ফিরে এলাম নাইরোবিতে

নাইরোবিতে আমরা ফিরে এসেছি। এখন নির্বাচনের অপেক্ষায় দিন গুণে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। মাঝে একদিন সেনাসদর থেকে খবর পেলাম এরশাদের অনেক সাঙ্গপাঙ্গকে সেনাবাহিনী থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। অনেককেই দুর্নীতির মামলায় জেলেপুরা হয়েছে। জেনারেল এরশাদের বিশ্বস্ত DGFI জেনারেল আশরাফ এবং DG NSI ব্রিগেডিয়ার নাসেরকে আর্মি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের বিভিন্ন গর্হিত কীর্তিকলাপের জন্য। জেনারেল এরশাদের সকল কুকর্মের শিরোমণি ছিল এই দুই অফিসার। আরও জানতে পারলাম বিচারপতি সাহাবুদ্দীন নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষে ভোটারদের নিরাপত্তার জন্য সেনা মোতায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রশাসনকে নির্দলীয় করণের জন্য আমলাতন্ত্রে রদবদল করা হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ সহ উন্নতবিশ্বের প্রায় সবদেশই পর্যবেক্ষক পাঠাতে রাজি হয়েছে।দেশে নির্বাচনী জোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে। সর্ববিবেচনায় খালেদা জিয়াই জয়ী হয়ে পরবর্তী সরকার গঠন করবেন বলেই সব মহলের অভিমত। বিদেশেও বিভিন্ন দেশের ক্ষমতা বলয়ে খালেদা জিয়ার প্রতিই সহানুভূতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেই সময় রব্বানির এক পুরনো সহকর্মী জনাব সাইদউদ্দিন সিদ্দিকি, হাবিব ব্যাঙ্কের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ঢাকায় কান্ট্রিহেড হিসাবে পোস্টেড ছিলেন। তিনিই রব্বানিকে বলেছিলেন, ‘৯১ সালের নির্বাচনকালে বিদেশের বিভিন্ন একাউন্ট থেকে কোটি কোটি টাকা আসতো আর সেই টাকা উঠিয়ে নিতেন বেগম খালেদা জিয়া। একই ভাবে জামায়াতে ইসলামীসহ খালেদার নেতৃত্বাধীন জোটের শরিকদের জন্যও বিদেশ থেকে এসেছে হাবিব ব্যাঙ্কে মোটা অঙ্কের টাকা বিভিন্ন দেশ থেকে।
এই অর্থের সংকুলানের পর নির্বাচনী প্রচারণায় ভারতের মদদপুষ্ট আওয়ামীলীগ জোটের মোকাবেলা করা সম্ভব হয়ে ওঠে খালেদা জিয়ার জোটের পক্ষে। জনসমর্থন ক্রমশ খালেদা জিয়ার জোটের প্রতি বাড়তে থাকে। যতই দিন এগুচ্ছে খালেদার জোটের বিজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠছে। সব মহল থেকে তেমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। অবশেষে সব প্রতীক্ষার পর এল নির্বাচনের দিন।সকাল থেকে আমি ও রব্বানি আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে পরদিন রাত পর্যন্ত খাতা-কলম হাতে টেলিফোনের মাধ্যমে ভোটিং প্যাটার্ন এবং সেই হিসাবে সিটের হিসাব-নিকাশ করতে থাকলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই ছিল সবচেয়ে ফ্রি আর ফেয়ার ইলেকশন। অনেক সিটের ব্যবধানে বিজয়ী হল বিএনপি জোট। নির্বাচনের অফিসিয়াল ফলাফল ঘোষিত হলে বিএনপি জোট সরকার গঠন করবে সেটাই বাস্তব সত্যে পরিণত হল। এই বিজয়ে বিস্মিত হয়ে গেল আওয়ামীলীগ জোট এবং ভারতের চাণক্যরা। তাদের নিশ্চিত বিজয় বিএনপি জোট এভাবে ছিনিয়ে নিতে পারে সেটা তাদের জন্য ছিল কল্পনাতীত। এই অপ্রত্যাশিত পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না আওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। এরশাদের সমর্থনও ছিল সুনিশ্চিত। তারপরও ভরাডুবি হল কি করে আওয়ামীলীগের! সেটাই ভাবিয়ে তুলেছিল ভারতকে। অফিসিয়াল রেজাল্ট বের হবার আগেই হাসিনা এক প্রেস কনফারেন্সে হাস্যকর অভিযোগ তুললেন নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে। কিন্তু তার অভিযোগ ধোপে টিকল না। তখন প্রতিহিংসা পরায়ণ হাসিনা ঘোষণা দিলেন সরকারকে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না। গণতান্ত্রিক মানসিকতার এক বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ!
ফোন আসা শুরু হল বেইজিং, রিয়াদ, আবুধাবি, দুবাই, ত্রিপলি, কাতার, তেহরান এবং ইসলামাবাদ থেকে। বন্ধুরা সবাই আমার বিচার-বিশ্লেষণের সত্যতা বাস্তবে প্রমাণিত হওয়ায় সানন্দে অভিনন্দন জানালেন। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেই আমাকে ঢাকায় জরুরী ভিত্তিতে ডেকে পাঠালেন সপরিবারে। জবাবে বললাম ঢাকায় আসার পথে বিভিন্ন দেশের বন্ধুবান্ধব যারা আন্তরিকভাবে সাহায্য সহযোগিতার জন্য কাজ করেছেন দের ধন্যবাদ জানিয়ে আসতে চাই। তিনি জবাবে বললেন অবশ্যই। নিম্মিকে সাথে নিয়ে যাবার জন্য আবারও অনুরোধ জানালেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। রব্বানিকে অনুরোধ করলাম আমার সাথে ঢাকা যাওয়ার জন্য। কিন্তু রব্বানি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলো ঠিক এই মুহূর্তে তাকে প্রকাশ্যে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। পরে উপযুক্ত সময় ঢাকা যাবার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যাবে। আমরা দু’জনই আমাদের সব প্রচেষ্টার সফলতায় তৃপ্ত এবং স্বস্তি বোধ করছিলাম। কিন্তু নিম্মি এই বিজয় সম্পর্কে একেবারেই ভাবলেশহীন। রব্বানি তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল কি ব্যাপার নিম্মি, মনে হচ্ছে খালেদা জিয়ার বিজয়ে তুমি একেবারেই নির্বিকার! জবাবে নিম্মি তার পূর্ব অবস্থানে অনড় থেকে বললো

আমি এখনো একই কথা বলবো। নিম্মির অভিব্যক্তিতে আমরা দু’জনই কিছুটা বিস্মিত ও বিমর্ষ হলাম। স্বল্পভাষিণী নিম্মির অতীতের সব কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে, বিশেষ করে মানুষ চেনার ক্ষেত্রে। তাই তার সাথে বিতর্কে যাবার Moral courage আমাদের ছিলো না।