জিয়ার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে

বিদেশে নির্বাসিত অবস্থায় থেকেও আমরা কিন্তু এ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারছিলাম বিভিন্ন সূত্র থেকে। জিয়ার পায়ের নিচ থেকে অতিদ্রুত মাটি সরে যাচ্ছে সেটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল আমাদের কাছে। দেশের ঈশান কোণে অশনি শংকেত, আর জেনারেল জিয়া তখন সারা বিশ্বে তার ভাবমূর্তি বাড়াবার প্রয়াসে ব্যস্ত! ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সামরিক, বেসামরিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ডেলিগেশন গণচীন সফর করে গেছে। এখনও আসছে যাচ্ছে। সেই সব ডেলিগেশনে পূর্বপরিচিত বিশ্বস্ত আস্থাভাজন সহযোদ্ধা এবং বন্ধুরাও আসছেন যাচ্ছেন। তারাও জানিয়ে যাচ্ছিলেন ভেতরের অনেক গোপন খবরাখবর। সবারই প্রায় একই কথা জিয়ার দিন ফুরিয়ে আসছে। ব্যক্তি হিসাবে জিয়ার পরিণাম কি হবে, ক্ষমতায় থাকবেন না ক্ষমতাচ্যুত হবেন সেটা আমাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। আমাদের ভাবনা ছিল জিয়ার তিরোধানের পর দেশের রাজনৈতিক মূলধারা কোন পথে অগ্রসর হবে! স্বাধীনতা এবং জাতীয় স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না! দেশটিকে অঙ্গরাজ্যে কিংবা করদ রাজ্যে পরিণত করবে নাতো আগ্রাসী ভারত ১৯৪৭ সালে ‘ভারত মাতার’ অঙ্গচ্ছেদ ঘটানোর প্রক্রিয়াতে বাংলাদেশী মুসলমানরা যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলো তার প্রতিশোধ নেবার জন্য!

শেষকালে যদি বাংলাদেশকে নেপাল অথবা ভুটানে পরিণত করা হয় তবে সেই গ্লানি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসাবে আমাদের পক্ষে মেনে নেয়া কি করে সম্ভব হবে! আমাদেরই অনুপ্রেরণায় সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুকে লালন করে হাসিমুখে শত শত মুক্তিযোদ্ধা নির্দ্বিধায় আমাদের নির্দেশ মেনে নিয়ে শাহাদত বরণ করেছেন। তাদের লালিত সেই স্বপ্ন যদি ব্যর্থ হয়ে যায় আর আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকি তবে কি জবাব দেবো আল্লাহ্‌ এবং ঐসব বিদেহী আত্মাদের কাছে? আমাদের জন্য এই বিষয়টি একটি বড় নৈতিক প্রশ্ন হয়ে দাড়াল।

পিকিং হোটেলে খাওয়া দাওয়ার কিছুটা অসুবিধে হচ্ছিলো। তাই সেখান থেকে শিফট করলাম কাছেই সিন চাও হোটেলে। তখনকার সময়ে বেইজিং-এর দ্বিতীয় বৃহত্তম হোটেল। এই ঐতিহ্যবাহী হোটেলটার একটা বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। চীনের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গ যখন বেইজিং-এ আসেন তখন তারা এই হোটেলেই অবস্থান করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত রাজনৈতিক ডেলিগেশনগুলোকেও এখানেই রাখা হয়। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী নেতা-নেত্রীদের অনেকেই রাজনৈতিক আশ্রিত হিসাবে এখানে বসবাস করছেন বহু বছর ধরে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে। তাই বিদেশী কোন সাধারণ অতিথিদের এখানে রাখা হয় না। স্থানীয় কূটনীতিকদেরও এই হোটেলে প্রবেশ করার বিষয়ে বাছবিচার রয়েছে। আমি এবং নিম্মিই একমাত্র ব্যতিক্রম। চীনা কর্তৃপক্ষ আমাদের এখানে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন কেনো? এর একমাত্র উত্তর হতে পারে বিশ্বাসযোগ্যতা। তারা হয়তো বুঝে নিয়েছিলেন আমি অন্যদের মতো পেশাদার কূটনীতিক নই। আমাকে ভিন্ন চোখেই দেখতেন চীনা কর্তৃপক্ষ তার প্রমাণ আমি পেয়েছি।

সেই সময় পিকিং-এর ৪০ বর্গমাইলের বাইরে কোনও কূটনীতিক যদি যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করতো সেক্ষেত্রে তাকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে যেতে হতো চীনা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু আমার এ ধরনের সফরের বিষয়ে তারা ছিলেন উদার। যখন যেখানে যেতে চেয়েছি সেখানেই সপরিবারে বিশেষ অতিথি হয়ে যাবার সব ব্যবস্থা সাদরে তারা করে দিতেন। শুধু তাই নয়, সাথে দেয়া হতো অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানী সফরসঙ্গী এবং চৌকস দোভাষী। সেই সময়ের ইউনান, উইঘুর, সিনচিয়াং, তিব্বত-এর মতো স্পর্শকাতর প্রদেশগুলোতেও যেতে দিতে তারা কখনোই কোনও আপত্তি করেননি। চীন-মঙ্গোলিয়া সীমান্তে আমুর নদীর উপত্যকায় সোভিয়েতের সাথে একটা ছোটোখাটো যুদ্ধের পর আমি সেখানে যেতে চাইলে সেখানেও আমাকে যেতে দিতে চীনারা রাজি হয়েছিলো। চৈনিক নেতৃবৃন্দ অবগত ছিলেন কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে আমি ব্যক্তিগত ভাবে গণচীনের ইতিহাস, বিপ্লব, নবচীনের রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক অবকাঠামোর পুনর্বিন্যাস এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের অগ্রাভিযান সম্পর্কে বিস্তর পড়াশুনা ও গবেষণা করছি চীনের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বোঝার ও জানার জন্য। আমি যখন চীনে গিয়েছিলাম তখন সময়টা চীনের জন্য ছিল একটি ক্রান্তিকাল। সেই সময় ধনতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্ব এমনকি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নও চীনের বিরুদ্ধে লৌহবর্ম তৈরি করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করে চলেছিল যাতে গণচীনকে দুর্বল করে রাখা যায়। তারা একযোগে চেষ্টা করছিল চীনকে খণ্ডিত করার জন্যও। কিন্তু পরীক্ষিত এবং অভিজ্ঞ চৈনিক নেতৃবৃন্দ আত্মবিশ্বাস, নৈতিকতা, প্রজ্ঞা, ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক শিক্ষা, দূরদৃষ্টি, আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপন করে সক্ষম হয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধ জনগণকে সাথে নিয়ে শত্রুপক্ষের সব চক্রান্তের জাল বানচাল করে দিতে। সব ষড়যন্ত্র ও বাধা অতিক্রম করে গণচীন ধাপে ধাপে স্বনির্ভরশীল দেশ ও জাতি হিসাবে নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্য হাসিল করার আপোষহীন যাত্রায় এগিয়ে চলেছিলো অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে। সেই সময় থেকে আজঅব্দি তাদের অগ্রযাত্রাকে বন্ধ করে দেয়া সম্ভব হয়নি কোনও বহিঃশক্তির পক্ষেই। লৌহবর্মের আবর্তে ঘেরা গণচীনে নিরাপত্তার জন্য তখন সব দূতাবাসকেই স্থানীয় স্টাফদের নিতে হতো একটি চৈনিক প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রয়োজন মতো অভিজ্ঞ এবং দক্ষ জনদেরই পাঠানো হতো দূতাবাসগুলোতে। তবে পদবীতে তাদের আসল পরিচয়টা কখনই জানা সম্ভব হতো না। তাদের মাধ্যমেই যেকোনো দূতাবাসের সব বিস্তারিত খবরাখবর এবং হাল-হকিকত পৌঁছে যেতো চৈনিক কর্তা ব্যক্তিদের কাছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। আমরা তখনও সিন চাও হোটেলেই অবস্থান করছিলাম। এরই মধ্যে ঘটে গেল এক ভয়াবহ অবিস্মরণীয় লোমহর্ষক ভূমিকম্প। এক রাতে হঠাৎ অদ্ভুত ঝাঁকুনি এবং কম্পনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সমস্ত ভবনটা সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে দোদুল্যমান জাহাজের মতো দুলছে। ঘরের আসবাবপত্র এদিক সেদিক গড়াগড়ি খাচ্ছে! ভীষণ জোরদার এক ভূমিকম্প! অতিকষ্টে নিম্মিকে আঁকড়ে ধরে দরজা খুলে কোনোমতে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচের লনে পৌছাতে সক্ষম হলাম। অন্যরাও সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ক্রন্দনরত বাচ্চাকাচ্চাদের টেনে হিঁচড়ে কোন রকমে নিচে নামিয়ে আনতে ব্যস্ত। মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে আচমকা দুর্যোগে সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভয়ে আর শংকায় কাঁপছে। ভবনটা তখনও থেমে থেমে দুলছে। মাটির উপর দাঁড়িয়েও কম্পন অনুভূত হওয়ায় সবাই ভবন থেকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে জড়সড় হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় একে অপরের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছিলাম। কয়েকজন আতঙ্কে মূর্ছা গিয়েছিলেন। আমরা তাদের চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করছিলাম সাধ্য অনুযায়ী।

কয়েক মিনিটের ব্যাপার। তখনও মাঝে মধ্যে মৃদু ভূকম্পন হচ্ছে! এরই মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স এবং ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা এসে পড়েছেন। তারা আমাদের অল্প দূরে একটি মাঠে চলে যাবার জন্য অনুরোধ জানালেন। আমরা সবাই তাদের কথা মতো সেখানে চলে গেলাম। প্রায় একই সাথে এসে পৌঁছালো দুই ট্রাক PLA -এর সৈনিক বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সাথে নিয়ে। দক্ষ কর্মীরা ধীরস্থির ভাবে পুরো ভবনটাতে তল্লাশি চালিয়ে দেখল কথাও কেউ রয়ে গেছে কিনা। কয়েকজন বয়স্ক নর-নারীকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে আসলো এবং তাদের এ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলো। সবাই এই অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বাকরুদ্ধ ও স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। নিম্মি ক্রমাগত দোয়া-দুরুদ পড়ছে। জীবনে এক ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা! সেই রাতটা খোলা আকাশের নিচে মাঠে তাঁবুতেই কাটাতে হল। পরদিন জানতে পারলাম এই ধরনের তীব্র ভূমিকম্প চীনের ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি। বেইজিং থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চীনের দুইটি বৃহত্তম শিল্প এবং বন্দরনগরী তিয়েন সিন ও শেন ইয়াং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ঘটনার পর প্রায় দুই সপ্তাহ আমাদের তাঁবুতেই থাকতে হয়েছিলো। এই ভীতিকর অভিজ্ঞতা জীবনেও ভুলবার নয়। এই প্রচণ্ড ভূমিকম্পের খবর বিশ্বে প্রচারিত হলে জাতিসঙ্ঘ সমেত পৃথিবীর সবদেশই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য। কিন্তু চৈনিক নেতৃবৃন্দ কোনও বৈদেশিক সাহায্য নিতে অপারগতা জানায় কৃতজ্ঞতার সাথেই। চৈনিক জাতির আত্মমর্যাদা বোধ দেখে হতবাক হয়ে যায় বিশ্ববাসী! আমি সশরীরে গিয়েছিলাম ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখতে। অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং হৃদয় বিদারক সেই দৃশ্য! দুটো শহরের একটিতেও কোনও অট্টালিকা দাড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলাম না। সবই মাটির সাথে মিশে গিয়ে কংক্রিটের স্তূপে পরিণত হয়েছে। যেমনটি হয়েছিলো লন্ডনের অবস্থা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জার্মান বোমারুদের আঘাতে। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। লক্ষ লক্ষ আবাল বৃদ্ধ বণিতা হয়েছে বাস্তুহারা। কিন্তু কোনও আহাজারি নেই কোথাও। সবখানেই দেখলাম PLA এর সৈনিকদের সাথে সাধারণ নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ত্রাণকার্যের সাথে সাথে পুনঃনির্মাণের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে দিনরাত। সমগ্র দুনিয়াকে স্তম্ভিত করে দিয়ে চার বছরের মধ্যেই দুটো শহরকেই অত্যাধুনিক শিল্প-বন্দর নগরীতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলো চীনা জাতি। এক অভাবনীয় বিস্ময়কর কীর্তি! দুঃখকে কি করে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হয় তারই এক বিরল নিদর্শন। সিন চাও হোটেলে থাকা অবস্থায় বিশ্বের অনেক দেশের বিপ্লবী পরিবারের সাথে আমাদের গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো। তারা সবাই ছিলেন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত গণচীন সরকারের সম্মানিত অতিথি।

১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশের বেশী সিটে জিতে সরকার গঠন করে। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী ভোটে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক জারিকৃত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি ইনডেমনিটি এ্যাক্ট হিসাবে পাশ হলে ৫ম সংশোধনীর অংশ হিসাবে সাংবিধানিক বৈধতা লাভ করে এবং সংবিধানের অংশে পরিণত হয়। এই সাংবিধানিক বৈধতা জেনারেল জিয়ার বিএনপিকে বাধ্য হয়েই দিতে হয়েছিলো। কারণ, তার রাজনীতির ভিত্তিই ছিল ১৫ই আগস্টের বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থান এবং তার ধারাবাহিকতায় ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব। রাষ্ট্রপতি এবং সংসদ নির্বাচনে খন্দকার মোশতাক এবং রশিদ-ফারুককে অংশগ্রহণের কথার বরখেলাপ করার পর ফারুক দেশে ফিরে যায় প্রকাশ্যে রাজনীতি করার লক্ষে। কিন্তু জিয়া তাকে বিনা বিচারে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করেন। এর প্রতিবাদে আমরা সবাই চাকুরিতে ইস্তফা দিয়েছিলাম। কিন্তু জেনারেল জিয়া আমাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। প্রায় দুই বছর কারাবন্দী করে রেখে তিনি ফারুককে মুক্তি দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেন। এ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেলো, জিয়া কখনোই আগস্ট এবং নভেম্বর বিপ্লবের নেতাদের দেশে ফিরে খোলাখুলি রাজনীতি করতে দেবেন না নিজের, আওয়ামীলীগ এবং ভারতের স্বার্থেই।

এই পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় দেশে জিয়া প্রচলিত পাতানো খেলার রাজনীতির বিপরীতে ‘৭১-এর চেতনা এবং স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য সেনা পরিষদের নীতি-আদর্শ এবং রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে গোপনে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের এই সিদ্ধান্তের প্রতি অভূতপূর্ব সমর্থন পাওয়া গেলো দেশের সর্বমহলের প্রকৃত দেশপ্রেমিক, ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকে। এরপর আমরা পার্টি গঠনের কাজ কি করে এগিয়ে নেয়া যায় সেই বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বের সাথে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করলাম।

নিজেদের ভুল বুঝে ক্ষমা চেয়ে রাজনৈতিক ভাবেই জিয়ার মোকাবেলা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলো রশিদ এবং ফারুক।কর্নেল ফারুক জিয়ার আমলে তার অনুমতি না নিয়ে দেশে ফেরার মাশুল হিসাবে বছর দুয়েক জেল খাটার পর রশিদ আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। সবার অনুমতি সাপেক্ষে আমি তার সাথে এক গোপন বৈঠকে বসতে রাজি হলাম। বৈঠকে রশিদ অতীতের সব তিক্ততার জন্য ক্ষমা চেয়ে বললো

লিবিয়া ছাড়ার আগে তোরা যা বলে এসেছিলি সেটাই একমাত্র বাস্তব পন্থা। জিয়ার মুখোশ উন্মোচনের অন্য কোনও বিকল্প নেই। বর্তমানে তার অপ-রাজনীতির মোকাবেলা করাও সম্ভব একমাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই, সামরিক সংঘর্ষের মাধ্যমে বর্তমানে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নয়। এটা এখন আমি আর ফারুক বুঝতে পেরেছি। এই ধরনের কোনও উদ্যোগ তোদের পক্ষেই নেয়া সম্ভব। যদি তোরা নেবার চিন্তা-ভাবনা করে থাকিস তবে আমরাও তোদের সাথে একত্রে কাজ করতে রাজি আছি।

রশিদ, তোদের স্বীকারোক্তিতে আন্তরিকতা রয়েছে ধরে নিয়েই বলবো, তোদের দেশপ্রেম সম্পর্কে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই। তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সফল আগস্ট এবং নভেম্বরের বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলাম। ভবিষ্যতে যদি আমরা কোনও রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেই তবে সেই উদ্যোগে তোদের অংশগ্রহণের সদিচ্ছাটাও প্রশংসনীয়। তোদের এই প্রস্তাবটা গ্রহণীয় কিনা সেটা সবার সাথে আলাপের পরই জানাবো। তবে এই ধরনের কোনও রাজনৈতিক উদ্যোগে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন বিভিন্ন প্রকারের সাহায্য-সহযোগিতার। বিশেষ করে প্রচুর অর্থের দরকার যেটা দেশ থেকে যোগান দেয়া সম্ভব নয়। এর যোগানের ব্যবস্থা করতে হবে বাইরের ধনী বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সহমর্মী নেতাদের কাছ থেকেই। এই বিষয়ে আমাদের জন্য মোয়াম্মর গাদ্দাফিই হতে পারেন সবচেয়ে নির্ভরশীল সাহায্যকারী এবং যোগসূত্র। আমরা জানি তোদের একার পক্ষে আর্থিক সহযোগিতা পেলেও রাজনীতি করার চেষ্টা সম্ভবত ফলপ্রসূ হবে না। সেটা ইতিমধ্যে তোরা হয়তো বুঝেও থাকতে পারিস। আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর উপযুক্ত সময়ে এই বিষয়ে পরিষ্কার বোঝাপড়ার জন্য ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে।

ঠিক আছে, ফিরে গিয়ে আমরা তোদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকবো। গাদ্দাফিকেও সেটাই জানিয়ে রাখবো। এভাবেই বৈঠক শেষে ফিরে যায় রশিদ।

কয়েক দিনের মধ্যেই ঐক্যমতের ভিত্তিতে তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে কর্নেল রশিদকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। জবাব পেলাম, ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের ব্যবস্থা শিগ্রি করার তাগিদ দিয়েছেন গাদ্দাফি। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে বৈঠকের ব্যবস্থা করা হল।ঐ বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর গাদ্দাফি সম্মত হলেন আর্থিক জোগানসহ আনুষঙ্গিক সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করতে। তাছাড়া তিনি বিভিন্ন দেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিশ্বাসযোগ্য নেতাদের সাথেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবার অঙ্গীকারও করেন। এটা ছিল একটি বিশাল সাফল্য। এরপর থেকে নিজেদের কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে আমরা ঘন ঘন বিভিন্ন জায়গাতে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে রাজনৈতিক সংগঠনের কাজকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে চললাম। জনগণের মধ্যে আমাদের নীতি-আদর্শ এবং ম্যানিফেস্টোর গ্রহণযোগ্যতা এবং ব্যাপক সমর্থনের ফলে পার্টির সাংগঠনিক কাজ এগিয়ে চলেছিল আশাতীত ভাবে। জিয়া আমাদের এই কার্যকলাপ সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানতে পারছিলেন না, তবে তিনি বুঝতে পারছিলেন তার ভুল পথে চলার জন্য সেনাবাহিনীতে তার জনপ্রিয়তা ক্রমেই কমে আসছে। জনগণের মধ্যে তার নিজস্ব ভাবমূর্তি বাড়াবার জন্য তার নিজস্ব ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কেও বিভিন্ন প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।

সেই সন্ধিক্ষণে জেনারেল জিয়া জানালেন তিনি আবার চীন সফরে আসছেন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে। এই সফরকালে তিনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং তার রাজনীতি নিয়ে আমার সাথে বিশদ আলোচনা করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। কিন্তু আমি সেই ধরনের কোনও আলোচনা করতে ইচ্ছুক ছিলাম না। তার সফরের ব্যাপারেও এবার আমি ছিলাম উদাসীন। এবারের সফর হবে ৪৮ ঘণ্টার। চীন সফরের পর তিনি যাবেন পিয়ং ইয়ং সফরে উত্তর কোরিয়ায়। তিনি ফোনে বিশেষভাবে অনুরোধ জানালেন এই সফরকালে আমি যেন তার এই দুই দেশ সফরে সার্বক্ষণিক সঙ্গী হই। জবাবে আমি তাকে জানিয়েছিলাম, সেটা আমার পক্ষে এই যাত্রায় সম্ভব হবে না। কারণ, এই সফরকালে পূর্ব আয়োজিত এক সফরে আমাকে পিকিং-এর বাইরে যেতে হবে অন্য একটি প্রদেশে। এই বিষয়ে সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত হয়ে গেছে বিধায় সেটা এখন বাতিল করার কোনও উপায় নেই। আমার জবাবে তিনি বুঝতে পারলেন আমি তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি। তাই হয়তো তিনি জানালেন এবারের সফরে তিনি আব্বাকে ডেলিগেশনের উপ-প্রধান করে নিয়ে আসছেন। সঙ্গে আন্টি এবং আমার বোনেরাও সফরসঙ্গী হয়ে আসছে যেহেতু বেগম খালেদা জিয়াকেও তিনি সাথে করে রাষ্ট্রীয় এই সফরে আসছেন। আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে তাকে জানালাম, এতে কোনও অসুবিধে হবে না। পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনা নিম্মিই কোরতে পারবে, কিন্তু আমার সফরসূচি বাতিল করাটা শোভনীয় হবে না এবং আমার অনুপস্থিতিতে তার সফরে কোনও কমতি বা ঘাটতি হবে না। তিনি চীনা নেতৃবৃন্দের কাছে সুপরিচিত। এভাবেই শেষ হয় আমাদের কথোপকথন।পরদিনই আব্বা ফোন করলেন। তিনি কিছুটা উষ্মার সাথেই বললেন

এই সফরকালে জিয়া তোর সাথে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য আমাকে সঙ্গে নিয়ে আসছেন, আর তুই তাকে জানিয়েছিস সেই সময় তোর পক্ষে বেইজিং এ থাকা সম্ভব হবে না। আমি শান্তভাবেই জবাবে আব্বাকে বললাম

হ্যাঁ, সেটাই আমি জানিয়েছি প্রেসিডেন্টকে। কারণটাও তাকে বুঝিয়ে বলেছি।

না, তোর সফরসূচি বাদ দিয়ে তার সাথে তোকে আলোচনায় বসতেই হবে। এটা আমার আদেশ হিসাবেই তোকে মেনে নিতে হবে। তিনি নিজে আমাকে বলেছেন, যে তোর সাথে তার আলোচনা করাটা নাকি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চতুর জিয়া আব্বাকে দিয়ে ফোন করিয়ে আমাকে বাধ্য করলেন যাতে আমি সফরকালে তার সাথে আলোচনায় বসি। আব্বার ফোনের পর আমার পক্ষে আর কিছুই করার ছিল না। নিরুপায় হয়ে আমার সফরসূচি বাদ দিয়ে পিকিং এই থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম তার আগমনের অপেক্ষায়। প্রয়োজন মতো জেনারেল জিয়ার সফর সংক্রান্ত বিষয়ে যাই ঘটছিলো সেটা অন্য সাথী ভাইদেরকেও জানাচ্ছিলাম। ইতিমধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্নেল শাহরিয়ার চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে জনশক্তি রফতানির ব্যবসা শুরু করেছে আবুধাবীতে একটি ট্র্যাভেল এবং রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস খুলে। মেজর হুদা তখন কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলো। সেই সময় অহেতুক বিশেষ কারণ দর্শিয়ে হুদাকে দেশে তলব করা হয়। দেশের প্রতিকূল রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে হুদা দেশে যাওয়া থেকে বিরত থাকে এবং চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে আবুধাবি হয়ে আত্মীয়ের নিকট কানাডা বেড়াতে চলে যায়।