জেনারেল মনজুরের সাথে বৈঠক

ভেতরে একটা কামরায় নিয়ে গেলেন এক ভদ্রলোক, তাকেও চিনি না। ঘরে ঢুকে দেখি সিভিল ড্রেসে জেনারেল মঞ্জুর বসে আছেন আমাদের অপেক্ষায়। পৌঁছে দিয়ে ভদ্রলোক রুম থেকে চলে গেলেন। কুশল বিনিময়ের পর জেনারেল মনজুর বললেন
ডালিম, ঢাকায় আসার পর তুমি অনেকের সাথেই দেখা করেছো, কিন্তু আমার সাথে দেখা করনি। তাতে আমি কষ্ট পেয়েছি। Sorry Sir, সময় ও সুযোগের অভাবে সেটা হয়ে ওঠেনি। তবে আপনি ডেকে পাঠালে নিশ্চয় দেখা করতাম। আপনি যাদের দিকে ইঙ্গিত করছেন তারা সবাই ডেকে পাঠাবার পরই দেখা করেছি। তাছাড়া মাহবুব জানালো আপনি খুবই ব্যস্ত থাকেন। তাই বিরক্ত করতে চাইনি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাসঘাতকতা আর একই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত করছেন জিয়া। তারপরও তুমি তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসিয়ে রাখতে সাহায্য করলে কোন যুক্তিতে? কঠিন প্রশ্ন বটে!

স্যার, আমি যাই করে থাকি সেটা আমার একক সিদ্ধান্ত নয়, আমাদের সবার সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্ত। তাছাড়া যাই করা হয়েছে সেটা অবশ্যই কোনও ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে করা হয়নি, সেটা করা হয়েছে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে। এতে জিয়া যদি উপকৃত হয়ে থাকেন সেটা কখনোই আমাদের বিবেচ্য বিষয় ছিল না। যে কারণে ৩রা নভেম্বর আমরা দেশ ছেড়ে ব্যাংকক চলে গিয়েছিলাম ঠিক সেই কারণেই ফারুককে নিরস্ত্র করতে আমি তার সাথে কথা বলেছিলাম। আমার বক্তব্যকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেছিল বলেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফারুক ফিরে চলে গিয়েছিলো স্বেচ্ছায়। কারণটা আপনার মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু স্যার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এত দরদ থাকার পরও ৭ই নভেম্বরের পর জিয়া যে রকম ভাবে অমানুষিক নিষ্ঠুরতার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করে চলেছেন সেইক্ষেত্রে আপনার মতো একজন সচেতন প্রভাবশালী CGS এর পক্ষে কোন কিছুই করার ছিল না কি? সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত আপনি সেই পদেই জিয়ার বিশেষ আস্থাভাজন পার্সোনাল স্টাফ অফিসার হিসাবে তার একজন মুখ্য পরামর্শদাতা হিসাবেই চাকুরি করে চলেছেন। আমি যদি আপনার জায়গাতে থাকতাম তবে আমি কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলেও এ ধরনের অন্যায় বরদাস্ত করে অন্তত চাকুরী করতাম না।

আমি উপায়হীন। সামরিক বাহিনীতে তোমাদের যেমন একটি সংগঠিত শক্তি রয়েছে সেটা আমার নেই। আমি জানি, সেই শক্তিই জিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্রে ৭ই নভেম্বরের পর পুনরায় অধিষ্ঠিত করেছিলো আর্মি চীফ হিসেবে। তাদের জোরেই জিয়া তাহেরকেও পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলো। এবার তোমরা যদি ফারুককে সমর্থন করতে তবে অতি সহজেই জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারতে। CGS হিসেবে আর্মির খবরাখবর আমি রাখি। তাই নিশ্চিত হয়েই আমি এটা বললাম। আর জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করলে শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই নয়, সামরিক বাহিনীর দেশপ্রেমিক বৃহত্তর অংশই তোমাদের সমর্থন করতো। আমার বিশ্বাস এটা তোমারও অজানা ছিল না। তারপরও তোমরা জিয়াকেই বাঁচিয়ে নবজীবন দান করলে?

আপনার মতো বুদ্ধিমানের জন্য বিস্তারিত জবাব না দিয়ে অল্প কথায় বলছি।

স্যার, ঘরের শত্রু বিভীষণকে মারতে গেলে পুরো ঘরটাই বিধ্বস্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। ঠিক একই কারণে ৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েও প্রত্যক্ষভাবে তার মোকাবেলা না করে পরোক্ষভাবে তার মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার এই ছোট্ট জবাবটা নিয়ে একটু চিন্তা করলেই সব কিছুই আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আপনি বুঝতে পারবেন তাহের এবং ফারুকের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান সঠিক না বেঠিক। আপনাকে বিব্রত করার জন্য নয়, সাংগঠনিক শক্তির কথা বললেন তাই বলছি, ১৫ই আগস্টের পর আমি আমাদের পক্ষ থেকে কিন্তু আপনাকে দিল্লী থেকে ডেকে আনিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম এখানে আপনার প্রয়োজন। কিন্তু আপনি ওই সাংগঠনিক শক্তির সাথে এক হয়ে কাজ করতে কোনও আগ্রহ প্রকাশ না করে দিল্লী ফিরে গিয়েছিলেন। এতে আমরা কিছুটা হতাশ এবং বিস্মিত হয়েছিলাম! তাছাড়া সব ক্রান্তিকালে চিহ্নিত কিছু লোকই সর্বদা অগ্রণীর ভূমিকা পালন করবে সেটাই বা যুক্তিসঙ্গত হয় কি করে? আপনি এবং আপনার মতো আরও অনেকেই তো ক্ষমতা বলয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে বহাল আছেন। আপনাদের পক্ষেও তো পথভ্রষ্ট নেতাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা কিংবা তাকে অপসারণ করে যোগ্য ব্যক্তিকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসানোর কাজটি খুব একটা কঠিন নয়। শুধুমাত্র চাকুরি না করে এই বিষয়টি নিয়ে আপনি গুরুত্বের সাথে ভাববেন সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। যদিও বিশ্বাসঘাতকতা এবং চক্রান্তের ফলে বর্তমানে আমরা অনেকটাই দুর্বল তবুও কথা দিচ্ছি, দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে সময়োচিত যেকোনো সঠিক উদ্যোগে আপনার প্রতি আমাদের সমর্থন থাকবে। আমার মনে হয় এরপর আর আলোচনার কিছু নেই।

আমাদের সাথে যোগাযোগ থাকবে নিশ্চয়?

নিশ্চয়ই। ইচ্ছে থাকলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তো কোনও সমস্যা দেখছি না। স্যার, বিদায়ের আগে একটি কথা বলে যাই with no malice, personal interest or grievances যদি অনুমতি দেন।

বলো, অনুমতি দিলেন জেনারেল মঞ্জুর।

আজ আপনার সাথে খোলাখুলি আলাপের মাধ্যমে আপনার চিন্তাধারার কিছুটা হলেও জানতে পারলাম। দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির তেমন কোনও তফাৎ নেই। দিল্লীতে মিলিটারি এট্যাঁ’চে হিসাবে বছর দু’এক কাটিয়ে আসার পর আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মনোভাব এবং নীলনকশাটা কি। জিয়া কোন পথে হাঁটছেন সেটা ৭ই নভেম্বরের পর বুঝতে না পারলেও দেরিতে হলেও এখন আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। এখনও সময় আছে দেশ এবং জাতিকে জিয়ার সর্বনাশা খেলার হাত থেকে বাঁচানোর। এবারের সংগ্রামে অগ্রণী হবার অবস্থাতে আমরা নেই। এবারের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে হবে আপনাদেরকেই বিশেষ করে অগ্রণী হতে হবে আপনাকেই। আমরা আপনাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে একাত্ম হয়ে লড়বো। ফারুক-রশিদও থাকবে আমাদের সাথেই। জিয়াকে কিছুতেই ভারতের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে হাসিনাকে দেশে ডেকে এনে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করতে দেয়া উচিৎ হবে না। যদি তিনি জাতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই কাজটি করেন তখন জনগণের কাছে তার পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত হবে ভারতের দালাল হিসাবে। সেটাই হবে জিয়াকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের সঠিক সুযোগ। সত্যি করে বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা আপনার সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না। রাজনৈতিকভাবে আপনি কতটুকু সচেতন সেটাও আমাদের জানা নেই। আপনার মানশিকতা, চিন্তা ভাবনা, মূল্যবোধ কিংবা আপনি কি ধরনের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করেন এর কিছুই আমাদের জানা নেই। তবু আমি আমাদের তরফ থেকে কেনো আপনাকে দিল্লী থেকে ডাকিয়ে এনেছিলাম জানেন কি? কারণটা ছিল, আপনার সম্পর্কে মাহবুব মানে আপনার ভাগ্নে যতটুকুই বলেছিলো তা থেকে আমাদের মনে হয়েছিলো আর কিছু না হলেও, আপনি একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক এবং গণমুখী জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা। এই পদক্ষেপে মীর শওকত, নাসিম, হেলাল মোর্শেদ-এর মতো আওয়ামীলীগ পন্থী দু’চারজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ছাড়া প্রায় অন্য সবারই সমর্থন পাওয়া যাবে। প্রত্যাগত অফিসারদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলরা এখনও সুসংগঠিত নয়। তাই তারা কোনও ফ্যাক্টর হবে না সেই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। বরং বলতে পারি প্রত্যাগতদের বেশিরভাগই সাপোর্ট করবে। সামরিক বাহিনীর সৈনিক এবং অফিসারদের বৃহদংশের সমর্থনও সুনিশ্চিত। আমরা ৩২ জন সিনিয়র অফিসারকে বের করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শুধুমাত্র দুর্নীতির দায়ে, ঠিক সে ভাবেই এরশাদসহ ভারত এবং আওয়ামীলীগ পন্থী চরিত্রহীন, দুর্নীতি পরায়ণ অফিসারদের বের করে দিতে হবে। এরপর যদি আমাদের আর্মিতে ফিরিয়ে আনা হয় আমরা অতি সহজেই আগামি ২০ বছরের জন্য পরীক্ষিত অফিসারদের বেছে ইউনিট পর্যায় পর্যন্ত Chain of Command তৈরি করে নিতে সক্ষম হবো। দুই বছরের মধ্যে এই কাজটা শেষ করে আমরা চাকুরি ছেড়ে আমাদের সুচিন্তিত নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচি ভিত্তিক দেশব্যাপী সংগঠন গড়ে তুলবো। দেশে থাকবে মাত্র তিনটি সমমনা দল। আমাদের দল ছাড়া, একটি খন্দকার মোশতাকের, অন্যটি হবে ইসলাম ভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের জন্য। আমাদের রাজনীতির ভিত্তি হবে ইসলামিক মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বর্তমানের সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তার উপর রেফারেন্ডাম নেবে পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রেফারেন্ডামে গৃহীত সংবিধানের আওতার বাইরে কোনও রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকবে না। এর জন্য দেশের সব কয়টি দেশপ্রেমিক এবং জাতীয়তাবাদী দল গ্রুপের নেতা-নেত্রীদের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা সবাই ভারতের মোকাবেলায় দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে প্রগতির পথে এগিয়ে যাবার এটাই একমাত্র পথ মনে করে সমর্থন দিতে রাজি আছেন। তারাও মনে করেন অবাধ গণতন্ত্রের নামে মাছের বাজার নয়, সাংবিধানিক সীমিত গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভব একটি পশ্চাদপদ অনুন্নত দেশকে স্বনির্ভর গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা। পটপরিবর্তনের পর ইচ্ছে হলে আপনি আমদের গড়া রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারেন ইউনিফর্ম ছেড়ে। সেনাবাহিনীর পূর্ণ সমর্থন পেলে আমাদের দলই হবে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। কিন্তু এখানে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হল, জিয়ার রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা পাবার আগেই এই পরিকল্পনা কার্যকরী করতে হবে। একবার যদি হাসিনাকে আনিয়ে তিনি রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হন, তবে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সামরিক কিংবা রাজনৈতিক কোনোভাবেই সম্ভব হবে না সহসা। সেটা জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক ভাবে গ্রহণীয়ও হবে না। বিষয়টি যদি যুক্তিসঙ্গত মনে করেন তবে সতর্কতার সাথে দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে এগুবার এখনই সময়। জিয়াও দ্রুত এগুচ্ছেন তার পথে সেটাতো বুঝতেই পারছেন। তাই আপনাকে দ্রুততর হতে হবে। একমাত্র এইভাবেই আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে অতীতের সব ভুল-ভ্রান্তি আর রক্তক্ষরণের পরও আমাদের চেতনা আর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করা। অন্য আর কোনও পথ নেই। সাহসিকতার সাথে নিঃস্বার্থ হয়ে বৃহত্তর জনস্বার্থে এগুলে বিজয় আল্লাহ্পাক আপনাকে দেবেন ইন শাহ আল্লাহ। শেষ কথা, বর্তমানে আপনিই হচ্ছেন জিয়ার রাহুর গ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচানোর শেষ অবলম্বন। সময় থাকতে উপযুক্ত উদ্যোগ না নিলে আপনি এবং অন্য যারা এখনো ক্ষমতা বলয় মানে আর্মিতে রয়েছেন তাদের অবস্থাও হবে আমাদেরই মতো কিংবা এর চেয়েও শোচনীয়। বিশেষ করে আপনাকে আর্মিতে রাখবেন না জিয়া এটা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। আমরা জিয়ার জন্য এতো কিছু করেও তার টার্গেটে পরিণত হয়েছি। কিন্তু কিছু না করলেও আপনি তার টার্গেট হবেন। Have no misgiving about that, Sir. কর্নেল জিয়াউদ্দিন, কর্নেল তাহের এবং মেজর জলিলকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম আমাদের স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তার মূল হচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। কিন্তু সমাজতন্ত্রের ভূতের প্রভাবে তারা সেটা বুঝতে পারেননি। ইসলাম শুধু মাত্র একটি ধর্ম নয়, ঐশ্বরিক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মার্ক্সসিজম ধনতন্ত্রের একটি এন্টি-থিসিস। তাই চিরস্থায়ী কোনও দর্শন নয়। সময়ের সাথে এরও বিলুপ্তি ঘটবে সমাজ বিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্ব অনুযায়ী। সাম্যবাদ আর সমাজতন্ত্র কোনও মৌলিক দর্শন নয়, এগুলোও প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব। তাই ক্ষণস্থায়ী। তাছাড়া ইসলামের সাথে সাম্যবাদ এবং সমাজতন্ত্রের কোনও বিরোধ নেই। তারা বিপথগামী না হলে জিয়ার পক্ষে আমাদের শক্তিকে এভাবে খর্ব করা কোনোক্রমেই সম্ভব হতো না। ভবিষ্যতে আপনি কি করবেন সেটা নিতান্তই আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে যাই করবেন সেটা করতে হবে খুবই সতর্কতার সাথে। আমি শুধু আমার সীমিত জ্ঞানে কিছু চিন্তার খোরাক দিয়ে গেলাম। পরিশেষে, আপনাকে একটি কথা জানিয়ে যাচ্ছি, ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের ঘটনা কোনও তাৎক্ষণিক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে যুদ্ধকালীন সময় থেকে সুচিন্তিত রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচি ভিত্তিক গোপন প্রচেষ্টা। সেই প্রচেষ্টাতে আপনাকে সামিল করানোর চেষ্টা করে আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম। আপনি আমাকে সেই সুযোগ দেননি। সেটা স্ব-ইচ্ছায় না আমার ইঙ্গিত না বুঝে সেটা বলা সম্ভব নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ১৫ই আগস্টের পর আপনাকে ডেকে আনার পরও আপনি আমাদের একজন হয়ে কাজ করতে তেমন কোনও আগ্রহ প্রকাশ করেননি।

ডেকে পাঠানোর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন। এই ধরণের বৈঠক আগে হলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হতো। তবে সবকিছুই ঘটে আল্লাহর ইচ্ছায়। দেরিতে হলেও আজকের বৈঠকের জন্য আল্লাহ্ পাকের শুকরিয়া অবশ্যই আমাদের আদায় করতে হবে। আল্লাহ্ দেশ ও জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে আপনার সহায় হউন সেই দোয়া করবো। সেনাসদরে একটা জাতসাপের ঝাঁপিতে রয়েছেন, সেটা সবসময় মনে রেখে আপনাকে চলতে হবে। শওকত, এরশাদ, নাসিম, নুরুদ্দিন, মহব্বতজান চৌধুরী, মচ্ছু সালাম, হেলাল মোর্শেদ, মইনুল হোসেন চৌধুরী, আমিনুল হককে কোনোভাবেই বিশ্বাস করবেন না। এরা সবাই জিয়ার চোখ আর কান। বুকে বুক মিলিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলাম। সাচো নীরব সাক্ষী হয়েছিল পুরোটা সময়। বেরিয়ে এসে গাড়ীতে বসে বলেছিলো দোস্ত, তুই আজ আমাকে অবাক করে দিয়েছিস! এতো স্পষ্ট করে জোরালো যৌক্তিকতার সাথে নির্ভীকভাবে জেনারেল মঞ্জুরকে যা বলে এলি এর প্রশংসা না করে পারছি না। আমার বিশ্বাস, তিনি তোর বক্তব্যকে গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করবেন। বাসায় নামিয়ে দিয়ে সাচো চলে গেলো। সন্ধ্যায় মাহবুব এসে জানালো, দু’দিন পর আমার ফ্লাইট কনফার্ম করা হয়েছে।

স্যার, মামা আপনাকে ডেকেছিলেন?

ডাকটা কি তোমার কেরামতি নাকি? আমার কথার উত্তরে মাহবুব কিছু না বলে তার অতিপরিচিত মৃদু হাসিটাই হাসলো। হ্যাঁ, এইমাত্র ফিরলাম তার সাথে বনানীর এক বাড়িতে দীর্ঘ আলাপ করে। আলাপের বিষয়ে তুমি কিছুই জানতে চাইবে না, কারণ মামাই সেটা ভাগ্নেকে বলবেন। জবাবটা দেবার পর দুইজনই জোরে হেসে উঠলাম।

আচ্ছা স্যার, একটা প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছিনা। ৭ই নভেম্বরের পর বিপ্লবীরা জিয়াকে সেনাপ্রধানের পদে বসানোর পর জিয়া জনাব খন্দকার মোশতাককে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেন কিন্ত মোশতাক তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কেনো?

জবাবটা খুঁজে পাবার জন্য পর্দার আড়ালের কিছু তথ্য তোমাকে জানতে হবে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ বিরোধী বৈপ্লবিক অভ্যুথানের সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ব্রিগেডিয়ার খালেদের সাথে আমাদের বোঝাপড়ার পর বঙ্গভবনে কর্নেল তাহেরের সাথে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সফল অভ্যুত্থানের পর জিয়াকে মুক্ত করে চীফের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে। তারপর জিয়া আমাদের ফিরিয়ে আনবেন সেনাবাহিনীতে। একই সাথে জিয়াই অনুরোধ জানাবেন খন্দকার মোশতাকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে। এভাবেই আগস্ট বিপ্লবের চেতনা ও ধারাকে এগিয়ে নেবার পথ নিশ্চিত করা হবে। তাহের সেইসব সিদ্ধান্ত মেনে নেন। বৈঠকে এটাও নির্ধারণ করা হয় সেনা পরিষদের প্রবাসী নেতারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবেন কর্নেল তাহের এবং দেশের সব কয়েকটি সেনানিবাসে সেনা পরিষদের নেতাদের সাথে। বাস্তব অবস্থার নিরিখে অনুকূল সময়ে পর্যালোচনার পর প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের পরই যৌথ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিপ্লব সংগঠিত করা হবে। এভাবেই ঘটানো হয়েছিল ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান যা পরে পরিণত হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত সিপাহী-জনতার বিপ্লবে। দেশত্যাগের আগেই এই সিদ্ধান্তগুলো প্রতিটি সেনানিবাসের সেনা পরিষদের ইউনিট কমান্ডারদের জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো।

সেই বৈঠকেই প্রণীত হয়েছিলো কিভাবে কন সময় খালেদ-চক্রকে উৎখাত করা হবে সেনা পরিষদ এবং তাহেরের বিপ্লবী সংস্থার যৌথ উদ্যোগে। আমরা জানতাম, দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর খালেদ-চক্র নিজেরাই তাদের প্রো-আওয়ামী-বাকশালী স্বরূপটি প্রকাশ করে বিপ্লবের সুযোগটা সৃষ্টি করে দেবে। আর সেটাই হবে উপযুক্ত সময় বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর। বৈঠকে গৃহীত পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জিয়া সেনা পরিষদের নির্দেশেই খন্দকার মোশতাককে অনুরোধ জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। জবাবে জনাব খন্দকার মোশতাক জিয়াকে বলেন, কালবিলম্ব না করে ব্যাংকক থেকে আমাদের আর্মিতে ফিরিয়ে আনতে। আমরা ফিরলেই তিনি আবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, তার আগে নয় সেটাও তিনি জিয়াকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু জিয়া তাকে বলেছিলেন, আমাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তার কিছু সময়ের প্রয়োজন। তার এই জবাবকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেননি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী খন্দকার মোশতাক। তার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় তিনি বুঝতে পারেন জিয়ার মনে অন্য কন অভিলাষ গজিয়ে উঠেছে। খন্দকার মোশতাক একজন প্রবীণ ঝানু রাজনীতিবিদ।

১৫ই আগস্টের পর The Time ম্যাগাজিন তার সম্পর্কে একটি স্পেশাল প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণতার বিচারে তাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি লালবাহাদুর শাস্ত্রীর উপরে স্থান দেয়। আমরা যুদ্ধকাল থেকেই তার রুশ-ভারত বিরোধী অবস্থান সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত ছিলাম। তাছাড়া তিনি আব্বার সহপাঠী ছিলেন। তাই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তার সাথে আলোচনার পরই তাকে রাষ্ট্রপতি বানিয়ে আওয়ামী-বাকশালীদের বৃহদংশকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে এনে বাকশাল এর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে সারাবিশ্বে প্রমাণিত করতে সমর্থ হয়েছিলাম যে শুধু দেশবাসীই নয়, বাকশালের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও মুজিবের এক দলীয় বাকশালী স্বৈরতন্ত্রকে মেনে নেয়নি। কিন্তু মুজিবের নিষ্পেষণের ভয়ে তারা প্রতিবাদ করতে পারেননি। খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি বানানোর জন্যই গণচীন, সৌদি আরব, পাকিস্তান সহ পৃথিবীর প্রায় সবদেশের স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব হয়েছিলো। যার ফলে, সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত ভারত বাংলাদেশে সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে আমেরিকা এবং গণচীনের হুমকির মুখে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। জিয়ার মনোভাব আমাদের জানাবার পর আলোচনার মাধ্যমেই খন্দকার মোশতাক নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে জিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সাংবিধানিক জটিলতার অজুহাত দেখিয়ে।

I am simply baffled to see the maturity of you all compared to ages. Thank you very much Sir, for sharing so many sensitive information in details. বলেই মাহবুব আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল সব মহলেই আপনি একজন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক, স্পষ্টবাদী, সাহসী, আপোষহীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচিত। কিন্তু আপনার রাজনৈতিক সচেতনতা এবং জ্ঞান যে এতো গভীর সেটা আমিও বুঝতে পারিনি কাছের মানুষ হয়েও। কিছুটা লেখাপড়া আর কিছুটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এর বেশী কিছুই নয়।

এরপর দেশত্যাগ করার আগ পর্যন্ত সময়টা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আর ঘনিষ্ঠজনদের সাথে দেখা সাক্ষাত করে আনন্দেই কেটে গেলো। শিশুভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি আমাকে বলেছিলেন

ডালিম, তুমি আবারও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে যে অবদান লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে গেলে একদিন জাতি নিশ্চয় তার স্বীকৃতি দেবে। My hats off to you বলে আমাকে উষ্ণ আন্তরিকতায় জড়িয়ে ধরে বিদায় জানালেন। ধরা গলায় বললেন, জানিনা আবার কবে তোমার সাথে দেখা হবে। তবে দোয়া রইলো যেখানেই থাকো আল্লাহ্ তোমার সহায় হউন, ফিরে গিয়ে বাকি সবাইকে আমার ভালবাসা আর দোয়া জানিও।

আপনি যেভাবে আমার খেয়াল রাখলেন স্নেহের ছায়ার আচ্ছাদনে পুরোটা সময় সেটার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আপনাকে ছোট করবো না।তবে জীবনে কখনও ভুলবো না আপনার এই নিঃস্বার্থ স্নেহ-ভালোবাসার ঋণ। ফিরে গিয়ে সবাইকে বলবো সবকিছুই। You are really great, too good to be true! আমাদের নাবালক ভাই! দু’জনেই হেসে উঠলাম।