আবার ঢাকায়

এক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকায় যাওয়া ঠিক। সপরিবারে ঢাকা পৌঁছে মিনি ফুপ্পুর বাসাতেই ডেরা বাঁধলাম। কিন্তু স্বপন আর রোজির জোরাজুরিতে প্রথম দুই-তিন দিন ওদের বাসায় থাকতে হল।

কামরুল হক স্বপন বীর বিক্রম আমার একমাত্র ছোটভাই। বয়সে আমার চেয়ে বছর চারেকের ছোট একজন বহুল পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ‘৬০-এর দশকে ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে স্কলারশিপ নিয়ে বৈরুত আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে চলে যায়। সেখানকার পড়াশুনা শেষে উচ্চশিক্ষার্থে চলে যায় জার্মানিতে। সেখান থেকে ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে নিজের ব্যবসা শুরু করে। একই সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটির IBA Department এ ভর্তি হয় MBA করার জন্য। কিন্তু ডিগ্রীলাভের আগেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের প্রারম্ভেই স্বপন, বদি, কাজি, সাচো, জুয়েল, আজাদ, বাদল, আলম, চুল্লু, সামাদ, মেওয়া, রুমি, ফাজলে, ফতেহ আলি, উলফাত, মোখতার, তৈয়ব আলি এবং তাদের আরও কয়েকজন বন্ধু ও পরিচিতজন ২নম্বর সেক্টরের অধীন ত্রিপুরার মেলাঘর ক্যাম্পে গিয়ে গেরিলা হয়ে যোগদান করে ট্রেনিং-এর জন্য। ট্রেনিং শেষে তাদের ঢাকায় পাঠানো হয় খানসেনাদের বিরুদ্ধে অপারেশন করার জন্য। এদের সবাই আমার অতিপ্রিয় আপনজন। এই গেরিলাগ্রুপটি ঢাকা শহরে অবিশ্বাস্য দুঃসাহসিক অপারেশন করে খানসেনাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করে। ঢাকা শহরের প্রায় সবকয়টি দুঃসাহসিকঅপারেশনের হোতা ছিল স্বপনদের দুর্ধর্ষ গেরিলা গ্রুপটিই। তাদের দুঃসাহসিক অপারেশনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের অপারেশন, ফার্মগেট অপারেশন, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার প্লান্ট অপারেশন, ডেমরা অপারেশন, গুলবাগ পাওয়ার হাউস অপারেশন, ধানমণ্ডি অপারেশন, যাত্রাবাড়ী অপারেশন। এই অমিত সাহসী গ্রুপটি নিজেদের জীবন বাজী রেখে জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের পরিবার এবং বাচ্চাদের খান সেনাদের হাতে বন্দী অবস্থা থেকে উদ্ধার করে সাফল্যের সাথে তাদের সহি সালামতে সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দেয়।এই জানবাজ বিচ্ছু দলটির তৎপরতায়ভয় এবং আতংকে তটস্থ হয়ে উঠেছিলো হানাদার বাহিনী এবং ঢাকার হেডকোয়ার্টার-এ অবস্থিত তাদের কমান্ডাররা। কিন্তু যুদ্ধের এক পর্যায়ে আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জনাব জিল্লুর রহমানেরপত্নী আওয়ামীলীগের পরলোকগত নেত্রী আইভি রহমানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ফরিদের বিশ্বাসঘাতকতায় একই রাতে হানাদার বাহিনী এক আচমকা ঝটিকা অপারেশন চালিয়ে আমার আব্বা, বাসায় সেই রাতে অবস্থানরত সব আত্মীয়-স্বজন, কাজের লোকজনসহ গেরিলা দলটির বেশীরভাগ সদস্যদের শহরের বিভিন্ন অবস্থান থেকে বন্দী করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রাণে বেঁচে যেতে সক্ষম হয় মাত্র দুইজন, স্বপন ও কাজি কামালুদ্দিন। বেঁচে যায় এই বিচ্ছুদলের আরও কয়েকজন, যারা সেই কালরাত্রিতে ঢাকার বাইরে অবস্থান করছিলো।
মীরজাফরের অবতার ফরিদের বিশ্বাসঘাতকতায় বন্দী মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই জীবিত ফিরে আসতে পারেনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর বন্দী অবস্থায় অকথ্য নির্যাতন চালনোর পর তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। কিন্তু যেকোনো কারণেই হউক নিরীহ সাধারণ নাগরিকদের উপর অসহনীয় অত্যাচার করা হলেও তাদের মেরে ফেলা হয়নি। তাই আমার আব্বা, বন্দী পুরুষ আত্মীয়-স্বজন এবং বাসার কাজের লোকজনসহ আরও অনেককে মুক্ত করা হয় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আধমরা অবস্থায় আল্লাহ্‌তায়ালার অসীম করুণায়।

অকুতোভয়য় এইসব মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই ছিলো ভার্সিটির কৃতি ছাত্র, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল তাদের সামনে। কিন্তু দেশপ্রেম এবং বিবেকের তাড়নায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই সূর্য সন্তানরা গর্জে উঠে সব কিছুর আকর্ষণ এবং মায়া ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো স্বাধীনতা সংগ্রামে।

কিন্তু জাতি আজঅব্দি এইসব বীরদের সঠিক মূল্যায়ন করে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পেরেছে কি? এদের বীরগাথা নিয়ে লেখেনা কেউ, এদের নিয়ে হয় না কনও সেমিনার কিংবা স্মরণ সভা। কিন্তু পরিলক্ষিত হয়, যে দুইটি পরিবার বাংলাদেশকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে পরিণত করার জন্য পশুদের চেয়েও হিংস্রতার সাথে লড়াই এবং চুল টানাটানি করছে জনগণের কাঁধে ভর করে, তাদের নিয়ে হরহামেশা সেমিনার, জনসভা, পদযাত্রা, গাড়ির শোভাযাত্রার কমতি নেই। কমতি নেই দেশের সবচেয়ে বড় চোর, দুর্নীতিবাজ, চরিত্রহীন, লম্পট কুসন্তানদের যুবরাজ বানানোর জঘন্য প্রতিযোগিতার।

সত্যি বিচিত্র এ দেশ সেলুকাস! এই উক্তি খণ্ডানোর মতো সাহসী মানুষ কি নেই এই প্রজন্মে? প্রত্যাশা করা যায় কি আগামী প্রজন্মে? যে জাতি প্রকৃত দেশপ্রেমিক বীরদের মর্যাদা দিতে পারে না বা জানে না, তারা কখনোই আত্মসম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার দাবিদার হতে পারে না। ইতিহাসের এই শিক্ষা না নিলে থাকবে না সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব। ফলে ভবিষ্যৎবলেও কিছুই থাকবে না ১৮ কোটি বাংলাদেশীর তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর।কি করে ঘটেছিল এই ন্যক্কারজনক ঘটনা সেটা বিশদভাবে জানার ইচ্ছে যাদের আছে তারা আমার লেখা এবং প্রকাশিত ‘কিছু কথা কিছু ব্যথা’ বইটি পড়তে পারেন। বইটি সংগ্রহ করতে না পারলে ওয়েবসাইট www.majordalimbubangla.com থেকেও বইটি পড়তে পারেন কিংবা ডাউন লোড করে নিতে পারেন। বইটিতে আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছি কয়েকটি সত্যি ঘটনা তুলে ধরার মাধ্যমে আমার কয়েকজন অবহেলিত সাথী মুক্তিযোদ্ধা যাদের বীরগাথা উপেক্ষিত হয়েছে এবং অনেককেই দেয়া হয়নি কোনও স্বীকৃতি পদক, Guerilla Advisor to the Sector Commanders এবং একজন Commander হিসেবে আমার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও।
এই অক্ষমতার যাতনা বুকে নিয়েই লিখেছি ঐ সমস্ত উপেক্ষিত নিবেদিতপ্রাণ নিঃস্বার্থ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরগাথা ‘কিছু কথা কিছু ব্যথা’ বইটিতে। মুক্তিযোদ্ধাদের এমন হাজারও বীরগাথাকে প্রকাশ না করে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে সুপরিকল্পিত চক্রান্তের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান দেশ ও বিদেশবাসীর কাছে গৌণ প্রমাণ করার জন্য বিশেষ করে ভারতের স্বার্থে। ‘৭১-এ শ্রেণী বিভেদ নির্বিশেষে প্রকৃত নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা এবং কি ছিলো তাদের মন-মানসিকতা সেটা বর্তমান এবং ভবিষ্যৎপ্রজন্মের বোঝার সুবিধার্থে দু’জন মুক্তিযোদ্ধার উদাহরণ তুলে ধরা হল।

জার্মানিতে চিকিৎসার পর দেশে ফেরার কিছুদিন আগে স্বপন এবং কাজি দেরাদুন মিলিটারি একাডেমী থেকে কৃতিত্বের সাথে কমিশন লাভ করে দেশে ফিরে দুইজনই সেনাবাহিনীতে যোগদানে অনীহা প্রকাশ করে। স্বপন তার নিজ ব্যবসাকে নতুন করে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগের সাথে সাথে তার লেখাপড়া শেষ করায় ব্রতী হয়। কাজি ভার্সিটিতে পড়াশুনা করার সময়েই পাকিস্তানের ন্যাশনাল বাস্কেট বল টিমে খেলতো। পড়াশুনা শেষে যোগ্যতার ভিত্তিতে তাকে পাকিস্তান সরকার জার্মানিতে পাঠায় কোচ হিসাবে ট্রেনিং নেবার জন্য। ফিরে আসার পর জাতীয় কোচ হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্পোর্টস ফেডারেশনের একজন কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয় কাজি কামালুদ্দিন। যুদ্ধের পর কাজি বাংলাদেশের স্পোর্টস ফেডারেশনের কর্মকর্তার পদেই যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়, সাথে নিজস্ব ব্যবসাও শুরু করে।

তাদেরকে সেনাবাহিনীতে যোগদান করানোর জন্য অনেক করে বুঝিয়েছিলেন জেনারেল শফিউল্লাহ, জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। কিন্তু তারা সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। যুক্তি হিসাবে তারা বলেছিলো মুক্তিযুদ্ধটা স্বাভাবিক পথে এগুলে প্রলম্বিত হতে পারে, আর সেই ক্ষেত্রে IMA এর ট্রেনিংটা কাজে লাগবে বিবেচনা করেই তারা দেরাদুনে ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করেছিলো। কিন্তু সেখানে প্রশিক্ষণরত অবস্থাতেই মুক্তিযুদ্ধটাকে স্বাভাবিক পরিণতির দিকে এগুতে না দিয়ে সেটাকে হাইজ্যাক করে ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ এবং রক্তের বিনিময়ে অক্লেশে বিজয় হাসিল করে পাকিস্তানকে পরাস্ত করে এবং স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে তাদের বিজয়ের দান হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এবং বিশ্বপরিসরে প্রতীয়মান করতে সমর্থ হয়। দাক্ষিণ্যের এই স্বাধীনতা অদূর ভবিষ্যতে অরক্ষিত হয়ে পরাধীনতায় পরিণত হতে পারে। তার হেফাজতের জন্য আপনাদের মতো পেশাদার দক্ষ সেনা অফিসাররা তো রইলেন। আমরা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম নিজেদের লড়াই নিজেরা লড়ে দেশকে স্বাধীন করার জন্য, চাকুরির প্রত্যাশায় নয়। অরক্ষিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য যদি জীবিত অবস্থায় আবার একটি মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজন হয় তাহলে আবার আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নেবো মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে।

স্বপন ও কাজির এই দৃঢ় আত্মবিশ্বাস এবং প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয় ছিলো হাজার হাজার দেশপ্রেমিক জনদরদী মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনোভাব এবং বুকে লালিত স্বপ্নের প্রতিফলন।

সেই স্বপ্ন স্বাধীনতার চার দশকের পরেও আজঅব্দি বাস্তবায়িত হয়নি ক্ষমতায় থাকা নেতা-নেত্রীদের বিশ্বাসঘাতকতা, অপশাসন, দুর্নীতি এবং বিদেশী প্রভুদের সেবাদাসত্বের কারণে।

এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী কে সেটাও ভেবে দেখতে হবে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে।

‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তখনকার প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলো নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদী চেতনায়। সাধারণ জনগণের সাথে এক কাতারে মিশে শাণিত হয়েছিলো তাদের দেশাত্মবোধ, সামাজিক এবং রাজনৈতিক চেতনা। বয়সের তুলনায় মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে উঠেছিলো অনেক বেশি পরিপক্ব। এর ফলে, তারা হয়ে উঠেছিলো যুগযুগ ধরে নিগৃহীত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, আর্থ-সামাজিকভাবে সম অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং শোষিত দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পক্ষের প্রতিবাদী শক্তি।

এই নবশক্তির জাগরণে কেঁপে উঠেছিলো ঘুণেধরা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ভিত তাই তারা হয়েছিলো প্রতারণা এবং নিগ্রহের শিকার। দাবড়ে দেয়া হয়েছিলো তাদের উপর রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সন্ত্রাসের লাল ঘোড়া। কিন্তু সাময়িকভাবে সেই চেতনাকে দাবিয়ে দিলেও সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ এবং জনস্বার্থের আদর্শভিত্তিক যে অপরাজেয় ঐক্যবদ্ধ শক্তির জন্ম হয়, তার কাছে সব অপশক্তিকেই পরাজয় বরণ করতে হয় দেরিতে হলেও, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। একমাত্র এই শক্তিই হতে পারে কোনও একটি দেশ এবং জাতির মূল রক্ষাকবচ।

ঢাকায় পৌঁছানোর সংবাদ পেয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে পরদিন রাত ৯ টায় তার বাসভবনে দেখা করার পয়গাম পাঠালেন। পরদিন নির্ধারিত সময়ে তার বাসায় পৌঁছালাম, আমাকে স্বাগত জানিয়ে বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো দন্ত বিকশিত সেই ফালু। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিসেস জিয়া এলেন মশলা চিবুতে চিবুতে। বুঝতে পারলাম, তিনি অধীর হয়েই আমার প্রতীক্ষায় ছিলেন। তার আগমনে উঠে সালাম জানাতেই প্রতিউত্তর দিয়ে ইশারায় বসতে বলে নিজেও বসে পড়লেন পাশের সোফায়।কেমন আছেন, কোথায় উঠেছেন, রাতের খাবার খেয়েছেন? ভালই, দেশে আসলে যাযাবরের মতো কোনোও একখানে ডেরা ফেলে সব নিকট আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে থাকতে হয়। এখন এসেছি স্বপনের বাসা থেকে। চা খেতে আপত্তি নেই নিশ্চয়, বলেই চা-নাস্তার ফরমায়েশ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন

কেমন হল আপনার আমেরিকা সফর? কিছু না বলে সিলড চিঠি তিনটি তার হাতে দিয়ে অনুরোধ জানালাম খুলে পড়তে। তিনি তার রিডিং গ্লাস আনিয়ে চিঠিগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। পড়া শেষে প্রথমতো তিনি কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন! পরে উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন এটা কি করে সম্ভব হল?

সঠিক জবাবটা আমার নিজেরও জানা নেই।

আপনাকে যতই বোঝার চেষ্টা করছি ততই হতবাক হচ্ছি। অসম্ভব কাজগুলো কি করে এতো সহজেই সম্ভব করে তোলেন আপনি! আমি শুধু সাধ্যমতো আন্তরিকভাবে চেষ্টা করি। ফল দেবার মালিক আল্লাহ্‌ সোবহানওয়াতালা।

তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন। এবার বলুন, আমার করণীয় কি?

আমাদের এক বন্ধু আছেন তার নাম জিম। তিনি লাগাতার তিন দশকের বেশি সময় তার এলাকা থেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য হিসাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্ষমতা বলয়ে সব মহলে তিনি একজন অভিজ্ঞ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসাবে বিশেষভাবে সমাদৃত। তিনিই সমন্বয়কারী হিসাবে আপনার এবং বন্ধুদের মধ্যে সর্ব ব্যাপারে যোগাযোগ রক্ষা করবেন। আপনার সফর, ব্যক্তিগত সম্পর্ক মজবুত ভিত্তিতে কি করে গড়ে তোলা যায় এবং বিভিন্ন জটিল সমস্যাগুলো কি করে সমাধান করা সম্ভব তার মূল পরামর্শদাতাও হবেন তিনিই। আপনার আমন্ত্রণে তাকে ডাকিয়ে এনে প্রাথমিক পরিচয়টা আমিই করিয়ে দেবো। তাহলে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে তার সুবিধা অনুযায়ী আসার নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দেই আমার তরফ থেকে, কি বলেন? হ্যাঁ, তাই করতে হবে। তবে আমার অভিমত, প্রথম পরিচয়টা ঢাকায় না হওয়াটাই শ্রেয়। গোপনীয়তার স্বার্থে কোনও তৃতীয় দেশে সাক্ষাতটা হলেই ভাল হয়। পরিচয়ের পর পূর্বপরিচিত কাউকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কিংবা ব্যক্তিগত ভাবে আপনি ঢাকায় ডেকে পাঠালে সেটা হবে একটা সাধারণ ব্যাপার। তাই সন্দেহের অবকাশও কম থাকবে। আপনার যুক্তিটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এরমধ্যে জিম্বাবুইতে কমনওয়েলথ-এর সামিট কনফারেন্স ছাড়া অন্য কথাও যাবার শিডিউল তো নেই।
এই অবস্থায় আপনি একটা কাজ করতে পারেন। ঐ সামিট কনফারেন্সে আমাকে দলভুক্ত সদস্য হিসেবে যোগদানের নির্দেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে বলবেন পাঠিয়ে দিতে। এর আগেই জিমের নিমন্ত্রণ পত্রটা আমার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে আপনাকে। আমি সেটা জিমের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তাকে যথাসময়ে হারারেতে চলে আসতে বলবো। তারপর কনফারেন্স কালে কোনও এক ফাঁকে তার সাথে আপনার গোপন সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে নেবো।

কথার ফাঁকে চায়ের সাথে পরিবেশন করা হলো দেশীয় পিঠা। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে খেলাম খানিকটা।
ঠিক আছে, আপনার পরামর্শ অনুযায়ী সব করবো আমি। এবার অন্য দুটো প্রসঙ্গে আপনার মতামত কি সেটা জানতে চাইবো। বলুন।

সরকার গঠনের পরমুহূর্ত থেকেই প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে ওয়েস্টমিনস্টার এর আদলে সংসদীয় গণতন্ত্র কায়েমের দাবি তুলেছে আওয়ামীলীগ ও এরশাদের জাতীয় পার্টি। অন্যদিকে জামায়াতের তরফ থেকে আগামীতে ‘কেয়ার টেকার সরকারে’ এর অধীন নির্বাচনের একটা দাবি তোলা হবে। এই দুইটি ইস্যুতে তারা যুগপৎ আন্দোলনে যাবে সংসদ এবং সংসদের বাইরে শুনতে পাচ্ছি। এই দুইটি ইস্যু সম্পর্কে আপনার মতামত কি?

এই বিষয়ে বিশদভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করবেন এবং সিদ্ধান্তও নেবেন আপনারা। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে দুটোই সুদূর প্রসারী রাজনৈতিক কূটচাল যাতে বাংলাদেশে কখনোই কোনও স্থিতিশীল সরকার কায়েম না থাকতে পারে। এর বিস্তারিত যুক্তিভিত্তিক তর্ক অবশ্যই হতে পারে। আমি সে ধরনের কোনও বিশদ আলোচনায় না গিয়ে শুধু বলবো ‘প্রেসিডেন্সিয়াল ফর্ম অফ গভর্নমেন্ট’ দেশে প্রথম জারি করেছিলেন কালুর ঘাট থেকে মেজর জিয়া পরে শেখ মুজিবর রহমানের মতো একজন ব্যক্তি যার কথাই ছিল আইন। তারপরও তিনি এই পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন কেনও? আর রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রয়াত শহীদ প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া এবং পতিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদ সেই পদ্ধতিটি বলবৎরেখেছিলেন কেনও?
এই দুইটি ইস্যুতে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে এই প্রশ্ন দুটোর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক বলেই মনে করি। অবশ্যই এর পেছনে এই তিনজনেরই যুক্তি ছিল। সেটাই খতিয়ে দেখতে হবে। নির্দলীয় ‘কেয়ার টেকার গভর্নমেন্ট’ এর অধীনে নির্বাচনের নজির বিশ্বের কোনও দেশেই পাওয়া যায় না। আমার ধারণা পৃথিবীতে নির্দলীয় দুই ধরনের মানুষই পাওয়া যায়, পাগল আর মৃত ব্যক্তি। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো একটা অনুন্নত দেশ যার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি জনগোষ্ঠী দারিদ্রসীমার নিচে মানবেতর জীবন কাটায়, যে দেশে আজঅব্দি যতগুলো সরকার আসলো গেলো তারা মানুষের বাঁচার ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে এইসব এক্সপেরিমেন্টকে প্রাধান্য দেয়ার বিলাসিতা যুক্তিসঙ্গত নয়।

১৮ টি সিটের অধিকারী জামায়াতের দাবির চেয়ে জনগণের দাবিগুলোকেই আপনার প্রাধান্য দেয়া উচিৎ। তাছাড়া এই দুইটি দাবির কোনোটাই আপনার নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল না বিধায় জনগণের কাছে এর কোনও দায়বদ্ধতাও আপনার নেই। সেই ক্ষেত্রে এই দায়ভার আপনি কিংবা আপনার সরকার নেবে কেন? এটাই আপনাকে পরিষ্কার করে জনগণকে বোঝাতে হবে। অনেকেই বলছেন, আমি রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে হাসিনাকে পরাস্ত করতে পারবো না।

অনুমানটার সাথে একমত হতে পারলাম না। সাংগঠনিকভাবে আপনার দল আওয়ামীলীগের চেয়ে দুর্বল, তারপরও আপনি নির্বাচনে জিতেছেন। সেটা কি আপনার দলীয় শক্তির বলে? মোটেও না। শহীদ জিয়ার স্ত্রী হিসেবে দেশবাসী আপনাকে একজন ধর্মপ্রাণ, স্বৈরাচার বিরোধী এবং ভারত বিরোধী জাতীয়তাবাদী আপোষহীন নেত্রী হিসাবেই নির্বাচনে জয়ী করেছে। আপনার দলীয় প্রার্থীদের যোগ্যতার বাছ-বিচার তেমন একটা করেনি সাধারণ ভোটাররা। তারা ভোট দিয়েছে ধানের শীষে। এই বাস্তবতার আলোকে যারা আপনাকে বলার চেষ্টা করছেন যে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতায় আপনি হাসিনার কাছে ভোটে হেরে যাবেন, তাদের এ বক্তব্য যুক্তির ধোপে টেকে না।

সেক্ষেত্রে দুঃখজনক হলেও বলতেই হবে, তাদের এমন বক্তব্যের উদ্দেশ্য হল আপনার নিজস্ব শক্তিকে খর্ব করা। নির্বাচনের সরকারি ফলাফল বের হওয়ার সাথে সাথেই হাসিনা সংবাদ সম্মেলন করে পরিষ্কার ভাষায় দোষারোপ করেছেন যে নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে। তিনি একই সাথে দম্ভোক্তি করেছেন, এক মুহূর্তের জন্যও বর্তমান সরকারকে শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না। সেক্ষেত্রে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেকে দুর্বল করে তোলার জন্য আপনিই যদি রাস্তা করে দেন সমঝোতার মাধ্যমে সেটা ভিন্ন কথা। তাছাড়া আপনার আশেপাশের অনেকেই আপনার প্রতি আন্তরিকভাবে অনুগত নয়, তারা সুযোগ সন্ধানী বাস্তুঘুঘু। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের প্রতিই তাদের সব আনুগত্য। ভুলে যাবেন না, অনেক কারণের মধ্যে প্রকৃত মিত্র আর শত্রু চেনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ছিলো জেনারেল জিয়ার মর্মান্তিক অপমৃত্যুর একটা প্রধান কারণ।

স্তব্ধ নিথর হয়ে বেগম জিয়া শুনছিলেন আমার কথাগুলো। কথা শেষে উঠবো ভাবছি, ঠিক তখনই তিনি বলে উঠলেন

ভাই, আমি আপনাকে আবারও অনুরোধ করছি, আপনি সিনিয়র মন্ত্রী হিসাবে আমার পাশে এসে দাড়ান। ভাবী, আপনার আন্তরিকতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আবারও বিব্রত হয়েই বলতে হচ্ছে, আমার কিংবা আমাদের কারও পক্ষেই বিএনপিতে যোগ দিয়ে রাজনীতি করা এখন আর বাস্তবসম্মত নয়। তার চেয়ে আপনি নিজের তরফ থেকেই নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলে আপনি এতদিন আমাদের প্রতি যে অন্যায়-অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিবিধান করে আমাদের দেশে ফিরিয়ে এনে সমাজে পুনর্বাসিত করবেন। সেটাই করুন, তাতেই উভয় পক্ষের মঙ্গল হবে।

বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম বাসায়। আজকের কথোপকথনের মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেলো,সংবাদ সম্মেলনে হাসিনার দাম্ভিক বক্তব্য নিছক হুমকি ছিল না। খালেদা সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য ইতিমধ্যেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে RAW এবং ভারতীয় চাণক্যপুরির যোগসাজশে। ভারত কখনোই চাইবে না বাংলাদেশ তাদের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন একটা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করুক। ভারত বেষ্টিত বাংলাদেশকে নিজস্ব সত্তা বজায় রেখে সমৃদ্ধির পথে এগুতে হলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অবশ্যই হতে হবে চীনকেন্দ্রীক। একই সাথে আমেরিকাসহ ইউরোপীয় শক্তিসমূহ এবং মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর সাথে গড়ে তুলতে হবে যতটুকু সম্ভব সমতাভিত্তিক সম্পর্ক। তবে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে, বাংলাদেশের অন্য যেকোনো দেশের সাথে গড়া সম্পর্ক যাতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কে কোনও প্রকার টানাপড়েন সৃষ্টি না করে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে স্বনির্ভরতা অর্জন এবং অগ্রগতি কোনোটাই সম্ভব হবে না। উজ্জ্বল সম্ভাবনার দেশটি বিলীন হয়ে যাবে হতাশার অন্ধকারে ব্যর্থরাষ্ট্র হিসাবে। তাই প্রথম থেকেই বিশেষ সতর্কতার সাথে গোপনীয়তা রক্ষা করে চলতে হবে। কারণ, মজবুত ভিত্তি তৈরি হওয়ার আগেই ঘুণাক্ষরে টের পেলে ভারতের মতো একটি শক্তি অতি সহজেই সক্ষম হবে সেই প্রচেষ্টাকে অংকুরেই বিনাশ করে দিতে।