নিরুদ্দেশে যাত্রা

নির্বাচনের সরকারি ফলাফল প্রকাশের পরই বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেলাম, ক্ষমতায় আসীন হয়েই হাসিনা তার জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য সফল আগস্ট অভ্যুত্থানের নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করবেন যে ভাবেই হউক না কেনো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। তাই আমি এবং আরও কয়েকজন দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হই পরিবার পরিজনদের দেশে রেখেই অজানা ঠিকানার উদ্দেশ্যে। প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করে সরকার গঠনের পরপরই শেখ হাসিনা সংসদে একটি সাধারন বিল উত্থাপন করে সাংগঠনিক বিধি লঙ্ঘন করে দুই-তৃতীয়াংশের পরিবর্তে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতায় পঞ্চম সংশোধনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ ইনডেমনিটি এ্যাক্টটি বাতিল করিয়ে নিলেন বেআইনি ভাবে। বিলটি যখন পাশ করানো হয় তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তার জোটের সদস্যরা এর প্রতিবাদে টু শব্দটি না করে সংসদ থেকে ওয়াক আউট করলেন। ‘মৌনং সম্মতি লক্ষণং’ প্রমাণিত হওয়ার পরই হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রয়াত শেখ মুজিবের একজন একান্ত সচিব মোহিতুল ইসলামের দ্বারা ১৫ই আগস্ট সফল সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে ধানমণ্ডি থানায় একটি জিডি দারিজ করিয়ে গোলাম রসুলের জজকোর্টে ‘মুজিব হত্যা’ নামে একটা সাধারণ ক্রিমিনাল খুনের মামলা শুরু করে দেয়া হয়। ঐ মামলায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং জেনারেল জিয়াউর রাহমান ছিলেন যথাক্রমে ১নংএবং ২নং আসামী। নুরুল ইসলাম মঞ্জু সহ অভ্যুত্থানের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সব সামরিক অফিসার যারা বিভিন্ন দেশে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করছিল অথবা দেশে কিংবা বিদেশে এবং সেনা পরিষদের বিপ্লবী কয়েকজন JCO এবং NCO কে আসামী করা হয়। জারি করা হয় সবার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা।

একই সাথে, লালবাগ থানায় দারিজ করানো একটি জিডির ভিত্তিতে ‘জেল হত্যা’ নামে আর একটি বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এই মামলাতেও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমদ, প্রয়াত সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান সহ আগস্ট বিপ্লবের সব শীর্ষ নেতাদের আসামি করা হয়। অতি ক্ষিপ্রতার সাথে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্টও জারি করাতে সক্ষম হয় হাসিনা সরকার। সব কিছুই ঘটছিল অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে। পরবর্তী সময়ে মৃত বিবেচনায় খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম আসামীদের এই লিস্ট দুটো থেকে বাদ দেয়া হয়। ক্যাঙ্গারু আদালতে বিচারের প্রহসনের পর শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য নিয়োজিত বিচারক গোপালগঞ্জের গোলাম রসুল দম্ভভরে উদ্ভট রায় দিলো, ‘আসামীদের ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারতে হবে’ যদিও পিনাল কোডে এমন কোনও বিধান নেই। খালেদা জিয়ার জোট এই ধরনের রায়ের পরও নিশ্চুপ থাকে।

নির্বাচনের দিন বিকালেই বিএনপির ভরাডুবি অনুধাবন করে মেজর হুদা তার নির্বাচনী এলাকা থেকে ঢাকা ফেরত আসে এবং দেশত্যাগ করে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে ব্যাংকক আগমন করে। আমি হুদার সাথে যোগাযোগ করে তাকে বলি, ব্যাংকক তার জন্য মোটেও নিরাপদ স্থান নয়, সুতরাং দ্রুত তাকে ব্যাংকক ত্যাগ করতে হবে’। জবাবে হুদা বলেছিল,ব্যাংককে কিছু কাজ আছে। শেষ হলেই সে ব্যাংকক ছাড়বে। হুদা ব্যাংকক পৌঁছানোর পরপরই বাংলাদেশ দূতাবাসের বিএনপিপন্থী রাষ্ট্রদূত জুলমত আলী খান তার বাসায় হুদাকে নিমন্ত্রণ করেন। অতীতে হুদা জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ছিল বিধায় অনেকের কাছেই হুদা এক অতি পরিচিত মুখ। সম্ভবত রাষ্ট্রদূতের বাসা থেকেই হুদার ব্যাংকক অবস্থানের কথা জানাজানি হয়ে যায়। কোনও এক অজানা কারণে হুদারও ব্যাংকক ছাড়তে দেরী হয়ে যায়। সবই নিয়তি! ব্যাংককে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের আমলারা হুদাকে অনুসরণ করতে থাকে। এক বৃষ্টির দিনে একটি দোকানের মধ্যে মিথ্যে নাটক সাজিয়ে হুদাকে ষড়যন্ত্র করে গ্রেফতার করা হয়। টাকা-পয়সা খরচ করতে পারলে ব্যাংককের মতো জায়গায় অসম্ভব বলে কিছু নেই। সে দিনটি ছিল শুক্রবার। শনি-রবি সাপ্তাহিক বন্ধ বিধায় হুদাকে দুইদিন ডিটেনশন সেন্টারে কাটাতে হয়। সোমবার তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ব্যাংকক পুলিশ হুদাকে ছেড়ে দেয়। হুদা হোটেলে এসে জানতে পারে তার পাসপোর্ট দূতাবাসের কর্নেল হানিফ ইকবাল নামের এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা (প্রাক্তন রক্ষীবাহিনীর অফিসার) বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে গেছে। কর্নেল হানিফ ইকবাল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তৎপর হয়ে হুদাকে তার কাছে হস্তান্তর করার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে হুদাকে বন্দী অবস্থায় ডিটেনশন সেন্টারে পাঠিয়ে দেয় ব্যাংকক পুলিশ কর্তৃপক্ষ।

হুদার ছোটবোন প্রয়াত রাষ্ট্রদূত কর্নেল পাশার স্ত্রী জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারেতে ছিল সেই সময়।

হুদার কোনও খোঁজ না পেয়ে উদ্বিগ্ন বোন রেডক্রসে জরুরী ই-মেল পাঠালে ব্যাংককের রেডক্রস অফিস হুদার বোনের ইমেলটি ব্যাংককে অবস্থিত UNHCR কে প্রদান করে। এ ভাবেই এই কেসের সাথে UNHCR জড়িত হয়ে পড়ায় প্রায় আড়াই বছর হাসিনা সরকার তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেও হুদাকে বাংলাদেশে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়নি। পরে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ সরকার থাইল্যান্ড সরকারের সাথে বন্দী বিনিময় চুক্তি সাক্ষরের কৌশল গ্রহন করে। বন্দী বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পরই হুদাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয় থাইল্যান্ড সরকার।

সংবিধান লঙ্ঘন করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় একটি বিল পাশ করিয়ে এই দুইটি ক্রিমিনাল খুনের মামলা দায়ের করা হয়। বিচার দুইটি শুরু করার প্রক্রিয়ায় আইনি বৈধতার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। কারণ, কোনও সফল সামরিক অভ্যুত্থানের বিচারের নজির দুনিয়ার কোনও দশেই নেই। কোনও ব্যর্থ অভ্যুথানেও যেখানে চাকুরিরত অফিসার কিংবা সৈনিক জড়িত থাকে তাদের বিচার করা সম্ভব একমাত্র সামরিক আইনের আওতায় কোর্টমার্শালের মাধ্যমে, বেসামরিক আইনী আদালতের মাধ্যমে নয়। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর একটি ন্যক্কারজনক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি তার ফুফা অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমানকে কন্ট্রাক্ট বেসিসে পুনরায় সেনাপ্রধান বানিয়ে তার মাধ্যমে সেনাসদর থেকে একটি সনদ জারি করিয়ে নেন যাতে বলা হয়, বর্তমান সরকার ‘মুজিব হত্যা’ এবং ‘জেল হত্যা’ নামক যে দুইটি বিচার কার্যকর বেসামরিক আদালতে শুরু করেছে তার সাথে চাকুরিতে বহালরত সেনা অফিসার এবং সৈনিকরা জড়িত থাকলেও সেই বিচার প্রক্রিয়ার পথে কোনও প্রতিবন্ধকতা সেনাসদরের তরফ থেকে নেই। ইতিমধ্যে মুজিব হত্যা মামলা শুরু করিয়ে দেয়া হয়েছে, আমাদের নামে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্ট। মেজর হুদার এই পরিণতিতে আমরা সবাই ভীষণভাবে মর্মাহত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমাদের কিছুই করার ছিল না। সিদ্ধান্ত গৃহীত হল যারা তখনও কূটনৈতিক হিসাবে চাকুরিতে বহাল রয়েছে তাদের সবাইকে চাকুরীরত অবস্থাতেই গোপনে যার যার সুবিধা মতো নিরাপদ আশ্রয় ঠিক করে নিতে হবে কালবিলম্ব না করে জরুরী ভিত্তিতে দেশে ফেরার নির্দেশ আসার আগেই। বাহ্যিকভাবে প্রত্যেকেই দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করে চলবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। ফেরত যাবার ডাক এলে মিশনের সবাইকে এমন ভাব দেখাতে হবে যে দেশেই ফিরে যাচ্ছে সবাই। প্রস্তুতিও নিতে হবে সেইভাবেই প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী যাতে করে কোনও সন্দেহের উদ্রেক না হয়। সব নিয়ম মেনেই প্রত্যেককে কর্মস্থল ত্যাগ করে পথিমধ্যে পাড়ি জমাতে হবে নিরাপদ আশ্রয়ে যাতে পরিকল্পনার পথে কোনও বাধার সৃষ্টি না হয়। হুদার দুর্ভাগ্যজনক পরিণামের বিষয়টিও সবাইকে জানিয়ে দেয়া হল। হাসিনা সরকার এবং ভারতীয় RAW-এর জালে আটকে পড়ায় হুদার পক্ষে ব্যাংকক থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি।

কর্নেল ফারুক, কর্নেল শাহরিয়ার, কর্নেল মহিউদ্দিনকে(যে বন্দী জিয়াকে ৭ই নভেম্বর মুক্ত করেছিল) আরও অনেকের সাথে বন্দী করে কারাগারের কন্ডেম সেলে নিক্ষিপ্ত করা হল বেআইনি ভাবে।

প্রায় আড়াই বছর যাবত আপ্রাণ চেষ্টা ও মিলিয়ন ডলার খরচ করে ১৯৯৮ সালের ৮ই নভেম্বর প্রহসনের বিচারের প্রহসনের রায় দেয়ার দিন সকালে ব্যাংককে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস নোংরা কৌশলের মাধ্যমে হুদাকে থাই কর্তৃপক্ষের নিকট হতে নিজেদের হেফাজতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরত নিয়ে আসে।
মেজর হুদাকেও দেশে ফিরিয়ে এনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হল কন্ডেম সেলে। একমাত্র মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামীদেরকেই রাখা হয় জেল কোড অনুযায়ী কন্ডেম সেলে। উচ্চ আদালত তাদের বেইল পিটিশন নাকচ করে দিলেও রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে তাদের ক্লাস দেবার রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু জিঘাংসা পরায়ণ অগ্নিশর্মা হাসিনার রোষ থেকে বাঁচার তাগিদে প্রশাসন এবং জেল কর্তৃপক্ষ আদালতের সেই রায় বাস্তবায়িত করা থেকে বিরত থাকে শেষদিন পর্যন্ত।

নির্বাহী সরকারের প্রশাসন কর্তৃক আদালতের রায় কার্যকরী না করা স্বাধীন বিচার বিভাগের পরাধীনতারই চরম বহিঃপ্রকাশ!