আব্বার উপস্থিতিতে প্রথম রাতে জেনারেল জিয়ার সাথে আমার বৈঠক

জনাব তেং শিয়াও পিং এর বক্তব্য শুনে জিয়া খানিকটা চুপসে গেলেন বলেই মনে হল। কৌশলে তার সাথে আলোচনায় না বসার শেষ চেষ্টাটা কার্যকরী হল না। অগত্যা নিম্মির সাথে পরিবারের সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে আমি আর আব্বা প্রেসিডেন্টের সাথে অতিথি ভবনেই পৌঁছালাম। জেনারেল জিয়া আমাদের দুইজনকে সাথে নিয়ে গিয়ে ঢুকলেন প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটে, সাথে খালেদা জিয়া। আমাদের বসার ঘরে বসিয়ে তিনি এবং বেগম সাহেবা গেলেন পাশের বেডরুমে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ফিরে আসলেন পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে। আপনারাও টাই কোট খুলে আরামে বসুন। ঠিক সেই সময় কর্নেল অলি বীরবিক্রম কৌতূহল বশত দরজা অল্প খুলে ভেতরে উঁকি দিতেই জিয়া তার দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালেন। নিমিষে অলি দরজা বন্ধ করে কেটে পড়লো। এরপর তিনি তার ADC-কে ডেকে বললেন দুধ চায়ের ব্যবস্থা করে পাঠাতে। একই সঙ্গে নির্দেশ দিলেন, যতক্ষণ তিনি তার সাথে যোগাযোগ না করেন ততক্ষণ এখানে কাউকেই আসতে দেয়া হবে না। কন কল এলে সে যেনো মেসেজ নোট করে রাখে। নির্দেশ শুনে ADC দরজা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। একটা সোফায় আমি আর আব্বা আর আমাদের বিপরীতে একটা সিঙ্গেল সোফায় মুখোমুখি জেনারেল জিয়া বসলেন। আমি আর আব্বাও টাই-কোট আর গলার বোতাম খুলে আরামে বসলাম। আমরা তিনজন ছাড়া ঘরে আর কেউ নেই, তবে পাশের ঘরে খালেদা জিয়া আড়ি পেতে আছেন কিনা জানা নেই। শুরুতেই বেশ নাটকীয়ভাবে জিয়া উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন ডালিম, Can we forget and forgive and start afresh? A wired proposition indeed! অবান্তর আবদার। ক্ষণিক ভেবে বললাম

স্যার, রাজনীতি হচ্ছে দাবা খেলার মতো। এই খেলায় চাল দেবার আগে অবকাশ থাকে সময় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার। কিন্তু একবার চাল দেয়ার পর সেটা আর ফিরিয়ে নেয়া যায় না। যুদ্ধের সময় কোরআন শপথ করে আমরা সুস্পষ্ট নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচীর ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নকে স্বাধীন বাংলাদেশে আপোষহীন বৈপ্লবিক পদক্ষেপের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ দেবার জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। যার ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার পর সেই উদ্যোগের উপর ভিত্তি করেই আমরা গড়ে তুলেছিলাম গোপন সংগঠন সেনা পরিষদ। আপনাকে সর্বসম্মতিক্রমে মধ্যমণি হিসাবে গ্রহণ করে সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করার পর আপনি আমাদের বিস্মিত করে ভিন্ন পথে চলার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা অপাংক্তেয় হয়ে পড়লাম। এর জন্য আপনি আমাদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারবেন না কোনোক্রমেই। কারণ, এখনো আমরা সেই নীতি-আদর্শ এবং স্বপ্ন নিয়েই আপনার পছন্দসই নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছি। কর্নেল ফারুককে রাজনীতি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আপনি দেশে ফেরার পর তাকে অযৌক্তিক ভাবে জেলে পুড়লেন। এর প্রতিবাদে আমরা সবাই ইস্তফা দিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি আমাদের ইস্তফা গ্রহণ করলেন না। এরপর আপনি হঠাৎ করেই আকস্মিক ভাবে আমাদের সেনাবাহিনী থেকে চিরস্থায়ী ভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেন। এগুলো এখন ইতিহাস।

আমি আগেও আপনাকে বলেছি, আপনি ভারতের সাথে আপোষ করে বিজাতীয় শক্তিগুলোর পদলেহী জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের প্রতিভূ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে যে পথে এগুচ্ছেন সেই বিপদসংকুল পথে ক্ষমতার লড়াইয়ে দেশ এবং জনগণের কোন কল্যাণ তো হবেই না, বরং দেশ ক্রমশ সার্বিকভাবে এগুবে অরক্ষিত স্বাধীনতার দিকেই যার অপর নাম পরাধীনতা। ব্যক্তিগত ভাবে এই প্রক্রিয়াতে আপনার পরিণতিটাও হয়ে উঠতে পারে ভয়ঙ্কর। জোড়াতালি দিয়ে একটি ছিন্নবস্ত্রকে বেশীদিন পরিধান করা যায় না। তাছাড়া এককভাবে এখন পর্যন্ত আপনি যা কিছুই করেছেন সেটা যদি ইতিবাচক হয়ে থাকে তবে তার সব কৃতিত্ব একান্তভাবে আপনারই প্রাপ্য তাতে আমাদের কোনও অবদান নেই। আর যদি আপনার কৃতকর্ম নেতিবাচক হয়ে থাকে তবে তার সব দায়-দায়িত্ব শুধু আপনারই। যুক্তিসঙ্গত কারণেই এই বিষয়ে আমাদের কোনও দায়-দায়িত্ব নেবার প্রশ্ন ওঠে না। এই বাস্তবতায় সব বুঝেশুনে, অতীতের সবকিছু ভুলে গিয়ে একত্রে কাজ করার কোনও অবকাশ নেই, স্যার। আশা করি, আপনি আমার এই বক্তব্যের মর্মার্থ যথাযথ ভাবে অনুধাবন করতে পারছেন। তাছাড়া আমাদের সবশক্তি সুপরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় আমাদের মতো কয়েকজন পঙ্গুকে সাথে নিয়ে আপনার কোনও লাভ হবে সেটা আমি মনে করিনা। তারপরও আপনি এই প্রস্তাবটা দিয়ে আমাকে কিছুটা অবাক করেছেন!তাছাড়া সহযোদ্ধাদের রক্তের উপর দিয়ে হেটে আপনার পাশে অবস্থান নেয়াটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়! আমি কি বোঝাতে চাইছি সেটা আপনার পক্ষে বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। আপনি আমাদের প্রত্যেককেই খুবই ভাল করেই জানেন। আপনার অজানা নয় যে আমাদের কথা আর কাজে কোনও ফারাক নেই, সেই বিশ্বাসেই কথাগুলো বললাম। গভীর মনোযোগের সাথে গম্ভীরভাবে আমার কথাগুলো শুনছিলেন দেশের সর্বশক্তিমান কর্ণধার রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান। পুরোটা সময় তিনি ছিলেন প্রায় নিশ্চুপ এবং বাকহীন।

আমি তো অতি আন্তরিকতার সাথেই অতীতের ভুলভ্রান্তি শুধরে নেবার জন্যই আবার তোমাদের সাথে নিয়ে কাজ করার আহবান জানাচ্ছি।

আপনার এই মহানুভবতা প্রশ্নবিদ্ধ নয় স্যার, কিন্তু যেই সমস্ত ভুলভ্রান্তি আপনি করেছেন সেগুলো শুধরে নেবার জন্য এবং যাদের পরামর্শে ভুলগুলো আপনার মাধ্যমে করানো হয়েছে তাদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে ঢাল নেই তলোয়ার নেই কয়েকজন নিধিরাম সর্দার তেমন কিছুই করতে পারবে না। এর জন্য দেশের ৮-১০ কোটি জনগণের মাঝ থেকে সম্পদশালী এবং শক্তিশালীদেরই খুঁজে নিতে হবে আপনাকে। পেতে অসুবিধা হবে না। ইতিমধ্যেই পেয়েছেন অনেককেই। আরও অসংখ্য জন মধুকরের মত ভন ভন করে ঘুরপাক খাচ্ছে আপনার চারপাশে। স্যার, সাধারণ জনগণ তেমন ভাবে না জানলেও আপনি ভালভাবেই জানেন, আমরা সবাই ব্যক্তিগতভাবে সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। আমাদের বাঁচার প্রেরণা ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা সবকিছুই দেশ ও জনস্বার্থ কেন্দ্রিক।

বুঝলাম সব, তোদের মধ্যে যেকোনো কারণেই হউক না কেন, কিছুটা Trust deficit সৃষ্টি হয়েছে। সেটা দূর করার জন্য তিনি যখন আন্তরিকভাবে আবার তোদের সাহায্য চাচ্ছেন এবং আবার একত্রিত হয়ে কাজ করার আবেদন জানাচ্ছেন, সেইক্ষেত্রে তোদের পক্ষে সেই আবেদনে সাড়া দেয়া সম্ভব নয় কেনো কথাটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। অনেক বিষয়ে অজ্ঞ আব্বা হঠাৎ কথার মধ্যে তার মনোভাব কিছুটা উষ্মার সাথেই প্রকাশ করলেন। জেনারেল জিয়া নিজেই আব্বাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন

হক সাহেব, আপনি অনুগ্রহ করে ছেলে হিসাবে ডালিমের উপর কোনও কিছু চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না। He is much more matured than his age.

এরপর আব্বা চুপ হয়ে গেলেন। Well Dalim, I appreciate your straight talk to which you are used to. তবুও অনুরোধ জানাবো, অন্যদের সাথে যোগাযোগ করে আমার প্রস্তাব সম্পর্কে তোমাদের শেষ সিদ্ধান্তটা ঢাকায় এসে তুমি আমাকে জানাবে। ঢাকায় আসতে এ জন্য বললাম, যাতে সরেজমিনে আমি কি ধরনের রাজনীতি করছি সেটা পরখ করে তোমাদের সিদ্ধান্তটা জানাও। বেশ, আপনার প্রস্তাবিত অনুরোধ নিয়ে সহযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করে আলাপ করবো। তবে যোগাযোগ না করেই বলতে পারি আমি আপনাকে যা বলেছি অন্যরাও আমার বিশ্বাস তেমন ধারণাই পোষণ করে।

এভাবেই আমাদের সেই রাতের বৈঠক শেষ হল চা পর্বের সমাপ্তির পর। আব্বাকে নিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম হঠাৎ প্রেসিডেন্ট বললেন

আগামীকাল রাতে আমরা আর একবার বৈঠকে বসবো ডিনারের পর।

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় ৩ ঘণ্টা ইতিমধ্যেই কেটে গেছে। রাত অনেক হওয়ার পরও বাসায় ফিরে দেখলাম সবাই জেগে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে আমাদের ফেরার অপেক্ষায়। সারাদিনের ধকল, তার উপর এতো রাতঅব্দি মিটিং এ আব্বাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাই মিটিং সম্পর্কে সবার সব কৌতূহলের অবসান ঘটালাম ছোট্ট জবাব দিয়ে। বললাম, নাটকের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে, শেষ অংক হবে আগামীকাল রাতে। আমার এই সংক্ষিপ্ত জবাবে সবাই কিছুটা হতাশ হয়েই যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।

পরদিন সকালে দ্বিপাক্ষিক অফিসিয়াল মিটিং হল। সেই মিটিং-এ কয়েকটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হল বেসামরিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতার। এরপর প্রতিনিধি দলকে নিয়ে যাওয়া হলো ‘গ্রেট ওয়াল অফ চায়না’ এবং ‘মিং টুমস’ দেখাবার জন্য। এরপর গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির আকারের একটি ফ্যাক্টরি দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হল। রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনেই নৈশ ভোজের আয়োজন করলেন PLA Foreign Relation Bureau প্রধান জেনারেল চেন সাই চিয়েন। তিনিও একজন Long March Veteran বর্ষীয়ান এবং অভিজ্ঞ নেতা। রাত ৮ টার মধ্যেই ভোজসভা সমাপ্ত হল। ভোজের পর সবাইকে লক্ষ করে জিয়া বললেন, সারাদিনের ধকলে আজ সবাই ক্লান্ত। অতএব সবাই বিশ্রাম নিন। আব্বাকেও বললেন আজকের বৈঠকে তিনি তাকে আর কষ্ট দেবেন না। তার কথায় আব্বাকে বাসায় পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হল।