জেনারেল মনজুরের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল

প্রিয় কমরেড যা জানিয়ে গেলো তাতে পরিষ্কার বুঝতে পারলাম সবকিছুই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগুচ্ছে। চীনে হাসিনাকে সমঝোতার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি জিয়া নিজেই যখন স্বীকার করেছিলেন তখন আমি তাকে বলেছিলাম, মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের প্রত্যাশা জামায়াতে ইসলাম-এর আমীর প্রোফেসর গোলাম আজমকে বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দিন। তাদের এই খায়েশটা পূরণ করলে রাজনৈতিকভাবে আপনি লাভবান হবেন। একদিকে জামায়াতকে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে তিনি একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন। অন্যদিকে ঐ সমস্ত ধনী প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন নিয়ে OIC-তে জেনারেল জিয়া তার অবস্থান মজবুত করতে সমর্থ হবেন। এতে দেশ ও জাতির লাভ হবে। তিনি আমার এই প্রস্তাবনায় তার নিজের স্বার্থটা বুঝতে পেরে জনাব গোলাম আজমকে দেশে ফিরে আসার সুযোগ করে দেন। জামায়াতের সাথে আমার কোনও সম্পর্ক কখনোই ছিল না। তবে জনাব মওদুদীর প্রকাশিত কিছু লেখা পড়ে তাকে একজন প্রগতিশীল ইসলামিক চিন্তাবিদ হিসাবেই গ্রহণ করেছিলাম। গণমানুষের কল্যাণে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডকে ইসলাম সমর্থন করে। এ বিষয়ে তার যুক্তিগুলো বেশ জোরালো। মার্ক্সসীয় দর্শনের ভিত্তি হল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। মানুষের জাগতিক জীবনের পরিসীমার মধ্যেই মূলত সীমিত তার দর্শন। মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের আত্মিক চাহিদা এবং পরকাল যার সাথে ঈশ্বরের অস্তিত্ব জড়িত সেটাকে কার্ল মার্ক্স মেনে নেননি। তাই তার মতবাদকে নাস্তিকতা বলে আখ্যায়িত করা হয়।

পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরে অন্য কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেননি কার্লস মার্ক্স। ধরা, ছোঁয়া, অনুভূতি এবং দৃষ্টির অগোচরেও যে কিছু থাকতে পারে সেটা মার্ক্স মেনে নেননি। কিন্তু এর সপক্ষে তেমন কোনও অকাট যুক্তিও দিতে পারেননি কার্ল মার্ক্স। ধরা যাক, আমাকে চোখ বেঁধে একটা কামরায় ঢোকানো হল। আমি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ঘরে কি আছে কি নেই কিছুই বুঝতে পারছি না, অনুভবও করতে পারছিনা। তার মানে কি ওই ঘরে কিছুই নেই? নাও থাকতে পারে আবার থাকতেও পারে। তাই মার্ক্স কি করে আবিষ্কার করলেন যে ধরা, ছোঁয়া, দেখার বাইরে কিছু থাকতে পারে না? তাছাড়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জটিল মহাসৃষ্টি এবং তার নিয়ামক শক্তি সম্পর্কেও কার্ল মার্ক্স কোনও কিছুই তেমন পরিষ্কারভাবে বলেননি। একটি পরিবার চালানোর জন্য একজন গৃহকর্তার প্রয়োজন হলে এই অসীম সৃষ্টি জগতটাকে সুচারুভাবে পরিচালিত করার জন্যও যুক্তিসঙ্গত ভাবেই বলা চলে একজন কর্তার প্রয়োজন অবধারিত। আর সেই কর্তা হবেন তিনিই যার রয়েছে সমগ্র সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। আর সেই জ্ঞান থাকা সম্ভব কেবলমাত্র সব সৃষ্টির স্রষ্টারই।

সুতরাং মানুষের মনোজগতের সব চিন্তা-ভাবনা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের উপর নির্ভরশীল নয়। মানুষ আত্মিকভাবে বিচরণ করতে পারে বাস্তব জগতের পরিসীমার বাইরেও। মার্ক্সের অস্বচ্ছ দিকগুলো সম্পর্কে কোরআনে স্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। কোরআনে পরিষ্কার ব্যাখ্যা ও নির্দেশ দেয়া আছে ইহকাল, পরকাল, বস্তুজগত, মনোজগত এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু সম্পর্কে। সৃষ্টিকারী এবং সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে আছে স্পষ্ট নির্দেশনা, যা আজঅব্দি কোনও ব্যক্তির পক্ষে খণ্ডানো সম্ভব হয়নি যুক্তিসঙ্গত ভাবে। তাই কোরআন হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। আর কিতাবটি যে ঐশ্বরিক তার প্রমাণ হচ্ছে আজঅব্দি কোনও মনীষীর পক্ষেই এই ধরনের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান প্রবর্তন করা সম্ভব হয়নি।বর্তমান আধুনিক যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটার পরও যখন বলা হচ্ছে আমাদের জগতের বাইরেও অনেক কিছুই আছে যার সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণাই নেই, তবে ইহকালের পর পরকাল আছে সেটা কেনো মানা হবে না সেটা বোধগম্য নয়। এর ফলেই বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির কালেও বিশ্ব মানবতার উপর নাস্তিকতার চেয়ে আস্তিকতার প্রভাবই বেশি।ইসলামের প্রকৃত নির্যাস ও মূল্যবোধগুলোকে মওলানা মওদুদী অতি সহজ ভাষায় বর্ণনা করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন ইসলাম বিশ্বমানবতার ধর্ম। সাম্য, সত্য, ন্যায়, ভাতৃত্ববোধ এবং শান্তির দিকনির্দেশনার জন্যই নাজেল করা হয়েছে ঐশ্বরিক কোরআন। কোরআনের বিধান রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে কি করে পালন করা সম্ভব জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ সাল্লেল্লাহু ওয়ালাইহি ওয়াসসাল্লাম। বিশ্বনবী মোহাম্মদ-এর মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান কোরআন নাজেল হয়। কোরআনেই সৃষ্টিকর্তা বলে দিয়েছেন, কোরআন পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। কোরআন প্রেরণের পর আর কোনও নবী পৃথিবীতে পাঠানো হবে না। তাই হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়ালাইহি ওয়াসসাল্লাম (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হউক)-কে বলা হয় শেষ নবী।

মাওলানা মওদুদীর তত্ত্বের উপর নির্ভর করে জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দল পাকিস্তানসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐসব দল মওলানা মওদুদীর ইসলামী রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আদর্শ ইসলামিক রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। মাওলানা মওদুদীর লেখার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা অতিদ্রুত মুসলিম জগতে তাকে অধুনাকালের একজন শ্রেষ্ঠ ইসলামিক চিন্তাবিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। একই সাথে সম্প্রসারণ ঘটে জামায়াতে ইসলামীর। কিন্তু বর্তমানে নানা বিচ্যুতির কারণে জামায়াতে ইসলামীর অগ্রগতিতে ভাটা পড়েছে কমবেশি প্রতিটি দেশেই। জনাব মওদুদীর আপোষহীন সংগ্রামের পথ থেকে সরে এসে প্রচলিত ধারার সমঝোতার নোংরা ক্ষমতার রাজনীতির অংশ হয়ে পড়াটাও জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা হ্রাসের একটি প্রধান কারণ। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণবিরোধী কায়েমী স্বার্থবাদীদের দ্বারা গঠিত বিদেশী শক্তিসমূহের মদদপুষ্ট দলগুলোর পাতানো খেলার রাজনীতিরই অংশীদারিত্ব করে চলেছে জামায়াতে ইসলামী প্রায় সব দেশেই। নেতৃত্ব হয়ে পড়েছে দেউলিয়া। সেটাই সংক্রমিত হচ্ছে সর্বস্তরে। তারপরও মাওলানা মওদুদীর কদর রয়েছে তরুণ প্রজন্মের কাছে। যেকোনো দেশ এবং জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন তরুণ প্রজন্মের উপরেই।

লন্ডনে বসেই খবর পাচ্ছি, জিয়ার সাথে মঞ্জুরের সম্পর্কে দ্রুত অবনতি ঘটছে। তারই ফলশ্রুতিতে হঠাৎ জেনারেল মনজুরকে চট্টগ্রামের কমান্ড থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্টাফ কলেজের প্রধান হিসাবে নিয়োগপত্র ইস্যু করা হল সেনাসদর থেকে। এতে সতর্ক ঘণ্টা বেজে উঠলো। জেনারেল গুডেরিয়ান বুঝতে পারলেন এরপর তাকে আর্মি থেকে আদবের সাথে বেড় করে দেয়া হবে। তাকে সরিয়ে দেবার পর তার আস্থাভাজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের উপর খড়গ নেমে আসবে। অপমানে ক্ষোভে মরিয়া হয়ে উঠলেন জেনারেল মনজুর। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন জেনারেল গুডেরিয়ান, ঢাকায় স্টাফ কলেজে যাওয়ার হুকুম মানা চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জিয়ার সাথে শেষ বোঝাপড়া করতে হবে। ইতিমধ্যেই হাসিনা এবং রেহানাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানের সাথে ফিরিয়ে এনেছেন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া বসন্তের কোকিল হিসেবে পরিচিত ডঃ কামাল হোসেন, তোফায়েল আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মধ্যস্থতায়। হাসিনাকে অধিষ্ঠিত করা হল পুনর্জীবিত আওয়ামীলীগের চেয়ারপার্সন হিসেবে। তাদের সব পৈতৃক সহায় সম্পত্তি এমনকি পার্টি ফান্ড সবকিছুই ফিরিয়ে দিলেন জিয়া। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করে দিয়ে ভারতের মনোরঞ্জন করতে অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন জিয়া। এই কাজটি একমাত্র তখনকার অবস্থায় জিয়ার মতো একজন জনপ্রিয় নেতার পক্ষেই করা সম্ভব ছিল মৃতপ্রায় আওয়ামীলীগকে পুনর্জীবন দান করে শেখ পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা। জেনারেল এরশাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না এই কাজ দু’টি করা। কাজ দু’টি হয়ে যাবার পর আওয়ামী-বাকশালীদের সতেজ করার জন্য প্রয়োজন জিয়ার নয়, এরশাদের। ভারতের কাছে জেনারেল জিয়ার প্রয়োজন যে ফুরিয়ে যাবে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের পর, সেটা জিয়ার মতো ধূর্ত খেলোয়াড়ও কিন্তু রাজনীতির কূট চাল আঁচ করতে পারেননি।

এমনই সন্ধিক্ষণে ২৯-৩০শে মে ১৯৮১ সালে, হাসিনার দেশে ফেরার ১৩-১৪ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে এক রাজনৈতিক সফরে যান। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে অবস্থান গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। সারাদিন পার্টির কাজে ব্যস্ত থাকেন প্রেসিডেন্ট। রাতের খাবার খেয়ে বৃষ্টি ঝরা রাতে তিনি যখন ঘুমিয়েছিলেন তখন একদল তরুণ অফিসার আক্রমণ চালায় সার্কিট হাউজে। ঘরের দরজা খুলতেই সাব মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যান স্লিপিং স্যুট পরা প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া। আক্রমণকারীদের গুলিতে মারা যায় তার ADC ও কয়েকজন স্টাফ অফিসার। পাশের ঘরে অবস্থানরত বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও বাকি সফরসঙ্গীরা কাঁকতলিয় ভাবে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচে। মৃত ব্যক্তিদের লাশ নিয়ে ফিরে যায় আক্রমণকারীদের দল। এরা সবাই এসেছিল চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে।

কাকতালীয় ভাবে জিয়াকে যখন গুলিতে ঝাঁজরা করা হচ্ছিল তখন হাসিনা আর সাজেদা চৌধুরী পলায়নরত অবস্থায় আখাউড়ায় ধরা পড়েন। জিয়ার মৃত্যু সংবাদ জানার পর জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র দখল করে দেশবাসীকে জানান যে এক বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হয়েছেন। তিনি বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের কারণসমূহও একই সাথে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের পক্ষে জনসমর্থনের আবেদন জানান। কিন্তু তার আবেদনে সাড়া দেয়নি জিয়ার প্রাণহানির ঘটনায় শোকাতুর দেশের আমজনতা। বরং দেশবাসী জেনারেল মঞ্জুরের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একই ভাবে মঞ্জুর দেশের অন্যান্য সেনানিবাসগুলো থেকেও সমর্থন পেতে ব্যর্থ হন। ঢাকা থেকে জেনারেল এরশাদ, জেনারেল শওকত, জেনারেল নুরুদ্দিন এবং ব্রিগেডিয়ার নাসিম এর মতো দু’মুখো সাপেরাও বাতাস বুঝে মঞ্জুরের ডাকে সাড়া না দিয়ে তার বিপক্ষেই অবস্থান নেন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করার জন্য। রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম সেনানিবাস, বঙ্গভবন এবং সেনাসদরে ঘটনা প্রবাহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। জিয়ার মৃত্যুর পর জাস্টিস সাত্তারকে নির্বাহী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে নিয়োগ করা হয় বিএনপি সরকারের তরফ থেকে। পরে তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। বাস্তুঘুঘু সেনাপ্রধান গিয়ে উপস্থিত হন বঙ্গভবনে। সেখানে তিনি হতভম্ব রাষ্ট্রপতির কাছে জানতে চান বর্তমান অবস্থায় তার করণীয় কি। বিদ্রোহীদের দমন এবং দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে যা কিছু করা বিবেচ্য তাই করার হুকুম দিলেন প্রেসিডেন্ট। এভাবেই নিজের ইচ্ছামতো সব কিছু করার অনুমতি আদায় করে জেনারেল এরশাদ সেনাসদরে ফিরে আসেন। অন্যদিকে বিধি বাম দেখে জেনারেল মনজুর নিজের প্রাণরক্ষার্থে ভাটিয়ারী থেকে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ্‌কে তার হেডকোয়াটার্সে ডাকিয়ে এনে সেনাসদরের সাথে যোগাযোগ করে একটা আপোষ রফা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেনাপ্রধান চতুরতার সাথে মঞ্জুরের সাথে কথা না বলে তার বিশ্বস্ত CGS জেনারেল নুরুদ্দিনের মাধ্যমে আলোচনা শুরু করেন। তিনি কুমিল্লা থেকে একটি ব্রিগেডকে শোভাপুর ব্রিজের পাড়ে পজিশন নেবার জন্য হুকুম দেন GOCকে। আলোচনা চলাকালে প্রয়োজনীয় ডেপ্লয়মেন্ট সম্পূর্ণ হবার পর চীফ জেনারেল এরশাদের পক্ষ থেকে মঞ্জুরের ডিভিশনের সবাইকে হাতিয়ার ত্যাগ করে কুমিল্লা থেকে পাঠানো কমান্ডারের কাছে মঞ্জুরসহ সবাইকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ জারি করা হয়। গুডেরিয়ান জেনারেল এর পরিণাম বুঝতে পেরে তার অনুগত সব ব্রিগেড এবং ইউনিট কমান্ডারদের সবাইকে ডেকে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিয়ে তিনি তার পরিবার এবং কর্নেল মাহবুব ও কর্নেল মতিকে সঙ্গে নিয়ে বার্মায় পালিয়ে যাবার প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম সেনানিবাস ত্যাগ করেন। ইতিমধ্যে জিয়া এবং তার সাথে মৃত ব্যক্তিদের ঘটনার রাত্রিতেই সেনানিবাস থেকে কিছু দূরে এক পাহাড়ি এলাকায় কড়া নিরাপত্তায় সমাহিত করা হয়। পলায়নকালে পথিমধ্যে ইঞ্জিনিয়ার্স কোরের মেজর হাজি মন্নানের একদল সৈনিকের সাথে এনকাউন্টারে কর্নেল মাহবুব এবং কর্নেল মতি নিহত হন। মঞ্জুর তার পরিবার এবং কয়েকজন বিশ্বস্ত সঙ্গীসহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। মঞ্জুরের পলায়নের পর চট্টগ্রামের বাকি সব অফিসার এবং সৈনিকরা সেনাপ্রধানের হুকুম অনুযায়ী অস্ত্র ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করে। মঞ্জুরের বিশেষ আস্থাভাজন প্রায় ২০ জন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে বন্দী করা হয়। পলায়নরত মঞ্জুর পরিবার কর্নেল মতি এবং কর্নেল মাহবুবের মৃত্যুতে বিশেষভাবে ভেঙ্গে পড়েন। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত এবং শারীরিক ভাবে ক্লান্ত মঞ্জর পরিবার এবং তার সঙ্গীরা ফটিকছড়ির এক কৃষকের পর্ণকুটিরে কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য যাত্রা স্থগিত করে আশ্রয় নেন। ইতিমধ্যে মঞ্জুরের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, চট্টগ্রাম সেনাছাউনির ২৪তম ডিভিশনের সেনা সদস্যদের সারেন্ডার, প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যু এবং জেনারেল মঞ্জুরের পলায়নের খবর ক্রমাগত টিভি এবং রেডিওতে প্রচারিত হচ্ছিল। যার ফলে ঐ পর্ণকুটিরের সংলগ্ন একটি বাড়ির কোন এক ব্যক্তি সন্দেহপ্রবণ হয়ে মঞ্জুর এবং তার সঙ্গীদের আশ্রয়স্থলের খবরটি নিকটবর্তী থানায় জানিয়ে দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঐ পর্ণ কুটির ঘেরাও করে সপরিবারে জেনারেল মঞ্জুরকে গ্রেফতার করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। ২৪ ডিভিশনের নবনিযুক্ত কমান্ডার সঙ্গে সঙ্গে সেনাসদরে মনজুরের গ্রেফতারের খবরটি পৌছে দেন। পুলিশ যখন বন্দী অবস্থায় মঞ্জুরকে সপরিবারে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাচ্ছিল তখন জেনারেল মঞ্জুর ক্রমাগত মিনতি করছিলেন তাকে সেনাবাহিনীর হাতে সোপর্দ না করে কারাগারে প্রেরণ করার জন্য। কিন্তু পুলিশ তার সেই আকুতি মানেনি। খবর পাওয়া মাত্র জেনারেল এরশাদ হুকুম দেন বন্দী মঞ্জুর, তার পরিবার এবং অন্য সবাইকে অফিসার্স মেসে কড়া নিরাপত্তায় রাখার জন্য। এরপর জেনারেল এরশাদ তার বিশ্বস্ত DGFI কে ডেকে পাঠান। একান্তে বৈঠকের পর ক্যাপ্টেন এমদাদকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে ক্যাপ্টেন এমদাদ আসছে সেটা চট্টগ্রামের নব নিয়োজিত ভারপ্রাপ্ত GOC কে জানিয়ে দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন এমদাদ চট্টগ্রাম পৌঁছেই জেনারেল মঞ্জুরের সাথে একান্তে দেখা করে কয়েক মিনিট কথাবার্তার পর মঞ্জুরকে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে ঢাকায় ফিরে আসে। এরপর গণমাধ্যমে জোর প্রচারণা চালানো হয় পলায়ন রত মনজুরকে সপরিবারে পুলিশ গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসার পর ক্ষুব্ধ সৈনিকদের গুলিতে জেনারেল মঞ্জুর মারা যান। এরপর প্রেসিডেন্ট সাত্তারের অনুমতি সাপেক্ষে চট্টগ্রাম জেলের ভেতরে এক ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে ২০ জন বন্দীর মধ্যে ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ফাঁসি দেয়া হয়। বন্দী অফিসারের মধ্যে দুইজন অফিসার মেজর মোজাফফর এবং মেজর খালেদ দুইজনই প্রাক্তন রক্ষীবাহিনী অফিসার সন্দেহজনক ভাবে বিচার থেকে অব্যাহতি পায় এবং পরে দেশত্যাগ করতে সমর্থ হয়। এই দুইজন অফিসারই জেনারেল এরশাদের অনুপ্রবেশকারী গুপ্তচর হিসাবে কাজ করছিল। ক্যাপ্টেন এমদাদকেও একই ভাবে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই বিচার প্রক্রিয়া দেশের আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষ ছিল কিনা সেটা আজও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে।

বিপ্লবী নেতা সিরাজ শিকদারকে বন্দী অবস্থায় এনকাউন্টারে মারা, কর্নেল তাহেরের ফাঁসির বিচার, আগস্ট এবং নভেম্বর বিপ্লবের শীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে অসাংবিধানিক ভাবে খুনের মামলা দায়ের করে তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানের রায় এবং ২০১০ সালের ২৮শে জানুয়ারি মধ্যরাত্রে হাসিনা সরকার কর্তৃক ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো ও গলা কেটে হত্যা করা এবং BDR Carnage- এর প্রহসন মূলক বিচারগুলোর আইনি বৈধতা এবং স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় দেশের জনগণ এবং বিশ্বপরিসরে এগুলো স্বীকৃতি পায়নি।

ঘটনার দ্বিতীয় দিনেই জেনারেল জিয়া এবং তার সাথে মারা যাওয়া অফিসারদের মরদেহ কবর থেকে উঠিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। শেরেবাংলা নগর লেকের উত্তর পাড়ে মরহুম রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের মরদেহ দ্বিতীয়বারের মতো জানাজা পড়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। পরে সেখানে স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করা হয়।

এরপর খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে ২৪শে মার্চ ১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ এক ব্লাডলেস ক্যু-র মাধ্যমে জাস্টিস সাত্তারকে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজেই রাষ্ট্রপতির গদিতে উপবিষ্ট হন। তিনি সাময়িকভাবে সংবিধান স্থগিত রেখে দেশে সামরিক শাসন জারি করে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। তার ক্ষমতা গ্রহণ সম্পর্কে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি ছোট্ট জবাবে বলেছিলেন, I am not unhappy. তার এই প্রতিক্রিয়া দেশী-বিদেশী প্রচার মাধ্যমে বিশেষ খবর হিসাবে স্থান পায়। অতীব পরিতাপের বিষয় হল, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারাই এসেছেন তারা সবাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অতি নির্মমভাবে নির্মূল করার চেষ্টা করে এসেছেন স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে সংবিধান লংঘন করে নির্বিচারে। এই প্রক্রিয়া লজ্জাকর স্বৈরতন্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এই বিষয়ে কোন তরফ থেকেই কেউই উচ্চবাচ্য করছেন না। অথচ সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ছাড়া কোন সমাজেই সত্যিকারের গণতন্ত্র শেকড় গাড়তে পারে না। এই ন্যক্কারজনক কলঙ্কের কালিমা জাতি আজও বহন করে চলেছে।