রুহানী জগতের আর এক সূফি সাধকের সান্নিধ্যে

পরদিন যথাসময়ে গিয়ে পৌঁছালাম ক্যান্টনমেন্টের মেইন গেইটে। আমি গিয়ে বসলাম নবির পাশে। নবির গাড়ী থেকে এক ভদ্রলোক নেমে আমার গাড়ীর ড্রাইভার-এর পাশে গিয়ে বসলেন গাইড হিসাবে। মিনু আর বেনু ফুপ্পুকে দেখে নবি ত্রস্তে নেমে গিয়ে সালাম করে বললো

এতো আমার সৌভাগ্য দুই ফুপুই এসেছেন। কেয়া আর মানুও রয়েছে দেখছি! বড়লোক হয়েছো শুনেছি, তাই বলে গরীব ফুফুকে ভুলে গেলে কি করে? মিনু ফুপ্পুর প্রশ্ন।আসতে পারিনি কোনও এক বিশেষ কারণে। কিন্তু ফুপ্পু, ঝুনু তো আপনাদের খোঁজ খবর সব সময়েই নিতো। তাছাড়া আমিও তো ফোনে খবরা-খবর নিতাম মাঝে মধ্যে। তা নিতে, তবে মায়ের মন তো তাতে ভরে না বাবা। অশ্রুসিক্ত নবি আবেগে ধরা গলায় বললো

ফুপ্পু, দুঃসময়ে আপনি যেভাবে ঝুনু আর বাচ্চাদের দেখে রেখেছিলেন, সেটা আপনার এই ছেলের পক্ষে কি করে ভুলে যাওয়া সম্ভব? ঝুনুকে পাঠাতাম, কিন্তু নিজেকে অতিকষ্টে সামলে নিতাম। কারণ, জেল থেকে বেরিয়ে নিজেদের হাতে গড়া এই ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কোনোদিন ঢুকবো না প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আপনাদের কাছ থেকেই শিক্ষা পেয়েছি শপথ নিলে তার মর্যাদা প্রাণ দিয়ে হলেও রক্ষা করতে হয়। কাক্কু আর আপনি সেটা প্রায়ই আমাদের বলতেন। তাই আজ আমরা মিলিত হচ্ছি গেটের বাইরে। আপনাদের আসার আগে MP Check Post এর Duty Commander আমাকে গাড়ীতে দেখে ছুটে এসে সাল্যুট করে বলল
স্যার, আপনি এখানে থেমে পড়লেন? প্রতিজ্ঞা না ভাঙ্গার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে এক কাপ গরম চা নিয়ে এসে অতি শ্রদ্ধার সাথে বলল স্যার, এটা আমাদের সবার তরফ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে। চৌকি থেকে সবাই তখন বেরিয়ে এসে লাইন করে দাঁড়িয়ে স্যালুট করে আমার দিকে মিনতি ভরা চোখে তাকিয়ে। সেই আন্তরিকতা আমাকে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিতে বাধ্য করলো। ঠিক সেই সময় ঝাণ্ডা উড়িয়ে কোনও এক পদস্থ সেনা অফিসারের গাড়ী বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কেউ সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করলো না।

সেটাই স্বাভাবিক বাবা, অফিসার হিসেবে তোমাদের মর্যাদা সৈনিকদের অন্তরে আর অন্যান্যদের শুধুমাত্র পদমর্যাদায়। সম্মান আল্লাহ্‌র দান। আমরা সবাই তোমাদের জন্য গর্বিত।

নবি ফেরার পর আমাদের দুই গাড়ীর কাফেলা যাত্রা শুরু করল।পাক মটরস এ আসার পর নবি গাড়িী থামালো। পেছনের গাড়ীটাও থেমে পড়লো। নবির ইশারায় পেছনের গাড়ী থেকে ভদ্রলোক ও ড্রাইভার নেমে আমাদের কাছে এলেন। নবি নির্দেশ দিলো, যাত্রীদের সবাইকে তার গাড়ীতে বসিয়ে আমার গাড়ীটা ফিরে যাবে। বিচক্ষণ নবি, আমি সবি বুঝতে পারছিলাম। সব কিছুই করা হচ্ছে নিরাপত্তার কথা ভেবে। ড্রাইভারকে আমি বললাম, ভদ্রলোককে যেখানে যেতে চান নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে যেতে। সবাই এসে নবির নতুন রেঞ্জরোভারে উঠে বসলাম। নবি চালক আর আমি পাশে সাথে রয়েছে দুইটি পিস্তল আর নবির SMG. সবগুলোই লাইসেন্সড। তাছাড়াও নবির কাছে রয়েছে তার ওয়ারলেস টেলিহ্যান্ড সেট। এপথ ওপথ ঘুরে যাত্রাবাড়ি হয়ে গাড়ী এগুচ্ছে নরসিংদীর দিকে। আচ্ছা নবি, আব্বা হুজুরের কোনো নাম আছে নাকি? হ্যাঁ, মাস্তান শাহ্‌। মনে পড়ে গেল হযরতজীর মুখচ্ছবি। তার নাম মান শাহ্‌। নবি জানালো তিনি কখন কোথা থেকে এসেছেন, কত বয়স সেটা স্পষ্ট করে কেউ কিছুই বলতে পারে না। তার খানকার পরিবেশটাও একটা গৃহস্থবাড়ির মতো। সংসারী মানুষ। ক্ষেত-খামার করেই উপার্জন করেন জীবিকা। দিনে কতবার গোসল করেন তার হিসেব নেই। আশ্চর্য! অদ্ভুত মিল রয়েছে দু’জনের মধ্যেই! অতিথিদের আপ্যায়ন করেন নিজের ক্ষেতের চাল, পুকুরের মাছ, গৃহপালিত হাঁস-মুরগি, বাগানের শাক-সবজি দিয়ে। প্রয়োজনে পালিত গরু, খাসিও জবাই করা হয়। কথা বলতে বলতে পৌঁছালাম নরসংদীর শহরতলীতে সবুজে ঘেরা শান্ত পরিবেশে এক মসজিদের গাড়ী রাখার জায়গায়। মসজিদের সামনে বিশাল চত্বর। পাশেই একটি একতলা দালান। তাতে রয়েছে বড় একটি হল ঘর আর বেশ কয়েকটি থাকার ছোট ছোট ঘর। নবি জানালো, বড় ইস্তেমায় হল ঘরটাও লোকে ভরে যায়। মূলত মসজিদ, চত্বর আর পাকা বাড়িটা নিয়েই বাবার খানকা এক নির্মল সবুজ শান্ত পরিবেশে। মসজিদের পেছনে দুইদিকে প্রশস্ত বিশাল জায়গা নিয়ে বাবার বসত বাড়ি। পুরো জায়গাটাই প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বাইরে থেকে উঁচু উঁচু গাছের মগডালগুলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। মসজিদ থেকে একটু দূরে রয়েছে একটি গেট।নবি আমাদের ঐ ফটকের সামনেই নিয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম, দেয়াল ঘেরা জায়গাতে ঢোকার ফটক সেটা। বেল টিপতেই এক তরুণ সহাস্যে ফটক খুলে দাঁড়ালো সাদর অভ্যর্থনা জানাতে। উঠানে বিভিন্ন মৌসুমি ফুলের কেয়ারি। টিনের ছাদের ইটের বেশ কয়েকটি বিল্ডিং নিয়ে বাবার বসত বাড়িটি ঘিরে রয়েছে মনে পড়ার মতো সব রকমের দেশি এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের ফলের গাছ ও গুচ্ছের আচ্ছাদন।একটা বিল্ডিং এর বারান্দায় পাটি বিছানো। সেখানেই আমাদের বসিয়ে তরুণ ছেলেটি অন্দর মহলে চলে গেলো। চারিদিকে শান্ত পরিবেশ, লনের এক কোণে রাখা দানা আর পানির পাত্র ঘিরে এক ঝাঁক পায়রা, বুলবুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দানা খাচ্ছে নির্বিকারে। সাথে রয়েছে বেশ কয়েকটি শালিক, চড়ুই আর ঘুঘু পাখিও।

আমরা মৌসুমি ফুলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। বাবা বেরিয়ে এলেন তার স্ত্রী আর দুই তরুণী কন্যাকে সাথে নিয়ে। তার পরনে একটা লুঙ্গি। মাঝারি আকৃতির বাবার গায়ে কোনও কাপড় নেই কাঁধে একটা গামছা। কাঁচাপাকা ঘাড়অব্দি বাবড়ি চুল, মুখে মানানসই দাড়ি গোঁফ। মুখে স্মিতহাসি। তার স্ত্রীর পরনে আটপৌরে একটা তাঁতের শাড়ি, মেয়েদের পরনে সালওয়ার কামিজ। মাথায় রয়েছে দোপাট্টা। বাবার চোখ দুটো জ্যোতির্ময়। ঝকঝকে এক পাটি দাঁত। শ্যামবর্ণের সাধককে সুদর্শনই বলা চলে। সবাই আমাদের আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালো। পরিচয় এবং সালাম-দোয়া পর্বের পর তিনি আমাদের সাথে নিয়ে বসলেন। ইতিমধ্যে একটি মেয়ে কখন উঠে গিয়ে একটা মোটা বেলি ফুলের মালা এনে নিম্মির সুদীর্ঘ বেণীতে ক্লিপের সাহায্যে আটকে দিয়ে বললো দেখো আম্মু, বুবুর চুল কি সুন্দর, আর মালাটা কেমন মানিয়েছে, দেখো দেখো বাবা! বাবা নিম্মির দিকে চেয়ে বললেন মেয়ে আমার রাজকুমারী।
আর একটা ধাক্কা খেলাম! বিস্ময়! হযরতজীও একই কথা বলেছিলেন নিম্মিকে দেখে!মেয়েটি বললো বুবু, মালাটা কিন্তু আমি নিজ হাতে সকালে ফুল কুড়িয়ে গেঁথেছি, বাজার থেকে কেনা নয়।

নিম্মি মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে জিজ্ঞেস করলো বেলিফুলের মালা চুলে বাঁধতে আমার খুব ভালো লাগে, সেটা তুমি বুঝলে কি করে বলতো? আমি প্রতিদিন মালা গেঁথে বাবার গলায় পরিয়ে দিই। আজ যখন তাকে মালা পরাতে গিয়েছিলাম তখন তিনি বললেন

ওটা আজ একজন বিশেষ অতিথির জন্য পানিতে রেখে দে, ওটা তাকেই বেশি মানাবে। আপনাকে দেখে বুঝতে কষ্ট হয়নি বাবা আপনার জন্যই ওটা রেখে দিতে বলেছিলেন।

ইতিমধ্যে ধুমায়িত চা, সাথে চিঁড়েভাজা আর কয়েক রকমের পিঠা পরিবেশিত হয়েছে।

বাবা নিম্মিকে ইশারায় তার পাশে বসতে আহ্বান জানালেন, বসতেই নিম্মির মাথায় হাত রেখে বললেন আমার এই মেয়ে কোনও সাধারণ মেয়ে নয়, এই মেয়ে আমার অসাধারণ! আমরা সবাই নিশ্চুপ। মিনু ফুপ্পুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, নিম্মি বাবার স্নেহাশিষে অভিভূত হয়ে পড়েছিল বোধকরি। এরপর আমার দিকে চেয়ে বললেন তুমি অতি ভাগ্যবান, আল্লাহ্‌ তোমাকে আমার মেয়েকে দান করেছেন। নবি, তুইতো অনেককেই আমার এখানে নিয়ে এসেছিস। কিন্তু আজকের মতো আমি আর কাউকেই পাইনি, পাবো কিনা সেটাও জানিনা।

গৃহিণী বললেন তোমরা কথাবার্তা বলো আমি আসছি, বলে তিনি অন্দর মহলে চলে গেলেন। মিনু ফুপ্পু সজল চোখে মিনতি জানালেন বাবা, ওদের উপর বিপদের কালো মেঘ সব সময়েই ছেয়ে থাকে। আপনি ডালিম আর নিম্মির জন্য খাস দোয়া করবেন। বাবা হেসে বললেন বোন! দোয়া তো না চাইলেও করবো, তবে আমার দোয়ার প্রয়োজন নেই। আমার মেয়ের দোয়াই যথেষ্ট। বলে আবার নিম্মির মাথায় সস্নেহে তিনি হাত রাখলেন। ইশারাটা বুঝতে কারো কোনও অসুবিধে হল না। কিছুক্ষণের জন্য মনে হল বাবা চোখ বুঁজে ধ্যানমগ্ন হয়ে অন্য জগতে চলে গেলেন। আমরা সবাই নিশ্চুপ বসে ছিলাম। চোখ খুলে স্বাভাবিক হয়ে বাবা বললেন দেখে শুনে, বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে কতটুকুই বা বোঝা যায়? সৃষ্টিরহস্য অতি জটিল। সীমাহীন এর পরিব্যাপ্তি। হঠাৎ সরাসরি নিম্মির দিকে চেয়ে বাবা অনুরোধ জানালেন, তুমি যদি তোমার বুড়ো ছেলেকে অনুমতি দাও তবে আমি একটা সিগারেট খেতে চাই। নিম্মি হতবাক হয়ে মুখ তুলে বাবার দিকে চেয়ে বললো আমি অনুমতি দেবো! ওর দু’চোখও তখন অশ্রুসিক্ত। হ্যাঁ, তোমার অনুমতিই আমার প্রয়োজন। নিম্মি আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। তার চোখ থেকে অশ্রুবন্যা গড়িয়ে পড়ছে, সমস্ত শরীর কাঁপছে এক অদ্ভুত শিহরণে। বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন কাঁদছো কেনও? বলোখাবো কি খাবোনা? মুখে কিছুই বলতে পারলো না নিম্মি, মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালো। তাকে বেসামাল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দেবার জন্য মেয়েরা নিম্মিকে বললো

বুবু, চলুন আপনাদেরকে ভেতরে নিয়ে যাই। তারপর আপনাদেরকে দেখাবো আমাদের বাগান, দীঘি, হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়। সস্তিসহ নিম্মি, মিনু ফুপ্পু, বেনু ফুপ্পু, কেয়া আর মানুকে সঙ্গে নিয়ে তারা ভেতরে চলে গেলো। তারা চলে যাবার পর বাবা নবির কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে ধরিয়ে নবিকেও বললেন একটা ধরাতে। আমার দিকে চাইতেই নবি জানান দিলো আমার ধূমপানের অভ্যাস নেই। ভালো ভালো, এই বদ অভ্যাসটা থেকে দূরে থাকা সহজ নয়। নিম্মিরা চলে যাওয়ায় পরিবেশটা হাল্কা হয়ে উঠল। প্রসঙ্গ পালটে আমি জিজ্ঞেস করলাম বাবা, মানবকুল মানেই তো আল্লাহ্‌র খলিফা, তাহলে বিশ্বজোড়া এত হিংস্রতা, মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি কেনও? বাবা হেসে বললেন এটাও একটা রহস্য! সোজা কথায়, এই জাগতিক জীবনটা পরীক্ষার হলে বসে থাকা কিছুটা সময়। এই পরীক্ষার ফলের উপরেই নির্ভর করছে ইহকাল এবং অনন্ত পরকালের জীবনের পরিণাম। তাই প্রতিটি মানুষকে চেষ্টা করতে হবে যাতে পরীক্ষাটা যতটুকু সম্ভব ভাল দেয়া যায়। এর জন্য সৃষ্টিকর্তার রহমত এবং করুণা ভিক্ষা করতে হবে যাতে তার প্রদত্ত সিলেবাসটা ভালো করে বুঝে নিয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়া যায়। জাগতিক জীবনের পরীক্ষার যেমন বিভিন্ন স্তর আছে তেমনই আধ্যাত্মিক জীবনেও বিভিন্ন স্তর রয়েছে। জাগতিক এবং আধ্যাতিক জিবনের সব চাওয়া পাওয়ার হিসেব আন্তরিক একাগ্রতা, প্রশ্নাতীত বিশ্বাস এবং নিরলস সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে সৃষ্টিকর্তা ইচ্ছে করলে তার পূর্ব নির্ধারিত নিয়তি বদলেও দিতে পারেন যে কোনও সময়।

তার পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব। প্রতিটি মানুষকে নিজেকে আল্লাহ্‌র প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। যেদিন কোনও ব্যক্তি নিঃস্বার্থ ভাবে আল্লাহ্‌র গুণাবলীর বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে সেই দিনই মানুষ হিসাবে তার ন্যূনতম দায়িত্ব পালনে সে সক্ষম হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে। তবে এই কাজটা সহজ নয়। শয়তানের প্রলোভন রয়েছে প্রতি মুহূর্তে, সত্যের পথ থেকে ভ্রান্ত পথে বিপথগামী করার।

এই টানাপড়েনের মধ্যে সত্যকে বেছে নেয়াটাই হচ্ছে আসল পরীক্ষা। নিজস্ব চেষ্টা এবং সাধনার মাধ্যমে যকোনো মানুষ নিজেকে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে নিতে সক্ষম জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক দুই ক্ষেত্রেই। তবে যতই উপরে উঠবে তার জন্য কঠিনতর হয়ে উঠবে জাগতিক কিংবা আধ্যাত্মিক জীবনের পরীক্ষা। হঠাৎ করে বাবা আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন চলো, তোমাদের আমার ছোট্ট দুনিয়াটা দেখাই। তিনি আমাদের ফলের বাগান, ধানক্ষেত, গরু ও ছাগলের খামার, হাঁসের খামার, মুরগির খামার, শাক-সবজির বাগান, মাছের পুকুর সব কিছুই ঘুরে ঘুরে দেখালেন। সবখানেই সুপরিকল্পিত পরিচালনার ছাপ। ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে মেয়েরাও ফিরে এসেছে। তখন আমরা সবাই স্বাভাবিক। দুপুরে অতি সাধারণ কিন্তু সুস্বাদু ব্যঞ্জনের সাথে খাওয়ার পাট চুকিয়ে পানের বাটা ঘিরে বসলাম সবাই। হাল্কা কথাবার্তায়, হাসি ঠাট্টায় এক আনন্দঘন পরিবেশের মাঝে আমরা ডুবে গেলাম। ফুরফুরে হাওয়ায় গাছের পাতার টুপটাপ ঝরে পড়ার শব্দ, নাম জানা এবং নাম না জানা পাখিদের কলকাকলি, হাঁস-মুরগীর চির পরিচিত আওয়াজ পরিবেশকে আরও মনোরম করে তুলেছিল। আচমকা একঝাঁক সবুজ টিয়া উড়ে এসে বসলো ইউক্যালিপটাস গাছে। ওয়াক্তের নামাজ আদায় করছিলাম সংলগ্ন মসজিদে জামায়াতের সাথে। সন্ধ্যার আগেই ফেরার কথা। হঠাৎবাবা বললেন আজ তোমরা রাতটা এখানেই থেকে যাও।

এই সুন্দর মনোরম পরিবেশে থাকতে কারোই আপত্তি থাকার কথা নয় কিন্তু আমার ও নিম্মির রাতে একটা দাওয়াত রয়েছে। তাই কিছুটা ইতস্তত ভাবেই বললাম

বাবা, রাতে আজ আমাদের একটা পূর্বনির্ধারিত দাওয়াতে যেতে হবে। তাই ইচ্ছে থাকলেও আজ থাকা সম্ভব নয়। তবে আল্লাহ্‌র মর্জি হলে আবার আসবো হাতে বেশি সময় নিয়ে। অল্পদিনের ছুটি, তাই সবদিক রক্ষা করে চলতে কিছুটা সময়ের ঘাটতি পোহাতে হচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই আকাশে কালো মেঘ জমে উঠছিলো। বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করেছে। ঝড়ের পূর্বাভাস। বাবা আবারও বললেন বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে থেকেই যাও। আবহাওয়ার অবস্থা তো ভাল ঠেকছে না। আমি বললাম এক-দেড় ঘন্টার পথ ঝড়ের আগেই পৌঁছে যাবো। বাড়ির সবাই জোর আবদার করছিলো থেকে যাবার জন্য। কিন্তু নিতান্ত অপারগ অবস্থায় বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। নবি গাড়ী চালাতে চালাতে বলছিলো বাড়ির সবাই যখন এতো করে অনুরোধ করছিলো থেকে যাবার জন্য তখন থেকে গেলেও পারতিস। দীর্ঘদিন যাবত আমি বাবার এখানে আসছি, তিনি আমাকে অত্যধিক স্নেহ করেন। কিন্তু আমাকেও এভাবে তিনি কখনই রাতে থাকতে অনুরোধ করেননি। আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্রতী সাধকদের বোঝা মুশকিল। তাদের প্রকাশ ভঙ্গিতে কেমন যেন একটা কুহেলিকা থেকে যায়।বাবাই বলেছিলেন, কোনো কিছু অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটে গেলে লোকে বলে দুর্ঘটনা। কিন্তু কার ইশারায় কিংবা ইচ্ছায় সেটা ঘটলো তার কোনও হদিস মানুষ আজ অব্দি পেতে অক্ষম। ইন্দ্রিয়লব্ধ জাগতিক জ্ঞানের যেখানে ইতি সেখান থেকেই আধ্যাত্মিক পথের যাত্রা। বৈজ্ঞানিকরাই বলে, কর্ম ও প্রতিফলের বৃত্তেই ঘটছে সবকিছু। এই যুক্তিটা দুর্ঘটনার বেলায় খাটে কি?প্রতিটি মানুষ এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয় কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে কিন্তু সেটা কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন, কে কি উদ্দেশ্যে জন্ম নিলো। উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেলেই তার প্রত্যাবর্তন ঘটে এক অজানা ঠিকানায়।আমরা বোকার মতো গর্ব করে বলি আমি এটা করেছি, আমি সেটা করেছি, কিন্তু আমরা মানতে নারাজ যে আমাদের হাতে কিছু করার কোনোও ক্ষমতাই নেই। যা কিছুই করি সেটাও ঘটে তারই ইচ্ছায়। কোথা থেকে এলো, কোথায় যাবে সেটা জানতে পেরেছে কি মানুষ এখনও? এক্সিডেন্ট হয় কেনও? অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে কেনও? যা হবার তা হয় না, আবার যা হবার নয় তা হয়ে যায় কেনও? এই সব কেনোর উত্তর যখন মানুষ পায় না তখন সেটাকেই বলা হয় ভবিতব্য! কিন্তু ভবিতব্যটা বানালো কে? এর জবাব নেই মানুষের।

অবিমিশ্র এই বক্তব্যগুলো আধ্যাত্মিক লোকের অসীম গভীরতার ইঙ্গিতই বহন করে। বাবার কথা-বার্তায় আর হযরতজীর কথাবার্তায় একটা অদ্ভুত মিল স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিলো আমার মনে।

যাত্রার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলো অস্বাভাবিক ভাবে। সাথে শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির আচ্ছাদন ভেদ করে অল্পদূরেও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হেডলাইট অকেজো হয়ে পড়েছে। মাঝে মধ্যে বিদ্যুতের চমকের সাথে কান ফাটানো বাজের শব্দ। প্রবল ঝড়ের মধ্যে পড়ে সবাই আতংকিত। আমি নবিকে বললাম কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না, গাড়ী চালিয়ে নিতে পারবি তো? জবাব না দিয়ে দক্ষচালক নবি অতি সতর্কতার সাথে গাড়ী ধীরগতিতে এগিয়ে নিয়ে চলছিলো। অকস্মাৎ তুমুল বৃষ্টির সাথে শিলপড়া শুরু হল। ফলে ভিজিবিলিটি আরও কমে গেলো। এই দুর্যোগের মধ্যেই ডেমরা ব্রিজ মাত্র পেরিয়েছি, তখন হঠাৎ নবির ব্র্যান্ড নিউ রেঞ্জরোভার থেমে গেলো! সবাই প্রায় এক সাথেই বলে উঠলাম

নবি গাড়ীর কি হল! নবি কয়েকবার সেলফ এর চাবি ঘোরালো থেমে যাওয়া গাড়ী স্টার্ট করার চেষ্টায়, কিন্তু গাড়ী স্টার্ট নিলো না। পথঘাট জনশূন্য। দুই দিকেই কোনও যানবাহনের নিশানাও নেই। নবি নিজেই একজন চৌকস ইলেকট্রিক্যাল এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। থমথমে গলায় নবি বললো বলেছিলাম না, বাবা এতো করে বললেন থেকে যাবার জন্য, কিন্তু শুনলিনা। যাক, তুই স্টিয়ারিং ধরে বস, আমি নেমে দেখছি কি হল বলে গাড়ীর বনেট খুলে হাতে একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ নিয়ে নেমে গেলো নবি।
পেছনে মহিলারা সবাই দোয়া-দরূদ পড়ছেন আল্লাহ্‌র করুণা ভিক্ষা করে। শিলাবৃষ্টির তীব্রতা তখন কিছুটা কমেছে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে নবি আমাকে ইশারায় সেলফ স্টার্টার অন করতে বললো। দু’ তিন বার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গাড়ী স্টার্ট নিলো না। নবির পরিধেয় কাপড় ইতিমধ্যেই ভিজে চুপসে গেছে। বনেট বন্ধ করে নবি আমার কাছে এসে দাড়ালো। কাঁচ নামিয়ে জিজ্ঞেস কোরলাম কি ব্যাপার?কিছুই বুঝতে পারছিনা, আপাতদৃষ্টিতে সবতো ঠিকই আছে দেখলাম। তাহলে এখন কি হবে? যাত্রাবাড়ী বেশি দূরে নয়। তোরা গাড়ীতেই অপেক্ষা কর, আমি দেখি ওখান থেকে কনও মেকানিক ধরে আনতে পারি কিনা।
মাথা খারাপ নাকি, এই বৃষ্টির মাঝে তুমি এতদূর যাবে পায়ে হেঁটে!অন্য কোনও উপায় নেই মিনু ফুপ্পু। না, এই বৃষ্টিতে তোমাকে যেতে হবে না, বৃষ্টি থামলে যাবে তুমি। এখন ভেতরে এসে বসো। এরপর নিম্মির ওড়না আর নিজের চাদরটা এগিয়ে দিয়ে বললেন
ভেতরে এসে ওড়না দিয়ে মাথা আর শরীর ভাল করে মুছে কাপড় ছেড়ে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নাও। সুবোধ বালকের মতো তাই করলো নবি। বৃষ্টি ধরে এলো কিন্তু কোনও মানুষজনের চিহ্ন নেই।যতদূর রাস্তা দেখা যায় দুইদিকেই ফাঁকা। বৃষ্টি তখনো গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে।আমি যাই ফুপ্পু, বৃষ্টি যতটুকু পড়ছে তাতে অসুবিধে হবে না। আর একটু সবুর করো। কথোপকথনের মধ্যেই আচমকা একজন জটাধারী মানুষের ছায়া ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আমাদের গাড়ির কাছে এগিয়ে এলো। খালি গা, পরনে লুঙ্গি আর হাতে একটা লাঠি। গলায় ঝুলছে রং বেরঙের পুঁতির একটা মালা আর কালো সুতোয় বাঁধা একটা রুপোর তাবিজ। ঘাড় অব্দি যত্নহীন বাবড়ি চুল। সারা মুখ ঢেকে আছে দাড়ি-গোঁফে। শরীর, দাড়ি-গোঁফ থেকে তখনও বৃষ্টির পানি ঝরছে। সব মিলিয়ে মাজারে যে সমস্ত সাধু-সন্ন্যাসী দেখা যায় তাদের মতই একজন।

নবির দিকের উইন্ডোতে টোকা দিলো লোকটা, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরে চলেছে। নবি কাচ নামাতেই লোকটা বলল গাড়ী বিকল হইয়া পড়ছে মনে হয়! নবি জবাব দিলো জি, তাই। ইঞ্জিনের কিছু খারাপ হয়ে গেছে। লোকটার চোখ দুটো জ্যোতির্ময়। সে বলল যাত্রাবাড়ী ছাড়া কোথাও মেকানিক পাওন যাইবো না। কথার সাথে সাথে বনেটে হাতের লাঠিটা ঠুকছিলো লোকটা। লোকটার উপস্থিতিতে সবাই কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিলো। তাই লোকটার দিকে তাকিয়ে মিনু ফুপ্পু ব্যাগ থেকে ১০০ টাকার একটা নোট বের করে নবিকে দিয়ে বললেন

এটা ওকে দিয়ে বিদেয় করো। গাড়ির জানালা দিয়ে নোটটা নবি লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিতেই আগন্তুক অবজ্ঞাভরে বনেটে সশব্দে একটা বাড়ী মেরে রাগত ভাবে বলে উঠলো

টাকা দিয়া সব হয় না, জানোস না গাধার বাচ্চা? আমারে ফকির মনে কইরা টাকা দিতে চাইলি ক্যান, আমি কি ভিক্ষা চাইছি? গাড়ী স্টার্ট কর বলেই পেছনের দিকে পা বাড়ালো জটাধারী লোকটা টাকাটা না নিয়েই। আমি বললাম সেলফটা অন করতো। নবি সেলফ ঘোরালো আর সাথে সাথেই গাড়ী স্টার্ট নিয়ে গর্জে উঠল সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে।
সবাই পেছনে তাকিয়ে দেখলাম সেই লোকটির কোনও হদিস নেই। জলজ্যান্ত লোকটা এভাবে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেলো! এটা কি তবে একটি অলৌকিক ঘটনা! সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে একে অপরের দিকে চেয়ে বলে উঠলাম সুবহান আল্লাহ্‌! সত্য লৌকিকতাকেও হার মানিয়ে দিলো! নবি নীরবে গাড়ী চালাচ্ছিল। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর পথে তেমন আর কথাবার্তা জমলো না। ক্যান্টনমেন্টের মেইন গেটের কাছে পৌঁছেই নবি তার ওয়ারলেস ফোন থেকে মোস্তাফিজ কাক্কুকে ফোন করতেই আমার গাড়ী এসে পৌঁছে গেলো কয়েক মিনিটের মধ্যে। মিনু ফুপ্পু নবিকে অনেক করে অনুরোধ করেছিলেন রাতের খাবার তার বাসায় খেয়ে যেতে। কিন্তু নবি তার প্রতিজ্ঞায় অটল থেকে ফুপ্পুর কাছ থেকে মাফ চেয়ে এবং সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চলে গেলো। বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল নুরুন্নবি খান বীরবিক্রমের সাথে সারাদিনের আধ্যাত্মিক জগতের যে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছিলাম সেদিন তা সারাজীবনে কখনোই ভুলবার নয়।