জিয়ার ডাকে ঢাকার পথে

যাই হউক, জমিরের ব্যবস্থা অনুযায়ী একদিন আমি নিম্মিকে সাথে নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে উড়াল দিলাম ঢাকার পথে। লন্ডনে পৌঁছে জানতে পারলাম রশিদ জার্মানি হয়ে ঢাকায় পৌঁছে গেছে আর ফারুক সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছে। খবরগুলো আমাদের কাছ থেকে গোপন করে রাখায় সন্দেহ হল, এর পেছনে কিছু একটা মতলব আছে। খবরগুলো বেনগাজীতে জানিয়ে দিয়ে বললাম সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে এলার্ট থাকতে হবে। লন্ডন থেকে ঢাকা যাওয়ার সব ব্যবস্থা লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন করেছিলো। নির্ধারিত দিনে বিমানের একটা ফ্লাইটে ঢাকায় যাবার জন্য হিথরো এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। সেই সময় আমার শ্বশুর সাহেব লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কন্স্যুলার মিনিস্টারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। Basically, he was an Ex-PSP Officer, পদবীতে ছিলেন DIG Police. মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনিও জনাব হোসেন আলীর সাথে Calcutta Mission থেকে একসাথে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের পক্ষে Defect করেছিলেন। তার কর্মনিষ্ঠা, নীতি-আদর্শ, সততা পাকিস্তান আমল থেকেই ছিল সর্বজনবিদিত। তার চরিত্র বোঝার জন্য দুই একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি। ষাটের দশকের শেষার্ধে চট্টগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যায় এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অপরিসীম। তখন আমার হবু শ্বশুর জনাব আর আই চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ছিলেন আজম খান। জেনারেল আজম অবাঙ্গালী হয়েও ছিলেন এক অসাধারণ মানবিক গুণে গুণান্বিত ব্যাক্তি। বাঙ্গালীদের জন্য তার আন্তরিক ভালোবাসা এবং বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বৈরী আচরণের বিরোধিতার ইতিকথা আজো বাংলাদেশী জনগণ শ্রদ্ধার সাথেই স্মরণ করে। জনাব চৌধুরী দুঃস্থ জনগণের পুনর্বাসনের জন্য দুর্গত এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রমের সাথে ত্রাণ কাজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার কাজে খুশি হয়ে জেনারেল আজম খান পুরস্কার হিসাবে তাকে ঢাকার অভিজাত গুলশান আবাসিক এলাকায় দুই বিঘার দুইটি প্লট বরাদ্দ করেন। খবরটা জেনে জনাব চৌধুরী গভর্নর সাহেবের সাথে সাক্ষাত করে তাকে বলেছিলেন একজন বেতনভুক সরকারি চাকুরে হয়ে সাধ্যমত তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তার জন্য কোন পুরস্কার গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। জবাবে গভর্নর আজম খান কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘If you don’t take it as a free gift then pay through monthly installments.’ জনাব চৌধুরী বলেছিলেন সংসারের খরচ চালিয়ে সেটাও সম্ভব নয়। তাই কৃতজ্ঞতার সাথে তিনি গভর্নর সাহেবকে অনুরোধ করেছিলেন প্লট দুটির এলটমেন্ট বাতিল করে দিতে। ‘৭১ সালে পাকিস্তানের কোলকাতা মিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব হোসেন আলীর নেতৃত্বে যখন বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে কোলকাতা মিশনের সব অফিসার ও স্টাফরা গোপন বৈঠক করছিলেন, তখন জনাব চৌধুরী ছিলেন মিশনের উপপ্রধান হিসাবে Covert Job এ নিয়োজিত। তৃতীয় সচিব ছিলেন আর. করিম জয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তারা সবাই ডিফেক্ট করবেন। তখন মিশনের সবাই কোলকাতায় সপরিবারে বসবাস করছিলেন, কিন্তু তখন চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী, একমাত্র ছেলে বাপ্পি এবং কন্যা নিম্মি ঢাকায় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন। কোলকাতায় তার সাথে থাকতো সর্বকনিষ্ঠ কন্যা মানু। সে তখন Convent School এর ছাত্রী। পরিবারের নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়েও তিনি অন্য সবার সাথে ডিফেক্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেছিলেন, ভারতের সাথে যেই ৭ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করে আওয়ামীলীগ প্রবাসী সরকার গঠন করছে সেই চুক্তির অধীনে রক্ত দিয়েও প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হবে কিনা সেই সম্পর্কে তার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বরং ভবিষ্যতে আওয়ামীলীগ সরকারের অধীনে বাংলাদেশ হয়তো বা ভারতের একটি করদ রাজ্যেই পরিণত হবে। তার সেই বক্তব্যের জবাব তখন উপস্থিত কারো পক্ষেই দেয়া সম্ভব হয়নি। তার Defection এর খবর প্রচারিত হবার পর তার পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। সেই লোমহর্ষক পলায়নের বিস্তারিত বিবরণ পূর্বে প্রকাশিত বই ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ তে এবং ওয়েবসাইট দুটোতে বিস্তারিত লেখা রয়েছে। Defection এর আগেই অবশ্য ভারত সরকার জনাব হোসেন আলীকে আশ্বস্ত করেছিল তাদের বেতন-ভাতা, থাকা-খাওয়া এবং অন্যান্য কূটনৈতিক সব সুবিধাদি বহাল রাখা হবে। কোন বিষয়েই কোন ঘাটতি হবে না। প্রবাসী সরকারের মাধ্যমে মিশন চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেবে ভারত সরকার। Defection এর পর ভারত সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যখন জনাব চৌধুরীর কাছে তার Contacts দের ফাইলগুলো চেয়েছিল তখন জনাব রফিকুল ইসলাম চৌধুরী সেগুলো দিতে অস্বীকার করে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো দিল্লীতে পাকিস্তান হাইকমিশনে পাঠিয়ে দিয়ে বাকি সব জ্বালিয়ে ফেলেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘Such a request is beyond professional ethics.’ নৈতিকতার এক বিরল উদাহরণ! তার সেই দিনের দূরদর্শী ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা বর্তমানের বাংলাদেশে কতটুকু প্রমাণিত, সেটা যাচাই করার ভার দেশবাসীর উপরই থাকল। ১৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর মোশতাক সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, সরকারি চাকুরেদের সবাইকে যথাসময় অবসর নিতে হবে। কাউকে Extension দেয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তের পর একদিন প্রেসিডেন্ট ডেকে জানালেন আমার ছোট শালি মানুর পড়াশোনার সমাপ্তির জন্য জনাব চৌধুরীকে আরও দু’বছর লন্ডনে থাকতে হবে অবসর নেবার পর। তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশসহ ফাইল এসেছে তার চাকুরির মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়িয়ে দেবার। তিনি আমার মতামত জানতে চাইলে আমি পরিষ্কার বলেছিলাম, সরকারের সিদ্ধান্ত সবার ক্ষেত্রে একই ভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ। তাই আমার শ্বশুরের ব্যাপারে ব্যতিক্রম করাটা ঠিক হবে না। প্রেসিডেন্টের পুরনো বন্ধু জনাব চৌধুরী। তাই প্রেসিডেন্ট বললেন, তার সাথে একবার আলাপ করতে। বলেছিলাম, এর প্রয়োজন ছিল না। কারণ, আমার বিশ্বাস তিনি এই সিদ্ধান্তে মনঃক্ষুন্ন হবেন না। তারপরও প্রেসিডেন্ট আমার সামনেই তাকে ফোন করলেন। আলাপ হল দুই পুরনো বন্ধুর মধ্যে। তিনি জানালেন Extension তিনি নেবেন না। কারণ, তার সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন সমাধান কি করে হল! জবাবে জনাব চৌধুরী জানালেন, তার সমস্যাটা নিয়ে তিনি ব্রিটিশ হোম অফিসের সাথে আলাপ করেছিলেন এবং ২ বছরের জন্য থাকার অনুমতি চেয়েছিলেন, তার সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার তার পুরো পরিবারকে ব্রিটিশ পাসপোর্টই দিয়ে দিয়েছে। এমন ঘটনা কখনো ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই। ধর্মের কল এভাবেই বোধ করি বাতাসে নড়ে। সততার মূল্য মানুষ দিতে না পারলেও সৃষ্টিকর্তা কার্পণ্য করেন না। তিনি যথাসময়ে সবার ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করে থাকেন কোন না কোন উপায়ে। অফিস কামাই করে জনাব চৌধুরী এয়ারপোর্টে আসেননি। তিনি ছাড়া অন্য সবাই আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিল। যথাসময়ে প্লেন আকাশে উড়ল। আমি একটা ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছিলাম। কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে চীফ পারসার সম্ভ্রমের সাথে এসে জানাল, আমাকে ককপিটে ডেকে পাঠানো হয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, বিমানের অনেক সিনিয়র ক্যাপ্টেনই বন্ধু। বন্ধুদের কেউই আজ বিমান উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তেমনই কেউ ডেকে পাঠিয়েছে। তাই উঠে পারসারের সাথে ককপিটে গিয়ে ঢুকলাম। ঢুকতেই চোখ আমার চড়ক গাছ! দেখলাম এয়ার চীফ তোয়াব প্লেন চালাচ্ছেন। কিছুটা অবাক হয়ে সালাম জানিয়ে বললাম স্যার, আপনি? আমার আগমনে কো-পাইলটের সিটটা খালি করিয়ে জনাব তোয়াব আমাকে সেইখানে বসতে বললেন। আমি বসে পড়লাম। মনে পড়ে গেলো পুরনো দিনের কথা, যখন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের পাইলট হিসাবে ককপিটে বসে প্লেন নিয়ে আকাশে ভেসে বেড়াতাম। উড়োজাহাজ চালানোর হাতেখড়ি ও প্রশিক্ষণ আমাদের দু’জনেরই একই যায়গায়, PAF Base রিসালপুরে। ব্যবধান শুধু অভিজ্ঞতার। সেটা বয়সে বড় হওয়ার কারণে। আধুনিক বিমানগুলোর প্রায় সবগুলোই যান্ত্রিক অনুশাসনেই পরিচালিত হয়। শুধু টেকঅফ আর ল্যান্ডিং এর সময় পাইলটদেরকে হাল ধরতে হয়। বাকিটা পথে অটো পাইলট অন করে দিলেই জাহাজ ফ্লাইট প্ল্যানের কমান্ড অনুযায়ী চলতে থাকে গন্তব্যস্থলের দিকে। শুধু মাঝেমধ্যে দেখতে হয় প্রয়োজনীয় মিটারগুলোর রিডিং ঠিক আছে কিনা আর পথিমধ্যে চেকপয়েন্টগুলো থেকে জেনে নিতে হয়ে যান্ত্রিক বলাকা ঠিক পথে এগুচ্ছে কিনা। তবে কোন অস্বাভাবিক অবস্থায় ক্যাপ্টেনকেই সামাল দিতে হয় পরিস্থিতির কো-পাইলট, নেভিগেটর আর ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার এর সহায়তায়। যান্ত্রিক কোনও গোলযোগ হলে জাহাজ নিজেই জানান দেয়। গোলযোগ সারিয়ে তোলে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। দিক নির্দেশনা উচ্চতার কোনও হেরফের কিংবা জ্বালানি সংকটের সমাধান করে নেভিগেটর। সার্বিক তদারকির ভার ক্যাপ্টেনের। আগেপিছে আশেপাশের সবকিছুই ধরা পরে রাডারে। যান্ত্রিক বলাকা এগিয়ে চলেছে, আমাদের একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে ককপিট ক্রুরা পাশেই রেস্টিং কেবিনে চলে গেছে। আমি ও এয়ার চীফ তোয়াব আলাপ করছি। তিনি বলছেন- বিমান এটি নতুন লিজে নিয়েছে। ফাইনাল সাইনিং সেরিমনি এ্যাটেণ্ড করতে এসেছিলাম। মাঝে জার্মানিতে কয়েকদিনের জন্য ফ্যামিলি দেখতে গিয়েছিলাম এই সুযোগে। You know, since the terrifying incident of 2-3 November, your Bhabi has decided to live in Germany with the children. এরপর থেকে দুইপক্ষই আসা যাওয়া করে থাকি সুযোগ-সুবিধা মতো। তুমিও ঢাকায় চলেছো ব্যাপার কি? তার প্রশ্নই বলে দিলো আমি ছাড়া আমাদের অন্য আরও কেউ ঢাকায় যাচ্ছে সেটা উনার জানা। বললাম কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, জেনারেল জিয়া ডেকে পাঠিয়েছেন। তাই যাচ্ছি।

কর্নেল রশিদ, ফারুকও যাচ্ছে নাকি? না, শুধু আমাকে আর রশিদকেই ডেকে পাঠানো হয়েছে।

I see! আমার জবাবে এভিএম তোয়াবকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিলো। কেনো হঠাৎ ডেকে পাঠালেন জিয়া?

প্রশ্নটার জবাবটা জানা থাকলে তো যাবার প্রয়োজন ছিল না। যাক বলুন, আপনার সিরাত মাহফিল কেমন চলছে? দাওয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। বিষয়টি প্রশংসনীয়।

তা ঠিক। তবে আমার এই উদ্যোগটাকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না। উপরন্তু উদ্যোগটাকে রাজনৈতিক রং দেবার চেষ্টাও করা হচ্ছে।

এই ব্যাপারে জেনারেল জিয়ার মনোভাব কি?

ঠিক পরিষ্কার নয়, কিছুটা রহস্যজনক। তার জবাব শুনে মুচকি হেসে বললাম স্যার, আপনি সব সময় বলে থাকেন আপনার কোনও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। এরপরও রশিদ, ফারুকের সাথে আপনি হরহামেশাই দেখা সাক্ষাত করছেন লন্ডনে কিংবা জার্মানিতে। ত্রিপোলিতেও কয়েকবারই আসা-যাওয়া করেছেন। এই সব জেনে জেনারেল জিয়া যদি কিছুটা সন্দিহান হয়ে ওঠেন তাহলে সেটাকে কি অস্বাভাবিক বলা চলে? আমি তো বলবো সেটাই স্বাভাবিক। সন্দেহ কেনো, তিনি যদি আপনাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন তবে সেটাকেও যুক্তিসঙ্গত বলা যেতে পারে।

কিছু বুঝতে পারছিনা। স্বগতোক্তি করলেন এভিএম তোয়াব।

পারবেন স্যার, সময়েতেই পারবেন। জেনারেল জিয়া একজন পাকা খেলোয়াড়। আমার কথায় চুপ করে গেলেন এভিএম তোয়াব। তিনি কতটা সাহসী তার প্রমাণ পেয়ে গিয়েছিলাম ২-৩ নভেম্বর ’৭৫ রাতেই। তাকে নিয়ে রশিদ, ফারুক গাদ্দাফির টাকায় জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে যে খেলা খেলতে চাইছে সেটা কোনোদিনই সাফল্যের মুখ দেখবে না সে সম্পর্কে আমাদের মনে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। শুধু ধর্মীয় জিকিরের আবরণে জনপ্রিয়তা অর্জন করে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা বাংলাদেশে কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ, বাংলাদেশের মুসলমানরা ধর্মভীরু- কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। তাই যদি হতো তবে অনেক আগেই জামায়াতে ইসলামী কিংবা অন্যসব ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দেখা যেতো। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের কাছে ধর্মহীনতা এবং ধর্মান্ধতা সমানভাবে বর্জিত। এই বাস্তবতাকে না বুঝতে পারায় এই দুই অক্ষের নেতৃত্বের উস্কানি এবং ভ্রান্ত প্ররোচনায় বলির পাঁঠা হতে হয়েছে অগুণতি সাধারণ নিরীহ ধর্মপ্রাণ দেশবাসীকে।

দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে বিদেশের পেট্রোডলার পকেটস্থ করে যারাই সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভুতির সুযোগ নিয়ে ধর্মের ধারক-বাহক হয়ে লোকজনকে জিম্মি করে রেখেছেন তাদের ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি দেখে তাদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। ফিকরাবাজির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যে ফাটল আর ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে জাতিকে দুর্বল করে রাখাটাই তাদের মূল লক্ষ। পাঠকগণ নিশ্চয়ই অবগত রয়েছেন, ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশকে কব্জা করে নিয়েছিল মুসলমান শাসকদের পরাজিত করে। বিশ্বাসঘাতক হিন্দু রাজন্যবর্গ এবং বেনিয়াদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সাহায্য ও সহযোগিতায় প্রতিদানে মুসলমান সম্প্রদায়ের সব সম্পদ ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ এবং বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে ছিনিয়ে নিয়ে তাদের যে শুধু বিত্তহীন গোলামেই পরিণত করেছিলো তাই নয়, একই সাথে তাদেরকে অশিক্ষিত করে রেখেছিলো সমসাময়িক জ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেশের আলেম সমাজের কিছু প্রভাবশালী ওলামাদের কিনে নিয়ে তাদের মাধ্যমে পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থা মুসলমানদের জন্য হারাম ফতোয়া জারি করে। তাদের অর্থেই ঐসব তল্পিবাহক আলেম ওলামাদের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছিলো দেওবন্দ, বেরেলভি জাতীয় ফিকরাবাজির বিভিন্ন সূতিকাগার শুধুমাত্র মুসলমানদের বিভক্ত করে রাখার জন্যই। কুটকৌশলে তারা হিন্দু সম্প্রদায়কে অনুপ্রাণিত করেছিলো প্রগতিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হতে আর ঐ সব ধর্ম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মুসলমানদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো কোরআন, হাদিস যার অপব্যাখ্যা করে সৃষ্টি করা হয়েছিলো হাজারো ফিকরা। সেই বিষফোঁড়ার বিষাক্ত কবলে বর্তমানে উপমহাদেশের সব কয়টি দেশই হয়ে উঠেছে অস্থিতিশীল এবং ভঙ্গুর। আসল অপশক্তির মোকাবেলার পরিবর্তে নানাভাগে বিভক্ত নামেমাত্র মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে আত্মঘাতী সহিংস সংঘাত এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় একে অপরের বিরুদ্ধে নৃশংস দাঙ্গা-ফ্যাসাদে লিপ্ত হয়ে দেশগুলোকে পশ্চাদমুখী করে মধ্যযুগেই ঠেলে দিচ্ছে। ধর্মীয় উগ্রতা এবং সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীরা সুযোগ বুঝে বিশ্বপরিসরে ভ্রান্ত প্রচারণা চালিয়ে প্রকৃত ইসলামের ভাবমর্যাদাকেই ক্ষুন্ন করছে। যদিও প্রকৃত ইসলাম হল সার্বজনীন শান্তি এবং মানবতার ধর্ম, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।

ফিরে চলি এভিএম তোয়াব এর সাথে আলাপে। পরিবেশ হালকা করার জন্য সঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলাম

স্যার, আপনাদের মার্শাল’ল এডমিনিস্ট্রেশন কেমন চলছে? জেনারেল জিয়ার গৃহীত রাজনৈতিক উদ্যোগকে আপনি কি ভাবে দেখছেন? নিজের কারিশমা বাড়াবার জন্য গেঞ্জি পরে কোদাল কাঁধে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে খাল কাটার কর্মসূচির চমকে তো দেশবাসী বিমুগ্ধ। তার প্রণীত ১৯ দফাও জনগণ সাদরে গ্রহণ করেছে বলে জানতে পারলাম। এই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তার? এভিএম তোয়াব আমার প্রশ্নগুলোর কোনও জবাব না দিয়ে হেসে বললেন

এই সমস্ত বিষয়ে জেনারেল জিয়া আমাদের সাথে কোনও আলাপ আলোচনা করার প্রয়োজনই বোধ করেন না। এই সব বিষয়ে জেনারেল এরশাদ, জেনারেল মহব্বতজান, জেনারেল শিশু, জেনারেল মঞ্জুর, জেনারেল শওকতই তার মূল পরামর্শদাতা। বাহ্যিকভাবে আমি এবং জিয়ার আত্মীয় এম এইচ খান ন্যাভাল চীফ ডেপুটি মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর বটে, তবে সব ক্ষমতা তো জিয়ার মুঠোয়। তার অঙ্গুলি হেলনেই দেশ পরিচালিত হচ্ছে। শুনেছি ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোটের পর একটি রাজনৈতিক দল গঠন করছেন জিয়া। সেই প্রক্রিয়াতেও আমাদের কোনও ভূমিকা নেই।

তাহলে তো বলতে হয় কাঁধে চাকচিক্য বাড়িয়েও আপনারা হচ্ছেন নিধিরাম সর্দার, কি বলেন স্যার? কিছু মনে করবেন না একটু রসিকতা করলাম পরিবেশটাকে হালকা করতে। বড্ড গুমোট অনুভব করছিলাম। আমার কথায় জনাব তোয়াব প্রাণ খুলে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।

ঠিকই ধরেছো তুমি। একটা খোঁচাও দিলেন সাথে। তোমরা সবাই গত, আর আমরা যাবার পথে, হা হা হা! তবে স্বীকার করতে সংকোচ নেই তোমরা সাহসী বীর। কিছু অর্জন করে গিয়েছো কিন্তু আমরা এলাম আর যাবো। তবে কোনও অর্জন ছাড়াই। যে ধরনের পাঁচমিশালি ককটেল সৃষ্টি করা হচ্ছে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় তার সেই রাজনীতিতে দেশ বা জাতি কতখানি উপকৃত হবে সেটা জানিনা। তবে রাষ্ট্রীয় সব ক্ষমতা জিয়া সংরক্ষণ করবে নিজের মুঠিতে তথাকথিত গণতান্ত্রিক লেবাসের আবরণে সেটাই স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কম্প্রোমাইজের নীতিই হবে তার রাজনীতির আদর্শ। এই ধরনের রাজনীতি পাকিস্তানেও চলে এসেছে শুরু থেকেই। তার পরিণাম সম্পর্কে আমার চেয়ে তুমি কম অবগত নও। জাতীয় পরিসরে কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী আর তাদের বিদেশী শক্তিধর মোড়লদের সাথে কম্প্রোমাইজ করে ব্যক্তি আর গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিল করা যায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। কিন্তু তার বিনিময়ে বিকিয়ে দিতে হয় দেশ ও জাতীয় স্বার্থ এবং স্বকীয়তা। তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মতোই চলবে বাংলাদেশের রাজনীতি। জিয়া এর বিপরীতে কোনও প্রগতিশীল বৈপ্লবিক রাজনীতির সূচনা করবেন তেমনটি মনে করার কারণ নেই।

ভাগ্যচক্রে ‘৭১ এ স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়া একজন চতুর উচ্চাভিলাষী পাকিস্তানী সামরিক অফিসার হিসাবে ভারত এবং প্রবাসী সরকারের চক্ষুশূল, স্বাধীনতার পর তোমাদের ছত্রছায়ায় সেনাবাহিনীতে টিকে থাকা, অবশেষে আগস্ট ও নভেম্বর বিপ্লবের বদৌলতে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে আবিষ্কার! এটাই তো তার জীবন বৃত্তান্ত। এতে তার নিজের অবদান কতটুকু? বাংলাদেশের মাটি-মানুষের সাথেই বা তার নাড়ির সংযোগ কতটুকু? আমার মতোই ভালো করে বাংলা বলতে বা লিখতেও পারেন না। আমি আর জিয়া রাজনৈতিক ভাবে কতটুকু সচেতন ছিলাম কিংবা আমরা কি কখনোই ছাত্র বা জাতীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম? সঠিক জবাবটা হবে Absolutely not. বরং বলতে হবে We were just careerists and that was our only passion.

তোমাদের কথা আলাদা। জানতে পেরেছি, তোমাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক পরিবার থেকে আগত। ছোটকাল থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত। তাছাড়া রাজনীতির উপর বিস্তর পড়াশুনা ও চর্চা তোমাদের অনেককেই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করে তোলে চাকুরিতে যোগ দেবার আগেই। চাকুরিতে যোগ দেবার পর শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ তোমাদের সচেতনাকে আরও ধারালো করে তোলে। তাই তোমরা সব সময় কঠিন ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিতে পেরেছো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা বয়সের তুলনায় তোমাদের রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি পরিপক্ব করে তুলেছে সেটাই আমি বিশ্বাস করি। তোমাদের সাথে জিয়া বা আমার মতো লোকদের কোনও তুলনাই হতে পারে না। এই সত্যটা স্বীকার করে নিতে আমি মোটেও লজ্জিত নই। আমি চুপচাপ শুনছিলাম এভিএম তোয়াবের বক্তব্য। এতোটা সাহসও মানুষের হতে পারে সেটা কখনোই আমি কল্পনা করতে পারতাম না তোমাদের স্বচক্ষে না দেখলে। দেশ ও জাতিকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে বাঁচাতে নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে তুমি ও নূর দুইজনেই ছুটে এসেছিলে খালেদের সাথে আলোচনার জন্য। তোমাদের দেশপ্রেম আর সাহস দেখে সেদিন শ্রদ্ধায় আমার মাথা নিচু হয়ে এসেছিল, মনে মনে সিনিয়র হয়েও আমি তোমাদের স্যালুট করেছিলাম যদিও ভাষায় কিছুই প্রকাশ করার সাহস হয়নি, তবে নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মেছিল। খুব ছোট আর স্বার্থপর মনে হয়েছিলো নিজেকে।

এভিএম তোয়াবের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগপ্রবণ বক্তব্যে সততার অভাব ছিল না। খুলে না বললেও তার কথা থেকে জিয়ার সম্পর্কে তার মনোভাব বুঝতেও বেগ পেতে হয়নি আমার। সাহস আল্লাহ্ তায়ালার একটা বিশেষ দান। অতি কঠিন ক্রান্তিলগ্নে খুব কম লোকেই সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারে। এটাও একটা প্রাকৃতিক বিধান। এই অভিজ্ঞতা লেখকের হয়েছে অনেকবার রণাঙ্গনে। জনাব এভিএম তোয়াব যখন লিবিয়াতে এসেছিলেন তখন রশিদ, ফারুক তাকে যেভাবেই হউক রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিল যে গাদ্দাফির গ্রীনবুক এ বর্ণিত অস্বচ্ছ ‘প্রগতিশীল ইসলামিক সমাজতন্ত্র’ দর্শনের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের ধর্মভীরু জনসাধারণের মধ্যে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দাড় করাবার চেষ্টা তাকে করতে হবে। এর জন্য যত টাকাই লাগুক তার যোগান তাকে দেয়া হবে। এর ভিত্তিতেই তিনি ফিরে গিয়ে শুরু করেছিলেন সিরাত মাহফিল। সেনা পরিষদের আমরা বিশ্বাস করতাম, গাদ্দাফির গ্রীনবুক ভিত্তিক আদর্শ এবং শুধু মাত্র জনগণের ধর্মীয় চেতনাকে ব্যবহার করে কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে কার্যকরী করা সম্ভব হবে না। তাই, আমরা তাদের উদ্যোগ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে দূর থেকে তাদের কার্যক্রম অবলোকন করছিলাম। জনাব তোয়াব যখন দেশে ফিরে গিয়ে সিরাত মাহফিল করা শুরু করেন তখন জিয়া তার ঘর গোছাতে ব্যস্ত। তাই সাময়িক ভাবে তোয়াব কিছুটা খোলা ছুট পেয়েছিলেন। তবে আমরা জানতাম উপযুক্ত সময়ে এভিএম তোয়াবকে বলির পাঁঠা হতে হবে জিয়ার হাতে। রশিদ, ফারুক থেকে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এয়ার চীফ তোয়াবের কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো জিয়ার সাথে তার সহাবস্থান খুব একটা সুখকর ছিল না।

আমি একটি বিষয় নিয়েই বিশেষভাবে ভাবছিলাম। জার্মানিতে দুই ভায়রার সাথে মিলিত হয়ে তোয়াব দেশে ফিরছেন। রশিদ ঢাকায়, ফারুক সিঙ্গাপুরে! এসব আমার কাছে একটি অশনি সংকেত বলেই মনে হচ্ছিলো। ভাবছিলাম, যদি শেষকালে দুই ভায়রা মিলে কোনও অঘটন ঘটিয়েই বসে সেইক্ষেত্রে আমার এবং সেনা পরিষদের বেঁচে থাকা অবশিষ্টদের করণীয় কি হবে সে সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত আমাকে জিয়ার সাথে দেখা করার আগেই নিয়ে নিতে হবে। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, পৌঁছেই লিবিয়াতে অবস্থিত সহযোদ্ধা এবং দেশের বিভিন্ন সেনাছাউনিগুলোতে সেনা পরিষদের ইউনিটগুলোর নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশ্বস্ত বন্ধু-বান্ধব এবং সমমনা শুভার্থীদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। এইসব চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই এক সময় এভিএম তোয়াব নিজেই ল্যান্ড করলেন ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। ক্যাপ্টেন তাকে সাহায্য করলেন। ল্যান্ডিংটা একটু হেভি হয়েছিলো, তবে খুব একটা বেশি না। আমার দিকে চেয়ে তিনি বললেন Bloody hell! The landing was a bit heavy isn’t it? Not much of any concern Sir. যাত্রীরা কেউই কিছুই টের পেলো না। ল্যান্ডিং এর পর আমরা দুইজনই নিজেদের জায়গাতে ফিরে এসে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ক্যাপটেন ট্যাঁক্সিং করে প্লেন টারম্যাকে দাড় করালো। দরজা খুলতেই দেখলাম VIP Lounge এর চত্বরের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, মিনু ফুপ্পু, স্বপন, বাপ্পি, মহুয়া, কেয়া। সাথে মেজর মাহবুব বীর উত্তম। সারগোদীয়ান মাহবুব জেনারেল মঞ্জুরের ভাগ্নে। জেনারেল মঞ্জুর ও কর্নেল জিয়াউদ্দিন (দালাইলামা) দুইজনই ছিলেন সারগোদীয়ান। বন্ধুবর মুক্তিযোদ্ধা ডঃ কামাল সিদ্দিকীও (Principal Secretary to President Mushtaq Ahmed & Begum Khaleda Zia) ছিল সারগোদীয়ান। মাহবুবের বোন মাহমুদা ছিল নিম্মির সহপাঠী। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই সেনা পরিষদ গঠনের যৌক্তিকতা এবং ভবিষ্যৎ গণমুক্তি সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের নীতি-আদর্শের প্রতি পূর্ণ আস্থার সাথে সেও আমাদেরই একজন হয়ে কাজ করে চলেছিলো সাংগঠনিক ক্ষেত্রে। সেই সূত্রে মাহবুবের সাথে আমাদের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিলো। স্বাধীনতার পর আমরা সবাই কুমিল্লাতে জিয়ার নেতৃত্বে ৩৩ ব্রিগেড পুনর্গঠনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছিলাম। অনেক দেন-দরবারের পর মুজিব সরকার ৫টি পদাতিক ব্রিগেড এবং আনুষঙ্গিক ইউনিট, বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনীর Nucleolus গঠনের সম্মতি দিতে বাধ্য হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে মিত্র ভারত লুট করে নিয়ে গিয়েছিলো পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ১৬০০০ কোটি টাকার যুদ্ধ সম্ভার এবং অস্ত্রশস্ত্র। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্ট থেকে তারা ইলেকট্রিকাল এবং সেনেটারি ফিটিংসগুলো খুলে নিয়ে যেতে দ্বিধাবোধ করেনি। সমুদ্র বন্দর এবং স্থলবন্দরগুলোতে স্তূপীকৃত আমদানিকৃত ও রপ্তানির জন্য আনীত সব মালামাল গণিমত হিসাবে লুটে নিয়ে যায় ভারতীয় বাহিনী। দেশের বড় বড় শহরের সব দোকানপাট থেকে সমস্ত মালামাল, সোনা; মিল-ফ্যাক্টরিগুলো থেকে মেশিন, কাঁচামাল এবং স্পেয়ারপার্টস কিছুই লুটে নেয়া বাদ দেয়নি বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়ক শক্তি বাংলাদেশের সরকারের সম্মতিক্রমে। এ ধরনের হরিলুটের বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে অভাবনীয় লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকারে পরিণত হতে হয়েছিল। একই কারণে মেজর জলিলের মতো একজন বীর সেক্টর কমান্ডারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সরকারি নির্দেশে। কিন্তু পরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল চাপে তাকে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ভারত সরকার চাইছিল মুজিব সরকারের নিরাপত্তার অজুহাতে ২৫ বছরের গোলামির চুক্তির আওতায় দীর্ঘমেয়াদী অবস্থান রাখবে বাংলাদেশে। তাই মুজিব সরকারের আদেশে দেশের সব কয়টি ক্যান্টনমেন্ট দিয়ে দেয়া হয় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অধীনে। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় হাতিয়ার ভারতীয় বাহিনীর হাতে জমা দিয়ে ৫০ টাকা পথ খরচা নিয়ে আপন আপন ঠিকানায় ফিরে যাবার। নিয়মিত বাহিনি ‘Z’, ‘S’, ‘K’-কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয় শহর থেকে দূরে বিশেষ করে ঢাকার বাইরে। আর মুক্তিবাহিনীকে বনে-জংগলে। সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষ করে ঐসব মুক্তিযোদ্ধারা যারা সম্প্রসারণবাদী ভারতীয় আধিপত্য মেনে না নিয়ে আর একটি ভারত বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিজেদের সংগঠিত করে তুলেছিল খানসেনাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধের আবরণে। তারাই তখন সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় বাহিনীর সদস্য এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে দেশের সর্বপ্রান্তে ওদের অবস্থানের উপর চোরাগোপ্তা গেরিলা অপারেশান করে তাদের উৎখাতের মাধ্যমে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করতে হবে। প্রতি রাতে মারা পড়তে থাকে শত শত লুটেরা বাহিনী এবং তাদের মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে তল্পিবাহক মুজিব এবং তার মনিব ভারতীয় সরকার। এই ধরনের লুটতরাজের ফলে দেশবাসীও ভারতের উদ্দেশ্যকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি ভারত বাংলাদেশে ঢুকেছে রক্ষক হিসেবে নয়, ভক্ষক হয়ে। দেশের মুক্তিকামী জনগণ প্রতিবাদী লড়াকু দেশপ্রেমিক মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের প্রতি সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বারিয়ে দেন। ফলে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় বাহিনীর মনোবল দ্রুত ভেঙ্গে পরতে থাকে দেশবাসীর ঘৃণা এবং গেরিলাদের চোরাগোপ্তা আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনের কথা, সহায়ক প্রতিবেশী দেশ ভারতকে আমরা শ্রদ্ধা করবো, কিন্তু ভারত যদি বাংলাদেশকে তাদের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করতে চায় তবে প্রয়োজনে আরও রক্ত দেবো কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হতে দেবো না। সবারই এক কথা, ইসলামাবাদ থেকে দিল্লীর গোলামির জন্য লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করা হয়নি। রক্তের বদৌলতে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই স্বাধীনতা রক্ষা করবো যেকোনো ত্যাগের বিনিময়ে। এভাবেই স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের প্রতি বাংলাদেশীদের বিদ্বেষ ও ঘৃণা দুটোই ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। একইসাথে বিদেশী সামরিক বাহিনীর অবস্থানের ফলে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিতেও চাইছিলো না বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী। কারণ, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অবস্থানের ফলে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিবর্তে, অঞ্চলটাকে তখনও তারা মনে করছিল ‘Occupied Territory’ of Pakistan হিসাবে। এই উভয় সংকটে পরে মুজিব সরকারের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে ভারত সরকার বাধ্য হয় তাদের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে উঠিয়ে নিতে।

এই বিষয়েও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইতিহাস বিকৃতির প্রয়াসের কমতি নেই। তারা প্রোপাগান্ডা করে থাকে দেশে ফেরার পর মুজিবের হুকুমেই নাকি ইন্দিরা সরকার ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে ফেরত নিয়ে গিয়েছিল! এটা নাকি ছিল মুজিবের একটা বিরাট সাফল্য! দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীদের মধ্যে মিথ্যাচারের মাধ্যমে কৃতিত্ব নেবার যে জঘন্য প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায় তাতে মনে হয় তারা জনগণকে বেকুব মনে করেন। তারা এটাও ভুলে যান যে একদিন এইসব মিথ্যাচার ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েই স্থান পাবে। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ ছারতে বাধ্য হবার পর মুজিব সরকারের নিরাপত্তার জন্য বিএলএফ, কাদেরিয়া বাহিনী, আওয়ামীলীগের ক্যাডার ও বিভিন্ন নেতাদের অধীনস্থ বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় অত্যাধুনিক কুখ্যাত রক্ষীবাহিনী ভারতের সাহায্যে। কারণ, চাপের মুখে মুজিব সরকার জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করার অনুমতি দিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের এবং পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার এবং সৈনিকদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে বিশ্বাস করতে পারেনি মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী as their character was not pro-establishment but pro-people. দেশ ও জাতীয় স্বার্থই ছিল তাদের কাছে প্রধান, ব্যক্তি-গোষ্ঠী কিংবা দলীয় স্বার্থ নয়।

বিমান বাহিনীর চীফ তোয়াবকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন বিমান বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা। ভিআইপি লাউঞ্জে একই সাথে গিয়ে ঢুকলাম আমরা। অনেক দিনের অনিশ্চয়তা এবং ব্যবধানে আমাকে দেখে সবাই অশ্রুসিক্ত চোখে জড়িয়ে ধরলো। আমি একে একে সবাইকে জনাব তোয়াবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। স্বপনের সাথে পরিচয় হবার পর জনাব তোয়াব তাকে বললেন

শুনেছি তুমিও তো বীরবিক্রম খেতাব প্রাপ্ত একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা শহরে খানসেনাদের বিরুদ্ধে যতগুলো লোমহর্ষক গেরিলা অপারেশন করা হয়েছে সেই গেরিলা গ্রুপটির মধ্যে তুমি অন্যতম। জানতে পেরেছি, দেরাদুন থেকে কমিশন নিয়ে দেশে ফেরার পর সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে তুমি আর্মিতে যোগদান না করে ব্যবসা করছো? জবাবে স্বপন বললো

স্যার, আমাদের দলের সবাই ছিল সাহসী, নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধা। আমিও ছিলাম তাদেরই একজন। তাই কৃতিত্বের যদি কিছু থাকে সেটার দাবীদার সবাই, আমি একা নই। তাছাড়া যুদ্ধের আগেই বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনা শেষ করে জার্মানি থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে নিজের ব্যবসা শুরু করেছিলাম, আর সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে MBA কোর্সটাও শেষ করছিলাম। সেই সময় যুদ্ধ শুরু হয়, আর তাতে আমরা যোগদান করি দেশকে স্বাধীন করতে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই ফিরে এসেছি নিজের ব্যবসাতে। যুদ্ধে হারিয়েছি অনেক প্রিয় সহযোদ্ধাদের। আর্মিতে চাকুরি করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধে আমরা কেউই যোগ দেইনি।

স্বপন, শাহাদাত চৌধুরী (সাচো), ফতেহ আলী, বদি, রুমি, কাজি কামাল, বাদল, আলম, চুল্লু, সামাদ, আজাদ, উলফাত, তৈয়ব আলি, মেওয়া, ফাজলে, বাচ্চু, মোক্তার, দস্তগির, মায়া, মূলত এদের নিয়েই ২নং সেক্টরের অধীন গঠিত হয়েছিল এই দুর্ধর্ষ গেরিলা গ্রুপটি। এরা ত্রাসের সঞ্চার করেছিলো ঢাকায় খানসেনাদের মনে দুঃসাহসিক অপারেশন চালিয়ে। তটস্থ করে তুলেছিলো কুর্মিটোলার হেডকোয়াটার্স এর বাঘা বাঘা জেনারেল সমরবিদদের। জনগণ তাদের নামকরণ করেছিলো সংক্ষেপে ‘বিচ্ছু’ হিসেবে। খানসেনাদের কাছে তারা পরিচিত ছিল ‘মুক্তি’ নামে। অবস্থা এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল এই দামাল জানবাজ গেরিলা গ্রুপটি যে বাতাসে গাছের পাতা নড়লেও খানসেনারা আতঙ্কে লাফ দিয়ে পালিয়ে যেতো ‘মুক্তি আগিয়া’ ‘মুক্তি আগিয়া’ রব তুলে। স্বপন জার্মানিতে পড়াশুনা করেছে জেনে, এভিএম তোয়াব স্বপনের সঙ্গে কিছুক্ষণ জার্মান ভাষায় কথা বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন He is very sharp and bright young man, I am impressed. জবাবে বলেছিলাম Sir, all of his Comrades were the brightest lot in the Dhaka University. All were stars in real sense of the term. Luggage have arrived, so it is time to leave.  মালপত্র এসে গেছে তাই বিদায় নেবার পালা। এভিএম তোয়াব এর কাছ থেকে বিদায় চাইলে তিনি বললেন

ফিরে যাবার আগে দেখা হবে নিশ্চয়ই? Shapan, do remain in touch.

যদি সুযোগ হয়। বলে বিদায় নিয়ে আমরা সবাই মালিবাগে এসে পৌঁছালাম।

বাসায় পৌঁছে দেখি আব্বাসহ সবাই আমার প্রতীক্ষায় সময় গুণছেন। সবারই এক প্রশ্ন, নিম্মিকে কেনো সাথে নিয়ে এলাম না। সংক্ষেপে জবাবে বললাম, অবস্থা বিবেচনা করে তাকে লন্ডনে খালাম্মাদের কাছে রেখে এসেছি। কিছুক্ষণ পর মাহবুব এক ফাঁকে আমাকে বললো

স্যার, শিশুভাই এর সাথে আলাপ করে আপনার আগমন বার্তাটা জানিয়ে দিন। মাহবুব নিজেই ডায়েল করে আমাকে রিসিভার দিয়ে বললো শিশুভাই on the line.

আসসালামালাইকুম শিশুভাই, ডালিম বলছি।

ওয়াসসালাম। Nice to hear you, how was the flight? Not bad but interesting! ভালো। শোনো, সন্ধ্যায় বাসায় এসো। রাতের খাবার একসাথেই খাবো। টনি, লাজু, কাজু সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে নিম্মির অপেক্ষায়। নিম্মিকে তো সঙ্গে আনিনি, তাকে লন্ডনেই রেখে এসেছি। কেনো, সঙ্গে করে দেশে নিয়ে আসলেও তো পারতে? তা পারতাম, তবে ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না what is on the card. তাই রিস্ক না নিয়ে লন্ডনেই রেখে এলাম। I see, anyway, তুমি আসবে সন্ধ্যায়। আর একটি কথা, মাহবুব being one of your closest has been placed at your disposal. He would be at your beak and call. যখন যা প্রয়োজন ডেকে পাঠালে সেই সেটা করবে। তাকে তোমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসাবেও গ্রহণ করতে পারো। Rest over dinner.

As you desire, শিশুভাই। Thanks a lot. ফোন রেখে দিলাম। এর পর মাহবুব বললো

স্যার আমি এখন তবে আসি। বলেই একটা কাগজে দুইটা টেলিফোন নম্বর লিখে আমার হাতে দিয়ে বললো সন্ধ্যায় আমিই আপনাকে শিশুভাইয়ের বাসায় পৌঁছে দেবো, just give me a call whenever you are set to go. Okay fine, Thanks for everything. বুকের সাথে বুক মিলিয়ে বাসার সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাহবুব চলে গেলো। মাহবুব বাসার সবার সাথেই বিশেষভাবে পরিচিত। আব্বা বললেন

মাহবুব সার্বক্ষণিকভাবে তোর সাথে থাকবে এটা শুনে আমি অনেকটা স্বস্তি বোধ করছি। দেশের যা অবস্থা বিশেষ করে সেনাবাহিনীর মধ্যে স্থিতিশীলতা এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি। ইতিমধ্যে একদিন শিশুর মাধ্যমে জিয়া আমাকে ডেকে পাঠিয়ে অনুরোধ জানালেন, তাকে রাজনৈতিক ভাবে সাহায্য করতে। তিনি তার ১৯ দফার ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক দল দাড় করাতে চাইছেন। তার আবেদনে বেশ আন্তরিকতা অনুভব করে আমি, শামছুল হুদা, শাহ আজিজ, যাদু মিয়া, ভোলা মিয়াঁ, আরও পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে তার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে কাজ করছি। তিনি বললেন, বাকশাল আর ভারত বিরোধী নীতিই হবে তার রাজনীতির মূল আদর্শ। তাই যদি সত্যি হয়, তবে তো তাকে সাহায্য করাই উচিৎ। তাছাড়া জিয়া তো তোদেরই একজন। মোশতাকও টানাটানি করছিল তার দলে যোগ দেবার জন্য। তবে আমরা মনে করি জনসমর্থনের দিক দিয়ে জিয়াই এগিয়ে। তাই নির্বাচনে জিয়াই জিতবে। তবে মোশতাক একটি শক্তিশালী দলের নেতা হিসাবে বিরোধী দলীয় নেতা হতে পারবে। আগামী নির্বাচনের আগেই পার্টি হিসাবে আওয়ামীলীগ বিলীন হয়ে যাবে। নেতৃত্বের কোন্দলে তাদের পার্টির কনভেনশন করা সম্ভব হচ্ছে না। তুই কি বলিস?

আব্বা, দেশত্যাগের পর এইতো এলাম, তাই কোনও কিছু না জেনে না বুঝে মন্তব্য করতে চাই না। তবে জিয়া একজন চতুর খেলোয়াড়। আমার মনে হয়, তিনি ভারতের সাথে সমঝোতা করেই রাজনীতি করবেন। তাই আওয়ামীলীগ বিলীন হয়ে যাবে এই ধারণাটা সঠিক নাও হতে পারে। আপনারা সবাই পুরনো রাজনীতিবিদ। তাই সব বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্যতা আপনাদের আছে। সেখানে আমার মতামতের উপর আপনাদের নির্ভরশীল হতে হবে সিদ্ধান্তের বিষয়ে তেমনটি আমি মনে করি না। আপনারা যা ভালো বুঝবেন সেটাই করবেন। তবে একটি কথা জেনে রাখুন, মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। জিয়ার ব্যাপারেও সেটা প্রযোজ্য। অবাক হবেন না যদি কোনোদিন দেখেন জিয়া নিজেই হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে ফিরিয়ে এনে আওয়ামীলীগকে দেশের রাজনীতির মূলধারায় পুনর্বাসিত করছেন।

তা কি করে সম্ভব!

শুধুমাত্র ক্ষমতার রাজনীতিতে সব কিছুই সম্ভব। তাছাড়া প্রচলিত রাজনীতিতে শেষ কথা বলে তো কিছু নেই। তোদের কেনো ডেকে পাঠিয়েছেন জিয়া?

তিনি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে চান।

আলোচনার আবার কি আছে?

সেটাতো জানিনা, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন তাই এসেছি।

ইতিমধ্যে আব্বা একটা ফোন পেয়ে বললেন, আমাকে একটু বেরুতে হচ্ছে, তুই বিশ্রাম কর। কাল থেকে তো তোর টিকিটির নাগালও পাওয়া যাবে না। সাবধানে থাকিস। উঠে চলে গেলেন আব্বা। আব্বার কথায় সবাই হেসে উঠল। কেয়া বললো

জানো ভাইয়া, তোমাদের যাওয়ার পর অফিসার আর সৈনিক ভাইরা কিন্তু প্রায়ই এসে আমাদের খোঁজখবর নিতো আর বলতো, আপনারা স্যারদের ফিরে আসতে বলুন, জিয়ার অনুমতির জন্য তারা কেনো অপেক্ষা করছেন! তাই বুঝি?

হ্যাঁ।
এরপর দুপুরের খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে আমি মহুয়াকে বললাম এবার আমাকে উঠতে দে। জিয়ার মুখোমুখি হওয়ার আগে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। মহুয়া ফোনটা আমার ঘরে লাগিয়ে দিয়ে আয়। মহুয়া নীরব কর্মী ও তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারিণী। নিম্মির মতই স্বল্পভাষী, তাই হয়তো তারা দুইজনই হরিহর আত্মা! কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে জানালো সব কিছু ঠিকঠাক করে দেয়া হয়েছে। আমি উঠতেই মহুয়া বললো

ভাইয়া, তোমার ডিউটি করার জন্য আরও একটা গাড়ী আর ড্রাইভার ২৪ ঘণ্টা থাকবে বাসায়।

এটার কোনও প্রয়োজন ছিল না।

তবুও ওটা থাকবে যতদিন তুমি দেশে থাকবে।

বলছিস যখন ঠিক আছে, থাকুক। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুরু হল ফোনালাপ। বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে বেঁচে থাকা সেনা পরিষদের সদস্য অফিসার-সৈনিক, বিশ্ববিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, সাংবাদিক মহল, আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী মহল, ছাত্র ও যুব সমাজের বিশেষ আস্থাভাজন রাজনৈতিক কর্মী এবং নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন পেশায় নিয়জিত বন্ধু-বান্ধব, সমমনা পুরনো নিকটজনদের আমার আগমন বার্তা জানিয়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং জিয়া ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত জেনে নিলাম। জিয়া সম্পর্কে দেশের সাধারণ জনগণের মনোভাবও জেনে নিলাম। সবক্ষেত্র থেকেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলো। একটা বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে সচেতন সবাই প্রায় একই অভিব্যক্তি জানাল। জিয়া গতানুগতিক সমঝোতা ভিত্তিক এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক পুরনো ধাঁচের পাতানো খেলার রাজনীতিই করবেন। কোনও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কোনও আমূল পরিবর্তনের দিকে জিয়া যাবেন না। Status quo-তে বিশ্বাসী জিয়া, প্রতিবেশী ভারতসহ বহির্বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর বলয়ে থেকেই জাতীয় পরিসরে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলোকে খুশি রেখেই চলবেন। তাই তার রাজনীতি তেমন একটা গণমুখী হবে না জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী। এতে দেশ বা জনগণের ভাগ্যের কতটুকু পরিবর্তন হবে সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও একটি বিষয় পরিষ্কার ভাবেই বলা চলে, জিয়া পরিবার, তার দলীয় নেতৃত্বের ভাগ্য উন্নয়নের দ্বার অবারিত হবে। তিনি সুচতু্র ভাবে নিজেকে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রেখে নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি পরায়ণ করে নিজের হাতের মুঠোয় রাখবেন ‘ইয়েস ম্যান’ হিসাবে। এ ভাবেই সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে দেশ চালাবেন নিজের খেয়ালখুশি মতো। প্রতিবাদী কণ্ঠ কিংবা দ্বিমত বলে কিছুই থাকবে না তার দলে। গণতন্ত্রের লেবাসে জিয়া হয়ে উঠবেন এক ভয়ানক স্বৈরচারী রাষ্ট্রনায়ক। যেটাকে বলা হয় intellectual corruption. যেকোনো দেশ এবং জাতির জন্য পার্থিব দুর্নীতির চেয়ে মননশীল দুর্নীতি শতগুণ ক্ষতিকর। ক্ষমতালোভী কানকথায় বিশ্বাসী জিয়া যে কত নিষ্ঠুর হতে পারেন তার নজির ইতিমধ্যেই তিনি স্থাপন করেছেন প্রায় ৩০০০ বিপ্লবী সেনাসদস্য ও নেতাকর্মী নৃশংসভাবে হত্যা করে সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের নাটক সাজিয়ে। সেনাসদস্যদের বুট এবং উর্দিসহ গণকবরে পুঁতে দেয়া হয় রাতের অন্ধকারে কড়া নিরাপত্তায় বিভিন্ন স্থানে। বন্ধুদের বেশিরভাগের ধারণা ভাঙ্গা স্যুটকেস, ছেঁড়া গেঞ্জি, কোদাল কাঁধে খালকাটার গণসংযোগের চাতুর্যে বর্তমানে কিছুটা বিমোহিত জনগণের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি সময়ে লাগবে না। অনেকেই জানালো, ডঃ কামাল হোসেনের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ভারতের সাথে সমঝোতা করে তিনি হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করবেন দেশে বহুদলীয় রাজনীতি চালু হলেই। এর পরিণাম দেশ ও জাতির জন্য হবে ভয়ংকর। শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে এই ধরণের আত্মঘাতী পদক্ষেপ যদি নেয়া হয় তবে ‘৭১ এর স্বাধীনতার ঘোষক দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা জিয়াকে ইতিহাস মূল্যায়ন করবে এক সুবিধাবাদী, জাতীয় বেঈমান, রক্তপিপাসু এবং ক্ষমতালোভী ব্যক্তি হিসেবে। সম্ভবত তার নিজের পরিণতিও হবে অতি করুণ! সবকিছুই বেনগাজীতে জানালাম এবং আমার এবং সেনা পরিষদের করণীয় সম্পর্কে তাদের অভিমত জানতে চাইলাম। সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল সহযোদ্ধা বিপ্লবী সাথীরা। তারা বললো, বর্তমানের অবস্থা ২-৩ নভেম্বরের চেয়ে জটিল এবং নাজুক। এই পরিস্থিতিতে, সেনা পরিষদকে জিয়া বিরোধী কোনও দ্বন্দ্বে জড়িত হওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে কৌশলগত কারণেই। শুধু তাই নয়, ভায়রাদ্বয় যদি প্রতিক্রিয়াশীল কোনও হঠকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তবে তাদের পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে হবে, তাদের সাথে সেনা পরিষদের কোনও সম্পর্ক থাকবে না এবং তাদের সেই ধরনের যেকোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করা হবে। এতে জিয়া উপকৃত হবেন। তবে আমাদের নীতি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশ ও জাতীয় স্বার্থেই অটল থাকতে হবে। দেশের রাজনীতিকে যেভাবে জিয়া এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তার মোকাবেলা রাজনৈতিক ভাবে করার সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। অপ্রিয় সত্য হল, কর্নেল তাহের এবং তার অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সামরিক বাহিনীতে হঠকারী শ্রেণিসংগ্রামের পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে গণহারে অফিসার এবং সদস্যদের বিনাবিচারে হত্যা করাটা সামরিক বাহিনীর সাধারণ সদস্য এবং দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আর সেই সুযোগে পরিকল্পিত ভাবে জিয়া সেনা পরিষদকে তার প্রতিপক্ষ ভেবে ১৮-১৯ টা সাজানো ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ধুয়া তুলে প্রায় ৩০০০ সেনা পরিষদের সদস্য, সাধারণ দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার, মুক্তিযোদ্ধা এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সমমনা নেতা-কর্মীদের নির্মম ভাবে হত্যা করেছেন। কারাবন্দী এবং চাকুরীচুত করেছেন অনেককেই। এভাবেই তার পথের কাঁটা দূর করেছেন জেনারেল জিয়া চাতুর্যের সাথে ক্ষমতার স্বার্থে। এই সত্যটা সম্পর্কে সাধারণ জনগণ অবহিত নন, এই সুযোগটা ভালোভাবে কাজে লাগিয়ে জিয়া এখনো দেশবাসীর কাছে তিনি আমাদেরই একজন সেই ভাবমূর্তিটাও বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে তার সাথে কোনও প্রকারের সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সেটা জনগণের কাছে গ্রহণীয় হবে না এবং এখনো সেনা পরিষদের যতটুকুই অবশিষ্ট আছে সেটুকুও ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের ভাবমূর্তি এবং শক্তি দুটোই ক্ষুন্ন হবে। এই বিষয়ে শিশুভাইয়ের উপদেশটাই আমাদের জন্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাদের জোরালো যুক্তি সাপেক্ষে ঢাকায় সিদ্ধান্ত নেয়া হল, এই মুহূর্তে জিয়া বিরোধী কোনও কার্যক্রমে জড়িত হবে না সেনা পরিষদ, বরং এর বিপক্ষেই অবস্থান নেবে। সন্ধ্যার পর মাহবুব আমাকে পৌঁছে দিল মইনুল রোডে শিশুভাইয়ের বাসায়। শিশুভাই তখনো বাড়ী ফেরেননি। টনি ভাবী, লাজু কাজুরা নিম্মিকে কেন সাথে করে আনিনি সে বিষয়ে অভিযোগ করলো। কারণটি তাদের সাদামাটা ভাবে বোঝালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাহবুবের কাছ থেকে আমার আগমনী বার্তা পেয়ে বাসায় চলে এলেন শিশুভাই। সাধারণত তিনি মধ্যরাত্রির আগে বাসায় ফেরেন না জানিয়েছিলেন টনি ভাবী। সারাদিন জাগোদলের অফিসে বাকবিতন্ডা, সমঝোতার ম্যারাথন মিটিং, দরকষাকষির ঝকমারিতে বিধ্বস্ত ক্লান্ত হয়ে ফিরেছেন শিশুভাই। শিশুভাই, আপনাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে!

আর বলো না, জাগোদলের অফিসকে একটি মাছের বাজারের সাথেই তুলনা করা চলে। সব সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী, দলছুট বাস্তুঘুঘু নেতাকর্মীরা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য মাছির মতো ভনভন করছে। কে কার পিঠে ছোরা মেরে বা ঘাড়ের উপর দিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেই Rat Race এ সবাই একইভাবে আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত। জঘন্য এদের বেশিরভাগের চরিত্র। স্বার্থের জন্য মানুষ নিজেকে কতটা ছোট করতে পারে এই দায়িত্ব না নিলে জানতে পারতাম না। আমার জন্য বর্তমানের দায়িত্বটা মানুষ চেনার একটা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ। তুমি একটু সময় দাও, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি। অবশ্যই।

শিশুভাই অল্পক্ষণেই ফ্রেশ হয়ে ফিরে এলেন। কেমন আছ তুমি এবং বেনগাজীর বাকিরা?

আমরা বদলে যাইনি শিশুভাই, আমরা আগের মতোই আছি। নিম্মিকে সাথে নিয়ে আসলেও তো পারতে?

পারতাম। তবে তাকে লন্ডনেই রেখে এসেছি খালাম্মাদের কাছে। মনে হচ্ছে, ভালোমন্দেই সময় কাটছে দেশের ‘রাজপুতিনের’?

বিশ্বাস করো ডালিম, আমি ইতিমধ্যেই হতাশ হয়ে পড়েছি। এই সমস্ত প্যাঁচালো অসৎ চরিত্রের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে দেশ কিংবা জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন করা কি করে সম্ভব? কিন্তু বর্তমানের স্ট্রং ম্যান জেনারেল জিয়া তো আমাদের তুলনায় এদেরকেই বেশি আস্থাভাজন মনে করে তাদের সাথে নিয়েই রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমার কথায় কিছুক্ষণ চুপ থেকে শিশুভাই বললেন

বাইরের জেনারেল ইসলামের খোলসটা দেখে লোকজন যাই মনে করুক না কেনো, তোমাদের কাছে আমার বাইরের এবং ভিতরের সত্তার কিছুই গোপন নাই, বিশেষ করে তোমার কাছে। তাই নিঃসংকোচে বলছি, I am totally frustrated with the current state of affairs, you guys had created an tremendous opportunity to build a self respecting and self reliant progressive nation but that opportunity had been lost. জিয়া যে ধরনের রাজনীতির সূচনা করতে যাচ্ছেন তাতে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব কোনোটাই সুরক্ষিত হবে না। জাতির ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে ধরনের আমূল মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন সেটাও তার পক্ষে আনা সম্ভব হবে না, যদিও জনসম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে বাংলাদেশ একটি যথেষ্ট সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র।

কারণটি হবে জিয়ার ভুল রাজনীতি। তার রাজনীতির চরিত্র হবে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর মতোই। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে স্বৈরতন্ত্র কিংবা ভুয়া গণতন্ত্রের লেবাসে একনায়কতন্ত্র অথবা পরিবারতন্ত্রই হউক সেটা নিয়ন্ত্রিত হবে জনস্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের দ্বারা। ফলে সব আশা-প্রত্যাশা পরিণত হবে সোনার হরিণে এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। আমার মনে হয়, জিয়াকে তার ভুলের মাশুল দিতে হবে চরমভাবে। দেশ ও জাতির সাথে তার নিজস্ব পরিণতিটাও হবে দুঃখজনক। এই বাস্তবতাটা যদি যুদ্ধকালে পরিষ্কার বুঝতে পারতাম তবে আমার যেসমস্ত চারিত্রিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে তারপরও হয়তো বা তোমাদেরই একজন হয়ে যেতাম। এই ব্যর্থতা আমাকে আজ কুরে কুরে খাচ্ছে। আত্মগ্লানিতে নিজেকে খুবই ছোট মনে হচ্ছে। একজন অতি বিশ্বস্ত আপনজনের কাছে সুযোগ পেয়ে নিজেকে একটু হালকা করে নিচ্ছি। বাধা দিও না। ধরা গলায় বললেন শিশুভাই। তবুও তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম

শিশুভাই, এতো মন খারাপ করছেন কেনো? জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে, ঝুঁকি নিয়ে আজ আমরা জিয়ার হাতে ব্যবহৃত পণ্যে পরিণত হয়েছি, আপনিও তাই হতেন। ফুঁসে উঠলেন শিশুভাই

না, আমি যদি তোমাদের একজন হতাম যুক্তিসঙ্গতভাবে জিয়ার চরিত্র তোমাদের কাছে তুলে ধরতাম, তাহলে তোমরা তাকে কিছুতেই rallying figure হিসাবে গ্রহণ করতে না, আর সেইক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতার শিকারেও পরিণত হতে হতো না এতদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা। সেদিন সেই আন্তরিক সন্ধ্যায় শিশুভাই মনের দুয়ার খুলে অনেকটাই আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। তার চোখে পানি জমে উঠেছিলো। কোনদিকেই তার ভ্রুক্ষেপ নেই, একনাগাড়ে বলে চলেছেন তিনি মন উজাড় করে আর আমি নীরবে একাগ্র মনে শুনছি তার কথা। দুর্বল চরিত্রের মানুষ হয়েও আজ কিছু কথা বলবো, মনে রেখো তোমাদের শিশুভাইয়ের কথাগুলো। সময়ই প্রমাণ করবে আমার হৃদয় নিংড়ানো বক্তব্যের সত্যতা। তোমাদের নজিরবিহীন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নৈতিক এবং মানবিক চরিত্র, আত্মত্যাগের সুমহান আদর্শ, রাজনৈতিক বিপ্লবী নীতি-আদর্শ এবং নিপীড়িত এবং বঞ্চিত জনগণের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে আপোষহীন সংগ্রামের প্রত্যয় দ্বারাই সম্ভব সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ‘৭১-এর চেতনা ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন; একটি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন, স্বনির্ভর, প্রগতিশীল, সুখী, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সাময়িকভাবে, অজ্ঞ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসী, বিক্রিত বুদ্ধিজীবী এবং সমাজপতি, বর্তমানে কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর প্রতিভূ সরকারের এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের উচ্ছিষ্ট ভোগের লোভে লালায়িত হয়ে তাদের অঙ্গুলি হেলনে তোমাদের সম্পর্কে যে মূল্যায়নই সরবে প্রচার করুক না কেনো একদিন এই দেশেরই জনগণ সব সত্যই উদ্ঘাটন করতে সমর্থ হবে। তখন তাদের কষ্টিপাথরের পাল্লায় একদিকে মুজিব আর জিয়া এবং অন্যদিকে তোমাদের দাঁড় করালে তোমাদেরকেই বিবেচনা করা হবে জাতীয় বীর আর মুজিব এবং জিয়া দুই জনকেই আখ্যায়িত করা হবে জাতীয় বেঈমান হিসাবে। আমি নীরবে বসেছিলাম। শিশুভাই যাকে মাঝেমধ্যে ঠাট্টা করে আমরা সম্বোধন করতাম ‘নাবালক ভাই’ হিসাবে, যার ভীরুতা নিয়েও কাছের জনরা তিরস্কার করতাম অহরহ সেই শিশুভাই আজ ঘটনাচক্রে জেনারেল জিয়ার বিশেষ আস্থাভাজন হিসাবে বাংলাদেশের ক্ষমতাধর ‘রাজপুতিন’ নামে খ্যাত সেই শিশুভাই আজ কোন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ ধরনের স্বগতোক্তি করছেন! আমাদের সাথে শিশুভাই-এর কোনও লেনদেনের সম্পর্ক নেই, ছিলও না কখনোই। ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার বন্ধন। তাই বোধকরি এতদিনের সুপ্ত বিবেক আজ জেগে উঠেছে প্রবহমান ঘটনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে। তার সচেতনতা মেনে নিতে পারছে না জিয়া ও তার দোসরদের কর্মকাণ্ড। তার আন্তরিকতায় কোনও খাদ ধরতে পারিনি। তাই তার প্রতি ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো নিজের অজান্তেই। আল্লাহ চাইলে যেকোনো মানুষের মন-মানসিকতা বদলে দিতে পারেন মুহূর্তে তারই জ্বলন্ত একটি নিদর্শন আজকের শিশুভাই সেটা আমাকে মেনে নিতেই হল। টনি ভাবী এসে জানালেন খাবার দেয়া হয়েছে। শিশুভাই উঠে আমাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেলেন। টনি ভাবী ইতিমধ্যেই মাহবুবকে ডেকে নিয়ে এসেছেন। খাবার টেবিলে বসে দেখলাম ভাবী আমার পছন্দের ছোট মাছের বিভিন্ন ব্যঞ্জন, ভর্তা আর চাটনিতে টেবিল ভরে ফেলেছেন। খাবারের বহর দেখে চক্ষু চড়কগাছ, বললাম ভাবী একি করেছেন!জবাবে ভাবী বললেন, কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না, সেটা আমার জানা আছে, তাই এই ব্যবস্থা। হেসে শিশুভাই মশকরা করে বললেন, ভোজন রসিক ডালিম ইতিমধ্যেই খাবারের ব্যাপারেও নিজেকে De-class করে ফেলেছে সেটা জানা ছিল না।

থামো তুমি, খাওয়া শুরু কর সব জুড়িয়ে যাচ্ছে বলে সস্নেহে নিজ হাতে আমার প্লেটে পছন্দের ব্যঞ্জনগুলো তুলে দিচ্ছিলেন টনি ভাবী। খাওয়ার পর্ব শেষে আমরা আবার গিয়ে বসলাম বসার ঘরে। আসার সময় নিম্মি কিছু গিফট কিনে দিয়েছিল। আমার ডাকে ভাবী, লাজু, কাজু এলো বসার ঘরে। আমি শিশু পরিবারের জন্য দেয়া নিম্মির প্রিতি উপহারগুলো সবার হাতে তুলে দিলাম। আসার পথে স্কাইশপ থেকে শিশুভাই-এর জন্য আনা যাকিছু সেটা তাকে দিলাম। সবারই গিফটগুলো পছন্দ হল। প্রিয় টনি ভাবী বললেন, দেখো নিম্মির কাণ্ড, এসবের কি দরকার ছিল! বললাম, প্রীতি উপহার।

ও মা! তুমিতো দেখছি নিম্মির চেয়েও এক কাঠি সরেস। তবে বলতেই হচ্ছে, নিম্মির টেস্ট আছে।

সাধে কি আর তোমাকে বুদ্ধির ঢেঁকি বলি! পুরো ঢাকায় এটা স্বীকৃত, আর তুমি ডালিমকে সেটাই জানাচ্ছো। যাও, এবার তোমরা। আমরা কিছু কাজের কথা বলি। তার কথায় সবাই বিদায় নিলো।

লাজু কাজু আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে দৌড়ে তাদের ঘরে চলে গেলো।

শুনলাম, তুমি আর এয়ার চীফ তোয়াব লন্ডন থেকে একই ফ্লাইটে এসেছো?

হ্যাঁ, তিনি নিজেই তো সদ্য লিজে নেয়া বিমানটি চালিয়ে নিয়ে এলেন। ককপিটে আমরা দুইজন পুরো সময়টা বসে আলাপ করতে করতে এলাম।

কি আলাপ করলে?

সব কিছু সংক্ষেপে বয়ান করে বললাম শিশুভাই, দুই ভায়রা যদি কোনও অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করেই তখন আমরা কি করবো বলে আপনি আশা করেন?

রশিদ তো জিয়ার অফার নাকচ করে দিয়ে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, ওয়াদা মাফিক সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে না আনলে তারা মানে রশিদ আর ফারুক অন্য কোনও চাকুরি গ্রহণ করবে না। জিয়া সামরিক বাহিনীতে যা কিছু করেছে এরপর তোমাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা তার পক্ষে কোন মতেই সম্ভব না। একই সাথে পৃথিবীর যেকোনো জায়গাতে তোমরা একত্রে থাকো সেটাও জিয়ার মাথাব্যথার কারণ। রাজনৈতিকভাবে আগস্ট বিপ্লবের সাথে একাত্মতার শপথ নিলেও এখন তার পক্ষে তোমাদের সাথে নিয়ে রাজনীতি করাও সম্ভব নয়। বিশেষ করে ভারতের আনুকূল্য পাবার প্রত্যাশায় আওয়ামী-বাকশালীদের শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন আঙ্গিকে বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারায় পুনর্বাসিত করার ভারতীয় শর্ত মেনে নেবার পর। জিয়া এখন সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন, ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের সাথে এবং মুজিবের মৃত্যুর সাথে তার কোনও সম্পর্ক কখনোই ছিল না যদিও জিয়া স্বয়ং মুক্ত হওয়ার পর ভালভাবেই বুঝতে পারেন, ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব আর ১৫ই আগস্ট এর বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মূলে কাজ করেছিল একই শক্তি সেনা পরিষদ। ৭ই নভেম্বর তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ছিল সেনা পরিষদের সহায়ক শক্তি মাত্র। তিনি এটাও জানেন, এই দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনা একই সূত্রে বাঁধা। ভারতীয় চাণক্যরা জিয়াকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে জিয়া চারিত্রিকভাবে বিপ্লবী নন। জিয়ার রাজনীতি হবে ক্ষমতার স্বার্থে সমঝোতার রাজনীতি। তাই ভারতের সাথে নিজের স্বার্থেই তিনি আপোষ করতে বাধ্য হবেন। একই সাথে নিজের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জিয়া সামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে বেছে বেছে ইসলামিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং জাতীয়তাবাদীদের সমূলে উপড়ে ফেলতে সচেষ্ট হবেন। তাদের মূল্যায়নই সঠিক প্রমাণিত হল! খন্দকার মোশতাক যখন পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয়ার জেনারেল জিয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন তখন জিয়া অতি সহজেই জাস্টিস সায়েমকেই ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাষ্ট্রপতি রেখে সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে এক সময় তাকে বঙ্গভবন থেকে বিদায় করে দেন। এরপর শুরু করেন রক্তের হোলিখেলা। ব্যর্থ সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের নাটক সাজিয়ে প্রায় হাজার তিনেক সেনাসদস্যকে বেছে বেছে বিনাবিচারে হত্যা করা হয় অতি নিষ্ঠুরতার সাথে। রাজনৈতিক অঙ্গন এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে অগুণতি প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক নেতা-কর্মীকে মেরে ফেলা হয় কিংবা জেলে ঢুকানো হয়। এভাবেই জিয়া মনে করছেন, সামরিক বাহিনীতে তার ক্ষমতা তিনি নিরংকুশ করতে পেরেছেন বিশেষ করে সেনা পরিষদের শক্তি দুর্বল করে দিয়ে।

শিশুভাইয়ের বক্তব্য আমদের অজানা ছিল না, তিনি আমাদের জানা সব কিছুর সত্যতাই প্রমাণ করছিলেন। জেনারেল জিয়া মনে করছেন তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো আর কোনও শক্তি অবশিষ্ট নেই। তিনি বোকার রাজ্যেই বাস করছেন। তার জানা নেই, বিপ্লবীদের মারা যায় কিন্তু বিপ্লবী চেতনার মৃত্যু ঘটানো সম্ভব হয় না। তার বর্বর নৃশংসতায় সামরিক বাহিনীতে আক্রোশ আর ঘৃণা যেভাবে ধূমায়িত হচ্ছে তাতে যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। সেই জ্বলন্ত লাভায় জিয়ার কি পরিণতি হবে সেটা ভাববার বিষয় নয়। আমাদের চিন্তার বিষয় হল যদি ভারতের প্ররোচনায় কিংবা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সাহায্যে জিয়া এইসব করে থাকেন তবে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে!

শিশুভাই, আপনি দেখছি একজন দক্ষ রাজনীতি বিশারদ এবং দার্শনিক হয়ে উঠেছেন।

আমি তেমন কিছুই নই। শুধুমাত্র চলমান ঘটনা প্রবাহের সত্যকেই যতটা বুঝি তোমার কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। এখানে লাভ-লোকসানের কোন হিসেব নেই। শ্রদ্ধা করি তোমাদের সাহস, আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম ও আপোষহীন চারিত্রিক দৃঢ়তাকে। অন্তর থেকে ভালোবাসি তোমাদের এবং শ্রদ্ধা করি তোমাদের নীতি-আদর্শকে। আমি শুনছিলাম সব কিছু আর মৃদু মৃদু হাসছিলাম। আমার মৃদু হাসি লক্ষ করে শিশুভাই বললেন ঠাট্টা করছো? তা অবশ্য করতেই পারো।

না, আপনাকে নতুন ভাবে বোঝার চেষ্টা করছি শিশুভাই। কিন্তু কই, জবাব দিলেন নাতো আমাদের কি করা উচিৎ?

আগেও বলেছি আবারও বলছি, তোমরা প্রত্যেকেই এক একটি অমূল্য রতন। ৮-১০ কোটি দেশবাসীর মধ্যে তোমাদের মতো নিবেদিতপ্রাণ জনদরদী খুঁজলেও খুব একটা পাওয়া যাবে না এই অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই আমার হয়েছে। অপশক্তিগুলোর চোখ রয়েছে তোমাদের উপর। তাই বর্তমানে কোন ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের শেষ করে দিও না। অনেক রাত হল, সকালেই তো আবার আপনাকে অফিসে উপস্থিত হতে হবে। তাই আজকের মত আসি বলে উঠে দাঁড়ালাম। গাড়ী পর্যন্ত আমাকে আর মাহবুবকে পৌঁছে দিলেন শিশুভাই। হাঁটতে হাঁটতে বললাম

আপনি আমাদের যেভাবে আসমানে তুলে দিলেন ভয় হচ্ছে ধপাস করে ধরণীতলে পড়ে না যাই!

সাবধানে থাকবে।

Wilco. দোয়া করবেন। আল্লাহ্ যদি সুযোগ আর তৌফিক দেন তবে আমাদের সবার কাছে Happy go lucky type শিশুভাইয়ের আজকের এই অসাধারণ রূপটা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা নিশ্চয়ই করবো।

শিশুভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে গাড়ীর দরজা খুলে দাড়ালেন। আমি ভেতরে ঢুকে বসলাম, মাহবুবও উঠে বসল পাশে। ড্রাইভার গাড়ী স্টার্ট করতেই শিশুভাই গাড়ীর জানালার কাছে এসে বললেন কালই হয়তো তোমাকে ডেকে পাঠাবেন জেনারেল জিয়া, তার CMLA’s Office এ। Not for Court Martial I suppose! কার বিচার কে করবে বা কেমন হবে সেটা আল্লাহ্ই জানেন, বললেন শিশুভাই।

তিনজনই উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। মালিবাগে পৌঁছে দিয়ে মাহবুব জিজ্ঞেস করল আমি কি থেকে যাবো স্যার?

পাগল নাকি! তুমি ফিরে যাও। এত ভয় করলে কি চলে? তাছাড়া এলাকাটা আমাদের নিজস্ব। খানসেনারাই এই বাড়ী রেইড করে স্বপনকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিল এই কথাটা ভুলে যাচ্ছ কেনো?

ঠিক আছে স্যার, তবে সিভিল ড্রেসে কয়েকজন বিশ্বস্ত সৈনিক থাকবে বাসার পাহারায়। এই বিষয়ে আপনার কোনও আপত্তি আমি শুনবো না। মিনতি ভরা চোখ মাহবুবের। তাই হেসে বললাম, ক্রসফায়ারে মারা না পরি। জবাব শুনে মুচকি হেসে মাহবুব বলল চীফ ডাকলে, সময় মতো ডেকে পাঠাবেন স্যার। ফোন করে দিলেই আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাবো। ঠিক আছে, আল্লাহ হাফেজ। আল্লাহ হাফেজ, চলে গেল মাহবুব। কেয়ার ঘরে গিয়ে দেখি পানের বাটা ঘিরে স্বপন, মহুয়া, মুন্নি আর কেয়া আমার অপেক্ষায় নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে মুখর। আমি পৌঁছতেই কেয়া আমার মুখে একটা পান গুঁজে দিয়ে বলে উঠল

ভাইয়া, তোমার সাথে আমাদের কিছু serious কথা আছে। চলো উপরে স্বপন ভাইয়ার ঘরে। কারণ, আমরা চাইনা আব্বা আমাদের কথাবার্তা শুনুক। ঠিক আছে। কিন্তু মহুয়া তুই বাসায় ফিরবি না? অনেক রাত হয়ে গেছে। তুমি যতদিন আছো ততদিন আমি মালিবাগেই থাকবো। লিটু আর শাশুড়িকে সেটা জানিয়ে দিয়ে এসেছি। বিশালকে সাথে নিয়ে এসেছি as he remains much happier at Malibag, so no problem. তোমার দেখাশুনা করার জন্যই এই ব্যবস্থা। আন্টির পক্ষে একা সবকিছু সামলানো সম্ভব নয়। কেনও? বাসায় তো একগাদা পুরনো লোকজন রয়েছে, সবাই যার যার কাজে fully trained. Anyway চল উপরে যাই। দোতলায় স্বপনের বেডরুমের কার্পেটে কুশন নিয়ে সবাই জাঁকিয়ে বসলাম।
মহুয়াই শুরু করলো

জানো ভাইয়া, তোমরা দেশ ছাড়ার পর তোমাদের ভক্ত সৈনিক আর অফিসার ভাইরা প্রায়ই খোঁজ খবর নিতে আসতো। তাদের একটাই কথা, আমরা যাতে তোমাদের কালবিলম্ব না করে ফিরে আসতে অনুরোধ করি। কারণ, তারা জিয়া সম্পর্কে দিন দিন সন্দিহান হয়ে পড়ছেন। তাদের ধারণা, জিয়া তোমাদের ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছেন না। ঘটনা প্রবাহে তাদের ধারণাটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়।

পরাজিত বিপ্লবীকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিস তাইনা?

কি বললে? পরাজিত বিপ্লবী! বিপ্লবতো শেষ হয়ে যায়নি। চলছে, চলবেও। তাই জয়-পরাজয়ের প্রশ্নটা অবান্তর। জিয়া নিজেই নিজের কবর খুঁড়ছে, ফোঁড়ন কাটল কেয়া। ঠিকই বলেছে কেয়া। মোনাফেকির মাশুল জিয়াকে দিতেই হবে। তবে সেটা আমার বিবেচ্য বিষয় নয়। জিয়ার মৃত্যুর সাথে বিপ্লবের মৃত্যু হবে না। বিপ্লব একটি সনাতন আবহমান প্রক্রিয়া।

ওরে বাবা, কোটিপতির বউ হয়ে তোর মুখে বিপ্লবের বাণী! আমিতো রীতিমতো ভিরমি খাচ্ছি!

কেনো? তুমি যদি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করে বিপ্লবী হতে পারো তবে তোমার বোন বিপ্লবী হলে দোষ কোথায়? আজ যারা ধনসম্পদের পাহাড় গড়ে নব্যবিত্তশালী বনে সমাজটাকে কিনে নিয়েছে তাদের ওই বিত্তবৈভব সবই তো দেশ থেকেই অর্জিত বৈধ-অবৈধ ভাবে। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই কৃতঘ্ন। নৈতিকতা বিবর্জিত কলুষিত মন তাদের। আমি কোটিপতির বউ হতে পারি, তবে আমার একটা স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা আছে। আমি আমার সত্তাকে কারো কাছে বন্ধক দেইনি, আমি শিক্ষিতা। আজ আমি যাই হই না কেনো, তার জন্য দেশের কাছে আমি ঋণী এতটুকু বোঝার যোগ্যতাও আমার আছে। তাই দেশ ও জনগণ নিয়ে আমাকেও ভাবতে হবে। সেটাই স্বাভাবিক, এটা কি তুমি অস্বীকার করতে পারো? তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কি কোনও অবদানই ছিল না? আমরা কি নির্যাতিত হইনি? প্রাণের ঝুঁকি কি আমরা নেইনি?

সেটাতো সর্বজন স্বীকৃত।

ভাইয়া, তুমি জ্ঞানী, বিস্তর তোমার পড়াশুনা। তারপরও তোমারই বোন হিসাবে আমি তোমাকে শুধু বলতে চাই, বৈপ্লবিক প্রক্রিয়াতে উত্থান-পতন থাকবেই। তাই বলে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। সব কিছু মেনে নিয়েই যতটুকু সম্ভব এগিয়ে যেতে হবে। রণেভঙ্গ দেয়া চলবে না। তোমাদের কাছে জাতির অনেক প্রত্যাশা। সেটা আমরা বাইরে থেকে যতটুকু বুঝি ততখানি তোমরা নাও বুঝতে পারো। হোঁচট যদি খেয়েই থাকো তার মোকাবেলা করতে হবে বাস্তব ভিত্তিক বিচক্ষণতার সাথে, আবেগের সাথে নয়। দৃঢ়চেতা সাহসী কিন্তু ধীরস্থির শান্ত প্রকৃতির মহুয়ার মধ্য যে এই ধরনের স্ফুলিঙ্গ থাকতে পারে সেটা বাহ্যিক ভাবে বোঝা মুশকিল। এমনি হয়তো না জানা লক্ষকোটি প্রাণে সুপ্ত হয়ে ধিক ধিক করে জ্বলছে অঙ্গার, এই অঙ্গারকে প্রজ্বলিত করে দাবানল সৃষ্টি করার মধ্যেই রয়েছে বিপ্লবের সফলতার চাবিকাঠি। কথার মোড় অন্যদিকে ফিরিয়ে দিলাম। আধশোয়া অবস্থায় স্বপনকে জিজ্ঞেস করলাম

কিরে তোর ব্যবসা কেমন চলছে? ভালোই চলছে, ১৫ই আগস্টের পর তোর আর নূর ভাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী SANS INTERNATIONAL বন্ধ করে দিয়ে নিজের কোম্পানির নামে Import Export এর ব্যবসার পাশাপাশি নৌযান ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছি। কাঁটাতার, নাটবলটু, স্ক্রু, চাবি তৈরি করার ডিজাইনটা মোটা দামে মেহের ইন্ডাস্ট্রি কিনে নিলো। ওই টাকায় দুটো Double Decker Launch বানানো হচ্ছে আমার Design অনুযায়ী। প্রতিটি লঞ্চ ৫০০ যাত্রী বহনের ক্ষমতা রাখবে। সদরঘাট থেকে চাঁদপুর হয়ে বরিশাল এই রুটেই চালানো হবে লঞ্চদুটো। আমার বিশ্বাস ১ বছরেই ক্যাপিটাল ফিরে আসবে। এমনটি হলে আরও দুটো লঞ্চ বানাবো। ৩-৪ বছরের পর সেগুলো বিক্রি করে দিয়ে Under bonded House System, joint venture এ ready made garments factory install করার ইচ্ছে আছে with Taiwan or Korea. This is a labor intensive field and most of the workers would be female. This would be 100% export oriented business. So, earnings would be n foreign currencies. হংকং এবং সিঙ্গাপুর এ অনেক Korean and Taiwanese companies office খুলে বসে আছে, ওদের থেকেই shall chose some reputed one for the joint venture. নুরুল কাদের ভাইও তাই ভাবছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়ে স্বপনের দূরদর্শিতা ও জ্ঞান অসাধারণ তীক্ষ্ণ সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই ও যাই করুক না কেনো সেটা বুঝেশুনেই করবে সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।

১৯৭৪ সালে PO-9 এর আওতায় মুজিব সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বেছে বেছে মোট ৬০ জন সরকার বিরোধী মনোভাব সম্পন্ন অফিসারকে চাকুরিচ্যুত করা হবে। সর্ব প্রথম যেই ১২ জন আর্মি অফিসারকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছিলো তার মধ্যে আমি আর নূর ছিলাম তালিকার শীর্ষে। সেনাবাহিনী থেকে বের করে দিয়ে মুজিব নিজেই আমাকে আর নূরকে ডেকে পাঠিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য সবকিছুই তিনি আমাদের জন্য করতে প্রস্তুত। ব্যবসা করতে চাইলে শেখ নাসেরের পার্টনার হয়ে ব্যবসা করতে পারি, যদি বিদেশে যেতে চাই তবে কূটনীতিক হিসেবে যেখানে ইচ্ছে সেখানেই তিনি আমাদের পাঠাতে রাজি আছেন। আমরা তার সেই সব প্রস্তাব বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে বেরিয়ে এসেছিলাম। এরপর ভাবছিলাম সংসার চালানোর জন্য কি করা যায়!তখন স্বপনই সহায় হয়ে প্রস্তাব দিল তার সাথে ব্যবসাতে যোগ দিতে। আমাদের আর একজন বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার কর্নেল আকবর হোসেন (জিয়ার আমলে মন্ত্রী) চাকুরিচ্যুত হওয়ার আগেই চাকুরি ছেড়ে আমাদের সাথে যোগ দিল। কুমিল্লার সাজেদ মোক্তারের ছেলে আকবর হোসেনের সাথে ছাত্রকাল থেকেই বন্ধুত্ব। ৪ জনের নামের প্রথম অক্ষর মিলিয়ে মতিঝিলের টয়েনবি সারকুলার রোডে স্বপনের অফিসেই জন্ম নিল SANS INTERNATIONAL LTD নামের কোম্পানি। অল্প সময়েই অনেক সজ্জন এবং সহানুভূতিশীল পদস্থ ব্যক্তিদের সাহায্য এবং সহযোগিতায় আমাদের ব্যবসা ভালোই জমে উঠলো। এতে রুটি-রুজির সমস্যা রইলো না। সেই সময়, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর এবং কর্নেল আকবর মিলে প্রতিষ্ঠিত করে একটি নতুন রাজনৈতিক দল United People’s Party, সংক্ষেপে (UPP)। আমাদের তারা আহ্বান জানিয়েছিলেন তাদের পার্টিতে যোগদান করার জন্য। কিন্তু আমরা তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলাম আমরা নীতি-আদর্শের দিক দিয়ে সমমনা, আপনারা আপনাদের পথে এগিয়ে চলুন। আমরা আমাদের পথে এগিয়ে যাবো। জাতীয় স্বার্থে উপযুক্ত সময়ে আমরা অতি সহজেই একত্রিত হতে পারবো। ইতিমধ্যে মেজর শাহরিয়ারও চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে স্বপনের পরামর্শে এয়ারপোর্ট রোডে electric and electronic items repairing shop SHERRY ENTERPRISE খুলে বসেছে। তার কারবারও ভালোই জমে উঠলো অল্প সময়েই।

ডালিম শোন, আমি তোকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।

জিয়া তোকে কেনো ডেকে পাঠিয়েছে সেটা আমি জানিনা। তবে এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে, জিয়া তোদের শিকড় উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে চলেছে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন অজুহাতে। তোদের মধ্যে বোঝাপড়া যাই হয়ে থাকুক সেটার কোনও মূল্য নেই আজকের জিয়ার কাছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে তিনি তোদেরকেই তার ক্ষমতার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা মনে করছেন। ১৫ই আগস্টের সাথে তার কোনও সম্পর্ক কখনোই ছিল না সেই ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে তার ইশারায়। মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে সম্বোধন করতে দ্বিধা বোধ করছেন না জিয়া। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার, জিয়া ভারতের সাথে আঁতাত করেই রাজনীতি করবেন। প্রয়োজনে আওয়ামীলীগকে হাসিনার নেতৃত্বে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার মতো ছাড় দিতেও প্রস্তুত জিয়া। সং সেজে গ্রামে-গঞ্জে মাদারির মতো কোদাল কাঁধে ঘুরে বেড়িয়ে জিয়া আমজনতার কাছে সাময়িক ভাবে হলেও নিজের জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা দুটোই হাসিল করতে সক্ষম হয়েছেন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগ তাকে পরাজিত করতে পারবে না। Long term নিয়ে জিয়া এখন কিছুই ভাবছেন না। তবে গণচীন, মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিম দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য সৃষ্টির চেষ্টা তিনি করলেও করতে পারেন, কিন্তু যত ছাড়ই জিয়া দিক না কেনো ভারত তাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। কে জানে, হয়তো ভারতই তাকে কবরে পাঠানোর ক্ষেত্র তৈরি করে হায়েনার হাসি হাসছে সময়ের অপেক্ষায়। চাণক্যদের কূটচালের মোকাবেলায় জিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আপোষ করে খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না। জিয়ার উচিৎ ছিল যেই শক্তি তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করাতে সক্ষম হয়েছিলো তাদের সাথেই এগিয়ে চলা, সেটাই ছিল তার জন্য সর্বোত্তম পন্থা। কিন্তু রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে সেইপথ থেকে সরে এসে চক্রান্তের যে মাকড়সার জাল জিয়া নিজেই তৈরি করেছেন, তাতে আজ নিজেই আটকা পড়ে গেছেন। বাঁচার কোনও রাস্তাই নেই জিয়ার। জিয়ার কোদাল কাঁধের আর ভাঙ্গা স্যুটকেসের চমকের ধোঁকাবাজি অতি অল্প সময়তেই ধরা পড়ে যাবে জনগণের কাছে। প্রকাশিত হয়ে পড়বে তার নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ইতিকথা। কিন্তু আমার মনে হয়, তার আগেই তার অপমৃত্যু হবে। সেইক্ষেত্রে কিছু সময় তার দল নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবে প্রয়াত জিয়ার নাম ভাঙ্গিয়ে, কিন্তু পরিশেষে দলটিরও অপমৃত্যু ঘটবে। কিন্তু বেঁচে থাকবে আওয়ামীলীগ আর শেষ হাসি হাসবে ভারতের চাণক্যরা। শিশুভাই সবকিছু বুঝে চেষ্টা করছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়ার। Immigration papers হাতে পেলেই তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমাবেন সপরিবারে। আর একটি কথা। ঠিক এই মুহূর্তে জিয়াবিরোধী যেকোনো পদক্ষেপে লাভ হবে জাতীয় শত্রুদের আর তাদের বিদেশী মোড়ল ভারতের। বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি করদরাজ্যে। আর ১০ কোটি দেশবাসী বন্দী হবে দাসত্বের জিঞ্জিরে দীর্ঘকালের জন্য। আমার বিশ্লেষণের সাথে তোরা একমত নাও হতে পারিস। তবে অনুরোধ এই বিষয়ে খবরাখবর নিয়ে একটু ভেবেচিন্তেই যা করার করিস। এবারের প্রসঙ্গটা পারিবারিক। জিয়া যে ভাবেই হউক আব্বা, শাহ আজিজ, শামসুল হুদা চাচা, জাদু মিয়াকে তার দলে টেনে নিতে পেরেছেন। বিষয়টি অনেকটা ‘গোড়া কেটে উপর দিয়ে পানি ঢালার মতো’। এতে জিয়া মুখে কিছু না বলেও জনগণকে বোঝাতে পারবে তার সব কার্যক্রমে তোদের সম্মতি রয়েছে। সামরিক বাহিনীতে তোদের সমর্থক যারাই বেঁচে আছে তারা বিষয়টি খুব একটা ভালো নজরে দেখছে কি?

না, তা হয়তো দেখছে না তবে তারা সবাই রাজনৈতিকভাবে সচেতন। তারা জিয়ার আসল চরিত্র ইতিমধ্যেই বুঝে নিয়েছে। আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে পারবেন না জিয়া। ভবিষ্যতে আমরা যাই করি সেটা আমরা করবো দেশ ও জাতির স্বার্থে, জিয়ার ব্যক্তিস্বার্থে নয় এ বিষয়ে তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস। আব্বাদের এখন জিয়ার কাছ থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। জিয়া কানকথায় বিশ্বাসী এক প্রতিহিংসা পরায়ণ ব্যক্তি। তাই তাদেরকে জিয়াকে বুঝতে হবে নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকেই। এর কোনও বিকল্প নেই স্বপন। আমরা সর্বদাই বিভিন্ন বিশ্বস্ত সূত্র থেকে নির্ভরযোগ্য খবরাখবরের চুলচেরা বিশ্লেষণের পরই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। অস্বীকার করবো না, আজঅব্দি একটাই মারাত্মক ভুল আমাদের হয়েছে। সেটা হল জিয়াকে চিনতে আমরা ভুল করেছিলাম; ভুলই বা বলি কি করে! কোরআন ছুঁয়ে শপথ নিয়ে আমাদের একজন হয়েছিলো জিয়া যুদ্ধকালে। সেই জিয়ার মোনাফেকিতে আজ আমরা জিতেও পরাজিত। এর মাশুল শুধু আমাদেরই নয়, দেশবাসীকেও দিতে হবে ভবিষ্যতে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-স্বপ্ন বাস্তবায়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিলো সেনা পরিষদের সাথে গাদ্দারি করে! সব সম্ভাবনার অবারিত দ্বার বন্ধ করে দিলো শুধুমাত্র নিজের ক্ষমতার জন্য ভারতের সাথে আপোষ করে। এতদিনের নিরলস পরিশ্রম, সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষা সবকিছুই পণ্ড হয়ে গেলো একটি মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ভাই! শুধু কি তাই, ঐ সমস্ত ত্যাগী সাথীরা, যারা বুক দিয়ে জিয়াকে বাঁচিয়ে রেখে সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করালো তাদের রক্তেই তিনি তার হাত রঞ্জিত করলেন অতি নিষ্ঠুরতার সাথে। এর বিচার কি আল্লাহ্ করবেন না? নিশ্চয়ই বিচার করবেন তিনি।

হ্যাঁ, তার জঘন্য নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের বিচার হবেই ইহকালে এবং পরকালে। আর একটি কথা। জানিস, কেনো শিশুভাই মাহবুবকে তোর সাথে ছায়ার মতো থাকতে বলেছেন?

কিছুটা আঁচ করতে পারি হয়তো আমার নিরাপত্তার জন্য কিন্তু আমার নিরাপত্তার হুমকিটা ঠিক কোথা থেকে সেটা বুঝতে পারছি না!

আমি তোর Threat perception টা পরিষ্কার করে দিচ্ছি। শিশুভাই তোর ব্যাপারে জিয়াকে বিশ্বাস করতে পারছেন না বলেই মাহবুবকে তিনি নিজস্ব উদ্যোগেই তোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি তোদের সবাইকেই অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন এবং আন্তরিকভাবে ভালোবাসেন, বিশেষ করে তোকে। যা ঘুমোতে যা, অনেক রাত হল। কালকের কথাবার্তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা কর গিয়ে।

সবাই উঠে নিজ নিজ কামরায় চলে এলাম। কাপড় বদলে শুয়ে পড়লাম। শিশুভাই আর স্বপনের কথাগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল ১০ টায় দরজায় টোকা দিয়ে মহুয়া আমাকে জাগিয়ে তুলে বলল CMLA এর অফিস থেকে জেনারেল জিয়ার ADC ফোন করেছে। উঠে গিয়ে ফোন ধরতেই ADC বললেন, চীফ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন বিকেল ৫টায় CMLA এর অফিসে পুরনো সংসদ ভবনে। সেখানেই সাক্ষাত হবে। ঠিক আছে। বলে লাইন কেটে দিয়ে মাহবুবকে খবরটা জানিয়ে দিলাম। মাহবুব বলল, যথাসময়ে ও এসে আমাকে নিয়ে যাবে। এরপর শিশুভাইকে ফোন করলাম শিশুভাই, চীফ আমকে বিকেল ৫টায় CMLA ’s office এ ডেকে পাঠিয়েছেন। মাহবুব এসে আমাকে নিয়ে যাবে। That’s fine. একটা বিষয়ে খেয়াল রেখো, কথা বলবে কম শুনবে বেশি। Okay Sir, shall do as you said. রাখি এখন, সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। Be polite and listen what he says. But be firm in whatever you say. Prepare well and take care. পরে সাক্ষাতে শোনা যাবে কি কথা হল। শিশুভাই, কালকের জন্য আরো একবার আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানবেন। We all love you a lot with respect from the core of our hearts. We too, bye ফোন রেখে দিলেন শিশুভাই।

যথাসময় মাহবুব এলো। আমরা গিয়ে পৌঁছলাম CMLA’s Office এ। গেটের গার্ডরুম থেকে আমার আগমনী বার্তা পেয়ে ADC ক্যাপ্টেন জিল্লুর গাড়ী বারান্দা থেকেই অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলো। মাহবুব ADC- এর ঘরে অপেক্ষায় থাকলো। আমি সংলগ্ন দরজা দিয়ে গিয়ে ঢুকলাম Chief Martial Law Administrator এর বিশাল Office এ।

উর্দি পরা জেনারেল জিয়া বিশাল টিক উডের গ্লাসটপ টেবিল এর বিপরীত দিকে বসে অপেক্ষায় ছিলেন। Bottle Green Ray Ban চশমাটা টেবিলের উপর রাখা। তার এই চশমা নিয়ে অনেক মুখরোচক গুজব বাজারে চালু আছে, কিন্তু প্রকৃত বিষয়টি হল বেশিরভাগ সময় তিনি ওটা পরে থাকতেন কারণ তিনি ছিলেন সামান্য লক্ষীট্যারা। তবে কাছ থেকে খুব সূক্ষ্মভাবে না দেখলে বিষয়টি বোঝা ছিল কষ্টকর। আমাকে ঢুকতে দেখে তিনি চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের এপাশে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন অনেকদিন পর তোমাকে দেখে ভালো লাগছে। How are you and others keeping? বলেই তিনি আমাকে একটি চেয়ারে সার ইশারা করে নিজে তার Revolving Chair-এ গিয়ে বসলেন। বসে হালকা ভাবে জবাব দিলাম

যেমন রেখেছেন ঠিক তেমনই আছি স্যার। জবাব শুনে একটু চিন্তা করে বললেন

কি খাবে চা না কফি? কফির কথাটা শুনে মনে পড়ে গেলো যখনই তার বাসায় যেতাম তখন লনে কিংবা ড্রইংরুমে তিনি নিজেই কফি বানিয়ে খাওয়াতেন। Inter Com-এ ADC কে নির্দেশ দিলেন জিয়া কফি পাঠিয়ে দেবার জন্য। বলো, বেনগাজীতে তোমাদের কেমন কাটছে? How do you find Gaddafi?

রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে বিলাসবহুল পরিবেশে ভালোই সময় কাটছে আমাদের। গাদ্দাফি নিজেকে একজন ইসলামিক বিপ্লবী হিসেবে মনে করেন। তার রাজনৈতিক দর্শন তিনি সারাবিশ্বে তার ‘গ্রীন বুকের’ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। একই সাথে তিনি একজন কট্টর পুঁজিবাদ ভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ বিরোধী হিসাবে বিশ্বের প্রতিপ্রান্তে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সমস্ত সংগ্রাম চলছে তাকে সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে চলেছেন মোয়াম্মর মানে প্রিয় নেতা গাদ্দাফি। মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ নেতারা তো রাজপ্রাসাদে শুয়ে মুসলিম উম্মাহর মুক্তির আর ইসলামের পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু এই তরুণ নেতা রাজপ্রাসাদে থেকেই কিন্তু বিপ্লবের স্বার্থে তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা মতো কাজ করে চলেছেন। প্রথমে নাসেরের ‘Pan Arabism’ তাকে রোমাঞ্চিত করে তুলেছিলো, পরে তিনি ‘Pan Islamism’ এর দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি বিশ্বাস করেন, একদিন বিশ্বের মুসলমানরা নিজেদের ঈমানি শক্তি ফিরে পেয়ে বৈপ্লবিক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদী এবং ইহুদিবাদী আগ্রাসন এবং শোষণের বিরুদ্ধে লড়ে তাদের পতন ঘটাবে। বিশ্বজোড়া নিপীড়িত জনগোষ্ঠী এবং মুসলমানদের পুনর্জাগরণের বিষয়ে, বিশেষ করে বিশ্বপুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের মোড়ল আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে গাদ্দাফি বদ্ধপরিকর। তার জন্য আয়ারল্যেন্ডের সিনফিন মুভমেন্ট, বৈরুতে হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের ফেদাইন, ইরিত্রিয়া, মিন্দানাও-এর মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম, বসনিয়া, হারজেগোভিনা, ক্রোশিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সব কয়টি দেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে মুক্ত হস্তে আর্থিক সাহায্য করে চলেছেন গাদ্দাফি পশ্চিমা বিশ্বের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করেই। মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহ-আমীরদের প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ। তার মতে, এদের সবাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাহায্যে ক্ষমতাসীন হয়ে শুধু নিজের দেশবাসীরই নয় পুরো উম্মাহর সর্বনাশ করে চলেছেন। তল্পিবাহক ওইসব কায়েমী স্বার্থবাদী বাদশাহ-আমীররা তাদের বিদেশী প্রভুদের ইশারায় মুসলিম উম্মাহকে শত ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে টাকার জোরে। তারাই বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ফ্যাকড়াবাজি আর ফ্যাসাদের জন্ম দিয়ে বিভক্তির মাত্রা বাড়িয়ে চলেছেন তাদের দরিদ্রতার সুযোগ গ্রহণ করে। গাদ্দাফির এই ধরনের চিন্তা ভাবনাতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তেল গ্যাস সমৃ্দ্ধ ধনী বাদশাহ আর আমীররা তাকে উগ্রপন্থী এবং চরমপন্থী হিসাবে একঘরে করে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন, তাতে মোটেও বিচলিত নন গাদ্দাফি। তার চিন্তা-চেতনা আর কার্যক্রমের সমর্থনেই বোধকরি কবি লিখেছিলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’, যদিও তার আদর্শের সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দ্বিমত থাকার অবকাশ রয়েছে তারপরও বলতে হচ্ছে, সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তার মতো প্রগতিশীল নেতা সারা মুসলিম বিশ্বে দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অনেক সংগ্রামী নেতাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে, দেখেছি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছেই গাদ্দাফি একজন শ্রদ্ধেয় এবং বিশ্বস্ত আপনজন। অবশ্য এদের মধ্যে অনেককেই মনে হয়েছে সুবিধাবাদী, ধড়িবাজ শৃগাল। বলেই জেনারেল জিয়ার চোখে চোখ রাখলাম। তিনি কিছুটা বিব্রত হয়েছেন বলেই মনে হল। চোখ সরিয়ে দরজার দিকে চাইলেন জিয়া। দেখলাম ADC এর তত্ত্বাবধানে বেয়ারা খাবারের ট্রলি নিয়ে প্রবেশ করছে। সাজানো ট্রে রেখে তারা ফিরে গেল জেনারেল জিয়ার ইশারায়। তিনি নিজেই দুটো কাপে কফি তৈরি করে একটা আমাকে দিয়ে অন্যটি নিজে নিয়ে বললেন Let’s start and feel free. Of course Sir, একটা প্লেটে কিছু পছন্দমতো খাবার তুলে নিলাম।

জানতে পারলাম, বাংলাদেশের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল গাদ্দাফি?

স্যার, গাদ্দাফি বাংলাদেশ সম্পর্কে খুবই আশাবাদী এবং তিনি  লাদেশের সাথে ভাতৃপ্রতিম সম্পর্ক গড়ে তুলতে খুবই ইচ্ছুক। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য সার্বিক ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত। তিনি আমাদের নিঃসংকোচে বলেছেন তার দৃঢ় বিশ্বাস, বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের অধীনে বাংলাদেশ পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে দ্রুততর গতিতে প্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের অসম্প্রদায়িক দুনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী যারা রক্তের আহুতি দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তারা অবশ্যই স্ব-নির্ভরতার ভিত্তিতেই নিজেদের একটি আত্মমর্যাদাশীল সুখী সমৃদ্ধশালী জাতি এবং রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাড়াতে সক্ষম হবে। আমাদের সাথে বিস্তারিত আলাপ আলোচনার পর তার এই প্রত্যয় নাকি আরো জোরদার হয়েছে। বাঁকা চোখে জিয়াকে পরখ করে দেখলাম তিনি কিছুটা গম্ভীর হয়ে উঠেছেন।

আমার সম্পর্কে তার কি ধারণা?

আপনি তো আমাদেরই একজন সেটাই গাদ্দাফি জানেন। তাই আপনার বিষয়ে আলাদাভাবে কোনও আলোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। অবশ্য প্রয়োজন হলে সেটাও করার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া আপনার সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকলে, আপনার অনুরোধে তিনি আমাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে উষ্ণ আন্তরিকতার সাথে লালন করে আসছেন কেনো? সুযোগ পেয়ে একটা খোঁচা দিয়ে দিলাম। ফলে, তার কালো মুখটা আর একটু কালো হয়ে উঠলো। মন্দ লাগছিলো না বর্ণচোরা জিয়ার অস্বস্তি দেখতে।

হঠাৎ Red Telephone বেজে উঠলো। রিসিভার তুলে নিলেন CMLA জেনারেল জিয়া। অপরপ্রান্ত থেকে কে কি বলছিল শুনতে পারছিলাম না। এ তরফের জিয়া গভীর মনোযোগের সাথে ফোনের কথা শুনছিলেন আর গম্ভীর মুখে আমার দিকে চোখ তুলে বার বার চাইছিলেন। আমি নির্বিঘ্নে খাবার সাবাড় করছিলাম আর কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। বেশ কয়েক মিনিট পর তিনি ‘Okay, I am looking into the matter’ বলে রিসিভার ক্রেডলে রেখে দিয়ে স্তম্ভিত হয়ে কিছু ভাবছিলেন। ঘন ঘন Red Telephone বাজতে থাকায় জিয়ার ভাবনায় ছেদ পড়ছিলো। ‘হুঁ’ ‘হ্যাঁ’ বলে অতি সংক্ষেপে আলাপ সারছিলেন জিয়া। তেমনই একটা কল শেষ হওয়ার পর জেনারেল জিয়া হঠাৎ Red Telephone এর রিসিভারটা ক্রেডল থেকে টেবিলে নামিয়ে ফোনটাকে engaged করে রাখলেন। একই সাথে ADC কে বললেন, তিনি না বলা পর্যন্ত যেন কোনও incoming call তাকে transfer করা না হয়। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলো না বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটেছে।

Dalim, something totally unexpected had happened! কর্নেল ফারুক এখন বগুড়ায়। Brigade Commander has been taken under house arrest and he has taken over the Brigade. সিঙ্গাপুর থেকে যোগাযোগের পর ফারুক থাই-এর একটি ফ্লাইট-এ ঢাকায় পৌঁছানোর পর একদল সৈনিক ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাকে বিমান থেকেই তুলে নিয়ে প্রথমে সাভারে বেঙ্গল ল্যান্সার-এর যেই স্কোয়াড্রনটা রয়েছে সেখানে নিয়ে যায়। স্বল্পক্ষণ সেখানে থাকার পর সোজা বগুড়াতে, সেখানেই ল্যান্সারের মূল ইউনিটটা রয়েছে। এই ঘটনা আর তোমার এবং রশিদের দেশে আগমনের বার্তাটি যেভাবেই হউক দেশের সব ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সবখানেই চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। রশিদকে ইতিমধ্যেই সৈনিকরা ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে গেছে। সব GOC-রা আমাকে চাপ দিচ্ছে যতশীঘ্র সম্ভব তোমাদের সাথে একটা সমঝোতা করার জন্য। তাদের অভিমত, তা না হলে ঢাকাসহ সব ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়বে যা আমার কিংবা তাদের পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। সীমান্তের ওপারেও Indian troops movement এর খবর আসছে। ফারুক ঢাকার উদ্দেশ্যে মার্চ করার জন্য তৈরি হচ্ছে। সাভার থেকে বেশকিছু অফিসার এবং সৈনিক ইতিমধ্যেই চলে গেছে আরিচা আর নগরবাড়ি ফেরি ঘাট secure করার জন্য to facilitate Faruk’s advance to Dhaka. বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-সাভার মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করছে ফারুককে স্বাগত জানাতে। জয়দেবপুর থেকেই গেছে তারা। কুমিল্লা ও চিটাগং থেকেও সৈনিকরা দাউদকান্দি এবং শোভাপুর ব্রিজের কাছে জমায়েত হয়েছে। সব ক্যান্টনমেন্টের GOC এবং উচ্চপদস্থ কমান্ডাররা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে যেহেতু তাদের নির্দেশ সৈনিকরা মানছে না, তুমি কি এসবের কিছুই জানো না?

আপনার এই প্রশ্নটা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত আর বিস্ময়কর মনে হচ্ছে! ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, জবাব দেবো কি দেবো না। কারণ, জবাবটা শুধু আমাকেই বিব্রত করবেনা, আপনাকেও বিব্রত করবে। সন্দেহপ্রবণ মন নিয়ে প্রশ্নটা যখন করেই ফেললেন, তখন জবাবটা আমি দেবো সেটা যত কঠিনই হোক না কেনো। বিনা কারণে কাউকে অবিশ্বাস করাটা আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট নয়। আপনার মতো একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি হয়ে এতদিনের ঘনিষ্ঠতার পর সেটা আপনার না বোঝার কথা নয়। সেনা পরিষদ আর আমাদের সাথে আপনার আর রশিদ, ফারুকের কি সম্পর্ক সেটা আশা করি আপনি ভুলে যাননি। সেইক্ষেত্রে, এমন একটা প্রশ্ন আমাকে কি করে করতে পারলেন আপনি? কর্নেল ফারুকের এই পরিকল্পনাতে যদি আমি বা আমি যাদের প্রতিনিধিত্ব করছি তারা জড়িতই থাকবো তবে আমি এই মুহূর্তে আপনার সামনে বসা কেনো? অন্যরা কেনো ফারুকের সাথে দেশে উপস্থিত না হয়ে বেনগাজীতে অবস্থান করছে? এর বেশি আর কিছুই আমি বলতে চাই না। যতটুকু জানি, আপনি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেই বিষয়ে আলোচনা আপনি এখন করতে পারবেন না। তাই যদি অনুমতি দেন তবে আমি চলি, বর্তমানের সংকট সমাধান করে পরে ডেকে পাঠালে আবার আসবো। বলে উঠতে যাচ্ছিলাম, শক্তিধর জিয়া ত্বরিত টেবিলের অন্য পাশ থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে বসার অনুরোধ জানিয়ে একটি চেয়ারে প্রায় জোর করেই বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে আর একটি চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।

ডালিম, ফারুক যদি তার ট্যাঙ্কবহর নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে পড়ে তাহলে Chain of Command ভেঙ্গে পড়বে, সারা দেশজুড়ে এক অরাজকতা সৃষ্টি হবে আর সেই সুযোগে Indian armed forces might move in to reinstall Awami- Bakshalites again in power by force…. Please Sir, for heaven’s sake stop telling me all these. I am not here to take lessons from you in this regard. What I know is that you and your cronies wouldn’t be able to resist Faruk and he shall be ousting you all from power. This is your only concern at this moment.

স্যার, জ্ঞান দেবার চেষ্টা না করে আপনি আমার কয়েকটা কথা শুনুন। চুপসে গিয়ে জেনারেল জিয়া বললেন বলো।

অনেক দিনের ব্যবধানে আজ আপনার সাথে আমি মুখোমুখি কথা বলছি একান্তে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে তাইনা?

হ্যাঁ।

এই অল্প সময়তেই একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে যেই জিয়াকে বিশ্বাস করে আমরা সযত্নে লালন করে এসেছিলাম আপনি সেই জিয়া নন। নিজেকে এইভাবে বদলে ফেলার পরিণামটা ভাল হবে না খারাপ হবে সেটা সময়ই আপনাকে বুঝিয়ে দেবে। ইতিহাস কিন্তু কাউকে ছাড় দেয় না। যেকোনো কারণেই হউক, আপনি ইতিমধ্যেই অনেক সত্যকে অস্বীকার করে ফেলেছেন এবং ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করছেন। আমার এই বক্তব্য সঠিকভাবে বোঝার জন্য আপনার স্মৃতিকে একটু স্বচ্ছ করে দিচ্ছি। ‘৭১ সাল থেকে আজ অব্দি জাতীয়-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যা কিছুই প্রকাশ্যে ঘটেছে সেটা সম্পর্কে দেশবাসী এবং বিশ্ববাসী অবগত। কিন্তু পর্দার অন্তরালে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে যে সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতো দেশের বেশিরভাগ বিজ্ঞজনই অবগত নন। কেউ কেউ হয়তো বা কিছুটা আঁচ করতে পারেন আংশিকভাবে, এর বেশি নয়। ঐসব ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বিধায় আমরা কিন্তু অজ্ঞ নই।

১৯৭১ সালে, আর্মি ক্র্যাকডাউনের পর আপনি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নয়, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অধীনস্থ অফিসার এবং সৈনিকদের উদ্যোগেই বিদ্রোহ করে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই ঘোষণার কৃতিত্বটার দাবিদার শুধু আপনি একা নন, সেই সময় আপনার সহযোদ্ধাদের সবাই সেই কৃতিত্বের দাবিদার। কিন্তু আপনি আজঅব্দি সেই সত্যটা সম্পর্কে নিশ্চুপ রয়েছেন। আপনার সেই ঘোষণার জন্য মুজিবনগর বাংলাদেশী প্রবাসী সরকার এবং ভারতীয় সরকারের কাছে মেজর জিয়া মানে, আপনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একজন উচ্চাভিলাষী অফিসার হিসাবে তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। যার ফলে যুদ্ধের শুরুতেই আপনাকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে এনে কোলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডের হেডকোয়াটার্স এ ডাম্প করা হয়। আপনার বাসস্থান নির্ধারিত হয় কল্যানীতে। প্রবাসী ও ভারত সরকারের মনোভাব বুঝে তখন আপনার সাথে কম লোকজনই যোগাযোগ করতো। সেই সময় স্বেচ্ছায় আমিই পূর্বপরিচিত জন হিসেবে গোপনে আপনার সাথে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রবাসী আওয়ামীলীগ সরকারের দাসখত, ভারতীয় ষড়যন্ত্র এবং আগামীদিনের স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে তাদের সুদূর প্রসারী নীলনকশা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করি বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতেই। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমরাও নীতি-আদর্শ ভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি প্রণয়ন করে একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করছি মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে, সেই বিষয়ও আমি আপনাকে অবগত করে বলেছিলাম আমাদের এই কার্যক্রম আপনাকে কেন্দ্র করেই আমরা এগিয়ে নিতে চাই, যদি এতে আপনি সম্মত হন। অনেক ভেবে চিন্তে আমাদের নীতি-আদর্শে বিশ্বাস করেই, আমাদের একজন হয়ে কাজ করার জন্য আপনি কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলেন। আপনার তরফ থেকে শর্ত ছিল একটাই, উপযুক্ত সময়ের আগপর্যন্ত আমাদের সম্পর্কটা গোপন রাখতে হবে। জবাবে আপনাকে আশ্বস্ত করে কথা দিয়েছিলাম, আল্লাহ্র রহমতে দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে আপনাকে উপবিষ্ট করার আগ পর্যন্ত কেউই আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে কিছুই জানতে পারবে না ইনশা আল্লাহ। আপনার সাথে আমাদের যোগাযোগও থাকবে ন্যূনতম পর্যায়ে। এরপর যুদ্ধকালে প্রবাসী সরকার যখন ‘S’ এবং ‘K’ ফোর্স নামে দুইটি রেগুলার ব্রিগেড গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন কাদের চাপে ‘Z’ ফোর্স নামের ব্রিগেডটি কিভাবে গঠন করতে প্রবাসী সরকার বাধ্য হয়েছিলো সেটা আপনি ভালো করেই জানেন।

স্বাধীনতার পর আমরা একসাথেই কুমিল্লাতে ছিলাম, আপনি ছিলেন প্রথম ব্রিগেড কমান্ডার। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই মুজিব সরকার আপনাকে অ্যাক্টিভ কমান্ড থেকে সরিয়ে সেনাসদরে নিয়ে আসার পর আপনাকে কর্নেল হিসাবেই সামরিক বাহিনী থেকে বের করে দেবার চক্রান্তের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মিলিটারি এটাচি করে বার্মায় পাঠনোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পরে আপনাকে সুপারসিড করে শফিউল্লাহকে জেনারেল বানিয়ে আর্মি চীফ পদে অধিষ্ঠিত করা হয় যাতে আপনি প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন সুপারসিডেড অফিসার হিসেবে। কিন্তু সরকারের সেই চক্রান্তকেও অকার্যকর করে কোন শক্তি আপনাকে যাতে শফিউল্লার অধীনস্থ PSO হয়ে থাকতে না হয়ে তার জন্য DCOAS এর একটি পদ সৃষ্টি করে সেখানে শফিউল্লার সমপদমর্যাদায় আপনাকে নিয়োগ দিতে সরকারকে বাধ্য করেছিলো সেটাও আপনার অজানা নয়। এরপর PO-9 এর প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের চাকুরি থেকে অসময় অবসরে পাঠানোর পর আপনি ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়লে বলেছিলাম, চিন্তার কোনও কারণ নেই, সময়মত সব ঠিক হয়ে যাবে।

এরপর ১৫ই আগস্ট এর বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর আমাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি শফিউল্লাহকে সরিয়ে আপনাকে আর্মি চীফ পদে নিয়োগ দান করেন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী। সেটাও আপনি ভালভাবেই জানেন। সেই সময় খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হলেও সরকারের পেছনে মূলশক্তি ছিল সেনা পরিষদ, আর আপনি তাদেরই মনোনীত আর্মি চীফ হিসাবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। লক্ষ্য একটাই- ধাপে ধাপে রাষ্ট্রীয় এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে আমাদের স্বপ্ন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাতীয় পরিসরে বাস্তবায়িত করা। এরপর অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটে ২-৩ নভেম্বের ’৭৫ এর প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’দাতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল শাফায়াত এর প্ররোচনায়। এর জন্য আপনি কতটুকু দায়ী সেটা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে হবে না। সেই সংকটেরও মোকাবেলা করেছিলাম আমরা আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেই। খালেদ-চক্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও সম্মুখ সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে পরোক্ষভাবে খালেদ-চক্রকে উৎখাত করার পরিকল্পনা শেষে আলোচনার মাধ্যমে কৌশলগত কারণেই খালেদভাবী এবং হুদাভাবীকে সঙ্গে করে ব্যাংকক চলে যাই। সেখান থেকেই পরিচালিত হয় ৭ই নভেম্বর-এর সিপাহী জনতার বিপ্লব, সেটা আপনি মুক্ত হয়ে চীফের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরমুহূর্তেই বুঝতে পারেন। কর্নেল তাহেরই যদি ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানের মুখ্যশক্তি হতো তাহলে তো আপনাকে তার হাতের পুতুল হতে হতো তাই না স্যার? কিন্তু তেমনটি তো হয়নি। আপনাকে তাহেরের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলো সেই একই শক্তি, যখন কর্নেল তাহের আপনাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে নেবার জন্য জবরদস্তি করছিলেন তখন কর্নেল তাহেরকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে দিয়ে তাকে সরাসরি বলা হয়েছিলো তিনি যেন আর ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করার চেষ্টা না করেন, তাই না স্যার? সেই শক্তিটি যে সেনা পরিষদ সেটা বুঝতে আপনার বেগ পেতে হয়েছিলো কি? আমাদের সাথে আলাপের পরই আপনি আমাদের কথামতো খন্দকার মোশতাককে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আপনার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। যুক্তি হিসাবে আপনাকে ও জাতির উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, এতে সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দেবে। তবে একই ভাষণে তিনি অবশ্য জাতিকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ৩রা অক্টোবর ১৯৭৫, জাতির উদ্দেশ্যে তার ভাষণে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন ১৫ই আগস্ট ১৯৭৬ থেকে দেশে বহুদলীয় রাজনীতি শুরু করা হবে এবং ২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে জনগণ যদি তার উপর আস্থাজ্ঞাপন করেন তবে ভোটে জিতেই তিনি আবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন, তাই না স্যার? হ্যাঁ। কিন্তু সাংবিধানিক জটিলতাটাই কিন্তু আসল কারণ ছিল না আপনার প্রস্তাব গ্রহণ না করার পেছনে।

মানে?

আলাপের মাধ্যমে তিনি আপনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কালবিলম্ব না করে আমাদের দেশে ফিরিয়ে এনে সেনাবাহিনীতে পুনর্নিয়োগ প্রদান করতে। জবাবে সরাসরি আপনার পক্ষে তখন তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব ছিল না। তাই আপনি বলেছিলেন, এই বিষয়ে আপনার আরও কিছু সময় প্রয়োজন। কি স্যার, ঠিক বলছিতো?

হ্যাঁ, ঠিকই বলছো।

ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী খন্দকার মোশতাক আপনার জবাব থেকে যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন আর আমাদের জানিয়েছিলেন তিনি আপনার নিয়তের বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। সে জন্যই তিনি পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের আপনার প্রস্তাব গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের আপনার ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। তার সিদ্ধান্তে জেনারেল ওসমানী হতবাক হয়ে খন্দকার মোশতাককে ফোন করেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি সবকিছু তাকেও খুলে বলেছিলেন। সব শোনার পর তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে জনাব মোশতাককে বলেছিলেন, পৃথিবীতে মানুষ চেনা দায়! কি জানেন স্যার, জনাব মোশতাকের কথা শুনেও কিন্তু আমরা আপনাকে অবিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যাক সে কথা। খন্দকার মোশতাকের সিদ্ধান্তের পর দেশের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার পথে আর কোনও বাধা না থাকায় অতি অল্পসময়ে আপনার পক্ষে শিখণ্ডি রাষ্ট্রপতি সায়েমকে সরিয়ে নিজেই CMLA হয়ে রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়ে ওঠা সহজ হয়ে যায়। আপনি এখনো সেই পদে অধিষ্ঠিত হয়ে বহাল তবিয়তে দেশ শাসন করে চলেছেন। ৩রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বরের পর সামরিক বাহিনীতে যা কিছুই ঘটেছে সে সম্পর্কে দেশবাসী তেমন কিছুই জানে না। কিন্তু আপনি এবং আমরা কি তাদের মতোই অজ্ঞ? আপনার একচ্ছত্র আধিপত্যকালে যাই হয়েছে বা হচ্ছে তার সব দায়-দায়িত্বের হিসাব কিন্তু দিতে হবে শুধুমাত্র আপনাকেই। তখন কিন্তু আপনার আজকের বিশ্বস্ত আস্থাভাজন পরামর্শদাতাদের কাউকেই ধারে কাছে খুঁজে পাওয়া যাবে না, এই একই কথা আমি শেখ মুজিবকেও বলেছিলাম তার সাথে শেষ সাক্ষাতকালে যখন তিনি আমাকে আর নূরকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তার ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাসভবনে। আপনি ঠিক বলেছেন, এই ক্রান্তিলগ্নে ভারতীয় আগ্রাসন দেশ ও জাতির জন্য হবে ভয়াবহ। কিন্তু আওয়ামী-বাকশালীদের হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় রাজনীতির মূলধারায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সমঝোতা আপনি তো ইতিমধ্যেই ভারতের সাথে তাদের অনুকম্পা ও সহমর্মিতা পাবার আশায় করে ফেলেছেন ‘বসন্তের কোকিল’ ডঃ কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম আর তোফায়েল আহমেদের মাধ্যমে যখন পার্টিটি টুকরো টুকরো হয়ে বিলীন হয়ে পড়ছিলো। এ ধরনের কাজ তো ‘খাল কেটে কুমীর ডেকে আনার’ মতই আত্মঘাতী। খবরটা সত্যি না মিথ্যা স্যার?

কোনও জবাব নেই। জেনারেল জিয়া মুখ কালো করে মাথা নিচু করে বসেছিলেন।

স্যার, জানিনা আপনি কাদের পরামর্শে ভারতের সাথে সমঝোতা করে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করতে চলেছেন। এতো চড়াই-উৎরাই পেরিয়েও আপনি কি করে বুঝতে অক্ষম হলেন আপনি যতই ছাড় দিন না কেনো ভারতের কাছে আপনি কখনোই গ্রহণযোগ্যতা পাবেন না, শুধুমাত্র তাদের স্বার্থে ব্যবহৃত হবেন। স্বার্থ হাসিল হওয়ার পর আপনার প্রয়োজনীয়তাও শেষ হয়ে যাবে তখন আপনার পরিণতিটা কি হবে একবার ভেবে দেখেছেন কি? তাছাড়া, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বিপরীতমুখী স্বার্থের যে দ্বন্দ্ব বিরাজমান সেটা চিরস্থায়ী, সেক্ষেত্রে ভারতের সাথে সমঝোতা করে ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করা কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ, বাংলাদেশ যদি আত্মনির্ভর, প্রগতিশীল এবং সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে গড়ে ওঠে তবে দীর্ঘদিন যাবত ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্তা যারা ভারতীয় কেন্দ্রীয় শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও বীরবিক্রমে সাহসিকতার সাথে লড়ে চলেছে তাদের মনোবল বেড়ে যাবে। তারা ভাববে, বাংলাদেশ যদি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন আর সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারে তবে তারা পারবে না কেনো? ফলে, স্বল্পসময়েই অযৌক্তিক ভাবে সৃষ্ট ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং এই অঞ্চল ফিরে যাবে হাজারো বছরের ঐতিহ্যবাহী আকৃতিতে। আজ যারা আপনার বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা তাদের রাজনীতির মৌলিক সংজ্ঞা এবং ইতিহাস সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান আছে সে প্রশ্ন না করে শুধু এতটুকুই বলবো, তাদের কেউই এখানকার রাজনীতি তো দূরের কথা, এ অঞ্চলের মাটি-মানুষের সাথেও তেমনভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন না কখনোই। তারা দেখেছেন আইয়ুব খানের রাজনীতি, জুলফিকার আলি ভুট্টোর মতো ঠগবাজদের রাজনীতি আর দেখেছেন কূটকৌশলী ক্ষমতালিপ্সু জেনারেলদের আর আমলাদের। কিন্তু তখনকার পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশের জনগণের মানুশিকতা শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী থেকে ছিল সবদিক থেকেই আলাদা। এরপরও আত্মরম্ভি আইয়ুব খান কিংবা মাদারি ভুট্টো কিন্তু তাদের স্বরূপটি বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারেননি পাকিস্তানের জনগণের কাছ থেকে। আপনিও পারবেন কিনা তাতেও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। বর্তমানে ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য আপনার নিজস্ব অবদান কতটুকু সে বিষয়ে কিছু বলে আপনাকে বিব্রত করতে চাই না। তবে আপনাকে মধ্যমণি করে যারা তিলে তিলে অনেক আত্মত্যাগ এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনা পরিষদ গড়ে তুলেছিলো সেই প্রক্রিয়ায় আমিই ছিলাম তাদের আর আপনার মধ্যে মূল যোগসূত্র। তাই সবার তরফ থেকে আমি আপনাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, আমাদের কিংবা দেশ ও জাতির প্রতি আপনি যাই করে থাকুন তার জন্য আপনার প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র ক্ষোভ কিংবা অনুযোগ নেই। কারণ, আমরা সবাই বিশ্বাস করি মানুষ মাত্রই তার নিজ কর্মফলের জন্য দায়ী। একই ভাবে ইহকালে এবং পরকালে। দেশ ও জাতীয় স্বার্থে সবকিছুই সহ্য করার তৌফিক আল্লাহ্ পাক আমাদের দিয়েছেন। তাছাড়া সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে আমরা সবাই আলহামদুলিল্লাহ! এটা আপনার চেয়ে অন্য কারো বেশী বোঝার কথা নয়। যাবার আগে আর একটা কথা বলে যাচ্ছি, আজকে যেই সংকটের মোকাবেলা আপনাকে করতে হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন সংকটের মোকাবেলা আপনাকে ভবিষ্যতে করতে হবে আপনার এই ধরনের সমঝোতার রাজনীতির পথে। শুনে রাখুন, পাশা, নূর, শাহরিয়ার, হুদা, ডলিমদের বাইরের এবং ভেতরের সত্তায় কোনও পার্থক্য নেই। মানুষ নিজেকে দিয়েই অন্যকে বোঝার এবং জানার চেষ্টা করে। আমরা মনেপ্রাণে আপনাকে আমাদেরই মতো একজন বিশ্বাস করেই গ্রহণ করেছিলাম। আপনি আমাদের বুঝতে ভুল করেছেন। এখন হয়তো আপনি আমাদেরই আপনার মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন। কিন্তু স্যার, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন প্রতিদ্বন্দ্বী যদি আমরা হয়েও থাকি ব্যক্তিগতভাবে আপনার কোনও ক্ষতি আমরা করবো না। কারণ, আমাদের বিশ্বাস, একদিন আপনি বুঝতে পারবেন আপনাকে ভুল পথের অন্ধকূপের অতলে নিক্ষিপ্ত করেছিলো সেনা পরিষদের নেতারা নয়, তার জন্য দায়ী সুযোগ সন্ধানী ষড়যন্ত্রকারী আপনার ঘরের শত্রু বিভীষণরা। আপনি এটাও বুঝবেন আমাদের মধ্যে মানবিকতা, নৈতিকতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, আন্তরিকতা এবং সহমর্মিতা কিছুটা হলেও রয়েছে যার প্রমাণ আপনি নিশ্চয়ই পেয়েছেন ইতিমধ্যেই। কথাগুলো কিছুটা তিক্ত হলেও বলে গেলাম। পরে একটু খতিয়ে দেখলে তাতে আপনার কিছুটা লাভ হলেও হতে পারে। যদিও পানি ইতিমধ্যে গড়িয়েছে অনেক দূর। এখন আমি বিদায় নেবো। বলে উঠে দাড়াতেই বিচলিত ক্ষমতাধর জেনারেল জিয়া বলে উঠলেন

এখন কি আমরা আর এক নই?

অদ্ভুত প্রশ্ন! স্যার, এতক্ষণ আমি কি তবে ‘অরণ্যে রোদন’ করলাম! এত কথার পর এই ধরনের প্রশ্ন পরিহাস তুল্য। আসি স্যার, বলতেই তিনি আবার আমার ডান হাতটা দুই হাতে ধরে কাতরভাবে বললেন ফারুককে বোঝাতেই হবে তোমাকে।

ফারুক তো আমাকে জিজ্ঞেস করে আসেনি। সে তার নিজের ইচ্ছায় এসেছে।

কিছুক্ষণ ভেবে জিয়া বললেন এক কাজ করলে কেমন হয়?

কি?
চলো, তোমাকে নিয়ে আমি সব ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে দরবারে বলি, আমরা এখনো একই সাথে আছি এবং ১৫ই আগস্টে এবং ৭ই নভেম্বর-এর চেতনা এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এটাও তুমি সবাইকে বুঝিয়ে বলবে যে, বিপ্লবের স্বার্থেই তোমরা কিছুদিনের জন্য বিদেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছো। এটা যদি গ্রহণযোগ্য না হয় তবে সব ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রতিনিধি আনিয়ে সেনাকুঞ্জে দরবারের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।

তা হয়তো করা যেতে পারে, কিন্তু সেখানেও এই ধরনের বক্তব্য আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয় আপনার পাশে দাঁড়িয়ে। কারণ, সেই রাস্তাটা আপনি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছেন। কি করে, সেটা আপনার নিজেরই জানা আছে। আমার জবাবে চুপসে গেলেন জিয়া। আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হবে কিনা জানিনা, তবে দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে যদি কিছু করা সম্ভব হয় সেটা করার চেষ্টা নিশ্চয় করবো। এরপর বেরিয়ে এসেছিলাম। ADC- এর রুমে বসেই মাহবুব ঘটে যাওয়া ঘটনার সবকিছু জেনে গেছে। গাড়ীতে বসেই বললাম

ব্রিগেড মেস-এর নির্ধারিত কামরায় চলো। পথিমধ্যে লোকজনদের মধ্যে স্বাভাবিকতাই লক্ষ্য করলাম যেমনটি লক্ষ্য করেছিলাম ২-৩রা নভেম্বর রাতে। সে রাতেও তারা ছিল বেখবর আজকেও ঠিক তারা তেমনিভাবে বেখবর!