শ্রদ্ধেয় মওলানা ভাসানীর সাথে শেষ সাক্ষাত

বাংলাদেশের জনদরদী, মজলুমদের নেতা মওলানা ভাসানী তার মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন আগে শেষবারের মতো বাংলাদেশের জনগণের মরণ-বাঁচন সমস্যা নিয়ে যে সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন তা থেকে পাঠকগণ বর্ষীয়ান নেতার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও ভাবনার গভীরতা সম্পর্কে জানতে পারবেন বলেই ঘটনাটির অবতারণা করলাম। এ থেকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে বাস্তব ইতিহাস সম্পর্কে তার জ্ঞানের প্রসারতা।

‘৭০এর দশকের শেষে মওলানা লন্ডন গিয়েছিলেন একটি জটিল অস্ত্রোপচারের জন্য। আমিও তখন লন্ডনেই অবস্থান করছিলাম। খবরটা তার কাছে পৌঁছে যায়। খবরটা জানতে পেরেই তিনি আমাকে একদিন ডেকে পাঠালেন আমার বাল্যবন্ধু গাজীউল হাসান খানের মাধ্যমে। গাজী তখন স্থায়ীভাবে লন্ডনে বসবাস করছে। পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিল সাংবাদিকতা। একইসাথে পূর্ব লন্ডনে তার নিজস্ব প্রেস থেকে আমার প্ররোচনায় উৎসাহিত হয়ে ‘দেশবার্তা’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলাম দু’জনেই।

সময় মতো আমরা হুজুরের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলাম। অপারেশনের পর বাংলাদেশ দূতাবাসই এই ফ্ল্যাটটির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেই বৈঠকে আমাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলাপ করেছিলেন মওলানা। প্রায় দুই ঘণ্টা ছিলাম তার কাছে। কথা প্রসঙ্গে একসময় হঠাৎ তিনি বললেন, ‘তর যায়গা লন্ডন না, দেশে ফিরা যাইতে হইবো।’ হুজুরের কথার কি জবাব দেবো, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সেই সময় সেনাপরিষদ এবং আমাদের সাথে প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়ার কার্যক্রম ও রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রসঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিলো। এই প্রসঙ্গে যা দেখেছি ‘যা বুঝেছি যা করেছি’তে বিস্তারিত লিখেছি। ভাবছিলাম, হুজুরকে সব বিস্তারিত খুলে বলবো কিনা! ১৫ই আগস্ট বিপ্লবকে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে সমর্থন দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন। হুজুর আগস্ট বিপ্লব সম্পর্কে একটি প্রেস কনফারেন্সও করেছিলেন।

তারপর, একদিন আমি জেনারেল জিয়াকে গোপনে সন্তোষ নিয়ে গিয়েছিলাম, তাকে হুজুরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে দিকনির্দেশনা নেবার জন্য। ভাবনায় ছেদ পড়ল, মাওলানা বলে উঠলেন, ‘জিয়ার সাথে মতের অমিল হইছে, হেইডা আমি জানি। কিন্তু, ভুল পথেই চলছে জিয়া। ফিরা গিয়া আমি তারে বুঝামু, বুঝলে ভালো না বুঝলে আমি জানি কি করতে হইবো। তোরা তৈরি থাকিস। তবে বাবাজান একটা কথা, বুড়া মানুষের কথাডা মন দিয়া হুনিছ। যেই কাম শুরু করছস, তার শেষ বহুদূরে। বর্তমানের বাংলাদেশের মধ্যেই চোখ বন্ধ কইরা উটপাখি হইয়া বইয়া থাকলেই চলবো না। চোখ খুইল্লা চাইতে হইবো সীমানার বাইরে। কথাডা নিয়া চিন্তা করবা। নাইলে বাংলাদেশ ভাঙ্গা দেশে পরিণত হইবো।’

‘হুজুর দোয়া করেন, যাতে আমি আর আমার সহযোদ্ধারা আপনার ইশারা মতো দেশ আর মজলুম দেশবাসীর জন্য নিজেদের জীবন কোরবান করতে পারি সেই হেকমত আর সুযোগ যেন আল্লাহপাক আমাদের দেন।’

আমার জবাব শোনার পর তিনি আধশোয়া অবস্থাতেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করলেন।

তার উষ্ণতা ও আন্তরিকতায় আমার বুক ভরে উঠে ছিল। ডাক্তার এসে গেছে চেকআপের জন্য, আমাদের বিদায় নিতে হবে। সালাম করে আমি ও গাজী বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বুকের মধ্যে গেঁথে নিয়ে এলাম দরবেশতুল্য এক মহামানবের অমূল্য দিক নির্দেশনা। সেটাই ছিল মওলানা ভাসানীর সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎকার। এর অল্প কয়েকদিন পরেই তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর মৃত্যুতে জাতি হারাল একজন জনদরদী অভিজ্ঞ মুরুব্বী এবং দূরদর্শী-বিচক্ষণ নেতা!