এ ভিএম তোয়াব আসছেন

এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে জমির এসে জানাল এয়ার চীফ এভিএম তোয়াব আসছেন আমাদের সাথে দেখা করতে। জমির খবরটা খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু আমরা এই খবরে তেমন উচ্ছ্বসিত হলাম না। কারণ, ফারুক-রশিদের মনোনীত তোয়াবের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সাহসের নমুনা আমরা জেনে গিয়েছিলাম ২-৩রা নভেম্বর রাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদের নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’দাতার পর যখন তাকে স্লিপিং স্যুট পরিহিত অবস্থায় ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের হেডকোয়াটার্সে বন্দী করে আনা হয়েছিলো। আমি ও নূর যখন খালেদ ভাই এবং তার দোসরদের সাথে আলোচনার জন্য কনফারেন্স রুমের দিকে এগুচ্ছিলাম তখনই বন্দী করে ধরে আনা হয়েছিলো জনাব তোয়াবকে। আহত পাখির মতো কাঁপছিলেন এয়ার চীফ এভিএম তোয়াব। আমাকে দেখে ধড়ে প্রাণ ফিরে পেয়ে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করছিলেন

ডালিম, তুমি এখানে! কি হচ্ছে বলতো?

তার ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থা দেখে অনুকম্পার সাথে বলেছিলাম পাশের ঘরে কর্নেল আমিন এবং ক্যাপ্টেন মুনিরের সাথে বসে দেখুন কি হচ্ছে।

৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও কর্নেল আমিন এবং এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন মুনিরকে ইতিমধ্যেই খালেদ-চক্র বন্দী অবস্থায় ঐ ঘরে বসিয়ে রেখেছে সেটা আমরা পৌঁছেই দেখতে পেয়েছিলাম। আমরা কনফারেন্স রুমে ঢুকে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। একপক্ষে আমি আর নূর অন্যপক্ষে ব্রিগেডিয়ার খালেদ, রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান, কর্নেল রউফ, কর্নেল সাব্বিউদ্দিন, কর্নেল শাফায়াত জামিল, কর্নেল মইনুল হোসেন, কর্নেল মান্নাফ, মেজর মালেক, মেজর হাফিজ, মেজর গফফার, লেফটেন্যান্ট ইকবাল, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ওবায়দুল কাদের (বর্তমানে আওয়ামী লীগের মহাসচিব), ক্যাপ্টেন কবির, লেফটেন্যান্ট নাসের, লেফটেন্যান্ট তাজ এবং আরো কয়েকজন তরুণ অফিসার। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত তখনও এসে পৌঁছায়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্দী অবস্থায় ধরে আনা হয়েছিলো ন্যাভাল চীফ রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খানকে। তারও অতি করুণ অবস্থা। জীবন ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। তারও পরনে স্লিপিং স্যুট। খবরটা দিতেই খানিকটা উষ্মার সাথেই তাকেও ঐ একই খোঁয়াড়ে ঢুকানোর নির্দেশ দিলেন খালেদ ভাই। পরবর্তীকালে জিয়া ভক্ত হয়ে মন্নাফ এবং মইনুল হোসেন দুইজনই পদোন্নতি পেয়ে জেনারেল এবং রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। ২-৩ নভেম্বর রাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদের ক্যুদেতা এবং ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে আমার আর নূরের সাথে আলোচনা সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা রয়েছে, ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ আমার প্রকাশিত প্রথম বইটিতে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২১শে বই মেলায় প্রতিকূলতার কারণে বইটির ছয়টি এডিশন দুই সপ্তাহের মধ্যে বিক্রি হয়ে যাওয়ায় এরপর সাধারণভাবে ছাপানো এবং প্রচারণা সম্ভব হয়নি সরকারের হুকুমে। পরে বইটি ইংরেজি এবং উর্দু ভাষায়ও প্রকাশ পায়। ৭ই নভেম্বর এর সিপাহী-জনতার বিপ্লব সম্পর্কেও তথ্যবহুল ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে আমার লেখা এবং প্রকাশিত ‘জাতীয় বিপ্লব এবং সংহতি দিবস ৭ই নভেম্বর, ১৯৭৫ এবং অব্যাহতি আইনসমূহ’ বইটিতে। এই বইটিও বাংলা এবং ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকদের পক্ষে বই দুইটি বর্তমানে বাজার থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে কিনা জানিনা। তবে প্রয়োজনবোধে হয়তো বই দুইটি প্রদত্ত ওয়েবসাইট দুটো থেকে বাংলা কিংবা ইংরেজিতে ডাউনলোড করে নিতে পারেন।

১। www.majordalimbu.com

২। www.majordalimbubangla.com

এই বই দু’টিতে এমন সব বস্তুনিষ্ঠ তথ্য এবং ঘটনার বিবরণ দেয়া রয়েছে যার থেকে পাঠক অতি সহজেই সত্য জেনে নিতে পারবেন।
বই দু’টির প্রকাশনার পর থেকে আজঅব্দি বই দু’টিতে যা কিছুই লেখা হয়েছে তার প্রতিবাদ কোনও মহল থেকেই করা সম্ভব হয়নি আলহামদুলিল্লাহ।

অবশ্য আওয়ামীলীগ সরকার ওয়েবসাইট দুটো কয়েকবার বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশী ভিউয়ারদের জন্য।

ফিরে চলি বেনগাজীতে।

এভিএম তোয়াব এলেন জমিরকে সঙ্গে নিয়ে। তার কাছ থেকে বাস্তবে ঘটনা প্রবাহ কোন পথে এবং চলমান অবস্থায় জিয়া কি করছেন এই সমস্ত বিষয়ে সব কিছুই জানা যাবে। দু’দিন থাকবেন আমাদের সাথে। ‘৭১-এর যুদ্ধের সাথে তার কোন সম্পর্কই ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের সাথেও তার তেমন কোনও সম্পর্ক ছিল না। কারণ, ‘৭১-এর আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানে তার পত্নী এক জার্মান মহিলার সাথে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন তোয়াব সস্ত্রীক জার্মানিতেই অবস্থান করছিলেন। আগস্ট বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর রশিদ আর ফারুকের অনুরোধে সেনা পরিষদের শীর্ষ নেতাদের সাথে আলোচনা কালে সেনা পরিষদের পক্ষ থেকে যখন তাদের জানানো হয় বিপ্লব সফল হলে জেনারেল ওসমানী হবেন ডিফেন্স এডভাইজার, জেনারেল খলিল হবেন জয়েন্ট চীফ অফ স্টাফ, জেনারেল জিয়াকে বানানো হবে আর্মি চীফ, এডমিরাল এম এইচ খান থাকবেন ন্যাভাল চীফ এবং মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপক্যাপ্টেন বাশার হবেন এয়ার চীফ- সেই সময় দুই ভায়রা বলে, আমাদের প্রস্তাবনাগুলো তাদের মেনে নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু তাদের একটি প্রস্তাব সেনা পরিষদকে মেনে নিতে হবে। সেটা হল, গ্রুপক্যাপ্টেন বাশার এর পরিবর্তে গ্রুপক্যাপ্টেন তোয়াবকে এয়ার চীফ বানাতে হবে। আমরা তাদের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলাম। কারণ, গ্রুপক্যাপ্টেন তোয়াব চাকুরিতে বাশারের চেয়ে সিনিয়র ছিলেন এবং পাকিস্তান এয়ারফোর্সের একজন চৌকস অফিসার হিসাবে পরিচিত। প্রেসিডেন্ট হিসাবে খন্দকার মোশতাক আহমেদ দুই পক্ষের কাছেই গ্রহণীয় ছিলেন বিধায় তাকে নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না। রশিদ এবং ফারুক কেনো গ্রুপক্যাপ্টেন তোয়াবকে এয়ার চীফ বানাতে চেয়েছিল সেই বিষয়টা এখনো সেনা পরিষদের শীর্ষ নেতাদের কাছে পরিষ্কার নয়!দুই দিনই এয়ার ভাইস মার্শাল এভিএম তোয়াবের সাথে আমাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হল। সঙ্গত কারণেই জমির আমাদের বৈঠকে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। এবারের সফরে জমির ছিল এয়ার চীফ তোয়াবের এস্করট। খোলামেলা আলোচনা হয়েছিলো আন্তরিক পরিবেশেই। প্রথমেই আমরা জানতে চাইলাম সামরিক বাহিনীর অবস্থা সম্পর্কে। জনাব তোয়াব জবাব দিলেন

বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে বহু মত আর পথের অনুসারী আছে। ইতিমধ্যে কর্নেল তাহের এবং তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে কঠোর ভাবে দমন করা হয়েছে, তবে এখনো সামরিক বাহিনীতে অস্থিতিশীলতা বিরাজমান। ক্ষণে ক্ষণেই বিভিন্ন ইস্যুতে বিস্ফোরণ ঘটছে। তবে জিয়ার নেতৃত্বে পদস্থ অফিসাররা সম্মিলিতভাবে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন Chain of Command পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তার বক্তব্যের পর কর্নেল পাশা প্রশ্ন করলো

স্যার, এই অবস্থাতে আমাদের কি কোনও করণীয়ই নেই? এভিএম তোয়াব খোলাখুলিভাবেই বললেন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য জোর দাবি জানানো হয়েছে সেনাকুঞ্জের দরবারে বিপ্লবীদের তরফ থেকে জিয়ার কাছে। জিয়া তাদের দাবির জবাবে ওয়াদাও করেছেন অতিসত্বর তোমাদের ফিরিয়ে নেবার ব্যবস্থা তিনি করবেন। কিন্তু ব্যবস্থা করার জন্য তাকে কিছুদিন সময় দিতে হবে। তার এই সময় চাওয়াটাকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিপ্লবীরা।

কর্নেল শাহরিয়ার বললো

এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা সশরীরে যদি তাদের পাশে উপস্থিত থাকতাম তাহলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার কাজে কোনও ব্যাঘাত ঘটতো বলে মনে করছেন কি জেনারেল জিয়া? জনাব তোয়াব স্পষ্ট জবাব দিলেন

তিনি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করেন আমরা ফিরে গেলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার কাজটা সবার জন্যই সহজ হতো। তাই জিয়ার সাথে এই বিষয়ে তার কয়েকবারই কথা হয়েছে। কিন্তু জিয়া রহস্যজনক ভাবে জবাবে তাকে জানিয়েছেন, আমাদের দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি তিনি নিজেই দেখবেন। তাছাড়া তিনি তাকে এটাও বলেছেন, আমাদের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে এবং সঠিক সময়ে তিনি আমাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনবেন। সময় নির্ধারণের দায়িত্বটা নাকি আমরাই তাকে দিয়েছি as he is on the ground.

তার এই বক্তব্য সম্পূর্ণ সত্য না হলেও আংশিক ভাবে সত্য। তাই শাহরিয়ার এই বিষয়ে আলোচনা না বাড়িয়ে প্রসঙ্গের ইতি টানলো। রশিদ এবং ফারুক তাৎক্ষণিক উত্তেজিত ভাবে বলে উঠেছিলো, জিয়ার সাথে আমাদের তো কোনও যোগাযোগই নেই। আমরা বাকিরা সবাই ছিলাম নিশ্চুপ। কারণ, আমাদের সাথে জিয়ার যোগাযোগ ছিল। ব্যক্তিগতভাবে জিয়া আমাদের কাছে ওয়াদা করেছিলেন, তিনি আমাদের অতি অল্প সময়েই ফিরিয়ে নেবার বন্দোবস্ত করছেন। দুইপক্ষের সুবিধার জন্যই তিনি আরও কিছুদিন সময় চাইছিলেন। তার যুক্তি ছিল, তিনি সবই জানতে পেরেছেন। কর্নেল তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সেনা পরিষদের সহযোগী হিসাবে ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু পরে তাহের বিপ্লবের সর্ব কৃতিত্ব নেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এমন সব হঠকারিতায় লিপ্ত হয় যাতে বাধ্য হয়েই তাহের এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে তাকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। এই অবস্থায় যদি আমরা দৃশ্যপট থেকে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকি তবে তার পক্ষে তাহেরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হবে। তার যুক্তিটা খোঁড়া হলেও আমরা মেনে নিয়েছিলাম। তিনি এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অনুরোধ করেছিলেন, যাতে আমরা সেনা পরিষদের বিপ্লবীদের বুঝিয়ে বলি যে তিনি আমাদেরই মনোনীত চীফ এবং আমাদেরই একজন। তাই কোনও প্রকার ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই। আমরা এক ছিলাম, আছি এবং থাকবো। জিয়া কোরান শপথটাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তার সেই ধরনের কথার পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা তার উপর বিশ্বাস রেখেই রশিদ আর ফারুকের অগোচরে দেশে সেনা পরিষদের সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলাম জিয়ার প্রতি সন্দিহান না হয়ে আন্তরিকভাবে তাকে সার্বিক সাহায্য এবং সহযোগিতা করে চলার জন্য। তাদের এটাও জানিয়েছিলাম, জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে তার সাথে আলোচনার পরই আমরা যুক্তিসঙ্গত কারণেই কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি।এবার কর্নেল ফারুক সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো জনাব তোয়াবের প্রতি

স্যার, সৈনিকদের কাছে আমাদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, তারা অহরহ আমাদের বার্তা পাঠাচ্ছে অবিলম্বে দেশে ফিরে যাবার জন্য। তিন চীফই আমাদের পছন্দের মনোনীত ব্যক্তি। সেক্ষেত্রে আমাদের ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এতো গড়িমসি কেনো, আপনি খোলাখুলি জবাব দিন। ফারুকের এই প্রশ্নে কিছুটা বিপাকে পড়লেন তোয়াব। সবার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন এই প্রশ্নের সঠিক জবাবই সবাই প্রত্যাশা করছে। তাই একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি পান করে গলা ভিজিয়ে তিনি জবাব দিলেন

দেখো, প্রশ্নটা কঠিন, জবাবটাও সহজ নয়। জবাবে আমি আমার নিজস্ব বক্তব্যই জানাবো। তাই তোমাদের কথা দিতে হবে এই বক্তব্য যেন আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আমরা তাকে এই বিষয়ে আশ্বস্ত করলাম। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে তোয়াব বলতে শুরু করলেন

তাহেরকে Neutralize করতে জাসদের শীর্ষনেতাদের বন্দী করা ছাড়াও সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্যকে মেরে ফেলা হয়েছে বিনা বিচারে তাহেরের অনুগতজন সেই অনুমানের ভিত্তিতে। কিন্তু তারা যে সবাই তাহেরের অনুসারী সে বিষয়ে কোনও সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এতে সামরিক বাহিনীতে ক্ষোভ ও উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধরণের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে জিয়ার সামনে কেউই কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না, বরং কানকথায় বিশ্বাসী জিয়ার প্রিয়পাত্র সাজার জন্য তাকে ঘিরে থাকা অনেকেই তাকে উস্কে দিচ্ছে। আমার মনে হয়, জিয়া নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য আরও অনেককেই মারবেন। এই ন্যক্কারজনক হত্যাযজ্ঞের ভার জিয়া দিয়েছেন জেনারেল এরশাদ আর তারই কোর্সমেট জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীকে। এর জন্যই তাকে প্রমোশন দিয়ে বানানো হয়েছে DGFI কর্নেল লতিফের স্থানে। তাকে এইসব কর্মকাণ্ডে পরামর্শ দিচ্ছে জেনারেল এরশাদ, জেনারেল মঞ্জুর, জেনারেল মীর শওকত। এরাই হচ্ছে বর্তমানে সামরিক বাহিনী সম্পর্কে জিয়ার মূল পরামর্শদাতা। এতটুকু বলে আরও একগ্লাস পানি হাতে তুলে এক নিঃশ্বাসে পান করলেন এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব। সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে তার বক্তব্য শুনছিলাম।

আচ্ছা স্যার, এই হত্যাযজ্ঞের সাথে জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুও কি জড়িত? নূরের প্রশ্ন।

না, আমার মনে হয় শিশু এর মধ্যে নেই। সে নিজেকে এইসব থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে জিয়ার রাজনৈতিক দল গঠনের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। কিছুক্ষণ ভেবে এভিএম তোয়াব আবার বলতে শুরু করলেন

আমি যতটুকু বুঝি, জিয়া চাইছে সামরিক বাহিনী থেকে উগ্র বিপ্লবী চিন্তাধারী সব অফিসার এবং সৈনিকদের নির্মূল করতে। এতে করে যত লোক মারতে হয় জিয়া মারবে, জেলে পাঠাবে আর চাকুরিচ্যুত করবে। এভাবেই জিয়া সমগ্র সামরিক বাহিনীর উপর তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে বদ্ধপরিকর। এরপর তার সম্ভাব্য সব প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে তিনি তার আস্থাভাজন সেনা কমান্ডারদের হাতে সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে নিজে জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে অধিষ্ঠিত হবার চিন্তা ভাবনা করছেন বলেই আমার বিশ্বাস। হঠাৎ আমার দিকে চোখ ইশারা করে এভিএম তোয়াব বললেন

তোমার আব্বার সাথে জেনারেল জিয়া যোগাযোগ করছেন এবং তার মাধ্যমে শাহ আজিজ, শামসুল হুদা চৌধুরী, জাদু মিয়া প্রমুখদের তার দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছেন। এই ব্যাপারে কি তুমি কিছুই জানো না? তোমার আব্বার সাথে যোগাযোগটা বোধকরি শিশুর মাধ্যমেই হয়েছে। মনে হচ্ছে, জিয়ার এই রাজনৈতিক উদ্যোগের পেছনে মওলানা ভাসানীর আশির্বাদও রয়েছে। জানতে পারলাম ১৫ই আগস্টের পর তুমিই নাকি গোপনে জিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলে সন্তোষে মওলানা ভাসানীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে? আমি বিস্তারিত কিছু না বলে শুধু বললাম

আব্বা একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, তাই তিনি যাই করছেন সেটা তার চিন্তাভাবনা মোতাবেকই করে থাকবেন, সেটা তিনি আমাকে জানিয়ে করবেন এমন ধারণাটা যুক্তিসঙ্গত নয়। এরপর কিছুটা বিব্রত অবস্থায় সার কথাটা বলবেন কিনা ভেবে নিয়ে তিনি বললেন কিছু কথা বলবো যদি তোমরা আমাকে ভুল না বোঝো।

মনে করার কিছুই নেই। আপনি মন খুলে সব কথাই বলতে পারেন। আপনি যাই বলছেন তা অত্যন্ত আন্তরিক ভাবেই বলছেন, সেটা আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারছি। আমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে কোনও রাখঢাক না রেখে স্পষ্ট করেই তিনি বলতে লাগলেন

এখন যদি তোমরা জিয়ার বিরুদ্ধে কোনও সংঘাতে জড়িয়ে পরো তাহলে দেশবাসী সেটাকে সুনজরে দেখবে না। সামরিক বাহিনীতেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। সবাই মনে করবে তোমরা ক্ষমতালিপ্সু, which you are not. I have no hesitation to say that all of you are selfless patriots of rare breed. আমার ধারণা, জিয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় তোমাদের কোনও স্থান হবে না। তিনি যেভাবে এগুচ্ছেন তাতে তোমাদের কখনোই তিনি সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নিতে পারবেন না। তোমাদের সমর্থকরাও এটাই উপলব্ধি করেই তোমাদের তার ডাকের অপেক্ষা না করে ফিরে যেতে বলছে তাদের নিরাপত্তার জন্যই। আমার ধারণা, ইতিমধ্যেই তোমাদের অনেক সাথীদেরও জিয়া মেরে ফেলেছেন, এটাই তোমাদের ফিরিয়ে না নেয়ার প্রধান কারণ। যাদের উপর ভর করেই হউক না কেনো, তিনি একে একে খালেদ-চক্র, খন্দকার মোশতাক এবং কর্নেল তাহেরকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন চতুরতার সাথে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পথে এখন বাধা তোমরাই। তাই আমার মনে হয়, তিনি তোমাদেরকে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেবেন না। শুধু তাই নয়, তিনি তোমাদের দেশেও ফিরতে দেবেন না যতদিন তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। তার এ ধরনের বক্তব্যে ফারুক ভীষণভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠে আমাদের উদ্দেশ্য করে বললো

কি আমি বলিনি, Zia would prove himself to be a betrayer? আমরা সবাই নির্বিকার হয়ে জনাব তোয়াবের বক্তব্য শুনছিলাম। উত্তেজিত ফারুক একই ভাবে বলে উঠলো

How dare he kill our Comrades! He should not be allowed to go unchallenged. We must go back at once to confront the traitor and teach that bastard a lesson. Enough is enough. এভিএম তোয়াব ফারুককে শান্ত হতে বলে বললেন

Zia by default has been able to create an image in the country as a savior and a courageous leader. He has also by now somehow managed to establish equations with America, Britain and other world powers as well as India. He has also become a pseudo Islamist to draw attention of the oil rich Muslim countries. All this has been possible for him because, shrewdly he has been able to muster support of the members of the armed forces projecting him to be one of you all. I find it really amazing, how could he be so preposterous and could deceive you so easily! Anyway, I strongly feel, you have lost the battle for the time being and at this point of time, should you make any move against him that might not be successful. So, I humbly suggest, please, be cool and seriously ponder about the future.

আমি স্বচক্ষে দেখেছি ২-৩রা নভেম্বর রাতে ডালিম ও নূরকে অবিশ্বাস্য সাহসিকতার সাথে খালেদ-চক্রের সাথে আলোচনা করে কি করে জিয়ার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিল নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেই রাতের ঘটনা প্রবাহ সারাজীবন আমার জন্য এক অমূল্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। তাদের দেশপ্রেম এবং সাহস দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম আর বুঝেছিলাম তোমরা প্রত্যেকেই ঐশ্বরিক শক্তিতে বলিয়ান। তাছাড়া তোমাদের দূরদর্শিতা দেখেও আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, যখন দেখলাম শক্তির দিক দিয়ে খালেদ-চক্রের চেয়ে অনেক বেশি বলিয়ান হয়েও তোমরা কোনও প্রকার সংঘর্ষের পথে এগুলে না, আলোচনার পর খালেদ-চক্রকে উৎখাত করার বিকল্প ব্যবস্থা করে প্রেসিডেন্টকে কি করতে হবে সেই পরামর্শ দিয়ে দেশত্যাগ করে ব্যাংকক চলে গিয়েছিলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ আর কর্নেল হুদার স্ত্রীদের সাথে নিয়ে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম কেনো তোমরা দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে। এটা ছিল একটা কৌশলগত কারণ। সশস্ত্র সংঘাতের সুযোগে ভারত ২৫ বছরের চুক্তির আওতায় অবশ্যই আগ্রাসন চালিয়ে বাকশালীদের আবার ক্ষমতায় বসিয়ে দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে বিলীন করে দিয়ে দেশটাকে সম্পূর্ণভাবে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করতো। ৭ই নভেম্বর এর অভ্যুথানের পেছনে তোমরাই ছিলে মূলশক্তি। দেশের সাধারণ মানুষ না জানলেও যারা সচেতন তাদের অনেকেই কিন্তু সেটা ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছেন। কিন্তু আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। Image এর দিক থেকে জিয়া আর খালেদের মধ্যে রয়েছে বিরাট পার্থক্য। খালেদকে দেশবাসী এবং সৈনিকরা দেখেছিলো ভারতের দালাল হিসাবে, কিন্তু বর্তমানে জিয়ার পরিচিতি হচ্ছে একজন ভারত বিরোধী দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। এই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ না করে কোনও হঠকারি পদক্ষেপ নিলে পরিণতি শুভ নাও হতে পারে। পরিশেষে এভিএম তোয়াব বললেন

জিয়ার সাথে মোকাবেলা করার একটাই পথ আছে। তার মোকাবেলা সম্ভব এক মাত্র রাজনৈতিক ভাবে। সশস্ত্র মোকাবেলা এই মুহূর্তে ফলপ্রসূ হবে না। এভাবেই সারগর্ভ মিটিং শেষ হল।

আমরা জানতে পারলাম ভেতরের অনেক তথ্য। আমরা সবাই খুবই মনোযোগের সাথে শুনছিলাম তার তথ্যভিত্তিক যুক্তি সঙ্গত বক্তব্য। এরপর ফারুক আর রশিদের সাথে তোয়াবের আর একটি বৈঠক হয়, সেখানে আমাদের কেউই উপস্থিত ছিল না বিধায় জানতে পারিনি তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল। দু’টি মিটিং এর পর বাকি সময়টা হাল্কা পরিবেশে কাটিয়ে জমিরের সাথে ফিরে গেলেন এয়ার চীফ। যাবার প্রাক্কালে তোয়াব জানতে চাইলেন, জিয়া নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবেন তার জন্য কি বার্তা তোমাদের তরফ থেকে দেয়া হয়েছে, তার জবাবে কি বলবেন তিনি।

আমি বললাম

জানাবেন রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে গাদ্দাফির বদান্যতায় রাজকীয় হালতেই আছি আমরা। তবে অপেক্ষায় আছি তিনি ওয়াদা মতো আমাদের কবে ফিরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করবেন। আরও বলবেন, বিলাসী জীবনে সময় কাটলেও মন আমাদের পড়ে আছে দেশেই, নাড়ির টান ভোলা সম্ভব নয়।

জনাব তোয়াব চলে যাবার পর হিসাব মিলাতে গিয়ে দেখলাম, বিভিন্নসূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জেনারেল জিয়া এবং দেশের চলমান ঘটনাবলী সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়নকেই স্বীকৃতি দিয়ে গেলেন এভিএম তোয়াব। তার বক্তব্যের চুলচেরা বিশ্লেষণের পর কয়েকটি বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো

১। জেনারেল জিয়া সেনা পরিষদের নীতি-আদর্শ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে এক অবিশ্বাস্য প্রতারণার নজির স্থাপন করেছেন। শঠতা এবং কূটবুদ্ধির অধিকারী জিয়া তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য এতদিন সেনা পরিষদকে ব্যবহার করে এসেছেন। সেনা পরিষদের আন্তরিক সাহায্য সহযোগিতায় ক্ষমতার কেন্দ্রে আসীন হয়েই জিয়া ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য ন্যক্কারজনক ভাবে তার বিশ্বস্ত কোর্সমেট DGFI জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর মাধ্যমে ষড়যন্ত্র মূলক ১৮টি ক্যু’দাতার (বিদ্রোহ) সাজানো নাটকের মাধ্যমে ‘মেকিয়াভেলির প্রিন্সে’র মতো নিষ্ঠুরতার সাথে সেনা পরিষদের পরীক্ষিত ত্যাগী নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর অফিসার এবং সৈনিকদের হত্যা করে সেনা পরিষদের শক্তি বিলীন করার চেষ্টা করছেন যাতে তার উপর আমাদের কোনও প্রাধান্য না থাকে। সবকিছু জিয়া করছেন সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার অজুহাতের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে।

২। তিনি দেশ ও জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সাথে আপোষ করে ক্ষমতার রাজনীতির প্রবর্তন করে জাতীয় পর্যায়ে দুর্নীতির ক্যান্সারের জীবাণু ছড়িয়ে দিতে উদ্যোত হয়েছেন।

৩। যদিও জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচি সেনা পরিষদের ম্যানিফেস্টো ভিত্তিক, কিন্তু তিনি তার এই ম্যানিফেস্টো বাস্তবায়নে আন্তরিক নন। এর প্রচারণা শুধুমাত্র জনসমর্থন আদায় করে দেশবাসীকে ধোঁকা দেবার একটি কূটকৌশল মাত্র। কারণ, এই ধরনের বিপ্লবী কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অতি প্রয়োজনীয় সেনাবাহিনীর প্রকৃত দেশপ্রেমিক সদস্য, আত্মত্যাগী, পরীক্ষিত কর্মীবাহিনী এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী নেতা-কর্মীদের না মিলিয়ে তিনি একদিকে বিলুপ্তপ্রায় আওয়ামী-বাকশালী এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির সাথে সমঝোতা করে ভারতের অনুকম্পা অন্যদিকে তথাকথিত মুসলিম বিশ্বের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একই সাথে আমেরিকা, ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল এবং প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে এগিয়ে নেবার পরিবর্তে দেশটিকে একটি পরভৃৎ রাষ্ট্রে পরিণত করার পথ বেছে নিয়েছেন শুধুই নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার স্বার্থে।

৪। সামরিক বাহিনীতে তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কায়েম করার জন্য আত্মঘাতী ‘Divide and Rule’ নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগতদের মাঝে সমন্বয়ের ধুয়া তুলে একটা নাজুক সমীকরণ সৃষ্টি করে জাতির মেরুদণ্ড সামরিক বাহিনীর ভিতকেই দুর্বল করে তুলেছেন জিয়া।

৫। আমাদের শক্তির উৎস হচ্ছে সেনা পরিষদ। যুদ্ধকালীন সময় কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ভাবে আমাদের একজন হয়ে কাজ করার অঙ্গীকার করার পরই আমরা এবং সেনা পরিষদ জিয়াকেই সংগঠনের মধ্যমণি হিসাবে গ্রহণ করে সব প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে এগিয়ে আমাদের সুদূর প্রসারী নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষে তাকে ধাপে ধাপে ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করেছিলাম। এই সত্য জানা সত্ত্বেও অভাবনীয়ভাবে জিয়া এখন সেই সংগঠনের সাথেই বেঈমানি করে যেভাবে সেটাকে নির্মূল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন সেটা তার পক্ষে সম্ভব হলেও আমাদের পক্ষে নিজেদের উদ্যোগে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষায় তিলে তিলে গড়ে তোলা সংগঠনের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানি করে তাদের রক্তে রঞ্জিত ব্যক্তির হাত ধরে তার সাথে রাজনীতি করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তার হত্যাযজ্ঞের কবল থেকে সাথীদের বাঁচাতে না পারলেও তাদের রক্তের সাথে মোনাফেকিতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠবে, তার আদালতে আমরা কখনোই ক্ষমার যোগ্য বলে বিবেচিত হবো না।

৬। জিয়া আমাদের নৈতিকতা, ব্যাপক পরিচিতি, গ্রহণযোগ্যতা, সাহস এবং কর্মক্ষমতা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত। তাই আমাদের হাত পা কেটে শক্তিহীন পঙ্গু করার পরও আমাদের নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অবশ্যই চেষ্টা করবেন সেই বিষয়ে আমাদের এখন থেকেই সতর্ক থাকতে হবে।

৭। ঘটনা প্রবাহ যেভাবে এগুচ্ছে তাতে যুক্তিসঙ্গত ভাবেই বলা চলে দেশে ফিরে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে রাজনীতি করার সুযোগও খলনায়ক জিয়া আমাদের দেবেন না।

৮। জিয়ার বদান্যতায় খন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও যে খুব একটা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে সে সম্পর্কেও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

৯। জিয়া এবং তার ভবিষ্যৎ রাজনীতি সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়নের জন্য আমাদের ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে হবে। জিয়ার আমলে আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একমাত্র শিশুভাই সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন জিয়ার মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে। তাই আমার উপরই দায়িত্ব দেয়া হল সম্ভব হলে শিশুভাইয়ের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করার।

১০। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল, এয়ার চীফ তোয়াবের বক্তব্যের বাস্তবতায় জিয়ার সাথে কোনও রকমের সশস্ত্র সংঘর্ষের চিন্তা সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক বিধায় বর্জনীয়।

প্রায় সব দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী নেতা-নেত্রীদের সাথে সেনা-পরিষদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের রয়েছে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা। একই ভাবে আমলাতন্ত্র, সুশীল সমাজ, মিডিয়া এবং ব্যবসায়ী মহলের অনেকের সাথেই আমাদের রয়েছে সখ্যতা। সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতেই। এই ধরনের যোগাযোগ না থাকলে আগস্ট বিপ্লব কোনক্রমেই দেশজোড়া স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পেতো না। ফারুক-রশিদের দেশব্যাপী কিংবা সমগ্র সামরিক বাহিনীতে তেমন কোন বিশেষ পরিচিতি ছিল না। বিষয়টির ব্যাপারে দুই ভায়রা ভালোভাবেই অবগত ছিল। আমাদের এই পার্থক্যটা নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বিধায় কখনোই বাইরে প্রকাশ করা হয়নি।