পেশাওয়ারের পথে

স্যুইটে পৌঁছে একটা হ্যান্ডব্যাগে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আর কয়েক প্রস্থ কাপড় গোছগাছ করে আমি ও রব্বানি বেরিয়ে পড়লাম পেশাওয়ারের পথে। কুয়াশাচ্ছন্ন রাত হলেও GT Road-এ ট্রাফিকের কমতি নেই। বিশেষ করে বড় বড় ট্রাক, ট্রলি এবং কনটেনার বহনকারী ট্রেইলর ছাড়াও বাস, কারগুলো সারিবদ্ধ ভাবে ছুটে চলেছে রাস্তার দু’ধার দিয়েই। আগে রাস্তাটা ছিল Narrow, এখন দেখলাম পুরো রাস্তাটাই প্রশস্ত Duel carriage Highway-এর রূপ ধারণ করেছে। খায়বার থেকে করাচী পর্যন্ত এটাই চলাচলের প্রধান সড়ক। আফগানিস্তান একটি ল্যান্ডলক্ড দেশ বিধায় ঐ দেশের সব পণ্য আনা-নেয়ার এটাই একমাত্র পথ। পথের দুই পাশেই ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে ছোট বড় শহর। অভিজ্ঞ চালক সতর্কতার সাথে গাড়ী চালিয়ে নিয়ে চলেছে। হঠাৎআমার সন্দেহ হল, পেছনের গাড়িটা যেনো আমাদের অনুসরণ করছে। ড্রাইভারকে আমার সন্দেহটা জানালাম। ড্রাইভার স্মিত হেসে জবাব দিলো,

ওটা আমাদের নিরাপত্তার জন্যই সাথে চলছে। হাসান আব্দালে চা পান করার জন্য কিছুক্ষণ বিরতি। রব্বানির পুরনো অভ্যাস, কিছুক্ষণ পর পর দুধপাত্তির কড়া গরম চা খাওয়ার। বিরতির পর আবার শুরু হল যাত্রা। পথে পড়লো ওয়াহ ক্যান্ট, সেখানে রয়েছে Ordinance Factory. কামরা বেসে রয়েছেAeronautical Complex.আটক নদীর উপর নতুন একটা duel carriage সেতু বানানো হয়েছে। এখানেই কাবুল নদ আর সওয়াত নদী এক হয়ে সৃষ্টি হয়েছে সিন্ধু নদযার অববাহিকায় গড়ে উঠেছিলো Indus Valley Civilization. খরস্রোতা এই দু’টি স্রোতস্বিনীর সঙ্গমস্থলে আগে একটাই সেতু ছিল পাহাড়ের গা ঘেঁষে। সেতুটি ব্রিটিশ আমলের তৈরি।এই সেতুর উপরেই ছিল রেললাইন এবং যানবাহন চলাচলের রাস্তা। নদীর পাড় ঘেঁষেই চেরাটের বিখ্যাত আটক ফোর্ট। এই ফোর্টেই অবস্থিত কমান্ডো ট্রেনিং সেন্টার। তাই, আটক ফোর্টের পুরো এলাকাটা জুড়েই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অতি পরিচিত জায়গাগুলো, অনেক স্মৃতি বিজড়িত। নওশেরা ক্যান্টনমেন্টের বিস্তৃতি ঘটেছে প্রয়োজনের তাগিদেই, তবে দেখতে অনেকটাই আগের মতই আছে। কাবুল নদের উপর নওশেরা সেতুটা আধুনিক ভাবে প্রশস্ত করে বানান হয়েছে। নওশেরাতে রয়েছে আরমার্ড স্কুল,আর্টিলারি স্কুল, সাপ্লাই ট্রেনিং সেন্টার। এর জন্য নওশেরা পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্টনমেন্ট। নওশেরা থেকে উত্তরপূর্ব দিকে মোড় নিয়ে মর্দানের দিকে মাইল পাঁচেক গেলেই রিসালপুরে দেখা যাবে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল এবং PAF Training Academy. পথের দুই পাশে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করিয়ে দিলো অনেক স্মৃতি। যৌবনকালের সেইসব স্মৃতি রোমন্থন কোরতে কোরতে পৌঁছে গেলাম পেশাওয়ার। শহরে ঢোকার পরই দেখা যায় জামরুদ ফোর্ট। সেখানে রয়েছে Frontier Force Regiment এর ট্রেনিং সেন্টার। গাড়ী এসে থামলো PC Hotel এর পোর্চে। Duty Manager সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে নিয়ে গেলেন নির্দিষ্ট স্যুইটে। তখনকার সময় পেশাওয়ারে একমাত্র পাঁচ তারকা হোটেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুলের তোড়া আর তাজা ফলের সাজি নিয়ে এলেন Deputy Manager. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মেহমান বলে কথা! শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তারা কালক্ষেপণ না করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন সবাই। রব্বানি খালেদ ভাইকে ফোন করে আমাদের আগমনী বার্তাটা জানালো। খালেদ ভাই বললেন, তিনি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হোটেলে পৌঁছে গেলেন তিনি। নিজের যোগ্যতা ছাড়াও জেনারেল শিনওয়ারীর সাথে তার রয়েছে আত্মীয়তা।বিধায় খালেদ ভাই সেনাবাহিনীসহ সুশীল সমাজে বিশেষভাবে পরিচিত।রুমেঢুকেই আমাদের দুই জনকেই জড়িয়ে ধরলেন আন্তরিক উষ্ণতায়।

খালেদ ভাই,নাইরোবিতে আপনার দাওয়াত কবুল করে বলেছিলাম সময় আর সুযোগ হলে নিশ্চয় আপনার ওখানে যাবো So, here we are. আমি কিন্তু এখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা আপনারা এভাবে আচমকা এসে উপস্থিত হবেন। It is really a very pleasant surprise. I am so delighted to see you both. আপনাদের এভাবে হঠাৎ করে আসাটা কিছুটা অপ্রত্যাশিতহলেওআমিকৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপনি আমার আমন্ত্রণ ভুলে যাননি বলে।

কি করে ভুলবো বলুন, প্রথম সাক্ষাতেই আপনি আমার মন কেড়ে নিয়েছিলেন। খালেদ ভাই এবার বললেন, হোটেলে থাকা চলবে না। তার বাসায় যেতে হবে। সেখানেই রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন ভাবী। কোনও অজুহাতই শুনবেন না খালেদ ভাই। অতিথি পরায়ণতায় পাঠানদের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। অতএব হ্যান্ডব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে তার সাথে যেতে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। Reception-এ বলে রাখা হলো যে কনও মেসেজ এলে সেটা নোট করে খালেদ ভাইয়ের বাসার নম্বরে জানিয়ে দিতে। এসব ব্যবস্থা খালেদ ভাই যেভাবে করলেন তাতে মনে হল তিনি হোটেল ম্যানেজমেন্ট-এর কাছে সুপরিচিত।

বাসায় ভাবী খাওয়া-দাওয়ার বিশাল আয়োজন করেছেন। এক পর্যায়ে ভাবী বললেন

আমাদের গরীবখানা থাকতে হোটেলে উঠলেন কেনও! কিছুটা বিব্রত হয়ে জবাব দিলাম

স্বেচ্ছায় তো উঠিনি, ইসলামাবাদের কর্তারাই সব ব্যবস্থা করেছেন। খাওয়ার পাট শেষে ভাবী কাওয়া পরিবেশন করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। বসার ঘরে কোয়েটা ষ্টোভ জ্বলছে। টাকে ঘিরে বসলাম তিন বন্ধু। তা হঠাৎএ ভাবে এখানে? প্রশ্ন করলেন খালেদ ভাই।
বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদেই আমাদের এভাবে আসতে হল। কারণটা মূলত বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশের মুসলমানদের সমস্যা। বিশেষ ভাবে বাংলাদেশের ১৪ কোটি মুসলমানদের কঠিন সমস্যা।আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে জেতাতে না পারলে বাংলাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে ভারতের দাসত্বের জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে পড়বে যদি আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে। তার জন্য হযরতজীর দোয়া চাইতে এসেছি আপনার মাধ্যমে। ঐশ্বরিক কৃপা ছাড়া শুধুমাত্র জাগতিক সাহায্য-সহযোগিতায় খালেদা জিয়াকে জেতানো প্রায় অসম্ভব। তাই নিরুপায় হয়ে তার দোয়ার জন্য আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। জানিনা হযরতজী আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন কিনা। কিন্তু ভাই, আপনাকে বিশেষভাবে চেষ্টা করতে হবে। বিশ্বাস করুন খালেদ ভাই, এই পুরো ব্যাপারে আমি আর রব্বানি জড়িত হয়ে পড়লেও এতে আমাদের কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই। সব শুনে খালেদ ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন অনেকটা ধ্যানমগ্ন অবস্থায়।

কি জানেন, রব্বানির ফোন পেয়েই আমি ছুটে গিয়েছিলাম হযরতজীর সাথে দেখা করতে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, এই সময় তিনি সাধারণত শহরে থাকেন না কিন্তু তাকে পেলাম শহরের বাড়িতেই। যাওয়া মাত্রই তিনি স্মিত হেসে আমাকে বললেন, কি আমাকে এখানে দেখে বিস্মিত হচ্ছো তাই না? এখানে আমি বিশেষ এক প্রয়োজনেই অবস্থান করছি প্রতীক্ষায়। রহস্য সাধকের উক্তির জবাবে আমি তাকে জানালাম আমার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেখা করে আপনার দোয়া চাইতে এসেছেন বিদেশ থেকে। কথা শেষ না করতেই তিনি বলে উঠলেন, অবশ্যই আমি তাদের সাথে দেখা করবো ঠিক হয়েছে কাল ফজরের পরই আপনাদের নিয়ে যেতে হবে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য। তার মুরিদ হিসেবে কারও সাথে সাক্ষাৎদানের ব্যাপারেএই ধরনের উচ্ছ্বাস আগে কখনও দেখিনি। আমি বুঝতে পারলাম, তিনি আপনাদের প্রতীক্ষাতেই শহরে এসে অবস্থান নিয়েছেন।

আল্লাহ্‌পাকেরঅশেষকরুণা, তাঁর রহমতেই হযরতজী আমাদের সাথে সাক্ষাৎকোরতে রাজি হয়েছেন।

ঠিক তাই, রব্বানিও বললো। আপনারা দীর্ঘ সফরে নিশ্চয় ক্লান্ত। তাই শুয়ে পড়ুন। আমি ফজরের আজান হলে আপনাদের উঠিয়ে দেবো। নামাজের পরই আমরা গিয়ে পৌঁছাব হযরতজীর আস্তানায়। আমার কিছু এবাদত বাকি আছে। সেটা শেষ করে আমিও শুয়ে পড়বো। শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিলেন খালেদ ভাই। আধ্যাত্মিক রহস্য বোঝার মতো জ্ঞান আমাদের নেই, তবুও হযরতজী আমাদের সাথে সাক্ষাৎকরার সিদ্ধান্ত নেয়ায় আল্লাহ্‌ পাকের শুকরিয়া আদায় করে প্রশান্ত চিত্তে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সকালে ফজরের আজানের আগেই খালেদ ভাই এসে জাগিয়ে দিলেন। খালেদ ভাই বললেন, হযরতজীর হুকুম এসেছে নাস্তা তার ওখানেই করতে হবে। এটাও একটা অস্বাভাবিক ব্যতিক্রম দর্শনার্থীদের জন্য।সবি আল্লাহ্‌পাকের ইচ্ছা! আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। যথাসময়ে পৌঁছালাম হযরতজীর বাসায়। ফজরের ওয়াক্ত, শহর এখনো জেগে ওঠেনি। রাস্তাঘাট ফাঁকা। একটা গলির ভেতরে প্রাচীর ঘেরাএকতলা বাড়ি, বসার ঘরটার মেঝে কার্পেট দিয়ে মোড়া। ঘরের মাঝখানে একটি খাটিয়াতে বসে আছেন হযরতজী। হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় একটা ধোতি পরে খালি গায়ে বসে আছেন লম্বা সুঠামদেহী সাদা দাড়িতে মুখায়বব ঢাকা সুশ্রী এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ, কাঁধে সাদা পাগড়িটা রাখা। দেখে বয়েস কতো বোঝার উপায় নেই। মাথার চুল খুবই ছোট করে ছাঁটা। এই শীতেও তিনি অনবরত ঘামছেন আর কাঁধের পাগড়ির কাপড়টা দিয়ে মুছে নিচ্ছেন শরীর কিছুক্ষণ পর পর। এর আগে এই ধরনের কোনও সূফি সাধকের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়নি। আমরা খালেদ ভাইকে সব ব্যাপারে অনুসরণ করে চলেছি। ঘরে ঢুকেই আমরা মেঝেতে বিছানো কার্পেটের উপর বসে পড়লাম। অর্ধনিমীলিত চোখে ধ্যানস্থ অবস্থায় বসে আছেন হযরতজী। কিছুক্ষণ পর হযরতজী আমাদের দিকে চাইলেন। His bright beaming eyes were absolutely piercing! খালেদ ভাই অত্যন্ত আদবের সাথে তার কাছে গিয়ে নিচু স্বরে আমাদের পরিচয় জানালেন। রব্বানির পরনে সালওয়ার কামিজ আর আমার পরনে পায়জামা-কুর্তা। দু’জনই উপরে চাদর জড়িয়ে নিয়েছিলাম। এতো নিচু স্বরে তারা কথা বলছিলেনযার কিছুই আমরা শুনতে পারছিলাম না। সব শুনে তিনি আমাকে ইশারায় কাছে ডেকে নিয়ে খাটিয়াতে তার পাশে বসিয়ে ডান হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। খালেদ ভাই তার পায়ের কাছে বসে রব্বানিকে তার পাশে বসতে ইশারা করলেন।আমার কাঁধে হাত রেখেইহযরতজী সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন- তোমার কেনো এসেছো?

হুজুর, আমরা কোনও ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে দোয়া নিতে আসিনি।এই উপমহাদেশের মুসলমানদের বিশেষ করে বাংলাদেশের ১৪ কোটি মুসলমানের স্বকীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে আপনার দোয়া চাইতে এসেছি। কি সমস্যা? হুজুর, আগামী নির্বাচনে যাতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের জোট জিততে পারে তার জন্য আপনাকে দোয়া করতে হবে। কোনোক্রমে যদি ভারতের প্রতিভূ শেখ হাসিনা নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় তবে ১৪ কোটি মুসলমান পৌত্তলিকদের গোলামির জিঞ্জিরে অনির্দিষ্টকালের জন্য শৃঙ্খলিত হয়েপড়বে।দেশটি পরিণত হবে ভারতের একটি করদ রাজ্যে। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করেছেতাদেরএক সুদূরপ্রসারী নীলনকশা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের লালিত স্বপ্ন ‘অখণ্ড ভারত’পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষে। যুদ্ধকালীন সময় থেকেই আমরা সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগঠিত ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করানোর পর তার বিশ্বাসঘাতকতায় আমাদের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। সে এক করুণ উপাখ্যান। যদিও বেগম খালেদা জিয়া তারই স্ত্রী তবুও দেশওজাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিকল্প হিসেবে তার বিজয়ের জন্যই আপনাকে আল্লাহ্‌পাকের রহমত হাসিল করার জন্য দোয়া করতেই হবে হুজুর। আমি আমার আর্জি পেশ করার সময় হয়তো কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। তাই নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়ছিলো। সব শুনে হযরতজী আমাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বললেন

বেটা কেঁদো না, আল্লাহ্‌ নিশ্চয় মেহেরবান। তিনি অবশ্যই আমাদের এই সাক্ষাতের সাক্ষী। তোমরা নাস্তা করো, আমি আসছি।বলেই দ্রুত উঠে ভেতরে চলে গেলেন হযরতজী।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন রকম খাবার পরিবেশিত হল। আমিও এরই মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়েছি। মাথা নিচু করে চুপ করে বসেছিলেন খালেদ ভাই এবং রব্বানি। রব্বানির চোখও অশ্রুসিক্ত।নাস্তা পরিবেশিত হবার পর খালেদ ভাই আহ্বান জানালেন নাস্তা করার জন্য। নাস্তা শেষে আমি খালেদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, হযরতজী কি ফিরে আসবেন? অবশ্যই বিদায় জানাতে আসবেন। এখন তিনি ভেতরে ধ্যানে বসেছেন। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ না তিনি ফিরে আসেন। যাবার আগে হযরতজী আমাকে দুই দুইবার জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি চাও কে জিতুক? আমি জবাবে দুইবারই বলেছিলাম বেগম খালেদা জিয়া। নাস্তা শেষে পরিচারকরা সব উঠিয়ে নিয়ে গেলো ভেতরে। আমরা নিশ্চুপ বসে থাকলাম তার ফেরার অপেক্ষায়। বেশ কিছু সময় পর পর্দা সরিয়ে হযরতজী ঘরে ঢুকলেন। তার চোখে জ্বলন্ত আগুন! সারা গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ছে! তাকে দেখে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো না। বললেন ইন শা আল্লাহ্‌ খালেদা জিয়াই জিতবেন নির্বাচনে। এর জন্য আল্লাহ্‌র রহমত ছাড়া প্রয়োজনীয় জাগতিক সব সাহায্য-সহযোগিতাও পাবেন তিনি আল্লাহ্‌র ইচ্ছায়। ভরাডুবি হবে ফিতনা হাসিনার। তবে বাংলাদেশ থেকে কেউ এসেছিলো এক বিয়েতে। সে বললো, বাংলাদেশের অবস্থা ভালো না। রক্তারক্তি হবে সেখানে, অনেক লোক বর্ডারের এপাশ থেকে ওপাশে যাবে আসবেও অনেকেই। এই অবস্থায় আমি তাকে বলেছি এখানেই থেকে যেতে। তোমাকেও আফ্রিকা ছেড়ে আরও কাছে অবস্থান নিতে হতে পারে। এবার তোমরা যেতে পারো। আমাকে গোসল করতে হবে।

পরে খালেদ ভাই আমাদের জানিয়েছিলেন শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, সব ঋতুতেই দিনে ১৮/২০ বার ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করে থাকেন এই সাধক মহাপুরুষ। আর তার শরীরের উপরের অংশ সব সময় খালি থাকে দিবারাত্রি। জীবনে এর আগে এমন একজন অলি-আল্লাহ্‌র সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি আমার। এক অদ্ভুত শিহরণ মূলক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলাম খালেদ ভাইয়ের বাসায়। বাড়িতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আর এক বিস্ময়! ভিতরে প্রবেশ করা মাত্র ত্রস্তে ভাবী এসে জানালেন PC থেকে ঘন ঘন ফোন আসছে। তাদের প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বলা হচ্ছে, আমরা যেখানেই থাকিনা কেনো যোগাযোগ করে খবর দিতে আমরা যাতে অনতিবিলম্বে ইসলামাবাদ ফিরে আসি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। অদ্ভুত যোগাযোগ! খালেদ ভাই মুচকি হেসে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। চলুন আপনাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি। ভাবীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে ফিরলাম হোটেলে। আমাদের দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন ম্যানেজার। ঠিক সেই সময় আবার ফোন এল ইসলামাবাদ থেকে। জানিয়ে দিলাম আমরা রওনা হচ্ছি এক্ষুনি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইসলামাবাদ পৌঁছাব। আমাকে বলা হল সোজা প্রধানমন্ত্রীর দফতরেই যেন আসি। তথাস্তু বলে ফোন রেখে দিলাম। এরপর খালেদ ভাইকে সব কিছুর জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে রওনা হবো- ঠিক তখন খালেদ ভাই বললেন নির্বাচনে বিজয়ের পর পেশাওয়ারে সপরিবারে আসতে যাতে না ভুলি। অবশ্যই আসবো প্রতিজ্ঞা করে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গাইডের সবকিছুই চেনা। তাই ঝড়ের গতিতে সতর্কতার সাথে পৌঁছালো প্রধানমন্ত্রীর দফতরে।

চৌধুরী সুজাত এবং নওয়াজ শরিফ দুইজনই অপেক্ষায় ছিলেন। আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গিয়ে তারা জানালেন, বেগম খালেদা জিয়াকে জানিয়ে দিতে নির্বাচনের জন্য অর্থ সংকুলান এবং সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের জন্য উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করবে পাকিস্তান সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করে।সেই সিদ্ধান্তই হয়েছে NSC এর বৈঠকে ISI এবং ঢাকাস্থ দূতাবাসের বিশ্লেষণের বিপরীতে আমার উপস্থাপনার অনুকূলে। দু’জনকেই কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ জানিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।