রাষ্ট্রপতি হিসাবে জিয়ার গণচীনে দ্বিতীয় সফর

নির্দিষ্ট দিনে বিমানের একটি বিমান ভর্তি সফরসঙ্গী নিয়ে এসে পৌঁছালেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দুই দুইবার ক্ষমতা বলয় থেকে ছিটকে পড়া কমরেড দেং শিয়াও পিং চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর মৃত্যুর পর ‘গ্যাং অফ ফোর’ কে পরাস্ত করে আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে এসে চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির কাণ্ডারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনিই বিমানবন্দরে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে অভ্যর্থনা জানান যদিও তখন চীনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হুয়ো গুয়ো ফেং। এয়ারপোর্টে জেনারেল জিয়া আমাকে উপস্থিত দেখে আশ্বস্ত হলেন। মনে মনে হয়তো ভেবে থাকবেন হক সাহেবের ফোনে কাজ হয়েছে। আমার সিদ্ধান্ত বদলাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। শীতের শেষ সময় হলেও তখনো পিকিং-এর আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে থাকে দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়। সাথে সাইবেরিয়া থেকে আসা তীক্ষ্ন ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী চীন সরকারের তরফ থেকে কমরেড দেং শিয়াও পিং সেই রাতেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দম্পতি এবং তার প্রতিনিধি দলকে রাষ্ট্রীয় ভোজে আপ্যায়নের নিমন্ত্রণ জানালেন ‘গ্রেট হল অফ দি পিপলস’ এ। চুন হান হাই-এর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে ডেলিগেশনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথামত দূতাবাসের সবাই এবং চীনে অবস্থানকারী সব বাংলাদেশীদের সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ করা হয়েছে ঐ নৈশভোজে। আমি ও নিম্মি দু’জনই উপস্থিত। অভ্যাগত সব অতিথিদের বসানো হল একটা বিশাল হল ঘরে। আমি ও নিম্মি আব্বা এবং সফরে আসা পরিবারের সদস্যদের সাথে বসে আলাপ করছিলাম। হঠাৎ বেগম জিয়া নিম্মিকে ইশারায় ডেকে তার পাশে বসিয়ে আলাপে রত হলেন।অল্পক্ষণের ব্যবধানে জনাব দেং শিয়াও পিং, প্রধানমন্ত্রী হুয়ো গুয়ো ফেং ও অন্যান্য চৈনিক নেতাদের সাথে করে আমাদের সাথে মিলিত হলেন। উষ্ণ পরিবেশে পরিচয় পর্ব শেষ হবার পর ফটোসেশন শেষ করে চেইন স্মোকার কমরেড দেং শিয়াও পিং জিয়ার পাশে নির্ধারিত আসনে বসে দোভাষীর মাধ্যমে আলাপ শুরু করলেন। উপস্থিত সবাই আমরা নীরবে দোভাষীর বয়ান থেকে তাদের আলাপ আলোচনার বিষয়বস্তু মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। ২০-২৫ মিনিট পর একজন পরিচারক সবাইকে সাথে করে খাবার ঘরে নিয়ে গেলো। অভ্যাগত সবাইকে যার যার নির্ধারিত আসনে বসিয়ে দিলো হাসিমুখে সুন্দরী পরিচারিকারা। মেইন টেবিলে গেস্ট অফ অনার রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং বেগম খালেদা জিয়া। হোস্ট দেং শিয়াও পিং, প্রধানমন্ত্রী হুয়ো গুয়ো ফেং এবং আব্বার সাথে একই টেবিলে আমার আর নিম্মির বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক কথাবার্তা চলছিল। এক সময় জেনারেল জিয়া জিজ্ঞেস করলেন

এক্সেলেন্সি, বয়স অনুপাতে আপনি নিজেকে এতটা স্বাস্থ্যবান রেখেছেন কি করে সেই রহস্যটা জানতে চাই। সবাইকে চমকে দিয়ে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠে দেং জবাব দিলেন

মহামান্য রাষ্ট্রপতি, রহস্যটা হচ্ছে, আমি একজন চেইন স্মোকার আর আমি প্রাণ খুলে হাসি। বলেই আবার তিনি উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন। তার রসিকতাটা সবাই উপভোগ করলেন। তার এই জবাবে একটা সূক্ষ্ম ইঙ্গিত অনুধাবন করলাম আমি। বর্ষীয়ান ঝানু তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী এই নেতা ইতিমধ্যেই বুঝে নিয়েছেন জিয়া প্রাণ খুলে হাসতে অভ্যস্ত নন।

খাবারের শুরুতেই চীনা রীতি অনুযায়ী হোস্ট দেং শিয়াও পিং ছোট্ট একটি স্বাগত ভাষণ দিলেন। তিনি ভাষণে বললেন পরিবর্তনশীল ভৌগোলিক সীমানা অনেক ক্ষেত্রে জাতিগোষ্ঠীর মনঃপূত না হলেও তারা বিশ্বস্ত বন্ধু অবশ্যই বেছে নিতে পারে। চীনের মতোই বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে প্রাচীন এক সভ্যতার ঐতিহ্য। এই দুই দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে প্রবলধারায় ব্রহ্মপুত্র নদ। এই স্রোতস্বিনীর পানি ও মহিমা চীন এবং বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী নির্বিঘ্নে উপভোগ করে আসছে অনাদিকাল থেকে। এই দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বের সেতু গড়ে তুলেছিলেন পর্যটকরা। শ্রী অতীশ দীপঙ্কর নামের এক মনীষী বৌদ্ধধর্মের বাণী প্রচার করার জন্য চীনে এসেছিলেন প্রাচীন বাংলাদেশ থেকেই। সেই ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল লক্ষ-কোটি নাবাসী। পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মের বাণী নিয়ে ধর্মীয় প্রচারকরা চীনে এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকেই। ইসলাম ধর্মের শান্তির বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে এক সময় ৪০ কোটিরও বেশি চীনাবাসী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। তারা আজঅব্দি যার যার নিজস্ব ধর্ম পালন করে চলেছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সাথেই।গণচীন সম্প্রসারণবাদে বিশ্বাস করে না, এটা ঐতিহাসিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। ছোট-বড় সব দেশের সাথে সমতা ভিত্তিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তোলা চীনা পররাষ্ট্রনীতির একটি মৌলিক নীতি। বাংলাদেশ এবং গণচীনের ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ককে বহুমাত্রিকভাবে মজবুত করে তুলতে অতীতের মতো বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও গণচীন আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করে যাবে। আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তিনটি স্তরে গড়ে তোলা হয়। ‘রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের, জনগণের সাথে জনগণের, পার্টির সাথে পার্টির। এটা আপনার প্রথম সফরের সময়ও আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে জানানো হয়েছিল।

এরপর তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়ার চীন সফরের সাফল্য এবং জিয়া দম্পতি ও সফর সঙ্গীদের এবং উপস্থিত সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করে টোষ্টে সবাইকে যোগদানের আবেদন জানিয়ে পানীয়র গ্লাস তুলে নিয়ে বললেন, ‘কাম্বে’ মানে পাত্র খালি করুন। এর জবাবে প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে জিয়া বললেন

দ্বিতীয় বারের মতো চীন সফরের সুযোগ পেয়ে তিনি আনন্দিত। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আমরা আন্তরিক ভাবেই কৃতজ্ঞ। কিন্তু ভারতের সাথে আমাদের রয়েছে কিছু মৌলিক দ্বন্দ্ব। এইসব দ্বন্দ্বের সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে হতে হবে আত্মনির্ভরশীল। সদ্যস্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে একটি স্বনির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মহান গণচীনের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার রয়েছে। বাংলাদেশের প্রগতির জন্য চৈনিক নেতৃবৃন্দ এবং চীন সরকারের কাছ থেকে সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার আশ্বাসকে তিনি অভিনন্দন জানাচ্ছেন। সময়ের আবর্তে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন আরও জোরদার হবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন। ভারত পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের জনগণ এবং তার সরকার গণচীনের সাথে সর্বক্ষেত্রে দৃঢ় ভিত্তির উপর সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। এরপর তিনিও পানীয়র গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘কাম্বে’।

এ ভাবেই শেষ হল নৈশভোজ। জিয়ার এই বক্তব্যের খসড়া আমিই লিখেছিলাম। জিয়া ভারত সংক্রান্ত কথাগুলো তার বক্তব্যে রাখতে চাইছিলেন না। কিন্তু আমার জোরালো যুক্তির জবাব দিতে না পেরে বাধ্য হয়েই তাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়েছিলো আমার লেখা খসড়াটা। এখানে সংক্ষেপে বাংলাদেশ, চীন এবং ভারতের চরিত্র নিয়ে কিছু আলোকপাত করা প্রয়োজন।
‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ নামে কোনও দেশের অস্তিত্ব ঐতিহাসিক ভাবে এই দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে কখনোই ছিল না। এই উপমহাদেশে নৃতাত্ত্বিক, ভাষা, ধর্ম, সাংস্কৃতিক ভাবে ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব অঞ্চলে গড়ে তুলেছিল প্রাচীন সভ্যতা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এই ভূখণ্ড অস্ত্রবলে দখল করে নেবার পরই এই অঞ্চলে ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ নামের একটি দেশের জন্ম দেয়। এরপর এই উপমহাদেশ ছেড়ে যাবার সময় বহুজাতিক এই ভূখণ্ডে দ্বিজাতি তত্ত্ব ভিত্তিক ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন এবং ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তান নামের দুইটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করে তারা এলান করে, দেশীয় রাজন্যবর্গের অধীন রাজ্যগুলো তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ইন্ডিয়া কিংবা পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে পারে কিংবা স্বাধীন সত্ত্বা বজায় রাখতে পারে। এই ভাবেই ধুরন্ধর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই অঞ্চলের জাতিগত সমস্যার সমাধান না করেই প্রস্থান করে। তাদের চলে যাবার পর কাশ্মীর, জুনাগড়, মানভাদার, হায়দ্রাবাদ এবং ত্রিপুরা পাকিস্তানের অংশ হতে চাইলে তাদের সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করে নেয় ভারতের শাসকগোষ্ঠী। গোয়া, দমন, দিউও দখল করে নেয়। আসাম, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, অরুণাচল, মেঘালয় স্বাধীনতা দাবি করে। সেই সময় থেকে আজঅব্দি এইসব আঞ্চলিক স্বাধীনতা সংগ্রামগুলোকে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন রেখে নির্মূল করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছে সব কয়টি কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু তাদের সেই পাশবিক সামরিক অভিযানের মুখেও ওই সব জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার সংগ্রাম দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। তাছাড়া সৃষ্টি হচ্ছে আরও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতার দাবি। যেমন জবর দখল করে নেয়া জম্মু-কাশ্মীরের আজাদীর লড়াই, শিখদের খালিস্তানের দাবি, দাক্ষিণাত্যের চারটি প্রদেশ জুড়ে তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। বিহার, ছত্রিশগড়, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, গুর্খাল্যান্ড এবং মধ্যপ্রদেশ জুড়ে মাওবাদীদের আন্দোলন। বর্তমানে ত্রিপুরাবাসীরাও লড়ছে স্বাধীনতার সংগ্রাম। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যদিও নেপালকে স্বাধীনতা দিয়ে যায়। কিন্তু আগ্রাসী ইন্ডিয়া নেপালকে জন্মলগ্ন থেকেই একটি করদ রাজ্যে পরিণত করে রাখে অসম চুক্তির মাধ্যমে। পৃথিবীর একমাত্র ঘোষিত হিন্দুরাষ্ট্র নেপালও বর্তমানে ইন্ডিয়ার আধিপত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। একই ভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছে আর একটি করদ রাজ্য ভুটান। ১৯৭৫ সালে সিকিম নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে কূটকৌশলে ক্ষমতালিপ্সু লেন্দুপ দর্জির মাধ্যমে অঙ্গীভূত করে নেয়ার পর সেখানের জনগোষ্ঠী এখন স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করার জন্য সোচ্চার হয়ে উঠেছে।

ভারতীয় বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী এবং মিডিয়া বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জোর প্রচারণা চালিয়ে বলার চেষ্টা করে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাতে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু লেখক মনে করেন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রমাণ করে উপমহাদেশ কখনই একক জাতিগোষ্ঠীর আবাসভূমি ছিল না, এটা ছিল বহুজাতির আবাস স্থল।

১৯৬২ সালে ইন্ডিয়া গণচীনের শক্তিকে বুঝতে না পেরে দেশটির বিরুদ্ধে সোভিয়েত প্ররোচনায় এক আগ্রাসী সামরিক অভিযান চালিয়ে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। গণচীনের সামরিক বাহিনী এই আচমকা আক্রমণকে সাফল্যের সাথে শুধু প্রতিহতই করেনি, তারা আকসাই চীন, লাদাখ এবং অরুণাচলের বর্ডার থেকে প্রায় ৪০০০ কিলোমিটারেরও বেশি ইন্ডিয়ার স্থলভাগ দখল করে নেহেরুকে জানান দেয় তিনি আলোচনায় বসতে রাজি কিনা। নেহেরু করজোড়ে গণচীনের প্রস্তাব মেনে নিলে, গণচীনের নেতৃত্ব তাদের বিজয়ী লালফৌজকে পূর্বের সীমান্তে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আলোচনায় বসেন। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।

ব্রিটিশ কর্তৃক রচিত উপমহাদেশের উত্তরপশ্চিম সীমান্তের ডুরাণ্ড লাইন এবং উত্তরপূর্ব সীমান্তের ম্যাকমোহন লাইন বিতর্কিত বিধায় আজঅব্দি গণচীনের কাছে দুটোই অগ্রহণীয়। ১৯৭১ সালে ইন্ডিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করেছিল বটে, কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা ১৬০০০ কোটি টাকার পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া যুদ্ধসম্ভার, মিল-ফ্যাক্টরি, স্বর্ণ-রৌপ্য, বন্দরে স্তূপীকৃত বিভিন্ন মালপত্র এবং কাঁচামাল লুট করে নিয়ে যায় মিত্রশক্তি হিসাবে। আগ্রাসী ভারত তৎকালীন প্রবাসী বাংলাদেশের অদূরদর্শী, নির্বোধ, দাসখত লিখে দেয়া মেরুদণ্ডহীন শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট সুবর্ণ সুযোগটা লুফে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল-

প্রথমতঃ তাদের চিরশত্রু পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে দুর্বল করে তোলা।

দ্বিতীয়তঃ এরপর সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে একটি পুতুল সরকার বসিয়ে দেশটিকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করা। তারা তাদের পদলেহি রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে সেই লক্ষ্য হাসিল করার চেষ্টা করে চলেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা হবার পর থেকেই।
বাংলাদেশকে তাদের অধীনস্থ রাখার প্রধান দু’টি কারণ রয়েছে।

প্রথমত- বাংলাদেশের স্থল, জল এবং আকাশ তাদের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থে যেভাবে খুশি ব্যবহার করার অধিকার অর্জন করা। দ্বিতীয়ত- এই ভূখণ্ডের অপরিমেয় সম্পদ কব্জা করে নেয়া। যাতে করে বাংলাদেশ কোনোক্রমেই স্বাবলম্বী হয়ে সমৃদ্ধশালী একটি রাষ্ট্রে পরিণত হতে না পারে। বাংলাদেশকে পরিণত করতে হবে সার্বিকভাবে একটি ভারত নির্ভর রাষ্ট্র হিসাবে। এমনটি না হলে, ইন্ডিয়াতে যে সমস্ত জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার লড়াই লড়ছে সেগুলো বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে আরও বেগবান করে তুলবে। এর পরিণতিতে কৃত্রিম ‘ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন’ এর বিলুপ্তি ঘটবে। চিরকালের মতো কবর চাপা পড়বে চাণক্যদের গ্রেটার ইন্ডিয়া (ভারত মাতা) প্রতিষ্ঠিত করার সাধ ও স্বপ্ন। এই বাস্তব সত্য সম্পর্কে প্রতিবেশী দেশগুলোর বুদ্ধিজীবী এবং রাষ্ট্রনায়কগণকে ভাবতে হবে বাস্তবতার নিরিখে। এই সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসী শক্তিটির বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আবশ্যকতা একক প্রচেষ্টায় আঞ্চলিক মোড়লের আগ্রাসনের মোকাবেলা করা কোন দেশের পক্ষেই সম্ভব হবে না। এটা একটি অকাট বাস্তবতা।

গণচীন বিশ্বের সুপ্রাচীন সভ্যতার অন্যতম। এই জনগোষ্ঠীর রয়েছে ৪০০০ বছরের লিখিত ইতিহাস। প্রাচীন অন্য কোনও জাতিগোষ্ঠীর এ ধরনের লিখিত ইতিহাস আছে বলে আমার জানা নেই। তাদের ইতিহাসই সাক্ষী বহন করছে চীন কখনোই নিজ সীমানার বাইরে কোনও আগ্রাসী অভিযান চালায়নি। ‘চীন’ শব্দটি চয়ন করেছে বিদেশীরা। চৈনিক ভাষায় চীনকে বলা হয় ‘চুঙ্গয়্যো’- মানে ‘সভ্যতার’ কেন্দ্র।

এই বিবেচনায় পাঠকগণ বুঝতে পারবেন, সদা আগ্রাসী ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বনির্ভরতার উপর ভিত্তি করে নিজেদের একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার স্বার্থে গণচীনের মতো একটি উদীয়মান শক্তির সাথে ঐতিহাসিক কারণেই বর্তমানে যুগোপযোগী ভ্রাতৃসুলভ সুসম্পর্ক আরো গভীর করে তোলা ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ এবং অপরিহার্য প্রতিবেশী সব কয়টি দেশের জন্যই।

গণচীন বাংলাদেশকে ১৫ই আগস্ট সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্বীকৃতি প্রদান করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে দৃঢ়ভিত্তির উপর সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে নেয়ার যে দ্বার খুলে দিয়েছিল কিন্তু দূরদর্শিতার অভাব, পশ্চিমা শক্তিগুলোর অনুকম্পার খায়েশ, পেট্রো ডলারের লোভ এবং ভারতের মন জুগিয়ে চলার রাজনীতির ফলে জেনারেল জিয়া সেই সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করা থেকে দেশ ও জাতিকে বঞ্চিত করেছিলেন। সময়ের সাথে সেই সুযোগ পরবর্তী কালে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা এবং নানাবিধ দুর্বলতার কারণে ক্রমান্বয়ে বর্তমান বিশ্বের উদীয়মান পরাশক্তি গণচীন এবং বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে আত্মঘাতী টানাপড়েন। ফিরে চলা যাক রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে।

কমরেড দেং শিয়াও পিং সবাইকে নিয়ে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে গাড়ীর বহরের দিকে এগিয়ে চলেছেন বিদায় জানাতে। পথিমধ্যে আমি নিচু স্বরে আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে যাবেন নাকি বাসায়।ইতিমধ্যে আমরা হোটেল ছেড়ে ওয়াং ফু চিং-এর নির্ধারিত ফ্ল্যাটে এসে উঠেছি। জিয়া আমাদের কথাবার্তা শুনে বললেন না, হক সাহেবের সাথে তুমিও চলো অতিথি ভবনে, তোমার সাথে কিছু জরুরী আলাপ আছে। কথা শেষে হক সাহেবকে নিয়ে বাসায় যেয়ো। কমরেড দেং শিয়াও পিং আমাদের বাংলায় আলাপ করা দেখে আব্বার দিকে চাইলেন। আব্বা একটু বিব্রত ভাবেই বললেন

এক্সেলেন্সি, এ আমার বড় ছেলে। উত্তরে মৃদু হাসির সাথে সিগারেটে একটি লম্বা সুখটান দিয়ে জনাব দেং শিয়াও পিং বললেন জানি।

আপনার ছেলে দেশের একজন কৃতিসন্তান এবং জাতীয় বীর। চীন-বাংলাদেশের বন্ধুত্বমূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে জোরদার করার জন্য এখানে আসার পর থেকেই আপনার যোগ্য সন্তান আন্তরিকতার সাথে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এই ধরণের উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য। চীনা নেতৃবৃন্দ তাকে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হিসাবেই মনে করে। আপনি অবশ্যই একজন গর্বিত পিতা।