চীন থেকে লন্ডনে নির্বাসন কালে

একদিন হঠাৎ করেই ফোন পেলাম আমাদের সবারই প্রিয় এক মুক্তিযোদ্ধা ব্যবসায়ী ছোটো ভাইয়ের। সে জানালো দেশ থেকে লন্ডন এসেছে আমার আর নূরের সাথে জরুরী ভিত্তিতে দেখা করার জন্য। দেখা করেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে দেশে ফিরতে হবে। দিনক্ষণ এবং স্থান ঠিক করা হল। পিকাডেলি সার্কাসের একটি লেনে অনেক দিনের চেনা ছোট্ট একটা খাবারের দোকান আছে। সেটা চালায় এক স্কটিশ দম্পতি। প্রায়ই সেখানে দুপুরে ফ্রেশ গ্রিল্ড ট্রাউট আর গ্রীন বয়েল্ড ভেজিটেবল উইথ মাস্টারড কিংবা ইটালিয়ান সস খেতে যাই। ছোটো ভাইকে সেখানেই দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ করেছিলাম। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আলাপ চলছিলো। এক কালের তুখোড় ছাত্র ছোটো ভাই উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়েও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার পর সাধারণ বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হয়ে আমাদের একজন হিসেবে কাজ করে আসছে। যুদ্ধের পর অনেক সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সরকারী কিংবা আর্মির চাকুরি গ্রহণ না করে স্বাধীন ব্যবসা করছে। সেইসূত্রে প্রায়ই বিদেশে সফর করে থাকে। বলো ছোটো ভাই, হঠাৎ এমন কি জরুরী বিষয়ে আলাপের জন্য ঢাকা থেকে তোমাকে ছুটে আসতে হল!

অবস্থা সঙ্গিন ডালিম ভাই। জেনারেল জিয়া ক্ষমতার লিপ্সায় একের পর এক যে সমস্ত পদক্ষেপ নিচ্ছেন তাতে সাংগঠনিক ভাবে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ছে তাই নয়, তার ভারত তোষণ নীতি অচিরেই দেশটাকে পরিণত করবে একটি করদ রাজ্যে, আর দেশবাসী পরিণত হবে ভারতের গোলামে। প্রকৃত জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক সেনা সদস্য এবং মুক্তিযোদ্ধারা এটা মেনে নিতে পারছে না। সবার একই কথা, তাকে এই পথ থেকে সরিয়ে আনতে হবে নতুবা ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে কালবিলম্ব না করে।

সবই বুঝলাম, তোমাদের আশংকা অমূলক নয়। তবে কথা হল বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? জেনারেল মঞ্জুর বেঁচে থাকা অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনের উপর ভিত্তি করে এ ধরনের উদ্যোগ নেবার চিন্তাভাবনা করছেন। এই বিষয়ে আপনাদের মতামত জানতে চাওয়ার জন্যই আসতে হয়েছে আমাকে। এই ধরণের কোনও উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে কি হবে না সেই বিষয়ে মতামত দেবার আগে তোমাকে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলতে চাই।

শোন ছোটোভাই, যুদ্ধকালীন সময় থেকেই আমরা একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিজেদের সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করি স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় সুদূর প্রসারী নীলনকশার বিরুদ্ধে। এই বিষয়ে তুমি অবগত। যুদ্ধের আড়ালে ওই তৎপরতায় লিপ্ত সবাই একই নীতি-আদর্শ এবং দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি নিয়ে আগুয়ান হচ্ছিলাম। আমাদের সাথে যোগদান করেন জিয়াউদ্দিন, তাহের, জলিল-এর মতো নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক কমান্ডাররা। সেই সন্ধিক্ষণে জিয়ার মতো একজন অফিসারকে সামনে রেখেই আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে হয় বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে। এভাবেই জিয়াকেই আমাদের গ্রহণ করতে হয় মধ্যমণি হিসাবে। তার তরফ থেকে একটি শর্ত ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত জিয়াকে আমরা ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করাতে না পারি ততদিন তার সাথে আমাদের সম্পর্কটা গোপন রাখতে হবে। সংগঠনের স্বার্থেই তার সেই শর্ত আমরা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসানো হল তখন তিনি আমাদের বাদ দিয়ে নিজের রাস্তায় চলার সিদ্ধান্ত নিলেন। কেনো তিনি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু এর ফলে আমাদের সব স্বপ্ন-প্রত্যাশা ধূলিসাৎ হয়ে গেলো! আমরা বিজয়ী হয়েও হেরে গেলাম!

এর পরিণাম এখন সুস্পষ্ট সবার কাছেই। যেই সোভিয়েত বলয়ের ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম তার শিকড় কেটে তাদের সাথে আপোষ করেই এখন তিনি জাতীয়তাবাদী এবং জনস্বার্থের রাজনীতির চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠেছেন। তার ১৯ দফাটাও আমাদেরই কর্মসূচি থেকেই নেয়া। তার দলের ম্যানিফেস্টোটাও আমাদেরই রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টোর অনুকরণে প্রণীত।কিন্তু এরপরও বলছি তিনি নিজে যেই মাপের বিপ্লবী নেতাই হউন আর তার নীতি-আদর্শ নকল ভিত্তিক হওয়ার পরও তার বাস্তবায়নের জন্য তার পরীক্ষিত কর্মীবাহিনী কোথায়? তিনি তো প্রায় তিন হাজারেরও বেশী দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করলেন। বিভিন্ন অজুহাত সৃষ্টি করে। কর্নেল জিয়াউদ্দিন, মেজর তাহের, মেজর জলিল এদের মাথায় এক সময় মার্কসিজম আর সমাজতন্ত্রের রোমান্টিসিজমের ভূত সওয়ার হওয়া সত্ত্বেও আমরা কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে ওই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। তুমি হয়ত বা অবগত আছ যখন কর্নেল জিয়াউদ্দিন হলিডেতে আচমকা তার নিবন্ধ ছেপে চাকুরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখন আমরা তার ঐ সিদ্ধান্ত বদলাতে অনেক অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি জবাবে বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর সবাই নাকি পচে গেছে, তাদের পক্ষে কোনও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে না। তারা সবাই যদি ঐ ভাবে আর্মি থেকে বেরিয়ে না যেতেন তাহলে এখন জিয়া যা করছেন সেটা কি করতে পারতেন? পারতেন না। যাক, এসবই হচ্ছে বিপ্লবের পথে প্রতিবন্ধকতা।

এবার জেনারেল মঞ্জুর সম্পর্কে কিছু কথা তোমাকে বলছি। আজ তুমি যা শুনবে সে সম্পর্কে জেনারেল মঞ্জুর এবং কর্নেল মাহবুব বীর উত্তম-এর মতো কয়েকজন ছাড়া অন্য কেউই তেমন একটা জানে না।

জেনারেল মঞ্জুর একজন চৌকস সেনা অফিসার। সারগোদা পাবলিক স্কুল থেকে পড়াশুনা শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন মধ্যবিত্ত পরিবারের জেনারেল মঞ্জুর। সামরিক বাহিনী, রণকৌশল, যুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে তার জ্ঞান এবং নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার জন্য পাকিস্তান আমলেই অনেকেই তাকে ‘গুডেরিয়ান’ বলে সম্বোধন করতো। যেকোনো দেশের পেশাদার সেনাবাহিনীতে জেনারেল হবার যোগ্যতা তার আছে। তাই তিনি আজ বাংলাদেশ আর্মিতেও একজন জেনারেল। কিন্তু একজন জনপ্রিয় বিপ্লবী নেতা হওয়ার মতো মন-মানসিকতা, নিজেকে জনগণের স্তরে নামিয়ে আনার প্রস্তুতি এবং যোগ্যতা তার আছে কিনা সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। এর কারণ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্যায়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার পর দুর্নীতির দায়ে মেজর ওসমানকে সরিয়ে তাকে যখন ৮ নং সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয় তখন গেরিলা এডভাইজার হিসাবে যে কয়টি সেক্টরে আমি দায়িত্ব পালন করছিলাম ৮নং সেক্টর তার মধ্যে একটি। সেই সুবাদে আমি কয়েকবার মনজুরের সাথে ভারতীয় নীলনকশা এবং আমাদের তৎপরতা সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তিনি প্রতিবারই এই বিষয়ে আমাকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর যখন ভারতীয় বাহিনী দেশের সব কিছু লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমরা এর বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নিই। সেই সময় তাজউদ্দিন সরকারের হুকুমে ফাঁদ পেতে কনফারেন্সের নাম করে মেজর জলিলকে যশোরে ডাকিয়ে এনে মঞ্জুরই কিন্তু তাকে বন্দী করেন একজন পেশাদার সরকারের অনুগত অফিসার হিসাবে। যখন আমরা সবাই এর বিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে উঠেছিলাম এবং আওয়ামীলীগ সরকারকে বাধ্য করেছিলাম তাকে মুক্তি দিয়ে চাকুরিতে পুনর্বাসিত করতে তিনি সেই প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে সযত্নে সরিয়ে রেখেছিলেন। স্বাধীনতার পর আমি কর্নেল মাহবুবের মাধ্যমেও তার সাথে আলাপের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। এরপরও ১৫ই আগস্ট বৈপ্লবিক পটপরিবর্তনের পর আমি তাকে দিল্লী মিশন থেকে ডাকিয়ে আনিয়েছিলাম এবং অনুরোধ করেছিলাম বিপ্লবের স্বার্থে একযোগে কাজ করতে। কিন্তু তিনি ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের জবাব দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন।

তারপরও কথা থাকে ছোটো ভাই, ৭ই নভেম্বরের পর জেনারেল জিয়া তার অবস্থান মজবুত করার জন্য সেনাছাউনিগুলোতে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেন তার বিরুদ্ধে শিশুভাই-এর মতো একজন ভীরু মানুষও প্রতিবাদ করেছিলেন। জেনারেল মঞ্জুর কিন্তু কাকতালীয় ভাবে ওই ধরনের হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন করে জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণেরই চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের হাত-পা যখন কাটা হচ্ছিলো সেনা পরিষদের শক্তি খর্ব করার জন্য তখনও মঞ্জুর সহ ক্ষমতা বলয়ের সবাই জিয়ার আস্থা অর্জনের জন্য তার পরিকল্পনাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। আমরা এখন ল্যাংড়া, লুলা শক্তিহীন। তাই মঞ্জুরের উদ্দেশ্য যতই মহৎ হউক না কেনো আমরা কোনোভাবেই জেনারেল মঞ্জুরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারি না। তাছাড়া আমরা জানিনা জেনারেল গুডেরিয়ান কি ধরনের বিপ্লবী এবং তার বৈপ্লবিক কর্মসূচিটা কি।

তুমি নিশ্চয়ই জানো, জেনারেল জিয়া আমাকে এবং রশিদকে ঢাকায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা জানাবার জন্য। তখন হঠাৎ ধূমকেতুর মতো কর্নেল ফারুক এসে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট দখল করে জিয়াকে গদিচ্যুত করতে তার সাঁজোয়া বহর নিয়ে ঢাকা আগমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। সেই সন্ধিক্ষণে জেনারেল জিয়া নিরুপায় হয়ে আমার হাত ধরে মিনতি করেছিলেন তাকে নিরস্ত্র করতে। কর্নেল মাহবুব তখন আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। অবস্থা সামাল দেবার পর প্রথমবারের মতো জেনারেল মঞ্জুর আমার সাথে গোপনে এক দীর্ঘ বৈঠকে মিলিত হন। সেই বৈঠকে তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন জিয়াকে উৎখাত করার উদ্যোগে আমরা কেন কর্নেল ফারুক আর রশিদকে সমর্থন করিনি? জবাবে বলেছিলাম, উৎখাত যদি করতেই হতো তবে শুধু জিয়াকেই নয়- তার সাথে সব সিনিয়র অফিসারদেরই চাকরি থেকে বের করে দিতে হতো। তার মধ্যে আপনিও বাদ পড়তেন না। এদের প্রায় সবাই ক্ষমতালিপ্সু, সুযোগসন্ধানী। তারা ক্ষমতার রাজনীতির সাথে পরিচিত, জনগণের রাজনীতির সাথে নয়। ১৫ই আগস্টের পর আমরা মাত্র ৩৬ জন দুর্নীতিবাজ এবং চরিত্রহীন সিনিয়র অফিসারকে চাকুরিচ্যুত করতে চেয়েছিলাম। সেটাও জিয়া করতে গড়িমসি করেছিলেন। ৩রা নভেম্বর এর প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতা ঘটার এটাও ছিল একটা কারণ। জিয়াসহ সবাইকে তুলে বাইরে ফেলে দেয়াটা তখন আমাদের জন্য খুবই সহজ ছিল, কিন্তু সেই সুযোগে যদি ভারতীয় সামরিক বাহিনী ২৫ বছরের চুক্তির আওতায় আগ্রাসন চালাতো সেটার মোকাবেলা কি আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হতো? সুযোগ সন্ধানী অনেকেই হয়েত তখন ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান তুলে আগ্রাসী বাহিনীর সাথেই মিলে যেতো। সেই সুযোগে প্রত্যাগতদের অনেকেই হয়ে যেতেন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা আর আমরা পরিণত হতাম রাজাকারে। অনেক হারিয়েছি, সব মেনেও নিয়েছি ভবিতব্য হিসাবে। কিন্তু নিজেদের গায়ে জাতীয় শত্রুর স্ট্যাম্পটা লাগানোর প্রবৃত্তি নেই। এরপর জেনারেল মঞ্জুর আর কথা বাড়াননি। বলতো, হঠাৎ কেন এত আগ্রহের সাথে সেদিন জেনারেল গুডেরিয়ান নিজেই আমাকে গোপন বৈঠকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?

ঠিক বুঝতে পারছিনা।

ঠিক আছে, আমিই বলছি। জেনারেল মঞ্জুরের ক্যারিয়ার শেষ হতে চলেছে। আমাদের খবর অনুযায়ী জিয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তাকে চট্টগ্রাম সেনানিবাস এর কমান্ড থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্টাফ কলেজে নিয়ে এসে কিছুদিন পর তাকে ডাইন আউট বাদ্যের সাথে বিদায় দেবেন। খবরটা আমরা যখন জানি তখন জেনারেল মঞ্জুরের পক্ষেও না জানার কোনও কারণ নেই। এটা জেনারেল গুডেরিয়ানের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা নেই, কিন্তু এর পেছনে জেনারেল এরশাদ যে চিকন খেলা খেলছেন তার পরিণতিটা হবে মারাত্মক। তাই এই বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে! তার সেই খেলা সম্পর্কে জেনারেল জিয়াও অবগত নন। আমাদের জেনারেল গুডেরিয়ান বা তার সহযোগী মানে তোমরাই বা জেনারেল এরশাদের দুরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা সম্পর্কে কতটুকু জানো কিংবা একেবারেই কিছু চিন্তা করছো কিনা বা বোঝার চেষ্টা করছো কিনা জানি না।

বিষয়টি একটু খুলে বলেন ডালিম ভাই।

তোমরা কি লক্ষ করেছ সরীসৃপ ব্রিগেডিয়ার নাসিম (MS) এর মাধ্যমে কমান্ড লেভেলে ছাঁকা সব মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মঞ্জুরের ডিভিশনে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এতে কিন্ত জেনারেল গুডেরিয়ানের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে না যদিও আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। বরং বলবো, এরশাদ এই কূটচালের মাধ্যমে এক ঢিলে বেঁচে থাকা সব মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছেন ভারত এবং RAW এর ইঙ্গিতে। এদের সাথে কিছু প্রাক্তন রক্ষীবাহিনীর অফিসারও তার চোখ কান হিসাবে জেনারেল মঞ্জুরকে উস্কে দেবার জন্য রাখা হয়েছে। মেজর মোজাফফর এবং লেফটেন্যান্ট খালেদ দুইজনই ঐ ধরনের উস্কানি দাতা। এরা দুইজনই প্রাক্তন রক্ষীবাহিনীর অফিসার।

এই চালের পরিণামটা হবে, মনজুর-জিয়া বচসায় জিয়া থাকবে না ক্ষমতার কেন্দ্রে। অন্যদিকে সেই সুযোগে জিয়ার প্রতি জনসমর্থন দেখে মঞ্জুরসহ সব জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধাকে ছেঁকে তুলে মেরে তার রাস্তা সাফ করে নেবে জেনারেল এরশাদ বিএনপির নিয়োগপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের কাঁধে বন্দুক রেখে। এটা তাকে করতেই হবে। তাছাড়া একজন প্রত্যাগত অফিসার হিসাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। ভারতের নীলনকশাকে ত্বরিত গতিতে এগিয়ে নেবার জন্য আওয়ামী-বাকশালী এবং জাসদসহ তথাকথিত বামদলগুলো এবং কয়েকটি পীর ঘরানার ধর্মীয় ব্যবসাদারদের আশীর্বাদপুষ্ট নাটের গুরু এরশাদকে ক্ষমতায় বসাবে ভারত এবং RAW. এটা আমাদের ধারণা যার কোনও মূল্যই হয়ত দেবেন না জেনারেল গুডেরিয়ান মঞ্জুর। তারপরও ইচ্ছে হলে কথাগুলো তাকে জানাতে পারো। কথা শেষ করার আগে একটি সংক্ষিপ্ত উপসংহার টেনে দিচ্ছি তোমার সুবিধার্থে।

১। আজকের জিয়া শুধুমাত্র ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর এর বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের ফসলই নয়, এখন তার অবস্থান সবদিক দিয়েই অনেক মজবুত।

২। সামরিক বাহিনী থেকে ঐসব বিপ্লবীদের নিধন করে যারা তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত করেছে জিয়া অতি কৌশলে প্রমাণ করেছেন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাকশালের পতন এবং বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় স্বৈরাচারী মুজিব এবং তার পরিবারের কয়েকজনের নিহত হওয়ার ঘটনার সাথে তার কোন সম্পর্কই নেই। একই সাথে একজন মধ্যপন্থী সমঝোতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী ব্যক্তি হিসাবেও নিজস্ব গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো, বিশেষ করে ভারতের কাছে।

৩। ভাঙ্গা স্যুটকেস, ছেঁড়া গেঞ্জি আর কোদাল কাঁধে খাল-খনন কর্মসূচির চমক সৃষ্টি করে জিয়া ইতিমধ্যেই ব্যক্তিগত ভাবে জনগণের মধ্যে একটা সস্তা ইতিবাচক ইমেজ বানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন।

৪। বিশ্বপরিসরেও আজ জিয়ার একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছে।

৫। জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে কোনও উদ্যোগ নেবার সময় জেনারেল মঞ্জুর হারিয়ে ফেলেছেন।

৬। মঞ্জুর চট্টগ্রামে শক্তিধর হলেও শুধুমাত্র চট্টগ্রাম নিয়েই বাংলাদেশ নয়।

৭। চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্যান্য সেনানিবাসে তার তেমন কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।

৮। গোড়া থেকেই জেনারেল মঞ্জুর অফিসার শ্রেণির কাছেই শ্রদ্ধেয়, কিন্তু আম সৈনিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তার তেমন কোনও ঘনিষ্ঠতা কখনোই তিনি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেননি।

৯। শৃগালের গা থেকে ভেড়ার চামড়ার আবরণ খসে পড়ার আগে জিয়ার বিরুদ্ধে কিছু ঘটালে সেটা মঞ্জুরের জন্য বুমেরাং হয়ে দাড়াতে পারে।

১০। ঠিক এইক্ষণে জেনারেল জিয়াকে তার পথ থেকে সরানো কিছুতেই সম্ভব না। এটা আমাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকেই বললাম।

দেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে তাকে ক্ষমতাচ্যুতই করতে হবে, কিন্তু সেই শক্তি জেনারেল গুডেরিয়ানের আছে বলে মনে হয়ে না। কারণ, ঢাকা, জয়দেবপুর, ঘাটাইল এবং সাভারের সব ইউনিট কমান্ডে বসানো হয়েছে জেনারেল এরশাদের অনুগতজনদের।
DGFI এবং DG NSI হিসেবে পোস্ট করা হয়েছে এরশাদের বিশ্বস্তজনদের। এসব সম্পর্কে জেনারেল জিয়া কতখানি অবগত আমি ঠিক জানি না। জেনারেল এরশাদ খুবই সতর্কতার সাথে ডাবল গেম খেলছেন জেনারেল নুরুদ্দিন, জেনারেল শওকত এবং ব্রিগেডিয়ার নাসিমদের আস্থায় নিয়ে।

১১। বিশ্বপরিসরে জেনারেল জিয়ার তুলনায় মঞ্জুরের পরিচিতি খুবই নগণ্য।

১২। জেনারেল গুডেরিয়ান এখন যতবড় বিপ্লবীই হয়ে থাকুন না কেন, নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্ব, জনসমর্থন, নীতি-আদর্শ ভিত্তিক একটি সঠিক সংগঠন এবং এক ঝাঁক প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী ছাড়া তার পক্ষে কোন বিপ্লবই সফল করে তোলা সম্ভব নয়। বিপ্লবের এই সংজ্ঞা অনুযায়ী জেনারেল মঞ্জুর কি কখনো কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন? জবাবটা পরিষ্কার- না।

১৩। ক্ষমতায় এসে বিপ্লব সফল করে তোলার মতো দল, নেতৃত্ব কিংবা কর্মীবাহিনী যে তৈরি করা সম্ভব নয় তার জলজ্যান্ত প্রমাণ স্বয়ং রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া।

১৪। শেষ কথা হল, যতক্ষণ না ঢাকা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে ততক্ষণ জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার কোনও পদক্ষেপ হবে সম্পূর্ণ আত্মঘাতী।

শেষবারের মতো জানতে চাচ্ছি, জেনারেল মঞ্জুরের প্রচেষ্টাতে আপনারা কি কোনও ভাবেই কোনও সাহায্য করতে পারেন না? মৃদু হেসে বললাম

তুমি একজন পুরনো কমরেড। তাই এতো বিস্তারিত আলাপ করলাম। অন্য কেউ হলে করতাম না। আমাদের বিশ্লেষণটাতে যদি জেনারেল গুডেরিয়ানের কোন উপকার হয় সেটাই হবে আমাদের অবদান।

দেখো ভাই, আমরা বিপ্লবী। আমাদের কাছে কোনও ব্যক্তিবিশেষ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের কাছে আমাদের স্বপ্ন, আদর্শ, নীতিমালা, দেশ ও জাতীয় স্বার্থটাই মুখ্য। দেশ এবং জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে আমরা সবকিছুই মেনে নিতে পারি। আমাদের সংগ্রাম ক্ষমতার সংগ্রাম নয়। জেনারেল মঞ্জুরকে বলবে, Although his days are numbered but that must not lead him to take any such desperate move which would turn out to be an infantile disorder and disastrous. জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার ফলে আমরা বর্তমানে হেরে গেছি ঠিকই, তবে দিনও বদলায়- তার সাথে নতুন সুযোগও সৃষ্টি হয়। This is the bottom line.

সত্যি ডালিম ভাই, আমি শুধু অভিভূতই হচ্ছি না- অবাকও হচ্ছি দীর্ঘকাল বিদেশে নির্বাসনে থেকেও দেশের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে এত সাবলীল আর সারগর্ভ বিশ্লেষণ কি করে করতে পারলেন, My hats off to you all! উত্তরটা খুবই সহজ। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই দেশ এবং জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে চলেছি আমরা। যতদিন আল্লাহ্‌ পাক হায়াত রেখেছেন এই ধ্যানই হবে আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা। সুযোগ ও সাধ্যমতো অতীতের মতোই ভবিষ্যতেও কাজ করে যাবো দেশ ও জাতীয় স্বার্থে সব চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে থেকেই। অনেক দিন পর অনেক আলাপ হল। আর কিছু জিজ্ঞেস করার না থাকলে চলো ওঠা যাক। না, আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। কবে ফিরছো?

দু’ এক দিনের মধ্যেই। বিদায় নেবার আগে ছোটো ভাই জানতে চাইলো ভবিষ্যতে যোগাযোগ করতে পারবে কিনা। জবাব দিলাম অবশ্যই। সবাইকে আমাদের সালাম আর দোয়া জানিও। আমাদের জন্যও তোমরা দোয়া কোরো।

নিশ্চয়ই, ইন শাহ্‌ আল্লাহ।

আল্লাহ্‌ হাফেজ।

শেষ হল আমাদের বৈঠক।