১৯৯১-এর নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিজয়ে সেনা পরিষদের অবদান

রোডম্যাপ অনুযায়ী এখন আমাদের বেরিয়ে পরতে হবে খালেদার জন্য আর্থিক যোগানের ব্যবস্থা এবং বিএনপি ও জামায়াতকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে। ঠিক হল, হুজুরপাকের রওজা মোবারকে হাজিরা দিয়ে সালাম জানিয়ে দুরুদ এবং নামাজ পড়ে ওমরাহ্‌ পালনের পর মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি রাষ্ট্র সফর করে আমি যাবো গণচীনে আর রব্বানি ফিরে আসবে নাইরোবিতে।
সেখানকার পুরানো বন্ধুরা বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবছেন সেটা জেনে নিতে। পরিকল্পনা মাফিক গিয়ে পৌঁছালাম মদিনা শরীফে। সেখানে জিয়ারত শেষে মক্কাতে ওমরাহ্‌ পালন করে গেলাম রিয়াদে। সেখানে House of Saud এ কয়েকজন পদস্থ এবং প্রভাবশালী পুরনো বন্ধু রয়েছেন। তাদের মাঝে রাজ পরিবারের একজন জেনারেল এবং প্রাক্তন গোয়েন্দা চীফও রয়েছেন। তাদের সাথে দেখা করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করলাম। আলাপকালে বুঝতে পারলাম, সেই সময়ে তাদের কাছে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য সমস্যা হচ্ছে ইরাক আর কুয়েতের মধ্যে রমলা তেলক্ষেত্র নিয়ে ক্রমবর্ধমান মতপার্থক্য। ঘনীভূত এই সঙ্কটে তারা দেখছে অশনি সঙ্কেত। তারপরও তারা আমাদের আশ্বস্ত করল ভাতৃপ্রতিম দেশ হিসাবে বাংলাদেশের জন্য তারা সম্ভাব্য সব কিছুই করবে বেগম খালেদা জিয়ার জন্য। এতটুকুই যথেষ্ট। সেখান থেকে আরব আমিরাত, ইরাক, কাতার, লিবিয়া সফর করলাম। সেখান থেকে আমি পৌঁছালাম বেইজিং গুয়াংচাউ হয়ে।

গণচীন ইতিমধ্যেই নিজেদের একটি উদীয়মান বিশ্বশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে বিস্ময়কর গতিতে এগিয়ে চলেছে। অভাবনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে একই সাথে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে চীনের রাষ্ট্রীয় দর্শন এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। একই সাথে বদলে যাচ্ছে তাদের World Out Look. তাদের এই নবযাত্রার শুরু থেকেই আমি দেখে আসার সুযোগ পেয়েছি হংকং-এ থাকার ফলে। চীনের আধুনিকীকরণের দৌড় ক্রমশ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে টেক্কা দিয়ে তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে নতুন আভায় উদ্ভাসিত হয়ে। পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে সে দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেই এগিয়ে চলেছে উদীয়মান পরাশক্তি গণচীন। বিশ্বশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে সমগ্র বিশ্বের ঘটনাবলীর সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে সেটাই স্বাভাবিক। চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সুপ্রাচীন। বাংলাদেশের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু শ্রী অতীশ দীপঙ্কর চীনে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন। আমি যখন চীনে কূটনীতিক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলাম তখনই কয়েকশত বছর ধরে পোতলা প্যালেসে রক্ষিত তার দেহাবশেষের ভষ্ম বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন চৈনিক নেতৃবৃন্দ।

হযরত শাহ জালাল(র)-এর পাঠানো ২৯ জন ধর্মপ্রচারক সারা চীনে ইসলাম ধর্মের বিকাশ ঘটায়। অধুনা কালে ১৫ই আগস্টের ঐতিহাসিক সফল সামরিক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গণচীন এবং সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ বেশিরভাগ মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ভূ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক দিক দিয়েও বাংলাদেশ গণচীন সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সাথে গভীর দ্বিপাক্ষিক সু-সম্পর্ক চীনা পররাষ্ট্রনীতির একটি স্থায়ী নির্ধারিত নীতি। তাই বাংলাদেশের সাথে রাষ্ট্রীয়, জনগণ এবং পার্টি এই তিন পর্যায়ে সমতা ভিত্তিক বন্ধুত্ব কায়েম রাখার ব্যাপারে চীনারা খুবই সচেতন।পুরানো বন্ধুদের সাথে কোনও রাখঢাক না রেখেই সর্বদা মন খুলে সব বিষয়েই আলাপ করে এসেছি। চীনা বন্ধুরাও আমাকে কখনোই শুধুমাত্র একজন কূটনীতিক হিসেবে না ভেবে পরম বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেই মিশে এসেছেন। প্রাণ খুলে আমার সাথে আলাপ করেছেন নিশ্চিন্তে সর্ববিষয়ে নির্দ্বিধায়, এমন কি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়েও। বৈঠকে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম বন্ধুদের বিশ্লেষণ আর আমাদের বিশ্লেষণে তেমন কোনও তারতম্য নেই। তাদেরও প্রত্যাশা, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ভারতের মদদপুষ্ট আওয়ামীলীগ এরশাদের সহায়তায় ক্ষমতায় না আসুক। তারাও একই ভাবে শঙ্কিত, এই জোট এবার ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা ক্রমান্নয়ে হুমকির মধ্যে পরবে বিধায় দেশটাকে পরিণত করা হবে একটি ভারত নির্ভর করদ রাজ্যে। সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা হয়ে উঠবে সুদূরপরাহত। তাই মন্দের ভালো বিএনপি জোটের বিজয়ের জন্য যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা করবে বন্ধুরাষ্ট্র গণচীন। কিন্তু তাদের ধারণা, বাস্তবে জেতার কাজটি সহজ হবে না। কারণ, বিরোধী পক্ষ সবদিক দিয়েই তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী বিশেষ করে সাংগঠনিক ভাবে। এই শক্তি সঞ্চয় করার পূর্ণসুযোগ পেয়েছে ভারত এবং আওয়ামী-বাকশালীরা জেনারেল এরশাদের ৮ বছরের শাসনকালে। এরশাদ এবং হাসিনা দুই জনই ভারতের কাছে দাসখত দিয়ে রাজনীতি করে আসছেন একে অপরের সম্পূরক হয়ে শুরু থেকেই। ভারতের নির্দেশেই দুইজনই চলেছেন। দেশ কিংবা জনগণ নিয়ে তাদের কোনও নিজস্ব চিন্তাভাবনা নেই। ক্ষমতাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। দুইটি দলই ভারতের কাছে বিক্রিত। আরও একটা অতি মূল্যবান কথা জানালো বন্ধুরা। তাদের মতে প্রয়াত জেনারেল জিয়ার দূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে সব চেয়ে বড় ভুল করেছিলেন ভারতের সাথে সমঝোতা করে হাসিনাকে দেশে এনে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা। যদিও বাংলাদেশের ভুক্তভোগী জনগণের বৃহদংশই স্বাধীনতার যুদ্ধকালীন সময় থেকেই চরমভাবে ভারত বিদ্বেষী। এই ভারত বিরোধী চেতনায় লোকজন যদি খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে ভোটে জিতিয়েও দেয়, তারপরও বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে আত্মনির্ভরশীল জাতি এবং দেশ হিসাবে গড়ে তোলার যোগ্যতা রাখেন না খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি। কারণ, জন্মলগ্ন থেকেই জিয়ারও মনোভাব ছিল একমাত্র ভারতকে খুশি রেখেই স্বচ্ছন্দে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব। আত্মকেন্দ্রিক, ক্ষমতালিপ্সু সুবিধাবাদীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই দল বিএনপি। প্রকৃত দেশপ্রেমিক এবং নিঃস্বার্থ নেতাকর্মীদের সংখ্যা নীতিনির্ধারণের পর্যায়ে খুবই কম পরিলক্ষিত হয়। উপরন্তু, পরিবারতন্ত্রের অভিশাপমুক্ত নন খালেদা জিয়া। এই বিচারে, তার দল এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য নেই। তাই শুধু পার্টি পর্যায়ে নয়, জাতীয় পরিসরেও দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি ছড়িয়ে পড়ছে ক্যান্সারের মতো। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রধান দলগুলোর সব কয়টিই নীতি-আদর্শ বিবর্জিত। সার্বিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে, ময়দানের সব কয়টি প্রধান দলের চরিত্র কমবেশি একই। তোমরা যে পথে জিয়াকে নিয়ে এগুতে চেয়েছিলে সেই পথটিই ছিল সার্বিক মুকির সঠিক পথ। ওই পথে এগুলে তোমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন অনেকাংশেই সম্ভব হতো ইতিমধ্যেই।

কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেন তোমাদেরই বেছে নেয়া সংগঠনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি জেনারেল জিয়াউর রহমান, এই কথাটি তুমি কখনোই আমাদের বলোনি, কিন্তু তারপরও বিষয়টি আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। বন্ধুরা আর একটি বিবেচনাযোগ্য কথা বলেছিলো।

তাদের ধারণা খালেদার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না আমাদের প্রতি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়া যে নীতি গ্রহণ করছিলেন সেই নীতি থেকে সরে আসা। তোমাদের দেশে ফিরে পৃথকভাবে রাজনীতি করতে দিতে পারেন না খালেদা জিয়া, তাতে বিএনপির রাজনীতিই শেষ হয়ে যাবে।

জবাবে আমি বলেছিলাম এই বিষয়টি নিয়ে ভাবছি না আমরা। এই মুহূর্তে ব্যক্তিস্বার্থের তুলনায় জাতীয় স্বার্থটাই আমাদের কাছে মুখ্য। যে করেই হউক বাংলাদেশকে ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করার চক্রান্তের মোকাবেলা করতে হবে। আর এই লক্ষ্য নিয়েই তোমাদের পরামর্শ এবং সাহায্য সহযোগিতা পাবার আশা নিয়েই এসেছি নিজেদের আত্মার তাগিদেই, খালেদা জিয়ার নিয়োজিত দূত হিসেবে নয়। এটা আমরা বুঝতে পেরেছি পুরনো এবং প্রিয়বন্ধু হিসেবে। বিশ্বাস করো, এই ক্রান্তিকালে তুমি আসবেই আমাদের সাথে দেখা করতে যত শীঘ্র সম্ভব সেটাও আমরা জানতাম। এখনকার পরিস্থিতিতে ‘৭১-এ তোমরা যে ধরণের একটি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলেছিলে সেই ধরনের শক্তি খালেদার পক্ষে গড়ে তোলা কখনই সম্ভব হবে না। তিনি তার প্রয়াত স্বামীর পদাংকই অনুসরণ করবেন।

তবে এতে হতাশ হবার কিছুই নেই। গণচীনের ইতিহাসে ২০০ টি বিপ্লব বিফল হবার পর ১৯৪৮ সালে, দীর্ঘ ২৮ বছর বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ এবং জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সাথে সামাজিক বিপ্লবের প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রেখে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। বিপ্লবের পথে অনেক উত্থান-পতন থাকে। তোমরাও সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকো। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, সময়ের ধারাতেই সুযোগের সৃষ্টি হয়। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আবার নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে অবশ্যই তোমরা তোমাদের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হবে। কারণ তোমরা সবাই নিবেদিতপ্রাণ নিখাদ দেশপ্রেমিক।
বন্ধু, তোমাকে আমাদের অনেকেই প্রসঙ্গক্রমে আগেও অনেকবার বলেছেন, তোমাদের প্রয়োজন দেশের মাটিতে সুস্থ রাজনীতির জন্ম দেয়া। তোমাদের মতো আত্মত্যাগী, দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ দেশপ্রেমিকদের নেতৃত্বেই গড়ে তোলা সম্ভব স্বনির্ভর, প্রগতিশীল, আত্মমর্যাদাশালী সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ প্রশ্ন থাকে, এই ধারণা আমদের কি করে জন্মালো? তুমি যখন চীনে ছিলে সেই সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনেক প্রতিনিধি দল গণচীনে এসেছে। একই ভাবে গণচীন থেকেও বাংলাদেশে গিয়েছে অনেক প্রতিনিধি দল। তুমি চলে যাবার পরও সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। আমরা তাদের কাছ থেকেই জেনেছি, বাংলাদেশের জনগণ তোমাদেরকে জাতীয় বীর হিসাবেই তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছে। আর সেই সম্মান, শ্রদ্ধা এবং জনপ্রিয়তা পদভারে প্রাপ্ত নয়। নিরলস দীর্ঘ সংগ্রাম, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, ত্যাগ ও তিতিক্ষায় অর্জিত। আমরা আশায় থাকবো তোমাদের একদিন রাজনীতিতে নেতৃত্বের স্থানে দেখার। বন্ধুদের প্রত্যাশার বাস্তবায়নের সুযোগ কখনো হবে কিনা জানা নেই, তবে আল্লাহ্‌র মর্জি হলে হতেও পারে।
বন্ধুদের প্রায় সবাই ছিলেন বয়সে প্রবীণ এবং লং মার্চে অংশগ্রহণকারী। এদের সবাই ছিলেন অভিজ্ঞ, জ্ঞানী, শীর্ষস্থানীয় ক্ষমতাশালী নেতৃবৃন্দ। বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম নাইরোবিতে। ফিরে এসে চীনা বন্ধুদের সাথে আলাপের সব খুলে বলে রব্বানিকে জিজ্ঞেস করলাম কেমন বুঝলে?

এক কথায় আমি হতবাক! চীনাদের সাথে মেলামেশা করার তেমন কোনও সুযোগ হয়নি, তবে যাদের হয়েছে তারা বলেছে চীনাদের বোঝা খুবই শক্ত। বন্ধুত্ব গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। আজ তাদের সেই অভিমতের উল্টোটাই শোনালে তুমি। মানতেই হবে, তুমি তাদের সাথে যে ধরনের অকৃত্রিম ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে পেরেছো সেটা খুব কম সংখ্যক ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞার গভীরতা, দূরদর্শিতা এবং সারগর্ভ বিশ্লেষণ আমাকে বিমোহিত করেছে। প্রতিটা বিষয় যে ধরনের স্বচ্ছতার সাথে তারা ব্যাখ্যা করেছে তাতে আমি আশ্চর্য হয়েছি বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের পরিধি দেখে।
তবে যে বিষয়টি আমাকে স্তম্ভিত করেছে, সেটা হল, তুমি নিজেকে যতটুকু চেনো তার চেয়ে অনেক গুণবেশি তারা তোমাকে চেনে।

এবারের গন্তব্যস্থল হল ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ পাকিস্তান। স্বাভাবিক কারণেই সে দেশের সামরিকবাহিনী, রাজনৈতিক মহল, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী মহলের অনেকের সাথেই আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কারণ, যৌবনের একটা লম্বা সময় কাটিয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানে। রব্বানির ক্ষেত্রে সর্বমহলে এটি আরও বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য। সাহরানপুরের কালিয়া শরিফের খান্দানের সাথে সম্পৃক্ত রব্বানি পরিবার ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর হিজরত করে করাচীতে মোহাজের হিসেবে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন করাচীই ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর এবং রাজধানী। সিদ্ধান্ত হল রব্বানি পৃথক ভাবে করাচী পৌঁছাবে, আমার টেলিফোন পাবার পর ইসলামাবাদে সাথে এসে যোগ দেবে।
এবারের সফরের গোপনীয়তা রক্ষার্থে ওয়াশিংটনে বসবাসকারী আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডঃ ডিলন আমাদের Common Friend তখনকার পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী সুজাতের সাথে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করে দিলেন। নির্ধারিত দিনে মধ্যরাত্রে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে এসে পৌঁছালাম ইসলামাবাদে। VIP Room-এ চৌধুরী সুজাতের পাঠানো প্রটোকল অফিসার তার cordless hand set এগিয়ে দিয়ে বললেন মিনিস্টার সাহেব। আচ্ছা দিন। বলে সেটটা হাতে তুলে নিয়ে বললাম আসসালাম, সুজাত ভাই। কেমন আছেন? হঠাৎ করে একটি অতি জরুরী বিষয়ে আপনাদের সাথে আলাপ করতেই এইভাবে আসতে বাধ্য হলাম।
একি বলছেন ভাই সাহেব। এটাতো আপনার নিজের দেশ। যখন ইচ্ছে আসবেন।স্বাগতম। যাত্রা কেমন হল, পথে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? আপনার ইচ্ছেমতই সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি।

ধন্যবাদ। আমরাও বেরুচ্ছি, অল্প সময়ের মধ্যেই আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাবো ইন শাহ আল্লাহ্‌। ফিরিয়ে দিলাম ওয়্যারলেস মুঠোফোন অফিসারকে। এরপর আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পরলেন প্রটোকল অফিসার। VIP Motor Cade. Out Rider-দের সৌজন্যে অতি দ্রুতগতিতে অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম ইসলামাবাদের ব্লু এরিয়াতে মারগালা হিলস এর পাদদেশে সুজাত চৌধুরীর প্রাসাদোপম বাড়ীতে। সুজাত নিজেই বেরিয়ে এসে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। He made me comfortable in a sitting room. আমাকে বসিয়ে তিনি আসছি, বলে ভেতরে চলে গেলেন। আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। সামনে টেবিলের উপর কয়েকটি বিদেশী ম্যাগাজিন রাখা ছিল। আমি The Time টা হাতে তুলে নিলাম। ওটাতে খালিস্তান মুভমেন্ট সম্পর্কে একটি কভার স্টোরি লেখা হয়েছে। আশির দশকের কথা। আমি তখন হংকং এ পোস্টেড। সেই সময় হঠাৎ ‘আনন্দ সাহেব সনদ’-এর মাধ্যমে ভারতের শিখরা নিজেদের একটি ভিন্ন জাতি ঘোষণা দিয়ে তাদের জন্য স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্রের দাবি করলে ভারতসহ পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে এর সমর্থনে শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে দাবানলের সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। তৎকালীন আন্তর্জাতিক মিডিয়া খালিস্তানের বিষয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো। সারাবিশ্বের শিখদের সমর্থন দেখে লন্ডনে সান্ত চৌহানের নেতৃত্বে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করার পর খালিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান করার জন্য জাতিসঙ্ঘের সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি আবেদন জানায় প্রবাসী অস্থায়ী সরকার। সাংবিধানিক ভাবে বাংলাদেশ বিশ্বের যেকোনো জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি নৈতিক, রাজনৈতিক, এবং কূটনৈতিক সমর্থন প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই আমি এবং আমার অন্যান্য বিপ্লবী সহযোদ্ধারা যারা বিভিন্ন বাংলাদেশ দূতাবাসে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করছিলাম তারা সবাই শিখদের খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি বিভিন্ন ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। ফলে খালিস্তান আন্দোলনের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা-কর্মীদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিলো অনেকেই হয়ে উঠেছিলেন পারিবারিক বন্ধু। একই প্রেক্ষিতে তামিল জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কেও এখানে আমি কিছু ঐতিহাসিক তথ্য পাঠকদের জন্য তুলে ধরতে চেষ্টা করবো অতি সংক্ষেপে। ভারতের দাক্ষিণাত্য মানে প্রায় পুরো ভারতের একতৃতীয়াংশ জুড়ে চারটি রাজ্য মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, তামিলনাডুতে বসবাস একই জনগোষ্ঠীর। তাদের রয়েছে হাজারও বছরের প্রাচীন সভ্যতারঐতিহ্য। প্রাচীনকালে বর্তমানের শ্রীলংকা তামিলনাডুর সাথে সংযুক্ত ছিল। এরা নৃতাত্ত্বিক ভাবে ছিল ভেড্ডীড। তাদের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, স্থাপত্য শিল্প, ভাস্কর্য সব কিছুই ছিল যাযাবর আর্যদের তুলনায় সমসাময়িক কালের যে কোনও সভ্যতার মতোই উন্নতমানের। তাই বহিরাগত আর্যরা ঈর্ষান্বিত হয়ে তাদের আখ্যায়িত করেছিলো রাবণ বা রাক্ষসের জাতি হিসাবে। বর্তমানে উত্তরের আর্যাবর্তের তুলনায় সবদিক দিয়েই দাক্ষিণাত্য এগিয়ে গিয়ে নিজেদের হারানো গৌরব এবং ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করার লক্ষে ‘তামিল ল্যান্ড’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। হংকং থাকাকালীন সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় তাত্ত্বিক এবং নেতৃবৃন্দের সাথেও আমার পরিচিত হবার সৌভাগ্য হয়েছিলো দুই পদস্থ প্রকৌশলী তামিল বন্ধুর মাধ্যমে। এই দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামের মূল নেতৃবৃন্দও বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। তামিলরাও ছড়িয়ে রয়েছে সারাবিশ্ব জুড়ে। এ দু’টি স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়ে পাঠকদের জন্য প আলাদা ভাবে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রইলো।

ফিরে এলেন সুজাত। একটু পরই খাবারের ডাক পরলো। আমরা খাবারের পাট চুকিয়ে আবার বসার ঘরে ফিরে এলাম। মধ্যরাত গড়িয়ে গেছে। তাই সুজাত বললেন

এখন আপনি বিশ্রাম করুন, কাল সকালে আলাপ হবে। তার নির্দেশে শয়নকক্ষে নিয়ে গেলো অপেক্ষারত পরিচারক। বেশ ক্লান্তি বোধ করছিলাম। তাই একে অপরকে শুভরাত্রি জানিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে পড়লাম। হট শাওয়ার নিয়ে সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ফজরের আজানের পর বেয়ারা বেড টি নিয়ে এসে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললো। ঘন্টাখানেকের মধ্যে শাওয়ার নিয়ে নামাজ পড়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে ঢুকলাম বসার ঘরে। খবর পেয়ে চৌধুরী সাহেবও কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে নাশতার জন্য খাবার ঘরে যেতে যেতে জানতে চাইলেন

ভাল ঘুম হয়েছে কিনা। আমি বললাম চমৎকার ঘুম হয়েছে। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন

কি ধরনের নাস্তা পছন্দ করবেন, কন্টিনেন্টাল নাকি পাকিস্তানী? জবাবে বললাম, অবশ্যই পাকিস্তানী।

চৌধুরী সাহেবের হুকুমে পরিবেশিত হল গরম লুচি, হালুয়া, লাচ্ছি, আণ্ডা ফ্রাই, পারাটা, আলু ভাজা ইত্যাদি। নাস্তাপর্ব শেষ করে আরাম করে বসলাম একটা প্রাইভেট সিটিং রুমে। সুজাত পিএসকে ডেকে বললেন তিনি না ডাকলে কেউ আমাদের ডিস্টার্ব করবে না, আর কোনও ফোন কল তাকে যেন না দেয়া হয়, যতক্ষণ আমাদের মিটিং চলে। অভিজ্ঞ পিএসনির্দেশ নিয়ে বেরিয়ে গেল।

 ঘরে শুধু আমরা দু’জন, রুদ্ধদ্বার বৈঠক।চৌধুরী সুজাত বললেন

বলুন ভাই সাহেব, আপনার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু। আমি সব কিছুই তাকে খুলে বললাম। সব শুনে, তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন বিষয়টির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজশরীফসহ National Security Council কেও On Board নিতে হবে। আমি নওয়াজ শরীফ-এর সাথে প্রথমে একান্তে একটা বৈঠক করবো। তারপর আমরা ঠিক করবো কি ভাবে অন্য সবাইকে On Board নেয়া যায়। এর জন্যই, আমি নওয়াজ শরীফ-এর সাথে বৈঠক না হওয়া পর্যন্ত আমার বাড়িতেই আপনাকে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি শুধুমাত্র গোপনীয়তার স্বার্থেই যাতে এই কাজে আগেভাগেই কেউ বাগড়া না দিয়ে বসে। রাজনৈতিক সরকার। তাই অনেক অপছন্দসই বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিভূ লোকজনকেও সাথে নিয়ে চলতে হচ্ছে। আর্মির ব্যাপারে আমাদের তেমন কোনও সমস্যা হবে না, হলেও সেটা আপনি নিজেই আমাদের চেয়েও ভাল করে হ্যান্ডেল করতে পারবেন সেটাও আমি জানি। আপনার বন্ধু-বান্ধবরাই তো বর্তমানে নীতি-নির্ধারণের পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। আমি একটা পরামর্শ দিতে চাই যদি আপনি কিছু মনে না করেন। এটা আপনি কি বলছেন সুজাত ভাই?আপনি নিঃসঙ্কোচে আপনার পরামর্শ আমাকে দিতে পারেন। নওয়াজ শরীফএর সাথে কথা হয়ে যাওয়ার পর আপনার পুরনো বন্ধুদের সাথে আপনি যোগাযোগ করলে সে দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া পেতে সুবিধে হবে। আপনার পরামর্শ খুবই যুক্তিসঙ্গত। আমি অবশ্যই সেটা করবো।

প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সাথে বৈঠক হল সুজাত ভাইয়ের। ফিরে এসে চৌধুরী সুজাত আলোচনাকালে জনাব নওয়াজ শরীফ বাংলাদেশ সম্পর্কে কি বললেন সেটা জানালেন।

বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগই এককভাবে অথবা জেনারেল এরশাদের সাথে মিলে সরকার গঠন করবে। খালেদা জিয়ার জোটের জেতার কোনও সম্ভাবনাই নেই, এই মনোভাবই পোষণ করছে ISI এবং ঢাকায় অবস্থিত দূতাবাস। সেইক্ষেত্রে এজেন্সিগুলোর তরফ থেকে পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে যেআওয়ামীলীগের সাথে একটা ন্যূনতম কার্যকরী সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা পাকিস্তানের জন্য একান্ত জরুরী হয়ে পরেছে। পাকিস্তানপররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। আপনার আগে বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ দূত হিসাবে জেনারেল জিয়ার কোর্সমেট জনাব মুস্তাফিজুর রহমান ইতিমধ্যেই এসেছিলেন, তাকে আমাদের তরফ থেকে এই কথাই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনিও তরুণ অফিসার হিসাবে জেনারেল জিয়ার মতোই ISI-তে চাকুরি করেছিলেন। এসমস্ত বিষয় অবশ্যই আপনার জানা আছে বলেই আমার বিশ্বাস। আপনার উপস্থাপনা আমাদের বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণের সম্পূর্ণ বিপরীত।

ঠিকই বলেছেন আপনি। তবে আপনাকে একটা কথা আমি প্রথমেই বলবো। সেটা হল, আমি কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার অনুরোধে তার দূত হয়ে ওকালতি কিংবা সাহায্য-সহযোগিতা চাইতে আসিনি। আমি এসেছি আমাদের বিবেকের তাড়নায় দু’টি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের স্বার্থেই। তাছাড়া আমাদের উপস্থাপনা নিরপেক্ষ তথ্য এবং বাস্তব ভিত্তিক। তিনটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হলে, বেগম খালেদা জিয়ার জনসমর্থনের জোয়ারে ভারত থেকে যত সাহায্য-সহযোগিতাই আওয়ামীলীগ জোট পাক না কেনো, সবই ভেসে যাবে এবং খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে কিছুতেই হারানো সম্ভব হবে না। কি সেই তিনটি বিষয়? জিজ্ঞেস করলেন সুজাত ভাই।

১। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলান করা যেটা বর্তমানে খালেদা জিয়ার পক্ষে দেশের ভেতর থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।

২। বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য সমমনা ইসলামিক মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছোট ছোট দলগুলকে নিয়ে নির্বাচনী মোর্চা গঠন কোরতে হবে।

৩। নির্বাচন কালে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ দান কোরতে হবে নির্বাচন কমিশন-এর মাধ্যমে যাতে ভোটাররা নিরাপদে ভোট দান কোরতে পারে।

দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিষয় দু’টি সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এখন শুধু প্রয়োজন এই জোটকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলান করা। ঐক্য জোট গোড়ে তোলা।

আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বিএনপি জোটের বিজয় সুনিশ্চিত। আর এই বিজয়ে সবচেয়ে উপকৃত হবে ভাতৃপ্রতিম দেশ পাকিস্তান। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন এই উপমহাদেশের ভূরাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাবফেলবে সেটা বোঝার মতো সঙ্গতি আপনাদের নীতি-নির্ধারকদের রয়েছে। এই বিশ্বাসেই ঝুঁকি নিয়েও আমি আমার সহযোদ্ধাদের তরফ থেকে শুধু খালেদা জিয়ার জন্যই নয়, ভাতৃপ্রতিম বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মুসলমানদের ক্রমান্বয়ে ভারতের দুর্বিষহ নাগপাশ থেকে বাচানোর তাগিদেই। ভাইদের কাছে এসেছি কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়াই যদিও সিদ্ধান্ত নেবেন আপনারাই। তবুও আমি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাসকরি, গোয়েন্দাপ্রতিষ্ঠানসমূহ এবং দূতাবাসের প্রতিবেদনের পাশাপাশি আমাদের উপস্থাপনাটাও বিবেচ্য। কারণ, আমি যাদের প্রতিনিধিত্ব করে আপনাদের কাছে এসেছি তাদের সবারই জন্ম রাজনৈতিক পরিবারে। ছাত্র রাজনীতি, স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক ধারা এবং ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঘটনাবলী থেকে আজ অবধি দেশের বাইরে থেকেও জাতীয় চলমান রাজনৈতিক ধারার সাথে আমি এবং তারা সবাই সম্পৃক্ত এবং ঘটনাবলী সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত। তাই, আমাদের প্রতিবেদনকেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করাটা যুক্তিসঙ্গত হবে আপনাদের নীতি-নির্ধারকদের জন্য। জনাব মুস্তাফিজুর রহমানের এখানে আসার বিষয়টি আমাদের জানা আছে। এরপরও আমি কেনও এলাম? আমাদের আত্মবিশ্বাসই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমাদের প্রতিবেদনের যৌক্তিকতা আপনাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে এবং আপনারা সাহায্য-সহযোগিতার হাত অবশ্যই বাড়িয়ে দেবেন এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আমার কথা শুনে চৌধুরী সুজাত কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে বসে রইলেন। আমার মনে হল, তিনি আমার বক্তব্যের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বললেন, তারা জরুরী ভিত্তিতে National Security Council (NSC)-এর বৈঠক তলব করে আমার উপস্থাপনার উপর আলোচনা করে NSC-এর সিদ্ধান্ত আমাকে জানিয়ে দেবেন।

সেই সময় আর্মি চীফ জেনারেল আসলাম বেগ চীন সফর করছিলেন। তাকে সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হল। ঢাকা থেকে জরুরী তলব করে পাঠান হল রাষ্ট্রদূতকেও। NSC-এর জরুরী বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্যই এমনটি করা হয়। সুজাত ভাই আমাকে এই খবরগুলো জানিয়েছিলেন। কয়েকদিন এখানে থাকতে হবে। তাই দেশে-বিদেশে যোগাযোগের সুবিধার্থে আমি হোটেল ম্যারিয়ট-এ অবস্থান নিলাম। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের বিশেষ ব্যবস্থা করে দিলেন চৌধুরী সুজাত। দেখাশোনা এবং নিরাপত্তারও বিশেষ ব্যবস্থা পরিলক্ষিত করলাম। হোটেলে অবস্থান নিয়েই রব্বানির সাথে যোগাযোগ কোরলাম। সেইদিনই রব্বানি ইসলামাবাদে এসে পৌঁছালো। গোপনীয়তার স্বার্থে আমিও যোগাযোগ করছি শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক পরিচিতজনদের সাথেই। হোটেল-এ শিফট করার পরদিন নাস্তার জন্য রুম সার্ভিসকে অর্ডার দিয়ে তৈরি হচ্ছিলাম আমি ও রব্বানি। হঠাৎ মেইন ডোর-এর কলিং বেল বেজে উঠলো। রব্বানি দরজা খুলে দেখলো এক কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক দরজায় দাড়িয়ে। সালাম জানিয়ে ভদ্রলোক বললেন পিণ্ডি থেকে তিনি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। ব্রিগেডিয়ার রফি তাকে পাঠিয়েছেন। তাকে বসার ঘরে বসিয়ে খবরটা আমাকে জানালো রব্বানি।

ব্রিগেডিয়ার রফি তখন ISI-তে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করছিলেন। কোয়েটাতে আমরা একসাথে একই ডিভিশনে পোস্টেড ছিলাম। সেই সুবাদে তাকে আমি চিনি। একমাত্র শওকত ভাই ছাড়া এখানে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে অন্য কারো জানার কথা নয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে যোগাযোগে প্রয়োজনে তিনি আমাকে সাহায্য করবেন তেমন বন্দোবস্তই করে দিয়েছেন সুজাত ভাই। পরিচিত ব্রিগেডিয়ার রফির তরফ থেকে এসেছেন ভদ্রলোক, তাই দু’জনই গিয়ে বসলাম সাক্ষাতের জন্য। ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়ে জানালেন তিনি পদবীতে একজন কর্নেল। ইতিমধ্যে রুম সার্ভিস-এর ওয়েটার নাস্তা নিয়ে এলো। আমি কর্নেল সাহেবকে আহ্বান জানালাম আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য। কর্নেল ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, তিনি প্রাতঃরাশ সেরেই এসেছেন। কর্নেলকে একটি কাপে চা ঢেলে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম এতে নিশ্চয় আপনার আপত্তি হবে না? প্রায় চল্লিশের কোঠায় কর্নেল বিনীতভাবে বললেন, এতে আপত্তি নেই স্যার, বলে কাপটি হাতে তুলে নিলেন। আমরাও নাস্তা করতে শুরু করলাম। খাওয়ার পর্ব শেষ করে তিনজনই আরামে বসলাম।

বলুন, আপনার আসার উদ্দেশ্য? কর্নেল যে ব্রিগেডিয়ার রফির অধীনস্থ একজন কর্মকর্তা সেটা বুঝেই প্রশ্নটা করলাম। না, তেমন বিশেষ কোনও কাজে নয়, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে আলাপ করতে এলাম। বলেই অনুমতি নিয়ে ভদ্রলোক একটি সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করছিলেন দেখে বললাম কিছু মনে করবেন না, আমাদের এখুনি বের হতে হচ্ছে একটা পূর্বনির্ধারিত এপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করতে। তাই আলাপের তো সময় হবে না। আমার জবাবে ভদ্রলোক খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে থাকবেন, তার আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে সিগারেটটা ফসকে মেঝেতে পরে গেলো। বুঝতে অসুবিধে হয়নি কর্নেল সাহেব এসেছিলেন খবর সংগ্রহ করার জন্য। নিজেকে সামলে নিয়ে কর্নেল বললেন ঠিক আছে স্যার, আপনি ব্যস্ত। তাই আমি না হয় অন্য কোনোদিন সময় নিয়ে আসবো বলে পকেট থেকে একটি চিরকুট বের করে আমার হাতে দিলেন। খুলে দেখলাম ব্রিগেডিয়ার রফি লিখে পাঠিয়েছেন, তিনি আমাকে লাঞ্চ কিংবা ডিনারে নিমন্ত্রণ করতে চান আমার সুবিধে মতো। যদি একটু সময় করে তার নিমন্ত্রণ রক্ষা করি তবে তিনি খুবই খুশি হবেন। তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরটাও লিখে দিয়েছেন যোগাযোগের সুবিধের জন্য। চিরকুট পড়ে কর্নেলকে বললাম ব্রিগেডিয়ার রফিকে আমার সালাম জানিয়ে বলবেন, আমি সময় করে অবশ্যই তার সাথে যোগাযোগ করবো। এবার আমাদের উঠতে হচ্ছে বলতেইবুদ্ধিমান কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন স্যার, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। আপনাকে দেখার খুবই ইচ্ছে ছিল। আমিও খুশি হয়েছি আপনার সাথে পরিচিত হয়ে। তবে সময়ের অভাবে আলাপটা জমলো না। বেরিয়ে গেলেন গোয়েন্দা কর্নেল কিছুটা নিরাশ হয়েই। কর্নেলের প্রস্থানের পর রব্বানি মুচকি হেসে বললো

তুমি কর্নেল সাহেবকে যেভাবে বিদায় করলে সেটা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হতো কিনা সে বিষয়ে কিছু না বলে শুধু এতটুকুই বলছি, এই দেশে ঐ সংস্থার কোনও ক্যাপ্টেন কিংবা মেজরের সাথে কথা বলতে গিয়ে অনেক বাঘা বাঘা হোমরা-চোমরাদেরও কাপড় ভিজে যায়।

হবে হয়তো, তবে আমি তো সেই জাতের কেউ নই, খুবই সাধারণ একজন। জবাব শুনে রব্বানি উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। দরজার কলিং বেল আবার বেজে উঠলো। রব্বানি দরজা খুলে শওকত ভাইকে দেখে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে ভেতরে এনে বসালো। আসুন ভাই, কি ব্যাপার এত সকালে? হ্যাঁ, সকালেই আসলাম এই ভেবে যদি আপনাদের না পাই। চৌধুরী সাহেব আপনাকে জানাতে বলেছেন, দুই-চার দিনের আগে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা আপনাকে জানানো সম্ভব হবে না সেটাই তার ধারণা। তাই ইতিমধ্যে আপনি ইসলামাবাদের বাইরে কোথাও যাবার ইচ্ছে থাকলে সেই ব্যবস্থা করা সম্ভব। মারী আর নাথিয়াগলি ঘুরে আসুন না এখানে ভিড়ের মধ্যে বসে না থেকে।প্রস্তাব রাখলেন শওকত ভাই। না ভাই, ভাবছি পেশাওয়ার থেকে একটু ঘুরে আসবো। চাপলি কাবাবের লোভ ছাড়াও আমাদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছেন। তার সাথেও দেখা করে আসা যাবে। বন্ধুবর ডঃ খালেদ মুফতির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো রব্বানির মাধ্যমেই। বেশ, সেই ব্যবস্থাই করে দিচ্ছি। ওখানে PC-তে থাকবেন আপনারা। গাড়ীর সাথে আনুষঙ্গিক অন্যান্য সব ব্যবস্থা করে দিয়ে যাচ্ছি, যখন ইচ্ছে চলে যাবেন। এখানে কোনও অসুবিধে হচ্ছে নাতো? কোনও কষ্ট হচ্ছে না, বরং আরাম-আপ্যায়নের আতিশয্যে হাঁপিয়ে উঠছি। তবে সময় ভালই কাটছে।বাংলাদেশ আর বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের বিশেষ ব্যবস্থাটা খুবই কাজে আসছে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে ফিরে আসছি। চলে গেলেন শওকত ভাই। অত্যন্ত অমায়িক আর বিনয়ী শওকত ভাই। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলেন জবরদস্ত এক নওজোয়ানকে সাথে করে। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন যখনই রওনা হবেন এই নওজোয়ান আপনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে বলে মুচকি হাসলেন শওকত ভাই। তার অর্থবহ হাসিতে আমরাও হাসলাম। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন শওকত ভাই নওজোয়ানকে সাথে নিয়ে।রব্বানিকে বললাম আমার এক কোর্সমেট জেনারেল কাইউমের স্ত্রী অসুস্থ। তাইকাইউম সন্ধ্যায় নিজেএসেতার বাসায় নিয়ে যাবে।পিণ্ডির কাছাকাছি কোর্সমেটদের যারা রয়েছে তাদেরও ডেকেছে পুনর্মিলনের জন্য।ইতিমধ্যে তুমি ডঃ খালেদ মুফতি ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে জানিয়ে দাও হযরতজীর সাথে সাক্ষাত করে তার দোয়া নেবার জন্য আমরা আজ রাতেই পেশাওয়ার রওনা হচ্ছি। খালেদ ভাই যাতে মেহেরবানী করে সেই ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন। যে ভাবেই হউক, আমরা হযরতজীর সাথে দেখা না করে ফিরবো না। কারণ, এই উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থেই তার দোয়া ভিক্ষা চাইতে এসেছি আমরা, কোনও ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য নয়। ডঃ খালেদ মুফতি একজন আন্তর্জাতিক ভাবে খ্যাত সাইক্রিয়াটিস্ট এবং হযরতজীর একজন বিশেষ প্রিয় শিষ্য।এক সময়ের ডাকসাইটে জেনারেল শিনওয়ারীর সাথে সম্পর্কিত তার স্ত্রী। হযরতজী কি আমাদের দর্শন দিতে রাজি হবেন? মনে একটা সংশয় থেকেই গেলো। হযরতজী (হযরত মান শাহ্‌) একজন সূফি সাধক, রহস্য পুরুষও বটে। সারা বছর প্রতিদিন ১০/১২ বার ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করেন। একটা সালওয়ার কিংবা ধোতি পরে খালি গায় কদাচিৎ একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকেন। শহরে এলে শহরের কেন্দ্রে একটি বাসায় থাকেন। তবে বেশিরভাগ সময় তিনি শহরতলীতে তার খানকায় অবস্থান করেন। জালালি মেজাজের এই সাধকের দোয়া নেবার জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বড় বড় রথী-মহারথী, বিত্তবানরা তীর্থের কাকের মতো তার দর্শন পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু তিনি এদের বেশিরভাগের সাথে সাক্ষাত করেন না। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো, প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক, বেনজির, নওয়াজ শরিফ প্রমুখ অনেক চেষ্টা করেও তার দর্শন পেতেব্যর্থহয়েছেন। এইকথাগুলো আমাদের জানিয়েছিলেন খালেদ ভাই নাইরোবিতে আমার বাসায় দাওয়াত খেতে এসে। তখন থেকেই এই সূফি সাধকের সাথে সাক্ষাতের একটা অদম্য বাসনা লালন করে এসেছি আমি ও রব্বানি দু’জনই। রব্বানি তার কাজে লেগে গেলো। আমিও বেরিয়ে পড়লাম পুরনো কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য। সারাদিন তাদের সান্নিধ্যে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগেই হোটেলে ফিরে এলাম। রব্বানি জানালো, খালেদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে সব কিছুই তাকে খুলে বলা হয়েছে। তিনি সব শুনে বলেছেন, তিনি এক্ষুনি হযরতজীর সাথে দেখা করার চেষ্টা করবেন এবং জেনে নেবেন তিনি আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন কিনা। ঠিক হয়েছে, পেশাওয়ার পৌঁছেই আমরা খালেদ ভাই এর সাথে যোগাযোগ করা মাত্র তিনি হোটেলে চলে আসবেন আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য। যথা সময়ে কাইউম এসে পৌঁছাল।আমি তৈরি হয়েই ছিলাম তার আগমনের প্রতীক্ষায়। তার গাড়িতেই গিয়ে পৌঁছালাম পিণ্ডি ক্যান্টের ভেতরে তার বাসায়। পৌঁছে দেখলাম কোর্সমেটদের কয়েকজনকে একত্রিত করেছে কাইউম। অনেকটা চুপিসারেই একত্রিত হয়েছে সবাই কাইউমের নির্দেশ অনুযায়ী। ‘৭১-এর পর সাক্ষাতে সবাই আবেগে বিহ্বল। আবগে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অভিভূত। সবারই চোখ অশ্রুসিক্ত। ভাবী নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। তাকে দেখলেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। ভূরিভোজনের বিশাল ব্যবস্থা দেখে কিছুটা উষ্মার সাথেই কাইউমকে বললাম, ভাবীর এই অবস্থায় তুই এতো বিশাল আয়োজনকরতে গেলি কেনও? জবাবটা ভাবী নিজেই দিলেন ভাই, আমিতো কিছুই করিনি, চাইনিজ খাবার আপনার পছন্দ, তাই বেশিরভাগ পদ আনা হয়েছে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকেই।বাকিগুলো মেয়েরা করেছে। তাছাড়া আপনিসহ উপস্থিত সবাই তো একান্ত আপনজন, মেহমান নন। তার আন্তরিকতা হৃদয় ছুঁয়ে গেলো। যথেষ্ট ঠাণ্ডা, তাই প্রতিটি ঘরেই কোয়েটা স্টোভ জ্বলছে। খাওয়ার পর সবাই গিয়ে বসার ঘরে বসলাম। খুবই ঘরোয়া পরিবেশ। সবাই জানতে চাইল হঠাৎ এভাবে আমি এখানে কেনো? সংক্ষেপে উত্তর দিলাম। বিল্লাহ চার্জ করলো

বদমাশ, তুই আর তোর সাথীরা ডিপ্লোম্যাট হয়ে বিদেশে কি করছিস? দেশে ফিরে রাজনীতি করছিস না কেনো? রাজনীতির মানে যদি হয় একটা দল গঠন করে জনসভা, সেমিনার, প্রেস বিজ্ঞপ্তি, বক্তৃতা আর চুঙ্গা ফুঁকানো, তার জন্যও ময়দানে নামার আগে চাই প্রস্তুতি।সুযোগ একটা সৃষ্টি করেছিলাম কিন্তু জেনারেল জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতায় সেই সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। এখন আবার নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করছি এবং একই সাথে নিজেদের আরো পরিপক্ব করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছিসবাই। আল্লাহ্‌র ইচ্ছা হোলে, সময় সুযোগ পেলে নিশ্চয় ময়দানে অবতীর্ণ হবো ইন শাহ আল্লাহ। তাছাড়া প্রবাসে নির্বাসনে থেকেও দেশের চলমান রাজনৈতিক প্রবাহের সাথে আমরা কোনও না কোনও ভাবে জড়িততো রয়েছিই। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশে ভারতীয় চাণক্যদের আগ্রাসনের নীলনকশার বিরুদ্ধে আমরা তো জেহাদ করেই চলেছি সেই ‘৭১-এর যুদ্ধকালীন সময় থেকে। কিন্তু তোরা এখানে ভারতের সুদূরপ্রসারী দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে কি করছিস? কিছুই না। ঘুণেধরা ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের নিষ্পেষণের যাঁতাকল থেকে জনগণের মুক্তির জন্য কি করছিস তোরা? কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর চক্রান্তে দেশটা বিভক্ত হয়ে গেলো। কিন্তু তারপরও সবাই নির্বিকার! ১৯৫৪ সালে, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকার যখন জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে দিলো তখন পশ্চিম পাকিস্তানের ফিউডাল লর্ডরা আতংকিত হয়ে চক্রান্তমূলক ভাবে জেনারেল আইয়ুব খান-এর মাধ্যমে সারা দেশে মার্শাল’ ল জারি করে তাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে জমিদারী প্রথা চালু রাখলো! সেই ফিউডাল মাইন্ড সেট এবং জমিদারী ও সারমায়াদারী নিজাম দেশ ভাগ হয়ে যাবার পরও এখানে অটুট রয়েছে। কাইউম, তুইতো NDC-তে একজন CI (Chief Instructor), সত্যি করে বলতুই কি কখনো সাহস করে যারা ভবিষ্যতে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব দেবে তাদের বলতে পেরেছিস যে, Feudalism never allows to grow nationalism as it thrives on regionalism. I believe, you could never been able to utter this truth as Feudal mindset is so strongly ingrained in the state and social structure of the leftover Pakistan till this date. যেখানে এখনো এক-দুই শতাংশ শাসকগোষ্ঠীর অনুকম্পায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী গোলাম হয়ে রয়েছে বাঁচার তাগিদে, কারণ বিদেশী শক্তির মদদপুষ্ট এবং লালিত ঐ শাসকগোষ্ঠীর কব্জায় রয়েছে নব্বই শতাংশের বেশি জাতীয় সম্পদ। এমতাবস্থায় সামন্ত মনোভাব বজায় রেখে সামন্ত প্রভু আর মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সাথেই মিলেমিশে লুটপাটে ব্যস্ত থাকিস তাহলে শুনে রাখ, এই পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদ কখনই শিকড় গাড়তে পারবে না। ফলেআঞ্চলিক বৈষম্যতার কারণেই দেশটির অস্তিত্বই একদিন হয়তো বিলীন হয়ে যাবে বিদেশী শত্রুদের কারসাজি এবং সহায়তায়। গোষ্ঠীস্বার্থের ক্ষমতার রাজনীতি কখনোই কোনও দেশ বা জাতির উন্নতি কিংবা ভাগ্যোন্নয়ন সাধন করতে পারে না। তাই সময় থাকতে জেগে ওঠ, না হলে আল্লাহ্‌ না করুক,এই ফকিরের কথাটাই সত্যে পরিণত হবে ভবিষ্যতে। তোদের মতো বিজ্ঞ, ক্ষমতাধর লোকদের জন্য লেকচারটা একটু লম্বাই হয়ে গেলো, কিছু মনে করিস না।

সবাই আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। এরপর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে কাইউমকে বললাম, যেতে ইচ্ছে করছে না এই পরিবেশ ছেড়ে। তবুও যেতে হবে। কারণ, এখান থেকে ফিরেই পেশাওয়ার রওনা দিতে হবে এক বিশেষ জরুরী প্রয়োজনে। সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর ভাবী আর মেয়েদের ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। কাইউমই নামিয়ে দিয়ে গেলো। যাবার আগে পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য কাইউমকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। জবাবে কাইউম বললো তুই আমাদের সবার গর্ব। সবাই তোর সাথে দেখা করার জন্য কতটা উদগ্রীব সেটা তুই আন্দাজও করতে পারবি না দোস্ত। সময়ের অভাবে দূর থেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই আসতে না পেরে দুঃখ প্রকাশ করে আমাকে বলেছে, তাদের সালাম আর ভালোবাসা তোকে পৌঁছে দিতে। শুনে তাকে বললাম

আমার তরফ থেকে সালাম ও ভালোবাসা তুইও তাদের জানিয়ে দিস। চলে গেলো কাইউম।