুই উপভোগ করতে পারি নাই। পুরা সময়টাই ফোনের পাশে বইসা কাটাইতে হইছে। হোটেলে বন্দী হইয়া থাকলে কি আর রাতের ব্যাংককের মজা ভোগ করা যায়! কাজ কেমন হইলো?
উদ্দেশ্য সফল হইছে। রাত ৮ তার দিকে কামাল ফোনে জানালো, আজ বিকেলেই আমেরিকান রাষ্ট্রদূত খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে তিনি আমার কথাগুলোই ফরমালি জানিয়ে গিয়েছেন। খালেদা জিয়া আমেরিকান সরকারের এই সিদ্ধান্তের তারিফ করে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে 7th Fleet-এর আগমনকে স্বাগতমও জানিয়েছেন। ভালো খবর। আমাকেতো বেচে চলেছিস। এবার শোন, মহুয়া আমাদের সবাইকে নিয়ে যাচ্ছে Royal Orchid-এতোকেও সপরিবারে দাওয়াত দিচ্ছে। চলে আয়। বইনরে ক আমারে মনে রাখায় খুবই খুশি হইছি, কিন্তু একটু পরেই একটা জরুরী ক্যাবিনেট মিটিং শুরু হইবো। বুঝলাম, ঠিক আছে তার পেটিকোটের নীচেই বইয়া থাকো তুমি শালা নকরিবাজ! আমরা চললাম। আল্লাহ্ হাফেজ।
ফোন রেখে বসার ঘরে ফিরে আসতেই টিভিতে এলান হল একটি বিশেষ ঘোষণার।
দেখলাম, আমেরিকার রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে উপদ্রুত এলাকায় উদ্ধার এবং ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্য 7th Fleet-কে পাঠাবার আমেরিকান সরকারের সিদ্ধান্তের সংবাদটাই দেশবাসীকে জানান দেয়া হচ্ছে। উপস্থিত সবাই খবরটা শুনে উল্লসিত হয়ে মত প্রকাশ করলো, এটা খালেদা জিয়া সরকারের একটা বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। এর ফলে সরকারের নড়বড়ে অবস্থা আবার পোক্ত হয়ে উঠবে। এই ‘Operation Sea Angels’ এর ব্যবস্থা না হলে সহজেই হাসিনা সরকারকে ফেলে দিতো। সবাই খালেদা সরকারের এই সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগলো। আমি নীরবে সব উপভোগ করছিলাম। মহুয়া এসে জানালো, হোটেলে সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ও জানালো লিটুর আম্মা, সঙ্গিতা, দীপ্তি, সুপ্তি, মিঠু, কাপ্পা, অ্যান্টি, কামাল শাহ বাচ্চাদেরসহ সবাই পৌঁছে গেছে। খালাম্মা, চাচা, মোস্তাফিজ কাক্কু এবং মিনু ফুপ্পু রয়েছেন আমাদের সাথেই। নান্নু, কেয়া, মিলন, মানু, প্রিন্স, সফু, এসে গেল বাচ্চাদের নিয়ে। অল্প সময়ে পৌঁছাল স্বপন, রোজি বাচ্চাদেরসহ সাথে বাপ্পি ও তার পরিবার। মহুয়ার ফোন পেয়ে আমার Illustrated brother in law লিটুও এসে যোগ দিলো। It turned into a splendid get together of all immediate family members আনন্দঘন পরিবেশে পছন্দের থাই ফুড খেয়ে সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যার যার বাড়িতে ফিরে গেলো। আমরাও ফিরে এলাম মহুয়া আর লিটুকে ধন্যবাদ জানিয়ে।
পরিবারের প্রায় সবাই কমবেশি নিশাচর। সুতরাং ঘুম থেকে দেরি করে ওঠার অভ্যাস সবারই। তবে আমার আর নিম্মির রুটিনে কিছুটা ফারাক আছে। আমি ফজরের আজান শুনে উঠে নামাজ পড়ে আবার শুয়ে পড়ি। উঠি ১০-১১ টায়। নিম্মি ফজরের পর আর শোয় না। নামাজের পর ও কোরআন তেলাওয়াত করে আর কিছু ওজিফাও পড়ে। তারপর সময় মতো সস্তিকে উঠিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে সংসারের তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি উঠে আমার workout সেরে অফিসে চলে যাই। দুপুরের খাওয়ার পর সস্তিকে সাথে নিয়ে নিম্মি এক-দেড় ঘণ্টার জন্য ঘুমায়। দিনের বেলায় আমি ঘুমোতে পারি না। তাই ওরা যখন ঘুমোয় তখন আমি গুরুত্বপূর্ণ ফাইলস দেখি কিংবা লেখালেখি করি অথবা পড়ি স্টাডি রুমের শান্ত পরিবেশে। বাসার পরিচারক-পরিচারিকারাও সেই সময় বিশ্রাম নেয়। এর ব্যতিক্রম ঘটে দেশে এলে। তখন সবাই মিলে প্রতিটি মুহূর্ত প্রাণভরে উপভোগ করি।
বাসার পরিচারক-পরিচারিকারাও সেই সময় বিশ্রাম নেয়। এর ব্যতিক্রম ঘটে দেশে এলে। তখন সবাই মিলে প্রতিটি মুহূর্ত প্রাণভরে উপভোগ করি।
বাংলাদেশ সামরিকবাহিনী আর 7th Fleet-এর মেরিনসদের যৌথ অভিযান ‘Operation Sea Angels’ শুরু হয়ে গেছে। হতবাক হয়ে দেখলো দেশবাসী অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে কি নিপুণভাবে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে অকুতোভয় আমেরিকান মেরিনস এবং জাতীয় সেনা সদস্যরা ফেরেশতা হয়ে বাঁচিয়ে দিলো হাজারো জলবন্দী মানুষের জীবন! উদ্ধার কাজের পাশাপাশি ত্রাণএবং পুনর্বাসনের কাজও শুরু হয়ে গেলো দ্রুতগতিতে। সারা দুনিয়া থেকে এলো প্রচুর ত্রাণসামগ্রী। জনগণ প্রচার মাধ্যমে দেখলো প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষতিগ্রস্ত, পীড়িত জনগণের মাঝে। খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা প্রায় আকাশচুম্বী হয়ে উঠলো। যুদ্ধের জন্য তৈরি পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন এক বিশাল এবং অপরিমেয় শক্তিশালি নৌবহরকেও যে মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত করা সম্ভব তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হলোSea Borne ‘Operation Sea Angels’. কৃতজ্ঞতার সাথে দুঃস্থ জনগণ আল্লাহ্ পাকের দরবারে দোয়া জানালেন জানবাজ নিঃস্বার্থ মানবতাবাদী দু’দেশের সেনা সদস্যদের কল্যাণ কামনায়।
ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই চরম বিপর্যয়ের সফল মোকাবেলার সবটুকু কৃতিত্ব, প্রশংসা ও রাজনৈতিক ফায়দা পেলেন প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকার। কাদের প্রচেষ্টায় ‘Operation Sea Angels’ এর সব কৃতিত্বের দাবিদার হতে পারলেন খালেদা জিয়া এবং তার সরকার সেটা অজানা রয়ে গেলো শুধু দেশবাসীর কাছেই নয়, বিশ্ববাসীর কাছেও।
এরপর থেকে দিনগুলো কাটছিল আনন্দে। প্রতিদিন রাতেই কনও না কনও বন্ধুর বাসায় ঘরোয়া পার্টি দেয়া হচ্ছে নিম্মি ও আমাকে আপ্যায়ণ করার জন্য। সব কমন বন্ধুরা সস্ত্রীক সেই সব পার্টিতে উপস্থিত থাকছে। সাথে গানের জলসারও বন্দোবস্ত থাকছে। গান আমরা দুই জনই ভালবাসি। আমরা বিশেষ ভাবে কাউকে নিমন্ত্রণ করতে চাই কিনা সেটাও জেনে নেয়া হচ্ছে একরাতে স্বপনের বাসায় চলছে জমজমাট পার্টি। হঠাৎআজিজ মোহাম্মাদ ভাই এসে বসলো আমার আর নিম্মির পাশে।ডালিম, আমার একটা অভিযোগ আছে তোমাদের দু’জনের বিরুদ্ধে। কি রকম?
আমারবাড়ীতে যেকোনো পার্টিতে কূটনৈতিকপাড়াথেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ এবংসমাজের ক্ষমতাশালী রুই কাতলা যাদেরই নিমন্ত্রণ করি তারা সবাই সাগ্রহে এসে উপস্থিত হন। কিন্তু আমার একটা দুঃখ, বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও তোমরা আজঅব্দি আমার কনও নিমন্ত্রণই গ্রহণ করনি। এর কারণ কি? আমাদের অনুপস্থিতিতে তোমার পার্টির আমেজে কনও ভাটা পরেছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। না, তা হয়তো পরেনি, তবে ব্যাক্তিগতভাবে আমি পীড়িত হয়েছি।
তা কেনো? তোমার সাথে তো অন্যান্য জায়গাতে দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছেই। নেশায় রং ধরলে মনের কথা বেরিয়ে আসে। তাকে হাল্কা করার জন্য বললাম দেখো আজিজ, তোমার পার্টিগুলো ঠিক ঘরোয়া প্রকৃতির নয়-বরং সেগুলোকেবলাচলে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিভিন্ন মানসিকতার লোকজনদের মিলনকেন্দ্র। সেখানে আমরা দু’জনই নিজেদের কিছুটা বেমানান মনে করি। আমরা কেবল সেই সমস্ত পার্টিতেই আনন্দ পাই যেখানে থাকবে অতি ঘনিষ্ঠরা, যাদের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়, হাসি তামাশা করা যায়, অতীতেরস্মৃতি রোমন্থন করে হাসি-কান্না শেয়ার করা চলে।সেই ধরনের পরিবেশ তোমার পার্টিগুলোতে থাকে না। এটাই আমাদের অনুপস্থিতির প্রধান কারণ। অন্য কনও কারণ নেই। আজকের এই পার্টি এবং তোমার পার্টিগুলোর মাঝে যে পার্থক্য রয়েছে সেটা বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই?
নিশ্চুপ বসেছিল আজিজ কিছুটা বিষণ্ণ চিত্তে। শাহনাজ তখন মেহেদি হাসানের একটা প্রিয় গজল গাইছিল সঙ্গে তবলা বাজাচ্ছিলো বাচ্চু। চলো, গান শুনি গিয়ে বলে অন্য সবার সাথে গিয়ে যোগ দিলাম। বুফে ডিনার পরিবেশনার পর রোজি এসে পথ দেখিয়ে সবাইকে নিয়ে গেল ডাইনিং রুমে। টেবিলে গরম কেসারলের উপর পরিবেশিত হয়েছে হরেক রকমের খাবার। সবাই পছন্দসই খাবার প্লেটে তুলে নিয়ে ছোট ছোট জটলায় বিভক্তহয়ে খাবারে মন দিলো।
এক সময় কামাল সিদ্দিকি আমাকে আর নিম্মিকে বলল চল, একটু নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসি। বুঝতে পারলাম একান্তে আলাপের জন্যই কামাল প্রস্তাবটা দিচ্ছে। ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে উপরে একটা সিটিং রুমে আমরা বসলাম তিনজন। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তোদের সাথে আলাপ করতে চাই। আমি সব কিছু না জানলেও অনেকের চেয়ে কিছুটা বেশি জানি কি করে কোন শক্তির বলে জিয়া ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট হতে পেরেছিল। কিন্তু ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার পরমুহূর্ত থেকেই তোদের একজন হয়েও জিয়া তোদেরকেই তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে চিহ্নিত করে সেনা পরিষদ এবং সেই সংগঠনের নেতাদের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে। জিয়া যে ১৫ই আগস্ট বিপ্লবের সাথে তার সম্পৃক্ততা অস্বীকারই করেছিল শুধু তাই নয়, তোদের শক্তিকে সমূলে নির্মূল করার জন্য নিষ্ঠুরভাবে হাজারো বিপ্লবীকে হত্যা করেছিলো এবং অনেককেই বিনাবিচারে জেলে পুরেছিলো। এক সময় এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় তোকে এবং অন্যান্যদের জড়িত করে চরম শাস্তি দেবার উদ্যোগও নিয়েছিল। বন্দীদের অনেকেই এখন পর্যন্ত কারাগারে অমানবিক পরিবেশে দিন কাটাচ্ছে। তাদের কয়েকজনের সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো আমি নিজেও যখন বন্দী ছিলাম।
তাদের এবং তোদের নিখাদ ও নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তোরা সবকিছুই নীরবে মেনে নিয়েছিস যদিও আমি জানি, যদি ইচ্ছে করতিস তবে যেকোনো মুহূর্তে জিয়াকে গদিচ্যুত করার মতো শক্তি তোদের ছিল। কিন্তু আগ্রাসী ভারতের অনুপ্রবেশের কথা চিন্তা করেই সেটা তোরা করিসনি। আত্মত্যাগের এক অভাবনীয় নিদর্শন তোরা প্রত্যেকেই! আমি এটাও জানি, তুইসহ তোদের সবাই চাকুরি ছেড়ে সমাজে স্বাধীনভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে আগ্রহী। এই পরিপ্রেক্ষিতে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কাল থেকে নির্বাচন পর্যন্ত এবং নির্বাচনের পর আজঅব্দি তোদের পক্ষ থেকে তুই পর্দার অন্তরালে যে অসাধারণ অবদান দেশ ও জাতীয় স্বার্থে করে এসেছিস সেসব কিছুর সবচেয়ে বড় Beneficiary হচ্ছে খালেদা জিয়া। এই বাস্তবতায় কারাবন্দী সহযোদ্ধাদের মুক্তি এবং তোদের স্বীকৃতি প্রদান করে যথাযথ মর্যাদায় সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার দাবি খালেদার কাছে উত্থাপন করাটা কি যুক্তিসঙ্গত নয়? অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত।
তুই হয়তো ঠিকই বলছিস তবে তোকে বুঝতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আজ পর্যন্ত আমরা যাই করেছি সেটা করেছি বৃহত্তর দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে, কোনও ব্যক্তি স্বার্থে নয়। আমাদের নিঃস্বার্থ অবদানে ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি উপকৃত হয়ে থাকে সেটা তার ভাগ্য। এর জন্য প্রতিদানে কিছু চেয়ে নেয়াটা আমরা যুক্তিসঙ্গত মনে করি না। তুই শুধু বিশ্বস্ত বন্ধুই নস, ভাইও বটে। নিম্মিরা তোকে বদ্দা বলে সম্বোধন করে, খালাম্মা আর চাচা তোকে বাপ্পির চেয়ে কম ভালবাসেন না তাই তোকে জানাচ্ছি, নির্বাচনের আগেই খালেদা জিয়া নিজে থেকেই কথা দিয়েছেন নির্বাচনে জয়ী হলে আমাদের প্রতি জিয়ার সময় থেকে যে অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিকার তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করবেন। এর অনেক সাক্ষী রয়েছে দশে বিদেশে।
যদি সেটাই তিনি করেন তাহলে আমরা বুঝবো, ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক সফল অভ্যুত্থান যে একই সূত্রে গাঁথা, এই দুইটি সফল বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল সেনা পরিষদ সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। সেই সত্যকেই স্বীকৃতি দিয়েই ভারতের রক্ত চক্ষুকে উপেখ্যা করেই তিনি আমাদের সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে রাজনীতির মূলধারায় কাজ করার সুযোগ করে দিলেন। তেমনটি হলে আমরাও অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভাববো, ইসলামী মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতির শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে কি করে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করার প্রক্রিয়ায় বিএনপির সাথে কি ধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। কূয়োর ব্যাঙের রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি না।আমাদের রয়েছে সুদূরপ্রসারী সুচিন্তিত স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য সেনা পরিষদের রয়েছে নীতি-আদর্শ ভিত্তিক একটি কর্মসূচি। এ সমস্ত বিষয়ে যুদ্ধকালীন সময় থেকেই তুই অনেক কিছুই জানিস। এখন শোন, তুই অনুমতি দিলে আমি এই দুইটি বিষয়ে ম্যাডামকে অতিসত্বর পদক্ষেপ নেবার জন্য বোঝাতে চেষ্টা করতে পারি। এই বিষয়ে আমার কিছুই বলার নেই, তুই তোর ইচ্ছে অনুযায়ী যা করতে চাস করতে পারিস। স্বল্পভাষী নিম্মি সব শুনে বললো
বদ্দা, আপনার কোনও প্রচেষ্টাই কার্যকর হবে না, কারণ খালেদা জিয়া জেনারেল জিয়ার পথেই হাঁটবেন। বরং আমার মনে হয়, খালেদা জিয়া যতটুকু সম্ভব তার স্বার্থ হাসিল করে নেবার পর অতি সহজেই তার দেয়া কথাটা ভুলে যাবেন। ডালিমদের রাজনীতিতে আলাদাভাবে কিছুতেই দাঁড়াতে দেয়া আপনাদের ম্যাডামের পক্ষে সম্ভব হবে না। এর অনেক যুক্তি রয়েছে। Sooner or later তিনিও জিয়ার মতোই বিশ্বাসঘাতকতার নজিরবিহীন আর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। চলুন নিচে যাওয়া যাক। নামতে নামতে কামাল বললো
চেষ্টা করতে দোষ কি বইন? নিম্মি কনও জবাব দিলো না। তিনজনই নিচে নেমে অন্যদের সাথে যোগ দিলাম। খাওয়ার পর চা, কফির সাথে পানের সরঞ্জাম পরিবেশিত হল। গানের আসরও জমে উঠেছে। এক কোণে নিম্মি, কামাল আর আমি একটা জায়গা বেছে নিলাম। আরামদায়ক কুশনে ঠেস দিয়ে গান শুনছিলাম আর নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে আলাপ করছিলাম। কামাল নিম্মিকে লক্ষ্য করে বললো
তুমি খালেদা সম্পর্কে এতটা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছো কেন বইন? আঁতে ঘা লাগছে মনে হয়! তাহলে একটু বুঝাইয়া কই শুনেন, যদিও এর অনেক কিছুই হয়তো আপনার জানা থাকলেও থাকতে পারে। ডালিমদের সাথে তথাকথিত ষড়যন্ত্রের দায়ে জড়িয়ে নবি ভাইয়েরও কোর্টমার্শাল শুরু করেছিলেন জেনারেল জিয়া। কর্নেল নুরুন্নবি খান বীরবিক্রম তখন ঢাকার ইএমই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক। শুধু তাই নয়, জিয়ার সাথেই নবিভাই শুরু থেকে সহযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধ করেছিলেন। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ঝুনুর(কর্নেল নবির স্ত্রী)মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়! ঝুনুকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার সরকারি বাসভবন ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ঝুনু বাস্তুহারা হয়ে অসহায় হয়ে পরে। এম এ পাশ ঝুনুর পক্ষে একটা চাকুরিও যোগাড় করা সম্ভব হয়নি যোগ্যতা থাকলেও। কারণ, জিয়ার রোষানলে পরার ভয়ে সবাই তখন বহুলভাবে পরিচিত একজন বীরবিক্রম মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীকে এড়িয়ে গেছে। তখন নিরুপায় ঝুনু এলিফেন্ট রোডের বস্তিসংলগ্ন একটা গলিতে দুই রুমের বাসায় বাচ্চাদের নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাই করে নেয়। একটা অখ্যাত স্কুলে সামান্য বেতনের একটা চাকরিও ভাগ্যক্রমে জুটে যায় আল্লাহ্র অসীম করুণায়। সংসারের ন্যূনতম খরচা যোগাতে ঝুনু বিপর্যস্ত হয়ে পরে।
দেশের বড় বড় বুলি কপচানো মহারথীদের কেউই এতটুকু সাহায্যের হাত বারিয়ে দেয়নি তখন।
জনগণ আর দেশের কথা বলতে বলতে আপনারা সব সময় মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, জীবনের ঝুঁকিও নিয়ে ফেলেন আগপিছ কিছু না ভেবেই যার দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের।
এই বিষয়টা কখনও ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে বলে আপনারা মনে করেন না। আমরাও আপনাদের সততায় সব কিছু মুখ বুঁজে মেনে নেইগর্বের সাথেই। আমরা তখন নির্বাসনে। আমি লন্ডনে একটি দোকানে কাজ করি। কারণ আমাদের স্থাবর অস্থাবর সহায় সম্পত্তি সবই বাজেয়াপ্ত করে লুটপাট করে নেয়া হয়েছিল তাই টাকা থেকে ঝুনুকে মাসিক কিছু টাকা পাঠাতাম আমার চাকুরির বেতন থেকে। একবার ঢাকায় এলে ঝুনু আমার সাথে দেখা করতে আসে। তখন জোর গুজব নবি ভাইকে ফাঁসি দেয়া হবে। ওর অবস্থা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। বুকটা ফেটে গিয়েছিলো। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, নবি ভাইকে না জানিয়ে তুমি একবার খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে তার সাহায্য চাও। আমার কথাতেই ঝুনু একদিন অতি কষ্টে খালেদার সাথে দেখা করতে সমর্থ হয়। অশ্রুর বন্যায় ভেসে ঝুনু তার দুর্বিষহ জীবনের কথা তাকে শোনায় এবং নবিভাইয়ের জীবন ভিক্ষা চায়। সব শুনে একজন অসহায় দুঃস্থ মহিলাকে কিজবাব য়েছিলেন আপনার ম্যাডাম গর্বের সাথে, জানেন? বলেছিলেন এসমস্ত কান্নাকাটি বন্ধ করুন।আমার স্বামী কতজনকে ফাঁসিতে লটকিয়েছেন, কতজনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মেরেছেন সেটা আপনি জানেন? তবুওতো ভালো আপনার স্বামী এখনও জীবিতই আছেন। তার যা হবার সেটা আইনি ভাবেই হবে। এরপর তাকে বিদায় করে দেন খালেদা জিয়া।
যার মধ্যে সভ্যতা, সহমর্মিতা, মায়া-মমতা এবং সহানুভূতি দেখাবার মতো ন্যূনতম জ্ঞানটুকু নেই সেই মহিলাকে কি বলা উচিৎ? মানুষ নাকি অমানুষ? এভাবে অপমানিত হয়ে ঝুনু ফিরে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পরেছিলো। সেই দিন ঝুনুকে বুকে ধারণ করে নিজেকে খুবই দোষী মনে হচ্ছিলো। নবি ভাইয়ের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েও সরকারের এজেন্সিরা কোনও স্বীকারোক্তি আদায় করতে সক্ষম হয়নি। পরে আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় নবি ভাই মুক্তি পান। কিন্তু তার মুক্তির অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দুর্বিষহ অবস্থার সাথে লড়াই করতে করতে ঝুনু অকালে মারা যায়। নিম্মির কথা শুনে লজ্জায় মাথা হেঁট করে একদম চুপ হয়ে গেলো কামাল। ঝুনুর মুখটা মনে ভেসে ওঠায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলো আমার মন। অতি নিষ্পাপ সরল হাসি হেসে সর্বদাই আপ্যায়ন করত ঝুনু যখনই গেছি তাদের বাসায়। এরপর আর পার্টিতে থাকতে মন চাইছিলো না। তাই বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম কোনও মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বাকরুদ্ধ অবস্থায়। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। স্বপন জানিয়েছিল সে নিজে গিয়ে নবিকে নিমন্ত্রণ করে এসেছিল কিন্তু সে রাতে তার সাইট এ যেতে হওয়ায় ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল নবি। বলেছিলো, আমার আর নিম্মির সাথে পরে দেখা করবে। পরদিনই নবি ফোন করলো। আমি তাকে মিনু ফুপ্পুর বাড়ীতে আসতে বললাম। জবাবে নবি বললো বন্ধু জেল থেকে বেরিয়ে শপথ নিয়েছি ক্যান্টনমেন্টের গেটপেরিয়ে বেঁচে থাকার শেষদিন পর্যন্ত কোনোক্রমেই ভেতরে প্রবেশ কোরব না। তাই দয়া করে তুই ভাবীকে নিয়ে আমার অফিসে চলে আয়। অফিস থেকে তোদের বাসায় নিয়ে যাবো।
এলিফেন্ট রোডে নবির বিরাট অফিস! নবির তখন রমরমা ব্যবসা। জেল থেকে বের হয়ে নবি একটি কনস্ট্রাকশন ফার্ম খুলে বসে। সে এখন শুধু একজন সফল ব্যবসায়ীই নয়, দেশের বিত্তবানদের শীর্ষ পর্যায়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে নিজের মেধা ও পরিশ্রমের বদৌলতে।ওর চেম্বারে নিয়ে গিয়ে তার বিরাট গ্লাসটপ টেবিলের সামনে আমাদের দু‘জনকে বসিয়ে নিজে গিয়ে অপর প্রান্তে তার রিভলভিং চেয়ারে বসলো নবি। অসাধারণ সাফল্যের পরও নবির মধ্যে কোনও পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। ঠিক আগের মতই রয়ে গেছে নবি! অফিসে আসতে বলেছি কেনও জানিস? কেনও? একটা জিনিস দেখাতে। বলেই তার সামনে টেবিলের গ্লাসের নিচে একটা ১০০ টাকার নোটের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো এটা দেখাতে। এটা তো ১০০ টাকার একটা নোট নবি ভাই!কিছুটা বিস্মিত হয়ে নবির দিকে তাকালো নিম্মি।
না ভাবী, এটা শুধুমাত্র একটা নোট নয়। এটাই আমার উন্নতির চাবিকাঠি, আর এটা আপনার দান। জেল থেকে বেরুবার পর ঝুনুর কাছ থেকে আমি আপনার সম্পর্কে বিস্তারিত সব কিছুই জানতে পারি। যখন ঝুনু ছিল সবার কাছেই বর্জনীয় তখন একমাত্র আপনিই তাকে বড়বোনের মতো বুকে টেনে নিয়ে যথাসম্ভব সাহায্য সহযোগিতা করে গেছেন গোপনে। আপনিই হয়ে উঠেছিলেন ঝুনুর সংগ্রামী জীবনের একমাত্র অনুপ্রেরণা। যখন কোম্পানি গঠন করে ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই তখন আপনার পাঠানো টাকা থেকেই ঝুনু কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলো, দেবীতুল্য ভাবীর টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করো।এতে আল্লাহ্পাক বরকত দেবেন। সেই টাকা থেকে এই নোটটা বাঁচিয়ে টেবিলের কাঁচের নিচে চোখের সামনে রেখে এগুচ্ছি। প্রতিটি সাফল্যের পর এই নোটটার মধ্যে আমি ঝুনুকে দেখতে পাই। শুনতে পাই ঝুনু বলছে বলেছিলাম না, পুত-পবিত্র ভাবীর টাকায় ব্যবসা শুরু করলে আল্লাহ্পাক তোমার উপর তার রহমত উজাড় করে দেবেন। কথাগুলো বলতে বলতে নবির দুই চোখে প্লাবন বইছিলো। আমাদের চোখ ও ঝাপসা হয়ে উঠেছিলো। কারণ, নবির স্বচ্ছলতা ঝুনু বেশিদিন উপভোগ করতে পারেনি। হঠাৎ করেই অপ্রত্যাশিত ভাবে ঝুনু সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পৃথিবী ছেড়ে অনন্তলোকের পথে যাত্রা করে। নবি উঠে দাঁড়িয়ে বললো চল, বাসায় বাচ্চারা তোদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সেকেন্ড ক্যাপিটালে চারতলা বিশাল একটা বাড়ি বানিয়েছে নবি। তিন বাচ্চার জন্য তিনতলা আর নিজের জন্য নিচের তলা। বাসার গেট খোলার আওয়াজ পেয়েই তার দুই মেয়ে আর ছেলে দৌড়ে এসে সালাম জানিয়ে নিম্মিকে জড়িয়ে ধরলো। নিম্মি ওদের জন্য কিছু উপহার আর চকলেট নিয়ে এসেছিলো। সেগুলো হাতে তুলে দিলো। রুচিশীল ছিমছাম ভাবে সাজানো বিশাল অট্টালিকায় কোনও কিছুরই অভাব নেই, শুধু ঝুনুর সদাহাস্য মুখের সাদর স্বাগতম ছাড়া! বাচ্চারা নিম্মিকে নিয়ে উপরে চলে গেলো, নিচে থেকে গেলাম আমি আর নবি। বিশ্বাস কর নবি, আমি কিন্তু এ সবের কিছুই জানতাম না! সেটাই স্বাভাবিক। ভাবী যা কিছুই করেছেন সেটা তিনি তার কর্তব্য মনে করে করেছেন সবার অগোচরে। এখানেই তিনি অনন্যা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় মেয়ে এসে আমাদের নিয়ে গেলো খাবার ঘরে। পরিবেশিত হয়েছে আমার প্রিয় ছোট মাছের ব্যঞ্জন, শাক আর ডাল। অবাক হলাম, এ যেনো ঝুনুর হাতেরই রান্না! মা, এগুলো কে রান্না করলো?
কেনো, ভালো হয়নি বুঝি? আমিই রেঁধেছি। অপূর্ব হয়েছে, মনে হচ্ছে ঝুনুর হাতের রান্নাই খাচ্ছি! বেঁচে থাকো মা, তোমার মার রান্নার হাতটাই পেয়েছো তুমি মা শা আল্লাহ্।
বিকেল পর্যন্ত নবিদের সাথে কাটাবার পর বিদায় নেবার প্রাক্কালে নবি বললো
কাল বৃহস্পতিবার, তোদের আর মিনু ফুপ্পুকে নিয়ে যাবো নরসিংদী আমার আধ্যাত্মিক গুরুর কাছে, তিনি একজন সিদ্ধ কামেল সূফি সাধক। তুই আবার এই দিকে ঝুঁকলি কবে?
আমিতো ফরজ হজ্জও করে ফেলেছি। বলিস কিরে! সুইন্ডনের কার্ল মার্কসের প্রতিভূ হজ্জ করে ফেলেছে! এতো অবিশ্বাস্য পরিবর্তন! তাই হয় বন্ধু, আল্লাহ্র মর্জিতে মুহূর্তে মানুষ বদলে যায়। ঝুনুর অপ্রত্যাশিত ভাবে চলে যাবার পর আল্লাহ্র ইচ্ছায় আমিও বদলে গেছি। তবে আমাকে কাঠ মোল্লা ভাবিসনে যেনো! বাবার সাথে আলাপ করলে তোদেরও ভাল লাগবে। পল্লীগ্রামের পরিবেশটাও নির্মল। কাল সকাল ১১ টায় তোরা ক্যান্টনমেন্ট এর মেইন গেটের সামনে পৌঁছাবি।ওখানেই আমি তোদের জন্য অপেক্ষা কোরব। ঠিক আছে। ভালোই হবে শহর থেকে দূরে একটা দিন একজন বুজুর্গের সান্নিধ্যে কাটিয়ে আসতে পারলে মনটা কিছুটা হলেও আবর্জনামুক্ত হবে। বাসায় ফিরে মিনু ফুপ্পুকে নবির দাওয়াতের কথাটা জানাতেই তিনি সাদরে সেটা গ্রহণ করলেন। বেনু ফুপ্পুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তিনিও যাবেন আমাদের সাথে। মোস্তাফিজ কাক্কুর বাবাও একজন খ্যাতিমান সূফিসাধক ছিলেন। এই জ্ঞান তাপসরা এই জগতের বাইরে যে বিশাল সৃষ্টি জগত রয়েছে সেই সম্পর্কে এবং আল্লাহ্তায়ালা কি করে এই বিশ্বভুবনে নিজের নিজাম কায়েম রেখে চলেছেন সেই রহস্য জানার সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্র নৈকট্য পাবার একাগ্র বাসনায় নিজেদের তরিকায় চিরন্তন নিমগ্ন থাকেন।
মিনু ফুপ্পু, বেনু ফুপ্পু এবং নিম্মি তিনজনই ভীষণভাবে ধার্মিক। মানুষের প্রতি তাদের ভালোবাসা আর দুঃখীজনের কষ্টে যে ভাবে তারা কাতর হয়ে ছুটে যায় সাহায্য-সহযোগিতা এবং সমবেদনা জানাবার জন্য নিঃস্বার্থভাবে, সেটা সচরাচর আজকের দুনিয়ায় দৃষ্টিগোচর হয় না। একই ভাবে উদারপ্রাণ পুরুষ মোস্তাফিজ কাক্কু। একই সাথে BJMC এবং BJIC এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জনাব মোস্তাফিজুর রহমানকে একজন দূরদর্শী, সৎ,পাট বিষয়ে অগাধ জ্ঞান সম্পন্ন অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ পরিচালক হিসেবেই জানেন তার সহকর্মী এবং পাট ব্যবসায়ীরা। সম্ভ্রান্ত পরিবারের এই ব্যক্তির বাইরের আবরণটা কঠিন হলেও তার মনটা ছিল শিশুর মতোই কোমল। তাদের জুটিটা ছিল একটা আদর্শ জুটি।আমাকে দু’জনেই নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ-ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। সব বিপদ-আপদে ঢাল হয়ে রক্ষা করেছেন। কিন্তু প্রতিদানে আমি কিছুই করতে পারিনি। পিতৃস্নেহ আর মাতৃমমতার ঋণ পরিশোধ করাও সম্ভব নয়। মায়া-মমতা একতরফা ভাবে নিম্নগামী চিরকাল। এটাও হয়তো একটি প্রাকৃতিক নিয়ম।