ব্যাংককে আমরা
ব্যাংককের বিমানবন্দরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সহ অন্যান্য স্টাফরা স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় ছিলেন। থাই সরকারের আয়োজিত নিরাপত্তার সাথে আমাদের নিয়ে উঠানো হল সুকুম্ভিত এলাকায় ইন্ট্যারন্যাশনাল হোটেলে। সরকারি খরচায় সেখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল দূতাবাস। সবকিছু ফ্রী। তারপরও প্রতিদিন ২০০ থাই ভাত হাতখরচা প্রত্যেকের জন্য। মন্দ নয়। দুই ভাবী আমাদের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে একই বিমানে ফিরে গেলেন।
ঢাকার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য ডিউটি রোস্টার বানানো হল ফোন অ্যাটেন্ড করার জন্য। দেশে অবস্থানকারী সেনা পরিষদের দায়িত্বশীল নেতারা দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনার সবকিছুই আমাদের জানাতে থাকেন। সব খবরাখবর এবং ঘটনাবলির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কি করণীয় সেগুলো তাদের জানিয়ে দেয়া হচ্ছিলো ব্যাংকক থেকে। পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা কর্নেল তাহেরের সাথে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সব নির্দেশ কার্যকরী করছিলেন।
জেনারেল জিয়াকে বন্দী করার সময় একটা সাদা কাগজে কর্নেল রউফের মাধ্যমে জেনারেল জিয়ার সই করিয়ে নিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ। খবরটা জানা থাকায় ২-৩ রা নভেম্বর রাতে ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল-এ পৌঁছেই খালেদ ভাইকে প্রশ্ন করেছিলাম শুধুমাত্র চীফ হবার বাসনায় এ জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা কি করে করতে পারলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খালেদ ভাই?
তুমি কি মনে করো আমি চীফ হবার লোভেই এখানে এসেছি?
তা নাহলে, সাদা কাগজে জিয়াকে সই করতে বাধ্য করার কি দরকার ছিল? আমার প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব হয়নি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের পক্ষে।
৪ঠা নভেম্বর প্রেসিডেন্ট-এর কাছে খালেদ প্রস্তাব রাখলেন জিয়াকে বরখাস্ত করে তাকে চীফ অফ আর্মি স্টাফ পদে নিয়োগ দেবার। প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ তাতে সম্মত না হয়ে রাষ্ট্রপতির পদে ইস্তফা দিয়ে নিজের আগামসি লেনের বাড়িতে চলে যান। একই সাথে নিজ নিজ পদে ইস্তফা প্রদান করে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী এবং জেনারেল খলিলুর রহমান।
এতে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ায় খালেদ এক অধ্যাদেশ জারি করে বিচারপতি জাস্টিস সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে বসান এবং তার মাধ্যমেই এক ফরমান জারি করে নিজে আর্মি চীফ হয়ে বসেন।এরপর রাষ্ট্রপতি সায়েমের মাধমে সংবিধান বাতিল করে মন্ত্রীসভা ও পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে সারা দেশে মার্শাল ল’ জারি করা হয়। প্রেসিডেন্ট চীফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং তিন বাহিনী চীফ ডেপুটি মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশ পরিচালনায় ব্রতী হন। পরদিন সব দৈনিক খবরের কাগজে ছবিসহ এই খবরগুলো ছাপানো হয়। রেডিও এবং টিভিতেও প্রচার করা হয় এসব কিছুই।
এই ধরনের হঠকারিতায় দেশবাসী সন্দিহান হয়ে ওঠেন! আল্লাহ্পাকের ইচ্ছায় দেশ ছাড়ার আগে বঙ্গভবনে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কর্নেল তাহেরের সাথে সেনা পরিষদের নেতাদের বিশ্লেষণে যেমনটি আশা করা হয়েছিলো ঠিক তেমনটিই ঘটিয়ে চলেছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার পরামর্শদাতারা অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে। এই সমস্ত খবরের ভিত্তিতে কতগুলো প্রশ্ন চিন্তার খোরাক হিসাবে সব সেনাছাউনিতে এবং বড়-ছোট শহরগুলোতে লিফলেট আকারে ছড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় ব্যাংকক থেকে।
১। প্রেসিডেন্ট, বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী এবং জেনারেল খলিলুর রাহমান কেনো পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন?
২। সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াকে কেনো গৃহবন্দী করে রাখা হচ্ছে?
৩। আগস্ট বিপ্লবের নেতারা দেশ ছেড়ে চলে গেলেন কেনো খালেদ-চক্রের সাথে ঘটনার রাত এবং পরের সারাদিন আলোচনার পর?
৪। সংবিধান স্থগিত করে মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদ কোন আইনে বাতিল করে সায়েমকে রাষ্ট্রপতি বানিয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ নিজেকে পদোন্নতি দিয়ে চীফ হয়ে বসলেন?
৫। খালেদের মা আর ভাই রাশেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আওয়ামী-বাকশালীদের বিজয় মিছিল কিসের আলামত?
৬। ভারতের সাহায্যে দেশে আবার একদলীয় স্বৈরশাসন কায়েম করাই কি খালেদ-চক্রের উদ্দেশ্য?
৭। জাতীয়স্বার্থ বিরোধী এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে আর একবার গর্জে উঠতে হবে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে এবং জনগণকে। এ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প আছে কি?
৮। ধর্মকর্ম কি আবার হুমকির মুখে পড়বে?
সেনা পরিষদ এবং বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থার লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে এবং গোপন যোগাযোগ এবং বাস্তব ঘটনা প্রবাহ থেকেই উল্লেখিত প্রশ্নগুলোর জবাব পেয়ে যাচ্ছিলেন দেশবাসী এবং সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকরা। ফলে সর্বক্ষেত্রে প্রজ্জ্বলিত হতে থাকে অসন্তোষের বহ্নিশিখা। ক্রমান্বয়ে খালেদ-চক্রের বিরুদ্ধে চলে যেতে থাকে জনমত। এই অবস্থায় ব্যাংকক থেকে পাঠানো নির্দেশ অনুযায়ী সেনা পরিষদের এবং কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতারা খালেদ বিরোধী বিপ্লবের কৌশল-প্রক্রিয়া নিয়ে দেশের সমমনা রাজনৈতিক ও সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথেও মত বিনিময় করতে থাকেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য। দেশের সব কয়টি সেনানিবাসে কি ঘটছিলো সে সম্পর্কে কিছুই টের পাচ্ছিলো না খালেদ-চক্রের নেতারা। কারণ তারা তখন বঙ্গভবনে ক্ষমতার নেশায় ছিল বিভোর।
৫ই নভেম্বর নতুন চীফ হিসাবে খালেদ হুকুম জারি করে বঙ্গভবন, রেসকোর্স ও ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে মোতায়েন করা সৈনিক এবং ট্যাঙ্কগুলো ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসতে।
জেনারেল খালেদের এই সিদ্ধান্ত বিপ্লবীদের জন্য হয়ে ওঠে সোনায় সোহাগা। ইতিমধ্যে ৪ঠা নভেম্বর অতি উৎসাহী হয়ে খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই রাশেদ মোশাররফের নেতৃত্বে মুজিবের ছবি ও ব্যানার সহ বাকশালীদের এক মিছিল বের করা হয় ঢাকায়। মিছিল থেকে স্লোগান তোলা হল, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই, জেল হত্যার বিচার চাই, জয় বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা ইত্যাদি।
খবরের কাগজে জনগণ এই দৃশ্য দেখে ভীত এবং আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। বাকশালীদের অতি উৎসাহী মিছিল ও খালেদ-চক্রের প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক বিরোধী ক্যু’ এক হয়ে ধরা পড়ে দেশবাসীর কাছে। সবার মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে খালেদের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’ এবং মিছিল বাকশালী স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠারই ভারতীয় কারসাজি। খালেদ ভারতের চর। এভাবেই দেশবাসীর কাছে সম্পূর্ণ ভাবে গ্রহণযোগ্যতা হারায় খালেদ-শাফায়াত জামিলগং। এই খবর এবং ছবি খালেদের চোখে পড়ে ৫ই নভেম্বর। দেখামাত্র তিনি তার মাকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ফোনে বলেছিলেন, মা! তোমরা আমাকে শেষ করে দিলে, আমি আর বাঁচবো না।
একদিন বঙ্গভবনে এক বৈঠকে সেনা পরিষদের মনোনীত চীফ জেনারেল জিয়ার ধীরে চলা নীতি সম্পর্কে তার আন্তরিকতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বচসা হয়। বৈঠকে মেজর হাফিজ, মেজর গফফার, লেফটেন্যান্ট ইকবাল মত প্রকাশ করে, জেনারেল জিয়া আগস্ট বিপ্লবের লক্ষ অর্জনে গড়িমসি করছেন। তাই তার জায়গায় ব্রিগেডিয়ার খালেদকে চীফ বানালে তার মাধ্যমে দ্রুত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে। তাদের অভিমত যুক্তিসঙ্গত মনে করেনি সংখ্যাগরিষ্ঠ উপস্থিত নেতারা। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, জেনারেল জিয়াকে চীফ হিসাবে রেখেই তার ভুলগুলো শুধরে নেবার পরামর্শ দেয়া হবে। সিদ্ধান্তটি তাদের মনঃপূত না হওয়ায় অর্বাচীনের মতো খালেদ ও শাফায়াত এর উস্কানিতে ঢাকায় অবস্থিত ১ম এবং ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনস্থ কিছু সৈনিককে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করে ৩রা নভেম্বরের অঘটন ঘটায় মূলত তারাই। ৫ই নভেম্বরের পর সেই সমস্ত বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়া সৈনিকরাও আবার সেনা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসে। এর ফলে খালেদ-চক্র বুঝতে সক্ষম হয় তাদের অবস্থান ঢাকাতেও নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। অবস্থা সঙ্গীন বুঝে স্বঘোষিত চীফ খালেদ তার বাল্যবন্ধু কর্নেল হুদার রংপুর ব্রিগেডের ১০ম ও ১৫তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঢাকায় তলব করে পাঠান। কর্নেল নোওয়াজিশের অধীনস্থ ১০ম ইস্টবেঙ্গল অতিদ্রুত বগুড়া থেকে এসে গণভবনে অবস্থান নেয়। কর্নেল জাফর ইমাম ১৫তম ইস্টবেঙ্গল এর কমান্ডিং অফিসার, নিজ উদ্যোগেই ২-৩রা নভেম্বরের ক্যু-এর খবর জেনে ব্রিগেডিয়ার খালেদকে সমর্থন জানানোর জন্য ঢাকায় এসে উপস্থিত হন। ১৫তম ইস্টবেঙ্গলকে ঢাকায় আনার আদেশ প্রাপ্ত জাফর ইমাম রংপুর পৌঁছালে তিনি নিজের ইউনিটের সৈনিকদের তাড়া খেয়ে প্রাণের ভয়ে রংপুর থেকে পালিয়ে নোয়াখালিতে তার গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে থাকেন। যাওয়ার পথে নিজের ধাওয়া খাওয়ার খবরটাও ঢাকায় ব্রিগেডিয়ার খালেদকে জানিয়ে দেবার সাহসটুকুও ছিল না তার। ৬ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট হিসাবে জাস্টিস সায়েমের শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। ঐদিনই বঙ্গভবনে সেনা প্রধান খালেদ মোশাররফ দুপুর ১১টায় কমান্ডারদের এক কনফারেন্স করলেন। কিন্তু ৬ই নভেম্বরের বাস্তব অবস্থা ঢাকাসহ অন্য সব সেনানিবাসে ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। ইতিমধ্যে আরেক দফা লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে সব ক্যান্টনমেন্টে এবং শহর-গঞ্জে। খালেদ যখন বঙ্গভবনে কনফারেন্স-এ ব্যস্ত তখন বনানীর এক বাড়িতে সেনা পরিষদের পক্ষ থেকে মেজর মহিউদ্দিন এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে কর্নেল তাহের বসেছিলেন খালেদ বিরোধী বিপ্লবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে। সেই মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হয়-
১। ৬-৭ই নভেম্বর রাত বারোটায় বিদ্রোহ শুরু হবে।
২। বিদ্রোহ পরিচালিত হবে ২য় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট থেকে মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে।
৩। ঠিক রাত বারোটায় মেজর মহিউদ্দিনের নির্দেশে একটি গান থেকে আকাশে ফায়ার করা হবে একটা ট্রেসার গোলা। সেটাই হবে বিপ্লব শুরুর সময় সংকেত ঢাকায় অবস্থিত সব ইউনিটগুলোর জন্য।
৪। কর্নেল তাহের দায়িত্ব নেন শহরের গোপন আস্তানা থেকে বিপ্লবের পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তোলার।
৫। বিপ্লবের লক্ষ খালেদ-চক্রের পতন ঘটিয়ে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেনা পরিষদের মনোনীত জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে তাকে আবার চীফের পদে অধিষ্ঠিত করার পর তার মাধ্যমে খন্দকার মোশতাককে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের আবেদন জানানো হবে।
৬। বিপ্লবকালে এবং পরবর্তী পর্যায়ে যেকোনো ধরনের ভারতীয় আগ্রাসনের মোকাবেলায় জনযুদ্ধ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে প্রতিটি দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর সৈনিক এবং বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দল, সংগঠনের নেতা, কর্মী ও সদস্যদের।
৭। বিপ্লবের সফলতার পর আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।
৮। স্লোগান সমূহঃ
(ক) নারায়ে তাকবির আল্লাহ হু আকবর।
(খ) সিপাহি-জনতা ভাই ভাই খালেদ-চক্রের রক্ত চাই।
(গ) খন্দকার মোশতাক জিন্দাবাদ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
(ঘ) মেজর ডালিম জিন্দাবাদ কর্নেল তাহের জিন্দাবাদ।
(ঙ) রশিদ-ফারুক জিন্দাবাদ খালেদ-শাফায়াত মুর্দাবাদ।
(চ) ডালিম-তাহের ভাই ভাই বাকশালীদের রক্ষা নাই।
(ছ) জেনারেল জিয়া যেখানে আমরা আছি সেখানে।
ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো জানিয়ে দেয়া হয় সব সংশ্লিষ্ট মহলে এবং প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে সেনা পরিষদের ইউনিটগুলোর নেতাদের কাছে। এরপর থেকে রাতের আঁধারে অতি সতর্কতার সাথে সার্বিক প্রস্তুতি চলতে থাকে প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে। রাত ১১টা। বঙ্গভবনে খালেদ ও শাফায়াত তাদের ক্ষমতা দখলকে বৈধ করার জন্য কাগজপত্র ঠিকঠাক করায় যখন ব্যস্ত তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাতের আঁধারে সচল হয়ে উঠছে বিভিন্ন ইউনিট। তারা সবাই প্রস্তুত, অপেক্ষা শুধু বিদ্রোহের সংকেতের। ২ফিল্ড রেজিমেন্টের পাশেই ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। খালেদ-চক্রের দ্বারা বহিষ্কৃত অধিনায়ক কর্নেল আমিনুল হক এবং এডজুটেণ্ট ক্যাপ্টেন মুনিরুল ইসলাম চৌধুরীকে ইতিমধ্যেই চুপিসারে ডাকিয়ে আনা হয়েছে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে। মেজর মহিউদ্দিনকে সার্বক্ষণিকভাবে সব বিষয়ে সাহায্য করছে সুবেদার মেজর আনিস, ক্যাপ্টেন মস্তফা, ক্যাপ্টেন কামাল, ক্যাপ্টেন জুবায়ের ও কয়েকজন বিশ্বস্ত জেসিও, এনসিও এবং সৈনিকরা। বিমান বাহিনীর সার্বিক দায়িত্বে রয়েছে ফ্লাইট সার্জেন্ট আবসার। ল্যান্সার এর ট্যাঙ্কগুলোর নিয়ন্ত্রণ করছে রিসালদার সারোয়ার। ক্যান্টনমেন্টের উত্তরপ্রান্তে বালুরঘাটে অবস্থিত সার্ভিস কোরের ইউনিটগুলো- মেডিকেল, সাপ্লাই, ইএমই ব্যাটালিয়নগুলো ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। রেলক্রসিং পার হলে অর্ডন্যান্স ডিপো। উত্তর পশ্চিমপ্রান্তে সিগন্যাল সেন্টার, ইঞ্জিনিয়ার্স ও লাইট অ্যাকঅ্যাক ইউনিটগুলো বিপ্লবের সংকেতের অপেক্ষায় সার্বিকভাবে প্রস্তুত। সশস্ত্র সবাই। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে কর্নেল তাহের এবং সমমনা রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জমায়েত হচ্ছে বায়তুল মোকাররম, ইউনিভার্সিটি, নীলক্ষেত, মোহাম্মদপুর, কাঁটাবন, ইব্রাহিমপুর, মিরপুর, তেজগাঁও, মগবাজার, এয়ারপোর্ট, মহাখালি, বনানি, টিভি এবং রেডিও স্টেশন এলাকায়, মতিঝিল, শান্তিনগর, প্রেসক্লাব, নিউমার্কেট, শাহবাগ এলাকায়ও সমবেত হচ্ছেন জনগণ। প্রয়োজনে ২য় ফিল্ড হেডকোয়ার্টারের সাথেও যোগাযোগ করছিলেন কর্নেল তাহের। কি ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়ে খালেদ-চক্র এবং সাধারণ জনগণ কিছুই জানতে পারছিল না।
H-Hour চরম মুহূর্ত, রাত ১২ টায়। বিস্ময়কর এক অবিস্মরণীয় ঘটনার সূচনা হতে চলেছে! দেশবাসীকে শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চয়তার হাত থেকে মুক্ত করতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী আর একটি বিপ্লব সংঘটিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে চলেছে।
দ্রুম! মেজর মহিউদ্দিনের নির্দেশে ২য় ফিল্ডের একটি কামান থেকে আকাশে ছোঁড়া হলো একটা ট্রেসার গোলা। রাতের আঁধার চিরে গোলাটা বিস্ফোরিত হওয়ায় আলোকিত হয়ে উঠলো পুরো ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবের সূচনা সঙ্কেত।
সাথে সাথেই চারদিকে শোনা যেতে লাগলো যান্ত্রিক যানবাহন এবং ট্যাঙ্ক বহরের সচল হবার শব্দ। এক এক রেজিমেন্ট থেকে অনবরত আকাশে ছোঁড়া হচ্ছে ট্রেসার। ফলে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে সারা ঢাকা শহর।বিভিন্ন ইউনিটগুলো থেকে বেরিয়ে পড়লো রণসজ্জায় সজ্জিত অফিসার-সৈনিকদের কাফেলা এবং ট্যাংক বহর। তারা সুশৃঙ্খলভাবে ছুটে চলেছে পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যস্থানের লক্ষে। তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে নির্ধারিত গগনবিদারী স্লোগানগুলো। পথিমধ্যে, তারা মাঝে মধ্যে আকাশে গুলি ছুঁড়ছে। ততক্ষণে উল্লাস-উচ্ছ্বাসে শহরবাসীর ঢল নেমেছে রাজপথে। পথের পাশের ঘর-বাড়ির ছাদে-জানালায় দেখা যাচ্ছিলো নারী-পুরুষের মুখ। সবাই হাত নেড়ে বিজয় সংকেত দেখাচ্ছিলো সেনা সদস্যদের। জনগণের মুখেও তখন উচ্চারিত হচ্ছিল সেনা সদস্যদের স্লোগানগুলো। অনেকেই উঠে পড়ছিলো চলন্ত ট্যাংকের উপর।
সামরিক বাহিনীর বিপ্লবী অভ্যুত্থান এভাবেই রূপান্তরিত হয়ে উঠল সিপাহী-জনতার বিপ্লবে। ঐ সমস্ত স্লোগান এবং সৈনিক-জনতার পদভারে প্রকম্পিত তখন সারা ঢাকা শহর। কারো বুঝতে বাকি রইলো না দেশপ্রেমিক সেনারা বিদ্রোহ করেছে কুচক্রী খালেদগংদের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতার বিরুদ্ধে। দেশের বিভিন্ন শহরগুলোতেও একই ভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলো জাগ্রত জনতা।
কোথাও নেই কোনও প্রতিরোধ।সারাদেশে সৃষ্টি হল এক অভাবনীয় ঐক্যবদ্ধ বিজয় উল্লাস! দেশ জুড়ে বইছে খুশির জোয়ার। সৈনিক-জনতা করছে কোলাকুলি। এ যেন ঈদের মিলন উৎসব! দেশের সবপ্রান্ত থেকে যা কিছু ঘটছে সে সমস্ত খবর পাঠানো হচ্ছে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে। আমজনতা প্রতিটি শহরের পথে-ঘাটে-অলিতে-গলিতে করছে মিষ্টি বিতরণ। একাত্মতায় বিলীন হয়ে গেছে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী ও জাগ্রত জনতা। এ ধরনের নজির পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে দেখা গিয়েছে কিনা সেটা আমার জানা নেই। এ ভাবেই সেনা পরিষদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে সৃষ্টি হয়েছিলো এক বিস্ময়কর নজিরবিহীন জাতীয় ঐক্যের ইতিহাস।এই ধরনের সংহতি প্রকাশ করে অকুতোভয় লড়াকু জাতি ভারতের চাণক্যদের একই সাথে তাদের পদলেহি পোষ্য দালালদের জানিয়ে দিয়েছিলো যে বাংলাদেশ একটি অপরাজেয় দুর্গ।প্রতিমুহূর্তের ঘটনাবলী ব্যাংককে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছিলো মেজর মহিউদ্দিন।