কিছু বিভ্রান্তি এবং অপপ্রচারের জবাব

বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ই নভেম্বর এর সিপাহী-জনতার মহান বিপ্লব দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল নিদর্শন বিধায় যথাযথ মর্যাদায় স্মরণীয়। এ বিষয়ে আমার লেখা ‘জাতীয় বিপ্লব এবং সংহতি দিবস ১৯৭৫ এবং অব্যাহতি আইনসমূহ’ তে ঘটনাসমূহের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছি। তার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই।

কিন্তু ঐদিনের সংঘটিত ঘটনাবলি নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হচ্ছে তার ব্যাখ্যা দেয়া অতি আবশ্যক যাতে করে পাঠকরা সত্য জানতে পারেন।

৭ই নভেম্বরের ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।

‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রত্যাশায় অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে এককভাবে ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় আওয়ামী-বাকশালী একদলীয় স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে জাতির শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, আর্থিকভাবে দেশকে তলা বিহীন ঝুড়িতে পরিণত করা, ২৫ বছরের গোলামির চুক্তি, শুধুমাত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য একদলীয় স্বৈরচারী বাকশালি শাসন প্রবর্তন করে জাতির মানবিক, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং বাক-স্বাধীনতা হরণ করে বাংলাদেশকে ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করার পাঁয়তারার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের লক্ষেই সেনা পরিষদের নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী ঘটিয়েছিলো ১৫ই আগস্টের সফল সামরিক অভ্যুথান। ১৫ই আগস্টের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান, ২-৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ-চক্রের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতা এবং ৭ই নভেম্বর এর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের ঘটনাগুলো একই সূত্রে বাঁধা।

একটি বিশেষ মহলের বক্তব্য হল ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত হন। বলা হয়, দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাও নাকি জিয়াউর রহমান। আরও বলা হয়, ১৯৭১ সালের চট্টগ্রামের সেনাবিদ্রোহের সিদ্ধান্তের সব কৃতিত্বও নাকি জেনারেল জিয়ার একার। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬-২৭শে মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববাসীর সমর্থন চাওয়ার সিদ্ধান্তটিও ছিল জেনারেল জিয়ার একান্ত সিদ্ধান্ত। এসব বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কিছু তথ্য নিচে বর্ণিত হল।

পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানে সার্বিক সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার পর পরিকল্পনার অংশ হিসাবে চট্টগ্রাম থেকে সিনিয়রমোস্ট বাঙ্গালী অফিসার ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও তার একান্ত সচিব তদানিন্তন ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীকে ঢাকায় ডেকে পাঠায় এবং তাদের সেখানে বন্দী করে রাখা হয়। পাক বাহিনীর মূল টার্গেট ছিল ঢাকার পিলখানার বিডিআর হেডকোয়ার্টার, শান্তিনগরে অবস্থিত পুলিশ লাইন, রাজশাহীর সারদার পুলিশ একাডেমী, চট্টগ্রামের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার।

সেনা অভিযানের কিছুদিন আগেই পাক আর্মি পিলখানার বিডিআর সিগন্যাল সেন্টারটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। দেশের রেডিও এবং টিভি কেন্দ্রগুলোও কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নেয়া হয়েছিল অনেক আগেই।

চট্টগ্রামে ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন পাঞ্জাবী কর্নেল জানজুয়া। মেজর জিয়া ছিলেন সেকেন্ড ইন কমান্ড। অন্যান্য অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন ভুঁইয়া, ক্যাপ্টেন মহসিন, লেফটেন্যান্ট অলি, লেফটেন্যান্ট শমশের মুবিন চৌধুরী প্রমুখ। কর্নেল চৌধুরী ছিলেন ইবিআরসি এর কমানড্যান্ট। ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম তখন চট্টগ্রামের বিডিআর এর এডজুটেন্ট। ২৫শে মার্চ কালরাতে ঢাকায় বিডিআর হেডকোয়ার্টারে খান সেনাদের আচমকা আক্রমণের খবর পেয়েই ক্যাপ্টেন রফিক তার অধীনস্থ সব বিওপিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সবাইকে নিরস্ত্র করে বন্দী করে বিওপিগুলো বাঙ্গালীদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবার আদেশ দিয়ে যোগাযোগ করেন ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের সাথে। ৮ম ইস্টবেঙ্গল তখন ষোলশহর এলাকায় ডেপ্লয়েড ছিল। শহরের আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব ছিল তাদেরই।

সেই সময় মেজর জিয়া কর্নেল জানজুয়ার হুকুমে যাচ্ছিলেন বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজ এম ভি সোয়াত থেকে গোলাবারুদ নামানোর কাজ তদারক করার জন্য। পথে অজস্র লোকের ভিড় আর ব্যারিকেড সরিয়ে অগ্রসর হতে হচ্ছিলো তাকে।

ঠিক সেই সময়, মধ্যরাতে অপারেশন শুরু হয় ক্যান্টনমেন্টে ইস্টবেঙ্গল সেন্টারে। আচমকা হামলায় কর্নেল চৌধুরীসহ শত শত প্রশিক্ষণরত বাঙ্গালী রিক্রুট সেনাকে নৃশংস ভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় মেরে ফেলে শহীদ করা হয়। সেই অবস্থায়, ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে সমবেত হতভম্ব অফিসার ও সৈনিকরা বুঝতে পারলেন মেজর জিয়াকে মেরে ফেলার জন্যই তাকে পতেঙ্গা পাঠানো হয়েছে প্ল্যান করেই। কালবিলম্ব না করে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে পাঠানো হয় মেজর জিয়াকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কারণ ওয়্যারলেসে মেজর জিয়ার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছিলো না। তার সাথের অপারেটর এবং দেহরক্ষীদের সবাই ছিল অবাঙ্গালী। সেটাই সবার জন্য ছিল মূল আশংকার কারণ।

ক্ষিপ্রগতিতে জীপ চালিয়ে আগ্রাবাদের কাছে মেজর জিয়াকে ধরতে সক্ষম হন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। ক্যান্টনমেন্টের ঘটনাবলির সব কিছু জানার পর জিয়া এবং খালিকুজ্জামান সাথের খানসেনাদের সকলকে মেরে ফিরে আসেন ৮ম ইস্টবেঙ্গল এর হেডকোয়ার্টার ষোলশহরে।

সেখানে পৌছে ক্যাপ্টেন রফিকের বিদ্রোহ এবং ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে আচমকা হত্যাযজ্ঞের লোমহর্ষক বিস্তারিত বিবরণ জানতে পারেন মেজর জিয়া। সবার সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় ৮ম ইস্টবেঙ্গল বিদ্রোহ করবে। সিদ্ধান্তের পর মেজর জিয়া এবং অফিসারদের একটি দল কর্নেল জানজুয়ার বাসায় গিয়ে ৮ম ইস্টবেঙ্গল বিদ্রোহ করেছে জানানোর পর তাকে এবং পাহারারত সব অবাঙ্গালী সেনাদের কাবু করে তাদের মেরে ফেলেন। এরপর, সর্বসম্মতিক্রমে মেজর জিয়া ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

এরপরই সারা ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহের আগুন। শুরু হয় পশ্চিমা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধকারী সেনা সদস্যদের সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্য ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে কালুরঘাট সেতুর অপর প্রান্তে পজিশন নেবার। সম্মুখ যুদ্ধের পরিবর্তে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্যই এই কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কালুরঘাটে অবস্থিত বুস্টার স্টেশনের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীকে জনযুদ্ধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাতে হবে। বিশ্ববাসীকে আবেদন জানাতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা প্রদানে এগিয়ে আসার জন্য। আরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সিনিয়রমোস্ট অফিসার হিসাবে মেজর জিয়া নিজেই অস্থায়ী সুরকারের রাষ্ট্রপতি হিসাবে সেই ঘোষণা দেবেন। কালুরঘাটে ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী কক্সবাজার থেকে তার বিডিআর কন্টিনজেন্টের সৈনিকদের নিয়ে বিদ্রোহ করে মেজর জিয়ার বাহিনীর সাথে যোগদান করেন।

২৬-২৭ মার্চের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা কালুরঘাটের বুস্টার ট্রান্সমিটার থেকে তরুণ ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ আবদুস শাকের ও বেতার কর্মী বেলাল মোহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের একান্ত প্রচেষ্টাতেই প্রচার করা সম্ভব হয়েছিলো। পরে যেকোনো কারণেই হউক জিয়ার ভাষণে পরিবর্তন এনে বলা হয়েছিলো শেখ মুজিবের নির্দেশেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।

এই ঘোষণার ফলশ্রুতিতে দেশের সর্বত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার এবং মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদের কেন্দ্র করে। স্থানীয়ভাবে জেলা ও মহকুমা প্রশাসকদের অনেকেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে।

নুরুল কাদের চৌধুরী, তৌফিক এলাহি চৌধুরী, আকবর আলি খান, কামাল সিদ্দিকি, মাহবুবুল আলম চাষি, আসাদুজ্জামান, তৌফিক ইমাম, খসরুজ্জামান, মামুনুর রশিদ, অলিউল ইসলাম, সারদা পুলিশ একাডেমির প্রধান আব্দুল খালেক, পিএসপি অফিসার মাহবুব এদের অন্যতম। এরা সবাই ছিলেন পাকিস্তান আমলের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চৌকস সিএসপি এবং পিএসপি অফিসার।

মেজর জিয়ার কালুরঘাট থেকে দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা তার জন্য কাল হয়ে ওঠে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামীলীগ সরকার এবং ভারতের শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল ছিলেন জেনারেল জিয়া। তার স্বাধীনতার ঘোষণাকে আজঅব্দি মেনে না নিয়ে অস্বীকার করে চলেছে, মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে জেনারেল জিয়ার নাম দেশের সর্বক্ষেত্র থেকে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে।

এই কারণেই যুদ্ধকালীন সময় থেকেই প্রবাসী ও ভারত সরকার জিয়াকে সন্দেহের চোখে দেখেছে উচ্চাভিলাষী এক সেনা অফিসার হিসাবে। সেই কারণেই হঠাৎ করে যুদ্ধের প্রারম্ভেই তাকে ১নং সেক্টর কমান্ডারের পদ থেকে সরিয়ে থিয়েটার রোডের হেডকোয়ার্টারে নিযুক্তি দেয়া হয় স্টাফ অফিসার হিসাবে। পরে যখন শফিউল্লাহ এবং খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ‘এস’ ফোর্স এবং ‘কে’ ফোর্স নামে দু’টি নিয়মিত ব্রিগেড প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তখন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাদের চাপের মুখে ‘জেড’ ফোর্স নামে তৃতীয় আরেকটি ব্রিগেড বানিয়ে জিয়াকে তার অধিনায়ক বানাতে বাধ্য হয় মুজিবনগর প্রবাসী ও তাদের মুরুব্বি ভারত সরকার।

দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারাই স্বাধীনতার পর সেনা সদস্য হিসাবে গঠন করেছিলেন গোপন সংগঠন সেনা পরিষদ, সামরিক বাহিনী গঠন প্রক্রিয়ায় যদিও এর সূতিকাগার ছিল ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। জেনারেল জিয়াকে নিয়েই ধাপে ধাপে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নিখাদ গণমুখী জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক রাজনীতির উন্মেষ ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য দেশব্যাপী সাংগঠনিক তৎপরতা এগিয়ে নিয়ে চলেছিল সেনা পরিষদ। জেনারেল জিয়ার সাথে সেনা পরিষদের সম্পর্কের বিষয়টি কৌশলগত কারণে সুচিন্তিতভাবে গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল শুরু থেকেই।

স্বাধীনতার পর কর্নেল পদে জিয়াকে পদোন্নতি দিয়ে মুজিব সরকার হঠাৎ করে যখন তাকে বার্মায় (মিয়ানমার), পূর্ব জার্মানি অথবা বেলজিয়ামে মিলিটারি এট্যাঁ’চে করে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেয়ার চক্রান্তমূলক সিদ্ধান্ত নেয় তখন সেনা পরিষদই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সেনাবাহিনীতে এই অন্যায়ের প্রতিবাদে উত্তেজনা সৃষ্টি করে শেখ মুজিবের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলো। প্রবল চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব বাধ্য হয়েছিলেন সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে। এরপর যখন বয়োজ্যেষ্ঠতার তালিকায় জিয়াকে ডিঙ্গিয়ে শফিউল্লাহকে মেজর জেনারেল হিসাবে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সেনাপ্রধান বানায় শেখ মুজিব সরকার তখনও প্রতিবাদী বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনেও অগ্রণী ভূমিকায় ছিল সেনা পরিষদ। সেনা বিদ্রোহের ভয়ে আতঙ্কিত শেখ মুজিবকে বাধ্য করা হয়েছিলো জিয়াকে শফিউল্লাহর সমপর্যায়ে পদোন্নতি দিয়ে ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ নামে একটি বিশেষ পদ সৃষ্টি করে সেখানে জিয়াকে নিয়োগ প্রদান করতে। এ ক্ষেত্রেও মূল ভূমিকায় ছিল সেনা পরিষদ। এ ভাবেই জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে বের করে দেয়ার প্রতিটি সরকারী প্রচেষ্টাকেই ব্যর্থ করে দিয়েছিলো সেনা পরিষদ।

এই পটভূমিকাতেই ১৫ই আগস্ট সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুথানের পর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শফিউল্লাহকে অপসারণ এবং সেনা পরিষদের প্রতিনিধি হিসাবে জেনারেল জিয়াকে সেনা প্রধানের পদে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ। একই কারণে এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াব নিয়োগ প্রাপ্ত হন বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে। রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খানকে রাখা হয় নৌ বাহিনীর চীফ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে রিয়ার এডমিরাল এম এ খানকে ন্যাভাল চীফ পদে নিযুক্তি দেয়া হয় এম এইচ খানকে সরিয়ে।

২-৩ নভেম্বর খালেদের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতার প্রারম্ভে সেনা প্রধান জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী করা হয়। পরে তাকে বাধ্য করা হয় পদত্যাগ করতে। খালেদ নিজেই মেজর জেনারেল বনে আর্মি চীফ পদ দখল করে নেন। কিন্তু মাত্র ৩ দিনের ব্যবধানে ৭ই নভেম্বর সেনা পরিষদ ও কর্নেল তাহেরের নিয়ন্ত্রণাধীন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে সংঘটিত সফল বিপ্লবের পরিণতিতে জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং তার সহযোগী কর্নেল নাজমুল হুদা, মেজর হায়দার ও খালেদের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং ভায়রা কে কিউ হুদা পলায়ন কালে ক্ষুব্ধ বিপ্লবী সেনাদের হাতে নিহত হন।

বঙ্গভবন থেকে দেয়াল টপকে পালাবার সময় কর্নেল শাফায়াত জামিলের পা ভেঙ্গে গেলে পলায়ন কালে নারায়ণগঞ্জের কাছে ক্ষুব্ধ জনতা তাকে স্থানীয় প্রশাসকের হাতে সমর্পণ করে। মেজর হাফিজকেও বিক্ষুব্ধ জনগণের হাতে বন্দী হতে হয়।

অন্যদিকে সফল বিপ্লবের পরমুহূর্তেই ২য় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে আর্টিলারি, ল্যান্সার, সিগন্যাল, ইঞ্জিনিয়ার, ইএমই, সাপ্লাই, অর্ডিন্যান্স, মেডিকেল কোরের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি ট্যাংকের শোভাযাত্রা বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী স্লোগান দিতে দিতে সেনা পরিষদের নিযুক্ত আর্মি চীফ জেনারেল জিয়াকে কাঁধে তুলে ২ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসে।

যখন বিপ্লবীরা জিয়াকে মুক্ত করে নিয়ে আসছিল তখন জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া সৈনিকদের হাতে-পায়ে ধরে শঙ্কিত হয়ে তাকে না নিয়ে যাবার জন্য কাকুতি-মিনতি করছিলেন আর জিয়া অনুরোধ করছিলেন শুধু তার পেনশনটা নিশ্চিত করে দেবার জন্য। তখন মেজর মহিউদ্দিন অভয় দিয়ে খালেদাকে বলেছিলো, ভাবী আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? স্যার আমাদের চীফ, সেই পদেই পুনর্বহালের জন্য আমরা তাকে নিয়ে যাচ্ছি। এভাবেই আশ্বস্ত করা হয়েছিল দু’জনকেই। জিয়ার নিরাপত্তার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য করণীয় সম্পর্কে সার্বক্ষণিক নির্দেশ দিচ্ছিলেন ব্যাংকক থেকে দেশত্যাগী সেনা পরিষদের শীর্ষনেতারা। এই বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ থাকবে লেখার ধারাবাহিকতায়।

গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা, শৃঙ্খলাবোধ, দায়িত্বজ্ঞান, গোপনীয়তা, যোগাযোগের বিষয়ে কঠিন কম্পার্টমেন্টেশন নীতিসমূহ কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের সেনা পরিষদের নেতাকর্মীদের সবাইকে আন্তরিকতার সাথে কঠোরভাবে মেনে চলতে হতো। সেনা পরিষদের মূল আদর্শিক নীতিসমূহ ছিলঃ- জাতীয়তাবাদ, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে নিখাদ গণতন্ত্র, সুষম সমাজ ব্যবস্থা, মানবিক অধিকার, নিরপেক্ষ আইনের শাসন কায়েম করে নিজস্ব সত্তা বিকাশের মাধ্যমে স্বনির্ভর, প্রগতিশীল, সুখী-সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ে তোলা।

আমাদের সংগঠনের এই নীতি-আদর্শ শুধু মাত্র মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের কাছেই নয় দেশের সংখাগরিষ্ঠ জনগণের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো।

জেনারেল জিয়ার নিরাপত্তার স্বার্থেই সেনা পরিষদের গঠন প্রক্রিয়া, কার্যক্রম, জনপ্রিয়তা, বিভিন্ন সমমনা রাজনৈতিক দল, ব্যক্তিত্ব, পেশাজীবী ও শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়, সুশীল সমাজ ও ব্যবসায়ী মহলের বিভিন্ন নেতা-নেত্রীর সাথে সেনা পরিষদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের যোগাযোগের বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই তেমন আলোচিত হতো না। শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কেই প্রয়োজন মতো তাকে অবহিত রাখা হতো।

সেনাবাহিনীর গঠন প্রক্রিয়ার শুরুতেই মেজর জলিল আর্মি থেকে পদত্যাগ করেন, চাকুরী থেকে অব্যাহতি নেন কর্নেল তাহের। দু’জনই পরে জাসদে যোগদান করেন। এক পর্যায়ে বঙ্গশার্দুল কর্নেল জিয়াউদ্দিন পদত্যাগ করে যোগ দেন সর্বহারা পার্টিতে।

জাসদের ধর্মহীনতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দর্শন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ধোপে টেকেনি ধর্মপ্রাণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে। একই ভাবে, সর্বহারা পার্টির শ্রেণি সংগ্রামের নামে গলাকাটার রাজনীতিও প্রত্যাক্ষ্যাত হয়েছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশীদের কাছে।

জাসদ মূলত আওয়ামীলীগেরই ‘বি’ টিম, সেটা মেজর জলিল এবং কর্নেল তাহেরের বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। হতাশাগ্রস্ত জনদরদী দেশপ্রেমিক কর্নেল তাহের পরে নিজের উদ্যোগেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামের একটা সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন সামরিক বাহিনীর মধ্যে। তার সেই একক প্রচেষ্টাও তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। শুধুমাত্র ঢাকা সেনানিবাসেই গুটিকতক সেল সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিলো কর্নেল তাহেরের পক্ষে।

আমার এই বক্তব্যের সত্যতা লেখার ধারাবাহিকতায় পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠবে। শুধু মাত্র জাসদ ও সর্বহারা পার্টির সাথেই নয়, দেশের অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, এবং বিভিন্ন পেশার সমমনা ব্যক্তিদের সাথে যুদ্ধকালীন সময় থেকেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলো সেনা পরিষদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয় স্বাধীনতার পরও।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক এবং ডানপন্থী দলগুলোর কোনও অস্তিত্বই ছিল না। এরপরও ঐ সমস্ত দলের বিশ্বস্ত নেতা-কর্মীদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলো সেনা পরিষদ বিভিন্ন সূত্রে। এমনকি আওয়ামী-বাকশালীদের মধ্যে যে সমস্ত নেতা-নেত্রী, সচেতন কর্মীরা মুজিবের স্বৈরশাসন এবং ভারতের পদলেহী নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ছিলেন কিন্তু বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে খোলাখুলিভাবে মুজিবের বিরোধিতা করতে ছিলেন অপারগ তাদের সাথেও যোগাযোগ ছিল সেনা পরিষদের নেতাদের।

সংসদ অধিবেশনে কয়েক মিনিটের মধ্যে কাউকে কোনও কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শেখ মুজিব আওয়ামীলীগের মৃত্যু ঘটিয়ে একদলীয় স্বৈরশাসন বাকশাল কায়েম করে নিজেকে যখন রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা দেন তখন শুধুমাত্র দুইজন সাংসদ এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে পদত্যাগ করে অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছিলেন। তারা হলেন, বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী এবং ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। দীর্ঘ দিনে গড়ে ওঠা পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতেই সম্ভব হয়েছিলও এ ধরনের যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়া।

এক সময় মেজর তাহেরকে সাথে নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে। আমাদের সাথে আসতে না পারলেও পরে তিনি পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং সেনা পরিষদের একজন নেতাও হয়েছিলেন। কিন্তু পরে এক সময় সমাজতন্ত্রের ভূত মাথায় চেপে বসায় তিনি সেনা পরিষদ ত্যাগ করে জাসদে যোগদান করেন। একই ঘটনা ঘটে মেজর জলিলের সাথেও। পরে জাসদ ছেড়ে আবার সেনাপরিষদে ফিরে আসা সম্ভব না হলেও তাদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল তাদের অকাল মৃত্যুর আগপর্যন্ত।

একই ভাবে, রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও কর্নেল তাহের, মেজর জলিল ছাড়া সিরাজ সিকদার ও কর্নেল জিয়াউদ্দিনের সাথেও আমাদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল বরাবরই। এর ভিত্তি ছিল নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম এবং মুক্তিযুদ্ধের গণমুক্তির চেতনা। আমরা জানতাম, মত ও পথের ফরাক থাকলেও প্রয়োজনে দেশ ও জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে একত্রিত হতে পারবো আমরা সবাই অতি সহজেই। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত লেখা আছে ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ বইতে।

রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের শাসনকালে বন্দী অবস্থায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ সিকদারকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা, রাষ্ট্রপতি জিয়ার আমলে বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে হাজার হাজার সেনা সদস্য নিধন, ক্র্যাচের কর্নেল তাহের বীর উত্তমের ফাঁসি, ১৯৮১ সালে তৎকালিন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের হুকুমে বন্দী অবস্থায় জেনারেল মঞ্জুরকে গুলি করে হত্যা এবং একই সাথে ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বিচারের প্রহসনে মৃত্যুদণ্ড দেয়া, ১৯৯৬ সাল থেকে খালেদা জিয়ার দু’-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জোট সরকারের আমলসহ দীর্ঘ ১৪ বছরেরও বেশি সময় সংবিধান বিরোধী খুনের সাজানো মামলার আসামী করে সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ৫ জন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা- কর্নেল ফারুক, কর্নেল শাহরিয়ার, কর্নেল মহিউদ্দিন (যে জিয়াকে ৭ই নভেম্বর মুক্ত করেছিল), মেজর হুদা (প্রাক্তন সাংসদ), মেজর মহিউদ্দিনকে অমানবিক অবস্থায় ডেথ সেল এ রাখার পর, ২০১০ সালে মুজিব কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জোটের মুখে কুলুপ আঁটা পরোক্ষ সমর্থনে বিশ্ববাসীর তীব্র নিন্দার তোয়াক্কা না করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং গলা কেটে হত্যা (জু্ডিশিয়াল মার্ডার) এর মাধ্যমে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ মেটানো এবং বিডিআর হত্যাযজ্ঞের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলোর প্রতিকার দেশবাসীকে অবশ্যই করতে হবে বিবেকের তাড়নায়।

তা না করলে নৈতিকতাহীন অসৎ, বেঈমান ক্ষমতালোভী নেতা-নেত্রীদের চাপিয়ে দেয়া কলঙ্কের অভিশাপ থেকে জাতি কখনোই মুক্ত হতে পারবে না।

যে জাতি জাতীয় বীরদের সম্মান করতে পারে না সে জাতি ধ্বংস হয়ে যায়- এটাই ইতিহাসের লিখন। তবে লেখক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন বাংলাদেশীরা তেমন জাতি নয়।

স্বাধীনতার পর বিপ্লবী সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি শেখ মুজিবের সরকারের বিরুদ্ধে ত্রাসের সৃষ্টি করে। দুই বছরের মধ্যেই ৬০টিরও বেশি থানা এবং ২০-টিরও বেশি ব্যাংক লুট করে তার দল চমক সৃষ্টি করে তরুণ প্রজন্মকে রোমাঞ্চিত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু যেহেতু তার দলের আদর্শ ছিল শ্রেণিসংগ্রাম ও নাস্তিকতা ভিত্তিক সমাজতন্ত্র তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সর্বহারা পার্টির আদর্শ গ্রহণ করেনি।

যাই হোক, তৎকালিন ডিআইজি জনাব ই এ চৌধুরী তার শ্যালককে সর্বহারা পার্টিতে গুপ্তচর হিসাবে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তার দেয়া খবরের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম থেকে আচমকা সিরাজ সিকদারকে বন্দী করতে সক্ষম হন। সেইদিনই তাকে ঢাকায় এনে রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে রাখা হয়। অকথ্য নির্মম অত্যাচার চালানো হয় তার উপর বন্দী অবস্থায়। যে রাতে শেখ মুজিবের হুকুমে তাকে মেরে ফেলা হয় সেই রাতের দ্বিপ্রহরে আমি আর গুডুভাই (কর্নেল নাজমুল হুদা) গোপনে রক্ষীবাহিনী প্রধান কর্নেল নুরুজ্জামানের অনুমতিক্রমে তাকে দেখতে যাই সেকেন্ড ক্যাপিটালের সদর দফতরে। সঙ্গে কিছু ফল ও খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু কোনও কিছু খাবার অবস্থা তার ছিল না।

মৃতপ্রায় অচেতন অসাড় অবস্থায় তাকে ফেলে রাখা হয়েছিল ঘরের মেঝেতে। গুডুভাই এর এটাই প্রথম দেখা। আমার সাথে দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু সেই কালরাতে অতিপরিচিত কিংবদন্তির সিংহপুরুষ সিরাজ সিকদারের মুখটাকেও চেনার উপায় ছিল না। সেই লোমহর্ষক দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে এসেছিলাম দুজনেই দুঃখ ও গ্লানির অবর্ণনীয় বেদনা বুকে নিয়ে।

পরদিন সংসদের অধিবেশনে দাম্ভিক প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব স্বয়ং লজ্জাহীনভাবে উচ্চস্বরে গর্জে জানান দিলেন বন্দী অবস্থায় সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যার খবরটি। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে দর্পভরে বলেছিলেন-কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? এভাবেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বন্দীদের বিনা বিচারে মারার রীতি শুরু করে মুজিব এবং তার আওয়ামীলীগ সরকার।
তার এই ধরনের দাম্ভিক উক্তিতে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল দেশবাসী এবং বিশ্ববিবেক!