বাংলাদেশ

আমাদের এই ভূখণ্ড বা দেশের উৎপত্তি হয়েছে মূলত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা এবং এদের হাজারও শাখা-প্রশাখা বাহিত পলিমাটি দ্বারা। আদিবঙ্গের জন্ম দিয়ে ঐ সমস্ত স্রোতস্বিনী বিলীন হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। পলিমাটি দ্বারা সৃষ্টি এই ভূখণ্ডের প্রাচীন ঐতিহাসিক নাম ছিল বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ। ‘বঙ্গ’ শব্দের আভিধানিক মানে হচ্ছে সঙ্কর ধাতু দিয়ে জোড়া লাগানোর দেশ। এ থেকেই ধারণা করা যায়, প্রাচীন সমসাময়িক সভ্যতার কাতারে বঙ্গদেশের স্থান ছিল শীর্ষ পর্যায়ে। কারণ, খনিজ ধাতব পদার্থ যেমন সোনা, লোহা, তামা, কাঁসা, টিন ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাযুক্তিক জ্ঞান ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধাতুর ব্যবহারের মাত্রা আজও গণ্য করা হয় সভ্যতার মানদণ্ড হিসাবে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর আদিবাসভূমি বঙ্গদেশের রয়েছে একটি ঐতিহাসিক সীমানা। উত্তরে হিমালয়ের গা ঘেঁষে নেপাল, ভুটান, সিকিম, উত্তরপূর্বে আসাম, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, অরুণাচল, মেঘালয়, উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্বারভাঙ্গা পর্যন্ত ভাগীরথীর অববাহিকার সমতল এবং রাঢ়ভূমি-রাজমহল, সাঁওতাল পরগণা, ছোটনাগপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, পশ্চিমবঙ্গের পুরোটাই, বিহারের বীরভূম, মানভূম, কেওঞ্জর, ময়ুরভঞ্জের অরণ্যময় মালভূমি, অঙ্গ, বর্তমানের মিথিলা ও কলিঙ্গ উড়িষ্যার অংশ হিসাবে বাংলাদেশের তথা আদিবঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পূর্বে মিয়ানমার আর শ্যামদেশ ঘেষে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই সুবিশাল আদিবঙ্গ বা বাংলাদেশের সীমানার মধ্যেই গৌড়, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, রাঢ়, সুহ্ম, তাম্রলিপ্ত, সমতট, অঙ্গ, বাঙ্গাল, হরিকেল নামের ঐতিহ্যময় জনপদ গড়ে তুলেছিল বঙ্গবাসী বা বাংলাদেশীরা। কোল, ভীল, শবর, পুলিন্দ, হাড়ী, ডোম, চণ্ডাল, সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাও, ভূমিজ, বাগদী, বাউরি, পোদ, মালপাহাড়ি প্রমুখ অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর মিলন এবং তাদের সাথে বহিরাগত নানা রক্তের ধারা মিশে এক হয়ে গড়ে উঠে বঙ্গবাসী কিংবা বাংলাদেশী জাতিসত্তার।

কালের স্রোতে বহিরাগত আগ্রাসী শক্তিদের দ্বারা বাংলাদেশীদের আবাসভূমি খণ্ডিত হলেও ঐতিহাসিক সীমানা একদিন অবশ্যই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে প্রাকৃতিক নিয়মেই। রাষ্ট্রীয় সীমানা অনিবার্যভাবে অতীতের মতো পরিবর্তনশীল থাকবে আগামীতেও। আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রাচীনকালে গড়ে তুলেছিলেন প্রসিদ্ধ জনপদগুলো। সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছেন, জন্ম দিয়েছিলেন বিস্ময়কর সংস্কৃতি ও শিল্প ঐতিহ্যের। এই ঐতিহ্য আমাদের জাতীয় অধিকার। আজ রাষ্ট্রীয় সীমানা এবং জাতীয়তাবাদ নিয়ে গোষ্ঠীস্বার্থে অযথা যতই বিতর্কের অবতারণা করা হোক না কেন, বাংলাদেশের সচেতন জনগণকে বোকা বানিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা সম্ভব হবে না চিরকাল। তারা তাদের অতীত ঐতিহ্য এবং ন্যায্য অধিকার সময় মতো আদায় করে ছাড়বেই যোগ্য উত্তরসুরি হিসাবে ইন শা আল্লাহ্‌। সমাজ জ্ঞানী এবং বিপ্লবী মাও সে তুং বলেছেন, ‘বিজাতীয়দের স্বার্থে যেসমস্ত জাতিসত্তা এবং তাদের রাষ্ট্রীয় সীমানা বিভিক্ত করা হয়েছে ছলে বলে কৌশলে, তারা একদিন আবার একত্রিত হবে এবং পুনরুদ্ধার করবে তাদের হারানো ভূখন্ড।’ এই বাস্তবতায় লেখকের বিশ্বাস, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অতীত ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করে পূর্ণমর্যাদায় একদিন প্রতিষ্ঠিত করবে প্রকৃত বাংলাদেশ এবং সারা দুনিয়াতে মাথা উঁচু করে দাড়াতে সক্ষম হবে গর্বিত বাংলাদেশী হিসাবে। উদীয়মান সূর্য ক্রমশ পূর্ণতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে আর তারই আলোকে স্বচ্ছ শতাব্দীকালের ধারায় গঠিত প্রকৃত বাংলাদেশ। এটা লেখকের কাল্পনিক দিবাস্বপ্ন নয়। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই ভবিষ্যতে একদিন এই স্বপ্ন রূপান্তরিত হবে বাস্তব সত্যে। আমাদের এই দেশের নাম বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ। প্রশ্ন দেখা দেয় ‘বাংলা’ অথবা ‘বাঙ্গালা’ এবং ‘বাঙ্গালী’ শব্দের উৎপত্তি হল কি করে? ঐতিহাসিক পটভূমিকায় আবুল ফজল ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে বাংলা বাঙ্গালা, বাঙ্গালী শব্দের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটা হল- প্রাচীন বঙ্গ শব্দের সাথে ‘আল’ শব্দ যুক্ত করে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ্‌ বাংলা শব্দের চয়ন করেন। আল শব্দের অর্থ পানি রোধ করার ছোট বড় বাঁধ। অন্যদিকে, সুকুমার সেনের অভিমত হল- প্রথমে বঙ্গ থেকে বাঙ্গালাহ শব্দের সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম শাসন আমলে। পারসিক শব্দ বাঙ্গালাহকে পর্তুগীজ দস্যুরা বানিয়েছে বেঙ্গল আর বঙ্গবাসীদের নামকরণ হয় বেঙ্গলী। ইংরেজরা এই পরিভাষাকেই বহাল রাখে তল্পিবাহক চাণক্যদের অনুরোধে। বর্তমান বাংলাদেশে এখনো জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে বিভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয়। সমাজের শক্তিধর গোষ্ঠী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, এবং রাজনীতিবিদরা এই বিভ্রান্তিকে আরও জটিল করে তুলেছেন ক্ষণস্থায়ী ফায়দা লুটার জন্য। এই বিভাজনকারী বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য বুদ্ধিজীবীদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রয়োজন তাও প্রায় অনুপস্থিত। জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে পরিষ্কার ভাবে সত্যকে আমাদের জানতে হবে, আমাদের জাতীয়তাবাদ কি? ‘বাংলাদেশী’ না ‘বাঙালী’! আদিবঙ্গ অববাহিকা ও তদসংলগ্ন অঞ্চল যে দক্ষিণএশিয়া উপমহাদেশে প্রাচীন কালে সুপরিচিত, স্ব-বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল একটি উন্নত বিত্তশালী অঞ্চল হিসাবে পরিগণিত হতো তার অসংখ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে বর্ণিত রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০-১০০০ সালের মধ্যে ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গের কথা রয়েছে। মহাভারত ও হরিবংশেও দেখা যায় বঙ্গ প্রসঙ্গ। সুতরাং বাংলাদেশী জনগণকে অর্বাচীন বলে আখ্যায়িত করার কোনও উপায় নেই। রামায়ণেও বঙ্গের উল্লেখ আছে। এদেশের সর্বত্র ক্ষৌম কাপাশিক বস্ত্রশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল বলেও কৌটিল্য বয়ান করেছেন। বরাহ মিহির (৫০০-৫৪৩) খ্রিস্টাব্দে তার ‘বৃহৎ সংহিতা’ গ্রন্থে পূর্বাঞ্চলীয় দেশকে বঙ্গ বলে অবহিত করেছেন। সতীশচন্দ্র মিত্র যশোর, খুলনা, সংলগ্ন দক্ষিণবঙ্গের কিছু অংশকে উপবঙ্গ রূপে সনাক্ত করার প্রয়াস পান।

হিমযুগের পর থেকে বাংলাদেশ কখনো জনশূন্য থাকেনি। পৃথিবীর অন্যান্য মানব সভ্যতার মতো বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীরও বিবর্তন ঘটে ছিল। কারণ, এখানেও প্রত্ন প্রস্তর এবং তাম্র যুগের অস্ত্র সম্ভার ও মুদ্রা পাওয়া গেছে। ভাষার ও আকৃতির ঐক্য হতে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় বাংলাদেশের আদিম জনগোষ্ঠী একটি বিশেষ মানবগোষ্ঠীর বংশধর। এই মানবগোষ্ঠীর সাথে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের চেহারা, গড়ন এবং ভাষার মিল পাওয়া যায় বলেই এদের বলা হয় অস্ট্রো-এশিয়াটিক অথবা অস্ট্রিক। বাংলাদেশের দোরগোড়ায় রাজমহল পাহাড়, সেখানের বনজঙ্গলে বসবাসকারী পাহাড়িদের ছোটো-খাটো গড়ন, চেহারা, গায়ের রং কালো, নাক থ্যাবড়া। বেদ ও নিষাদে যে বর্ণনা আছে তাতে বঙ্গবাসীদের সাথে সিংহলের ভেড্ডাদের হুবহু মিল রয়েছে তাই, এদের নৃতাত্ত্বিক নামকরণ হয় ভেড্ডীড। নিষাদজাতি বলেও এই দুই জনগোষ্ঠীকে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রাচীন বাংলাদেশে নানা পরিবেশে এবং জল হাওয়ায় দলগত ভাবে মানুষ বসবাস করতো। পরে তাদের রক্তে বহিরাগতদের রক্তের ধারা এসে মিশেছে পর্যটন ও ব্যবসায়িক সূত্রে। বাঁচবার আলাদা আলাদা প্রক্রিয়া এবং ভিনদেশী রক্তের মেলামেশার দরুন স্থান ভেদে চেহারায় বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। মননশীলতায়, ভাষায়, সভ্যতার বাস্তব উপাদানে তার প্রচুর ছাপও রয়েছে। বাংলাদেশের মাটি আর সেই মাটিতে নানা নৃতাত্ত্বিক জাতের মিশ্রণের ফলেই বাংলাদেশের জনপ্রকৃতির মাঝে ঐক্যের শেকড় দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে আছে।বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীগণের বহিরাগত আর্যদের সাথে কোনও সংশ্রব ছিল না। বাংলা ভাষার বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছেন। উপরন্তু, আর্য কিংবা দ্রাবিড় আসলে নরগোষ্ঠীর নাম নয়, ভাষাগোষ্ঠীর নাম মাত্র। একই নরগোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার চলন থাকতে পারে। কাজেই শুধুমাত্র ভাষা দিয়ে কোনও নরগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ যুক্তিগত কারণেই সঠিক নয়। শুধুমাত্র একটি উপাদানের উপর ভিত্তি করে কোনও জাতিসত্তার বিকাশ সম্ভব নয়। জাতীয়তাবাদ গঠনে মূলত ভূখণ্ড, ভাষা, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ বিশেষ ভূমিকা রাখে। যেকোনো ভূখণ্ডে ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, জাত, কুল, নির্বিশেষে যখন কোন জনগোষ্ঠী এক সামগ্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে তখনই জাতীয়তাবাদ প্রাণ পায়। জাতীয়তাবাদ মূলত এক ধরনের অনুভূতি, এক ধরনের আবেগ তাড়িত মানসিকতা, এক ধরনের একাত্মবোধ ও চেতনা যা সৃষ্টি হয় প্রবহমান জীবনধারায়। জাতীয় সংগ্রামের ধারায় গতিশীলতা অর্জন করার জন্য কখন কোন উপাদানটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে সেটা নির্ভর করে সময়, বাস্তব পরিস্থিতি, সংগ্রামের লক্ষ, জনগণের প্রত্যাশা এবং নেতাদের সিদ্ধান্তের উপর। অতীত সম্পর্কে গৌরববোধ, বর্তমানের সুখ কিংবা বঞ্চনা আর ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগ্রত করে এবং জনমনে গড়ে তোলে ঐক্যবদ্ধ মূর্ছনা। এ ধরনের ঐক্যবদ্ধ চেতনা যখন সাধারণ জনগণকে একত্রিত করে তখন সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তা হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। সামাজিক সত্তা হিসাবে সেটা বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশিত হলেই একটি জাতি সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য নৈতিকভাবে প্রস্তুত হয়। বাংলাদেশীদের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের এক পর্যায়ে ভাষা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে এ কথা সত্যি, তাই বলে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদকে বাঙালী জাতীয়তাবাদ বলে আখ্যায়িত করলে সেটা হবে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হাজার বছরের ঐতিহ্যে গড়ে ওঠা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উপর একটি ভাষাগোষ্ঠীর আধিপত্য চাপিয়ে দেয়া। কারণ, বাংলাভাষীর সমার্থক বাঙ্গালী শব্দটি কোনও নরগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচিতি নয়, ভাষাগোষ্ঠীর পরিচিতি মাত্র।