সত্য কহন

এ ভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশে মানবতা বিরোধী এবং বেআইনি ভাবে বন্দী অবস্থায় হত্যার প্রচলন শুরু করা হয় আওয়ামী-বাকশালি আমলেই। দলীয় প্রধান এবং সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান নিজেই ছিলেন হত্যাকারী। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর বঙ্গশার্দুল কর্নেল জিয়াউদ্দিন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন সর্বহারা পার্টিকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পার্টি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।

স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবের শাসনকালে রক্ষীবাহিনীসহ আওয়ামীলীগের নেতাদের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন প্রাইভেট বাহিনী এবং দলীয় সশস্ত্র ক্যাডারদের সীমাহীন দুর্নীতি ও জুলুমের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধা, বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের ৫০,০০০ এরও বেশি নেতা-কর্মীকে আইন বহির্ভূতভাবে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়।

শুধু জাসদেরই ৩০,০০০ এর বেশি নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিলো বলে দাবি করেছিলেন দলীয় নেতৃবৃন্দ যারা আজ সাথীদের রক্তের সাথে বেঈমানি করে হাসিনার নৌকোয় উঠে নির্বাচনী বৈতরণী পার করে হয়েছেন আওয়ামীলীগের মন্ত্রী!

মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষঅব্দি যত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হননি তার চেয়ে বেশি মুক্তিযোদ্ধাকে শহীদ করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। এ ধরনের হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের মরণোত্তর বিচার দাবি করা কি ন্যায়সঙ্গত নয়? এর দায়ভার কি করে এড়াতে পারেন মুজিব, জিয়া, এরশাদ, খালেদা, শেখ হাসিনা এবং তাদের সহযোগীরা যারা বিগত ৪৫ বছরের উপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা উপভোগ করে আসছেন?

জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে যতোই চমক ও রোমাঞ্চ কোনও রাজনৈতিক দল কিংবা সংগঠন সৃষ্টি করুক না কেনো, তার মোহ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জাসদ ও সর্বহারা পার্টির পরিণতি সেই সাক্ষ্যই বহন করে।

আওয়ামী-বাকশালী অপশাসন এবং নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট জনগণ তাদের সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে খুশি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাদের দলীয় নীতি-আদর্শের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সীমিত। তাই ধূমকেতুর মতোই ঘটেছিল তাদের উথান-পতন।
পক্ষান্তরে সঠিক নীতি-আদর্শ এবং কৌশল গ্রহণের ফলে সেনা অভ্যুথানের সপক্ষে জাতীয় পর্যায়ে একটি রাজনৈতিক অঘোষিত মোরচা গঠন করতে সক্ষম হয় সেনা পরিষদ।

শেখ মুজিবের বদান্যতায় যে সমস্ত পা চাটা আওয়ামীভক্ত অফিসাররা এক লাফে মেজর থেকে জেনারেল হয়েছিলেন ঐ সমস্ত কাঁধভারি নপুংসক অফিসারদের চরিত্রের কিছুটা নমুনা এবং জিয়ার সাথে লেখকের সম্পর্ক কেমন ছিল সেটা বুঝার জন্য জেনারেল জিয়ার কোর্সমেট কর্নেল (অব) এম এ হামিদের (প্রত্যাগত অফিসার) লেখা গ্রন্থ ‘তিনটি সেনা অভ্যুথান ও কিছু না বলা কথা’ থেকে একটি অনুচ্ছেদ তুলে ধরা হল।

“১৫ই আগস্ট আটটার দিকে ক্যান্টনমেন্টের প্রায় সব পদস্থ সিনিয়র অফিসাররা নিজ নিজ ইউনিট থেকে প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য এক এক করে সেনাসদরে এসে জড়ো হচ্ছিলেন। আমিও উপস্থিত হলাম ডিএমও কর্নেল নুরুদ্দিনের কামরায়, সেখানে ১৫/২০ জন সিনিয়র অফিসার জমায়েত হয়ে জটলা করছে। সবাই টেবিলের উপর রাখা একটা রেডিওতে খবর শুনছে উপুড় হয়ে। আমি নুরুদ্দিনের কাছে খবর জানতে চাইলাম। সে জানাল, স্যার, আপনি যতটুকু জানেন, ঠিক ততটুকুই আমি জানি, আপাতত খবর ঐ খানে, সে টেবিলে রাখা রেডিওটার দিকে ইঙ্গিত করলো। এরই মধ্যে, দেখলাম দু’টি জীপ কালো ড্রেস পরা সেপাইদের নিয়ে মেইন গেট দিয়ে শোঁ শোঁ করে দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে। চীফের কামরার সামনে এসে থামল জীপ দুটো। একটি জীপ থেকে নামল মেজর ডালিম এবং কারো প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা চীফ এর ঘরের ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলো ডালিম, পথে বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিট কমান্ডার কর্নেল মোমেন আমাদের কাছ থেকে বারান্দা পেরিয়ে মেজর ডালিমের সাথে আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করে, আমিও তখন বারান্দা থেকে নেমে এসেছি মোমেনের পেছনে। ডালিম বিরক্ত হয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো, স্যার! দয়া করে চুপচাপ সরে যান। তার রাগান্বিত মূর্তি দেখে আমি বারান্দার একটা ক্ষুদ্র পিলারের পেছনে নিজের শরীরটা কোনোমতে আড়াল করে নিলাম। কর্নেল ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া অবস্থায় ফিরে এলো আমার কাছে।

মেজর ডালিম এসেছে জানতে পেরে নুরুদ্দিনের কামরায় জমা হয়ে যেসব অফিসাররা গভীর মনোযোগ দিয়ে কান পেতে খবর শুনছিল তারা কোনও কিছু না বুঝেই মহাবিপদ আশংকায় পড়ি কি মরি অবস্থায় যে যেদিকে পারল প্রাণ নিয়ে দিল ছুট। এক নিমিষে ১৫/২০ জন সিনিয়র অফিসারের জটলা সাফ! তড়িঘড়ি করতে গিয়ে কেউ চেয়ার উল্টালো, কেউ অন্যকে মাড়ালো। একজন তো আস্ত টেবিলটাই উল্টে ফেলে দিলো। আমিও দিলাম ভোঁ দৌড়। বিপদে চাচা আগে আপনা প্রাণ বাঁচা। তখন চীফের ঘরে উপস্থিত ছিলেন জেনারেল শফিউল্লাহ, জেনারেল জিয়া, ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল নাসিম। জীপ দুটোর উপর রাইফেল হাতে উপবিষ্ট কয়েকজন সৈনিক। যেকোনো মুহূর্তে হুকুম পেলে অনল বর্ষণে প্রস্তুত। যখন দেখলাম কিছুই হচ্ছে না, তখন উঁকিঝুঁকি দিয়ে পূর্বের অবস্থানে পিলারের আড়ালে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই চীফের ঘরের দরজা খুলে গেলো। বেরিয়ে এলেন চীফ শফিউল্লাহ, তার পেছনে মেজর ডালিম। শফিউল্লাহর মুখ কালো ও গম্ভীর। স্পষ্ট বোঝা গেলো একান্ত নিরুপায় হয়েই তিনি ডালিমের সাথে বেরিয়ে আসছেন। ডালিমের পেছনেই জেনারেল জিয়া, ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ। শফিউল্লাহ নিজের স্টাফ কারেই উঠলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদকে সঙ্গে নিয়ে। আমি লুকিয়েই সবকিছু দেখছিলাম আর শুনছিলাম। জিয়া ডালিমকে সহাস্যে আমন্ত্রণ জানালেন এসো ডালিম তুমি আমার গাড়ীতে। না স্যার, জেনারেল-এর গাড়ীতে আমি কেনো! সুস্পষ্ট জবাব দিয়েই ডালিম তার জীপে চড়ে বসলো। ডালিমের পেছনে শফিউল্লাহ ও জিয়ার গাড়ী তার পেছনে দ্বিতীয় সশস্ত্র জীপ। শোঁ শোঁ করে বেরিয়ে গেলো চারটি গাড়ীই।’’

সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী বাকশাল সরকারের উচ্ছেদ এবং মুজিবের মৃত্যুর ঘোষণা দিয়েই আমি রেডিও স্টেশন থেকেই প্রথমে জেনারেল ওসমানীকে ফোন করে বলেছিলাম স্যার, দেশবাসীর দোয়া ও আল্লাহপাকের অসীম করুণায় মুজিবশাহীর পতন ঘটাতে সফল হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ! রশিদ অল্পক্ষণের মধ্যেই জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদকে নিয়ে এখানে আসছে। পৌঁছেই তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণকারী হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন। আজকে সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান হবে। জেনারেল জিয়ার সাথে আলাপ করে তিন বাহিনী প্রধানদের রেডিও স্টেশনে নিয়ে আসার জন্য আমি নিজেই যাচ্ছি ক্যান্টনমেন্টে। রক্ষীবাহিনী প্রধান এবং আই জি পুলিশকেও নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষিও আসছেন। কালকে আমি নিজে এসে আপনাকে বঙ্গভবনে নিয়ে যাবো রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাতের জন্য। তিনিই আপনাকে অনুরোধ জানাবেন ডিফেন্স এ্যাডভাইজার হিসাবে তার সরকারে যোগ দিতে।

এরপর জিয়াকে ফোন করে তাকে বলি আপনি শফিউল্লাহকে বুঝিয়ে বলবেন, জনপ্রিয় সফল অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কোন সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার অবকাশ নেই। অবস্থার সামাল দিতে হবে সংবিধান অনুযায়ী পদক্ষেপের মাধ্যমেই। তবে একটি বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণ করে শফিউল্লাহকে সরিয়ে আপনাকে চীফ অফ স্টাফ পদে বহালের হুকুম জারি করার পরও কৌশলগত কারণেই আপনার সাথে সেনা পরিষদের সম্পর্কের বিষয়টি গোপন রাখতে হবে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে রেডিওতে ঘোষণা শুনে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল ভোরে যখন জেনারেল জিয়াকে ফোন করেছিলেন তখন নির্লিপ্ত গলায় জিয়া জবাবে বলেছিলেন, “If the President is killed then Vice President is there, let the constitution take its course”. আর জেনারেল জিয়া যখন আমাকে তার স্টাফ কারে বসার আহ্বান জানিয়েছিলেন তখন আমি তার অপ্রত্যাশিত আহ্বানে সাড়া না দিয়ে নিজের জীপেই উঠে বসেছিলাম। চীফের ঘরে আমাকে তেমন কিছুই বলতে হয়নি। জেনারেল জিয়া আর ব্রিগেডিয়ার খালেদই জেনারেল শফিউল্লাহকে যা বোঝাবার বুঝিয়েছিলেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ, চীফ অফ জেনারেল স্টাফ অভিমত দিয়েছিলেন “Bangabandhu is dead. The army has revolted and whole army has celebrated. So, no one can dare to do anything now.” জিয়া বলেছিলেন, “We must uphold the constitution giving allegiance to the new government.”

এ থেকে জেনারেল শফিউল্লাহ বুঝতে পারলেন পুরো সেনাবাহিনী তখন তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই আমার সাথে বেরিয়ে আসতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে আমি জেনারেল জিয়াসহ তিন বাহিনী প্রধানকে সাথে নিয়ে ফিরে এলাম রেডিও স্টেশনে। রক্ষীবাহিনী প্রধান ও আই জি পুলিশকেও এনে হাজির করা হয়েছে। বিডিআর প্রধানকেও তলব করে আনা হয়েছে।

রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদ রেডিও বাংলাদেশ এ পৌঁছানোর পর তাকে আমার নেতৃতেই সর্ব প্রথম ‘গার্ড অফ অনার’ দেয়া হয়। তারপর সেনা পরিষদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি জনাব খোন্দকার মোশতাক আহমেদ জাতির উদ্দেশ্যে তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। এরপর প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রধানরা একে একে সবাই রাষ্ট্রপতি জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদের আনুগত্য প্রকাশ করে বৈপ্লবিক অভ্যুথানের সপক্ষে ভাষণ দিলেন। সেগুলো রেডিও এবং টিভিতে প্রচারিত হয়েছিলো।

ঐদিন সন্ধ্যায় এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসাবে বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করেন। ২৫শে আগস্ট সরকারি আদেশে রাজবন্দী মশিউর রহমান এবং অলি আহাদকে বিনাশর্তে মুক্তি দেয়ার সাথে বাকশাল কায়েম করার ফলে বিলুপ্ত সব রাজনৈতিক দলগুলোকে দলীয় রাজবন্দীদের তালিকা প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়। একই দিনে জেনারেল ওসমানীকে রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেয়া হয়। জেনারেল খলিলুর রহমানকে জয়েন্ট চীফ অফ ডিফেন্স স্টাফ পদে বহাল করা হয়। জেনারেল শফিউল্লাহর স্থানে জেনারেল জিয়াউর রহমান আর্মি চীফ অফ স্টাফ হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বিমান বাহিনী প্রধান হিসাবে নিযুক্তি পান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তোয়াব। রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খানকে নৌবাহিনী প্রধান রেখে দেয়া হয়। এখানে পাঠকদের জানতে হবে যেকোনো রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী প্রধানদের শুধুমাত্র পেশাগত যোগ্যতা কিংবা জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয় না। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেবার আগে রাজনৈতিক এবং অন্য আরও অনেক বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে।

১৬ই আগস্ট মওলানা ভাসানী নয়া সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে একটি তারবার্তা পাঠান। একই দিনে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকা দু’টি মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়।

৩রা অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে(রেডিও এবং টিভিতে প্রচারিত) ঘোষণা করেন, ১৯৭৬ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে দেশে বহুদলীয় অবাধ গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি পুনরায় চালু করা হবে এবং ১৯৭৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ বিষয়ে একটি সরকারি অর্ডিন্যান্সও জারি করা হয়।

এই বাস্তবতার আলোকে, জিয়া কি করে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা হয়ে উঠলেন? তিনি তো পুনঃনিয়োগের পর প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদের আদেশ মোতাবেক বহুদলীয় রাজনীতি চালু করতে বাধ্য হয়েছিলেন মাত্র।

সেনা পরিষদের মধ্যমণি জেনারেল জিয়াকে ৭ই নভেম্বরের পর পুনরায় সেনাপ্রধান হিসাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পর আশ্চর্যজনক ভাবে স্বয়ং জেনারেল জিয়া ও তার দোসররা জোর প্রচারণা চালাতে লাগলেন দেশে-বিদেশে যে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের যুগান্তকারী বৈপ্লবিক অভ্যুথানের মূল চালিকা শক্তি গোপন সংগঠন সেনা পরিষদ, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবীদের সাথে তার কোনও সম্পর্কই ছিল না। তাই যদি হয় তবে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে তিনি ও তার দল রাষ্ট্রপতি মোশতাকের জারিকৃত ‘Indemnity Ordinance’ টিকে ‘Indemnity Act’ এ রূপান্তরিত করে ৫ম সংশোধনীর অংশ হিসাবে দুই তৃতীয়াংশের বেশি ভোটে নির্বাচিত সংসদে পাস করিয়ে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কোন যুক্তিতে?

অনেকেই বলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশেষ করে এক ধরনের আঁতেলরা।

তাদের বক্তব্য হচ্ছে আগস্ট বিপ্লবের নেতারা নাকি প্রাণের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। পালিয়ে যাওয়া আর কৌশলগত কারণে দেশত্যাগ-এর মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ বইতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে, বাংলা ওয়েব সাইট www.majordalimbubangla.com -এও দেয়া আছে। পাঠক যদি সেগুলো পড়ে থাকেন তবে সত্যটা জানতে পারবেন। এবার এগিয়ে চলা যাক।

৩রা নভেম্বর রাত ৮ টা ৪৫ মিনিটে আমরা, সেনা পরিষদের প্রকাশিত হয়ে পড়া শীর্ষ নেতারা পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী সপরিবারে উপস্থিত হলাম এয়ারপোর্টে ব্যাংককে যাবার জন্য। সাথে যাচ্ছেন খালেদ ভাই-এর স্ত্রী রুবি ভাবী এবং গুডু ভাই-এর স্ত্রী নিলু ভাবী। পলায়নকারী বিপ্লবীদের সাথে ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল হুদার স্ত্রীরা সহযাত্রী হবেন কন যুক্তিতে? ঢাকা সেনানিবাস থেকে অনেক অফিসার আর সেনারা এসেছিলেন প্রিয় নেতাদের বিদায় জানাতে। ভীরু, পলায়নকারী নেতাদের বিদায় জানাতে এত সেনা সদস্য এয়ারপোর্টে আসবেন কেনো? তারা এসেছিলেন, কারণ তাদের বেশির ভাগই ছিলেন সেনা পরিষদের সদস্য। তাদের জানা ছিল আমরা কৌশলগত কারণেই সাময়িকভাবে দেশত্যাগ করছি।

যথাসময়ে ফকার ফ্রেন্ডশিপ-এর স্পেশাল ফ্লাইটটি আমাদের নিয়ে উড়াল দিল। পথে চট্টগ্রামে রিফুয়েলিং এর জন্য অবতরণ করলো বিমান। আগে থেকে খবর দেয়ায় চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে সেনা পরিষদের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা টারম্যাকে অপেক্ষা করছিলেন। আমি প্লেন থেকে নেমে তাদের সাথে কিছু জরুরি আলাপ শেষে প্লেনে ফিরে এলাম। প্লেন টেক অফ না করা পর্যন্ত তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানিয়েছিলেন। এরপর, রেঙ্গুন হয়ে ব্যাংকক পৌঁছলাম। রেঙ্গুন এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রদূত খাজা কায়সার এবং মিলিটারি এট্যাঁ’চে কর্নেল নুরুল ইসলাম শিশু।