এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে খালেদা জিয়ার পাশে সেনা পরিষদ

এরশাদ বিরোধী আন্দোলন কালে আমি নাইরোবিতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে আগত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক নিয়োজিত Peace Keeping or Peace Making Mission এ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর Contingent গুলোর দেখাশোনার দায়িত্বও প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে অর্পণ করা হয়েছিলো আমার উপর। এতেকরে একদিকে সেনা সদর, সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত পদস্থ অফিসারবৃন্দ এবং অন্যদিকে আফ্রিকায় আগত সেনা সদস্যদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়। সেই সুবাদে পূর্বপরিচিত বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন সুহৃদদের কাছ থেকে দেশের চলমান রাজনীতি এবং অবস্থা সম্পর্কে সামরিক বাহিনীতে প্রকাশ্য ও গোপন প্রতিক্রিয়ার বিষয় সব খবরাখবরই আমি জানতে পারছিলাম। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যসামগ্রীর সার সংকলন থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক গভীর ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে সোভিয়েত সমর্থিত ভারত সরকার RAW-এর মাধ্যমে যাতে করে অতিসত্বর তাদের নীলনকশা বাস্তবায়িত করা যায়। গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা হারানোর আগেই কিছু একটা করতে হবে। ভেবে পাচ্ছিলাম না নির্বাসিত অবস্থায় আমাদের পক্ষে এই ক্রান্তিকালে গভীরষড়যন্ত্র এবং সংকট মোকাবেলা করা কি করে সম্ভব! সহযোদ্ধাদের সাথে আলোচনা হল।সবাই অভিমত জানালো, এই বিষয়ে যদি কিছু করার থাকে তবে আমাকেই অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, বাস্তবতা এবং দৈনন্দিন কি ঘটছে সেটা জানার সুযোগ শুধু আমারই আছে। বিষয়টি নিয়ে আমার অনেকদিনের পুরনো পরীক্ষিত ভাতৃপ্রতিম বন্ধু গোলাম রব্বানি খানের সাথে আলোচনা করবো ঠিক করলাম।

রব্বানি পেশাগতভাবে একজন ব্যাংকার। পড়াশোনাশেষে পাকিস্তান আমলেই হাবিব ব্যাঙ্কে অফিসার হিসাবে যোগদান করার মাধ্যমে তার ব্যাংকিং জীবনের সূত্রপাত। এরপর মেধা আর পরিশ্রমের ভিত্তিতেই সময়েরসাথে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বহুল পরিচিত ইন্টারন্যাশনাল ব্যাঙ্কে শীর্ষস্থানীয় এক্সিকিউটিভ হিসেবে দীর্ঘসময় কাজ করে। অবশেষে নাইরোবিতে নিজেই Export Bank Of Africa নামে একটি ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করে। তার ভিশন, কর্মদক্ষতা, পরিপক্ব অভিজ্ঞতা এবং সততার ফলে অতি অল্প সময়েই বিপুল সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান হিসাবে অতিদ্রুত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে শাখাখোলার যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয় Export Bank Of Africa. একজনবনেদী বংশের উত্তরাধিকারী, সাচ্চা ইমানদার, সৎ এবং মানবতাবাদী গরীবেরবন্ধু হিসাবে রব্বানির পরিচিতির স্বাক্ষর পাওয়া যাবে প্রতিটি দেশেই যেখানে সে কাজ করেছে। অত্যন্ত বিনয়ীঅমায়িক, নিঃস্বার্থ জনদরদী মানুষটি আমার দৃষ্টি কেড়ে নেয় এবং প্রথম দর্শনেই তাকে ভাল লেগেছিলো। সময়ের সাথে আমাদের মধ্যে সর্বকালীন নির্ভরশীল বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পেশাগতভাবে ব্যাঙ্কার হলেও জীবনদর্শন, বিশ্বরাজনীতি, ধর্ম এবং চলমান বিশ্বেরআর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, পরাশক্তিগুলোর আগ্রাসী মনোভাব ও তৎপরতা, মুসলিম জাহানের দুঃখজনক অবস্থা এবং রাজা-বাদশাহ, শেখ-আমীরদের অধঃপতন সম্পর্কে রব্বানির জ্ঞান ও বিশ্লেষণিক ক্ষমতা আমাকে বিস্মিত ও বিমোহিত করেছিলো। সারা দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং তাদের তল্পিবাহক জাতীয় কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর যাঁতাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিষ্পেষণ, জুলুম এবং বঞ্চনার বিষয়ে একই ভাবে সচেতন রব্বানি। তাই আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের বাঁধন অটুট হয়ে ওঠে দীর্ঘ সময়ের চড়াই-উৎরাই এর কষ্টিপাথরে। উপমহাদেশে বহুলভাবে পরিচিত এবং শ্রদ্ধেয় কালিয়া শরিফের সূফী পরিবারের সাথে রক্তের সম্পর্কে সম্পৃক্ত রব্বানি খান এক অতি দুর্লভ ব্যক্তিত্ব। বিশেষকরে আজকের জামানায় রব্বানি খানের মতো এক অমূল্য রতন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলোর ক্ষমতা বলয়ে তার পরিচিতির পরিধিও ব্যাপক। কিন্তু পরিচিতি এবং বন্ধুত্ব বেচে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করাকে মনে-প্রাণে রব্বানি ঘৃণা করে এসেছে বরাবর। এটাও একটা অসাধারণ গুণ। রব্বানির বাবা জাতে পাঠান ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের একজন অফিসার ছিলেন। তিনি কখনোই কোন অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। পাকিস্তানের সৃষ্টির পর তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন এবং বিভিন্ন দেশে কৃতিত্বের সাথে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেন। দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা ছিলাম একই ভাবে চিন্তিত। আঞ্চলিক রাজনীতি, অসম আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, ভারতীয় চাণক্যদের কূটকৌশল এবং দুরভিসন্ধি সম্পর্কে আমরা ছিলাম বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের শাসকগোষ্ঠীর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ করে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক এবং নির্মম আগ্রাসী আচরণের কারণে এই অঞ্চলের মুসলমানদের ভবিষ্যৎ কি হবে সেটাও আমাদের শঙ্কিত করে তুলেছিলো। এই পরিপ্রেক্ষিতে, নিজ নিজ পেশাগত দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে এই উপমহাদেশের নিপীড়িত এবং বঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুক্তি এবং ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য একত্রে আমরা অনেক কাজ করেছি নিজেদের সাধ্যানুযায়ী। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শক্তিধর দেশগুলোর আগ্রাসন, সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রাম সম্পর্কেও ভাবতাম আমরা। একদিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট এবং ষড়যন্ত্রের সব কিছু খুলে বললাম রব্বানিকে। সব শুনে রব্বানি বললো

গভীর ক্রান্তিকালে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা চলবে না ভাই। যেভাবেই হউক এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বাংলাদেশকে বাচাবার একটা পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা অবশ্যই কোরতে হবে। ফল দেবার মালিক আল্লাহ। তার উৎসাহে বেশ অনুপ্রাণিত হয়ে আমি বললাম খালেদা জিয়া এবং জেনারেল এরশাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই সর্বনাশা সংকট থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও হতে পারে। সে চেষ্টা আমি করতে পারি।

অবশ্যই সেটাই তোমাকে করতে হবে কালবিলম্ব না করে। আমি তোমার পাশে থেকে এই প্রচেষ্টায় সার্বিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।

রব্বানির সুচিন্তিত অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম খালেদার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবো।

প্রবাসী জীবনে বিভিন্ন দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী, ধনী, সমাজপতি, শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং ক্ষমতা বলয়ের অদৃশ্য অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তিবর্গের সাথে পরিচিত হবার সৌভাগ্য হয়েছে নিজ উদ্যোগে এবং বিভিন্ন সূত্রে। তাদের অনেকের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বমূলক সম্পর্কও গড়ে ওঠে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক পর্যায়ে। দেশেও এ ধরনের পরিচিতি, বন্ধুত্ব এবংঘনিষ্ঠতার পরিধি ব্যাপক। এইসমস্ত সম্পর্কের ভিত্তিই হচ্ছে পারস্পরিক আস্থা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা। রব্বানিকে বললাম

আমি বাসায় ফিরেই খালেদার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। সে আমার কথা শুনে বললো

চলো, আমিও যাবো তোমার সাথে। দেখা যাক যোগাযোগ সম্ভব হয় কিনা।

ঠিকআছে, চলো দেখা যাক কি হয়। ইতিমধ্যেই মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি নিজের পরিচয়টা গোপন রাখার জন্য ছদ্মনামেই খালেদার সাথে যোগাযোগ করবো। ঠিক হল ‘মোহাম্মদ’ নামেই খালেদার সাথে যোগাযোগ করা হবে বিভিন্ন নম্বর থেকে।তিনিও জানিয়ে দেবেন কখন তাকে কোন নম্বরে পাওয়া যাবে আলাপ করার জন্য। বাসায় ফিরে সাচোকে প্রথমে ফোন করলাম জানতে কার কাছ থেকে খালেদার অবস্থান সম্পর্কে খবরাখবর পাওয়া সম্ভব। সাচো জানিয়ে দিল একমাত্র শফিকুল গণি স্বপনআর জনাব মুস্তাফিজুর রহমান ছাড়া তার গতিবিধি আর অবস্থান সম্পর্কে দলের কাউকেই কিছু জানানো হয় না। যাদু মিয়ার ছেলে শফিকুল গণি স্বপন বয়সে ছোট হলেও বিশ্বস্ত বন্ধু। তাই কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। ফোনে যোগাযোগ করলাম স্বপনের সাথে। তাকে সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললাম

আমি জরুরী ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে চাই বিশেষ গোপনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। যদি তিনি রাজি থাকেন সেই ক্ষেত্রে তাকে আমার শর্তগুলো মেনেই আলাপ করতে হবে গোপনীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে। স্বপনকে শর্তগুলো জানিয়ে দিলাম। আমার কথা বুঝে স্বপন বললো

আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আমি আপনাকে ম্যাডামের অভিমত জানাচ্ছি। বেশ, এইনম্বরেই আমি অপেক্ষায় রইলাম। বলে রিসিভার রেখে দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে রব্বানিকে সব বুঝিয়ে বললাম। বাসা থেকে বেরুবার সময় থেকেই ফকিরের হাতে তসবিহ। আমরা একে অপরকে ‘ফকির’ বলেই সম্বোধন কোরতাম। সব শুনে রব্বানি বললো

আল্লাহ্‌ যা করবেন সেটা ভালোর জন্যই করবেন ইন শা আল্লাহ্‌। সেইদিন থেকে ‘৯১সালের নির্বাচন পর্যন্ত রব্বানি আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছে তার দেয়া কথামতো। আধা ঘণ্টা পর ফোন বেজে উঠলো। স্বপন অপর প্রান্তে। ও আমাকে জানালো

ম্যাডাম আমার সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছুক আমার সব শর্ত মেনে নিয়েই। বলেই একটা টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললো

আপনি এখনি এই নম্বরে ‘মোহাম্মদ’ নামে ফোন করন, তিনি অপেক্ষায় আছেন।

স্বপনের কাছ থেকে পাওয়া টেলিফোন নম্বর দিয়েই শুরু হল যোগাযোগ। তখনও মুঠোফোনের প্রচোলন হয়নি। প্রথমবার ডায়ালেই লাইন পাওয়া গেলো।

হ্যালো, কে কোথা থেকে বলছেন? অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল একটি পুরুষ কণ্ঠ।

আমি বিদেশ থেকে মোহাম্মদ বলছি। ও আচ্ছা ধরুন, দিচ্ছি।

আসসালামু আলাইকুম, আমি খালেদা বলছি।

ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভাবী কেমন আছেন?

সেটাতো বুঝতেই পারছেন ভাই।

ভাবী, একটি বিষয় প্রথমেই পরিষ্কার করে নিতে চাই। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মন যুগিয়ে কথা বলার অভ্যেস নেই আমার। খোলামেলা সরাসরি কথা বলতেই অভ্যস্ত আমি। সেটা মেনে নিয়ে কথা বলতে আপনি ইচ্ছুক হবেন কি হবেন না, সেটা আমার জেনে নেয়া উচিৎ।

স্বচ্ছন্দে আপনি খোলাখুলি ভাবেই আমার সাথে আলাপ করতে পারেন আপনার মতো করেই।

ধন্যবাদ। আচ্ছা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচির ঘোষণা দিলেন কোন বিবেচনায়? আপনাদের আন্দোলনের শরিক দল আওয়ামীলীগ বোধকরি এই বিষয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আগ্রহী তাই নয় কি? ভাবী, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে আজঅব্দি বিভিন্ন ভাবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামিক মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের পরিকল্পিতভাবে চতুরতার সাথে সমূলে উৎপাটন করা হচ্ছে বিভিন্ন মিথ্যা অজুহাত এবং ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নিয়ে। আপনার এই কর্মসূচীকে অজুহাত বানিয়ে এখন যারা বেঁচে আছে তাদেরও নির্মূল করা হবে সুপরিকল্পিত ভাবে। দেশবাসীর মোকাবেলায় দেশের সামরিক বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে এক আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধের সৃষ্টির পরিকল্পনা চলছে। খালেদা জিয়া কিছুটা বিব্রত হয়ে জবাব দিলেন

শরিক দলগুলোর সাথে আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমেই ঐ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

এর পরিণতিটা কি হবে সেটা সম্পর্কে আপনার আর অন্যান্য শরিকরা কি ভাবছেন সেটা আমি কি জানতে পারি?

আমাদের সবার ধারণা সারাদেশ থেকে জনতার স্রোত ঢাকায় এনে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করলে চাপের মুখে এরশাদকে রাষ্ট্রপতির পদে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা সম্ভব হবে এবং একই সাথে বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব হবে।

বিশ্লেষণটা একটি দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।

কেনো এই কথা বললেন? আপনার বিশ্লেষণটা কি ভিন্ন?

হ্যাঁ।

তাহলে বলুন, আমি শুনতে ইচ্ছুক।

বিভিন্নসূত্রে পাওয়া খবরা-খবরের ভিত্তিতেই আমার বিশ্লেষণ। আপনাদের ইচ্ছা পূরণটা এতো সহজ-সরল হবে না। শুধুমাত্র মিটিং, মিছিল আর গণ-সমাবেশের মাধ্যমে কোনও স্বৈরাশাসকের পতন ঘটানো সম্ভব হয়েছে এমন উদাহরণ মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল। বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে জেনারেল এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাংবিধানিক ভাবে একজন শক্তিধর ব্যাক্তি। সামরিক বাহিনী, পুলিশ, অন্যান্যআইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহ, গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রশাসনের উপর থেকে নিচ পর্যন্তস্থানীয় সরকারের সব পর্যায়ে তার পছন্দসই লোকজনদের বসিয়ে তাদের তিনি তার সেবাদাস করে নিয়েছেন। জেনারেল জিয়ার অকাল মৃত্যুর ঘটনা এবং এর পরবর্তী সবকিছুর পেছনে ভারতের সেবাদাস জেনারেল এরশাদ নাটের গুরু হিসাবে আওয়ামী-বাকশালীদের সাথে নিয়ে চতুর খেলা খেলে নিজেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে সমর্থ একজন জেনারেল। তিনি লোক সমাগমের চাপে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন এমনটি ভাবার কোনও অবকাশ নেই। তার হাতে এখনো তুরুপের তাসটি রয়ে গেছে। যথাসময়ে সেটা প্রয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যেই। এ সম্পর্কে আপনারা কি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?

না, একটু খোলাসা করে বলুন।

আমি বিশ্বাস করি, আপনাদের ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার কর্মসূচির সুযোগেই এরশাদ তার তুরুপের তাসটি খেলবেন।

কি ধরনের খেলা হবে সেটা একটু বুঝিয়ে বলুন ভাই।

এরশাদকে ‘ভোলা বাদশাহ’ ভাবছেন কেনো? লোকটি শৃগালের মতোই ধূর্ত এবং গিরগিটির মতই বর্ণচোরা। তিনি আপনাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত সব খবরা-খবরই রাখছেন। বঙ্গভবনে ইতিমধ্যেই একটি ‘Ops Room’ বানানো হয়েছে। স্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উপরই কিন্তু নির্ভরশীল থাকছেন না জেনারেল এরশাদ। প্রাপ্ত সব খবরাখবরগুলোকে যাচাই-বাছাই করে নিচ্ছেন RAW, KGB এবং আওয়ামী-বাকশালীদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে। এভাবেই নির্ধারিত হচ্ছে তার প্রতিটি চাল। আপনাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় লোকসমাগমের উদ্যোগকে অংকুরেই বিনষ্ট করে দেয়া হবে সারা দেশে সামরিক শাসন জারি করার মাধ্যমে। একই সাথে দেশজুড়ে শুরু করা হবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং টার্গেট কিলিং। ফলে গৃহযুদ্ধ হবে একটা বাস্তব পরিণতি।
আপনার সহযোগী হাসিনা এবং তার দল কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের টার্গেট হবে না,টার্গেট করা হবে আপনাকে এবং জনগণের মাঝ থেকে বাছাই করা পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রকৃত ভারত বিরোধী জাতীয়তাবাদী নেতা-কর্মীদের। এই প্রক্রিয়ায় যদি কোনও কারণে অবস্থা রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন বিরাজমান ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তির আওতায় এরশাদ ডেকে পাঠাবেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে। ভারতীয় হস্তক্ষেপে অতি অল্প সময়ে স্তব্ধ করে দেয়া হবে আপনাদের গণ-আন্দোলন। সাধারণ শান্তিপ্রিয় জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভারতীয় হস্তক্ষেপকে স্বাগতও জানাতে পারে হাসিনার প্রচ্ছন্ন তৎপরতায়। এরপর জেনারেল এরশাদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে ঠিক যেমনভাবে ফুরিয়ে গিয়েছিলো জেনারেল জিয়ার প্রয়োজনীয়তা হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন এবং রাজনীতিতে আওয়ামীলীগকে পুনর্বাসিত করার পর। ক্ষমতায় এরশাদের পরিবর্তে বসানো হবে হাসিনার নেতৃত্বে নব্য বাকশালী সরকার ভারতীয় নিরাপত্তায়।

তখন আপনি আপোষহীন দেশনেত্রী কি করবেন? আর একটি কালুরঘাট খুঁজে নিয়ে সেখান থেকে ঘোষণা দিবেন, ‘আমি খালেদা জিয়া বলছি……’। কথাটা বলেই হেসে উঠলাম। খালেদা একদম নিঃশচুপ! তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম ভাবী লাইনে আছেন তো?

আমি শুনছি, আপনি বলতে থাকেন। আপনাকে জ্ঞান দেবার জন্য নয়, মনে হয় ‘৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর-এর সাথে অনেকটা মিল রয়েছে বর্তমান অবস্থার। জানিনা, আপনি এর কতটুকু জানেন তাই বলছি।

১৬ই ডিসেম্বর, জেনারেল ওসমানীর পরিবর্তে চুক্তির বরখেলাপ করে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল অরোরার কাছে রেসকোর্সে পাকবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করলেন।তার সাথেই হারিয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের বীরগাথা।

প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ হুকুম জারি করে প্রবাসী সরকার তাদের রাখে বর্ডার সংলগ্ন বনে-বাদারে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের সরকার হুকুম দিলেন প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা থেকে হাতিয়ার জমা নিয়ে তাদের জানিয়ে দেয়া হউক ‘দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।’ তাই তাদের কাজও শেষ। যুদ্ধ বিজয়ের পুরস্কার হিসাবে প্রত্যেকের হাতে ৫০ ভারতীয় রুপি ধরিয়ে দিয়ে পিঠ চাপড়ে তাদের সাবাশি দিয়ে বিদায় করা হউক।

অন্যদিকে তখন সারাদেশের সর্বত্র ছেয়ে যায় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যে। ভারতীয় সেনাদের সাথে দেখা গেলো বিএলএফ এর সদস্য, অজস্র ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কাদেরিয়া বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক লীগেরমাস্তানদের মাথায় বিভিন্ন রং-বেরঙের পট্টি বাধা অস্ত্রধারীদের। এরা সবাই ছিল মুক্তিবাহিনীর বিপরীতে যুদ্ধকালেই RAW সৃষ্ট। এদেরকে প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধের শেষলগ্নে আগেভাগেই অস্ত্রসহ দেশের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো বিজয়লগ্নে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে ভারতীয় বাহিনীর দোসর হিসাবে তাদের অবাধ লুটতরাজে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য। তুলনামূলকভাবে এদের বলা চলে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক গঠিত ‘রাজাকার’, ‘আল বদর’ ও ‘আলশামস’। সারা দেশে ভারতীয় লুটেরা বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্বই হাইজ্যাক করে নিয়ে বিজয়ী বীরের বেশে ছড়িয়ে পড়েছিলো বাংলাদেশের প্রতিপ্রান্তে। দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নারী-পুরুষ তাদের ফুলের পাপড়ি বর্ষণ করে উষ্ণ স্বাগত জানিয়েছিলো। অবশ্য, অতি অল্প সময়ে তাদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হয়ে পড়ে দেশবাসীর কাছে। ধরা পড়ে যায় ভারতীয় চাণক্য এবং তাদের তাঁবেদার প্রতিষ্ঠিত সরকারের শুভঙ্করের ফাঁকি! তাই দেশবাসী তাদের নামকরণ করেছিল ‘১৬ ডিভিশন।’ বিজয়ের পর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যে ফুলের পাপড়ি না জুটলেও তারা ন্যায় আর সত্যের জন্য প্রতিবাদী হওয়ায় রাষ্ট্রীয় রোষানল, সন্ত্রাস এবং দলীয়বাহিনী সমূহের নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায়নি শেখ মুজিবের আওয়ামী-বাকশালি স্বৈরশাসনের আমলে। ভারতের পালিত কন্যা হাসিনা ও তার দলকে ক্ষমতায় বসানো হবে গণতন্ত্রের লেবাসেই। দেশ পরিণত হবেএকটি মেরুদণ্ডহীন করদ রাজ্যে আর জাতি হারাবে নিজ স্বকীয়তা, পরিণত হবে গোলামে অনির্দিষ্টকালের জন্য।স্বাধীনতার অর্থ হবে একটি জাতীয় পতাকা আর একটি জাতীয় সঙ্গীত, যার রচয়িতাও একজন ভারতীয় কবি যিনি লিখেছেন ভারতের জাতীয়সঙ্গীতও। কাকতালীয় ঘটনা বটে, তবে বিশ্বে এ ধরনের আরেকটি উপমা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইতিহাস বলে, তৃতীয় বিশ্বে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য কোনও চমক সৃষ্টি করে সেটাকে যথার্থ বলে প্রতিষ্ঠিত করা যেকোনো শাসকের পক্ষে খুবই সহজ ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে, কিন্তু সেটা চিরস্থায়ী করার কাজটি অসম্ভব। তৃতীয়বিশ্বের যারাই ক্ষমতায় যান তাদের বেশিরভাগই এই সত্যটাকে ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের কারণে ঠিক অনুধাবন করতে পারেন না। যদি কখনো বুঝতে পারেন তখন তাদের শোধরানোর সময়-সুযোগথাকে না।

উদাহরণ স্বরূপ, আপনার প্রয়াত স্বামী জেনারেল জিয়াকেই ধরে নিন। তিনি তার ভুল বুঝতে পেরে চীন সফরকালে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৫ ঘণ্টার উপর আমার সাথে খোলাখুলিভাবে আলোচনাকালে অতীতের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করে পুনরায় আমাদের সাথে একত্রিত হয়ে রাজনীতি করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন আমার প্রয়াত পিতার উপস্থিতিতে। তার সেই আহবান সম্পর্কে বিতর্কে না গিয়ে আন্তরিক ভাবেই শুধু তাকে বলেছিলাম, সেটা সার্বিক বিবেচনায় বাস্তব সম্মত নয়। কারণ, পানি তখন অনেক গড়িয়ে গিয়েছিলো। সেই সব আলোচনা এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে সবকিছুই আপনার জানা আশা করি। আমি মনে করি, জাতীয় পরিসরে ক্ষমতার রাজনীতিতে শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়রা ইতিহাস থেকে কেউই তেমন কোনও শিক্ষা নেন না। তাই প্রাকৃতিক নিয়মেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। এই প্রক্রিয়াতে আপনার কিংবা জেনারেল এরশাদের ব্যক্তিগতভাবে কি হবে সেটা বলা মুশকিল, তবে পরিণতিটা সুখকর হবে না সেটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। ব্যক্তিগত ভাবে কার কি হল সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়, অন্তত আমাদের কাছে। তবে ক্ষমতার এই আত্মঘাতী লড়াইয়ের পরিণামে দেশ ও জাতির যে চরম অপূরণীয় ক্ষতি হবে তার দায়ভার আপনাকেও অন্যদের সাথে বহন করতে হবে ইতিহাসের বিধান অতি নিষ্ঠুর! ইতিহাসের কষ্টিপাথরে প্রতিটি কার্যক্রমই ঘষে দেখা হয় সত্য উদ্ঘাটনের জন্য। এ থেকে নিষ্কৃতি পাবার কোনও উপায় নেই। তাই বলা হয় ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করে না। বলা হয়ে থাকে, ৪ঠা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতার পর আমরা সবাই নাকি দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম! সেটাই বিভিন্ন তরফ থেকে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে যদিও খালেদ ভাবী আর হুদা ভাবী আমাদের সাথেই ব্যাংকক পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বিরোধী পক্ষ এবং জোটের তরফ থেকে এই বিষয়ে নীরবতা সেই মিথ্যাচারের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন বললে সেটা কি ভুল হবে? দয়া করে মনে করবেন না আমি আপনাকে বিব্রত করার চেষ্টা করছি।

না, আমি তেমন কিছুই মনে করছি না, আমি আপনার বক্তব্য গুরুত্বের সাথেই শুনছি।

কিন্তু ভাই, স্বৈরশাসনের যাঁতাকলের নিষ্পেষণের অবসান করার অন্য কোন বিকল্প পথ আছে কি? আছে কি কোনও পথ যাতে করে স্বৈরশাসককে সরানো এবং দেশ ও জাতিকেও দুরভিসন্ধি মূলক চক্রান্তের হাত থেকে বাঁচানো যায়?

আপনি যদি ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত করেন, তাহলে জেনারেল এরশাদ যাতে কোনোক্রমেই দেশে সামরিক শাসন জারি কোরতে না পারেন এবং চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন সেই চেষ্টা আমি কোরতে পারি। তবে আমার একটা শর্ত আছে।

কি শর্ত?

সব সমঝোতা হয় দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে। তাই যদি এরশাদ পদত্যাগ করে সপরিবারে প্রবাসে চলে যেতে চান সেটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। তিনি দেশ ছাড়তে নাও চাইতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে পদত্যাগের পর অতি সহজেই তাকে জেলে পাঠানো সম্ভব হবে আপনাদের পক্ষে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে চাইবো তিনি দেশান্তরী হন, কিন্তু আমি জানি তার সিদ্ধান্তটি হবে ভারতের নির্দেশ মতো যাতে করে ভবিষ্যতে তাকে কাজে লাগানো যায়। ঠিক আছে, আমি আপনার শর্ত মেনে নিয়ে কথা দিলাম, সে যদি পদত্যাগের পর বিদেশে চলে যেতে চায় তবে তাকে সপরিবারে নিরাপদে বাইরে পাঠিয়ে দেবার রাস্তা করে দেয়ার সব দায়িত্বহবে আমার। ঠিক আছে, তাহলে আমিও আমার যা করণীয় সেটা শুরু করছি সব ঝুঁকি নিয়েই। তবে কথা দিতে হবে এই সমস্তকিছুই সীমাবদ্ধ থাকবে শুধুমাত্র আপনার আর আমার মধ্যে। অন্য কোনও তৃতীয় পক্ষ কিছুই জানতে পারবে না। এমনকি আপনার অতি নিকট আত্মীয়-স্বজন কিংবা বিশ্বাসভাজন পরামর্শদাতারাও না।

কথা দিলাম।

ঠিক আছে, তাহলে আজকের মতো রাখি। প্রয়োজন মতো আমি আবার আপনার সাথে যোগাযোগ কোরবো।

আমি আপনাকে বিশ্বাস করেই ঘেরাও কর্মসূচি সাময়িক ভাবে স্থগিত করে দিচ্ছি। আপনার কাছ থেকে আপডেটস জানার জন্য আমি অধীর আগ্রহের সাথে অপেক্ষায় থাকবো। দিনরাতের যেকোনো সময় আপনি সুবিধামতো আমার সাথে যোগাযোগ কোরতে পারেন। আমার অবস্থানের যদি কোন পরিবর্তন ঘটে তাহলে সেটা আপনাকে জানিয়ে দেয়া হবে।

ধন্যবাদ। বলে ফোন ছেড়ে দিলাম। পাশে বসা রব্বানিকে আলোচনার সার সংক্ষেপ জানিয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম দু’জনে মিলে। এরশাদের মার্শাল’ ল জারির খবরটা পেয়েছি। এখন জানতে হবে তার কৌশলটা কি হবে সেই বিষয়ে।

দু’দিনপর সেনাসদর থেকে খবর এলো ওয়্যারলেসে, আফ্রিকার একটি দেশের বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট কমান্ডারকে জরুরী ভিত্তিতে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য UN Headquarters-এঅনুরোধ জানানো হয়েছে। আরও জানতে পারলাম দেশে ফেরার পর প্রোমোশন দিয়ে তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ আর্মি চীফ নুরুদ্দিনের পরামর্শে। খবরটা ইতিবাচক। তার সাথে কুমিল্লা ব্রিগেডেএকসাথে কাজ করেছি। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে এবং পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত একজন অফিসার হওয়া সত্ত্বেও মনেপ্রাণে একজন সাচ্চা ইমানদার জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশী। মুক্তিযুদ্ধে শরিক হবার জন্য অনেক চেষ্টা করেও বেচারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালাতে পারেনি। দেশে ফিরে বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় নীলনকশা সম্পর্কে অবগত হবার পর ও ভীষণভাবে ভারত এবং আওয়ামী-বাকশালি বিরোধী হয়ে ওঠে। ফলে সে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে ওঠে। জানতে পারলাম, UN Headquarters থেকে তার Release order সে পেয়ে গেছে। কিন্তু ফিরে যাবার পর তাকে কোথায় কি পদে নিয়োগ দেয়া হবে সে সম্পর্কে তাকে কিছুই জানানো হয়নি।উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে আমিই তাকে সুখবরটা দিলাম। তাকে ফেরার পর পদোন্নতি দিয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাকে বললাম, খবরটা ঢাকাতে এখনও গোপনীয়। তাই সে যেন খবরটা কাউকে না বলে। একই সাথে বললাম, ফিরে যাবার পথে যাত্রা বিরতি কালে এবার সে হোটেলে নয়, থাকবে আমার বাড়িতে। কিছু বিশেষ আলাপ আছে। তাকে আর কিছু বলতে হল না। জবাবে সে বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে নাইরোবি পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। প্রোমোশনের খবরটা জানাতেই ও খুশি হয়ে বলে উঠলো, খবরটা জানানোর জন্য সে কৃতজ্ঞ। এসে পৌঁছালো বন্ধু। প্রথম রাতে খাবারের পাট চুকিয়ে দু’জনে বসলাম একান্তে কথাবার্তা বলার জন্য।

স্যার, বলুন দেশে কি হচ্ছে? মিডিয়াতে অনেক কিছুই বেরুচ্ছে, কিন্তু আসল ঘটনা কি?

আমি আপনাকে সবই খুলে বলবো, তবে তার পেছনে একটা প্রত্যাশা নিয়ে। আপনি একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি বলে আপনার মনের খেদ আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। কিন্তু ভাই, এই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অরক্ষিত করে রাখার চক্রান্ত চলে আসছে জন্মলগ্ন থেকেই। সেই চক্রান্তের গাঁটছড়া বেঁধেছে দেশের কায়েমী স্বার্থবাদী শাসক ও শোষক গোষ্ঠী। বাংলাদেশকে একটি করদরাজ্যে পরিণত করে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের গোলাম বানানোর সুদূর প্রসারী নীলনকশা রয়েছে ভারতীয় চাণক্যদের। এর বিরুদ্ধে আমরা লড়ে এসেছি মুক্তিযুদ্ধকাল থেকেই। ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসানোর পর জিয়া সেনা পরিষদের মধ্যমণি হয়েও বিশ্বাসঘাতকতা করায় আমাদের সুচিন্তিত অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। ভারতের সাথে আমাদের সংগঠনের মধ্যমণি জিয়া শুধুমাত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য আপোষ করে ভেবেছিলেন ভারতকে ছাড় দিয়ে বিলীন হওয়ার পথে হাসিনার নেতৃত্বেআওয়ামী-বাকশালিদের দেশের রাজনীতির মূলধারায় পুনর্বাসিত করলেই তিনি স্বচ্ছন্দে বাংলাদেশের শাসক হয়ে থাকতে পারবেন ভারতের আশির্বাদে। কিন্তু সেটা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তার সেই অভিলাষ ভুল প্রমাণিত হয়। ভারত তাদের কাজ হাসিল করে নিয়ে জিয়াকে তাদেরই আর এক দালাল জেনারেল এরশাদের মাধ্যমে ইহধাম থেকে সরিয়ে আওয়ামী-বাকশালিদের সহযোগিতায় এরশাদকেই ক্ষমতায় বসায়। তারা এরশাদের মাধ্যমে দুইটি স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিলো। প্রথমত- জিয়া এবং তার সাথে বেঁচে থাকা পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক অফিসার এবং সদস্যদের সামরিক বাহিনী থেকে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলা। দ্বিতীয়ত- আওয়ামী-বাকশালিদের সাংগঠনিক ভাবে মজবুত করে তোলা।
এই দুইটি উদ্দেশ্য তারা হাসিল করে ফেলেছে, তাই এখন তাদের এরশাদের আর প্রয়োজন নেই মুখ্য খেলোয়াড় হিসেবে। এখন তারা চায় হাসিনাকে ক্ষমতায়।বর্তমানে দেশেএরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ভারতের ইশারাতেই আওয়ামীলীগ খালেদার সাথে যুগপৎ আন্দোলন করছে। এই আন্দোলনের মাঝে একসময় খালেদাকে ধরাশায়ী করে আওয়ামীলীগকেই ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া হবে। একবার যদি আওয়ামী-বাকশালিদের আবার ক্ষমতায় বসানো সম্ভব হয় তবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বাংলাদেশ পরিণত হবে করদ রাজ্যে আর আমরা পরিণত হবো গোলামে। এই অবস্থায় সীমিত শক্তি নিয়ে আমাদের পক্ষে অগ্রণী হয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু আপনার মতো আরও যারা এখন সামরিক বাহিনী বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে রয়েছে তারা অবশ্যই এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আমরা আপনাদের সহায়ক শক্তি হিসাবে যথাসাধ্য ভূমিকা রাখারচেষ্টা করতে পারি।
স্যার, আর একটু পরিষ্কার করে বলুন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় কি? আগ্রহপ্রকাশ করলো আগত অতিথি। তার উৎসাহে আমি আরও কিছুটা অনুপ্রাণিত হলাম।

দেশের বর্তমান এরশাদ বিরোধী গণ-আন্দোলন এক বিস্ফোরক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সরকারী প্রশাসন টালমাটাল। সারাদেশ প্রায় অচল। এই অবস্থায় ভারত এরশাদকে চাপ দিচ্ছে দেশে মার্শাল’ ল জারি করার জন্য। কারণ, এই অবস্থায় দেশে মার্শাল’ ল জারি করলে যে অবস্থা সৃষ্টি হবে সেটা সরকারের পক্ষে সামাল দেয়া কিছুতেই সম্ভব হবেনা। তখন বেসামাল এরশাদ চাপিয়ে দেয়া গৃহযুদ্ধের দাবানল থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে ‘২৫ বছরের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির’ আওতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের জন্য আমন্ত্রণ জানাবে। সেই সুযোগে চাণক্যরা অতি সহজেই ত্রাণকর্তা হিসাবে দেশে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে তাদের পছন্দসই হাসিনার নেত্রীত্বে নব্য বাকশালি সরকারকে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত কোরে তাদের হারানো স্বর্গ ফিরে পাবে। গণ-আন্দোলন যাবে বানের জলে ভেসে। এইঘৃণ্য চক্রান্ত কি মেনে নেয়া যায়?

অবশ্যই নয় স্যার, কিন্তু আমরা কি করে এই চক্রান্তের মোকাবেলা করতে পারি?

সেটা পরের কথা। প্রথমে ঠিক করতে হবে এই হীন চক্রান্তের অন্ধকার থেকে দেশ ওদেশবাসীকে বাঁচানোর জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে একে অপরকে বিশ্বাস করে একাত্মভাবে কাজ করতে রাজি আছি কিনা।

আমি আপনাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে সম্মতি জানালাম। আপনি আমার উপর আস্থা রাখতে পারেন, স্যার। আপনাদের খুবই কাছ থেকে দেখার এবং বোঝার সুযোগ আমার হয়েছে। আপনারা সবাই পরীক্ষিত, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে আপনারা। মানুষ আজকের দুনিয়ায় দেশ ও জাতির স্বার্থে এতোটাও নিঃস্বার্থ হতে পারে সেটা অনুধাবন করে আপনাদের ভীষণভাবে শ্রদ্ধা করে এসেছি যদিও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর সুযোগ পাইনি। আমি নিশ্চিত এই সংকটের মোকাবেলা করার জন্য আপনি আপনার সাথীদের সাথে নিয়ে নিশ্চয়ই কোনও পরিকল্পনা করছেন, অতীতের সংকটগুলোর মোকাবেলা করার মতোই। আমাকে বিশ্বাস করে যদি কোনও বিশেষ দায়িত্ব দেন তবে সেটা পূরণ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করবো পরিণতি যাই হউক না কেন ইন শা আল্লাহ।

আমাদের কাজ হল চেষ্টা করা, প্রতিফল দেবার মালিক আল্লাহ্‌। আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, যাদের প্ররোচনায় জেনারেল এরশাদ দেশে মার্শাল’ল জারি করতে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেআর্মি চীফ জেনারেল নুরুদ্দিন,জেনারেল মচ্ছু সালাম, জেনারেল মাহমুদুল হাসান, জেনারেল মীর শওকত, ব্রিগেডিয়ার মাহমুদ, ব্রিগেডিয়ার রফিক, ব্রিগেডিয়ার ওয়াহিদ, ব্রিগেডিয়ার নাসিম, ব্রিগেডিয়ার আশরাফ, ব্রিগেডিয়ার নাসের, ব্রিগেডিয়ার আ ম সা আমিন। তবে বেশিরভাগ সেনা অফিসার এবং সৈনিকরা এই পদপক্ষেপকে আত্মঘাতী মনে করে সমর্থন করছে না। বিশেষ করে ইউনিট কমান্ডারদের পর্যায়ে। কিন্তু সাহসী নেতৃত্বের অভাবে তারা সোচ্চার হতে পারছে না। ক্যারিয়ারের কথা ভেবেও অনেকে সবকিছু বুঝেও প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করতে পারছে না। আমার জানামতে, ইউনিট কমান্ডারদের লেভেল থেকে নিচ পর্যায়ের ৯০% মার্শাল’ ল-এর বিরুদ্ধে। ধিক্কৃত চরিত্রহীন রাষ্ট্রপতির তার বিদেশী প্রভু ভারতের স্বার্থে দেশের জনগণের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানোর জন্য দেশের সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করার ঘোর বিরোধী তারা। আমার খবরের সত্যতা যাচাই করা আপনার জন্য কষ্টসাধ্য হবে না। গুরুত্বপূর্ণ পদে নবনিযুক্ত অফিসার হিসাবে ইউনিট কমান্ডারদের সাথে পরিচিত হবার জন্য একটিকনফারেন্স ডাকলেই আপনি তাদের মনোভাব সরেজমিনে জানতে পারবেন। সেই কনফারেন্সেই আপনি বুঝতে পারবেন আমার বক্তব্যের সত্যতা এবং বাস্তব অবস্থা। প্রথা অনুযায়ী দেশে মার্শাল’ ল ঘোষণার আদেশ সেনাসদরে পৌঁছার পর এক ঝটিকা অভিযানের মাধ্যমে আপনি প্রেসিডেন্ট এরশাদ, তার বিশ্বাসভাজনদের গৃহবন্দী করে বাইরের সাথে তাদের যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে দেবেন। তারা যাতে একে অপরের সাথে কোনও প্রকার যোগাযোগ করতে না পারে সেই ব্যবস্থাও আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে। এরপর থেকে আপনিই হবেন ডিফ্যাক্টো চীফ। গৃহবন্দী এরশাদের সাথে শুধুমাত্র ‘মোহাম্মাদ’ নামের ব্যাক্তিরই যোগাযোগের পথ খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে আপনাকে। খালেদা জিয়ার সাথে আমার যোগাযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে লুকিয়ে থাকা ভেড়ার ছালে আবৃত ধূর্ত ভারতীয় পোষা শৃগালগুলোর একটা লিস্টও আপনাকে দেয়া হবে। ওদেরকেও বন্দী করে ফেলতে হবে ত্বরিতগতিতে কোন প্রতিক্রিয়ার সময় না দিয়ে। কার বিরুদ্ধে কোন চার্জ আনা হবে সেসব নির্ভরযোগ্য তথ্যও আপনি পেয়ে যাবেন। আপনার এই পদক্ষেপের প্রতি পূর্ণ রাজনৈতিক সমর্থন নিশ্চিত করবেন বেগম খালেদা জিয়া চলমান গণআন্দোলনের মুখ্য নেত্রী হিসাবে। আপনাকে সেনাবাহিনীতে সার্বিক ভাবে সমর্থন দেবে সেনা পরিষদ এবং অন্য সব দেশপ্রেমিক অফিসার আর সেনাসদস্যরা। এরপর আমি এরশাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে দুই নেত্রী খালেদা এবং হাসিনার বিরুদ্ধে জারীকৃত হুলিয়া উঠিয়ে নেবো। এরশাদকে বাধ্য কোরবো পদত্যাগ করে ক্ষমতা চীফ জাস্টিসের কাছে হস্তান্তর করে নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিতে। এরপর জেনারেল এরশাদ যদি সপরিবারে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান তবে তাকে যেতে দেয়া হবে এই বিষয়ে খালেদা জিয়ার সাথে আমার ইতিমধ্যেই বোঝাপড়া হয়ে গেছে। আমার অনুরোধে তিনি ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচিও সাময়িকভাবে স্থগিত করতে রাজি হয়েছেন। বিষয়গুলো খুবই স্পর্শকাতর। তাই এইসবের গোপনীয়তা সতর্কতার সাথে রক্ষা করতে হবে ভাই। সেনাবাহিনীর ভেতরে কি ঘটবে সেই সম্পর্কে কিছুই খালেদাকে জানাইনি গোপনীয়তার স্বার্থেই।

কিন্তু স্যার, আপনি কিন্তু চীফ সম্পর্কে কিছুই বললেন না। তার অধীনস্থ হয়ে আমার পক্ষে দায়িত্বগুলো পালন করা কি সম্ভব হবে, যেখানে জেনারেল নুরুদ্দিন জেনারেল এরশাদের বিশ্বস্তদের একজন?

সম্ভব হবে, জেনারেল নুরুদ্দিনকে চীফ হিসাবে রেখেই।

কারণ, জেনারেল নুরুদ্দিন একজন উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি কিন্তু অন্তরে খুবই ভীরু। জেনারেল জিয়া হত্যার চক্রান্তের শেষ পর্যায়ে তিনি তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য হাসিনার সাথে দেখা করে তার আনুগত্য জানিয়ে এসেছিলেন। সেই সময় হাসিনা তাকে জেনারেল এরশাদের কথামতো চলার পরামর্শ দেয়। যার ফলে জিয়া হত্যা, মঞ্জুর হত্যা ও মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ফাঁসির ঘটনাগুলোতে তার একটা মুখ্য ভূমিকা থাকে জেনারেল এরশাদের নির্দেশে।

কিন্তু ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের পর হাসিনার আওয়ামীলীগ এবং জামায়াত যখন এরশাদকে বর্জন করে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে পুনরায় এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়, তখন থেকেই নুরুদ্দিন জেনারেল এরশাদের দিন শেষ হয়ে আসছে সেটা বুঝতে পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে। তিনি এখন বাঁচার অবলম্বন খুঁজছেন। এই দুর্বলতাটাই আপনাকে কাজে লাগাতে হবে। আপনি তাকে বোঝাবেন, আপনার কথা মতো চললে ভবিষ্যতে তার কোনও ক্ষতি হবে না। সে তখন আপনাকেই বাঁচার অবলম্বন হিসাবে গ্রহণ করে নেবে নিরুপায় হয়ে। সেই অবস্থায় তাকে সামনে রেখেই আপনি সবকিছুই করতে পারবেন। এতে আপনাকে কোন কিছুর জন্য অভিযুক্ত করাও সম্ভব হবে না। একই ভাবে, সব কিছুর মূলে থেকেও আপনি থাকবেন নিরাপদ। এভাবেই, সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। একজন বীর দেশপ্রেমিক হয়েও আপনি থেকে যাবেন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান, তাই এই খেলায় আপনার ভূমিকা পালন করতে বেগ পেতে হবে না, সে বিশ্বাস আমার আছে। বৃহত্তর স্বার্থে এই দায়িত্ব যদি সফলভাবে পালন করতে পারেন তবে ইতিহাসে আপনার অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাছাড়া পরকালে শেষ বিচারের দিনে একজন সাচ্চা ইমানদার হিসেবে আপনাকে পুরস্কৃত কোরবেন মহান আল্লাহ। কঠিন দায়িত্ব বটে, তবে অসম্ভব নয়। জুলুমকারীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় এবং শান্তিকামীদের উপরই আল্লাহ্‌র রহমত নাজেল হয়। সময় নিয়ে ধীরস্থির ভাবে ভেবেচিন্তে যাবার আগে আমাকে স্পষ্ট করে জবাব দিয়ে যাবেন, আপনার দায়িত্ব আপনি পালন করতে রাজি আছেন কি না। যাবার আগে দৃঢ়চেতা দেশপ্রেমিক বীর শপথ নিলো

তার দায়িত্ব সে পালন করবে।

খুবি খুশি হলাম। আপনার সম্পর্কে আমরা যা ভেবে এসেছি আপনি আজ নিজেকে তার চেয়েও অনেক বড় বলে প্রমাণিত করলেন! তবে খুবই সতর্কতার সাথে চলতে হবে আপনাকে। বিচক্ষণতার সাথেই নিতে হবে প্রতিটি পদক্ষেপ।

চলে গেলো দেশপ্রেমিক অফিসার। দেশে ফেরার সাথে সাথেই তাকে পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হল। নিজ দায়িত্ব গ্রহণ করার পরই জানতে পারলাম নতুন দায়িত্ব পাবার পর আমার কথার সাথে বাস্তব পরিস্থিতির মিল পেয়ে সে তার কাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে দ্রুত। জেনারেল নুরুদ্দিনকেও সহজেই তার আয়ত্তে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে সমমনা দেশপ্রেমিক। প্রেসিডেন্ট নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। দিনরাত তার অনুগত সেনাপ্রধানসহ বিশ্বাসভাজনদের নিয়ে বঙ্গভবনে এবং কমান্ডার ইন চীফ এর দফতরে লাগাতার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসে মার্শাল’ল জারি করার ব্লু প্রিন্ট প্রণয়ন করছেন। চীফ সেনাসদরে খুব কমই আসছেন। সেই ফাঁকে বন্ধু তার করণীয় সবকিছুই করে নিচ্ছে। ইতিমধ্যেই ফর্মেশন ও ইউনিট কমান্ডারদের মিটিং সেরে এবং প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে ভিজিট করে সরেজমিনে অফিসার আর সৈনিকদের প্রতিক্রিয়া ও মনোভাব জেনে নিয়েছে সে। অতি উত্তম! জানতে পারলাম, দেশের সব কয়টি ক্যান্টনমেন্টেই সেনাসদস্যরা দেশে মার্শাল’ল জারি করার বিপক্ষে সেটাও ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছেন বন্ধু। সামরিকবাহিনীর সদস্যরা একজন গণধিক্কৃত স্বৈরশাসক রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণের বিপক্ষে দাড়াতে চায় না। তারা মনে করে, সামরিক বাহিনীর জন্য জেনারেল এরশাদ এখন একটা গলগ্রহ ভারতীয় দালাল ছাড়া আর কিছুই নয়। এইসব খবর পাবার পর আমি নিশ্চিত হলাম আমাদের পরিকল্পনা সফল হবে। বাস্তব পরিস্থিতি বন্ধুর আত্মবিশ্বাসকেও বাড়িয়ে তুলেছে খবর পেলাম।

এখন খালেদাকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে তিনি যেকোনো দিন ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দেবেন। এই কথাটা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে তার মিত্র হাসিনার প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা না করেই, তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে নয়। এই ধরনের দেশব্যাপী বহুল প্রচারিত হুমকিতে প্রেসিডেন্ট বিচলিত হয়ে মার্শাল’ল জারির ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেবেন আর সেটা কার্যকরী করার জন্য ট্রুপস ডেপ্লয়মেন্ট-এর হুকুম জারি করবেন চীফ। ঠিক সেই সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী বন্ধু তার দায়িত্ব পালন শুরু করবেন। এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা পর্যন্ত তাকেই সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে ডিফ্যাক্টো চীফ হিসাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর না করছে, AHQ থেকে ISPR-এর মাধ্যমে কোন বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হবে না। মিডিয়ার সাথেও কোনও রকম যোগাযোগ রাখা হবে না। People should be absolutely in dark about the whole episode so that no one can react. He should also not meet any diplomat at any level. আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হবে। লিস্ট অনুযায়ী আওয়ামীলীগেরঃ সাজেদাচৌধুরী, নাসিম, শেখ সেলিম, আমির হোসেন আমু, জিল্লুর রাহমান, হানিফ, আইভিরাহমান, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, ডঃ কামাল হোসেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, গাজি গোলাম দস্তগির, মায়া, শামিম ওসমান, ডঃ ইকবাল, মিজানুর রহমান চৌধুরী, জয়নাল হাজারি, চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন। জাতীয় পার্টিরঃ এরশাদের ভাই কাদের, রুহুল আমিন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান, ডঃ মোশররফ হোসেন, কাজি জাফর, ব্যারিস্টার মওদুদ, আনিসুর রহমান। বিএনপিরঃ ব্রিগেডিয়ারহান্নান শাহ, বি চৌধুরী, ওবায়দুর রহমান, আব্দুল মন্নান, ব্যেরিস্টার নাজমুল হুদা, জমিরুদ্দিন সরকার, খন্দকার মোশাররফ, জেনারেল ভূঁইয়া এদের সবাইকে নিজ নিজ বাড়ীতে নজরবন্দী করা হবে। মিডিয়া, কূটনৈতিক পাড়ার কারো সাথে কিংবা পার্টির কোনও নেতা-কর্মীদের সাথে তাদের যোগাযোগ করতে দেয়া হবে না। তাদের সবার টেলিফোন লাইন কেটে দেয়া হবে। বর্ডারের উপর BDR কে বর্ডারে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের হুকুম জারি করা হবে। বিশেষ করে কাদের সিদ্দিকিকে বিশেষ নজরদারিতে রাখা হবে। এইসব এ্যাকশন শেষ হলে আমি এরশাদের সাথে যোগাযোগ করে আলোচনার মাধ্যমে নেত্রীদ্বয়-এর বিরুদ্ধে জারীকৃত হুলিয়া উঠিয়ে নেবার নির্দেশ আদায় করে নেবো এবং তাকে পদত্যাগে বাধ্য করবো। এরশাদের সাথে যোগাযোগ কালে খালেদা জিয়ার সাথেও আমাকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হবে। সতর্কতার সাথে সবকিছুর পেছনে বন্ধুই যে প্রধান ক্রিয়ানক সেটা গোপন রাখা হবে যাতে একজন নির্লোভ দেশপ্রেমিক হিসাবে তার জীবন এবং ক্যারিয়ারের কন ক্ষতি না হয়। তার দেশপ্রেম সাহসিকতার ফলেই দেশ ও জাতিকে বর্তমান চক্রান্তের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হব আমরা ইন শাহ আল্লাহ্‌। আবেগে আমি আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। এতো প্রলয় ঘটে যাবার পরও আমাদের হাতে গড়া সেনাবাহিনীতে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী তথা ‘৭১-এর দেশপ্রেম এখনও সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ হয়ে যায়নি আল্লাহ্‌র অসীম করুণায়। আমার নিরন্তর ছায়াসঙ্গী রব্বানি খান নীরবে সব কিছুই দেখছে আর শুনে বোঝার চেষ্টা করছে অবাক বিস্ময়ে! খালেদা জিয়ার সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানালাম

ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচি আপনি যেকোনো দিন দিতে পারেন এই কথাটা দেশের প্রতিপ্রান্তে ছড়িয়ে দিতে হবে তবে আনুষ্ঠানিকভাবে নয়। এই ধরনের প্রচারণা আপনার শরিক দলআওয়ামীলীগ পছন্দ না করলেও আপনি আপনার কাজ এমন ভাবে করবেন যাতে প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদ শঙ্কিত এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মার্শাল’ল জারি করার ত্বরিত উদ্যোগ গ্রহণ করেন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। আমার এই প্রস্তাবে খালেদা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন বলে মনে হল।

কেনো এমনটি করতে বলছেন, সেটা আমি কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না?

এই কেনো-র উত্তরটা পরবর্তী ঘটনাবলী থেকেই পেয়ে যাবেন। এই মুহূর্তে বিস্তারিত আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব না। Need to know basis-এ কিছুদিন আমাদের কথাবার্তা সীমিত রাখতে হবে। তবে এতটুকু বলতে পারি, ঘটনা যাই ঘটুক সেটা আপনাদের এবং দেশ ও জাতীয় স্বার্থেই ঘটবে ইন শা আল্লাহ! সাপ ও মরবে, লাঠিও ভাঙ্গবে না।

ঠিক আছে, আপনার কথা মেনে নিয়ে আমি সব ব্যবস্থা করছি।

ধন্যবাদ। ফোন রেখে দিলাম। এরপর থেকে সব কিছুই ঘটছিলো অতি দ্রুত লয়ে। পর্দার অন্তরালে সব কিছুর চূড়ান্ত ব্যবস্থা করে ফেলা হয়েছে। ঘেরাও কর্মসূচির খবরটা নেতা-কর্মীরা ছড়িয়ে দিলো। সারাদেশে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হল। সাজসাজ রবে মুখরিত হয়ে উঠলো সচেতন জনতা। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে খবরটা ছাপা হল। দেশ জুড়ে এই ঘেরাও কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থন লক্ষ করে শঙ্কিত হয়ে দেশে মার্শাল’ল জারি করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন জনধিক্কৃত স্বৈরশাসক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা ধরে রাখার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে। সশস্ত্র বাহিনী প্রধান হিসেবে জেনারেল এরশাদ তিন বাহিনী প্রধানকে ডেকে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিলেন। দেশের সামরিক বাহিনী এবং অন্যরা সম্মিলিত ভাবে এই আদেশ কার্যকরী করলেও এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে সেনাবাহিনী। সেনাসদরে ফিরে আর্মি চীফ নুরুদ্দিন সংশ্লিষ্ট জনকে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত জানিয়ে নির্দেশ দিলেন পরিকল্পনা অনুযায়ী ট্রুপ্স ডেপ্লয়মেন্টের ব্যবস্থা করতে। নির্দেশ অনুযায়ী ট্রুপ্স ডেপ্লয় করা হল বটে, তবে সেটা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচি রোধ করার জন্য নয়, দেশের রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ এবং তার অনুগত তাঁবেদারদের গৃহবন্দী করার জন্য। একই সাথে লিস্ট অনুযায়ী সবাইকে গৃহবন্দী এবং নজরবন্দী করা হল ত্বরিত গতিতে। হতভম্ব প্রেসিডেন্ট আর্মি চীফকে যখন জিজ্ঞেস করলেন

এ সবের মানে কি? তখন জেনারেল নুরুদ্দিন প্রেসিডেন্টকে বিনীত ভাবে জানালেন

একজন Loyal officer হিসাবে প্রেসিডেন্ট সহ তার নিকটস্থ আস্থাভাজনদের বাঁচানো এবং তাদের নিরাপত্তার জন্যই তাদেরকে Protective Custody-তে নেয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না। কারণ, দেশে মার্শাল’ল জারি করার হুকুম তামিল করতে গেলে সমগ্র সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহের বিস্ফোরণ ঘটে যেতো, আর দেশে জুড়ে জ্বলে উঠতো দাবানল। দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর অফিসার এবং সেনারা মার্শাল’ল এর বিপক্ষে। শুধু তাই নয়, তারা একজন গণধিকৃত রাষ্ট্রপতির জন্য জনগণের বিরুদ্ধেহাতিয়ার হাতে দাড়াতে সম্মত নয়। সবারই ধারণা, জেনারেল এরশাদ বর্তমানে সামরিক বাহিনীর জন্য একটি গলগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নন। ব্যাক্তির চেয়ে দেশ বড়, তাই রাষ্ট্রপতির উচিৎ হবে দেশে আগুন না জ্বালিয়ে জনগণের দাবি মেনে নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে কালবিলম্ব না করে পদত্যাগ করা। তা না হলে, সামরিক বাহিনী সহ সারা দেশে যে বিস্ফোরণ ঘটবে তাতে আমরা সবাই জ্বলে ছাই হয়ে যাবো। ক্ষমতা থেকে স্যার, আপনাকে সরে দাড়াতেই হবে।

অতর্কিত এবং অভাবনীয় এই ঘটনায় বিস্মিত হয়ে গেলো দেশবাসী। বন্ধ করে দেয়া হল ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচি। কিছুটা স্বস্তির সাথেই দেশবাসী প্রতীক্ষা করতে থাকল আগামীতে ইতিবাচক কিছু ঘটার প্রত্যাশায়। খালেদা জিয়াও বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন এমন অপ্রত্যাশিত অভাবনীয় ঘটনায়! তিনি ফোন করলেন আমাকে

এটা কি করে সম্ভব হল?

হয়েছে পরিকল্পনা অনুযায়ী। এখন আপনার দায়িত্ব হচ্ছে দেশে যাতে আইন-শৃঙ্খলাপরিস্থিতির অবনতি না ঘটে এবং দেশে জনগণের স্বাভাবিক জীবন যাতে বিঘ্নিত কিংবা বিপর্যস্ত না হয় সেটা নিশ্চিত করা। এখান থেকে এরশাদের সাথে আলোচনা করায় কিছু অসুবিধে আছে তাই আমি গোপনে লন্ডন যাচ্ছি কয়েকদিনের মধ্যেই। পৌঁছানোর পরই প্রথমে আপনাদের দু’জনের বিরুদ্ধে জারিকৃত হুলিয়া উঠিয়ে নেয়ার আদেশ জারি করতে বাধ্য করবো বন্দী প্রেসিডেন্ট এরশাদকে। এতে করে আপনি এবং দলের শীর্ষনেতারা খোলাখুলিভাবে গণসংযোগ স্থাপন করে অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবেন। এরপর শুরু হবে পদত্যাগের আলোচনা। আপনার সাথে এবং সেনাবাহিনীর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা কোরেই আলোচনা করবো আমি। অগ্রগতি এবং ফলাফলও আপনি জানতে পারবেন। রাখি আজকের মতো, কিছু জরুরী কাজ শেষ করে নিতে হবে সফরের প্রস্তুতি হিসাবে। আল্লাহ্‌ হাফেজ।

ঝটিকা এ্যাকশনের পর আমাকে ফোন করলো শফিকুল গণি স্বপন বেশ কিছুটা উৎকন্ঠার সাথেই। আকস্মিকভাবে এ ধরনের একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা যে ঘটতে পারে সে সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না তার।

ডালিম ভাই, আপনি কি কিছু জানেন কিকোরে কাদের দ্বারা এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হল?

আমার পক্ষে কি করে জানা সম্ভব ভাই? আমিতো তোমাকেই ফোন করবো ভাবছিলাম।তুমি প্রখ্যাত সাংবাদিক, তদুপরি জাদু মিয়ার ছেলে হিসাবে বিএনপির একজন প্রতিষ্ঠিত নেতা হওয়া ছাড়াও জেনারেল এরশাদের সাথেও তোমার আত্মীয়তা আছে। সেইক্ষেত্রে তোমার চেয়ে এই বিষয় আর কে বেশি কিছু জানতে পারে?

একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো স্বপন।

খালেদা জিয়ার সাথেও তো তোমার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। আমি তো আশা করেছিলাম তোমার কাছ থেকেই আসল খবরটা জানতে পারবো। নিউইয়র্ক-এর মিশনে অবস্থিত মহিউদ্দিন ভাই এবং মুক্তি আপি, তারাও কি কিছুই বলতে পারছেন না?

দেশে-বিদেশে কেউ কিছুই জানে না, সবাই অন্ধকারে। তবে আমার একটা অনুরোধ, যদি সম্ভব হয় তাহলে দেখবেন শারীরিক ভাবে তাদের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়। মহিউদ্দিনভাই, মুক্তি, বাবু, নেলি নিউইয়র্ক এবং লন্ডন থেকে ফোন করছে ঘন ঘন। ওরা সবাই ভয় এবং আতঙ্কে ভেঙ্গে পড়েছে। আপনাকেও তারা ফোন করতে পারে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী আপনাদের হাতে গড়া। তাই এই অনুরোধ, কিছু মনে করলেন নাতো?

মনে করার কিছুই নেই। তবে কি জানো স্বপন, আমাদের গড়া সামরিক বাহিনীর চরিত্র হনন করা হয়েছে অনেকাংশেই। বদলে ফেলা হয়েছে নৈতিকতা, নীতি-আদর্শ। তবুও আমি দেখবো, যদি আমার পক্ষে কিছু করার কোনও অবকাশ থাকে।

স্বপনের সাথে কথা বলার পরই লন্ডন থেকে বাবু আর নেলি ফোন করলো। বাবু মহিউদ্দিনের ছোট ভাই। আমি যখন হংকং এ ছিলাম তখন বাবুও হংকং এ BCCI Bank-এ চাকরি করতো। সেই সুবাদে পরিচয়। বাবু আর নেলিকে প্রথম দেখাতেই আমাদের ভালো লেগেছিল। খুবই সহজ সরল আর প্রাণখোলা দু’জনেই। প্রেসিডেন্টের সাথে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা থাকলেও এই দম্পতির মধ্যে কোনও দম্ভ ছিল না। সব ব্যাপারেই তারা আমাদের পরামর্শ নিয়ে চলতো। বাবু আর নেলির কাছে আমি ও নিম্মি দুজনেই বিশেষ ভাবে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলাম। মন থেকে দু’জনই আমাদের ভালোবাসতো। পাকিস্তান আমল থেকেই ডেইজি ভাবী, মানে বেগম এরশাদকে জেনে এসেছি। Young Officer-দের প্রতি তিনি সর্বদা ছিলেন স্নেহবৎসল। মেজর এরশাদ হাসিখুশি সৌখীন মানুষ হলেও Three Ws (Wealth Women Wine)-এর প্রতি তিনি বরাবরই ছিলেন আসক্ত।

আমি যখন গণচীনে তখন ডেইজি ভাবী প্রায় তিন মাসের উপর সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন আমি আর নিম্মিই তার দেখাশোনা করতাম। সেই সময় তার একান্ত সান্নিধ্যেআসার সুযোগ হয়েছিলো আমাদের। তাই তাকে আরও ভালো লেগেছিলো। তিনিও আমাকে আরনিম্মিকে আন্তরিকভাবেই ভালোবেসেছিলেন। বাবু আর নেলি ফোনে অনেক কান্নাকাটি করে মিনতি জানালো যাতে আমি সেনাবাহিনীতে পরিচিত জনদের সাথে কথা বলে কোনক্রমে জেনারেল এরশাদ আর অসুস্থ ডেইজি ভাবীকে দেশ থেকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। আমি আর নিম্মি দুইজনেই তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, সাধ্যমত সব কিছুই করবো। প্রয়োজনে তাদের অনুরোধ রক্ষা করে লন্ডনেও চলে আসবো। এতে বেশ কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল বাবু এবং নেলি দুইজনই। বাবুদের সাথে কথা বলার পর জেনারেল এরশাদের সাথে যোগাযোগ করলাম। সার্বক্ষণিক ছায়াসঙ্গী এবং বিশ্বস্ত বন্ধু গোলাম রব্বানি খান পাশে বসা একটি নোট প্যাডআর কলম হাতে। He is a very meticulous person. Rabbani is an extremely intelligent character with unbelievable photogenic memory.

আসসালামু আলাইকুম স্যার, কেমন আছেন? হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার কল পেয়ে জেনারেল এরশাদ খুবই আশ্চর্য হলেন। ওয়ালাইকুম আসসালাম, ডালিম তুমি কোথা থেকে? যোগাযোগ কোরলে কি ভাবে?

এর জবাব অবান্তর। আপনি পুরো দেশটাকে একটা সর্বনাশা সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন। শুধুমাত্র ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য দেশে মার্শাল’ল জারি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কেনো? আপনার সেই হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলেই আজ আপনি এবং আপনার সহচররা সবাই গৃহবন্দী। আপনার দীর্ঘ ৮ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আজ সারা দেশবাসী জেগে উঠেছে সেই অবস্থায় আপনার এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যদের বেশিরভাগই অবস্থান নিয়েছে দেশকে একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। গৃহযুদ্ধে আপনার আর আপনার দোসরদের পরিণতি কি হতো সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সময় এটা নয়। তবে আমি আপনাকে আন্তরিকভাবে একটি বাস্তব সত্য জানাচ্ছি। সামরিক বাহিনীর এই আকস্মিক পদক্ষেপ জনগণের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। তারা এখন অপেক্ষায় রয়েছে এর পর কি হয় দেখার জন্য। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে সবদিক বাঁচিয়ে বিশেষ করে আপনার পরিণতির কথা ভেবেই একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ খুঁজে বের করার জন্যই আমি আপনাকে ফোন করেছি বিবেকের তাড়নায়। ইতিমধ্যেই, ঢাকা থেকে স্বপন এবং লন্ডন থেকে বাবু আর নেলি ফোন করেছিলো। তারা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত এবং আপনার এবং ডেইজি ভাবীর নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। আমাকে আপন ভেবে তারা তিনজনই মিনতি জানিয়েছে, আপনাদের ব্যাপারে কিছু করা সম্ভব হলে করার জন্য। স্যার, মোনাফেকি আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। রাজনৈতিকভাবে আমাদের নীতি-আদর্শের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলেও পারিবারিক এবং ব্যক্তিগতভাবে শেখ সাহেব, জেনারেল জিয়া ও আপনার পরিবারের সাথে আমার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সবসময়েই ছিল এবং আছে, আর এই সম্পর্ক সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। এই সম্পর্ক প্রীতি, স্নেহ আর ভালবাসার সম্পর্ক। তাই আমি তাদের শান্ত করার জন্য আন্তরিকভাবেই বলেছি, আমি যথা সম্ভব চেষ্টা করবো যাতে আপনাদের উপর কোনও প্রকার শারীরিক নির্যাতন কিংবা অপ্রীতিকর কিছু করা না হয়। তবে আমার চেষ্টাকে সফল করে তোলার জন্য আপনার তরফ থেকেও সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। এখন আপনি বলুন, বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আপনি আমার সাথে সহযোগিতা করতে রাজি আছেন কিনা? আমাকে বিশ্বাস করে যদি আপনি সহযোগিতার কথা দেন, তবেই আমি এগুবো, তা না হলে আমি আমার সব উদ্দগ থেকে সরে দাড়াবো।  কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে জেনারেল এরশাদ বললেন

বেশ, বলো তুমি কি ধরনের সহযোগিতা চাও।

আমি যা বলবো সেটাকে আবেগ দিয়ে বিচার না করে যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।

তাই করবো। প্রথমে বলুন, আপনাদের কোনও বিশেষ অসুবিধে হচ্ছে না তো? ডেইজিভাবী কেমন আছেন?

ডেইজি ভালোই আছে। আমারও বন্দীত্ব ছাড়া তেমন কোনও অসুবিধা নেই। স্বাভাবিক অবস্থাতেই রাখা হয়েছে আমাদের। শুধু কারো সাথে যোগাযোগের কোন সুযোগ নেই। এটাতো Rules of Business সেটা আপনার ভালো করেই জানা আছে। স্যার মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবার। খালেদা জিয়ার সাথে আমার কথা হয়েছে। আমার কথায় ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচি তিনি সাময়িকভাবে স্থগিত করতে রাজি হয়েছেন যদিও আওয়ামীলীগ বিশেষ করে হাসিনা তার এই সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধিতা করছেন। কেনো সেটা আপনার বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়। আমার বিবেচনায় এখন আপনার জন্য একটাই পথ খোলা রয়েছে। Temporary Retreat. আপনি যদি স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফাদিয়ে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে আগামী নির্বাচনের ঘোষণা দেন তবে খালেদা জিয়া কথা দিয়েছেন, আপনি চাইলে সপরিবারে আপনাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা তিনি করবেন এবং আর্মিও সেটা মেনে নেবে। আমি জানি, হাসিনা এইসিদ্ধান্ত মেনে নেবে না সহজে। শুধু তাই নয়, ভারতের ইশারায় খালেদার চেয়ে বেশি সোচ্চার হচ্ছে হাসিনা আপনাকে জেলে পাঠিয়ে বিচার করার ব্যাপারে যাতে আপনি হাসিনার করুণার পাত্র হয়ে তার ও ভারতের স্বার্থে ব্যবহৃত হন। একটা সত্যি আপনাকে মেনে নিতে হবে স্যার, ভারতের কাছে আপনার আর তেমন কোনও মূল্য নেই। আপনাকে ৮ বছর ক্ষমতায় রেখে তাদের যা হাসিল করার ছিল সেটা তারা করে নিয়েছে। এখন থেকে হাসিনা থাকবে ড্রাইভিং সিটে আর আপনাকে থাকতে হবে তার তাঁবেদার হয়ে। জেনারেল জিয়াও ভারতের সাথে আপোষ করেছিলেন। হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী-বাকশালীদের রাজনীতির মূল ধারায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পর তার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়। ফলে তার পরিণতিটা কি হয়েছে সেই সময়ের একজন মুখ্য খেলোয়াড় হিসেবে আপনার ভালো করেই জানা আছে। ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের পর বিলুপ্ত প্রায় আওয়ামী-বাকশালিদের পুনর্জীবিত করার জন্য জেনারেল জিয়া এবং আপনি ব্যবহৃত হয়েছেন ভারতের সাথে জাতীয় স্বার্থবিরোধী সমঝোতার নীতি গ্রহণ করে। আমার অনুরোধ, আপনি আওয়ামীলীগকে যদি পলিটিক্যাল স্কোরিং-এর সুযোগটা না দেন তবে অতীতের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কিছুটা হলেও হবে। স্যার, শুধু সমঝোতা ভিত্তিক ক্ষমতার রাজনীতি জটিল এবং মর্মান্তিক ভাবে কুটিল।

তুমি সত্যিই বলছো ম্যাডাম কি সত্যই রাজি হয়েছেন আমাকে মুক্তি দিয়ে Safe Passage দেবার ব্যবস্থা তিনি করবেন!

জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর সাথে আপনার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তিনি যতটুকু জানেন তাতে আমি ভাবতে পারিনি তিনি আমার প্রস্তাবটা মেনে নেবেন। কিন্তু নিলেন আমাকে অনেকটা অবাক করে দিয়েই। স্যার, আমি মিথ্যাকে ঘৃণা করি। এটা কমবেশী পরিচিতজনরা সবাই জানে, আপনিও নিশ্চয় কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে থাকবেন দীর্ঘদিনের পরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতে।আপনি ভাবুন, কয়েক দিনের মধ্যেই আমি বাবু আর নেলির সাথে যাতে আপনি সরাসরি আলাপ করতে পারেন সেই ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবো। এতে আপনার সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা সুবিধে হতে পারে। রাখি স্যার, আজকের মতো।

ফোন রেখে দিয়ে রব্বানিকে আলাপের বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দিয়ে বললাম, এখন আমাকে লন্ডন যেতে হবে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। দীর্ঘদিনের সম্পর্কের দরুন রব্বানি সারবস্তুর প্রায়সবি বুঝে ফেলে আমাদের কথাবার্তা বাংলাতে হলেও। রব্বানি, কেনিয়া ভিজিটের সময় জেনারেল এরশাদের চেহারাটা দেখে তোমার কি ধারণা হয়েছে জানি না। ভীষণ পিছলে মাল, কথা পালটাতে এক মুহূর্ত লাগে না জেনারেল এরশাদের। CMLA থাকা কালে সবাই এরশাদ সম্পর্কে বলতো CMLA মানে Cancel My Last Announcement! দু’জনই উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। দোস্ত, আমি কিন্তু যতই তোমাকে দেখছি ততোই বিস্মিত হচ্ছি!

কেনো বলতো?

আমি পাকিস্তানের অনেক বাঘা বাঘা রাষ্ট্রদূত এবং হাই কমিশনারদের দেখেছি। দেখেছি তারা প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রাইম মিনিস্টার এর সাথে কিভাবে আচরণ করেণ। তোমাকেও দেখলাম রাষ্ট্রপতি এরশাদের ভিজিটের সময়। যেকোনো VVIP visit এর সময় সবাইকে দেখেছি গলদঘর্ম হতে, আর তোমাকে দেখলাম জেনারেল এরশাদের রাষ্ট্রীয়সফর কালে নির্বিকার এবং সবসময় তুমি যেমন থাকো ঠিক তেমনই! এখন দেখছি, হাজার মাইল দূরে বসে একটা মানুষ কি করে পাশা উল্টে দিচ্ছে অনায়াসে! ইতিহাসের জ্ঞান আমার সীমিত, তবে এ ধরনের মানুষের কথা ইতিহাসেও বিরল। এতটা আত্মপ্রত্যয় আর বল তুমি পাও কি করে?

প্রিয়বন্ধু, উদ্দেশ্যটা যদি সঠিক হয় আর ব্যক্তিকেন্দ্রীক না হয়ে বৃহত্তর স্বার্থে হয় তবে অসীম করুণাময় আল্লাহ্‌ই প্রয়োজনীয় সাহস কিংবা আত্মপ্রত্যয় যুগিয়ে দেন। এটা আমার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা।

রব্বানি চলে যাবার পর কিছু বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এরশাদের কথা আর কাজের মধ্যেঅনেক ফারাক থাকে। তাই তার কোন কথাতেই অতি উৎসাহিত হওয়া চলবে না। অতএব, আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে খালেদা জিয়া এবং সেনাসদরের সাথে খুবই সতর্কতার সাথেই আলাপ চালাতে হবে। পরদিন রাতে আবার এরশাদকে ফোন করলাম। রব্বানি রয়েছে পাশেই।

আসসালাম, আজ কেমন আছেন স্যার? কি ভাবলেন? স্যার, কিছু মনে না করলে একটা কথা খুলে বলতে চাই। কথাটা নেহায়েত আমার নিজস্ব বিবেচনা।

বলো কি বোলতে চাও। তুমি একজন শুভার্থী হিসেবে যা বলবে সেটা আমাদের ভালোর জন্যই বলবে, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই আমার।

স্যার, জীবন বাঁচিয়ে সপরিবারে দেশছেড়ে বাইরে চলে আসুন। আপনিতো শুনি ইতিমধ্যেই ৬০০ মিলিয়ন ডলার এর মালিক হয়ে বসেছেন। সেটা বিদেশের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের একাউন্টে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। টাকার অংকটা যদি অর্ধেকও হয় তবে সেটা দিয়ে বিশ্বের যেকোনো পছন্দসই জায়গাতে বিলাসবহুল জীবন কাটানো আপনার পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে না। তাছাড়া তৃতীয় বিশ্বেরপ্রায় সব কয়টি দেশেই প্রচলিত অনিশ্চিত রাজনৈতিক প্রবাহে ফিরে আসার সুযোগ যেকোনো সময় আবার সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাবুদেরও এই অভিমত। এমনটি তো অহরহ ঘটছে চারিদিকে। এই বয়সে জেলের ভাত আপনি হয়তো হজম করতে সক্ষম হবেন তবে, ভাবীর যেই শারীরিক অবস্থা তাতে এই ধরনের মানসিক এবং শারীরিক চাপ তার পক্ষে বরদাস্ত করাটা খুবই কষ্টকর হবে। উপরন্তু, বিদেশী প্রভুদের কথামতো না চললে আপনার বিষয়টি কিন্তু শুধুমাত্র কারাবন্দী পর্যন্ত নাও থাকতে পারে। তখন অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি সেটা নিশ্চয় আপনি বুঝতে পারছেন স্যার।

ঠিকই বলছো তুমি। আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি।

তাহলে, আপনার এই সিদ্ধান্তটা ম্যাডামকে জানাতে পারি কি?

নিশ্চয়ই।

দেখবেন স্যার, কথা রাখার ব্যাপারে বাজারে আপনার যে সুখ্যাতি রয়েছে সেটা যেন এইক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয়। তাহলে আমার পক্ষে কিন্তু আর কিছুই করা সম্ভব হবেনা। তাই আবারও জিজ্ঞেস করছি, ভালোভাবে ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেনতো? জেনারেল এরশাদ জবাব দিলেন

সবাই তো আর ডালিম নয়।

ঠিক আছে, তাহলে আমি ম্যাডামকে আপনার সম্মতির কথাটা জানিয়ে জিজ্ঞেস করি পদত্যাগ, ক্ষমতা হস্তান্তর এবং আগামি নির্বাচনের Modalities নিয়ে তারা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেই অনুযায়ী আমাদের এগুতে হবে। আপনিও বিষয়টি নিয়ে ভাবুন। দু’পক্ষের ভাবনা চিন্তার উপর নির্ভর করেই সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। কি বলেন স্যার?

ঠিকই বলেছো তুমি।

খালেদা জিয়ার সাথে যোগাযোগ করে জানালাম জেনারেল এরশাদ রাজি হয়েছেন পদত্যাগের পর ক্ষমতা হস্তান্তর করে জাতীয় নির্বাচনেরঘোষণা দিয়ে দেশত্যাগ করতে। এমন সহজেই এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন সেটা খালেদার জন্য অপ্রত্যাশিত হলেও খবরটা জেনে তিনি খুশিই হলেন। আমি তাকে আরও জানালাম, দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে জারিকৃত হুলিয়াও তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। সহসাই তার এই হুকুমনামা কার্যকরী হয়ে যাবে সরকারি পর্যায়ে। এরপর খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ?

জবাবটা দুই একদিনের মধ্যেই আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করে আপনাকে জানাচ্ছি, বললেন বেগম খালেদা জিয়া। আমি তাকে বললাম

যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জবাবটা জানানোই শ্রেয়। কারণ জেনারেল এরশাদকে মত পালটানোর সময় এবং সুযোগ দেয়াটা ঠিক হবে না। আর একটি কথা আপনাকে মনে রাখতে হবে। যদিও জেনারেল এরশাদ দেশ ছাড়তে রাজি হয়েছেন কিন্তু এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ভারত এবং RAW। আমি নিশ্চিত, আপনি কারণটা বুঝতে পারবেন। আপনার গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিতগুলো মনে থাকবে। সেই প্রেক্ষিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলবো ইন শা আল্লাহ্‌।

আমি আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো।

ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখেদিলেন খালেদা জিয়া।

এই সব কথোপকথনের সারবস্তু সেনাসদরের বিশেষজনকেও জানিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। ইতিমধ্যেবাবু আর নেলি লন্ডন থেকে অস্থির হয়ে ফোন করছে বার বার। পাবলিক টেলিফোন বুথথেকে তারা ফোন করে অবস্থার ইতিবাচক কোন অগ্রগতি হল কিনা জানতে চাইছে। প্রতিবারই আমি তাদের আশ্বস্ত করে জানাচ্ছি আলোচনা চলছে, ভয়ের কোন কারণ নেই। ভাই-ভাবী দুইজনই ভাল আছেন। আমার সাথে সবপক্ষেরই যোগাযোগ হচ্ছে। খুব শীঘ্রই সংকট কেটে যাবে ইন শা আল্লাহ্‌। তোমরাও দোয়া কর তারা যেন সহি-সালামতে দেশ থেকে বরিয়ে আসতে পারেন। পরদিনই খালেদা জানালেন চীফ জাস্টিসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে। জেনারেল এরশাদকে খবরটা জানানোর পর তিনি সম্মত হলেন। জাতির উদ্দেশে তার ভাষণ রেকর্ড করানো হল। নাতিদীর্ঘ ভাষণে তিনি তার স্বেচ্ছায়পদত্যাগ, দুইনেত্রীর বিরুদ্ধে হুলিয়া প্রত্যাহার, সাধারণ নির্বাচনেরস্বার্থে চীফ জাস্টিসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন বলে জাতিকে অবগত করলেন। তার এই ভাষণ প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথেই সারাদেশে জনগণ আনন্দে ফেটে পড়লো। খুশির জোয়ারে ভাসতে থাকলো পুরো বাংলাদেশ। এভাবেই পর্দার অন্তরালের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় একআত্মঘাতী সংঘর্ষের হাত থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পেলো! প্রতিবেশী দেশেরচাণক্যদের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে গেলো আল্লাহর অসীম করুণায়। আমি আর রব্বানিদু’জনই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মুখ্য খেলোয়াড় জেনারেলও পর্দার আড়ালেই রয়ে গেলো! আমি কিন্তু এরপরও শঙ্কামুক্ত হতে পারছিলাম না। শৃগালের মত ধূর্ত জেনারেল এরশাদশুধুমাত্র নিজেকে বাঁচানোর জন্য ক্ষমতা ছেড়ে দেশান্তরী হবার সিদ্ধান্তনিলেও তার বিদেশী প্রভু ভারত কি তাকে এত সহজে ছাড় দিতে রাজি হবে? এই প্রশ্নটাই ছিল আমার শঙ্কার প্রধান কারণ। যতদিন জেনারেল এরশাদ দেশ ত্যগ নাকরবেন ততদিন এই শঙ্কা থেকেই যাবে। যাই হউক, ভাষণটি জাতীয় প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হবার পর এরশাদের দেশ ছাড়ার বিষয়ে আলোচনার জন্য তাকে ফোন করলাম রব্বানির উপস্থিতিতেই।

আসসালাম স্যার, কেমন আছেন? দেশ ও জাতির স্বার্থে আপনি যে ত্যাগ স্বেচ্ছায় স্বীকারকরলেন সেটা প্রশংসনীয়। আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি অন্তর থেকেই। এবার বলুন, কবে আপনি দেশ ছাড়ছেন? আপনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করা হবে।

আমি দেশ ছাড়বো না, নির্বাচনে জিতে আমিই আবার সরকার গঠন করবো। আগামী নির্বাচনে আমি প্রায় ১২০ টি আসনে জিতবো।

স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! কি প্রলাপ বকছেন জেনারেল এরশাদ! আমার শঙ্কাই সঠিক বলে প্রমাণিত হল! খেলার সমাপ্তি হয়নি। কি সেই খেলা? আগামী নির্বাচনে কোনও কারচুপির অবকাশ থাকবে না। কারণ, চীফ জাস্টিস সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়েই বিশ্বপরিসরে একটি অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করাবেন। সেই ক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদ এবং তারদল কি করে ১২০ টি সিটে জিতে সরকার গঠন করবেন সেটা কোনও পাগলের পক্ষেও বিশ্বাস করা কঠিন! এই বাস্তবতার নিরিখে খেলাটা হবে, জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে খালেদার তুলনায় যেহেতু হাসিনা পিছিয়ে রয়েছে তাই এরশাদের মাধ্যমে তার ভোটেভাঙ্গন ধরিয়ে পরে আওয়ামীলীগ এরশাদকে প্রয়োজনে সাথে নিয়ে সরকার গঠন করবে। তাই তাকে দেশ ছাড়তে দিচ্ছে না প্রভু ভারত। ১৯৮৬সালে এরশাদ আওয়ামীলীগ ও জামায়াত-এর সাথে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনের প্রহসনের মাধ্যমে তার অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধ করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন জেনারেল এরশাদ। এর পেছনে কলকাঠি ভারত। জেনারেল এরশাদ এবং আওয়ামীলীগের গলায় বাঁধা সুতো ভারতীয় চাণক্যদের হাতে। জামায়াতের রাজনীতি জন্মের পর থেকেই বিভ্রান্তিকর। পাকিস্তান আন্দোলন কালে জামায়াতের তাত্ত্বিক গুরু মাওলানা মওদুদী দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থন কিংবা বিরোধিতা না করে তার জন্মভূমি ভারতের দাক্ষিণাত্যেই থেকে যান। পরে তিরিশের দশকে হিজরত করে ভারত ছেড়েপশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবে পাড়ি জমিয়েছিলেন মাওলানা! পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই কাদিয়ানীদের অমুসলমান বলে ফতোয়া জারি করায় এক রক্তক্ষয়ীদাঙ্গা-ফ্যাসাদের সূত্রপাত ঘটে পাকিস্তানে। অনেক নিরীহ লোকেরপ্রাণহানি ঘটে সেই দাঙ্গায়। এই দাঙ্গায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে মাওলানা মওদুদীকে বন্দী করা হয় এবং বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তবে কাকতলীয় ভাবে তিনি সেই যাত্রায় ছাড়া পেয়ে যান। এরপর থেকে পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী প্রো-এস্টাবলিশমেন্ট রাজনীতিকরে চলেছে।এর ভূরিভূরি প্রমাণ রয়েছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রবাহে।

ভারতের সাথে সমঝোতার ফলে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার পর ব্যালেন্সিং এ্যাক্ট হিসাবে জেনারেল জিয়া প্রফেসর গোলাম আজমকে দেশে ফিরে আসার অনুমতি প্রদান করেন। ফিরে এসে জনাব গোলাম আজম জামায়াত-এর আমীর পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দলের সাংগঠনিক তৎপরতায় মনোনিবেশ করেন। সেই প্রক্রিয়ার এক পর্যায় জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতাগ্রাসী জেনারেলএরশাদের আনুকূল্য পাবার জন্য এবং আওয়ামী লীগেরকাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা পাবার অভিপ্রায়ে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনেওআওয়ামীলীগের লেজুড়বৃত্তি করে অংশগ্রহণ করেছিল জামায়াতে ইসলামী।

কিন্তু তাদের দ্বারা প্রতারিত হয়েও খালেদা জিয়া সেই নির্বাচন বর্জনে ছিলেন অনড়। এর মূল কারণ ছিল, খালেদা জিয়া বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করছিলেন তার স্বামীর অকালমৃত্যুর পেছনে জেনারেল এরশাদ, আওয়ামীলীগ এবং ভারতের হাত ছিল।
তাই, বিক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া জেনারেল এরশাদের অবৈধ ভাবে অস্ত্রের মুখে বিএনপির নির্বাচিতরাষ্ট্রপতি জনাব সাত্তারের অসুস্থতার সুযোগ গ্রহণ করে ক্ষমতা কব্জা করাকে বৈধতা না দিয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।এতে তার আশাতীত লাভ হয়। খালেদার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি জনগণের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আপোষহীন নেত্রীহিসেবে।একই সাথে তার জনপ্রিয়তাও বেড়ে যায়। রাজনৈতিক ভাবে এটা ছিল তার একটি অপ্রত্যাশিত ব্যক্তিগত প্রাপ্তি। ফলে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়াই জনগণের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন মূলনেত্রী হিসাবে।

দেশজুড়ে গণআন্দোলন যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে ঠিক সেই সময় এরশাদের ভরাডুবি অবধারিত বুঝতে পেরে ভারতীয় চাণক্যদের ইশারায় আওয়ামীলীগ এরশাদের সাথে গাঁটছড়ায় ইতি টেনে আবারগণ-আন্দোলনে এসে শরিক হয়। জামায়াতও অবস্থা বুঝে এরশাদের প্রতি সমর্থন তুলে নিয়ে আন্দোলনে ঢুকে পড়ে আওয়ামীলীগের পদাংক অনুসরণ করে।

১৯৮৬ সালের এরশাদের পাতানো খেলার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আওয়ামীলীগ এবং জামায়াত উভয় দলই বিভিন্নভাবে লাভবান হয়েছিল। যাই হউক, এরশাদের কথা থেকে বুঝতে কষ্ট হলো না, আগামী নির্বাচনে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং আর্থিক সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে চাণক্যপুরির সার্বিক সাহায্যে আবার আওয়ামীলীগ এবং এরশাদ জোট সরকার বানাবার ব্যাপারে প্রায় সুনিশ্চিত। জনসমর্থন খালেদার পক্ষে থাকলেও অনুগত কিংবা নির্দলীয় প্রশাসন, অর্থবল, সাংগঠনিক এবং পেশিশক্তির দিক থেকে এরশাদএবং আওয়ামীলীগ তুলনামূলক ভাবে বিএনপি থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। এই চারটি উপাদানের উপরই বেশিরভাগ নির্ভর করে তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশের নির্বাচনী ফলাফল। দীর্ঘ ৮ বছর ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে দলীয় করণের কাজটি ভালোভাবেই করে নিতে সক্ষম হয়েছেন রাষ্ট্রপতি এরশাদ এবং আওয়ামীলীগ। জামায়াতও এইক্ষেত্রে কিছুটা এগুতে সক্ষম হয়েছে জুনিয়র পার্টনার হিসাবে। এই অশনিসংকেতে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। খালেদা জিয়াকে এরশাদের সিদ্ধান্ত বদল ও তার বক্তব্যের তাৎপর্য এবং বিশ্লেষণ খুলে বলা উচিৎ যাতে করে খালেদা জিয়া সতর্কতার সাথে এই কঠিন বাস্তবতার মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। আমাকে বিশেষভাবে চিন্তিত দেখে ছায়াসঙ্গী রব্বানি বললো

কি ব্যাপার, এতো চিন্তিত কেনো? আমি তাকে খেলার নতুন অধ্যায় সম্পর্কে সব কিছু খুলে বললাম। সব শুনে রব্বানি বললো শোনো, এই বিষয়ে আমার একটা বিশ্লেষণ আছে।

আগামী নির্বাচনের পর এরশাদ নয়, আওয়ামীলীগই সরকার গঠন কোরবে, জেনারেল এরশাদ হবে আওয়ামীলীগের সমর্থক শক্তি। আওয়ামীলীগ এবং ভারত জামায়াতকে ব্যবহার করতে চাইবে শুধু খালেদার ভোট কাটতে, তবে ক্ষমতায় জামায়াতকে অংশীদারিত্ব কখনই দেয়া হবে না। এরপরও কথা থাকে। এরশাদকে আওয়ামীলীগের লেজুড় হয়ে বৈধতা দিতেই হবে। বৈধতা দেবার পরও জামায়াত নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝে নিবে তাদের বেঁচে থাকাই হয়ে উঠবে মুশকিল। তাই রাজনৈতিক অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যই বিএনপির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া জামায়াতের আর কোনও গত্যান্তর থাকবে না। খালেদা জিয়ার নির্বাচনী মোর্চায় ঢোকার সার্বিক প্রচেষ্টা করবে তারা। বিএনপির উচিৎ হবে তাদের গ্রহণ করা। আমি দৃঢ়ভাবেই বলছি, আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ১৯৮৬ সালের মতো হবে না। সেইসময় বিএনপি জোটের আন্দোলনকে দুর্বল করে তোলার জন্যই জামায়াতকে সরিয়ে আনা হয়েছিলো। একই সাথে আওয়ামীলীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জেনারেল এরশাদের ক্ষমতাদখলকে বৈধতা দেবার জন্যই জামায়াতকে গুণতিতে নেয়া হয়েছিল। আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগ এবং জেনারেল এরশাদের কোনও প্রয়োজন হবে না জামায়াতের। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছে এখনঅব্দি জামায়াত-এর গ্রহণযোগ্যতা আমজনতার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। সেটা বিগত ১৯৮৬ এর নির্বাচনের ফলাফলেই পরিষ্কার হয়ে গেছে।

যেই বিষয়টি আমাকে বেশি ভাবিয়ে তুলছে সেটা হল, আগামী নির্বাচনে যদি আওয়ামীলীগ এরশাদকে সাথে নিয়ে ক্ষমতায় যায় তবে তথাকথিত জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী বিএনপি এবং ইসলামিক মূল্যবোধের চ্যাম্পিয়ন জামায়াতকে বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হবে ক্রমান্বয়ে। এই দুইটি দলই অস্তিত্ববিহীন হয়ে পড়বে সময়ের সাথে। পরিণামে দেশ পরিচালিত হবে নিও-বাকশালীদের দ্বারা।

তোমার বিশ্লেষণে ওজন আছে, সেইক্ষেত্রে এই দুইদলকে ঐক্যবদ্ধ করাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে। এই দুইদলের নেতৃবৃন্দকে বোঝাতে হবে বর্তমান বাস্তবতা। নিজেদের অস্তিত্বের খাতিরেই উভয় পক্ষকেই অতীতের তিক্ততা ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে আগামী নির্বাচন কেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হবে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে। এই সমঝোতার জন্য Common Friends দের সাহায্যও নেয়া যেতে পারে। হ্যাঁ, তা করা যেতে পারে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থাকে।

কি প্রশ্ন, জিজ্ঞেস করলো রব্বানি।

ধরো, এই দুইদলকে ঐক্যবদ্ধ করা গেলো। তারপরও সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল এই জোটের পক্ষে শুধুমাত্র খালেদার জনপ্রিয়তা দিয়ে সার্বিকভাবে বেশি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষকে পরাজিত করা সম্ভব হবে কি? ভায়া, এই জনসমর্থনের বেশীরভাগই হচ্ছে Silent Majority. আওয়ামীলীগ এবং জেনারেল এরশাদের স্ট্র্যাটেজি হবে তাদের অর্থবল, অনুগত প্রশাসন এবং পেশীশক্তি দিয়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে করে ঐ Silent Majority ভোট কেন্দ্রে যেতেই না পারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেক্ষেত্রে এই জনপ্রিয়তা প্রত্যাশা অনুযায়ী কন চমকপ্রদ ফল দেখাবার সুযোগ পাবে কি?

খুবই যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। তাই নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা নির্ভয়ে পোলিং বুথে গিয়ে ভোট দিতে পারে। এর জন্য সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করতে হবে প্রতিটি পোলিং বুথে। সুষ্ঠু আর নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এই দাবিটা জোরালো করে খালেদাকে অবশ্যই ওঠাতে হবে নির্বাচন কমিশনের কাছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের দাবির বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ উঠবে না দেশে কিংবা বিদেশে। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নেবে না আওয়ামীলীগ, জেনারেল এরশাদ এবং তাদের প্রভু ভারত। তবে এর প্রতিবাদে নির্বাচন বর্জন করা কিছুতেই সম্ভব হবেনা। কারণ, এবারের নির্বাচনটা হবে একটি গণআন্দোলনের ফসল হিসেবে। এই বিষয়গুলোর সমস্ত কিছুই বোঝাতে হবে বেগম জিয়াকে। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোও বাংলাদেশে একটি নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সোভিয়েত-ভারত দেশটাকে তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলবে সেটা কিছুতেই তারা হতে দিবে না। তাই তারাও চাইবে একটি নিরপেক্ষ সুষ্ঠ নির্বাচন কারণ তারাও পরিষ্কার বুঝতে পারছে নির্বাচন নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠ হলে সোভিয়েত-ভারত বিরোধী জোটেরই নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা বেশি।

তাহলে বিষয়টি খালেদাকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়া উচিৎ।

Absolutely correct! অবশ্যই যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।

সেই রাতেই খালেদা জিয়াকে ফোন করলাম।

হ্যালো, মোহাম্মদ বলছি।

বলুন, অপরপ্রান্তে খালেদা জিয়া।

জেনারেল এরশাদ মত পালটেছেন অদৃশ্য ইঙ্গিতে। দেশান্তরী হবেন না তিনি। জেনারেল এরশাদ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশে থেকেই আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। অপ্রত্যাশিত খবরটা শুনে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়লেন খালেদা জিয়া।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন তিনি দেশত্যাগ করতে রাজি আছেন।

তবে আমি এটাও বলেছিলাম তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন ভারতের মর্জি মোতাবেক। হ্যাঁ, তখন তিনি যা বলেছিলেন সেটাই আমি আপনাকে বলেছিলাম। এখন তিনি মত পাল্টে নির্বাচনে চাণক্যদের ষড়যন্ত্রের গুটি হিসাবে ব্যবহৃত হতে বাধ্য হয়েছেন। ষড়যন্ত্রটি সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা আমি আপনাকে দিতে চাই, যদি আপনি শুনতে চান।

বলুন।

আমি সার্বিক বিষয়ে আমার আর রব্বানির বিশ্লেষণের সারবস্তু তুলে ধরলাম। সব শুনে তিনি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন আপনার বিশ্লেষণ সম্পূর্ণভাবে যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আপনি আমাকে যেই পথে এগুতে বললেন, তার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। দেশের ভেতর থেকে বর্তমানে আমার জন্য সেটা যোগাড় করা সম্ভব নয়। বিত্তবানরা ইতিমধ্যেই আওয়ামীলীগ ও এরশাদের দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। তারা ধরেই নিয়েছে আওয়ামীলীগ আর এরশাদ মিলেই আগামী নির্বাচন জিতবে। আমাদের সব একাউন্ট এরশাদ ক্ষমতা দখলের পরই বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল, কি কষ্ট করে যে এতটুকু এসেছি সেটা একমাত্র আমিই জানি। নির্বাচনের জন্য সীমান্তের ওপার থেকে টাকার স্রোত বইছে। সেই স্রোতের বিরুদ্ধে একদম খালি হাতে কি টিকে থেকে মোকাবেলা করা সম্ভব ভাই?

কথাটা ঠিকই বলেছেন। তাছাড়া যাদের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া রাজনীতির জন্য টাকার ব্যবস্থা করতেন তাদের প্রায় সবাই তো জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পরই এরশাদের খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকে পড়েছে। এখনো তারা এরশাদের সাথেই আছে সেটা আমি জানি। আমার বক্তব্য শুনে হয়তো কিছুটা বিব্রত বোধ করে থাকবেন খালেদা জিয়া।আবার অল্প সময় নিয়ে বললেন

আপনাকে একটা অনুরোধ করতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন।

বলুন।

আপনার ছোটভাই স্বপনকে আমি নির্বাচন করার আবেদন করেছিলাম, কিন্তু সে রাজনীতিতে আসতে রাজি নয় বলে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। নির্বাচনের আগে আপনি কি আমার পাশে এসে দাড়াতে পারেন না? সরকারি চাকুরে হিসাবে সেটা সম্ভব নয়। এর চেয়ে বড় কথা হল, যে কারণে জেনারেল জিয়ার চীন সফর করার সময় তার অনুরোধ রক্ষা করে তার সাথে একত্রে রাজনীতি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি সেই কারণটি এখনও বর্তমান। তাছাড়া দেশে ফিরে আপনার জন্য যতটুকু সাহায্য-সহযোগিতা করতে সক্ষম হবো সেটা করার মতো মানুষ দেশেই যথেষ্ট রয়েছে। তার চেয়ে বিদেশে থেকেই ওই সমস্ত বিষয়ে আমি যদি আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করি যা দেশে থেকে কারো পক্ষে করা হয়তো সম্ভব নয়, তাহলে সেটাই বেশি লাভজনক এবং শ্রেয় নয় কি? আর্থিক সঙ্গতি এবং জামায়াতের সাথে নির্বাচনী ঐক্য এই দুইটি উপাদানই আপনার জন্য আগামী নির্বাচনে মূল বিষয়। আমি চেষ্টা করে দেখবো এই বিষয়ে কিছু করা সম্ভব হয় কিনা।

আপনার এই আন্তরিক উদ্যোগ, সবকিছুর জন্যই আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো ভাই।

ভাবী, আমরা কিন্তু কারো ব্যক্তিস্বার্থে কিছুই করছিনা। আমাদের সব প্রচেষ্টা হচ্ছে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে। ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে এগিয়ে নেবার জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যতদিন বেঁচে থাকি আমরা এই চেতনাকে বাংলাদেশের মাটিতে প্রোথিত করার জন্য সংগ্রাম করে যাবো, সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে থেকেই। আমাদের সেই চেষ্টায় কোনও ব্যক্তি বিশেষের যদি লাভ হয় সেটা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। আপনি অনুগ্রহ করে যতটুকু সম্ভব এগিয়ে যান, আমরাও আমাদের চেষ্টায় কোনও ত্রুটি রাখবো না। ফল কি হবে সেটা একান্তভাবে নির্ভর করবে আল্লাহ্‌ সুবহান ওয়া তায়ালার উপর। রাখি আজকের মতো। পরে প্রয়োজনে আবার যোগাযোগ করবো। আল্লাহ্‌ হাফেজ। রেখে দিলাম ফোন।

আমাদের কথোপকথনের বিষয়বস্তু রব্বানির মতো বিচক্ষণ ব্যক্তির পক্ষে বুঝতে কোন অসুবিধাই যে হয়নি সেটা তার দু’চারটা প্রশ্ন থেকেই বুঝে নিলাম। ঠিক হল, আগামীকাল আমরা দু’জন বসবো আমাদের পরবর্তী করণীয় কর্মসূচি প্রণয়ন করতে।
সন্ধ্যার পর রব্বানি এলো নাসরিনকে সাথে নিয়ে। আমিও ক্লাব থেকে ফিরে এসেছি। Annual Inter Club Tennis Tournament চলছে পার্কলেন স্পোর্টস ক্লাবে। আমি সেখানে এবার অংশ নিচ্ছি নাইরোবি ক্লাবের পক্ষ থেকে। পার্কলেন স্পোর্টস ক্লাবেরও মেম্বার আমি। তাই আমার এই পক্ষপাতিত্বে বন্ধুদের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়।পরে একটা সমঝোতা হয়, পরের বছর আমি পার্কলেনস্পোর্টস ক্লাবের তরফ থেকে খেলবো। নাসরিনদের আসার পর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রাতের খাবারের পাট চুকিয়ে আমরা গিয়ে বসলাম বসার ঘরে ফায়ার প্লেসের সামনে। পরিচারিকা বিত্রেস কফি পরিবেশন করে গেলো। কফি উৎপাদনে কেনিয়া পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। চা-ও উৎপন্ন হয় কেনিয়াতে। বেশিরভাগই রপ্তানি করা হয়ে বিদেশে। ছোট ছোট পাহাড় আর নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এই দুইটি উপাদান কফি উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক। হঠাৎ হাউস কিপার আলতাফ এসে খবর দিলো লন্ডন থেকে ফোন এসেছে। বাবু সাহেব ফোন করেছেন। ফোনটা প্লাগ ইন করে রিসিভারটা আমার হাতে দিয়ে বিদায় নিলো আলতাফ। অপ্রত্যাশিত নয়, অস্থির হয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বাবু ও নেলি আবার ফোন করেছে।

হ্যালো, আমি বাবু বলছি। কি খবর ডালিম ভাই?

খবর বিশেষ ভালো না। গতকাল জেনারেল এরশাদের সাথে কথা বলে হতাশ হয়ে পড়লাম, তিনি মত পালটে জানালেন ক্ষমতা হস্তান্তরের পর দেশ ছাড়বেন না। তিনি নির্বাচন করে নাকি ১৫০টা সিটে জিতে সরকার গঠন করবেন। প্রয়োজন হলে তিনি আওয়ামীলীগের সাথেও নির্বাচনী জোট বাঁধবেন। তার এই ধরনের ডিগবাজিতে আমি হতবাক হয়ে গেছি বাবু! এই আজগুবি হঠকারি সিদ্ধান্তের ফায়দা নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করবে আর জেনারেল এরশাদকে স্থান নিতে হবে শ্রীঘরে।

কি বলছেন ডালিম ভাই, দুলাভাই শেষে আওয়ামীলীগকে সমর্থন দিয়ে সরকার গঠনে সাহায্য করে জেলে যাবেন!

আমার তো তেমনটিই মনে হচ্ছে। কারণ, সরকার গঠনের পর মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত সিট ভাগাভাগির পর এরশাদ সাহেবের আর কোন প্রয়োজন থাকবে না আওয়ামীলীগের কাছে। সেই অবস্থায় জনগণের সাবাশি পাবার জন্য দুর্নীতি ও অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা গ্রহণ এবং ক্ষমতা অপব্যবহারের চার্জে তাকে জেলে পুরতে এতটুকুও কুণ্ঠিত হবে না হাসিনা এবং তাদের প্রভু ভারত। এ সবের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি জেনারেল এরশাদের হবে সেটা হচ্ছে, তার পিঠে ভারতের দালাল হিসাবে একটা চিরস্থায়ী স্ট্যাম্প লেগে যাবে। যার ফলে, ভবিষ্যতে হাসিনার পেটিকোটের নিচে থেকেই একদা দেশের রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদকে থাকতে হবে আওয়ামীলীগের তাঁবেদার হয়ে ভারতের ইঙ্গিতে। ভারতের দালালী আওয়ামীলীগের তাঁবেদারী, কারাবাস এটাই হবে তার নিয়তি! আমি তার মত না পাল্টানোর ঘোর বিরোধিতা করে বলেছিলাম, ৮ বছর তো রাজত্ব করলেন, এখন শেষ বয়সে ভারতের দালালী আর হাসিনার চাকরি না করে কিংবা জেলে না পচে বাইরে চলে আসলে কিছুটা হলেও সম্মানের সাথে আগামী দিনের সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেই ভালো করতেন। কিন্তু আমার সেই আবেদনে কর্ণপাত করলেন না জেনারেল এরশাদ। সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয় বাবু, আমি জেনারেল এরশাদের চেয়ে ডেইজি ভাবীর কথাটাই বিশেষভাবে ভাবছি। শারীরিকভাবে তিনি একজন অসুস্থ মহিলা। এতসব ঝামেলা তার পক্ষে কি সহ্য করা সম্ভব হবে! ডালিম ভাই, আমার একটা অনুরোধ আপনি কি দুই-এক দিনের জন্য লন্ডন আসতে পারেন?যদি আসতেন, তাহলে দুইজনে মিলে দুলাভাইকে তার এই ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বদলানোর চেষ্টা করতাম। আপাকেও বলতে পারতাম চাপ সৃষ্টি করে বাইরে চলে আসার জন্য। মনে হচ্ছে তুমি ঠিক আমাকে বিশ্বাস করছো না!

না না, এটা আপনি কি করে ভাবলেন! আপনাকে অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না। বিশ্বাস করি বলেই অনুরোধ জানালাম, এলে সবাই মিলে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতাম।

ঠিক আছে, আমি গোপনে পৌঁছানোর চেষ্টা করবো। বাবু, আমার কিছু মেহমান রয়েছে তাই এখন রাখতে হচ্ছে ফোন। কিছু মনে করো না। ঠিক আছে আমরা আপনার আসার প্রতীক্ষায় থাকবো, আল্লাহ্‌ হাফেজ।

উপস্থিত সবাইকে সবকিছু খুলে বললাম।

নিম্মি স্বল্পভাষী। হঠাৎ সে বলে উঠল তোমরা বেগম জিয়াকে বাঁচানোর আর নির্বাচনে জেতানোর চেষ্টা করছো কেনো? তিনি তো তার স্বামীর রাজনীতিকেই আরও শক্তভাবে এগিয়ে নেবেন। এতে দেশ বা জাতির কি লাভ হবে বলতে পারো?

হাসিনার তুলনায় খালেদা তো Lesser Evil. বলল রব্বানি।

চরিত্রগত ভাবে হাসিনা এবং খালেদা মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এর প্রমাণ সময়মতো আপনারা ঠিকই পাবেন। জানো নাসরিন, এদের মাথায় খালেদার যে ভূত চেপে বসেছে সেটা দূর হবার কোনও সম্ভাবনা নেই। Let them learn from their own experience. ডালিম তো বরাবরই মানুষ চিনতে ভুল করে এসেছে। এটা নিজে না মানলেও প্রমাণিত হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে, আমি সেই সমস্ত সবই জানি। জিয়াকে কেন্দ্র করে যুদ্ধকাল থেকেই যে স্বপ্ন তারা দেখে আসছিলো সেই স্বপ্নও যে নির্ঝরে ভঙ্গ হবে সেটাও আমি ওকে বলেছিলাম। একগুঁয়ে মানুষ তাই, কখনোই তর্কে যাই না। কারণ সেটা হবে অর্থহীন। Time shall prove Khaleda to be if not more but no less fraudulent and mischievous than her late husband General Ziaur Rahman. চলো, আমার ঘরে। সেখানে আরামে বসে গল্প করা যাবে বলে নাসরিনকে সাথে নিয়ে উঠে চলে গেলো নিম্মি।

আমি আর রব্বানি কফির পেয়ালা হাতে নিশ্চুপ বসে থাকলাম। স্তব্ধতা কাটিয়ে রব্বানিই মুখ খুললো

সত্যিই কি নিম্মি যুদ্ধের সময় বলেছিলো যে জিয়া বিশ্বাসযোগ্য নয়?

হ্যাঁ বলেছিলো।

তাহলে তো মেনে নিতেই হবে তার কথায় ওজন রয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে জেতানোর চেষ্টা করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তরও যে নেই এবারের নির্বাচনে কোনোভাবে যদি আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে তবে বাংলাদেশের মাটি থেকে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামিক শক্তিকে শিকড় সমেত উপড়ে ফেলা হবে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতের আধিপত্যের নিগড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সত্তা। ভবিষ্যৎ হয়ে উঠবে নেপাল, ভুটান কিংবা সিকিমের মতো। তাই সব জেনেও Lesser Evil-কেই সাহায্যের চেষ্টা করতে হবে। যেকোনো কারণেই হউক, বর্তমানে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের কাছে খালেদা জিয়াই হয়ে উঠেছেন ইসলামী মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার ধ্বজাধারী। সেই বিবেচনায়, আমি মনে করি আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা সেটা যত সামান্যই হউক না কেনো, চালিয়ে যেতে হবে খালেদা জিয়ার জন্য নয়- বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের স্বার্থেই।

হ্যাঁ বন্ধু তুমি ঠিকই বলছো। তাহলে, রব্বানি এই যুদ্ধের একটা রোডম্যাপ তুমিই ভাই ঠিক করে ফেলো। আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা এখান থেকে কি ভাবে শুরু আর কোথায় গিয়ে হবে তার শেষ! রব্বানি জানালো- গত রাতে ফিরে যাবার পর এইসব নিয়েই সারা রাত ভেবে একটা রোড ম্যাপ ও ইতিমধ্যেই ঠিক করে নিয়েছে। আমি যদি সম্মত হই তবে সেই ভাবেই এগোনো যেতে পারে।

ঠিক আছে, বলো শুনি তোমার রোডম্যাপটা কেমন। রব্বানি বলা শুরু করলো

১। বাবুর মাধ্যমে শেষ চেষ্টা করতে হবে এরশাদকে আওয়ামীলীগের কাছ থেকে সরিয়ে বাইরে নিয়ে আসার। যাতে তার দল বিএনপির ভোট কাটতে না পারে।

২। খালেদার আর্থিক সঙ্গতির জন্য বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোতে যেখানে আমাদের পূর্বপরিচিত প্রভাবশালী বন্ধু-বান্ধব রয়েছে তাদের মাধ্যমে ঐ সমস্ত দেশের ক্ষমতাসীনদের বুঝিয়ে খালেদাকে অর্থের যোগান দানের জন্য সম্মত করার চেষ্টা করতে হবে।

৩। অস্তিত্ব রক্ষার এই লড়াইয়ে অতীতের সব তিক্ততা ও ব্যবধান বাদ দিয়ে জামায়াত এবং বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে অন্যান্য সমমনা ভারত বিরোধী ছোট ছোট দলগুলোকে সাথে নিয়ে নির্বাচনী মোর্চা গঠনে বাধ্য করতে হবে।

৪। আমাদের প্রচেষ্টার চারণভূমি হবে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ, গণচীন এবং পাকিস্তান। আমরা যদি যুক্তি দিয়ে আমাদের প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মহলে পেশ করতে পারি তবে পাকিস্তানই হতে পারে এই প্রজেক্টের মূল সমন্নয়কারি চালিকাশক্তি।

৫। নির্বাচন কালে ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সামরিক বাহিনীকে ডেপ্লয় করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। গভীর মনোযোগের সাথে রব্বানির উপস্থাপনা শুনে বললাম

অতি উত্তম। তোমার রোডম্যাপ সম্পর্কে কোনও দ্বিমত কিংবা প্রশ্ন নেই আমার। আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করে কালবিলম্ব না করে আমাদের কার্যক্রম শুরু করে দেই, কি বলো?

তাই করা উচিৎ।

তা হলে, কাল পরশুর মধ্যেই আমি লন্ডন হয়ে আসি?

পরশু কেনো কালই চলে যাও বন্ধু। শুভস্য শীঘ্রম।

ঠিক আছে।

তাঞ্জানিয়াতে ট্যুরে যাচ্ছি বলে, দারুস সালাম থেকে লন্ডন এসে পৌঁছালাম। পৌঁছেই বাবুর সাথে যোগাযোগ করলাম। বাসার সবাইকে বললাম বিশেষ কাজে লন্ডন এসেছি, তাই খবরটা গোপন রাখতে হবে। বাবু খবর পেয়েই এসে আমাকে ওদের বাসায় নিয়ে গেলো। যোগাযোগ হল জেনারেল এরশাদ এবং ডেইজি ভাবীর সাথে। মোহাম্মদের মাধ্যমে পতিত রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ এবং ডেইজি ভাবীর সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পেলো বাবু এবং নেলি। বাবু নিজেই জেনারেল এরশাদকে আমার কথাগুলোই আবার বুঝিয়ে বলল এখনো সময় আছে। আপনি আপাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে বেরিয়ে আসুন। ডেইজি ভাবীকে জোর দিয়ে বাবু এবং নেলি দুইজনই বললো, দুলাভাই-এর কোনও কথাতেই যুক্তি নেই। তাই অশুভ পরিণাম থেকে বাঁচতে হলে তাদের দেশ থেকে বাইরে আসা ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই। তাদের দেশ থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে অবিলম্বে, তা না হলে সেই রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাবে সহসাই। তখন আর কিছুই করার থাকবে না। আমাদের অনুরোধে ডালিম ভাই গোপনে লন্ডন পর্যন্ত এসেছেন যাতে করে দুলাভাইকে সবাই মিলে দেশের বাস্তব অবস্থা বুঝিয়ে রাজি করানো যায় দেশ ছাড়ার জন্য। বাবু, নেলি এবং ভাবীর জোরের মুখে এরশাদ কিছুটা দোটানায় পরে জানালেন

আগামীকাল তিনি তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন। এরপর বাবু আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেলো। ফিরে এসে যোগাযোগ করলাম খালেদা জিয়ার সাথে। বললাম

এরশাদকে দেশ থেকে বের করে আনার শেষ চেষ্টা করছি। আগামীকাল তিনি তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন। কিন্তু বেগম জিয়া জানালেন

এদিকে হাসিনা সেই রাস্তা বন্ধ করার জন্য প্রেস কনফারেন্স করতে যাচ্ছে জানতে পারলাম। সেখানে হাসিনা হুঁশিয়ার করে দিয়ে দেশবাসীকে বলবেন তিনি জানতে পেরেছেন কিছু লোক ক্ষমতাচ্যুত দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসক যাতে দেশত্যাগ করতে পারে সেই চেষ্টা করছে। সেটা কিছুতেই হতে দেবে না দেশের জনগণ এবং আওয়ামীলীগ। এরশাদকে অবিলম্বে শ্রীঘরে পাঠানোর দাবিও তুলবেন হাসিনা। এই অবস্থায় তার প্রেস কনফারেন্সের আগেই যদি এরশাদ দেশ না ছাড়েন তাহলে পরে তাকে বিদেশে পাঠানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। বললেন খালেদা জিয়া। খুবই যুক্তিসঙ্গত কথা।

আচ্ছা, আমি দেখছি কতটুকু কি করতে পারি। অবস্থা ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হতে চলেছে। খালেদা জিয়ার কথায় উদ্বিগ্ন হয়ে তক্ষুনি বাবুকে ফোন করে বললাম আমাকে তার বাসায় নিয়ে যেতে। মিনিট দশেকের মধ্যেই বাবু এসে পৌঁছালো।
কি ব্যাপার ডালিম ভাই, এত জরুরী তলব! জরুরীই বটে। এইমাত্র খালেদা জিয়ার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম দেশের অবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। বাবুকে খালেদার আলাপের সার সংক্ষেপ খুলে বললাম। সব শুনে বাবু হতাশায় ভেঙ্গে পড়লো। তার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম

ভেঙ্গে পড়ার সময় এটা নয় বাবু, রাজনীতির খেলায় এখন সময় খুবই কম। তাই সময় নষ্ট না করে জেনারেল এরশাদকে শেষবারের মতো বোঝাতে চেষ্টা করতেই হবে। সে জন্যই তোমাকে আবার ডেকে পাঠাতে বাধ্য হলাম।

আবার গিয়ে উপস্থিত হলাম বাবুদের বাসায়। ফোন করলাম জেনারেল এরশাদকে।

স্যার, হয়তোবা আপনার সাথে শেষবারের মতো কথা বলছি। আমি আপনার শত্রু নই। আমি আপনাদের দু’জনকেই শ্রদ্ধা করি ব্যক্তিগত ভাবে। তাই অতি বিনয়ের সাথেই বলছি নতুন ফাঁদে পা ফেলে কেনোও বাকি জীবনটা গোলাম হয়ে থাকতে চাইছেন? ভাবীকেও কেনো কষ্টে ফেলছেন? এই বয়সে এই ধরনের কাজ কি শোভা পায়? Enough is enough, Sir.

বাবু খালেদা জিয়া থেকে সদ্যপ্রাপ্ত খবরটা জানিয়ে আকুতি জানাতে লাগল দেশ ছেড়ে আসার জন্য।

এরশাদ সবাইকে হতবাক করে দিয়ে বললেন খবরটি কিছুতেই সত্য হতে পারে না। কারণ, নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা না পেলেও তিনি আওয়ামীলীগের সাথেই কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন সেটাই ঠিক হয়ে আছে। সেক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ প্রধান হাসিনা এ ধরনের দাবি কিছুতেই উত্থাপন করতে পারে না তাদের স্বার্থেই। তিনি দেশে থেকেই রাজনীতি করবেন এবং আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তার নেতৃত্বেই সরকার গঠন করবেন তিনি। ক্ষমতার মোহ জেনারেল এরশাদকে সম্পূর্ণভাবে অন্ধ করে তুলেছে। তার একগুঁয়েমিতে এখানে বাবু নেলি আর ঐদিকে ডেইজি ভাবী কাঁদছেন। এমন একটা বিদঘুটে অবস্থায় পড়তে হবে সেটা জানা ছিল না। শেষবারের মতো রিসিভার হাতে নিয়ে আমি বললাম

স্যার, যখন থেকে আপনি আর আপনার দোসররা গৃহবন্দী হয়েছেন আপনারা তো নিজেদের মধ্যেও যোগাযোগ করতে পারছেন না, তাই না? সেই অবস্থায় আমি কেনো আপনার সাথে এবং খালেদা জিয়ার সাথে যেভাবেই হউক নিজ থেকেই যোগাযোগ করলাম? এতে আমার কি স্বার্থ সেটা একটু বুঝিয়ে দিলে কৃতার্থ হতাম। থমকে গেলেন এরশাদ। সত্যি, এতে তোমার কি স্বার্থ সেটা তো ভেবে দেখিনি! তাহলে এখন ভেবে বলুন। কেনই বা বাবু আর নেলির অনুরোধে গোপনে এখানে এসে আপনার সাথে এতো কথা বলছি দয়া করে তার কারণটাও বুঝিয়ে দিন।

হয়তো তুমি আমাদের ভালবাসো। তাই এ ছাড়া অন্য কোনও কারণ ভেবে পাচ্ছি না। তুমি একজন নির্লোভ, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। নিজের জন্য কখনোই তোমাকে কারো কাছেই কিছু চাইতে দেখিনি আমি।

আপনার জবাবটা আংশিক সত্য। তবে আর একটা কারণ রয়েছে। সেটা হল, এই মুহূর্তে দেশের চলমান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কি ঘটছে সেই সম্পর্কে আমি হয়তো আপনার কিংবা খালেদা জিয়ার চেয়ে বেশি না হলেও কিছুটা অবগত। আমি কিন্তু অনুমানভিত্তিক কোনও কিছুই বলছি না। যা বলছি সেটা তথ্যভিত্তিক। এটা খালেদা জিয়া মেনে নিয়েই আমার সাথে কথা বলছেন। আমার অনুরোধেই উনি জিয়া হত্যা সম্পর্কে আপনার ভূমিকার প্রায় সবকিছু জানার পরও আপনাকে সপরিবারে দেশের বাইরে চলে আসার ব্যাপারে সব বন্দোবস্ত করে দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। এই বন্দোবস্ত করাটা খুব সহজ ছিলো না। কিন্তু আপনি দুঃখজনক হলেও বাস্তবতাকে মেনে নিতে চাইছেন না। তাহলে কি বুঝবো আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না?

তোমাকে আমি অবিশ্বাস করবো সেটা তুমি ভাবলে কি করে?

ভাবতে আপনি বাধ্য করলেন, স্যার। এরপরও শেষবারের মতো অনুরোধ জানাচ্ছি, আজকের রাতের মধ্যেই বেরিয়ে আসুন। বাবু যা বলেছে তার সত্যতা কালকের মধ্যেই প্রমাণিত হয়ে যাবে। আপনি দেশে জেলবন্দী অবস্থা উপভোগ করতে চান নাকি বিদেশে মুক্তঅবস্থায় থাকতে চান- এটাই এখন আপনার বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিৎ। আমার কথা না হয় ছেড়েই দেন, এখানের সবাই যেভাবে আপনাকে মিনতি জানাচ্ছে, তাদের কথা আপনার মেনে নেয়া উচিৎ ছিল। এখন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় আমি বলবো মানুষ হিসাবে আপনি অতি স্বার্থপর এবং ক্ষমতালোভী। সেনাবাহিনীর আপনার পালিত জেনারেলরা তো আপনাকে মসনদে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হল। ফলে, আপনারা সবাই এখন গৃহবন্দী। আওয়ামীলীগ আর জামায়াত বাতাস বুঝে আপনাকে পরিত্যাগ করল। চাপে পড়ে আপনাকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। আপনার এই দুর্দিনে আপনার বিদেশী প্রভুরা কেউই এগিয়ে এলো না আপনাকে উদ্ধার করতে? তারা সবাই এখন আপনাকে কি করে Toilet Paper হিসাবে ব্যবহার করা যায় সেটাই ভাবছে। এ সমস্ত খবরাখবর জানার পরও আপনি দিবাস্বপ্নতেই বিভোর, এটা সত্যি বিস্ময়কর! আপনি অবগত নন, বর্তমানে দেশের মানুষ আপনার প্রতি এতোটাই ক্ষুব্ধ যে আপনাকে নাগালের মধ্যে পেলে তারা আপনার সুগঠিত শরীরটাকে বটি বটি করে চিল আর শকুনকে খাওয়াতো। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যেই সুযোগটা সৃষ্টি করেছিলাম সেটার কদর যখন আপনি করলেনই না এর পরিণতিটা কি হবে সেটা আপনি অচিরেই দেখতে পাবেন। আমার এই প্রচেষ্টায় আন্তরিকতার কমতি ছিল না। অতএব ঘটনা ঘটার পরও বিকারগ্রস্ত হয়ে আপনি একই কথা বলে চলেছেন, আগামী নির্বাচনে জিতে আপনিই আবার সরকার বানাবেন। সেই কারণে আপনি দেশত্যাগের সুযোগটা গ্রহণ করবেন না!

হ্যাঁ, ঠিক তাই।

খুবই ভালো। আমিও দেখবো অদূর ভবিষ্যতে পতিত স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের শেষটা কেমন হয়। এখন থেকে আমার আর কোন দায়িত্ব রইলো না। আপনার সাথে মোহাম্মদের আর আলাপ হবে না। নিয়তি থেকেই শিক্ষা নিতে হবে আপনাকে। ভাবীকে বললাম, আপনি আল্লাহ্‌র সাথে রুজু রাখবেন, তিনিই ভবিষ্যতে আপনার সহায় হবেন। আমরাও দোয়া করবো। আল্লাহ্‌ হাফেজ। বাবু বললো

ডালিম ভাই, আপনার কাছে আমরা চিরঋণী থাকবো। ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করবো না। আল্লাহ্‌ আপনার মঙ্গল করুন। বাবু আর নেলিকে সান্ত্বনা দিয়ে ফিরে এলাম বাসায়।

পরদিনই হাসিনার প্রেস কনফারেন্সের খবর প্রচারিত হল। এরশাদ এবং তার পরিবারকে বন্দী করা হয়েছে। তাদের গুলশানের বাড়িটাকেই ‘সাব জেল’ আখ্যায়িত করে সবাইকে সেখানে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে আওয়ামীলীগ জোর দাবি জানাচ্ছে, স্বৈরশাসক এর স্থান সাব জেল নয়, তাকে পাঠাতে হবে নাজিমুদ্দিন রোডে। ফিরে এলাম নাইরোবিতে। সব কিছু জানালাম পরম বন্ধু রব্বানিকে। সব শুনে রব্বানি ভবিষ্যদ্বাণী করলো জেলে থেকে এরশাদ নির্বাচনে তেমন বিশেষ কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না। তবে বিগত রাষ্ট্রপতি হিসাবে কিছু সিট পাবে বিশেষ করে রংপুর আর উত্তর বঙ্গে। সেটাই হয়তো হবে তার রক্ষাকবচ।