ব্রিগেড মেস-এ পৌঁছালাম

ব্রিগেড মেস-এর নির্ধারিত কামরায় পৌঁছে প্রথমেই যোগাযোগ করলাম বেনগাজীতে। সবকিছুই বিস্তারিত জানালাম সহবিপ্লবীদের। খবর পাওয়া গেছে রশিদ ইতিমধ্যেই ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে ঘুরে এসেছে। জিয়ার দরবারের প্রস্তাব আমি নাকচ করে দিয়েছি। জিয়ার কর্মকাণ্ডে সামরিক বাহিনীতে অসন্তোষ এবং উষ্মা থাকলেও এই মুহূর্তে জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তাকে হয়তো ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হবে, কিন্তু দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে নিয়ে ভারতীয় আগ্রাসনের মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। বর্তমান অবস্থা মারাত্মকভাবে ২-৩রা নভেম্বরের চেয়ে অনেক বেশি জটিল। সেই বিবেচনায় একমাত্র পথ রশিদ আর ফারুককে বুঝিয়ে নিরস্ত্র করা। এ ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব নয়। এখন তোমাদের মতামত জানাও, আমি কি করবো। পাশাই সবার তরফ থেকে বললো

স্যার, আপনি ঘটনাস্থলে রয়েছেন, সব কূল রক্ষা করে অবস্থা সামাল দেবার জন্য যাই ভাল বুঝবেন সেটাই করুন। আপনার বুদ্ধিমত্তার উপর আমাদের সবারই আস্থা আছে। কথা শেষ হল। মাহবুবও সংক্ষেপে সবার সাথে সালাম দোয়া এবং কুশল বিনিময় করলো। রশিদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পেলাম না। জানতে পারলাম সে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেছে। তাই, ফারুককে ফোন করলাম। আমি ফোন করেছি জেনে ফোন ধরলো ফারুক।

তুই এ ভাবে কাউকে কিছুই না জানিয়ে এসে কি করতে চলেছিস? জিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সেটা ঠিক, কিন্তু দেশের মাটিতে পা দেবার পর আমি যা জানতে পেরেছি তাতে কোনও সন্দেহ নেই আজকের পরিস্থিতি ২-৩রা নভেম্বর এর চেয়ে অনেক জটিল। যদি তুই শুনতে চাস তবে বলতে পারি একটু বিস্তারিতভাবে।

বল, আমি শুনবো কি বলার আছে তোর।

যাদের সাথেই আমার আলাপ হয়েছে দেশের বর্তমান অবস্থা এবং জিয়া সম্পর্কে তাদের সবার বক্তব্য প্রায় একই রকম। জিয়া আগস্ট বিপ্লবের নীতি-আদর্শ এবং বিপ্লবীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বিপ্লবীদের সাথে সব সম্পর্ক অস্বীকার করে সমঝোতার ভিত্তিতে ক্ষমতার রাজনীতি করতে চলেছেন। ভারতের সাথেও তিনি সমঝোতা করে নিয়েছেন তার রাজনীতির স্বার্থেই। একই লক্ষে তিনি ছেঁড়া গেঞ্জি, ভাঙ্গা স্যুটকেস আর কোদাল কাঁধে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে খালকাটা আর রাস্তা বানানোর কর্মসূচির মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করে নিজেকে একজন জনদরদী নেতা হিসাবে একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতেও সক্ষম হয়েছেন। অপর দিকে প্রায় হাজার তিনেক সেনা সদস্য এবং বেসামরিক বিপ্লবীদের সাজানো অভ্যুত্থানের নাটকের মাধ্যমে নির্মম ভাবে হত্যা করেছেন। জেলবন্দীও করেছেন অনেককেই সামরিক বাহিনী এবং দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার অজুহাতে। এতে সামরিক বাহিনী ক্ষোভ এবং প্রতিশোধ স্পৃহায় অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় জিয়া এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের ক্ষমতাচ্যুত করার কাজটি খুব একটা কঠিন হবে না। কিন্তু সেই সুযোগে ভারতীয় সরকার আওয়ামী-বাকশালীদের নিয়ে আর একটি প্রবাসী সরকার বানিয়ে ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যদি দেশে আগ্রাসন চালিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে তখন দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে সঙ্গে নিয়ে তাদের মোকাবেলা করা কি সম্ভব হবে? ভারতকে এই বিষয়ে পূর্ণ সমর্থন জানাবে সোভিয়েত বলয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের সমর্থন দেবার মতো কাউকে কি পাওয়া যাবে? খবর হল, জিয়া পশ্চিমা শক্তিগুলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছেও নিজের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করার চেষ্টায় অনেকটাই সফল হয়েছেন। আমাদের তো সেই রকম কোনও সুযোগই হয়নি এখন পর্যন্ত। এই বাস্তবতায় বলা চলে, ভারতের পক্ষে অতি সহজেই সম্ভব হবে আওয়ামী-বাকশালীদের পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। ফলে দেশটা পরিণত হবে একটি করদ রাজ্যে আর জাতি পরিণত হবে দাসে। এইবার আওয়ামী-বাকশালী সরকারের নিরাপত্তার জন্য ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে সুদৃঢ় ঘাটি গেড়ে বসবে এবং ক্রমান্বয়ে দেশের সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বিডিআর-এর বিলুপ্তি ঘটিয়ে সেগুলোকে পুনর্গঠিত করা হবে ভারতের সাহায্যে দলীয় ক্যাডারদের সমন্বয়ে নতুন আঙ্গিকে। এভাবেই ভারতীয় সুদূর প্রসারী নীলনকশা বাস্তবায়িত হবে। আমরা তো দেশ আর জাতীয় স্বার্থেই সেই সুযোগটা না দেবার জন্যই ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ সালে দেশত্যাগ করেছিলাম এবং খালেদ-চক্রকে ব্যাংকক থেকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। বর্তমানে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনও ভাবেই জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয় সামরিক সংঘর্ষের মাধ্যমে। জিয়ার মোকাবেলা করতে হবে রাজনৈতিক ভাবেই। আর একটি কথা, ধরা যাক আমরা জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করলাম, সেই ক্ষেত্রে আমরা বাধ্য হব আমাদের উপরের সব সিনিয়র অফিসারদের সামরিক বাহিনী থেকে বের করে দিতে। এ ধরনের পদক্ষেপে যে অবস্থার সৃষ্টি হবে সেই সুযোগটা কি ছাড়বে ভারত? অবশ্যই না। তাহলে জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করে লাভটা কি হবে সেটাও তোকে ভেবে দেখতে হবে। ফারুক নিশ্চুপ হয়ে শুনছিল আমার বক্তব্য। আমার বক্তব্য শেষে ফারুক বললো

All right then, আমি তোর বক্তব্য গুরুত্বের সাথেই শুনেছি, আমি ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিবো। Thanks, বলে ফোন রেখে দিলো ফারুক।

এরপর আমি জেনারেল জিয়াকে ফোন করে জানালাম, ফারুকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। অবিলম্বে ফারুকের বাবার সাথে যোগাযোগ করে তাকে বগুড়ায় পাঠাবার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিলাম। জেনারেল জিয়া আমার কথামতো ফারুকের বাবার সাথে যোগাযোগ করে তাকে অনুরোধ করেন বগুড়ায় গিয়ে ফারুককে বোঝানোর জন্য। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে তিনি রাজি হন এবং আর্মির একটি হেলিকপ্টারে করে ফারুকের ছোটবোন ইয়াসমিনকে সাথে নিয়ে ফারুককে বুঝিয়ে বগুড়া থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন। সন্ধির শর্ত হিসাবে ফারুক দাবি করেছিল, বহুদলীয় রাজনীতিতে তাদেরকে অংশগ্রহণের সুযোগ জিয়াকে দিতে হবে। তখন অবস্থার চাপে জিয়া তার সেই শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। এরপর রশিদ আর ফারুক দুইজনই ঢাকা ত্যাগ করেছিলো।

সংকট কেটে যাবার পরই আবার আমার ডাক পড়ল CMLA ’s Office এ। সময় মতো গিয়ে হাজির হলাম। ঘরে ঢুকতেই আগের মতই জিয়া চেয়ার থেকে উঠে এসে স্বাগত জানালেন। আলোচনার বিষয় আমাদের ভবিষ্যৎ।

তোমাকে কি করে ধন্যবাদ জানাবো ভেবে পাচ্ছি না।

আমি তেমন কিছুই করিনি, ফারুকই তার বুদ্ধি-বিবেচনায় তার সিদ্ধান্ত পাল্টে ছিল।

আমি সবই জানতে পেরেছি। আমি তার কথার কোনও জবাব না দিয়ে কফিতে মনোযোগ দিলাম। জিয়াও খাবারের প্লেটে কাঁটা চামচ নাড়াচাড়া করছিলেন আর ভাবছিলেন। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলা শুরু করলেন

ডালিম, তোমরা সবাই আমার কাছে প্রশংসার পাত্র, বিশেষ করে তোমাকে আমি স্নেহ এবং শ্রদ্ধা করি। অন্যদের সাথে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও তোমার সাথে আমার পরিচয় সেই কাকুলের দিনগুলো থেকেই। You all are undoubtedly selfless patriots and progressive minded revolutionaries. আমি অকপটে স্বীকার করছি বয়সের তুলনায় তোমরা সবাই রাজনৈতিকভাবে বেশি সচেতন। (বাংলা ভাষায় তেমন দক্ষতা না থাকায় জিয়া বাংলা ইংরেজি মিলিয়েই কথা বলতেন। এতে তাকে দোষ দেয়া চলে না, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের বগুড়ার গাবতলীতে পৈতৃকভিটা হলেও বাল্যকাল থেকে যুদ্ধের আগ পর্যন্ত প্রায় পুরোটা সময় তার কেটেছে পশ্চিম পাকিস্তানেই)। ৭ই নভেম্বরের পর এক চরম অস্থিতিশীল অবস্থায় আমাকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়। কৌশলে ১৫ই আগস্টের কথাটা উচ্চারণ করলেন না ধূর্ত জিয়া, এটাও বললেন না যে ১৫ই আগস্টের সাথে একটি যোগসূত্র রয়েছে ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের। তার জন্য আমি মনে করি কিছু সময়ের জন্য তোমাদের বাইরে রাখলে আমার সুবিধে হবে। সেই সময়টা লিবিয়ায় নিষ্কর্ম হয়ে বসে না থেকে দেশ ও জনস্বার্থে আমার প্রতিনিধি হয়ে যাতে তোমরা কাজ করে যেতে পারো তার জন্য আমি ঠিক করেছি তোমাদের সবাইকে বিদেশের ঐসব রাষ্ট্রে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে পাঠাবো যাদের সাহায্য-সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ভারতের মতো একটি রাষ্ট্রের হুমকির বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য। সে ধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কোনও পেশাদার আমলাদের দ্বারা গড়ে তোলা কখনোই সম্ভব না, কিন্তু সেটা তোমাদের দ্বারা সম্ভব বলেই আমার বিশ্বাস। অনেক আশা নিয়ে আমি এই প্রস্তাবটা করলাম। আমার এই প্রস্তাব তোমরা গ্রহণ করবে কিনা সেটা তোমাদের সিদ্ধান্ত। তবে আমার অনুরোধ, বিষয়টি নিয়ে একটু ভেবেচিন্তে তোমরা সিদ্ধান্ত নিয়ো। আমাকে নিরাশ করো না। তার বক্তব্য শেষে তিনি আমার দিকে একটি জবাবের প্রত্যাশায় উদগ্রীব হয়ে চাইলেন। তার বক্তব্য শুনে মনে করেছিলাম কোনও জবাব দেবো না, কারণ সেটা হবে ‘উলু বনে মুক্তা ছড়ানো’র মতোই। পরে ভাবলাম এই সুযোগে তাকে কতগুলো সত্য জানিয়ে যাই, এতে কোনও লাভ না হলেও ঐতিহাসিকদের বিবেচনার বিষয় হয়ে থাকবে আমার বক্তব্য।

স্যার, আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে কি হবে না সেটা আমি ফিরে যাবার পর সহযোদ্ধাদের সাথে আলাপের পরই আপনাকে জানিয়ে দেয়া হবে। এই বিষয় আর দীর্ঘ ব্যখ্যার প্রয়োজন নেই। যদি অনুমতি দেন তবে একজন পুরনো সাথী এবং সহযোদ্ধা হিসাবে কিছু কথা বলে যেতে চাই।

বলো, কি বলতে চাও?

৭ই নভেম্বর বিপ্লবের পর আপনাকে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুনরায় চীফের পদে অধিষ্ঠিত করেছিল আগস্ট বিপ্লবীরাই। সেনা পরিষদই ছিল ওই বিপ্লবের অগ্রণী এবং মূলশক্তি। কর্নেল তাহের ও তার অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ভূমিকা ছিল সহায়ক শক্তি হিসাবে গৌণ। এ সত্যটা আপনি ভালো করেই জানেন। সবকিছু জেনেই আপনি ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট হবার পরই সিদ্ধান্ত নেন, আগস্ট বিপ্লবের চেতনা আদর্শ এবং বিপ্লবীদের সাথে সব সম্পর্ক ছেদ করে ভিন্ন পথে অগ্রসর হওয়ার। আপনি জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন বিপ্লব এবং বিপ্লবীদের সাথে আপনার কখনোই কোনও সম্পর্ক ছিল না, বর্তমানেও নেই। এ ধরনের মিথ্যাচারের মাধ্যমে সাময়িকভাবে হয়তো সত্যকে চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু সত্য একদিন সত্য হিসাবেই ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা পাবে। এটাই সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষা। ‘বিপ্লব’ শব্দটার অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মানুষের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করার ইতিহাস সুপ্রাচীন। যদিও এই শব্দটির সহজ মানেটা হল আপোষহীন দ্রুত পরিবর্তন। মানব সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু এই অগ্রগতির ফসল পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঝুলিতে পরেনি। মুষ্টিমেয় কিছু লোক এবং পরিবার এর ফল ভোগ করে চলেছে জোরজুলুমের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ কিংবা নিও-উপনিবেশবাদের কালে তাদের সেই শোষণ প্রক্রিয়াকেই টিকিয়ে রাখার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকারের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আইন আদালত, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী সামরিক বাহিনী এবং এক অদ্ভুত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। ছল-চাতুরীর মাধ্যমে পেশীশক্তি এবং অর্থশক্তির বলে বলিয়ান আগ্রাসী শক্তিগুলো বিভিন্ন দেশে গড়ে তুলেছে তাদের তল্পিবাহক একটি মুৎসুদ্দি শ্রেণি। এই সমস্ত পোষা স্বার্থবাদী বাস্তুঘুঘুরা প্রয়োজন মতো কখনো গায়ে জড়াচ্ছে গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র কিংবা একনায়কতন্ত্রের লেবাস শুধুমাত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্যই। এতে সৃষ্টি হয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিজেদের এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের স্বার্থের সাথে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এবং জাতীয় স্বার্থের। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সবদেশেই ক্ষমতাসীন আর বিরোধীদলগুলোর মধ্যে চরিত্রগত ভাবে কোনও পার্থক্য নেই। কারণ, তাদের সবার শিকড় প্রোথিত ঐ কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর মধ্যেই। তারা বাহ্যিক ভাবে একে অপরের সাথে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বটে, তবে সেটা হয়ে থাকে সমঝোতার ভিত্তিতে। জনস্বার্থের বিরুদ্ধে তারা এক হয়ে যায়। বর্তমান কালে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে বিস্ফোরণ ঘটেছে তাতে এই শুভঙ্করের ফাঁকিটা পৃথিবীর প্রতিপ্রান্তের বঞ্চিত, শোষিত এবং নিপীড়িত জনগণ আজ কম-বেশি ধরতে সক্ষম হচ্ছেন তাতে তাদের সচেনতা বেড়ে চলেছে। এর ফলে, বর্তমানে বিশ্বজোড়া আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। তাদের ন্যায়সঙ্গত এই প্রতিবাদী প্রতিরোধ সংগ্রামকে বলা হচ্ছে ‘সন্ত্রাসবাদ’ ‘মৌলবাদ’ ইত্যাদি এবং প্রতিবাদী এবং প্রতিরোধকারীদের বলা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদী মৌলবাদী। কিন্তু এইসব অপপ্রচারের পরেও আজ অস্থিতিশীল হয়ে ধস নেমেছে বর্তমানের অসম শোষণমূলক বিশ্ব ব্যবস্থায়। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ ‘৭১ এ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিসংগ্রামে এক নতুন ন্যায়ভিত্তিক প্রকৃত স্বাধীনতার প্রত্যাশায়। সেই চেতনা আর স্বপ্নের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এবং চাণক্যদের সুদূরপ্রসারী নীলনকশার মাধ্যমে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করার ষড়যন্ত্রকে নস্যাত করার জন্যই যুদ্ধকালে আমরা গড়ে তুলেছিলাম একটি গোপন বৈপ্লবিক সংগঠন যার একজন সদস্য হয়েছিলেন আপনি শপথ নিয়ে স্বেচ্ছায়। আপনি হয়তো অনেক কিছুর মতোই এটাও ভুলে গেছেন, যখন আপনি ছিলেন পরিত্যাজ্য তখন আমি লোকচক্ষুর অন্তরালে আপনার কল্যাণীর নিবাসে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনার মাধ্যমে বুঝিয়েছি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে কি করে আমরা গোপন সংগঠন গড়ে তুলবো, কি করে ধাপে ধাপে আপনাকে সবার অজান্তে বৈপ্লবিক পন্থায় শীর্ষ জাতীয় নেতার স্থানে অভিষিক্ত করে ‘৭১-এর চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়িত করবো। আমাদের নীতিআদর্শ এবং রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেই আপনি ওয়াদা করেছিলেন আমাদের একজন হয়ে লড়ে যাবেন আজীবন। কিন্তু অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের দীর্ঘদিনের সংগ্রামে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পর্বতসম জগদ্দল পাথর সরিয়ে আমরা যখন বিজয়ের দ্বার উন্মোচন করতে সমর্থ হলাম তখনই সেই সোপান দিয়েই উল্টো পথে চলার সিদ্ধান্ত নিলেন আপনি। দেশী-বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদীদের সাথে সমঝোতার রাজনীতি করে জনগণের অধিকার অর্জন করা সম্ভব অতীতেও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। সময় মতো এই সত্য আপনি বুঝতে পারবেন। স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য আপনি আমাদের বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করছেন। কিন্তু সামরিক বাহিনীতে অস্থিতিশীলতার মূল কারণ সমূহ কিন্তু ৭ই নভেম্বরের পর আপনার নিজস্ব কর্মকাণ্ডগুলোই। বাস্তব সত্যটা আপনার কাছে এই মুহূর্তে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তবে অস্থিতিশীলতার যে অঙ্গার আপনি জ্বালিয়েছেন সেটা নিভে যাবার নয়। এর পরিণাম সম্পর্কে আপনার ধারণা কি সেটা আমার জানা নেই। তবে পরিণতিটা আপনার জন্য খুব একটা শুভ হবে বলে মনে হয় না। আপনি যাদের নিয়ে রাজনীতি করতে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই ক্ষমতালোলুপ। তাই সুধী সাবধান! সুবিধাবাদী সুযোগ সন্ধানীরা নিজস্ব স্বার্থের জন্য সব কিছুই করতে পারে। প্রয়োজনে পা চাটতে পারে আবার ঘাড়ও মটকাতে পারে। ছাত্রকাল থেকেই রাজনীতি করে এসেছি, তাই অভিজ্ঞতার আলোকেই কথাগুলো বলছি, কেতাবি কথা নয়। স্যার, ক্ষমতার শীর্ষে বসে মানুষের চরিত্র যাচাই করা সম্ভব নয়। চরিত্র যাচাইয়ের কষ্টি পাথর হচ্ছে দুঃসময় এবং সংগ্রামকাল। আপনি পরীক্ষিত সহযোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ভেবে নতুন করে যে সমস্ত আস্থাভাজন কিনে একত্রিত করছেন ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে সেটা নীতির রাজা সর্বোৎকৃষ্ট গণমুখী রাজনীতির জন্য নয়। আপনার এই সমঝোতার রাজনীতিতে রয়েছে সমূহ বিপদের আশংকা। আমি আমার বক্তব্য শেষ করবো আপনাকে আশ্বস্ত করে, আমরা যে যেখানেই থাকি না কেনো দেশ ও জাতির স্বার্থেই কাজ করে যাবো, কোনও ব্যক্তিস্বার্থে নয়। সময় নিয়ে ধৈর্যের সাথে আমার বক্তব্য শুনলেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কয়েকদিনের মধ্যেই দেশ ছেড়ে ফিরে যাবো বেনগাজীতে লন্ডন হয়ে। শিশু ভাইয়ের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকবে। তাই আমার গতিবিধি সম্পর্কে আপনি সবই জানতে পারবেন। চলি স্যার, আল্লাহ হাফেজ। বেরিয়ে এলাম তার অফিস থেকে।

ফারুকের দেশে আগমনের পর থেকে দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত সময়ের বেশির ভাগই কেটেছে ক্যান্টনমেন্টে। মালিবাগ পৌঁছে দেখি নিকট আত্মীয়-স্বজন সবাই আমার জন্য একরাশ উৎকন্ঠায় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। কারণ, ওই সময় বাসা থেকে কাপড়-চোপড় ড্রাইভার দিয়ে আনিয়ে নিয়ে সংক্ষেপে মহুয়াকে বলতাম আমি নিরাপদেই আছি চিন্তার কারণ নেই। তারা সবাই জানতে চায় কর্নেল ফারুকের আসার পর পর্দার অন্তরালে কি ঘটেছে! আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে! জটলার মধ্যে মহুয়াই বললো

স্যারকে একটু ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতে দাও, তারপর সব শোনা যাবে।

ভাইয়া, তুমি এক্ষুনি লন্ডনে নিম্মির সাথে কথা বলো। বেচারি ভীষণ চিন্তিত অবস্থায় আছে।

হ্যাঁ, সেটাই করা উচিৎ। তুই ফোন মিলিয়ে আমাকে দে। মহুয়া ফোনে নিম্মির সাথে যোগাযোগ করে আমাকে রিসিভার দিলো। ফোনে নিম্মি প্রথম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বললো

তুমি কোথায় কি অবস্থায় আছ জানার জন্য যখনই ফোন করেছি, মহুয়া আর কেয়া বলেছে তুমি ক্যান্টনমেন্টে খুবই ব্যস্ত, তবে নিরাপদেই আছ। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে আশ্বস্ত করে বললাম নিঃস্বার্থভাবে বৃহত্তর কোনও দায়িত্ব পালন করতে গেলে আল্লাহ্ই সহায় হন। এর প্রমাণ তো ২-৩রা নভেম্বর রাতেই তুমি পেয়েছো। রাত ১টায় বঙ্গভবনে তোমাকে বলেছিলাম, তুমি কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাও, আমি নূরকে সাথে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছি খালেদ ভাইয়ের সাথে আলোচনা করতে। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। আর তা না হলে আল্লাহ হাফেজ। তুমি দোয়া পড়ে আমাকে বলেছিলে, “তোমাকে আল্লাহ্র হাতে সোপর্দ করলাম তিনিই তোমাকে রক্ষা করবেন।’’ তোমার দোয়ায় আল্লাহর রহমতে ৩রা নভেম্বর অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশকে এক মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে তোমার কাছেই ফিরে এসেছিলাম। লন্ডনে পৌঁছেই আমি কিন্তু আঁচ করতে পেরেছিলাম এমন একটা কিছু ঘটতে পারে। তাই জোর করা সত্ত্বেও তোমাকে ঢাকায় নিয়ে আসিনি। এসব এসে বলবো। জান, তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে তুমি পাশে না থাকলেও আমি জানতাম তোমার দোয়া রয়েছে। তাইতো ২-৩রা নভেম্বরের চেয়ে জটিল অবস্থার মোকাবেলা করতে পেরেছি। দু’চার দিনের মধ্যেই তোমার কাছে ফিরে আসছি ইন শাহ আল্লাহ। অতএব চিন্তার কোনও কারণ নেই। অন্য সবার সাথে এরপর সালাম এবং কুশল বিনিময় করে ফোন রেখে দিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম গোসল করার জন্য। যেতে যেতে মাহবুবকে বললাম, দু’একদিনের মধ্যে আমার জন্য একটা সিট কনফার্ম করার জন্য। ইতিমধ্যে মহুয়া আর কেয়া দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে টেবিলে সাজিয়ে দিয়েছে। সবাই মিলে খাবার পাট চুকালাম। মহুয়ার তত্ত্বাবধানে আমার প্রিয় ব্যঞ্জনে ভরা ছিল টেবিল। মহুয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, কম কথার মানুষ। কিন্তু সব ব্যাপারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে সবকিছু তদারকি করে। কেয়া কিছুটা চঞ্চল আর মুখরা। খাওয়ার পর যাবার আগে মাহবুব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো

তোমরা স্যারকে একটু রেস্ট নেয়ার জন্য বাধ্য করার চেষ্টা কর। He has gone through extremely strenuous time all these days. সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো মাহবুব।

সবাই মেঝেতে শুয়ে বসে গেঁজাচ্ছিলাম। হঠাৎ অতি আপনজন বন্ধুবর সাচৌ (বিচিত্রার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) এসে উপস্থিত।  কোথায় ডালিম, আওয়াজ দিয়ে ঘরে ঢুকে আমাকে দেখেই বললো

এক্ষুনি তোকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে। তুই বাসায় ফিরেছিস খবরটা পেয়েই ছুটে এসেছি। উসকো খুসকো চুল, চোখে মোটা লেন্সের চশমা, শুকনো মুখ। বললাম

কোথায়?

কাপড় বদলে নে জলদি।

যাচ্ছি, বলে নিজের ঘরে গেলাম কাপড় বদলাতে।

বোঝাই যাচ্ছে আপনার দুপুরের খাওয়া হয়নি, আসুন একটু খেয়ে নিন।

ঠিক ধরেছিস। চল, বলে মহুয়ার সাথে সাচো খাবারের টেবিলে গিয়ে বসলো। ওর খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই আমি রেডি হয়ে ওর কাছে এসে বললাম

তলবটা বেশ জরুরী মনে হচ্ছে?

গাড়ীতেই আলাপ হবে। খাবারের সময় কথা বলা সুন্নতের খেলাপ বলেই গোগ্রাসে খাওয়া শেষ করে কেয়ার কাছ থেকে একটা পান মুখে পুরে সিগারেট ধরিয়ে সবাইকে বললো

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসবো। আমার গাড়ীতেই যেতে হবে।

হুকুম মতো সাচোর গাড়ীতে উঠে বসলাম। সাচো গাড়ী চালাচ্ছিলো বেশ দ্রুতগতিতে। বুঝতে পারছিলাম কেউ কোথাও অপেক্ষা করছে।

কিরে, শারলক হোমসের এর মতো কোথায় নিয়ে চলেছিস বলতো?

জেনারেল মঞ্জুর তোর জন্য অপেক্ষা করছেন।

আশ্চর্য! কেনো?

পাকিস্তান আর্মির চৌকস অফিসার ‘গ্যুডেরিয়ান’ নামে খ্যাত জেনারেল মঞ্জুর তার ভারিক্কি ভাব বজায় রেখে জুনিয়র অফিসারদের সাথে তেমন একটা মিশতেন না। তার স্ত্রীতো তার চেয়েও এককাঠি সরস ছিল এই বিষয়ে। যুদ্ধকালে আমাদের অনেক পরে মেজর জিয়াউদ্দিন আর মেজর তাহেরকে সাথে নিয়ে শিয়ালকোটের ব্রিগেড মেজর সপরিবারে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। কোয়েটা থেকে আমরা মেজর তাহেরকে সাথে নিয়েই পালানোর পরিকল্পনা করেছিলাম, কিন্তু হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে তাকে এ্যাবোটাবাদ বদলি করে দেয়ায় তিনি আমাদের সাথে পালাতে পারেননি। এ সম্পর্কে ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ তে বিশদভাবে লেখা রয়েছে। পরে যখন কর্নেল আবু ওসমানকে দুর্নীতির জন্য সেক্টর কমান্ডারের পদ থেকে সরিয়ে মেজর মঞ্জুরকে ৮নং সেক্টরের কমান্ডার বানানো হয়েছিলো তখন আমিও ঐ সেক্টরের গেরিলা এডভাইজার ছিলাম, কিন্তু তার সাথে তেমন একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেনি। তিনি নিজেই যখন সবার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে ভালবাসতেন তখন আমরাও গায়ে পড়ে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করিনি। তিনি বরাবরই ক্যারিয়ার সম্পর্কে খুবই সচেতন থাকতেন। স্বাধীনতার পর থেকে ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত সেনাবাহিনী এবং সরকারের মধ্যে যা কিছুই ঘটেছে তার থেকে তিনি সযত্নে নিজেকে সর্বদা সরিয়েই রেখেছেন। আস্থাভাজন হিসাবে স্বাধীনতার পর পরই তাকে ভারতে পাঠায় মুজিব সরকার মিলিটারি এট্যা’চে করে। এরপরও আমি তাকে ১৫ই আগস্টের পর ভারত থেকে ডাকিয়ে এনে বলেছিলাম

স্যার, এখানে আপনার প্রয়োজন। তাই দিল্লী থেকে আপনাকে ফিরিয়ে আনতে চাই। তিনি জবাবে তেমন কোন উৎসাহ দেখাননি। তার প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম! পট পরিবর্তনের পর তোরা সবাইতো ডাকের অপেক্ষা না করে ছুটে এসেছিলি বিপ্লবকে সমর্থন করে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে পুনর্গঠিত করার কাজে এবং বিভিন্ন দেশপ্রেমিক এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল-গ্রুপ এর নেতা-নেত্রীদের সাথে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে আলোচনার জন্য যোগাযোগের ব্যাপারে তোর অবদান কম ছিল না। ৭ই নভেম্বরের পর ভারত থেকে ফিরে জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে জিয়ার বিশেষ আস্থাভাজন CGS হঠাৎ আমাকে ডেকে পাঠালেন কেনো, কি প্রয়োজনে সেটাই ভাবছি!

সেটা আমারও জানা নেই তাই আমিও ভাবছি, গেলেই বোঝা যাবে। আমরা বনানীর একটা বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছালাম। কার বাড়ি সেটা আমি জানতাম না।

‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে অনেকেই অনেক কথা বলার চেষ্টা করে চলেছেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এদের বেশীর ভাগ দিগগজ এবং বোদ্ধারা কিন্তু নিজেরা তেমনভাবে যুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। তাই তাদের শোনা কথা এবং কল্পকথায় স্বচ্ছতার যথেষ্ট বৈপরীত্য ধরা পড়ে। বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগই সেই সময়ের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না বলেই এই সব অপপ্রচারে স্বাভাবিকভাবেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। এর জন্য দায়ী মুক্তিযোদ্ধারাই। বেশীরভাগ কমান্ডাররা যেকোনো সীমাবদ্ধতার কারণেই হোক মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যোদ্ধাদের বৃহদাংশের সার্বিক মনোভাব প্রত্যাশা, ভবিষ্যতে কি ধরনের স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের স্বপ্ন এবং কাম্য এ সম্পর্কে তেমন কোনও দলিল রেখে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন। যারাই লিখেছেন তারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার বিবরণ সম্পর্কেই লিখেছেন যেখানে তারা ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধের ঘটনাগুলো লিখে রাখাটা অবশ্যই প্রশংসনীয়, তবে তার চেয়েও বেশী তাদের লেখা উচিৎ ছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আপামর জনগণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-চাওয়া-পাওয়ার প্রত্যাশা এবং স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ অঙ্গীকার। যাকে বলা চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং Guerrilla Advisor to the Sector Commanders হিসেবে রণাঙ্গনের প্রতিপ্রান্তে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী এবং পেশা থেকে আগত আবাল বৃদ্ধ বণিতা, ইয়ুথ এবং শরণার্থী ক্যাম্পের অভিবাসী এবং সাধারণ জনগণের সাথে মিশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণা কি ছিল সেটা পাঠকদের কাছে বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে শুধুমাত্র ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করে একটি রাষ্ট্র, পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সবারই প্রত্যাশা ছিল, রক্তের বদলে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর নতুন যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হবে, সেটা গড়ে তুলতে হবে নতুন আঙ্গিকে। সেখানে থাকবে না মুষ্টিমেয় কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের আধিপত্য। তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলয়, প্রশাসন, আইন-আদালত এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তর থেকে সমূলে উপড়ে ফেলে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি ও স্ব-নির্ভর, প্রগতিশীল, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়িত বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি সুষম আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংগ্রামের মাধ্যমেই সৃষ্টি হবে ঐক্যবদ্ধ জনশক্তির। অগ্রণীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন পরীক্ষিত জনদরদী, নির্লোভ, আত্মত্যাগী, সাহসী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা। ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তাদের হতে হবে আপোষহীন। বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ছাড়া এই ধরনের বাংলাদেশ গড়ে তোলা কখনোই সম্ভব হবে না। বিগত কালের ঘুণে ধরা ক্ষয়িষ্ণু রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক পরিসরে আনতে হবে আমূল মৌলিক পরিবর্তন। তবেই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার। এই ধরনের একটি রাষ্ট্র এবং সমাজ গঠন তখনই সম্ভব হবে যখন দেশবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং তাদের সৃজনশীল কর্মশক্তি এবং দক্ষতাকে কাজে লাগানোর পূর্ণসুযোগ ও সম-অধিকার নিশ্চিত করা হবে। প্রগতির পথে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে নতুন আঙ্গিকে পুনর্গঠনের আর কোনও বিকল্প পথ নেই। এটাই ছিল ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বপ্ন। স্বল্পকথায় জাতি চেয়েছিল এমন এক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে যেখানে তারা উপভোগ করবে আর্থ-সামাজিক পরিসরে সম-মর্যাদা, আইনের শাসন, জান ও মালের নিরাপত্তা, আদালত, প্রশাসন, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ থেকে নিরপেক্ষতা। সুখ ও শান্তির দেশ, যেখানে সর্বক্ষেত্রে শিকড় গাড়বে গণতান্ত্রিক এবং স্বকীয় মূল্যবোধ, সহনশীলতা, সহমর্মিতার ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদী চেতনায় দেশকে প্রগতির পথে সমৃদ্ধশালী করে গড়ার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের অঙ্গীকার।

কিন্তু এই চেতনা ও স্বপ্ন ছিল ভারতের স্বার্থবিরোধী। তাই তারা তাদের প্রসূত প্রবাসী সরকারের যোগসাজসে এই চেতনা এবং স্বপ্নের পরিপন্থী এক সুদূরপ্রসারী নীলনকশা প্রণয়ন করে বাংলাদেশকে ভারত নির্ভর একটি করদ রাজ্যে পরিণত করার লক্ষে। সেই পরিকল্পনার বিরোধিতার প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধকালীন সময়েই রাজনৈতিকভাবে সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের আড়ালেই গড়ে তোলায় ব্রতী হয়েছিলেন একটি গোপন সংগঠন। স্বাধীনতার পর তাদের নিয়েই গড়ে তোলা বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে সেই গোপন সংগঠনের নামকরণ করা হয় সেনা পরিষদ। যেকোনো জাতিকে আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হতে হলে তাদের অবশ্যই জানতে হবে নিজেদের ঐতিহ্য, সঠিক বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস, জানতে হবে তাদের সম্পদ, সম্ভাবনা এবং জাতীয় অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো সম্পর্কে এবং সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে শত্রু-মিত্র কারা। বিশেষ করে, দেশের সামরিক বাহিনীরও থাকতে হবে এই সমস্ত বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা। কারণ, সামরিক বাহিনী হচ্ছে যেকোনো দেশ এবং জাতির মেরুদণ্ড। ইতিহাস বিকৃতির জঘন্য প্রতিযোগিতায় একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু তথ্য তুলে ধরছি পাঠকদের অবগতি জন্য।