গোপনে আমেরিকা সফর

বেশ কিছুদিন বাইরে থাকার কারণে অনেক কাজ জমে গিয়েছিল। সে সব শেষ করতে কয়েক দিন বেশ ব্যস্ততায় কাটল। ইতিমধ্যে গঙ্গাভাই আমার মেহমান হয়ে কেনিয়া, তানজানিয়া, উগান্ডা, জাম্বিয়া ঘুরে গেলেন তাদের মুভমেন্টের জন্য এক সফল ফান্ড রেইজিং মিশনের পর সপরিবারে। নাইরোবিতেই গঙ্গা ভাইয়ের সাথে আমেরিকার মিশন নিয়ে প্রাথমিক আলাপের পর সিদ্ধান্ত নেয়া হল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে আমেরিকাতে যেতে হবে এই বিষয়ে বন্ধুদের সাথে বিস্তারিত আলোচনার জন্য। একদিন তানজানিয়া সফরের কথা বলে আমেরিকার পথে রওনা দিলাম। দারুসসালাম থেকে লন্ডন হয়ে আমেরিকায় যাবো। প্ল্যানটা গঙ্গাভাইকে জানিয়ে দিলাম সাথে এটাও জানিয়ে দিলাম, গোপনীয়তার স্বার্থে এবারের ভিজিট সম্পর্কে নিম্মি কিংবা লন্ডনে আমার আত্মীয়-স্বজনদেরও কিছুই জানাবো না আমি।লন্ডনে থাকবো হোটেলে। গঙ্গাভাই সব বুঝে নিয়ে বললেন, লন্ডন ছাড়ার আগে শুধু ফ্লাইট ডিটেলসটা জানিয়ে দিতে। তিনি ইতিমধ্যে জিমের সাথে প্রাথমিক আলাপ সেরে রাখবেন।

লন্ডনে কয়েকজন বিশিষ্ট বন্ধুর সাথে দেখা-সাক্ষাত করে পৌঁছালাম নিউইয়র্ক হয়ে ওয়াশিংটন-এ। গোপনীয়তার স্বার্থেইতার বাড়ীর পরিবর্তে হিলটনে এবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গঙ্গাভাই নিজেই এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে রিসিভ করেলেন এবং আমরা হোটেলে পৌঁছালাম। হোটেল স্যুইটে গঙ্গাভাই জানালেন-সন্ধ্যায় জিমকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আসবেন। আমার সাথে বিস্তারিত আলাপের পরই ঠিক করা হবে আমরা কোন পথে এগুবো। লম্বা ফ্লাইট এর ধকলে কিছুটা ক্লান্তি স্বাভাবিক। তাই আপনিও এর মধ্যে বিশ্রাম করে ফ্রেশ হয়ে নিন। চলে গেলেন গঙ্গাভাই। ওয়াশিংটন ডিসি শহরটাকে দ্বিখণ্ডিত করে বয়ে চলেছে পটোম্যাক স্রোতস্বিনী। এক পাড় ঘেঁষে ভার্জিনিয়া অন্য কিনারা ঘেঁষে মেরিল্যান্ড। গঙ্গাভাইয়ের বাড়ি ভার্জিনিয়াতে। এক শান্ত সবুজ মনোরম পরিবেশে প্রাসাদোপম এক  ট্টালিকা। বেড়াতে এলে তার বাসাতেই থাকতে হতো। সন্ধ্যার আগেই এসে পৌছালেন গঙ্গাভাই বন্ধু জিমকে সাথে নিয়ে আমার স্যুইটে। জিম হাসিমুখে আমাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে স্বাগতম জানালেন।

এক নাগাড়ে তিন দশকের বেশি সময় তিনি একজন কংগ্রেসম্যান হিসেবে তার এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। রাজনীতির সাথে জড়িত জিম ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তা, দূরদর্শী, জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞ একজন বিশেষ প্রভাবশালী ক্ষমতাধর ব্যাক্তি আমেরিকার ক্ষমতা বলয়ে। সরকার আসে যায়, কিন্তু তার প্রভাবে এতে কোনও তারতম্য ঘটে না। কারণ, নীতি নির্ধারকদের সাথে তার রয়েছে দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠতা। তাই রিপাবলিকানই হউক কিংবা ডেমোক্র্যাট সবাই তাকে বিশেষ সমীহ ও শ্রদ্ধার সাথে তোয়াজ করে চলে সেটাই দেখে এসেছি। চা-নাস্তার অর্ডার দিয়ে বসলাম তিন বন্ধু। প্রথমেই আমি জিম এবং তার মাধ্যমে অন্যান্য বন্ধুদের ব্যক্তিগত ভাবে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালাম প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত জনগণের ত্রাণ এবং পুনর্বাসনের স্বার্থে যে মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিলো তার জন্য। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অবদানের জন্য লিখিত ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, বলেই খালেদা জিয়ার সই করা আমারই লেখা চিঠিগুলো জিমের হাতে তুলে দিলাম, সাথে তিনি যে আমাকে তার বিশেষ দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন সেই চিঠিটাও। এবার বলো, ‘অপারেশন সি এঞ্জেলস’ এর ফলাফল কেমন হচ্ছে এবং বাংলাদেশী জনগণের প্রতিক্রিয়া কি?

লাখো কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করেছে 7th Fleet-এর মেরিনরা বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। দেশবাসী হতবাক হয়ে দেখছে কি অভাবনীয় সাহসিকতার সাথে জীবন বাজী রেখে তারা এক দুঃসাধ্য অপারেশন করে চলেছে জলবন্দী অসহায় মানুষকে যমদূতের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য। পুনর্বাসনের কাজ এবং একই সাথে পানিতে আটকে পড়া অসহায় মানুষদের উদ্ধারের কাজ অতি ক্ষিপ্রতার সাথে এগিয়ে চলেছে। পুরো দেশবাসী দু’হাত তুলে মার্কিন সেনাদের জন্য আল্লাহ্‌র দরবারে দোয়া করছে তাদের মঙ্গল কামনায়, এটা আমি নিজে স্বচক্ষে দেখে এসেছি। ক্ষতিগ্রস্ত আবাল বৃদ্ধ বণিতার কাছে আজ প্রতিটি সৈনিক যেন ঈশ্বর প্রেরিত ফেরেশতা। আমি তোমাকে খুশি করার জন্য একবর্ণও বাড়িয়ে বলছি না। দেশ-বিদেশের প্রচার মাধ্যমে সবকিছুই দেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশী জনগণের স্মৃতিতে এই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা চির জাগরূক হয়ে থাকবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আমেরিকার এই মানবিক সিদ্ধান্ত দেশের জনগণের মানসে যে ইতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি করেছে তার ফলে ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার ভূমিকা মানুষের মনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা অনেকটাই মুছে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, আগামীতে দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে জোরদার করতে এই মানবিক সিদ্ধান্ত অবশ্যই সুদূর প্রসারী ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে দৃঢ় ভিত্তির উপর সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি বিষয়কে আমেরিকার নীতি-নির্ধারকদের মনে রাখতে হবে।

বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আগ্রাসী ভারত, এই বাস্তবতাটা আজ প্রতিটি বাংলাদেশীকে চরমভাবে ভারত বিদ্বেষী করে তুলেছে। তাই আমেরিকার স্বার্থেই ভারতের স্বার্থ মাথায় না রেখে সরাসরি আমেরিকাকে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে শুধুমাত্র দ্বিপাক্ষিক স্বার্থকে মাথায় রেখে। এ ছাড়া আমেরিকা বাংলাদেশ সম্পর্ক টেকসই হবে না কখনোই।

জিম আমার বক্তব্য মনোযোগের সাথে শুনছিল নীরবে। গঙ্গা ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের জন্য বন্ধুদের প্রায় সবাই এখন ফান্ড রেইজিং-এ ব্যস্ত। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কথাটা আমার কাছ থেকে জেনে বলেছেন, তার তরফ থেকে সামান্য অংকের কিছু টাকা তোমাদের নির্বাচনী ফান্ড-এ দান করতে। বলে একটা এনভেলপ জিমের হাতে তুলে দিলাম। ধন্যবাদ জানিয়ে এনভেলপটা গ্রহণ করে জিম বলল টাকার অংকটা যাই হউক না কেনও সেটা বিবেচ্য নয়। আমি সবার পক্ষ থেকে তার আন্তরিকতার প্রশংসা করে এই অনুদান গ্রহণ করলাম শ্রদ্ধার সাথেই। তোমার এই কথা আমি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীকে জানাবো। এবার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়টি তোমাকে বিশদ ভাবে অবগত করতে চাই। বলো, কি বলতে চাও তুমি।

‘৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আগেই সুচিন্তিতভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছিল সোভিয়েত-ভারতের মধ্যে ‘মৈত্রী এবং শান্তি’ চুক্তি এবং পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সেই চুক্তির আদলে ২৫ বছর মেয়াদি মুজিব এবং ইন্দিরার মধ্যেও স্বাক্ষরিত হয় এক অসম ‘মৈত্রী এবং শান্তি’ চুক্তি। এর সুদূর প্রসারী উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে ভারতের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করা। এই নীলনকশা প্রণীত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়েই এবং এই দাসখত মেনে নেয় শেখ মুজিব সরকার এককভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লালসায়। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের জনসমর্থিত সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ মুজিবের তিরোধানের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত ভারতীয় নীলনকশা ভেস্তে যায়। জনপ্রিয় ১৫ই আগস্ট বিপ্লবকে পরাস্ত করার জন্য ভারতীয় অক্ষশক্তি এবং আওয়ামী-বাকশালী জোট ব্রিগেডিয়ার খালেদের মাধ্যমে ২-৩রা নভেম্বর এক প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতা ঘটায়। কিন্তু তাদের গণবিচ্ছিন্ন এই প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দেয়া হয় ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার সমন্বয়ে আর একটি সফল সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এই অভ্যুত্থানেও অগ্রণীর ভূমিকা পালন করে ১৫ই আগস্টের বিপ্লবীরাই। এই পরাজয়ের পরও চক্রান্ত থেমে থাকেনি। বাংলাদেশে ঘটে যায় কয়েকটা অশুভ উত্থান পতনের ঘটনা। এর মধ্য দিয়েই অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০-এর নির্বাচন। রুশ-ভারত চক্রের মদদ পুষ্ট তাবেদার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ছিল, তাদের মিত্র এবং ভারত সমর্থিত সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের ৮ বছর শাসনকালে পিষ্ট, নিপীড়িত, সম্বলহীন, সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বিএনপি জোটকে অতি সহজেই পরাজিত করতে পারবে। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের সেই গুড়ে বালি পড়ে। নির্বাচনে জিতে যায় খালেদার জোট। গণতান্ত্রিক প্রথা অনুযায়ী এই পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি রুশ-ভারত অক্ষশক্তি সমর্থিত আওয়ামী লীগ। তাই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পরমুহূর্তেই হাসিনা হুংকার দিয়ে বলে, খালেদার সরকারকে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না।

শুধু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেই ক্ষান্ত হয়নি হাসিনা, ইতিমধ্যেই RAW-এর পরামর্শ অনুযায়ী বহুমুখী চক্রান্তের মাধ্যমে খালেদার সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করছে বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং তার দল। সঙ্গে রয়েছে জেনারেল এরশাদ, এমনকি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকেও খালেদা বিরোধী চক্রান্তে দলে ভেড়াবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়া চাইছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় সফরে এসে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তুলতে। শুধু তাই নয়, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমেরিকা সহ ইউরোপ এবং নর্থ আমেরিকার শক্তিশালী দেশের ক্ষমতা বলয়ের অদৃশ্য ক্ষমতাধর নীতি নির্ধারকদের সাথে দুই দেশের স্বার্থে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলার।

তোমার পরামর্শেই তিনি এই সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেছেন সেটা তুমি উল্লেখ না করলেও আমি ঠিকই বুঝতে পারছি বন্ধু। প্রধানমন্ত্রী তোমার পরামর্শ গ্রহণ করে নিয়ে সঠিক পথেই এগুতে চাচ্ছেন সেটা প্রশংসনীয় এবং তার এই প্রচেষ্টা যাতে ফলপ্রসূ হয় তার জন্য তোমার বন্ধু হিসাবে আমরা তাকে আন্তরিকভাবে যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা অবশ্যই করবো। কাল সকালে গঙ্গা তোমাকে নিয়ে ক্যাপিটল হিলে আসবে। সেখানে তোমার সাথে আমাদের বৈঠক হবে। সেখানে বন্ধুদের মধ্যে জেসি, বব, হেমিলটন এবং হ্যারি থাকবে। সেখানে তোমার বক্তব্যের উপর বিস্তারিত আলোচনা হবে। তারপর তোমাকে আমাদের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে। একই সাথে সেই সিদ্ধান্ত কি করে বাস্তবায়িত করা হবে সেটাও তোমাকে বুঝিয়ে দেয়া হবে দুই-তিন দিনের মধ্যে। আমি বৈঠকের আগেই তাদের সংক্ষেপে তোমার মিশন সম্পর্কে অবগত করে রাখবো আলোচনার সুবিধার্থে। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই ইহুদী। কিন্তু তাদের মানবিক এবং চারিত্রিক গুণাবলী জানার পর তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। এ থেকেই প্রমাণিত হয় ভালমন্দ সব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই বর্তমান। ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা বিদ্বেষ আমাদের বন্ধুত্বে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করে কলুষিত করতে সক্ষম হয়নি আজঅব্দি। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের প্রতি আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হল আমার এজেন্ডা ছাড়াও। বিশেষ উৎসাহের সাথেই বন্ধুরা আমার সাথে আলোচনা করেছিলেন। আলোচনাকালে, তারা খালেদা জিয়ার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে খুশি হয়েছিলেন। আমার পরামর্শে আমেরিকা-বাংলাদেশ সম্পর্ক জোরদার করার তার সঠিক চিন্তাভাবনা ও উদ্যোগের প্রয়াসেও তারা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে জানালেন, ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালনো হবে জিমের মাধ্যমেই তাই আমার দায়িত্ব হবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে জিমকে প্রাথমিক সৌজন্য সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেয়া। এরপর থেকে তাদের প্রতিনিধি হিসাবে খালেদা জিয়ার সাথে সর্ব বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে জিম দুই পক্ষের মধ্যে। বৈঠক শেষ হওয়ার আগে জেসি বললেন, জিমই তাদের লিখিত সিদ্ধান্ত আমাকে জানিয়ে দেবে। এভাবেই শেষ হল আমাদের বৈঠক। একটি এক্সক্লুসিভ ক্লাবে দুপুরের খাওয়ার দাওয়াত করলেন জেসি বন্ধুদের তরফ থেকে আমাকে এবং গঙ্গা ভাইকে। সেখানে কয়েকজন নতুন বন্ধুর সাথেও আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো জিম। খাবার পর্ব শেষে গঙ্গাভাই আমাকে হোটেলে নামিয়ে দিতে এলেন। হোটেলে পৌঁছে দুই বন্ধু বসলাম সারাদিনের কার্যকলাপের সম্পর্কে উপসংহার টানার জন্য। গঙ্গাভাই বললেন আপনার সাবলীল, স্পষ্ট , সারগর্ভ উপস্থাপনা এবং সওয়াল-জবাব বন্ধুদের সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। তাই ধরে নেয়া যায় তাদের সিদ্ধান্ত হবে ইতিবাচক, আর আপনার সফরও হবে ফলপ্রসূ। এর একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত জেসির বক্তব্যেই রয়েছে। তিনি বলেছেন, তাদের সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে আপনাকে জানানো হবে জিমের মাধ্যমে। সিদ্ধান্ত জানাতে জিম কখন আসবে সেটা আমাকে জানালেই আমি তাকে নিয়ে আপনার কাছে চলে আসবো।

বিদায় নিয়ে চলে গেলেন গঙ্গা ভাই। এখন সব কাজ শেষে ফলাফলের অপেক্ষার পালা।

হোটেল থেকে ফোন করলাম আমার ছোট খালা খুকুকে নিউ জার্সিতে। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার ফোনে খুশি হয়ে অনুরোধ করল, ফেরার পথে তাদের ওখানে যেনো অবশ্যই হয়ে যাই। জবাবে বললাম, এবার সময়ের স্বল্পতার জন্য সম্ভব নয়। শুনে খুকু বললো, তাহলে ও নিজেই ওয়াশিংটনে আসছে দেখা করার জন্য সাপ্তাহিক ছুটিতে। বলতে বাধ্য হলাম, সেটাও সম্ভব নয় এইবার। কারণ, দুই-তিন দিনের মধ্যেই আমাকে ফিরে যেতে হবে কাজ শেষে। আমার জবাবে বেচারি বলল খুবই হতাশ করলে! তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম

পরের বার নিম্মি আর সস্তিকে সঙ্গে করে সময় হাতে নিয়ে আসবো। তখন নিশ্চয় তোমাদের ওখানে বেরাব। খুকুর সাথে কথোপকথন শেষ করে ফোন করলাম খসরু মামা (ডঃ আকবর আলি খান) কে। তিনি তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসে ইকনোমিক মিনিস্টার হিসাবে পোস্টেড ছিলেন। অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার ফোন পেয়ে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
তুমি কোথেকে? ওয়াশিংটন থেকেই বলছি মামা। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব। ব্যাপার কি? নিম্মিও এসেছে নাকি? না, এবারের সফরটা সংক্ষিপ্ত তাই অকে আনিনি, এসেছি একটা বিশেষ কাজে। তাহলে ব্যস্ত না থাকলে আমি এসে তোমাকে বাসায় নিয়ে আসতে চাই, কোথায় উঠেছো? হিলটনে। আপনাকে আসতে হবে না, আমি ট্যাক্সি করে নিজেই আসবো। আপনি ঠিকানাটা দিন। মেরিল্যান্ডে থাকেন মামা, ঠিকানাটা জেনে নিয়ে গিয়ে পৌঁছালাম তাদের বাড়ীতে। পটোম্যাক নদী পার হয়ে মেরিল্যান্ডে খসরু মামার বাসায় পৌঁছাতে বেশি সময় লাগলো না। দরজায় বেল টিপতেই মামা নিজেই হাসি মুখে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। মামী এলেন, মামা তাকে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বললেন, চলে গেলেন মামী কিচেনে। তাদের একটি মাত্র কন্যা সন্তান, ও তখনও খুবই ছোট। তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কি মামু এমন চুপিসারে ওয়াশিংটন সফরে কেনও? খালেদা কি এজেন্ডা দিয়ে পাঠালেন এবার? হেসে হাল্কাভাবে বললাম প্রধানমন্ত্রীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তো আপনারাই রয়েছেন মামা। মামা আমাকে বিশেষ ভাবে স্নেহ করতেন। তিনি শুধু কালিনারায়ণ স্কলারই নন, জ্ঞানের এক বিশাল ভাণ্ডার এবং সবার কাছেই সমাদৃত একজন নিষ্কলুষ, বিচক্ষণ এবং জাঁদরেল আমলা। স্পষ্টবাদিতা এবং সততার এক বিরল উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা একই সাথে ছিলাম। বলিষ্ঠ চরিত্রের এই ব্যক্তিটিকে দলমত নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধার সাথে সমীহ করে থাকে। বললাম 7th Fleet-এর diversion এবং উড়ির চরে ‘Operation Sea Angels’ কার্যক্রমে আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব যারা এই সিদ্ধান্ত নিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করেছিলেন, তাদের প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য গোপনে আমাকে তার বিশেষ দূত হিসাবে আসতে হল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুক্তরাষ্ট্রে তার একটা রাষ্ট্রীয় সফরের চেষ্টাও করতে অনুরোধ করেছেন বেগম সাহেবা।

মামু, কেনও এইসব রদ্দিমালের জন্য অযথা বেগার খাটছো? জিয়ার পরও তোমাদের শিক্ষা হয়নি? এখন যে সমস্ত নেতা-নেত্রী মাঠ গরম করে জমিয়ে বসেছে তাদের লক্ষ্য শুধু একটাই। সেটা হচ্ছে কে কাকে ধরাশায়ী করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করবে। দেশ এবং জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্রকে কি করে ব্যবহার করতে হয়, সে সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণাই নেই। সেই জ্ঞান অর্জনে তাদের কারও বিন্দুমাত্র আগ্রহ অথবা উৎসাহ ও নেই। এইসব স্বার্থান্বেষীদের একমাত্র উদ্দেশ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশ বেঁচে নিজেদের আখের গোছানো। ‘৭১ থেকে আমাদের লালিত স্বপ্ন এদের দ্বারা বাস্তবায়ন কিছুতেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে সম্ভব হলে কিছু টাকাকড়ির ব্যবস্থা করো, তাহলে নিজেরাই দেশটার চেহারা বদলানোর জন্য আর একটা যুদ্ধ করার চেষ্টা করে দেখি। স্বল্প কথার মানুষ। গুটিকতক বাক্যে একটা ইতিহাসের সারবস্তু বয়ান করে ফেলার মতো জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী খসরু মামা। নিঃশব্দে শুনে একসময় বিদায় নেবার প্রাক্কালে অনুরোধ জানালাম মামা, আমার এবারের সফরটা খুবই গোপনীয়। হেসে তিনি বিদায় দিয়ে বললেন নিশ্চিন্ত থাকো মামু, আমি তোমার এই গোপন সফরের নীরব একজন সাক্ষী হয়েই থাকবো। মামাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। পরদিন বিকেলেই আগমনী বার্তা জানিয়ে এসে পৌঁছালেন গঙ্গাভাই জিমকে সঙ্গে করে। দু’জনকেই বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলো। ঘরে ঢুকেই গঙ্গাভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে বললেন আপনার সফরের লক্ষ্য অর্জনে আপনি সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছেন।

জিমও একই ভাবে জড়িয়ে ধরে বললো Hearty congratulation my dear friend, your mission has achieved great success.  তাদের উচ্ছ্বাসে আমি কিছুটা হতবাক হলাম! সোফায় বসলাম তিন বন্ধু। এমব্যাসাডর হক, তোমার প্রেজেন্টেশন এবং সওয়াল-জবাব এতটাই সাবলীল এবং যুক্তিসঙ্গত ছিলো যার ফলে বিশেষ গুরুত্বের সাথে সার্বিক বিবেচনার পর তোমার দু’টি প্রস্তাবই গ্রহণযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন বন্ধুরা এবং এর আশু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই জরুরী ভিত্তিতে করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে। তবে এর চেয়েও বড় একটা সারপ্রাইজ এর উল্লেখ রয়েছে চিঠিগুলোতে যা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তোমার প্রত্যাশার বাইরে, বলেই জিম তিনটি সিলড লেফাফা আমার হাতে দিলো। একই সাথে একটা খোলা লেফাফা। ওটার মধ্যে চিঠি তিনটির কপি রয়েছে তোমার জন্য। তিনটি চিঠিই প্রধানমন্ত্রীর নামে। উপরে লেখা রয়েছে CONFIDENTIAL. চিঠি তিনটি লিখেছেন, Senate Foreign Relations Committee Chairman, Leader of the Congress এবং Senate Endowment Committee Chairman. আমি চিঠিগুলোর কপি বের করে পড়লাম। তিনটি চিঠির সারবস্তু প্রায় একই।
অতিসত্বর খালেদা জিয়ার রাষ্ট্রীয় সফরের নিমন্ত্রণ জানানোর ব্যবস্থার চেষ্টা করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা বলয়ে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ইচ্ছা পূরণের জন্য সার্বিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করা হবে। শুধু তাই নয়, সফরকালে তাকে Joint Session of the Senate and the Congress এ ভাষণ দেবার আমন্ত্রণও জানানো হবে বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকার প্রধান হিসেবে। এ ধরনের সুযোগ অতি দুর্লভ। পৃথিবীর হাতে গোণা কয়েকজন রাষ্ট্র কিংবা সরকার প্রধানই আজঅব্দি এই সুযোগ লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের কাতারে সামিল হওয়ার সৌভাগ্য শুধু খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তিকেই বিশ্বপরিসরে সমুজ্জ্বল করবে তাই নয়, এতে বাংলাদেশ ও দেশবাসী একইভাবে গৌরবান্বিত একটি দেশ ও জাতি হিসাবে সুপরিচিত হয়ে উঠবে জগৎ জুড়ে। এটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। তাই সত্যই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সম্পর্কে তিনজনই মন্তব্য করেছেন যার সারবস্তু হল, আমার মতো জ্ঞানী, দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ একজন রাষ্ট্রদূত যেকোনো দেশ, জাতি এবং সরকারের গর্ব। এই বিষয়ে আমি কিছুটা বিব্রত হয়ে জিমকে বলেছিলাম আমার সম্পর্কে মন্তব্যগুলোতে বিব্রত বোধ করছি। না লিখলেই আমি স্বস্তি বোধ করতাম। তোমার সম্পর্কে মন্তব্যগুলো কেউই পত্র লেখকদের ডিক্টেট করিনি। তারা নিজেরাই যা বুঝেছেন সেটাই লিখেছেন। তাই এতে তোমার বিব্রত হবার কোনও কারণ আমি দেখতে পাচ্ছিনা বন্ধু।

ইতিমধ্যে চা-নাস্তা পরিবেশিত হয়েছে। তাই বন্ধুদের চিঠিগুলোর জন্য জিমের মাধ্যমে তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম এবার এসো, পেট পূজাতে মনোসংযোগ করা যাক। চা-নাস্তা খাওয়ার ফাঁকে জিম জানতে চাইলো কবে ফিরে যাচ্ছি। জবাবে বললাম, সম্ভব হলে আজ রাতেই লন্ডন হয়ে তানজানিয়া। সেখান থেকে নাইরোবি। তারপর ঢাকায়।
প্রয়োজন বোধে তুমি যেকোন সময় আমাকে ফোন করতে পারো। ধন্যবাদ। এরপর কিছুক্ষণ হাল্কা আলাপ করে বিদায় নিয়ে চলে গেলো জিম।

গঙ্গাভাই হোটেল থেকেই রাতের ফ্লাইটে লন্ডন আর তার একদিন পর লন্ডন থেকে তানজানিয়ার ফ্লাইট কনফার্ম করে ফেললেন। যথাসময়ে তিনি আমাকে প্লেনে তুলে দিয়ে বিদায় নিলেন। লন্ডন পৌঁছে কারো সাথে যোগাযোগ করলাম না। হোটেলেই এক রাত কাটিয়ে পৌঁছালাম তানজানিয়া। সেখান থেকে নাইরোবি। সবাই জানলো তানজানিয়ার ট্যুর শেষে ফিরে এসেছি।