বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করা হল জেনারেল জিয়াকে

৭ই নভেম্বর রাত ১২ টায় বিপ্লব শুরু করার সাঙ্কেতিক ট্রেসার গোলা ছোঁড়ার পরেই, মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী ট্যাংক সাথে নিয়ে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার জন্য ক্যান্টনমেন্টের ২৭ নং শহীদ মইনুল রোডের বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হল।
মেজর হাফিজ এবং তার ভায়রা লেফটেন্যোন্ট ইকবালের অধীনস্থ ১ম ইস্টবেঙ্গলের যে সমস্ত সৈনিকদের জিয়ার বাসায় গার্ড হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল তারা অবস্থা বেগতিক দেখে বিপ্লবীদের আগমনের আগেই পেছনের দেয়াল টপকে পালিয়ে গিয়েছিল।
মহিউদ্দিনের নির্দেশে ছাদ লক্ষ করে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা আওয়াজ করা হল। কিন্তু ভেতর থেকে ফায়ারের কোন জবাব এলো না।

তখন রাইফেলের বাঁট দিয়ে গেটের তালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ল মেজর মহিউদ্দিনের দল। জিয়ার ড্রাইভার তাদের পশ্চিম দিকের দরজার কাছে নিয়ে যায়। মহিউদ্দিন দরজায় আওয়াজ তুলে দরজা খোলার জন্য বার বার অনুরোধ করতে থাকে। এক সময় বারান্দায় বের হয়ে আসেন জেনারেল জিয়া, পেছনে পত্নী খালেদা জিয়া। জিয়াকে দেখে মেজর মহিউদ্দিন স্যালুট করে শান্ত গলায় বলল স্যার, আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।

চারদিক থেকে তখন শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন স্লোগান আর ফায়ারিং এর শব্দ। এই বস্থায় ভীতসন্ত্রস্ত জিয়া কিছুটা সঙ্কোচের সাথেই বলে উঠলেনআমি তো রিটায়ার করেছি, আমি আর কিছুর মধ্যে নেই, আমি কোথায় যাবো! তোমরা শুধু আমার পেনশনের ব্যবস্থাটা করে দিয়ো। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা!

জেনারেল জিয়াকে একটু নিরালায় নিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে মহিউদ্দিন বলল ব্যাংকক থেকে সেনা পরিষদের নেতাদের নির্দেশেই আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। খালেদ-চক্রের পাশা আমরা উলটে দিয়েছি আর একটি সফল বিপ্লবের মাধ্যমে। আমরা আপনাকে আবার চীফের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবো। আপনাকে নিয়েই যাবো। দোহাই আল্লাহর, আপনি আমাদের সাথে আসুন।
দৃঢ় আহবান জানালো মেজর মহিউদ্দিন। সে সময় জিয়া সব কিছু বুঝতে পেরে আশ্বস্ত হলেন। বেগম জিয়া তখন শুকনো মুখে জড়োসড়ো হয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছুই অবলোকন করছিলেন অবাক বিস্ময়ে!

লাগাতার গোলাগুলির মাঝে স্বামীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে তিনি বলে উঠলেন দেখুন ভাই, আমাদের নিয়ে আর টানাটানি করবেন না, প্লিজ দয়া করে আমাদের ছেড়ে দিন।

স্যার, ভাবীকে বুঝিয়ে বলুন আপনি আমাদের মনোনীত চীফ, তাই আপনাকে যেতেই হবে।

আমি আসছি। বলে খালেদা জিয়াকে সঙ্গে করে তিনি ভেতরে চলে গিয়ে ভাবীকে বুঝিয়ে শান্ত করে কাপড় পাল্টে ফিরে আসলেন।
মেজর মহিউদ্দিনের ইশারায় বিপ্লবীরা তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে জীপে বসিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চললো। উপস্থিত বিপ্লবীরা স্লোগানে স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুললো-

নারায়ে তাকবির, আল্লাহ হু আকবর।

জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ।

সিপাহী-জনতা ভাই ভাই।

বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।

বেগম খালেদা জিয়া তখন বারান্দায় দাড়িয়ে আবেগ উচ্ছ্বসিত সিক্ত নয়নে অপূর্ব এক ঐতিহাসিক অভাবনীয় ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলেন। পথিমধ্যে নিচু গলায় মেজর মহিউদ্দিনকে জিয়া জিজ্ঞেস করলেন

কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?

২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে। সংক্ষিপ্ত জবাব।

দুর্ভেদ্য নিরাপত্তার বেষ্টনী সৃষ্টি করে রেখেছে জিয়ার জীপের চারিদিকে গোলন্দাজ ও ল্যান্সার এর সৈনিকরা। সেনা পরিষদের বীর বিপ্লবীরাই সেদিন জিয়াকে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে এনেছিলো। ইউনিট লাইন এ ঢোকার সাথে সাথেই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল ২য় ফিল্ড এবং ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক এবং অফিসাররা। জেনারেল জিয়াকে সোজা নিয়ে যাওয়া হল কমান্ডিং অফিসারের কামরায়। সেখানে মেজর মহিউদ্দিন, কর্নেল আমিনুল হক, ক্যাপ্টেন জুবায়ের, ক্যাপ্টেন কামাল, ক্যাপ্টেন মুনির, সুবেদার মেজর আনিস ছাড়া আর কাউকেই ঢুকতে দেয়া হচ্ছিলো না। বাইরে সৃষ্টি করা হয়েছে কড়া নিরাপত্তা বলয়।
মূলত, স্বেচ্ছায় কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণকারী দেশান্তরী নেতৃত্বের অধীনেই পরিচালিত হয়েছিলো ৭ই নভেম্বর এর সফল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। কর্নেল তাহেরের দায়িত্ব ছিল ক্যান্টনমেন্টের বাইরে।

ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থার সেলগুলো পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেনা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনস্থ হয়েই নির্দেশ মেনে চলছিলো।

২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে পৌছে পায়জামা-পাঞ্জাবী পরা জিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। তিনি অতি সহজেই বুঝেতে পারলেন আগস্ট বিপ্লবের অগ্রণী সেনা পরিষদই ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি। জিয়া যখন তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন তখন মেজর মহিউদ্দিন তাকে অবহিত করলো স্যার, এই বিপ্লবের পরিকল্পনা গৃহীত হয় বঙ্গভবনে আগস্ট বিপ্লবের শীর্ষনেতাদের সাথে কর্নেল তাহেরের কয়েক দফা বৈঠকের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতেই। প্রকাশিত নেতারা ব্রিগেডিয়ার খালেদের সাথে আলোচনার পর কৌশলগত কারণে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। দেশ ছাড়ার আগে তারা দেশের সব সমমনা রাজনৈতিক ও সংগঠনের নেতাদের সাথেও আলাপ করে যান। ব্যাংকক পৌঁছনোর পর থেকে তাদের সাথে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। ঐ বৈঠকগুলোতে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো ছিল

১। সেনা পরিষদ ও বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে উপযুক্ত সময় আরও একটি সামরিক অভ্যুথান ঘটিয়ে খালেদ-চক্রকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে যখন তারা দেশ বিরোধী ভারতীয় দালাল হিসাবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

২। সফল বিপ্লবের পর আপনাকে পুনরায় আর্মি চীফের পদে অধিষ্ঠিত করা হবে।

৩। আগস্ট বিপ্লবের চেতনা ও কর্মসূচিকে এগিয়ে নেবার জন্য জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য আপনাকেই অনুরোধ জানাতে হবে।

৪। অবিলম্বে বিদেশে অবস্থানরত নেতাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে পুনর্গঠনের কাজে আপনাকে সহযোগিতা করার জন্য।

৫। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কিছু দাবি দাওয়াও বিবেচনায় নেয়া হবে যেমন- সৈনিকদের বেতন-ভাতা পুনর্বিবেচনা, ব্যাটম্যান প্রথার বিলুপ্তি, পদ ও প্রমোশন এর ব্যপারে স্বচ্ছতা।

জেনারেল জিয়া মেজর মহিউদ্দিনকে নির্দেশ দেন পালিয়ে থাকা ভীতিগ্রস্ত সব অফিসারদের ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা চালাতে। বিডিআর থেকে ব্রিগেডিয়ার খলিল, কর্নেল মহব্বতজান চৌধুরী, রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান এবং এভিএম তোয়াবকেও ডাকিয়ে আনা হল জিয়ার নির্দেশে। ইতিমধ্যে শহরের স্ট্র্যাটেজিক সব নির্ধারিত যায়গাগুলো বিপ্লবীরা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। ট্যাংক ডেপ্লয়মেন্ট এর দায়িত্বও সম্পন্ন করে ফেলেছে রিসালদার সারোয়ার। শহর নিয়ন্ত্রণের জন্য কন্ট্রোল রুম প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে রেসকোর্সে। হঠাৎ মেজর মহিউদ্দিন-এর কাছে মেসেজ এলো রেডিও এবং টিভি স্টেশন নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঠানো কমান্ডারের। রেডিও স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ কর্নেল তাহের ছাড়তে চাইছিলেন না, কিন্তু কমান্ডার নির্দেশ অনুযায়ী রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়াতে কর্নেল তাহের ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে শাসিয়ে বলেছেন, তিনি ক্যান্টনমেন্টেই যাচ্ছেন। জবাবে মহিউদ্দিন কমান্ডারকে বলেছিলো

তাকে আসতে দাও আমরা দেখবো। তুমি তোমার দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছো। তার জন্য ধন্যবাদই তোমার প্রাপ্য। আমার হুকুম ছাড়া অন্য কাউকেই তুমি রেডিও স্টেশন এবং টিভি স্টেশনে ঢুকতে দেবে না। বিশেষ করে কর্নেল তাহেরসহ জাসদ কিংবা বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থার কাউকেও আমার অনুমতি ছাড়া ঢুকতে দেবে না। তখনই মেজর মহিউদ্দিন আমাদের সাথে যোগাযোগ করে সবকিছু জানিয়ে জানতে চাইল করণীয় কি? তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হল, রেডিও এবং টিভি স্টেশন একই সাথে সাভারের বুস্টার স্টেশন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ট্যাঙ্কও সেখানে ডেপ্লয় করতে হবে কালবিলম্ব না করে নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য। তাকে সতর্ক করে আরও বলে দেয়া হল, কোনক্রমেই জিয়ার উপর সওয়ার হতে দেয়া চলবে না কর্নেল তাহেরকে। জিয়াকে দিয়ে তার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা তাহের করলে করতেও পারেন। সে ধরনের কোনও উদ্যোগ নিলে সহযোগী হলেও তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে মহিউদ্দিনকে। প্রয়োজনে তাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে তার বিরুদ্ধে প্রবেশ নিষেধের আদেশ জারি করতে হবে।

রাত ২:৩০ মিনিটে কর্নেল তাহের এসে পৌছালেন ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে। পৌছেই তিনি মেজর মহিউদ্দিনের কাছে জানতে চান রেডিও এবং টিভি, সাথে সাভারের বুস্টার স্টেশনে সৈনিকদের কেন পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।

নিরাপত্তার স্বার্থে, ছোট্ট কিন্তু দৃঢ় জবাব মহিউদ্দিনের। মহিউদ্দিনের সাথে তাহেরের বচসা হচ্ছে জানতে পেরে জিয়া নিজেই বেরিয়ে এলেন। তাহের তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ, তোমরা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছো। দেশকেও বাঁচিয়েছো।

জিয়াকে দেখে তাহের তাকে একটু নিরিবিলি জায়গাতে নিয়ে গিয়ে নিচু গলায় দাবি জানালো, কালক্ষেপ না করে এখনি তাকে রেডিওতে গিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে হবে। বলতে হবে- খালেদ-চক্রের পতন ঘটেছে, বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি আবার আর্মি চীফ এর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। অবস্থা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর হাতে। অনুরোধ জানাতে হবে দেশবাসীকে যাতে তারা দেশে পূর্ণ স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য সামরিক বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করে।

জিয়া জবাবে বললেন, প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সাথে তার আলাপ হয়েছে। তিনি তাকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হননি সাংবিধানিক জটিলতার জন্য। তিনি বললেন, খালেদ অর্বাচীনের মতো সংবিধান, মন্ত্রিসভা, সংসদ বাতিল করে দিয়ে মার্শাল ল’ জারি করার ফলে তার রাষ্ট্রপতি হওয়াটা আইনি ভিত্তি পাবে না। বর্তমান অবস্থায় জাস্টিস সায়েমকেই রাষ্ট্রপতি এবং চীফ মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে বহাল রেখে এবং তিন বাহিনী প্রধানকে উপ-মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করে সরকার পরিচালনা করেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তার মতে, এর কোনও আইনি বিকল্প নেই। তিনি জেনারেল জিয়াকে আরও বলেছেন, আর্মি চীফ হিসাবে তাকেই মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে। সরকারের মুখ্য লক্ষ্য হবে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে আগস্ট বিপ্লবের পর তার দেয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণের অঙ্গীকার অনুযায়ী যথা সময়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জাতীয় নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করা। সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই তিনি জনসমর্থিত রাষ্ট্রপতি হিসেবেই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ করবেন নির্বাচনে জিতলে। পরোক্ষভাবে তিনি তাদের রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

কেনো তিনি জেনারেল জিয়ার অনুরোধের পরও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন না সেই যুক্তি ও ব্যাখ্যা তিনি জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে ব্যক্ত করবেন। তিনিও জিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যত সত্বর সম্ভব একটি নাতিদীর্ঘ ভাষণের মাধ্যমে দেশবাসীকে অবগত করতে যে খালেদ-চক্রের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতা ব্যর্থ করে দিয়েছে দেশপ্রেমিক সশস্ত্রবাহিনী। জেনারেল জিয়া কর্নেল তাহেরকে আরো জানালেন, ব্যাংককে অবস্থিত অফিসারদের সাথে তার এবং জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদের যোগাযোগ রয়েছে। তারাও তার যুক্তিসঙ্গত উপস্থাপনা ও সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।

ঠিকই বলেছিলেন জিয়া। আমরা জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলাম। কারণ, তিনি একজন বিচক্ষণ পেশাদার আইনজীবীই শুধু ছিলেন না একই সাথে তিনি ছিলেন একজন সংবিধান বিশারদ।

সব শুনে তাহের বুঝতে পারলেন জিয়ার মাথায় হাত বুলানো সম্ভব নয়, কারণ ইতিমধ্যেই জেনারেল জিয়া বুঝে গেছেন ক্ষমতার কেন্দ্র কোথায় এবং খালেদের বিরুদ্ধে সফল বিপ্লব ঘটিয়ে সেনা পরিষদই তাকে মুক্ত করতে মূল ভুমিকা রেখেছে। তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা পালন করেছে সহযোগী ভূমিকা।

ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সূত্র থেকে মেজর মহিউদ্দিন জানতে পারে কর্নেল তাহের যেকোনো ভাবে জেনারেল জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে নিয়ে যেতে চাইছেন হত্যা করতে কিংবা কনো বিশেষ উদ্দেশ্যে। তাই সে তাহেরকে জানালো

জিয়া অবশ্যই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। কিছুক্ষণের মধেই রেডিও এবং টিভি স্টেশন থেকে লোক আসছে জেনারেল জিয়ার ভাষণ রেকর্ড করার জন্য। একই সাথে মহিউদ্দিন তাহেরকে জানিয়ে দিলো প্রেসিডেন্ট জাস্টিস সায়েম এবং খন্দকার মোশতাকের জাতির উদ্দেশে ভাষণও লাইভ প্রচারিত হবে রেডিও এবং টিভি থেকে সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে চলে যান কর্নেল তাহের। তার প্রাধান্য ক্রমশ কমে আসছে সেটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তার সব চিন্তা চেতনা তখন ঘুরপাক খাচ্ছে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই।

সেদিনই জেনারেল জিয়ার ভাষণ রেকর্ড করা হল ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টেই, তারপর থেকেই প্রচারিত হতে থাকে জেনারেল জিয়ার ভাষণ। সেই ভাষণ প্রচারিত হবার পর জাস্টিস সায়েমের ভাষণ এবং খন্দকার মোশতাকের জাতির উদ্দেশে ভাষণ লাইভ প্রচারিত হল রেডিও এবং টিভিতে। জেনারেল জিয়ার ভাষণের সারবস্তু ছিল-

“প্রিয় দেশবাসী, আমি জেনারেল জিয়া বলছি। আসসালামু আলাইকুম। ৭ই নভেম্বর এর মহান সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুথানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ-চক্রের জাতীয়স্বার্থ বিরোধী চক্রান্তের অবসান ঘটেছে এবং দেশ ও জাতীয় স্বার্থে এবং বিপ্লবীদের অনুরোধে আমি আবার সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমি দেশবাসীকে শান্ত থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনারা বন্ধ হয়ে যাওয়া অফিস, আদালত, বিমান বন্দর, মিল-কারখানা পুনরায় চালু করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করুন। বক্তব্য শেষ করার আগে জিয়া বলেছিলেন জনগণ ও সামরিক বাহিনীর একতা, দেশপ্রেম এবং আল্লাহই আমাদের সহায়। আল্লাহ্‌ হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।”

জিয়ার এই ভাষণ জনগণকে আশ্বস্ত ও উদ্দীপ্ত করে তুলেছিলো। খালেদের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’ সম্পর্কে দেশবাসী যখন বুঝতে পারে তার এই হঠকারি পদক্ষেপের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ইঙ্গিতে দেশকে ১৫ই আগস্টের পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আওয়ামী-বাকশালীদের পুনরায় ক্ষমতায় বসানো তখন থেকেই তারা আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করছিলো এই দেশবিরোধী চক্রান্তের হাত থেকে জাতিকে বাঁচানোর জন্য। তারা চাচ্ছিলো একটা পরিবর্তন। তাদের সেই প্রত্যাশার প্রতিফলনে যখন গর্জে উঠলো দেশপ্রেমিক সশস্ত্রবাহিনী তখন ১৫ই আগস্টের মতই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের সর্বত্র জনতার ঢল নেমেছিলো বিপ্লবীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। গর্জে উঠেছিলো তাদের সম্মিলিত কণ্ঠে ‘সিপাহী জনতা ভাই ভাই’, ‘সিপাহী জনতার বিপ্লব জিন্দাবাদ’ স্লোগান।

ঐ গগনবিদারী স্লোগানগুলো বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিলো বাংলাদেশের লড়াকু বীরসেনানী ও জনতার সংহতি জাতীয় স্বার্থে দুর্ভেদ্য। একই বার্তা পেয়েছিল আধিপত্যবাদী ভারত ও তাদের পোষা দেশীয় দালালরা।

৭ই নভেম্বের সকাল ৮ টার দিকে জেনারেল ওসমানী এলেন ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে। তিনি জেনারেল জিয়া এবং উপস্থিত সব বিপ্লবীদের মোবারকবাদ জানালেন। প্রথমেই জিয়াকে বললেন

জনাব খন্দকার মোশতাককেই পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবার অনুরোধ জানাতে হবে। জবাবে জেনারেল জিয়া তাকে খন্দকার মোশতাক এবং আমাদের সাথে যে আলাপ হয়েছে তা বিস্তারিত জানালেন। সব শুনে জেনারেল ওসমানী খন্দকার মোশতাকের যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশাবলীর সাথে একমত হলেন।

জেনারেল ওসমানীও অভিমত প্রকাশ করলেন

খন্দকার মোশতাকের অঙ্গিকার অনুযায়ী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে। এর জন্য অবিলম্বে স্বৈরশাসন বিরোধী সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। নির্ধারিত সময়ে শুরু করতে হবে বহুদলীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। তারপর সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর।

নতুন আঙ্গিকে যে সংবিধান প্রণীত হবে তাতে দেশের ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সমগ্র জাতির প্রত্যাশার প্রতিফলন থাকতে হবে। সংবিধানের ভিত্তি হবে জাতির ঐতিহ্য, কৃষ্টি, ধর্মীয়, মানবিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ।বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমান তাই, সংবিধানে স্পষ্টভাবে লেখা থাকবে সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌তালাই সার্বভৌম।এই বিশ্বাসই হবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের সংবিধানের মূলভিত্তি।

এ সমস্ত বিষয়ে যখন আলোচনা হচ্ছিলো তখন আবার এসে হাজির হলেন কর্নেল তাহের। মুখ কালো করে বসে থাকা তাহেরের উপস্থিতিতেই সেনা পরিষদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে প্রণীত সৈনিকদের দাবিনামাটি জেনারেল জিয়ার হাতে তুলে দেয়া হয়। সেটা পড়ে তিনি ওয়াদা করেন, দাবিগুলো ন্যায়সঙ্গত বিধায় সেগুলো অবশ্যই বাস্তবায়িত করা হবে। এরপর তিনি স্বেচ্ছায় সেই দাবিনামায় স্বাক্ষর করেন।

৭ই নভেম্বর জেনারেল জিয়ার জন্য ছিল একটি খুবই ব্যস্ত দিন। দুপুরে ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য জীপে করে জিয়া বের হলেন। সঙ্গে রয়েছে মেজর মহিউদ্দিন, সুবেদার মেজর আনিস ও বিশ্বস্ত এস্কর্ট। ১ম ইস্টবেঙ্গল, ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল, ল্যান্সার, সিগন্যাল, অর্ডন্যান্স, ইঞ্জিনিয়ার, লাইট অ্যাকঅ্যাক ইউনিটগুলো পরিদর্শন করে তারা ফিরে আসে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে।

কর্নেল তাহের তখনো বসেছিলেন জিয়ার ফেরার প্রতীক্ষায়। ফেরামাত্র কর্নেল তাহের জিয়াকে প্রস্তাব দিলেন, বিকালে তিনি শহীদ মিনারে এক ছাত্র-জনতার সমাবেশের আয়োজন করেছেন, সেখানে জেনারেল জিয়াকে যেতে হবে ভাষণ দিতে। প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়ে জিয়া তাহেরকে আমন্ত্রণ জানালেন সন্ধ্যায় রেডিও বাংলাদেশে আসার জন্য। হতাশ হয়ে চলে গেলেন কর্নেল তাহের। সন্ধ্যায় জিয়া রেডিও বাংলাদেশ-এ পৌঁছালেন। কর্নেল তাহেরও এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে জনাব খন্দকার মোশতাক এবং রাষ্ট্রপতি জাস্টিস সায়েম জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। জেনারেল জিয়া ও কর্নেল তাহের একত্রে বসেই তাদের ভাষণ শোনেন। সারাক্ষণই সেনা পরিষদের করা নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ছিলেন জিয়া।

এরপর তাহেরের বুঝতে বাকি রইল না সেনা পরিষদের প্রাধান্যের পরিপ্রেক্ষিতে দরকষাকষির মাধ্যমে জিয়াকে কিছুতেই কাবু করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। বেছে নিতে হবে অন্য পথ। রেডিও বাংলাদেশ থেকে ফেরার আগে মেজর মহিউদ্দিন কর্নেল তাহেরকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দেয়, তিনি যাতে সেনানিবাসে আর যাতায়াত না করেন। কারণ, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছিলো কর্নেল তাহেরের লোকজনেরা জেনারেল জিয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে।

রেডিও স্টেশন থেকে হতাশা ও ক্ষোভে কর্নেল তাহের হঠকারি সিদ্ধান্ত নেন, বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থার সদস্যদের মাধ্যমে শ্রেণী সংগ্রামের স্লোগান তুলে ঢাকা সেনানিবাসে অফিসার নিধনযজ্ঞ শুরু করে জিয়াসহ সেনা পরিষদকে পরাস্ত করে দখল করতে হবে ক্যান্টনমেন্ট সহ ঢাকা শহর। তার ধারণা ছিল, এই স্ফুলিঙ্গ দেশের অন্যান্য সেনানিবাসে দাবানল সৃষ্টি করবে। এভাবে সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করতে পারলে জনসমর্থন অতি সহজেই আদায় করা সম্ভব হবে।

এই ভ্রান্ত আত্মঘাতী পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭-৮ নভেম্বর গভীর রাত ১২ টায় অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকা সেনানিবাসের কয়েকটি জায়গায় স্লোগান শোনা গেলো ‘সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই অফিসারদের রক্ত চাই’, সাথে গোলাগুলির আওয়াজ! এমন একটা অঘটন কর্নেল তাহের ঘটাতে পারেন সে সম্পর্কে সচেতন ছিল সেনা পরিষদ। গোলাগুলির আওয়াজ ও বুক কাঁপানো স্লোগান শোনামাত্র ক্যান্টনমেন্টের বাসাবাড়ী ছেড়ে অনেক অফিসারই সপরিবারে প্রাণে বাঁচার জন্য পালাতে থাকেন। জেনারেল জিয়াকে নিরাপদ বেষ্টনীর মধে রেখে মেজর মহিউদ্দিন, সুবেদার মেজর আনিস এবং ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে অবস্থিত অফিসাররা মুহূর্তে অন্যান্য ইউনিটে যোগাযোগ করে পাল্টা অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

শুরু হয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ক্যান্টনমেন্টে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় অস্ত্রধারী ছোট ছোট কয়েকটি সক্রিয় গ্রুপকে কাবু করে বন্দী করা হয়। ফলে স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল সৃষ্টির খায়েশ পূর্ণ হল না কর্নেল তাহেরের!

সামরিক বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রামের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে কর্নেল তাহের গা ঢাকা দিতে বাধ্য হন। তার এই ধরনের হঠকারিতায় প্রাণ হারায় বেশকিছু সেনা সদস্য এবং ১২ জন অফিসার।

রাত ভোর হবার আগেই ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সাধারণ শহরবাসী এই মর্মান্তিক ঘটনার কিছুই টের পেল না।

৯ই নভেম্বর কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে জাসদের রব, মেজর জলিলসহ আরও কয়েকজনকে মুক্তি দেয়া হয়। ১০ই নভেম্বর থেকে ১২ই নভেম্বরের মধ্যে পালিয়ে যাওয়া প্রায় সব অফিসার যার যার ইউনিটে যোগদান করেন। তাদের পরিবার পরিজনরাও ফিরে আসে। ইতিমধ্যেই যশোহর থেকে কর্নেল সালামের কম্যান্ডো ব্যাটেলিয়ান ঢাকায় এনে সেনা সদরের নিরাপত্তা জোরদার করে জেনারেল জিয়া ২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে নিজেকে চীফ অফ স্টাফের অফিসে অধিষ্ঠিত করেন। এরপর থেকে সেখান থেকেই তিনি সেনা প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।

কর্নেল তাহেরের দুটো চালই ব্যর্থ হয়ে যাবার পর গোপনে জাসদের নেতৃত্বের সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় দেশে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে যাতে প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠাতে বাধ্য হয়। তারা নিশ্চিত ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটাতে পারলে শুরু করা সম্ভব হবে জনযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয়ী জাসদ দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম করতে সক্ষম হবে।

সিদ্ধান্ত হল, ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে রাষ্ট্রদূতসহ সব কূটনীতিক ও স্টাফদের মেরে ফেলা হবে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার অবশ্যই বাংলাদেশে সামরিক হামলা চালাবে।

উল্লেখ্য, আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানের পর এই ধরনের অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘিরে ভারত সৈন্য মোতায়েন করেছিলো প্যারা ব্রিগেড সহ। কিন্তু ১৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের প্রতি জনসমর্থন দেখে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার বাংলাদেশ আক্রমণের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। সম্প্রসারণবাদী ভারতের সিদ্ধান্ত বদলের আরও দুটো কারণ ছিলঃ

১। শেখ মুজিবের বাকশালী স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে বেসামরিক সরকার গঠন করার পরেই পাকিস্তান, গণচীন এবং সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে।

২। ভারতীয় সেনা মোতায়েনে উদ্বেগ প্রকাশ করে একই সাথে ভয়েস অফ আমেরিকা এবং রেডিও পিকিং(বেইজিং) থেকে ঘোষিত হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কোন বহিঃশক্তির আগ্রাসন পুরো অঞ্চলকেই অস্থিতিশীল করে তুলবে, সেটা গণচীন এবং আমেরিকা সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। শুধু তাই নয়, গণচীন ভারতীয় সেনা মোতায়েনের প্রতিক্রিয়ায় অরুণাচল এবং মেঘালয় সীমান্তে চীনা সামরিক বাহিনীকে জোরদার করে তোলে। গণচীন ও আমেরিকার সতর্কবাণীকে হাল্কাভাবে নেয়া সম্ভব ছিল না সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ভুক্ত ভারতের। সিদ্ধান্ত বাতিল করলেও ভারতীয় বাহিনী ডেপ্লয়েড রাখা হয়। এ সম্পর্কে জাসদ এবং কর্নেল তাহের অবগত ছিলেন।

সুযোগ সৃষ্টি করে দেবার জন্য তাহেরের অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার একটি সশস্ত্র দল ভারতীয় দূতাবাসে তার দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে হামলা চালায়। গোলাগুলিতে রাষ্ট্রদূত সমর সেন আহত হয়ে প্রাণে বেচে যান। দুই পক্ষেই হতাহত হয় কয়েকজন। বাকিরা ধরা পড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। সমর সেন বেচে যাওয়ায় ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের ভেতরে আগ্রাসনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।

এই ঘটনার দায়ে জাসদের কর্নেল তাহেরসহ মেজর জলিল, রব, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ শীর্ষ নেতাদের পুনরায় গ্রেফতার করা হয় ১৯শে নভেম্বর।

২১শে জুলাই ১৯৭৬ সালে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত রায়ে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তার ভুল রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের স্বার্থে ভ্রান্ত পদক্ষেপের সব হিসাব নিকাশ চুকিয়ে দিয়ে যান দেশ প্রেমিক, জনদরদী বীর মুক্তিযোদ্ধা পরম সুহৃদ কর্নেল তাহের।

মার্শাল ল’ এর অধীন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দারকেই (জিয়ার কোর্সমেট) জেনারেল জিয়া নিযুক্ত করেছিলেন। অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন উইং কমান্ডার রশিদ, কমোডোর সিদ্দিক আহমেদ, ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল আলি ও হাসান যদিও সেই বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে আজঅব্দি।

রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচার বিভাগীয় পদ্ধতি গুরুতরভাবে লঙ্ঘন এবং তড়িঘড়ি করে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হলেও জাসদের অন্যান্য শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের কিন্তু ফাঁসি হল না। পরবর্তী কালে দেখা গেলো তাদের অনেকেই জেনারেল জিয়ার সাথে পরে সখ্যতাও গড়ে তোলেন। এরাই আবার আজঅব্দি কর্নেল তাহেরের জন্য কুম্ভিরাশ্রু ফেলতে ফেলতে এরশাদ এবং আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করে মন্ত্রীসভা অলংকৃত করে ক্ষমতার হালুয়া-লুচি উপভোগ করে চলেছেন লজ্জাহীন ভাবে।

এই সমস্ত নীতি বিবর্জিত আদর্শহীন রাজনীতিকদের চরিত্র সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে দেশে সুস্থ রাজনীতির স্বার্থেই। শুধু তাই নয়, যারা দাবি করে এবং ন্যক্কারজনকভাবে প্রচারণায় লিপ্ত যে, কিছু বিপথগামী চাকুরিচ্যুত জুনিয়র অফিসারই শেখ মুজিবের স্বৈরাচারী বাকশাল সরকারের পতন ঘটিয়েছিলো। সেটাই যদি সঠিক হতো তবে, দেশের সামরিক বাহিনীর বৃহদংশ এবং রক্ষীবাহিনী সহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গুটিকতক বিপথগামী চাকুরিচ্যুত জুনিয়র অফিসারকে অতি সহজেই পরাস্ত করা যেতো। সেটা সম্ভব হল না কেনো?

জাসদ এবং অন্য যারা দাবি করে থাকে কর্নেল তাহের জেনারেল জিয়াকে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করেছিলেন এবং তিনিই ছিলেন ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লবের মূল নেতা। সেটাই যদি সত্য হয়ে থাকে তবে মেজর মহিউদ্দিনের হুকুম মেনে নিয়ে কর্নেল তাহের ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিলেন কেনো? প্রবেশ নিষেধ আদেশই বা মেনে নিতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন কেনো? উল্লেখিত যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের উদ্ভট বক্তব্যের সত্যতা কতটুকু সেটা যাচাই করার ভারও থাকলো পাঠকদের উপরেই।

২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে নিজেকে বের করে সেনাসদরে অধিষ্ঠিত করার পর মোটামুটি স্বচ্ছন্দ বোধ করতে লাগলেন সেনা পরিষদ ও বিপ্লবীদের মধ্যমণি জেনারেল জিয়াউর রহমান। তখন তার অন্য রূপ। তাকে তখন ঘিরে রেখেছে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত, কর্নেল অলি, ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর, ব্রিগেডিয়ার মহব্বতজান চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার মচ্ছু সালাম, ব্রিগেডিয়ার এরশাদ, কর্নেল মইনুল হোসেন, কর্নেল সাদেক, কর্নেল নাসিম প্রমুখ। এরাই তখন জেনারেল জিয়ার মুখ্য পরামর্শদাতা।

এই বেষ্টনীর ধারে কাছেও যাবার সুযোগ নেই মেজর মহিউদ্দিন, সুবেদার মেজর আনিস, রিসালদার সারোয়ার কিংবা ফ্লাইট সার্জেন্ট আফসারের। পরীক্ষিত সাথীদের দূরে সরিয়ে তিনি যাদের আস্থাভাজন মনে করে কাছে টেনে নিলেন ঐ সমস্ত ক্ষমতালিপ্সু মাকড়সার দল তখন জিয়ার অজান্তেই তার চারপাশে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করেছে।
ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত জিয়াকে বুঝিয়ে ঢাকায় ৯ম পদাতিক ডিভিশন দাড় করিয়ে পদোন্নতি বাগিয়ে নিজেই জেনারেল কমান্ডিং অফিসার হয়ে বসেছেন। তার পরামর্শেই ভারতে এনডিসি কোর্স কালেই এরশাদকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ডবল প্রমোশন দিয়ে জেনারেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয় এবং দেশে ফেরার পর তার মতো একজন চরিত্রহীন দুর্নীতি পরায়ণ অফিসারকে ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ পদে নিয়োগ দেন জেনারেল জিয়া।

দিল্লীর টার্ম শেষে মঞ্জুরকেও জেনারেল বানিয়ে চীফ অফ জেনারেল স্টাফের পদে নিয়োগ প্রদান করা হয় ক্ষমতার ভারসম্যতা রক্ষার স্বার্থে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি অনুযায়ী। এই ধরনের কূট-কৌশলের পরিণাম কি ভয়ংকর হতে পারে সেটা সব ক্ষমতার অধিকারী জেনারেল জিয়া তখন বুঝতে পারেননি। বুঝেছিলেন অনেক পরে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে কথা পরে আসবে।

এ পর্যায়ে একটি কাকতালীয় যোগাযোগের বিষয় উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। এরশাদ যখন ভারতে এনডিসি কোর্স করছিলেন, তখন মুচকুন্দ দুবে নামের ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক চৌকস অফিসারের সাথে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তার মাধমেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW (রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং) এর সাথে এরশাদের সম্পর্ক স্থাপনের ঘটনাটি ঘটে। এ সম্পর্কে জিয়া বোধকরি অবগত ছিলেন না। এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের পরই সেই মুচকুন্দ দুবেকেই ভারত সরকার ঢাকায় তাদের হাই কমিশনার নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিল।

জেনারেল এরশাদ যখন বন্দুকের জোরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা নিয়েছিলেন, তখন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন,“I am not unhappy.” এই বিষয়গুলো সবই একই সূত্রে বাধা।

বার্মার বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত মিলিটারি এট্যাঁ’চে ব্রিগেডিয়ার নুরুল ইসলাম শিশুকে ফিরিয়ে এনে তাকে জেনারেল বানানোর কথা হচ্ছে।৭ই নভেম্বর পালাতে গিয়ে পা ভেঙ্গে CMH-এ আশ্রয় নেয়া কর্নেল মইনুল হোসেনকেও জিয়া পদোন্নতি দেন যদিও শেখ কামালের মনোনীত পাত্রি ছিলেন তার স্ত্রী।

সমস্ত খবরই আমাদের কাছে পৌছে দেয়া হচ্ছিলো সেনা পরিষদের তরফ থেকে। বিদেশ থেকে জিয়া তার পছন্দের লোকদের দেশে ডেকে আনছেন কিন্তু আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের ফেরত আনার বিষয়ে কোনও উদ্যগই নেয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া বিপ্লবীদের তরফ থেকে দেয়া দাবিনামার বাস্তবায়নের বিষয়টিও ক্রমশ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন জেনারেল জিয়া এবং তাকে ঘিরে রাখা চাটুকার উপদেষ্টারা।

এর ফলে সেনা অসন্তোষ আবারো ধূমায়িত হয়ে উঠতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে ধূর্ত জিয়া বিপ্লবীদের এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সেনাকুঞ্জে। সমাবেশে সওয়াল-জবাব কালে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিপ্লবীদের কোনও প্রশ্নেরই সঠিক জবাব দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না জেনারেল জিয়ার পক্ষে।

বিপ্লবীদের মূল প্রশ্ন-

আগস্ট অভ্যুত্থানের নেতাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বিলম্বের কারণ কি? স্বাক্ষর করার পরও সৈনিকদের দাবিনামার বাস্তবায়নের কোন উদ্দগ নিচ্ছেন না কেন জেনারেল জিয়া? প্রবল চাপ ও প্রশ্নবাণে জর্জরিত অপদস্থ জিয়া এক সময়ে বলে উঠলেন

আমি তোমাদের সব দাবি কার্যকর করবো তবে সেটার জন্য তোমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। শীঘ্রই আমি আমার দূত পাঠাচ্ছি ব্যাংককে। দাবিনামাও বাস্তবায়িত হবে নিয়ম মাফিক। এসবের জন্য সময় প্রয়োজন। তোমরা যদি আমাকে বিশ্বাস না করো আর সময় দিতে না চাও তবে আমিও আর চীফ হিসাবে থাকতে চাই না বলেই নাটকীয় ভাবে নিজের কোমর থেকে বেল্ট খুলে টেবিলের উপর রেখে দিলেন জেনারেল জিয়া। এ ধরনের অপ্রত্যাশিত আচরণে স্তম্ভিত হয়ে গেলো উপস্থিত সবাই! বিপ্লবীদেরই মনোনীত চীফ জিয়া। তাই তাকে অবিশ্বাসের প্রশ্নই ওঠে না! রিসালদার সারোয়ারই নিজ আসন থেকে উঠে গিয়ে জেনারেল জিয়ার কোমরে বেল্ট পরিয়ে দিয়ে বললো

স্যার, আপনি আমাদের মনোনীত চীফ। সেক্ষেত্রে আপনি কি করে ভাবলেন আমরা আপনাকে অবিশ্বাস করছি! আমরা শুধু চাচ্ছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদেশে অবস্থানরত নেতাদের ফিরিয়ে এনে আপনার অবস্থান শক্ত করুন। এই সাথে, সৈনিকদের যুক্তিসঙ্গত দাবিগুলো মেনে নিয়ে আপনার উপর তাদের আস্থা দৃঢ় করুন। এ ভাবেই শেষ হয়েছিলো সেদিনের দরবার।

বিদেশে অবস্থান করেও আমাদের বুঝতে অসুবিধে হল না, সেনা পরিষদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নিজেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষস্থান দখল করার এক চতুর খেলা শুরু করেছেন আমাদেরই মধ্যমণি জেনারেল জিয়াউর রহমান। তার এই খেলায় কর্নেল তাহেরের পর সেনা পরিষদই তার প্রধান প্রতিপক্ষ। এর প্রমাণ পেতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না।

সেদিনের দরবারের পর জিয়াকে পরামর্শ দেয়া হল, ল্যান্সার এবং অ্যাকঅ্যাক রেজিমেন্টসহ লগ এরিয়ার ইউনিটগুলোকে ক্রমান্বয়ে ঢাকা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে ছলে বলে কৌশলে। কারণ, ঐ সমস্ত ইউনিটগুলোতেই রয়েছে সেনা পরিষদের শক্ত অবস্থান। এখনই যদি ২য় ফিল্ডকে সরানোর চেষ্টা করা হয় তবে পাশা উল্টে যেতে পারে। মূল পরামর্শদাতা জেনারেল মীর শওকত। তার সাথে একমত হন জেনারেল এরশাদ ও ব্রিগেডিয়ার মইনুল হোসেন, কর্নেল নাসিম, জেনারেল মচ্ছু সালাম প্রমুখ।

পরামর্শ অনুযায়ী অবিলম্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন জিয়া ল্যান্সার-এর একটি স্কোয়াড্রন সাভারে রেখে বাকি পুরো ইউনিট বগুড়াতে পাঠানো হবে। সিগন্যাল ইউনিটকে পাঠানো হবে কুমিল্লায়, আর অ্যাকঅ্যাক রেজিমেন্টকে পাঠানো হবে রংপুরে।

১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বেরের বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের তৎকালিন প্রধান ইউনিটগুলো যেখানে সেনা পরিষদের দৃঢ় অবস্থান ছিল সেগুলো হল-২য় ফিল্ড আর্টিলারি, বেঙ্গল ল্যান্সার, ১ম ইষ্টবেঙ্গল, ৩৮তম লাইট অ্যাকঅ্যাক রেজিমেন্ট, ২য় ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ান, সেন্ট্রাল অর্ডন্যান্স ডিপো, বেইস ওয়ার্কশপ, সিগন্যাল ব্যাটালিয়ান, সাপ্লাই ব্যাটালিয়ান, সিএমএইচ, আর্মি হেডকোয়ার্টার ব্যাটালিয়ান, এমপি ইউনিট, মেডিকেল কোর, ষ্টেশন হেডকোয়ার্টার, লগ এ্ররিয়ার অন্যান্য ইউনিটগুলো।

এর প্রায় সব কয়েটি ইউনিটই ছিল লগ কমান্ডারের অধীন। কর্নেল তাহেরের অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সেলগুলো নির্মূল করার পর সেনাপরিষদ ও বিপ্লবী সৈনিকদের বিরুদ্ধে তাদেরই প্রিয় চীফ অফ আর্মি স্টাফ জেনারেল জিয়াউর রহমানের চরিত্র এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানার জন্য পাঠকদের সুবিধার্থে জিয়ার কোর্সমেট এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু তদান্তিন লগ এরিয়া কমান্ডার কর্নেল হামিদের লেখা বই ‘তিনটি অভ্যুথান ও কিছু না বলা কথা’-র একটি অধ্যায় তুলে ধরা হল। ৭ই নভেম্বরের সিপাহি-জনতার সফল বিপ্লবের পর জিয়া আস্থাভাজন মনে করে ষ্টেশন কমান্ডারের পদ থেকে সরিয়ে কর্নেল হামিদকে লগ এরিয়া কমান্ডার পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কর্নেল হামিদ এই অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন